জিহাদ

ইসলাম ধর্মের একটি ইবাদত

জিহাদ (আরবি: جهاد‎), যার অর্থ সংগ্রাম; কোনো নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য লাভের জন্য সমগ্র শক্তি নিয়োগ করাকে বোঝানো হয়। এর আভিধানিক অর্থ পরিশ্রম,সাধনা,কষ্ট, চেষ্টা ইত্যাদি। তবে সচরাচর ইসলামী পারিভাষিক অর্থে 'জিহাদ' কথাটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কুরআনে জিহাদের কথা ৪১ বার উল্লেখ করা হয়েছে যেখানে "আল্লাহের পথে সংগ্রাম করা" অর্থে 'জিহাদ' কথাটি ব্যবহৃত হয়েছে।[১][২] জিহাদের সাথে জড়িত ব্যক্তিকে মুজাহিদ বলা হয়। জিহাদকে মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হিসাবে গণ্য করা হয়।

প্রাচ্য বিশেষজ্ঞ বার্নার্ড লুইসের মতে কুরআন ও হাদীসের অধিকাংশ জায়গাতেই জিহাদ শব্দটি ধর্মযুদ্ধ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।[৩] তবে সহীহ মুসলিমের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ইসলামী পণ্ডিত ইয়াহিয়া ইবন শরাফ আল-নাদভী বলেছেন, (জিহাদ অর্থ) "সমাজের সবার সামগ্রিক দায়িত্ব হলো ন্যায্য প্রতিবাদে অংশ নেয়া, ধর্মের সমস্যা দূর করা, স্রষ্টার আইনের কথা জানা, ন্যায়কে প্রতিষ্ঠা করা ও অন্যায়কে দূর করা।".[৪] কুরআন ও হাদীসের ব্যাখ্যা অনুযায়ী স্থানভেদে জিহাদ তিন রূপ হতে পারেঃ (ক) পাপ থেকে বেঁচে থাকার জন্য স্বীয় কৃপ্রবৃত্তির বিরূদ্ধে জিহাদ, (খ) মুসলিম সমাজকে উন্নয়নের সংগ্রাম, এবং (গ) যুদ্ধক্ষেত্রে সংগ্রাম। [৫]

ইসলাম ধর্মে জিহাদ সম্পাদনা

মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আল কুরআনে জিহাদকে মুসলমানদের জন্য একটি 'কর্তব্য' বলে উল্লেখ করা হয়েছে; সেখানে 'হারব' বা 'যুদ্ধ' শব্দ ব্যবহার না করে 'জিহাদ' শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। ইসলাম ধর্মে জিহাদ শব্দটি ব্যাপক অর্থ বহন করে। সংক্ষেপে বলা যায়, "সমগ্র মানবজাতির সমাজ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন সাধন করে ইসলামের নিজস্ব মতাদর্শ অনুসারে নতুন করে ঢেলে সাজানোর লক্ষ্যে চেষ্টা, সংগ্রাম ও চূড়ান্ত শক্তি প্রয়োগের নামই হলো জিহাদ"। বিশেষ কোনো জাতির হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে অন্য কোনো বিশেষ জাতির হাতে তুলে দেয়া ইসলামের লক্ষ্য নয়। বরং এর লক্ষ্য এই যে, (ইসলামের ভাষ্যমতে,) সমগ্র মানবজাতির কল্যাণ সাধনের লক্ষ্যে ইসলামের পরিপূর্ণ আদর্শ দ্বারা সারা বিশ্বকে ঐশ্বর্যমন্ডিত করে তোলা। এ উদ্দেশ্যে বিপ্লব সৃষ্টির জন্য ইসলাম তার অনুসারীদেরকে চেষ্টা ও সংগ্রাম চালিয়ে যেতে বলে। এই ব্যাপক চেষ্টা, সংগ্রাম ও শক্তি প্রয়োগের সমষ্টিগত নামই হচ্ছে ‘জিহাদ’। মুখের ভাষা ও লেখনির সাহায্যে মানুষের মানসিকতা, চিন্তাধারা ও দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন সাধন করা এবং তাদের মধ্যে ‘অন্তর্বিপ্লব’ সৃষ্টি করা জিহাদের একটি দিক। আবার তরবারি (সমরশক্তি) ব্যবহার করে 'অনৈসলামিক সমাজ ব্যবস্থা' নির্মূল করে নতুন 'সুবিচারমূলক ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা' প্রতিষ্ঠা করাও জিহাদের একটি দিক। এপথে মেধা, অর্থ-সম্পদ, শারীরিক শক্তি সামর্থ্য নিয়োগ করাও জিহাদ। এখানে উল্লেখ্য যে, ইসলাম মনে করে, "মানবজাতির জন্য ইসলামী আদর্শই একমাত্র সঠিক ও উপযুক্ত জীবন-দর্শন"। [৬] দ্বাদশবাদী শিয়া মতাদর্শে জিহাদ, ধর্মের ১০টি রীতির একটি।

জিহাদ শব্দের আভিধানিক ব্যবহার সম্পাদনা

আভিধানিক অর্থে জিহাদ হলো পরিশ্রম,সাধনা,কষ্ট, চেষ্টা ইত্যাদি। আক্ষরিক ভাবে জিহাদ শব্দটির অর্থ হলো কোনো বিষয়ে সংগ্রাম করা। এই সংগ্রাম সশস্ত্র বা অহিংস, ধর্মীয় বা ধর্মনিরপেক্ষ, সব রকমেরই হতে পারে। যেমন, মহাত্মা গান্ধীর সত্যাগ্রহ আন্দোলনকে আরবি ভাষায় জিহাদ বলেই অভিহিত করা হয়। একইভাবে নারীমুক্তির আন্দোলনকেও আরবি ভাষার বিভিন্ন প্রকাশনায় জিহাদ বলা হয়।[৭]

আরবের বাইরে জিহাদ শব্দটি বর্তমানে সশস্ত্র ও নিরস্ত্র সংগ্রাম - দুই রকমেরই অর্থে বর্তমানে ব্যবহৃত হয়। এটি ন্যায়নিষ্ঠ জীবনযাপন করে ইসলাম ধর্ম পালন এবং অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম বোঝায়।[৮] জিহাদের দুই রকমের অর্থ্য করা একটি বিতর্কিত বিষয়। গ্যালাপ পরিচালিত একটি জরিপে দেখা গেছে, ইন্দোনেশিয়ার অধিকাংশ ব্যক্তি এই শব্দটির অর্থত "ইসলামের ও ন্যায়ের জন্য জীবন বিসর্জন করা", অথবা "ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা" বলে মনে করেন। লেবানন, কুয়েত, জর্ডান ও মরক্কোতে অধিকাংশ ব্যক্তি এই শব্দটি দিয়ে স্রষ্টার প্রতি কর্তব্য, বা উপাসনা বোঝেন, এবং শব্দটির সাথে কোনোরকম সশস্ত্র সংগ্রামকে জড়ান না। অন্যান্য দেশের লোকদের মতে পাওয়া গেছে,:

  • "কঠিন পরিশ্রম করা" ও "জীবনের লক্ষ্যে পৌছানোর জন্য কাজ করা"
  • "ন্যায়ের জন্য সংগ্রাম করা"
  • "শান্তি, সমৃদ্ধি ইত্যাদির জন্য কাজ করা"
  • "ইসলামের নীতি মেনে চলা"[৯]

ভুল অর্থে প্রয়োগ ও বিভ্রান্তি সম্পাদনা

মুহাম্মদ - এ বায়োগ্রাফি অফ দ্য প্রফেট বইতে বি এ রবিনসন লিখেছেন: :"Fighting and warfare might sometimes be necessary, but it was only a minor part of the whole jihad or struggle."[১০] 'যুদ্ধ' এবং 'জিহাদ' সমার্থক নয়। 'যুদ্ধ' (হারব, কিতাল, war) জিহাদের একটি অংশ মাত্র।[১১] অনেকেই 'পবিত্র যুদ্ধ' বা 'ধর্মযুদ্ধ' বা 'holy war' শব্দসমষ্টিকে জিহাদের অর্থ বলে প্রচার করে থাকেন, যা সঠিক নয়। কুরআন বা হাদিসে কোথাও 'পবিত্র যুদ্ধ' বা 'ধর্মযুদ্ধ' বা 'holy war' শব্দসমষ্টি (হারবে মুক্বাদ্দাসা) ব্যবহৃত হয় নি। [১২] আরবি ভাষায় 'হারব' শব্দটি 'যুদ্ধ' বা 'war' শব্দের সমার্থক। এই ভুল অর্থে ব্যাপক প্রয়োগের কারণে সারা বিশ্বে জিহাদ শব্দটি 'সন্ত্রাস' বা 'ইসলামী সন্ত্রাস' শব্দের সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে।[১৩]

জিহাদের বিভিন্ন পর্যায় ও দিক সম্পাদনা

জিহাদ বিষয়ক গবেষক ও চিন্তাবিদ সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Wendy Doniger, সম্পাদক (১৯৯৯)। Merriam-Webster's Encyclopedia of World ReligionsMerriam-Websterআইএসবিএন ০-৮৭৭৭৯-০৪৪-২ , Jihad, p.571
  2. Josef W. Meri, সম্পাদক (২০০৫)। Medieval Islamic Civilization: An EncyclopediaRoutledgeআইএসবিএন ০-৪১৫-৯৬৬৯০-৬ , Jihad, p.419
  3. Bernard Lewis, The Political Language of Islam (University of Chicago Press, 1988), p. 72. Cf. William M. Watt, Islamic Conceptions of the Holy War in: Thomas P. Murphy, The Holy War (Ohio State University Press, 1974), p. 143
  4. Shaykh Hisham Kabbani। "Jihad—A Misunderstood Concept from Islam"। The Muslim Magazine। ১৭ জুলাই ২০০৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৬ আগস্ট ২০০৬  অজানা প্যারামিটার |coauthors= উপেক্ষা করা হয়েছে (|author= ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে) (সাহায্য)
  5. "Jihad"। BBC। ২০০৯-০৮-০৩। 
  6. John Esposito(2005), Islam: The Straight Path, pp.93
  7. Al-Batal, Mahmoud (২০০৬)। "6-"من رائدات الحركة النسائية العربية" (One of the Pioneers of the Arabic Feminist Movement)"। Al-Kitaab fii Tacllum al-cArabiyya, Part II (Arabic and English ভাষায়) (2 সংস্করণ)। Washington, DC: Georgetown University Pressআইএসবিএন 978-1-58901-096-3To struggle or exert oneself for a cause........جاهََدَ، يجاهِد، الجهاد  অজানা প্যারামিটার |coauthors= উপেক্ষা করা হয়েছে (|author= ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে) (সাহায্য)
  8. Esposito (2002a), p.26
  9. John L. Esposito, Dalia Mogahed, Who Speaks for Islam? What a Billion Muslims Really Think (Gallup, 2007) p. 20 f.
  10. B.A. Robinson (২০০৩-০৩-২৮)। "The Concept of Jihad "Struggle" in Islam"। Ontario Consultants on Religious Tolerance। সেপ্টেম্বর ৩০, ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ আগস্ট ১৬, ২০০৬ 
  11. "The meaning of Jihad"। ২৬ ডিসেম্বর ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৫ ডিসেম্বর ২০১২ 
  12. "The True Meaning of Jihad" 
  13. M. Amir Ali, Ph.D.। "Islam, Jihad, and Terrorism in Islam"। সংগ্রহের তারিখ ডিসেম্বর ২৫, ২০১২