দিকাইয়ারখোস (ইংরেজি: Dicaearchus; গ্রিক: Δικαίαρχος) একজন গ্রিক দার্শনিক, মানচিত্রকার, ভূগোলবিদ, গণিতবিদ এবং লেখক ছিলেন। তিনি এরিস্টটলের শিষ্য ছিলেন। তার রচিত লেখাগুলোর খুব কমই এখনো বিদ্যমান। তিনি গ্রিসের ইতিহাসভূগোল সম্পর্কে লিখেছেন। এর মধ্যে তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লেখা হলো ''গ্রিসে জীবন'' (Life of Greece)। তিনি মানচিত্রাঙ্কনবিদ্যার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। প্রথম ভৌগোলিক স্থানাঙ্ক ব্যবহারকারীদের মধ্যে তিনি একজন। এছাড়াও তিনি দর্শনরাজনীতির উপর বই লিখেছেন। তিনি প্লুতার্কসিসারোর মতো বিখ্যাত দার্শনিকদের উপর প্রভাব ফেলেছেন।[১]

দিকাইয়ারখোস

জীবন সম্পাদনা

তিনি ৩৫০ খ্রিস্টপূর্বের দিকে সিসিলির মেসিনায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ছিল ফেইদিয়াস। তিনি তার জীবনের বৃহত্তর অংশ গ্রিসে কাটিয়েছেন, বিশেষত পেলোপনেসে। তিনি এরিস্টটলের শিষ্য[২] এবং থিওফ্রাস্টাসের বন্ধু ছিলেন। তার কয়েকটি লেখা তিনি থিওফ্রেটাসকে উৎসর্গ করেন। তিনি ২৮৫ খ্রিস্টপূর্বের দিকে মৃত্যুবরণ করেন।

লেখাসমূহ সম্পাদনা

দিকাইয়ারখোস দার্শনিক এবং জ্ঞানী মানুষ হিসাবে অত্যন্ত সম্মানিত ছিল। বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে তার বিস্তৃত জ্ঞান থাকায় প্রাচীন গ্রিকরা তাকে শ্রদ্ধা করতো।[৩] তার রচিত লেখা কেবল পরবর্তী লেখকদের উদ্ধৃতি থেকে জানা যায়। তার রচনাগুলো ভূগোল, রাজনীতি, ইতিহাস, দর্শন এবং গণিত বিষয়ক ছিল। তবে এগুলোর একটি সঠিক তালিকা তৈরি করা কঠিন। যেহেতু স্বতন্ত্র রচনা হিসাবে উদ্ধৃত করা অনেকগুলো লেখা বৃহত্তর লেখার অংশ বলে মনে হয়। বর্তমানে বিদ্যমান অসম্পূর্ণ লেখাগুলো থেকে সম্পূর্ণ লেখার ধারণা পাওয়া যায় না। এজন্য প্রাচীন গ্রিসের অন্যতম দার্শনিক হওয়া সত্ত্বেও তিনি এতটা বিখ্যাত হতে পারেননি। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তিনি শুধুমাত্র ভূগোল বিষয়ে অবদান রেখেছেন। তিনি পাহাড়ের উচ্চতা পরিমাপের মাধ্যমে পৃথিবী যে গোলক তা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন।[৪] স্ট্রাবোর মতে দিকাইয়ারখোসের ভৌগোলিক লেখাগুলো পলিবিয়াস দ্বারা অনেক ক্ষেত্রে সমালোচিত ছিল।[৫] দিকাইয়ারখোস পশ্চিম ও উত্তর ইউরোপে নিজে না গিয়েই সেখানের বর্ণনা দিয়েছেন। তাই স্ট্রাবো নিজেই দিকাইয়ারখোসের পশ্চিম ও উত্তর ইউরোপের বর্ণনায় অসন্তুষ্ট ছিলেন।

তার ভৌগোলিক লেখাগুলো মধ্যে উল্লেখযোগ্য:

