ত্রিপিটক

বৌদ্ধধর্মের পবিত্র ধর্মানুশাসনিক পুস্তকসমূহের সংকলন

ত্রিপিটক বৌদ্ধ ধর্মীয় পালি গ্রন্থের নাম। বুদ্বের দর্শন এবং উপদেশের সংকলন। পালি তি-পিটক হতে বাংলায় ত্রিপিটক শব্দের প্রচলন। তিন পিটকের সমন্বিত সমাহারকে ত্রিপিটক বোঝানো হচ্ছে। এই তিনটি পিটক হলো বিনয় পিটক, সূত্র পিটকঅভিধর্ম পিটক

ত্রিপিটক
ত্রিপিটক
তথ্য
ধর্মবৌদ্ধধর্ম
ভাষাপালি ভাষা
অধ্যায়
অনুবাদে
Tripiṭaka
ইংরেজি:Three Baskets
পালি:Tipiṭaka
সংস্কৃত:त्रिपिटक
বাংলা:ত্রিপিটক
বর্মী:ပိဋကတ် သုံးပုံ
[pḭdəɡaʔ θóʊɴbòʊɴ]
চীনা:三藏
(pinyinSānzàng)
জাপানী:三蔵 (さんぞう)
(rōmaji: sanzō)
Khmer:ព្រះត្រៃបិដក
কোরীয়:삼장 (三臧)
(RR: samjang)
সিংহলি:ත්‍රිපිටකය
তামিল:திரிபிடகம்
থাই:พระไตรปิฎก
ভিয়েতনামী:Tam tạng (三藏)
বৌদ্ধ ধর্ম সংশ্লিষ্ট টীকাসমূহ

পিটক শব্দটি পালি এর অর্থ - ঝুড়ি, পাত্র, বাক্স ইত্যাদি, অর্থ যেখানে কোনো কিছু সংরক্ষণ করা হয়।[১] এটি থেরবাদী বৌদ্ধদের মূল ধর্মীয় গ্রন্থ।[২] খ্রীষ্ট পূর্ব ৩য় শতকে সম্রাট অশোকের রাজত্বকালে ত্রিপিটক পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ হিসাবে স্বীকৃত হয়। এই গ্রন্থের গ্রন্থনের কাজ শুরু হয়েছিল গৌতম বুদ্ধ এর পরিনির্বানের তিন মাস পর অর্থাৎ খ্রিষ্ট পূর্ব ৫৪৩ অব্দে এবং সমাপ্তি ঘটে খ্রিষ্ট পূর্ব প্রায় ২৩৬ অব্ধে। প্রায় তিনশ বছরে তিনটি সঙ্ঘায়নের মধ্যে এর গ্রন্থায়নের কাজ শেষ হয়। আর এতে অংশগ্রহণকারী পণ্ডিত অরহত ভিক্ষু ছিল ২২০০ জন।[৩]

উদ্ভব সম্পাদনা

ত্রিপিটক (সংস্কৃত: त्रिपिटक), বা ত্রিপিটক (পালি), মানে "তিনটি ঝুড়ি"।  এটি ত্রি (त्रि) বা পালি শব্দ টি এর একটি যৌগিক সংস্কৃত শব্দ, যার অর্থ "তিন", এবং পিটাক (পিটক) বা পিটা (पिट), যার অর্থ "ঝুড়ি"।  "তিন ঝুড়ি" ছিল মূলত খেজুর পাতার পান্ডুলিপির আধার যার উপর বৌদ্ধ ক্যানন গঠনকারী তিনটি বিভাগ সুত্ত, বিনয় এবং অভিধম্মের গ্রন্থের সংগ্রহ সংরক্ষিত ছিল।[৪]  পণ্ডিত সাহিত্যে ত্রিপিটাক এবং টিপিটাকা হিসাবে ডায়াক্রিটিক ছাড়া এই পদগুলিকেও বানান করা হয়।

ভাগ সম্পাদনা

ত্রিপিটককে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়:

ত্রিপিটকে ধর্মস্কন্দের বিন্যাস সম্পাদনা

ধর্মস্কন্দ্ব অর্থ - ধর্ম পরিচ্ছেদ বা বিষয় বিভাগ। অর্থাৎ ত্রিপিটকে বর্ণিত ক্ষুদ্র ও বৃহৎ প্রত্যেক বিষয়কে এক একটি স্কন্দ্ব বলা হয়। ত্রিপিটকে এরুপ চুরাশি হাজার (৮৪০০০) ধর্মস্কন্দ্ব রয়েছে। তার মধ্যে বিনয় পিটকে একুশ হাজার (২১০০০), সূত্র পিটকে একুশ হাজার (২১০০০) ও অভিধর্ম পিটকে বেয়াল্লিশ হাজার (৪২০০০)। এই চুরাশি হাজার বুদ্ধ বচন বা বুদ্ধ উল্লেখিত বিষয় বা শাস্ত্রবাক্য এই ত্রিপিটকে বিদ্যমান।

ত্রিপিটকের ভাষা সম্পাদনা

খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক হতে খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতক অবধি পালি ভাষা এবং এই ভাষায় রচিত সাহিত্য সমুহ ক্রমবিকাশের পথে অগ্রসর হয়েছে । গৌতম বুদ্ধের ব্যবহৃত ভাষা হিসাবে এই ভাষার ইতিহাস সর্বাধিক গুরুত্ব লাভ করে। বুদ্ধ তার ধর্ম আদর্শ প্রচারের জন্য সমগ্র উত্তর ভারত পরিভ্রমন করেন। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত মানুষদের সর্বজন বোধ্যতার তাগিদে পালি ভাষার প্রচলনের প্রসার ঘটে। ক্রমে বৌদ্ধ ভিক্ষু মন্ডলি ধর্মালোচনার মাধ্যম হিসাবে এই ভাষাতেই দক্ষতা অর্জন করেন। বুদ্ধ নিজে ও এই ভাষাতেই ধর্মদেশনা দিতেন। তাই পরবর্তিতে এই ভাষাতেই( পালিতে) মুল ত্রিপিটক গ্রন্থ রচিত ও সংরক্ষিত হয়।[৫]

গ্রন্থন পূর্বক ত্রিপিটকের অবস্থা সম্পাদনা

বুদ্ধের সময়কালে বৌদ্ধ ভিক্ষুগণ ধ্যানে-জ্ঞ্যানে অত্যন্ত উচ্চ মার্গের চেতনা সম্পন্ন ছিলেন। তাদের মধ্যে যে যেই বিষয়ে সাধনা করতেন সে সেই বিষয়ে অত্যধিক উন্নতি সাধন করতেন। এই সময়ে ভিক্ষুদের মধ্যে সুত্রধর, বিনয়ধর এবং মাতিকাধর নামে তিন ধারার সাধনাকারী ভিক্ষু ছিলেন।[৬] এই তিন শ্রেণীর ভিক্ষুগণ সকলেই ছিলেন স্মৃতিধর।

স্মৃতিধর এই ভিক্ষুগণ শ্রুতি থেকে স্মৃতিতে বুদ্ধ বাণীকে সংরক্ষণ করতেন। নিরন্তর অধ্যবসায়ে ভিক্ষুগণ তাদের শিষ্য পরম্পরায় এই রীতি সচল রাখতেন। বুদ্ধের শিষ্যদের মধ্যে প্রায় প্রত্যেকেরই এই শ্রুতি ও স্মৃতি ক্ষমতা ছিল। তাই ত্রিপিটক গ্রন্থনের পূর্বে সুত্রধরেরা সূত্র, বিনয়ধরেরা বিনয় এবং মাতিকা ধরেরা অভিধর্ম পিটক স্মৃতিতে রাখতেন।

ত্রিপিটক সংকলনে সঙ্গায়নের ভূমিকা সম্পাদনা

সঙ্গায়ন হচ্ছে ত্রিপিটকের মূল বিষয় সমূহ নিয়ে আলোচনা- পর্যালোচনা সভা। [৭] সঙ্গীতি শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো ধর্মসভা, সম্মেলন, পুনরায় শ্রবণ করা বা বিবেচনা করা, সমবেতভাবে উচ্চারণ, ঘোষণা ইত্যাদি।বিভিন্ন অর্থ পাওয়া গেলেও বৌদ্ধসাহিত্যে সঙ্গায়ন বা সঙ্গীতি শব্দটির অর্থ সভা বা সম্মেলন বোঝায়। [৮] বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের পর হতে বৌদ্ধ ধর্ম সম্পর্কিত প্রশ্ন মীমাংসা, প্রকৃত বুদ্ধবাণী নির্ধারণ, সংকলন, সংরক্ষণ, বিশুদ্ধতা রক্ষা এবং প্রচার প্রসারের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, যা বৌদ্ধধর্ম ইতিহাসে সঙ্গীতি নামে পরিচিত।

 
সম্রাট অশোক এবং মোগ্গলিপুত্ত-তিষ্য তৃতীয় বৌদ্ধ সঙ্গীতি, পাটলিপুত্রে

এসব সভায় শত শত প্রবীন জ্ঞানী এবং অর্হৎ ভিক্ষু উপস্থিত থাকতেন। আলোচ্য বিষয়ের গুরুত্বানুসারে এসব সভা কয়েকমাস ব্যাপী চলতো। [৮] থেরবাদী ঐতিহ্যানুসারে এই পর্যন্ত ছয়টি মহাসঙ্গীতির কথা জানা গেছে।

ত্রিপিটক সংকলনে বৌদ্ধ ঐতিহাসিক গ্রন্থের সত্যতা সম্পাদনা

বৌদ্ধ ঐতিহাসিক গ্রন্থ গুলোতে ত্রিপিটক সংকলনের উপযুক্ত তথ্য পাওয়া যায়। মহাবংস ও দীপবংস গ্রন্থে নিম্নোক্ত তথ্য পাওয়া যায়-

"পিটকত্রয় এবং তার অট্ঠকথা পূর্বে মহাজ্ঞানী(মহামতি) ভিক্ষুগণ কন্ঠে ধারণ করে নিয়ে এসেছিলেন(সিংহলে)। সেই সময় সত্ত্বগণের পরিহানি লক্ষ্য করে ভিক্ষুগণ সমবেত হয়ে ধর্মের চিরস্থায়িত্বের জন্য পুস্তক আকারে লিপিবদ্ধ করেন।"

চূল্লবংস গ্রন্থে নিম্নোক্ত তথ্য পাওয়া যায়- "পালিমত (ত্রিপিটক) এখানে (জম্বুদ্বীপ) আনা হয়েছে, অট্ঠকথা এখানে নেই; আচরিয়বাদ এবং অন্যান্য মতবাদও এখানে দেখা (পাওয়া) যায় না। সীহলট্ঠকথা শুদ্ধ, বুদ্ধ দেশিত এবং শারিপুত্র প্রমুখ আচার্য কর্তৃক ব্যাখ্যাকৃত, তিনটি সঙ্গীতিতে আবৃত্তি কৃত এবং মহিন্দ থের কর্তৃক সিংহলে প্রচারিত ও সিংহলী ভাষায় অনূদিত।"

সদ্ধম্ম সংগহো গ্রন্থে নিম্নোক্ত তথ্য পাওয়া যায়- " হে বুদ্ধঘোষ! জম্বুদ্বীপে কেবল পালি পিটকত্রয়ই (ত্রিপিটক) আছে, তার অট্ঠকথা এবং আচরিয়বাদ নেই। শারিপুত্র প্রমুখ কৃত এবং সঙ্গীতিত্রয়ে সংকলিত সিংহলী অট্ঠকথা মহিন্দ থের কর্তৃক সিংহলী ভাষায় অনূদিত হয়ে সিংহলদ্বীপে সংরক্ষিত আছে।"

গন্ধবংস গ্রন্থে নিম্নোক্ত তথ্য পাওয়া যায়- "প্রথম মহাসঙ্গীতিতে ৫০০ ক্ষীণাসব (অর্হৎ) নাম, অর্থ, উদ্দেশ্য, পদ, ব্যাখ্যা এবং পরিশোধনসহ পঞ্চনিকায় সংগ্রহ করেছিল। দ্বিতীয় সঙ্গীতিতে ৭০০ ক্ষীণাসব (অর্হৎ) পুনরায় শব্দের অর্থাদি সংকলন করেছিলেন। তৃতীয় সঙ্গীতিতে ১০০০ ক্ষীণাসব (অর্হৎ) পুনরায় শব্দের অর্থাদি সংকলন করেছিলেন। মোট ২২০০ জন ভিক্ষুই ছিলেন পোরাণাচার্য বা প্রাচীন আচার্য। এরূপ মহাকচ্চায়নসহ ২২০০ জন ক্ষীণাসব (অর্হৎ) পোরাণাচার্য নামে কথিত। পোরাণাচার্যগণই অট্ঠকথাচার্য।"

সাসনবংস গ্রন্থে নিমোক্ত তথ্য পাওয়া যায়- " অতঃপর, বুদ্ধঘোষ থের'র সিংহলদ্বীপ গিয়ে ত্রিপিটক লিখন এবং অট্ঠকথা সংকলন করেন। এ বিষয়ে মনে সংশয় উৎপাদন অনুচিত। বুদ্ধঘোষ থের পিটকত্রয় লিখে পরে জম্বুদ্বীপে ফিরে এসেছিলেন।"

এছাড়াও আরো অনেক বৌদ্ধ গ্রন্থে ত্রিপিটক সংকলনের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়।

ত্রিপিটকের অভ্যন্তরীণ গ্রন্থের পরিচয় সম্পাদনা

ষষ্ঠ বৌদ্ধসংগীতি অনুসারে নিম্নে তা দেওয়া হলো-

১) বিনয় পিটক

২) সূত্র পিটক

৩) অভিধর্ম পিটক

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. DR. Shukomal Barua and Suman Kanti Barua - ত্রিপিটক পরিচিতি , Page 1-3, Bangla Academy December 2000
  2. "Pali canon | Definition, Contents, & Facts | Britannica"www.britannica.com (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৫-১০ 
  3. DR. Shukomal Barua and Suman Kanti Barua - ত্রিপিটক পরিচিতি , Page 14, Chapter - Tripitok History. Bangla Academy December 2000.
  4. "ত্রিপিটক, ত্রিপিটক পাবলিশিং সোসাইটি ও বৌদ্ধ সমাজ"Buddhist WiKi - Bangla Buddhist Articles - Tripitaka pdf - Dhamma E-books (ইংরেজি ভাষায়)। ২০২০-০৭-১৬। ২০২২-০৬-১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৫-১০ 
  5. Wilhelm Geiger: The Mahavamsa, Introduction - p. XXVI.
  6. মহাপরিনির্বাণ সূত্র , দীর্ঘ নিকায়, সুত্ত পিটক। page : 56
  7. Benaya Pitakar Songayoun Prasno, translated by Alokabonso Vikso, Publisher: Pragabonso Akademey, 25 Fabuary 2013. P.01
  8. Buddhadharma o Noitik Siksha, C.9,10 NCTB, 2018, p.97
  9. পালি সাহিত্যের চন্দ্রকথা,গ্রন্থকার :ড.ভিক্ষু সত্যপাল। পৃষ্ঠা:36.প্রকাশক:বুদ্ধ ত্রিরত্ন মিশন, দিল্লী।
  10. DR. Shukomal Barua and Suman Kanti Barua - ত্রিপিটক পরিচিতি , Page 25, Chapter - Tripitok's Subject. Bangla Academy December 2000.
  11. বৌদ্ধধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা পাঠ্যপুস্তক বোর্ড,বাংলাদেশ,নবম-দশম শ্রেণী। পৃষ্ঠা -37

বহিসংযোগ সম্পাদনা

Pali Canon:

Myanmar Version of Buddhist Canon (6th revision):

Chinese Buddhist Canon:

Tibetan tradition:

Tripiṭaka collections:

Sri Lankan version of Tipiṭaka: