থাইরয়েড

একটি গ্রন্থি

থাইওয়েড গ্রন্থি বা থাইরয়েড হল দুইটি লোব দ্বারা গঠিত একটি অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি যার অবস্থান গ্রীবাতে। পুরুষের এডাম'স এপলের ঠিক নিচে এর অবস্থান। থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে থাইরয়েড হরমোন নিঃসৃত হয়। এই হরমোনগুলো মেটাবলিক রেট ও প্রোটিন সিন্থেসিসকে প্রভাবিত করে। থাইরয়েড হরমোনের মধ্যে ট্রাইডোথাইরোনাইন  (T3) ও থাইরক্সিন  (T4) আয়োডিন ও টাইরোসিন দ্বারা গঠিত হয়।থাইরয়েড ক্যালসিটোনিন নামক এক ধরনের হরমোন তৈরি করে যা ক্যালসিয়াম হোমিওস্ট্যাসিসে অবদান রাখে। [১]

থাইরয়েড
সামনে থেকে মানুষের থাইরয়েড যেমন দেখা যায়,যেখানে ধমনীগুলো দৃশ্যমান।
থাইরয়েড ঠিক ঘাড় এবং ধড়ের পৃষ্ঠের শারীরস্থানের সাথে সম্পর্কিত।
বিস্তারিত
পূর্বভ্রূণথাইরয়েড ডাইভার্টিকুলাম (দ্বিতীয় ফ্যারিঞ্জিয়াল খিলানে এন্ডোডার্মের সম্প্রসারণ)
তন্ত্রঅন্তঃক্ষরা গ্রন্থিতন্ত্র
ধমনীউচ্চতর, নিকৃষ্ট থাইরয়েড ধমনীসমূহ
শিরাউচ্চতর, মধ্য, নিকৃষ্ট থাইরয়েড শিরা
শনাক্তকারী
লাতিনGlandula thyreoidea
মে-এসএইচD013961
টিএ৯৮A11.3.00.001
টিএ২3863
এফএমএFMA:9603
শারীরস্থান পরিভাষা

গঠন সম্পাদনা

 
দুই লোব বিশিষ্ট থাইরয়েড গ্রন্থি ক্রিকয়েড ও শ্বাসনালি দ্বারা আবৃত থাকে। চিত্রে পিরামিডাকৃতির থাইরয়েডের মধ্যে দেখানো হচ্ছে।

থাইরয়েড গ্রন্থি একটি প্রজাপতি আকৃতির অঙ্গ। বাম ও ডানে দুই লোব ইস্থমুস দ্বারা সংযুক্ত থাকে। [২] প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের থাইরয়েডের ওজন ২৫ গ্রাম,[২]  প্রতিট লোব ৫ সেমি লম্বা , ৩ সেমি প্রশ্বস্ত এবং ২ সেমি পুরু। ইস্থমুস উচ্চতায় ও প্রশ্বস্ততায় প্রায় ১.২৫ সেমি হয়।[২] নারীদের পিটুইটারি গ্রন্থি সাধারণত পুরুষের থেকে বড় , গর্ভাবস্থায় এই আকার বেড়ে যায়।[২][৩]

ল্যারিংক্স ও শ্বাসনালি ঘেঁষে থাইরয়েড গ্রন্থি অবস্থিত।[২] ইস্থমুসের গঠন শ্বাসনালির দ্বিতীয় থেকে তৃতীয় নালী পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। থাইরয়েড গ্রন্থির উপরের অংশ থাইরয়েড কার্টিলেজ এবং নিচের অংশ শ্বাসনালির চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ রিং পর্যন্ত যায়।[৩] থাইরয়েড গ্রন্থি একটি পাতলা আবরণ দ্বারা আবৃত থাকে।[২] এই আবরণের বহিঃ ও আভ্যন্তরীণ আবরণ থাকে। বহিঃ আবরণ প্রিট্রাকিয়াল ফ্যাসিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে ক্রিকয়েড ও শ্বাসনালির কার্টিলেজ পর্যন্ত যায়।[৩] [২]

থাইরয়েড হরমোন সম্পাদনা

থাইরয়েড গ্রন্থির প্রধান কাজ আয়োডিন সংবলিত হরমোন তৈরি। ট্রিথাইরোনিন (T3) ও থাইরক্সিন (T4) হল আয়োডিন সমৃদ্ধ হরমোন।[৪] আয়োডিনের তিনটি অণু থাকায় এর নামকরণ T3 করা হয়েছে। অপরদিকে T4 চার আয়োডিন অণু থাকে। [১] এছাড়া পেপ্টাইড হরমোন ক্যালসিটোনিনও থাইরয়েড গ্রন্থিতে তৈরি হয়।  

জিন ও প্রোটিন প্রকাশ সম্পাদনা

মানব কোষের প্রায় ২০ হাজার প্রোটিন কোডিং জিন প্রকাশ প্রায় এবং এর মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশই সাধারণ থাইরয়েডে প্রকাশিত। [৫][৬] এসমস্ত জিনের প্রায় ২৫০ টির মতো জিন মূলতঃ থাইরয়েডে প্রকাশিত এবং ২০টি জিন অত্যন্ত সুচারুভাবে থাইরয়েড সংক্রান্ত। এই প্রোটিন সংলগ্ন জিনগুলো থাইরয়েড হরমোন সিন্থেসিসে জড়িত। উদাহরণস্বরূপঃ থাইরোগ্লোবিউলিন, টিপিও এবং আইওয়াইডি ফলিকুলার কোষে প্রকাশিত হয়। 

ইতিহাস সম্পাদনা

 
থমাস হোয়ারটন থাইরয়েডের নামকরণ করেছেন প্রাচীন গ্রীকে  ব্যবহৃত বর্ম শব্দ থেকে। চিত্রে উদাহরণ হিসেবে ৪৩১-৪২৩ খ্রিস্টপূর্ব সময়ের মুদ্রায় খোদাই করা বর্ম  দেখানো হচ্ছে।

থাইরয়েড গ্রন্থির রোগ এবং এর চিকিৎসা নিয়ে হাজার বছর আগের দলিল বিদ্যমান। অবশ্য এই গ্রন্থির বর্ণনা ও নামকরণ পাওয়া যায় রেনেসাঁ যুগের পরবর্তী সময়। [৭] খ্রিস্টপূর্ব ২৭০০ তে চৈনিক ভাষায়  গলগন্ড রোগ সংক্রান্ত লিপিতে থাইরয়েডের প্রথম বর্ণনা পাওয়া যায়।  ১৬০০ খ্রিস্টপূর্ব সময়ে চীনে গলগন্ড রোগের চিকিৎসায় পোড়া স্পঞ্জ ও সামুদ্রিক শৈবাল ব্যবহার করা হত। এই চিকিৎসা পদ্ধতি পরে বিশ্বের অন্যান্য জায়গায়ও ব্যবহার করা হয়।  আয়ুর্বেদের বই শুশ্রত সমহিতাতে ১৪০০ খ্রিস্টপূর্ব সময়ে হাইপারথাইরয়েডিজম, হাইপোথাইরয়েডিজম ও গলগন্ড রোগের ব্যাপারে বর্নিত আছে।[৮] হিপোক্রেটস ও প্লেটো চার শতকের দিকে থাইরয়েড গ্রন্থিকে লালাগ্রন্থি হিসেবে বর্নিত করেন।

১৫০০ সালের দিকে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি প্রথম থাইরয়েডের চিত্র অঙ্কন করেন।  ১৫৪৩ সালে আন্দ্রেয়া ভ্যাসিলাস প্রথম থাইরয়েড গ্রন্থির চিত্রসহ শারীরস্থানীয় বর্ণনা প্রদান করেন। ১৬৫৬ সালে থমাস হোয়ারটন থাইরয়েড গ্রন্থির নামকরণ প্রাচীন গ্রীক শব্দ (θυρεοειδής, অর্থ বর্মেরন্যায় / বর্মাকৃতি) অনুসারে করেন। এর গঠন প্রাচীন গ্রীসে ব্যবহৃত বর্মের মতো বলে এরূপ নামকরণ করা হয়।[৯][১০]

অন্যান্য প্রাণীতে সম্পাদনা

 
গলগন্ড রোগে আক্রান্ত ছাগল

সকল মেরুদন্ডী প্রাণীতে থাইরয়েড গ্রন্থি বিদ্যমান।  মাছের ক্ষেত্রে, সাধারণত এই গ্রন্থি ফুলকার নিচে থাকে এবং সবসময় দুইভাগে বিভক্ত হয় না। অবশ্য, থাইরয়েড কোষকলা শরীরের অন্যান্য অঙ্গ যেমন বৃক্ক,  প্লীহা, হৃৎপিণ্ড অথবা চোখে পাওয়া যায়। [১১]

অধিকাংশ স্তন্যপায়ী প্রাণীতে শুধুমাত্র একটি থাইরয়েড গ্রন্থি পাওয়া যায় এবং অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীর ক্ষেত্রেও এর আকৃতি মানুষের থাইরয়েড গ্রন্থির মতোই।

বিশ্ব থাইরয়েড দিবস সম্পাদনা

মানুষের বৃদ্ধি, বিকাশ, শারীরবৃত্তিক আর বিপাকীয় নানা ক্রিয়া-প্রক্রিয়া সাধনে থাইরয়েড হরমোন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বর্তমানে থাইরয়েড গ্রন্থির সমস্যা বিশ্বে অন্যতম হরমোনজনিত সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত। হরমোনজনিত রোগের ক্ষেত্রে ডায়াবেটিসের পরই এর অবস্থান। নারীরাই এই সমস্যায় বেশি ভুগে থাকেন। আগামী প্রজন্মের মেধা, প্রতিভার বিকাশে বর্তমানের মানুষদের, বিশেষ করে মেয়েদের থাইরয়েডের সুস্থতা দরকার। তাই থাইরয়েড সম্পর্কে ব্যাপক জনসচেতনতা তৈরি করার উদ্দেশ্যে ২৫ মে বিশ্ব থাইরয়েড দিবস পালন করা হয়।[১২]

আরো দেখুন সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Guyton & Hall 2011
  2. Gray's Anatomy 2008
  3. Elsevier's 2007
  4. Davidson's 2010
  5. "The human proteome in thyroid gland – The Human Protein Atlas"www.proteinatlas.org। সংগ্রহের তারিখ ২০১৭-০৯-২৫ উদ্ধৃতি টেমপ্লেট ইংরেজি প্যারামিটার ব্যবহার করেছে (link)
  6. Uhlén, Mathias; Fagerberg, Linn; Hallström, Björn M.; Lindskog, Cecilia; Oksvold, Per; Mardinoglu, Adil; Sivertsson, Åsa; Kampf, Caroline; Sjöstedt, Evelina (২০১৫-০১-২৩)। "Tissue-based map of the human proteome"Science (ইংরেজি ভাষায়)। 347 (6220): 1260419। আইএসএসএন 0036-8075ডিওআই:10.1126/science.1260419পিএমআইডি 25613900 উদ্ধৃতি টেমপ্লেট ইংরেজি প্যারামিটার ব্যবহার করেছে (link)
  7. "Thyroid History Timeline – American Thyroid Association"www.thyroid.org। ৩ আগস্ট ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৩ নভেম্বর ২০১৬ উদ্ধৃতি টেমপ্লেট ইংরেজি প্যারামিটার ব্যবহার করেছে (link)
  8. Niazi, Asfandyar Khan; Kalra, Sanjay; Irfan, Awais; Islam, Aliya (২০১৬-১১-১৩)। "Thyroidology over the ages"Indian Journal of Endocrinology and Metabolism15 (Suppl2): S121–S126। আইএসএসএন 2230-8210ডিওআই:10.4103/2230-8210.83347পিএমআইডি 21966648পিএমসি 3169859  
  9. Lewis, C.T. & Short, C. (1879). A Latin dictionary. founded on Andrews' edition of Freund's Latin dictionary.Oxford: Clarendon Press.
  10. Liddell, H.G. & Scott, R. (1940). A Greek-English Lexicon. revised and augmented throughout by Sir Henry Stuart Jones. with the assistance of. Roderick McKenzie. Oxford: Clarendon Press.
  11. Romer, Alfred Sherwood; Parsons, Thomas S. (১৯৭৭)। The Vertebrate Body। Philadelphia, PA: Holt-Saunders International। পৃষ্ঠা 555–556। আইএসবিএন 0-03-910284-X উদ্ধৃতি টেমপ্লেট ইংরেজি প্যারামিটার ব্যবহার করেছে (link)
  12. "থাইরয়েড সম্পর্কে জানুন, প্রথম আলো, ২৭ মে ২০২১"। ১৭ জুন ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৮ মে ২০২১