জয়মতী (ইংরেজি: Joymoti Konwari) ছিলেন আহোম তুংখুঙীয়া ফৈদের রাজপুত্র গদাপানির পত্নী। স্বামি ও দেশের হিতে জীবন উৎসর্গ করার জন্য তিনি অসমের ইতিহাসে বিশেষ মর্যদা লাভ করেছেন। এক বিশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতর কবলে পরে গদাপানি গোপন অবস্থায় লুকিয়ে ছিলেন। জয়মতী স্বামীর ঠিকানা প্রকাশ না করার জন্য দীর্ঘদিন চাউদাঙের শাস্তি পেয়ে মৃত্যুবরণ করেন। জয়মতীর পুত্র রুদ্র সিংহ পরবর্ত্তি সময়ে মায়ের শাস্তি পেয়ে মৃত্যুবরণ করা স্থানে জয়সাগর নামক পুকুর খনন করায় ও জয়দৌল নির্মাণ করেন।[১] এই বেদনাদায়ক কাহিনীকে কেন্দ্র করে জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালা ১৯৩৫ সনে প্রথম অসমীয়া চলচ্চিত্র জয়মতী নির্মাণ করেন।[১] ২০০৬ সনে মঞ্জু বরুয়ার পরিচালনায় জয়মতী নামক আরেকটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। কিছুসংখ্যক ইতিহাসবিদ জয়মতীর অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।

জয়মতী
জন্ম
মেচাগড় মাদুরী গাঁও, শিবসাগর জেলা
মৃত্যু
জেরেঙা পথার, শিবসাগর জেলা
দাম্পত্য সঙ্গীগদাপাণি
সন্তানলাই, লেচাই
পিতা-মাতালাইথেপেনা বরগোহাঞি এবং চন্দ্রদারু

বংশ এবং পরিবার সম্পাদনা

ইতিহাসবিদের মতে জয়মতীর পিতা ছিলেন আহোম রাজ্যের বিষয়ববীয়া লাইথেপেনা বরগোহাঞি ও মাতা চন্দ্রদারু। লাইথেপেনার পিতা ছিলেন লালুকসেন ও চন্দ্রদারুর পিতা ছিলেন লেচাই বরগোহাই। শিবসাগর থেকে ৯কিঃমিঃ দূরত্বে মেচাগর মাদুরি নামক গ্রামে জয়মতীর জন্ম হয়েছিল। ডঃ সুর্যকুমার ভূঞার অসম বুরঞ্জি নামক পুস্তকে উল্লেখিত একটি গানের মাধ্যমে জানা যায় যে লাইথেপেনার ১২জন পত্নী, ২৪ জন পুত্র ও জয়মতী সহ ১৩টি কন্যা ছিল। চুকাফা অসমে আহোম সাম্রাজ্য স্থাপন করার সময় থেকে লাইথেপেনার পূর্বপুরুষেরা বিষয়ববীয়া ও মন্ত্রীর পদে নিযুক্ত ছিলেন।

বিবাহ সম্পাদনা

একদা গোবর রাজার পুত্র গদাপানি মাদুরি গ্রামে লাইথেপেনার গৃহে উপস্থিত হন। শক্তিশালী যুবক গদাপানির খাদ্যের পরিমাণ অধিক ছিল। ক্ষুদার্ত ও ক্লান্ত অবস্থায় তিনি লাইথেপেনাকে আহার দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। জয়মতী লাইথেপেনার জেষ্ঠ কন্যা ছিলেন। তাই অতিথি সেবা-যত্নের দ্বায়িত্ব জয়মতীর ছিল । তিনি পান্তা ভাত দিয়ে অতিথিকে সেবা করালেন। জয়মতীর অতিথি সেবায় গদাপানি সন্তুষ্ট হন ও জয়মতীর প্রতি আকৃষ্ট হন। অবশেষে পরিবারের সবার অনুমতি নিয়ে গদাপানি ও জয়মতী চকলং প্রথায় (আহোম বিবাহ প্রথা) বিবাহ করেন।