  • ''গ্রিসে জীবন'' (Life of Greece; Βίος Ἑλλάδος) – এটি তার সবচেয়ে বিখ্যাত লেখা। এটি তিনটি বই নিয়ে গঠিত। এখানে গ্রিসের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক দিকগুলো আলোচনা করা হয়েছে।[৪] ১ম বইয়ে গ্রিসের ভূগোল ও ইতিহাস আলোচিত হয়েছে। ২য় বইয়ে গ্রিসের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের অবস্থা বর্ণিত হয়েছে। ৩য় বইয়ে গ্রিসের পারিবারিক ও সামাজিক দিকসহ ধর্ম ও খেলাধুলার বিষয় আলোচিত হয়েছে।[৬] ১ম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ের Bios Hellados এবং De Vita Populi Romani বই দুটির লেখক এই লেখা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিল। এর ২৪টি অসম্পূর্ণ অংশ রয়েছে।[৭] দিকাইয়ারখোস গ্রিসের প্রাচীনতম ইতিহাস থেকে দ্বিতীয় ফিলিপের রাজত্বকাল বর্ণনা করতে চেয়েছিলেন। এর সবচেয়ে পরিচিত অংশগুলো ভারো[৮] এবং পরফিরি উদ্ধৃত করেছে।[৯] এইখানে প্রগতি সম্পর্কে দুটি দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা হয়েছে। যেমন, কৃষিকাজের উদ্ভবের ফলে উৎপন্ন উদ্বৃত্ত খাদ্য ক্ষুধা দূর করে। কিন্তু এই উদ্বৃত্ত অংশ লোভের উন্মেষ ঘটায় যা যুদ্ধের দিকে পরিচালিত করে। তার মতে, মানুষের প্রত্যেক অগ্রগতি একটি সমস্যা সমাধান করে তবে অন্য সমস্যা বৃদ্ধি করে। এছাড়াও তিনি গ্রিসের সঙ্গীত ও সংস্কৃতির উৎস সম্পর্কে লিখেছেন।
  • ''পৃথিবীর সীমানা'' (Circuit of the Earth; Γῆς περίοδος)[১০] – দিকাইয়ারখোসের সময়ে পৃথিবীর যতদূর সম্পর্কে জানা ছিল তার মানচিত্র তৈরি করেছিলেন এবং তার বন্ধু থিওফ্রাস্টাসকে দিয়েছিলেন। সম্ভবত সেসব মানচিত্রের ব্যাখ্যা হিসেবে তিনি এই বই লিখেছেন। [১১]
  • ''গ্রিসের বর্ণনা'' (Description of Greece; Ἀναγραφὴ τῆς Ἑλλάδος) – এটি থিওফ্রাস্টাসকে উৎসর্গ করা ১৫০ চরণবিশিষ্ট অসম্পূর্ণ লেখা। পূর্বে একে সম্পূর্ণ দিকাইয়ারখোসের লেখা মনে করা হতো। তবে প্রথম ২৩ চরণের প্রথম অক্ষর থেকে জানা গিয়েছে যে এটি আসলে ডাইওনাইসাস নামক একজনের লেখা।[১২]
  • ''পর্বতের উচ্চতা সম্পর্কে'' (On the heights of mountains)[১৩] এটি সম্ভবত ''পৃথিবীর সীমানা''-র অংশ। ত্রিভুজীকরনের (triangulation) মাধ্যমে বিভিন্ন পাহাড়ের উচ্চতা পরিমাপের প্রথমতম প্রচেষ্টা এখানে পাওয়া যায়।
  • ''ট্রফোনিয়াসে অবতরণ'' (Descent into Trophonius; Ἡ εἰς Τροφωνίου κατάβασις) কয়েকটি বই জুড়ে এটি লেখা হয়েছে। অসম্পূর্ণ অংশের কিছু উদ্ধৃতি থেকে জানা যায় যে, এইখানে ট্রফোনিয়াস গুহার পুরোহিতদের উচ্ছৃঙ্খল ও চরিত্রহীন কর্মকাণ্ডের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে।[১৪] এছাড়াও এখানে স্বপ্নের মাধ্যমে ভবিষ্যদ্বাণীর বিষয়টি আলোচিত হয়েছে।[৪] তবে তিনি মনে করতেন যে, ভবিষ্যৎ জানার চেয়ে না জানাই উত্তম।[১৫]
  • ''স্পারটান সংবিধান'' (Spartan Constitution; Πολιτεία Σπαρτιατῶν)[১৬], ''অলিম্পিক সংলাপ'' (Olympic Dialogue; Ὀλυμπικὸς ἀγών)[১৭] ''প্যানাথেনাইক সংলাপ'' (Panathenaic Dialogue; Παναθηναικός)[১৮] এর পাশাপাশি অন্যান্য কিছু লেখা ''গ্রিসে জীবন'' এর অধ্যায় ছিল।

দিকাইয়ারখোসকে ''গ্রিসের শহর'' (The Cities of Greece) নামক বইয়ের লেখক মনে করা হয়েছিল। এখন জানা গিয়েছে যে, এটি আসলে হেরাক্লিডেস নামক অজানা এক লেখকের বই।[১৯]

রাজনৈতিক লেখাসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য:

  • ''তিন-শহর সংলাপ' (Three-city Dialogue; Τριπολιτικός Tripolitikos)[২০] এটি অনেক বিতর্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানে সম্ভবত বিভিন্ন সরকারের তুলনামূলক আলোচনা করা হয়েছিল। দিকাইয়ারখোস অ্যারিস্টটলকে অনুসরণ করে, তিনটি বিভাগে ভাগ করেছিলেন: গণতান্ত্রিক, অভিজাততান্ত্রিক (aristocracy) এবং রাজতান্ত্রিক[২১] তিনি স্পার্টান ব্যবস্থার মতো একটি "মিশ্র" সরকারকে সমর্থন করেছিলেন, যেখানে তিনটি বিভাগের উপাদানের ভূমিকা আছে। সিসারো সম্ভবত এই বই দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে দি রিপাব্লিকা লিখেছেন।

দার্শনিক লেখাসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য:

  • ''লেসবিয়ান বইসমূহ'' (Lesbian Books; Λεσβιακοί) এখানের দার্শনিক সংলাপটি লেসবসের মিটিলিনে সংঘটিত হওয়ায় এই নামকরণ করা হয়েছে। এই তিনটি বইয়ে দিকাইয়ারখোস আত্মার অমরত্বের বিষয়টি প্রমাণ করার প্রয়াস করেছেন।[২২] সিসারো[২৩] ''আত্মা সম্পর্কে'' (On the Soul) নামক লেখার উল্লেখ করার সময় সম্ভবত এই লেখার কথা বুঝিয়েছিলেন।
  • ''করিন্থিয়ান সংলাপ'' (Corinthian Dialogue; Κορινθιακοί) এটি তিনটি বইয়ের সমষ্টি। ''লেসবিয়ান বইসমূহ''- এর সম্পূরক হিসেবে এগুলো লেখা হয়েছে।[২৪] সিসারো On Human Destruction (লাতিন: de Interitu Hominum) নামে যেই লেখার কথা উল্লেখ করেছেন[২৫], সম্ভবত এটিই সেই লেখা।
  • বুরকারটের মতে (১৯৭২), পিথাগোরাস সম্পর্কে তথ্য প্রদানের ক্ষেত্রে আরিস্টক্সিনাস এবং দিকাইয়ারখোস সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।[২৬]
  • ''মানুষের ধ্বংস সম্পর্কে'' (On the Destruction of Man) এখানে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের চেয়ে মানুষ অন্যান্য মানুষের জন্য যে বেশি ক্ষতিকর তা আলোচনা করা হয়েছে। মানুষই যে মানবজাতির ধ্বংসের কারণ তা এখানে তুলে ধরা হয়েছে।[২৭] তার মতে, বেশিরভাগ মানুষের মৃত্যুর কারণ যুদ্ধ।[১৫]
  • "আত্মা সম্পর্কে'' (On the Soul; Περὶ ψυχῆς ) এই সংলাপে দিকাইয়ারখোস এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে দেহের সাথে আত্মার মৃত্যু ঘটে। তার মতে, আত্মা শরীরের চারটি মূল বৈশিষ্ট্যের সাথে মিলিত। এই বৈশিষ্ট্যগুলো হলো - শীতল, উষ্ণ, ভেজা ও শুকনো।[১৫]

''ইলিয়ামের বিসর্জন সম্পর্কে'' (On the Sacrifice at Ilium; περὶ τῆς ἐν Ἰλίῳ ϑυσίας)[২৮] দ্বারা সম্ভবত ইলিয়ামে মহান আলেকজান্ডারের বিসর্জনের কথা বোঝানো হয়েছিল।

তিনি প্লেটো, সক্রেটিসপিথাগোরাসের পাশাপাশি অন্যান্য দার্শনিকের জীবন সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।[২৭]

এছাড়াও কিছু ব্যাকরণ বিষয়ক রচনা রয়েছে যা সম্ভবত দিকাইয়ারখোস দ্বারা রচিত। যেমন- On Alcaeus (Περὶ Ἀλκαίου),[২৯] এবং Summaries of the plots of Euripides and Sophocles (ὑποθέσεις τῶν Εὐριπίδου καὶ Σοφοκλέους μύθων)। তবে দিকাইয়ারখোস নামক একজন ব্যাকরণবিদ দ্বারা এগুলো রচিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "Dicaearchus | Greek philosopher"Encyclopedia Britannica (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৯-২৬ 
  2. Henderson, Jeffrey। "CICERO, De Legibus"Loeb Classical Library (ইংরেজি ভাষায়)। ২০২০-০১-১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০১-১৩ 
  3. Cicero, Tusculanae Quaestiones, i. 18, de Officiis, ii. 5; Varro, de Re Rust. i. 2.
  4. "Dicaearchus of Messina | Encyclopedia.com"www.encyclopedia.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৯-২৬ 
  5. Strabo, ii.
  6. "A Dictionary of Greek and Roman biography and mythology, Dicaearchus"www.perseus.tufts.edu। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৯-২৬ 
  7. Mirhady 53-77
  8. Mirhady 55
  9. Mirhady 56A
  10. Lydus, de Mensibus.
  11. Cicero, ad Atticum, vi. 2; comp. Diogenes Laërtius v.
  12. P. E. Easterling, Bernard MacGregor Walker Knox, (1985), Greek literature, page 825. Cambridge University Press
  13. Pliny, H. N. ii. 65; Geminus, Elem. Astron. 14.
  14. Cicero, ad Atticum, vi. 2, xiii. 31; Athenaeus, xiii., xiv.
  15. "Дикеарх"Википедия (রুশ ভাষায়)। ২০২০-০৬-২৪। 
  16. Suda.
  17. Athenaeus, xiv.
  18. Scholion ad Aristophanis Vespis 564.
  19. "Greek & Roman Mythology - Tools"www.classics.upenn.edu। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৯-২৬ 
  20. Athenenaeus, iv.; Cicero, ad Atticum, xiii. 32
  21. Photius, Bibl. Cod. 37.
  22. Cicero, Tusculanae Quaestiones, i. 31.
  23. Cicero, ad Atticum, xiii. 12
  24. Cicero, Tusculanae Quaestiones, i. 10.
  25. Cicero, de Officiis, ii. 5.
  26. Burkert, Walter (১৯৭২)। Lore and Science in Ancient Pythagoreanism। Harvard University Press। পৃষ্ঠা 109। আইএসবিএন 9780674539181 
  27. "Dicaearchus"Oxford Reference (ইংরেজি ভাষায়)। ডিওআই:10.1093/oi/authority.20110803095716488। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৯-২৬ 
  28. Athenenaeus, xiii.
  29. Athenaeus, xi., xv.

উৎস সম্পাদনা

আরও পড়ুন সম্পাদনা

  • Fortenbaugh, W., Schütrumpf, E., (editors) Dicaearchus of Messana: Text, Translation, and Discussion. Transaction Publishers. (2001). আইএসবিএন ০-৭৬৫৮-০০৯৩-৪
  • Verhasselt, G. Die Fragmente der Griechischen Historiker Continued. IV. Biography and antiquarian literature, B. History of literature, music, art and culture. Fasc. 9 Dikaiarchos of Messene No. 1400. Leiden; Boston: Brill, 2018. আইএসবিএন ৯৭৮৯০০৪৩৫৭৪১৯
  • Wehrli, F., Dikaiarchos. Die Schule des Aristoteles. Texte und Kommentar, Hft. 1. Schwabe. 2nd edition (1967)
  • Alonso-Núñez, J.M., 'Approaches to world history in the Hellenistic period: Dicaearchus and Agatharchides' Athenaeum 85 (1997) 53-67
  • Bodei Giglioni, G., 'Dicearco e la riflessione sul passato' Rivista Storica Italiana 98 (1986) 629-652
  • Cooper, C., 'Aristoxenus, Περὶ Βίων and Peripatetic biography' Mouseion 2(3) (2002) 307-339
  • Purcell, N., 'The way we used to eat: diet, community, and history at Rome' American Journal of Philology 124 (2003) 329-358

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা