ট্রাইলোবাইট

আর্থোপ্রোডা এর শ্রেণি(জীবাশ্ম)

ট্রাইলোবাইট (ইংরেজি - Trilobite; জার্মান - Trilobiten; প্রাচীন গ্রিক τρία tria, অর্থাৎ 'তিন' এবং λοβός lobós, অর্থাৎ 'ফোলা অংশ') হল অধুনা বিলুপ্ত একটি সামুদ্রিক সন্ধিপদ পর্বের অমেরুদণ্ডী প্রাণী। পৃথিবীতে এদের অস্তিত্ব বজায় ছিল সুদীর্ঘ প্রায় ২৭ কোটি বছর। প্যালিওজোয়িক মহাযুগের (৫৪.১ কোটি বছর - ২৫.২২ কোটি বছর আগে পর্যন্ত সময়কাল) প্রায় সূচনাপর্বে ক্যাম্ব্রীয় যুগের দ্বিতীয় সিরিজের তৃতীয় পর্যায়, অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ৫২.১ কোটি বছর আগে থেকে এদের অস্তিত্বের জীবাশ্মঘটিত প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে।[২] কিন্তু ততদিনে তারা ইতিমধ্যেই বহু প্রজাতিতে বিভক্ত হয়ে পড়েছে ও পৃথিবীর বহু অংশেই ব্যাপক হারে ছড়িয়েও পড়েছে। এর থেকে বিজ্ঞানীরা সহজেই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পেরেছেন যে বিবর্তনের পথে তাদের উদ্ভব নিশ্চয়ই আরও কিছুকাল আগের ঘটনা। সেই সময় থেকে ২৫.১ কোটি বছর আগে পার্মিয়ান যুগের একেবারে শেষের দিকে বিলুপ্তির[৩] (পার্মিয়ান-ট্রায়াসিক বিলুপ্তি ঘটনা) আগে পর্যন্ত সমগ্র প্যালিওজোয়িক মহাযুগ জুড়েই এরা ছিল অন্যতম প্রধান সামুদ্রিক প্রাণী।[৪] ক্যালসিয়াম কার্বোনেটে তৈরি শক্ত বহির্কঙ্কালের কারণে এদের দেহের পক্ষে জীবাশ্মে পরিণত হওয়া ছিল অপেক্ষাকৃত সহজ। সেইকারণেই এদের জীবাশ্ম বহুল পরিমাণে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। তার উপর নির্ভর করে এদের প্রায় ১৭,০০০ প্রজাতিকে চিহ্নিত করা গেছে ও তাদের অঙ্গসংস্থানক্রমবিবর্তনকেও অনেকাংশেই বোঝা সম্ভব হয়েছে। বিভিন্ন স্তর থেকে পাওয়া এদের অপেক্ষাকৃত ভালো অবস্থার জীবাশ্মের প্রাচূর্যের কারণে সমগ্র প্যালিওজোয়িক মহাযুগ ও বিশেষত ক্যাম্ব্রীয় যুগের ক্ষেত্রে বর্তমানে এদের জীবাশ্মকে ইনডেক্স ফসিল হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।

ট্রাইলোবাইট
সময়গত পরিসীমা: ৫২.১–২৫.২কোটি ক্যাম্ব্রীয় যুগের সূচনাকাল – পার্মিয়ান যুগের শেষভাগ
মধ্য ডেভোনিয়ান যুগের ফাকপস রানা প্রজাতির ট্রাইলোবাইটের এই জীবাশ্মটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওহিওয় পাওয়া গিয়েছে।
মরক্কোয় প্রাপ্ত প্যারাডক্সাইড প্রজাতির একটি ট্রাইলোবাইটের জীবাশ্ম; মধ্য ক্যাম্বীয় যুগের।
বৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাস e
(শ্রেণিবিহীন): ফাইলোজোয়া
জগৎ/রাজ্য: অ্যানিম্যালিয়া (Animalia)
ইয়োহান এরনস্ট ইমানুয়েল ভালখ, ১৭৭১[১]
Orders

এদের বিভিন্ন প্রজাতির জীবনধারণ পদ্ধতির মধ্যে পার্থক্য থাকলেও এরা সকলেই ছিল সামুদ্রিক প্রাণী। এদের কেউ কেউ সমুদ্রের তলদেশে চলাফেরা করে বেড়াত। তারা কেউ বা ছিল শিকারী, আবার কেউ কেউ অন্য মৃত প্রাণী ও উদ্ভিদ খেয়ে জীবনধারণ করত। আবার কেউ কেউ ঝিল্লি জাতীয় অঙ্গের সাহায্যে জল ছেঁকে খাবার সংগ্রহ করত। এদের অন্য কিছু প্রজাতি আবার জলের উপরিতলে ভেসে বেড়াত ও প্ল্যাঙ্কটন জাতীয় খাদ্যগ্রহণ করত।[৪] সত্যি বলতে আজকের সন্ধিপদ প্রাণীদের স্বাভাবিক জীবন পদ্ধতির প্রায় সব কিছুই ট্রাইলোবাইটদের মধ্যেও চোখে পড়ত। তবে তাদের মধ্যে কোনও পরভোজী প্রজাতি ছিল বলে এখনও পর্যন্ত তেমন কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি, যদিও বিষয়টি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে বিতর্ক আছে।[২]

ট্রাইলোবাইটরা ছিল অমেরুদণ্ডী সন্ধিপদী প্রাণী। এদের একটি শক্ত বহির্কঙ্কাল থাকত। দেহ ছিল সুষম ও কয়েকটি সুস্পষ্ট অংশ নিয়ে গঠিত। এদের অনেকগুলি করে সন্ধিল পদ থাকত, যার সাহায্যে তারা সহজেই যেকোনও দিকে যেতে পারত। এদের যে সমস্ত জীবাশ্ম পাওয়া গেছে তার উপর ভিত্তি করে এদের ৯টি বর্গ, ১৫০টি পরিবার, ৫০০০'এরও বেশি গণ ও ১৭০০০'এর মতো প্রজাতিকে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে, যাদের মধ্যে ১৫০০০ প্রজাতির পূর্ণ বিবরণ দেওয়াও সম্ভব হয়েছে। এখনও প্রতিবছর এদের নতুন নতুন প্রজাতি আবিষ্কৃত হয়ে চলেছে। এত প্রজাতি খুঁজে পাওয়ার ফলে বিলুপ্ত প্রাণীজগতের মধ্যে ট্রাইলোবাইটকেই সবচেয়ে বেশি বৈচিত্রপূর্ণ বলে বর্তমানে মনে করা হয়। প্রায় ৭০ সেন্টিমিটার লম্বা আইসোলেটাস রেক্স হল এখনও পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া সবচেয়ে বড় প্রজাতির ট্রাইলোবাইট। উত্তর আমেরিকার হাডসন উপসাগরে এদের জীবাশ্ম খুঁজে পাওয়া গেছে।[৫]

নামকরণ সম্পাদনা

১৭৭১ খ্রিষ্টাব্দে এদের নাম হিসেবে ট্রিলোবিট শব্দটি জার্মান ভাষায় প্রথম ব্যবহার করেন প্রখ্যাত জার্মান ভাষাতত্ত্ববিদ ও ভূতত্ত্ববিদ ইয়োহান এরনস্ট ইমানুয়েল ভালখ[৬] ঊনবিংশ শতাব্দীর সূচনাপর্ব থেকে বিজ্ঞানীমহলে এদের পরিচয় হিসেবে এই নামটিই সাধারণভাবে গৃহীত হয়।[৭]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Robert Kihm; James St. John (২০০৭)। "Walch's trilobite research – A translation of his 1771 trilobite chapter"। Donald G. Mikulic; Ed Landing; Joanne Kluessendorf। Fabulous fossils – 300 years of worldwide research on trilobites (পিডিএফ)New York State Museum Bulletin507। University of the State of New York। পৃষ্ঠা 115–140। ২০১৪-০৭-১৪ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। 
  2. Fortey, Richard (2000), Trilobite!: Eyewitness to Evolution, London: HarperCollins, ISBN 0-00-257012-2
  3. Clarkson, E. N. K. (1998), Invertebrate Paleontology and Evolution (4th ed.), Oxford: Wiley/Blackwell Science, p. 452, ISBN 0-632-05238-4
  4. চট্টোপাধ্যায়, দেবীপ্রসাদ ও রমাকৃষ্ণ মৈত্র. পৃথিবীর ইতিহাস, কলকাতা, অনুষ্টুপ, ২০১০। আইএসবিএন 978-93-82425-45-8. পৃঃ- ৭১ - ৪।
  5. The World's Biggest Trilobite ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২১ জানুয়ারি ২০১৮ তারিখে সংগৃহীত ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৭।
  6. Johann Ernst Immanuel Walch: Die Naturgeschichte der Versteinerungen. Zur Erläuterung der Knorrischen Sammlung von Merkwürdigkeiten der Natur. (জার্মান) Theil 3. Felßecker, Nürnberg 1771.
  7. Robert Kihm, James St.John: "Walchs trilobite research". In: Donald G. Mikulic, Ed Landing, Joanne Kluessendorf (Hrsg.): Fabulous Fossils. 300 years of worldwide research on trilobites (= New York State Museum. Bulletin. 507). University of the State of New York – State Education Department, Albany NY 2007, ISBN 1-55557-235-9, S. 115–140.