রাজনৈতিক অস্থিরতা সম্পাদনা

১৬৭০ সালে রাজা চক্রধ্বজ সিংহের মৃত্যুর পর ও ১৬৮২ সালে গদাপানির রাজাভিষেকের সময় রাজার পদে ৬জন রাজকুমার নির্বাচিত করা হয়। ডেবেরা বরবরুয়া ষড়যন্ত্র করে উদয়াদিত্য সিংহকে হত্যার করার পর রাজ্যে কুশাসনের সুত্রপাত হয়। প্রতিদ্বন্দ্ব্বিসকলকে হত্যা করা হয়, প্রভাবশালী যুবরাজদের অঙ্গক্ষত করা হয় কারণ আহোম সামাজ্র্যে ক্ষত ব্যক্তিদের রাজা হওয়ার অধিকার ছিলনা । ও বিষয়ববীয়াদের দুর অঞ্চলে স্থানান্তর করা হয়। রাজনৈতিক অস্থিরতা দুর করার জন্য কয়েকজন বিষয়া একত্রিত হয়ে রাজধানীতে প্রবেশ করে ডেবেরা বরবরুয়াকে হত্যা করে এবং বিষয়ার দ্বারা নির্বাচিত রাজকুমারকে রাজসিহাংসনে বসায়। প্রধানমন্ত্রী আতন বরগোহাই রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। তিনি ২বার রাজা হওয়ার প্রস্তাব পান কিন্তু তিনি প্রস্তাব অস্বিকার করেন। প্রধান মন্ত্রী আতন বরগোহাই ও গুয়াহাটি বিষয়া লালুকসোলা বরফুকনের মাঝে মতভেদ ও রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্ব্বিতা তুমুল হয়ে উঠে। লালুকসোলা বরফুকন রাজশক্তি অধিকার করার স্বার্থে বঙ্গের শাসক সুলতান আমজতবরের সাথে গুয়াহাটি মোগলের হাতে হস্তান্তর করার চক্রান্ত করেন। বিনিময়ে তাঁকে চার লক্ষ টাকা ও আহোমের স্বর্গদেউ(রাজা) হওয়ার প্রতিশ্রুতি করা হয়। সেইমতে তিনি ১৬৭৯ সনে গুয়াহাটি নগর নবাব মনসুর খানকে হস্তান্তর করেন। তারপর তিনি দলেবলে আহোম সাম্রাজ্যের রাজধানী গড়গাও আক্রমণ করেন ও আতন বরগোহাইকে হত্যা করেন। ১৪ বৎসরের চুলিকফাকে তিনি রাজা ঘোষণা করেন। তাঁর ৫ বছরের কন্যাকে চুলিকফার সহিত বিবাহ করিয়ে নিজে বুরাফুকন নামক নতুন পদের সৃষ্টি করেন ও দেশের শাসনভার নিজের হাতে ন্যাস্ত করেন। ক্ষত ব্যক্তিদের রাজা হওয়ার অধিকার না থাকার সুযোগ নিয়ে লালুকসোলা বরফুকন প্রতিদ্বন্দ্ব্বি সকল রাজকুমারদের হত্যা ও অঙ্গ ক্ষত করার পরিকল্পনায় লিপ্ত হয়।

গদাপানির আত্মগোপন সম্পাদনা

জয়মতীর মনে দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে লালুকসোলার সেচ্ছাচারী শাসনকে দমন করে গদাপানি রাজ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনবেন। তাই তিনি লালুকসোলার হাতে অঙ্গ ক্ষত হওয়ার পূর্বে গদাপানিকে আত্মোগোপন করার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। ইতিহাসের মতে গদাপানি আত্মোগোপন করার সময় তিনি তাঁর পত্নি জয়মতি ও দুই পুত্র লাই ও লেচাইকে রেখে গিয়েছিলেন। কিন্তু হরকান্ত বরুয়ার মতে গদাপানি পরিবার সহ অরন্যে ঘড় বানিয়ে পালিয়ে ছিলেন কিন্তু লালুকসোলার সৈন্য সেই স্থানে উপস্থিত হওয়ায় জয়মতী তাঁর স্বামী গদাপানিকে পালিয়ে জাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। আত্মগোপন অবস্থায় তিনি মেটেকার বগী বরপোহারীর গৃহে ছিলেন তারপর তিনি নাগা পাহাড়ে আশ্রয় নেন। গদাপানিকে ধরিতে না পেরে রাজার সৈন্যেরা তাঁর পত্নী জয়মতীকে বন্দি করেন। রাজদরবারে জয়মতীকে অনেকবার প্রশ্ন করার পরও তিনি গদাপানি কোথায় লুকিয়ে আছেন তা বলেন নাই। পত্নীকে উদ্ধার করার জন্য গদাপানি আসবে ভেবে লালুকসোলা জয়মতীর উপর অত্যাচার করা আরম্ভ করেন। জয়মতীকে জেরেঙা পথার নামক স্থানে কাটাগাছের সহিত বেধে নানা ধরনের শাস্তি দেওয়া হয় তথাপিও তিনি স্বামীর বিষয়ে বলতে অস্বিকার করেন। পত্নির শাস্তির কথা শুনতে পেয়ে গদাপানি নগা পাহাড় থেকে ছদ্মবেশে জেরেঙা পথারে আসেন। তিনি অপরিচিত লোকের বেশে জয়মতীকে শাস্তি ভোগ না করে রাজাকে স্বামীর আত্মগোপনের ঠিকানা বলে দেওয়ার জন্য বলেন । কিন্তু জয়মতী ছদ্মবেশি স্বামীকে চিনে ফেলেন ও তাঁকে পালিয়ে থাকার জন্য অনুরোধ করেন। ১৪ দিনের নির্যাতন সহ্য করে ১৬৭৯ সনের ২৭ মে তারিখে জয়মতীর মৃত্যু হয়। দুতিরাম হাজরিকার অসম পদ্য বুরঞ্জী নামক পুস্তকে উল্লেখ করা মতে জয়মতীর লাই ও লেচাই নামক পুত্র ও আরেকটি কন্যা সন্তানও ছিল। চাওদাঙ কন্যা ও জয়মতীকে হত্যা করেছিলেন। অপরদিকে সুর্যকুমার ভূঞার মতে মৃত্যুর সময় জয়মতী গর্ভবতী ছিলেন।

গদাধর সিংহ ও রুদ্র সিংহের শাসন সম্পাদনা

জয়মতীর মৃত্যুর দুই বছর পর ১৬৮১ সেচ্ছাচারী লালুকসোলার শাশনকে দমন করে গদাপানি আহোম সাম্রাজ্যের রাজা হয়। তিনি টাই নাম চুপাত্‌ফা ও অসমীয়া রুদ্রসিংহ নাম গ্রহণ করেন। ১৬৮১ সন থেকে ১৬৯৬ সন পর্যন্ত তাঁর রাজত্বকালে অসমে শান্তি পুনরায় ঘুরে আসে। রাজসিংহাসনে বসে প্রথমে তিনি গুয়াহাটি থেকে মনসুর খানকে দূর করার জন্য সৈন্য পাঠায়। ১৬৮২ সনে ইটাখুলির রনে আহোমেরা মোগলদের পরাজয় করে ফলে গুয়াহাটি পুনরায় আহোমের অধীনে আসে। ১৬৯৬ সালে গদাধর সিংহের পুত্র লাই রাজসিংহাসনে বসেন। সিংহাসনে বসে তিনি চুখ্রুংফা ও রুদ্র সিংহ নাম গ্রহণ করেন। তাঁকে আহোম সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ রাজা হিসেবে অভিহিত করা হয়। মার স্মৃতিকল্পে তিনি জেরেঙা পাথারে জয়সাগর নামক পুকুর খনন করায় ও জয়দৌল নির্মাণ করেন। ১৭০৪-০৫ সালে রাজা রুদ্রসিংহ জয়সাগর পুকুরের পারে স্থিত শিব মন্দিরের সম্মুখে ফাকুয়া দৌল নির্মাণ করেন।

সম্মান সম্পাদনা

জয়মতীর এই মহান ত্যাগ করে স্মরণ করে অসমে প্রতিবছর ১৩ চৈত্র (ইংরেজি-২৭ মার্চ) সতী জয়মতী দিবস পালন করা হয়।[২] ২০১৩ সন থেকে অসম সরকার জয়মতী বটা নামক একটি বিশেষ পুরস্কার প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা