ত্শা-রোং-জ্লা-ব্জাং-দ্গ্রা'-'দুল

ত্শা-রোং-জ্লা-ব্জাং-দ্গ্রা'-'দুল (তিব্বতি: ཚ་རོང་ཟླ་བཟང་དགྲ་འདུལ་ওয়াইলি: tsha-rong zla-bzang dgra-'dul; চীনা: 擦绒·达桑占堆; ফিনিন: Cāróng Dásāng Zhānduī) (১৮৮৮-১৪ই মে, ১৯৫৯) একজন তিব্বতী কূটনীতিবিদ, সামরিক বিশারদ, অর্থনীতিবিদ ও প্রকৌশলী ছিলেন। তিনি বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে তিব্বতের সেনানায়ক হিসেবে চীনের বিরুদ্ধে তিব্বতের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে পরিগণিত হন। তিব্বতের আধুনিকীকরণ ও অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য ব্যগ্র ত্শা-রোং তিব্বতের প্রাচীন সমাহব্যবস্থাকে ভেঙ্গে বহির্বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে একটি আধুনিক সমাজ গঠনের ওপর জোর দিয়েছিলেন। তিব্বতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরী এবং তিব্বতী অর্থব্যবস্থাকে সুদৃঢ় করার উদ্দেশ্যে তিনি ব্রিটিশ ভারতে বেশ কয়েকটি কূটনৈতিক সফর করেন। তার কূটনৈতিক দক্ষতার কারণে ব্রিটিশরা তাকে তিব্বতে ব্রিটিশ সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু বলে অভিহিত করেন।[১]

ত্শা-রোং-জ্লা-ব্জাং-দ্গ্রা'-'দুল

সমর অধিনায়ক সম্পাদনা

ত্শা-রোং-জ্লা-ব্জাং-দ্গ্রা'-'দুল ১৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দে তিব্বতের লাসা শহরের উত্তরে ফেনপো নামক স্থানে এক কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বারো বছর বয়সে তিনি নোরবুলিংকা প্রাসাদের এক বৌদ্ধ ভিক্ষুর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। শীঘ্রই তিনি ত্রয়োদশ দলাই লামার ব্যক্তিগত সেবায় নিযুক্ত হন।[২] ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে ত্রয়োদশ দলাই লামা মঙ্গোলিয়া যাত্রা করলে তিনি তার সঙ্গী হন। দলাই লামা তার কর্তব্য নিষ্ঠায় এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন, যে ত্শা-রোং-জ্লা-ব্জাং-দ্গ্রা'-'দুল একজন সেবক থেকে ধীরে ধীরে উপদেষ্টা হিসেবে গুরুত্ব লাভ করেন। উদহারণ হিসেবে ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে তিনি কলকাতা শহরে তিব্বত সরকারের প্রতিনিধি হয়ে একটি বাণিজ্য চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।[১]

 
নোর-বু-দোন-'গ্রুব, খ্রি-স্মোন-ঝাব্স-পাদ এবং ত্শা-রোং-জ্লা-ব্জাং-দ্গ্রা'-'দুল

১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে ত্রয়োদশ দলাই লামা তিব্বত থেকে ব্রিটিশ ভারতে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে ত্শা-রোং একদল তিব্বতী সৈন্যের সাহায্যে চিং সেনাবাহিনীকে সফল ভাবে প্রতিরোধ করে দলাই লামাকে তিব্বত সীমান্ত পেরিয়ে যেতে সাহায্য করেন। এই প্রতিরোধের সম্মুখে চিং সেনাবাহিনীকে প্রচন্ড ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয় এবং তিব্বতীদের নিকট ত্শা-রোং একজন সমর নায়ক হিসেবে সম্মানিত হন। এরপর তিনি প্রায় এক বছর দলাই লামার সাথে দার্জিলিং শহরে বসবাস করেন। ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে ত্রয়োদশ দলাই লামার নির্দেশে তিনি শিগাৎসে যাত্রা করে চিং সেনাবাহিনীকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করেন। ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দে দলাই লামা তাকে আনুষ্ঠানিক ভাবে তিব্বতী সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়কের পদে অধিষ্ঠিত করে তাকে দ্জাসা উপাধি প্রদান করেন। এই বছরেই তাকে লাসা শহরে খ্রি-স্মোন-ঝাব্স-পাদ (ওয়াইলি: khri smon zhabs pad) এবং নোর-বু-দোন-'গ্রুব (ওয়াইলি: nor bu don 'grub) নামক দুই তিব্বতী পদস্থ আধিকারিকদের সঙ্গে একযোগে দুর্বল চিং রাজবংশের বিরুদ্ধে একটি সামরিক বিদ্রোহ সংগঠিত করতে পাঠানো হয়। এই বিদ্রোহের ফলে ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দের ১২ই আগস্ট চিং সেনাবাহিনী রসদের অভাবে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।[১][২] এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দের ১২ই ফেব্রুয়ারি ত্রয়োদশ দলাই লামা চীনের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে তিব্বতকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করেন।[৩]

আধুনিকীকরণের আদর্শ সম্পাদনা

১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে ত্শা-রোং-জ্লা-ব্জাং-দ্গ্রা'-'দুল কূটনৈতিক কারণে সিক্কিম ও ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে তীর্থভ্রমণের উদ্দেশ্যে ভারত যাত্রা করেন। তিব্বতের স্বাধীনতা ঘোষণার পর থেকেই তিনি একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি হিসেবে উঠে আসেন এবং তিব্বতের রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য তার ওপর দায়িত্ব প্রধান করা হয়। তিনি তিব্বতী সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়কের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি মন্ত্রিসভার একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব লাভ করেন। তিনি প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলিতে যাত্রা করে জাতীয় নীতি ও কৌশলগুলি সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। তিনি তিব্বতকে একটি সফল রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী এবং বৈদেশিক শক্তিগুলির সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে উপলব্ধি করেন। তার মতে সেনাবাহিনী শুধুমাত্র বৈদেশিক আক্রমণ থেকেই তিব্বতকে রক্ষা করবে তাই নয়, রাষ্ট্রের ভেতরের বিবাদগুলির নিষ্পত্তিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে একটি কেন্দ্রীভূত সেনা নির্ভর আধুনিক তিব্বত রাষ্ট্রের গঠন করবে। কিন্তু সাধারণ তিব্বতীদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় হওয়া সত্ত্বেও আধুনিকীকরণের বৈপ্লবিক চিন্তাভাবনা এবং সমজ সংস্কারের ডাক অভিজাত সম্প্রদায় ও উচ্চপদস্থ বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মধ্যে অসন্তোষের সৃষ্টি করেছিল, যারা তাকে তিব্বতের প্রাচীন ঐতিহ্য ও ইতিহাসের পরিপন্থী একজন শত্রু হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন।[২] ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ভারত থেকে ফিরে এলে, অভিজাতদের ইচ্ছেয় তাকে সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়কের পদ এবং মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এতদসত্ত্বেও দ্রেপুং বৌদ্ধবিহারের মতো তিব্বতের প্রভাবশালী বৌদ্ধবিহারের ভিক্ষুরা তাকে সবসময় সমর্থন করে গেছেন।[১]

অর্থনীতৈক উন্নতির প্রচেষ্টা সম্পাদনা

 
ডানদিকে ত্শা-রোং-জ্লা-ব্জাং-দ্গ্রা'-'দুল

১৯৩০ ও ১৯৪০-এর দশকে ত্শা-রোং-জ্লা-ব্জাং-দ্গ্রা'-'দুল তিব্বতের অর্থনৈতিক বিকাশের দিকে নজর দেন। ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে ত্রয়োদশ দলাই লামা মৃত্যুবরণ করলে তাকে গ্রা-ব্শি-দ্নুল-খাং (ওয়াইলি: gra bshi dnul khang) বা তিব্বতের ট্যাঁকশালের প্রধান করে দেওয়া হয়। এই বিভাগটি কাগজের নোটের মান বৃদ্ধি করা ছাড়াও অস্ত্র মজুত এবং লাসা শহরকে বৈদ্যুতিকরণের চেষ্টা করত।[২] ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি তিব্বতের অর্থব্যবস্থাকে সুদৃঢ় করতে কাগজের নোটের সমান দামের সোনা মজুত করার কথা প্রচার করতে শুরু করেন।[n ১]

সেতু নির্মাণ সম্পাদনা

১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি লাসা থেকে আট মাইল দূরে ভারত ও পশ্চিম তিব্বতের ব্যবসার পথে একটি সেতু নির্মাণের দায়িত্ব লাভ করেন। এই সেতু নির্মাণের কাজ সম্পন্ন হলে তিনি লাসা শহরের পূর্বে স্ক্যিদ নদীর ওপরে একটি সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। তিব্বত সরকারের অনুমোদন লাভের পর তিনি কলকাতা থেকে সেতু নির্মাণের প্রয়োজনীয় ইস্পাত কেনার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু এই পরিকল্পনা মাঝপ্তহে বন্ধ করে দেওয়া হয়।[১][২]

মৃত্যু সম্পাদনা

১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে চীনা সাম্যবাদী সরকারের তিব্বত আক্রমণের প্রতিবাদে লাসা শহরে বিদ্রোহ শুরু হলে চীনা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কূটনৈতিক স্তরে মধ্যস্থতা করার জন্য ত্শা-রোং-জ্লা-ব্জাং-দ্গ্রা'-'দুলকে একটি তিব্বতী প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব প্রদান করে পাঠানো হয়, কিন্তু কোন রকম সমঝোতা হওয়ার পূর্বেই চীনারা লাসা শহরের ওপর বোমাবর্ষণ শুরু করে। ত্শা-রোং-জ্লা-ব্জাং-দ্গ্রা'-'দুল সহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ আধিকারিককে গ্রেপ্তার করা হয়। বন্দী হোয়াত কিছু দিন পরে ১৪ই মে লাসা শহরের একটি চীনা কারাগারে তার মৃত্যু হয়।[২]

চলচ্চিত্র রূপায়ণ সম্পাদনা

জার্মান পর্বতারোহী হাইনরিখ হারার রচিত সেভেন ইয়ার্স ইন টিবেট অবলম্বনে তৈরী সেভেন ইয়ার্স ইন টিবেট চলচ্চিত্রে মাকো ইওয়ামাৎসু নামক জাপানী অভিনেতা ত্শা-রোং-জ্লা-ব্জাং-দ্গ্রা'-'দুলের চরিত্রে অভিনয় করেন।

পাদটীকা সম্পাদনা

  1. "In 1947 there was little of either grain reserves or gold. Tsarong was worried about this situation since we continued to print new paper currency. He always used to say that the paper money had to have some hard backing; that a currency note means that the government guarantees the value of the note in gold or some other commodity. He also used to talk about a foreign country where all the people suddenly came and asked to change paper money into silver and gold and the government had nothing, so the finance minister had to commit suicide."[৪]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "Tsarong Dzasa"। The Tibet Album, British Photography in Central Tibet (1920–1950), Oxford University। সংগ্রহের তারিখ ফেব্রুয়ারি ৩, ২০০৯ 
  2. "Profile: Important People in Tibetan History:Dasang Dadul Tsarong" (পিডিএফ)। The Tibet Museum। ২০০৬। সংগ্রহের তারিখ ফেব্রুয়ারি ৩, ২০০৯ 
  3. "Proclamation Issued by His Holiness the Dalai Lama XIII (1913)", Tibet Justice Center ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১ ডিসেম্বর ২০১৩ তারিখে. Retrieved 20 March 2009
  4. Goldstein, Melvyn C.; Rimpoche, Gelek। A History of Modern Tibet, 1913–1951। পৃষ্ঠা 570। সংগ্রহের তারিখ ফেব্রুয়ারি ৩, ২০০৯ 

আরো পড়ুন সম্পাদনা

  • Spence, Heather: “Tsarong II, The Hero of Chaksam, and the Modernisation Struggle in Tibet 1912-1931.” Tibet Journal, vol. 16, no. 1, Dharamsala, spring 1991, p. 34-57.
  • Taring, Rinchen Dolma: Daughter of Tibet. Reprint, Allied Publishers, New Delhi, 1978.
  • Tsarong, Dundul Namgyal: In the Service of his Country. The Biography of Dasang Damdul Tsarong. Commander General of Tibet. Snow Lion Publications, Ithaca, New York, 2000

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা