তওবা (আরবি: توبة) একটি আরবি শব্দ যার অর্থ অনুশোচনা করা, মহান আল্লাহতালার কাছে ফিরে আসা বা প্রত্যাবর্তন করা।[১][২] কোরআন এবং হাদীসে শব্দটি আল্লাহর নিষেধকৃত বিষয়সমূহ ত্যাগ করা ও তার আদেশকৃত বিষয়সমূহর দিকে ফিরে আসা বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে। ইসলামী ধর্মতত্ত্বে শব্দটি নিজের কৃত পাপের জন্য অনুতপ্ত হওয়া, তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা, এবং তা পরিত্যাগের দৃঢ় সংকল্পকে বোঝায়।[৩] যেহেতু কোরআনে এবং হাদীসে কৃত পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করার বিষয়টি বারংবার উল্লেখ ও গুরুত্বারোপ করা হয়েছে, সে কারণে ইসলামী ধর্তমত্ত্বে তওবার গুরুত্ব অনেক। তওবা ব্যাতিরেকে কবিরা গুনাহ মাফ হয় না। যে তওবার পর পাপকর্মের পুনরাবৃত্তি হয় না, তাকে বলে তওবাতুন নাসুহা বা খাঁটি তওবা।

শব্দতত্ত্ব সম্পাদনা

ইসলামে তওবা শব্দের মূল উৎস হল কুরআন এবং হাদিস। কুরআনের অনেক স্থানে তওবা শব্দটি উল্লেখ করা হয়েছে। তার মধ্যে কিছু হল:

  1. সূরা আন নূর ২৪, আয়াত ৩১[৪]
  2. সূরা আল ফুরকান ২৫, আয়াত ৭০-৭১[৫]
  3. সূরা আত - তাহরীম৬৬, আয়াত ৮।[৬]

অর্থ সম্পাদনা

তওবার আক্ষরিক অর্থ মহান আল্লাহর দিকে ফিরে আসা। ইসলামী শরীয়তে এর অর্থ অতীত পাপকাজ থেকে ফিরে আসা এবং ভবিষষ্যতে তা না করার দৃঢ় সংকল্প করা। কোরআনের সূরা ৬৬ আয়াত ০৮-তে তওবা শব্দটি ′নাসূহ (نصوح) শব্দ সহকারে ববহৃত হয়েছে যার অর্থ খাঁটি। সুতরাং, তওবার প্রকৃত তাৎপর্য হল আন্তরিক অনুশোচনা।

কুরআনের আলোকে তওবা সম্পাদনা

কুরআনের একটি পূর্ণাঙ্গ সূরার নামকরণ করা হয়েছে সূরা তওবা। এছাড়া সূরা নুর,সূরা তাহরিম, সূরা বাকারা, সূরা ফুরকানসহ কুরআনের আরও অনেক স্থানে তওবা এবং এর গুরুত্ব উল্লেখ করা হয়েছে।

— কুরআন, সূরা ২৪ (আন-নুর) >>>বিশ্বাসী নারীদেরকে বল,তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত করে ও তাদের লজ্জাস্থান রক্ষা করে।তারা যা সাধারণতঃপ্রকাশ থাকে তা ব্যতীত [২] তাদের সৌন্দর্য যেন প্রদর্শন না করে তারা তাদের বক্ষঃস্থল যেন মাথার কাপড় দ্বারা আবৃত রাখে। তারা যেন তাদের স্বামী,পিতা,শ্বশুর,পুত্র,স্বামীর পুত্র,ভ্রাতা,ভ্রাতুষ্পুত্র,ভগিনী পুত্র,তাদের নারীগ্ণ,ক্রীতদাস,যৌনকামনা-রহীত পুরুষ /নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ বালক ব্যতীত কারোও নিকট তাদের সৌন্দর্য্য প্রকাশ না করে।আর তারা যেন এমন সজোরে পদক্ষেপ না করে,যাতে তাদের গোপন আভরন প্রকাশ পেয়ে যায়। হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা সকলে আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন কর,যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার।.. আয়াত ৩১[৭] https://quran.com/24:31

হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহর সমীপে খাঁটি তওবা কর, এই আশায় যে তোমাদের প্রভু তোমাদের সকল পাপ ক্ষমা করে দেবেন আর তোমাদেরকে এমন উদ্যানসমূহে উপবিষ্ট করবেন যার নিম্নদেশে নদীসমূহ প্রবাহিত থাকবে...

— কুরআন, সূরা ৬৬ (আল-তাহরিম), আয়াত ৮[৮]

নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদেরকে ভালবাসেন যারা তাঁর কাছে তওবা করে, এবং তিনি তাদেরকে ভালবাসেন যারা নিজেদেরকে পবিত্র করে।

— কুরআন, সূরা ২ (আল-বাকারা), আয়াত ২২২[৯]

অবশ্যই আল্লাহ তাদের তওবা কবুল করবেন, যারা ভূলবশত মন্দ কাজ করে, অতঃপর অনতিবিলম্বে তওবা করে, এরাই হল সেসব লোক যাদেরকে আল্লাহ ক্ষমা করে দেন; আল্লাহ মহাজ্ঞানী রহস্যবিদ। আর এমন লোকদের জন্য কোন ক্ষমা নেই, যারা মন্দ কাজ করতেই থাকে, এমনকি যখন মাথার উপর মৃত্যু এসে উপস্থিত হয়, তখন বলতে থাকে - আমি এখন তওবা করছি। আর তওবা নেই তাদের জন্য, যারা কুফুরি(অবাধ্য) অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে। আমি তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছি।

— কুরআন, সূরা ৪ (আন-নিসা), আয়াত ১৭-১৮[১০]

কুরআনে আল্লাহ অবিশ্বাসী ও অবাধ্য (কাফির) দেরকে সম্বোধন করে বলেছেন যে, তারা যদি আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করে তবে আল্লাহ তাদেরকেও ক্ষমা করে দেবেন।:

কিয়ামত দিবসে তার (অবিশ্বাসী, অবাধ্য) শাস্তি বৃদ্ধি পেতে থাকবে, এবং সে তাতে অনন্তকাল লাঞ্ছিত অবস্থায় থাকবে,- কিন্তু তারা নয় যারা তওবা করে বিশ্বাস স্থাপন করে এবং সৎকর্ম করে, এইরূপ লোকেদের জন্য আল্লাহ পাপের পরিবর্তে পুণ্যসমূহ দান করবেন, আর আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল পরম করুণাময়। আর যে ব্যক্তি তওবা করে ও সৎকর্ম করে তবে তো সেই ব্যক্তি সত্যিই আল্লাহর নিকট (গ্রহণযোগ্যভাবে) রূপান্তরিত হয়ে প্রত্যাবর্তন করেছে।

— কুরআন, সূরা ২৫ (আল-ফুরকান), আয়াত ৬৯-৭১[১১]

হাদিসের আলোকে তওবা সম্পাদনা

কুরআনের ন্যায়, হাদীসেও তওবার উল্লেখ রয়েছে এবং এর প্রতি জোর দেওয়া হয়েছে। তিরমিযী গ্রন্থে একটি হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে:

রাসূলুল্লাহ বলেছেন, "প্রত্যেক আদম সন্তানই পাপ করে, পাপীদের মধ্যে তারাই সর্বোত্তম যারা তওবা করে।"/রাসূলুল্লাহ বলেছেন, "প্রত্যেক আদম সন্তান ত্রুটিশীল ও অপরাধী, আর অপরাধীদের মধ্যে উত্তম লোক তারা যারা তওবা করে।"

— আহমাদ ১৩০৪৯, তিরমিযী ২৪৯৯, ইবনে মাজাহ ৪২৫১, দারেমী ২৭২৭, বাইহাক্বী ৭১২৭

সহিহ মুসলিম থেকে আরেকটি হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে: সহীহ মুসলিমে, আবু আইয়ুব আনসারি এবং আবু হুরায়রা বর্ণনা করেন:

আল্লাহর রাসূল বলেন, "সেই সত্ত্বার কসম, যার হাতে আমার প্রাণ, মানুষ যদি পাপ না করতো তবে আল্লাহ তাআলা মানবজাতিকে উঠিয়ে নিয়ে এমন এক সম্প্রদায়ের অবতারণা করতেন, যারা পাপ করত এবং পরে (নিজের ভুল বুঝতে পেরে) আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতো এবং আল্লাহ তাদের ক্ষমা করে দিতেন।"

সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত, আবূ সাঈদ সা‘দ ইবন মালেক ইবন সিনান খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘‘তোমাদের পূর্বে (বনী ইস্রাইলের যুগে) একটি লোক ছিল; যে ৯৯টি মানুষকে হত্যা করেছিল। অতঃপর লোকদেরকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় আলেম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করল। তাকে একটি খ্রিষ্টান সন্নাসীর কথা বলা হল। সে তার কাছে এসে বলল, ‘সে ৯৯ জন মানুষকে হত্যা করেছে। এখন কি তার তওবার কোন সুযোগ আছে?’ সে বলল, ‘না।’ সুতরাং সে (ক্রোধান্বিত হয়ে) তাকেও হত্যা করে একশত পূরণ করে দিল। পুনরায় সে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আলেম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করল। এবারও তাকে এক আলেমের খোঁজ দেওয়া হল। সে তার নিকট এসে বলল যে, সে একশত মানুষ খুন করেছে। সুতরাং তার কি তওবার কোন সুযোগ আছে? সে বলল, ‘হ্যাঁ আছে! তার ও তওবার মধ্যে কে বাধা সৃষ্টি করবে? তুমি অমুক দেশে চলে যাও। সেখানে কিছু এমন লোক আছে যারা আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করে। তুমিও তাদের সাথে আল্লাহর ইবাদত কর। আর তোমার নিজ দেশে ফিরে যেও না। কেননা, ও দেশ পাপের দেশ।’ সুতরাং সে ব্যক্তি ঐ দেশ অভিমুখে যেতে আরম্ভ করল। যখন সে মধ্য রাস্তায় পৌঁছল, তখন তার মৃত্যু এসে গেল। (তার দেহ-পিঞ্জর থেকে আত্মা বের করার জন্য) রহমত ও আযাবের উভয় প্রকার ফেরেশতা উপস্থিত হলেন। ফিরিশতা- দের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক আরম্ভ হল। রহমতের ফেরেশতাগণ বললেন, ‘এই ব্যক্তি তওবা করে এসেছিল এবং পূর্ণ আন্তরিকতার সাথে আল্লাহর দিকে তার আগমন ঘটেছে।’ আর আযাবের ফিরিশতারা বললেন, ‘এ এখনো ভাল কাজ করেনি (এই জন্য সে শাস্তির উপযুক্ত)।’ এমতাবস্থায় একজন ফিরিশতা মানুষের রূপ ধারণ করে উপস্থিত হলেন। ফিরিশতাগণ তাঁকে সালিস মানলেন। তিনি ফায়সালা দিলেন যে, ‘তোমরা দু’ দেশের দূরত্ব মেপে দেখ। (অর্থাৎ এ যে এলাকা থেকে এসেছে সেখান থেকে এই স্থানের দূরত্ব এবং যে দেশে যাচ্ছিল তার দূরত্ব) এই দুয়ের মধ্যে সে যার দিকে বেশি নিকটবর্তী হবে, সে তারই অন্তর্ভুক্ত হবে।’ অতএব তাঁরা দূরত্ব মাপলেন এবং যে দেশে সে যাওয়ার ইচ্ছা করেছিল, সেই (ভালো) দেশকে বেশি নিকটবর্তী পেলেন। সুতরাং রহমতের ফিরিশতাগণ তার জান কবয করলেন।’’ (বুখারী ও মুসলিম)

সহীহতে আর একটি বর্ণনায় এরূপ আছে যে, ‘‘পরিমাপে ঐ ব্যক্তিকে সৎশীল লোকদের দেশের দিকে এক বিঘত বেশি নিকটবর্তী পাওয়া গেল। সুতরাং তাকে ঐ সৎশীল ব্যক্তিদের দেশবাসী বলে গণ্য করা হল।’’ সহীহতে আরো একটি বর্ণনায় এইরূপ এসেছে যে, ‘‘আল্লাহ তা‘আলা ঐ দেশকে (যেখান থেকে সে আসছিল তাকে) আদেশ করলেন যে, তুমি দূরে সরে যাও এবং এই সৎশীলদের দেশকে আদেশ করলেন যে, তুমি নিকটবর্তী হয়ে যাও। অতঃপর বললেন, ‘তোমরা এ দু’য়ের দূরত্ব মাপ।’ সুতরাং তাকে সৎশীলদের দেশের দিকে এক বিঘত বেশি নিকটবর্তী পেলেন। যার ফলে তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হল।’’

আরো একটি বর্ণনায় আছে, ‘‘সে ব্যক্তি নিজের বুকের উপর ভর করে ভালো দেশের দিকে একটু সরে গিয়েছিল।’’

— সহীহুল বুখারী ৩৪৭০, মুসলিম ২৭৬৬, ইবনু মাজাহ ২৬২৬, আহমাদ ১০৭৭০, ১১২৯০

সহিহ বুখারীসহিহ মুসলিম-এ, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ বর্ণনা করেন:

এক ব্যক্তি জনৈক মহিলাকে (অবৈধভাবে) চুম্বন করে বসে। পরে সে আল্লাহর রাসূল-এর নিকট এসে বিষয়টি তার গোচরীভূত করে। তখন আল্লাহ্ তা‘আলা আয়াত নাযিল করেনঃ ‘‘দিনের দু’প্রান্তে-সকাল ও সন্ধ্যায় এবং রাতের প্রথম অংশে সালাত কায়েম কর (পাচ ওয়াক্ত ফরয সালাত আদায় করো)। নিশ্চয়ই ভালো কাজ (ছোটখাটো) পাপাচারকে মিটিয়ে দেয়’’- (হূদ ১১/১১৪)[১২]। লোকটি জিজ্ঞেস করলো, হে আল্লাহর রাসূল! এ কি শুধু আমার বেলায়? আল্লাহর রাসূল বললেন: আমার সকল উম্মাতের জন্যই।

সহিহ মুসলিম-এ, আনাস ইবনে মালিক বর্ণনা করেন:

কোন এক ব্যক্তি আল্লাহর রাসুলের কাছে এসে বলল, আমি এমন এক পাপ করেছি যার জন্য আমার উপর হদ (হুদুদ আইনের শাস্তি) প্রযোজ্য হয়, তাই আল্লাহর কিতাব অনুসারে আমার উপর তা প্রয়োগ করুন। আল্লাহর রাসুল বললেনঃ তুমি কি সালাত আদায়ের সময় আমাদের সঙ্গে ছিলে না? লোকটি বলল: হ্যা। আল্লাহর রাসুল বললেন: আল্লাহ তোমাকে মাফ করে দিয়েছেন।

সহিহ বুখারীতে, আনাস ইবনে মালিক বর্ণনা করেন:

আল্লাহর রাসূল বলেন, "তোমাদের কেও মরুভূমিতে হারিয়ে যাওয়া উট খুঁজে পেয়ে যতটা খুশি হয়, আল্লাহ তাঁর বান্দার তওবাতে তাঁর চেয়েও বেশি খুশি হন।"

আবু হুরায়রা বর্ণনা করেন:

আমি আল্লাহর রাসূলকে বলতে শুনেছি, "আল্লাহর কসম! আমি প্রতিদিন সত্তরবারেরও অধিক বার আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করি এবং তওবা করে তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তন করি।"

হযরত আবদুর রহমান বিন জুবাইর হযরত আবু তালীব শাতবুল মামদুদ হতে বর্ণনা করেন, তিনি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট আসেন। অন্য বর্ণনায় এসেছে, একজন খুবই বৃদ্ধ ব্যক্তি লাঠিতে ভর দিয়ে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আসেন যার চোখের পাতা তার চোখের সাথে লেগে গিয়েছিল। তিনি রাসূলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলেন, যদি কোন লোক সব ধরনের পাপ করে থাকে, এমন কোন পাপ নেই যা সে করেনি (ছোট বড় সব ধরনের পাপই করেছে)। (অপর বর্ণনায় এসেছে যে, সে সব পাপই করেছে, তার পাপ যদি দুনিয়াবাসীর উপর বন্টন করে দেয়া হতো তাহলে তাদেরকে ধ্বংস করে দিত) এর কি তাওবা করার সুযোগ রয়েছে? তিনি বললেন, আপনি কি ইসলাম গ্রহণ করছেন? সে বললো, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ ব্যতীত কোন সত্য মাবুদ নেই এবং নিশ্চয় আপনি আল্লাহর রাসূল। তিনি বললেন, ভাল কাজ করবেন এবং মন্দ (পাপ) কাজ পরিত্যাগ করবেন তাহলে আল্লাহ তা'আলা আপনার জন্য সব পাপকে ভাল কাজে পরিণত করে দিবেন। সে বলল, আমার গাদ্দারী ও কুকীর্তি সমূহ? তিনি বললেন, হ্যাঁ। বর্ণনাকারী বলেন, সে বার বার আল্লাহু আকবার ( আল্লাহ মহান) ধ্বনি উচ্চারণ করছিল যতক্ষণ না সে চোখের আড়াল হয়ে যায়।

— (তবারানী, বাজ্জার; আল-মুনজেরী তারগীব গ্রন্থে উল্লেখ করেন যে, এর সনদ মজবুত ৪/১১৩; ইবনে হাজার ইসাবা গ্রন্থে বলেন, হাদীসটি শর্ত মোতাবেক রয়েছে ৪/১৪৯)[১৩]

আবূ উমামা (রাঃ) হতে বর্ণিত, আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, নিশ্চয় বামের ফিরিশতা পাপী বা অপরাধী মুসলিমের উপর থেকে ছয় ঘন্টা কলম তুলে রাখেন। অতঃপর সে যদি পাপে অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থী হয়, তাহলে তা উপেক্ষা করেন। নচেৎ একটি পাপ লেখা হয়।

— ত্বাবারানীর কাবীর ৭৬৬৭, বাইহাক্বীর শুআবুল ঈমান ৭০৫১, সহীহুল জামে’ হা/ ২০৯৭, সিঃ সহীহাহ ১২০৯

ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ সম্পাদনা

যেহেতু তওবা বা অনুশোচনা ইসলামী শরীয়ত সম্পর্কিত একটি বিষয়, এটা সেই দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করা যায়।

তওবা শুধু আল্লাহর নিকট সম্পাদনা

ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষ ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। যেকোনো মানুষই ভুল করতে পারে; শুধুমাত্র আল্লাহই ভুলের ঊর্ধ্বে। তাই মানুষকে ক্ষমা করার এখতিয়ার শুধুমাত্র আল্লাহই রয়েছে। ইসলামে মানুষের অন্যের অনুশোচনা শোনার ও তার ক্ষমা ঘোষণা দেয়ার বিষয়টি নিষিদ্ধ। অনুরুপ, আল্লাহ ব্যতীত অন্য করো নিকট তওবা চাওয়া নিষিদ্ধ। কোরআনে আল্লাহ বলেন:

আল্লাহকে বাদ দিয়ে তোমরা যাদেরকে ডাক, তারা তোমাদের মতই বান্দা

—সূরা আরাফ (০৭), আয়াত ১৯৪।[১৪]

তওবার শর্ত সম্পাদনা

ইসলামী শরীয়ত মতে, বান্দা তওবা করলে আল্লাহ তা গ্রহণ করেন। অবশ্য সেটা হতে হবে আন্তরিক। আলেমগণ এ বিষয়ে একমত যে যদি কোনো ব্যক্তি তার কৃত পাপের জন্য অনুতপ্ত না হয় বা তা পরিত্যাগের ইচ্ছা না করে, তহলে তার মৌখিক তওবা উপহাস ছাড়া আর কিছু নয়। মৌখিক তওবা প্রকৃত তওবা নয়। আন্তরিক তওবার কিছু শর্ত রয়েছে। হযরত আলী (রা.) কে তওবা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন তওবা হল ছয়টি বিষয়ের সমষ্টি:

  1. নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হওয়া
  2. অনাদায়ী ফরয/ওয়াজিব ইবাদতসমূহ আদায় করা
  3. অন্যের সম্পত্তি/অধিকার নষ্ট করে থাকলে তা ফেরত দেয়া
  4. শারীরিক বা মৌখিকভাবে কাউকে কষ্ট দিয়ে থাকলে ক্ষমা চওয়া
  5. ভবিষ্যতে পাপকাজ পরিত্যাগের দৃঢ় সংকল্প করা
  6. আল্লাহর আনুগত্যে নিজেকে সমর্পণ করা[২]

সূরা আত-তওবা-৯,।মোট আয়াত=১২৯

তওবা এবং আল্লাহর রহমত সম্পাদনা

ইসলামী শরীয়ত মতে আন্তরিক তওবা আল্লাহ গ্রহণ করে থাকেন। আল্লাহ বলেন:

নিশ্চই তিনি মহাক্ষমাশীল, অতীব দয়ালু —সূরা বাকারা (০২), আয়াত ৩৭।[১৫]

কোরআন শরীফের বিভিন্ন আয়াতে আল্লাহ নিজেকে দয়ালু, মহানুভব ও ক্ষমাশীল হিসেবে বর্ণনা করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, সূরা হাশরের ২২ নং আয়াতে তিনি বলেন "তিনি আল্লাহ, তিনি ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য নেই; তিনি দৃশ্য ও অদৃশ্যকে জানেন। তিনি পরম দয়ালু, অসীম দাতা"। প্রত্যেক সূরার শুরুতে "পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু আল্লাহ্‌র নামে শুরু করছ" আয়াতটির ব্যবহার এই সত্যকে আরো জোড়ালো করেছে। কোরআন এবং হাদীসের বর্ণনা মতে আল্লাহতা’লার সর্বব্যাপী রহমতে যেকোন বড় গুনাহও (কবিরা গুনাহ) মাফ হতে পারে, শর্ত থাকে যে গুনাহগার ব্যক্তি আন্তরিক তওবা করেছে। আল্লাহ বলেন:

নিশ্চই আল্লাহ তার সাথে শিরক করার আপরাধ ক্ষমা করবেন না; এটা ছাড়া যাকে ইচ্ছা তিনি ক্ষমা করেন —সূরা নিসা (০৪), আয়াত ৪৮।[১৬]

সুতরাং, ইসলামে আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া নিষিদ্ধ (হারাম)। আল্লাহ বলেন:

বলুন: হে আমার বান্দাগণ যারা নিজেদের উপর জুলুম করেছ, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চই আল্লাহ সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করেন; তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু —সূরা যুমার (৩৯), আয়াত ৫৩।[১৭]

মানুষের কর্তব্য সম্পাদনা

ইসলামী শরীয়তে তওবা একটি পারস্পরিক বিষয়: একজন ব্যক্তিকে উচিত তার ভুল বুঝতে পারা ও তা পরিত্যাগ করা যার ওপর আল্লাহ ক্ষমার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ইসলাম প্রত্যাশা করে মানুষ যেন তার ভুলসমূহ বুঝতে পারে এবং আল্লাহর নিকট ক্ষমা চায়। ইসলামএ ক্ষমা আপনাআপনি হয় না বরং তা অর্জনের বিষয়। নিজের পাপ এর প্রতি উদাসীন থাকাকে ক্ষতিকর মনে করা হয়। মহানবী (স.) বলেন: "একজন ঈমানদার ব্যক্তির নিকট তার পাপ হল একটি পাহাড়ের মত যার নিচে সে বসে রয়েছে এবং সে আশঙ্কা করে যে সেটি তার উপর পতিত হতে পারে। অন্যদিকে একজন দুষ্টু ব্যক্তি তার পাপকে উড়ন্ত মাছির মত মনে করে এবং সেটা অবজ্ঞা করে" - সহীহ বুখারী ৮:৭৫:৩২০।[১৮] হাদীসে মহানবী (স.) মানুষকে আল্লাহর নিকট ক্ষমা চওয়ার তাগিদ দিয়েছেন।
ইসলামী শরীয়তে তওবা দ্বারা সে সকল পাপ মাফ হয় যা ব্যক্তির হক সম্পর্কিত নয়। ব্যক্তির হক সম্পর্কিত পাপ যেমন কারো উপর যুলুম, অর্থ আত্মসাত, মিথ্যা অপবাদ দেয়া ইত্যাদির ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নিকট ক্ষমা চওয়া জরুরী। মৃত্যু-কষ্ট শুরু হওয়া এবং আযাবের ফেরেশতা দর্শনের পর তওবা কবুল হয়না।[১৯]

আরও দেখুন সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. মওলানা মুহাম্মদ শামসুল হক। আল মুরাদিফ: আরবি সমার্থক শব্দকোষ। ঢাকা: ইসলামীয়া কুতুবখানা। পৃষ্ঠা ৫৮। 
  2. Mufti Muhammad Shafi (২০০৪)। Ma'ariful Quran। Translated by Maulana Ahmed Khalil Aziz & Muhammad Taqi Usmani. Vol. 8; p.525। 
  3. D. Beaulieu, Peter (২০১২)। Beyond Secularism and Jihad?: A Triangular Inquiry Into the Mosque, the Manger, and Modernity। University Press of America। পৃষ্ঠা 88। আইএসবিএন 9780761858379 
  4. কুরআন ২৪:৩১
  5. কুরআন ২৫:৭১
  6. কুরআন ৬৬:৮
  7. কুরআন ২৪:৩১ (অনুবাদ করেছেন ইউসুফ আলী)
  8. কুরআন ৬৬:০৮ (অনুবাদ করেছেন ইউসুফ আলী)
  9. কুরআন ০২:২২২
  10. কুরআন ০৪:১৭,কুরআন ০৪:১৮
  11. কুরআন ২৫:৬৯-৭১ (অনুবাদ করেছেন ইউসুফ আলী)
  12. কুরআন ১১:১১৪ (অনুবাদ করেছেন ইউসুফ আলী)
  13. আল-মুনাজ্জিদ, মুহাম্মাদ সালেহ। আমি তাওবা করতে চাই কিন্ত! - বাংলা - মুহাম্মাদ সালেহ আল-মুনাজ্জিদ (পিডিএফ)। পৃষ্ঠা ৩২, ৩৩। সংগ্রহের তারিখ ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২২ 
  14. কুরআন ৭:১৯৪
  15. কুরআন ২:৩৭
  16. কুরআন ৪:৪৮ (অনুবাদ করেছেন ইউসুফ আলী)
  17. কুরআন ৩৯:৫৩
  18. সহীহ বুখারী, ৮:৭৫:৩২০ (ইংরেজি),
  19. মওলানা মুহিউদ্দীন খান (২০০০), নুরুল ঈমান । ঢাকা: মদীনা পাবলিকেশনস্। পৃ: ২৩৮।

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা