জওহার রাজ্য

ভারতের রাজ্য

জওহার রাজ্য[১] ছিলো ব্রিটিশ শাসিত ভারতে অবস্থিত একটি ৯ তোপ সেলামী সম্মানপ্রাপ্ত দেশীয় রাজ্য, যা বর্তমানে ভারতের অন্তর্গত৷ ব্রিটিশ ভারতে এটি বোম্বে প্রেসিডেন্সির রাজ্যগুলির মধ্যে একটি ছিলো।[২] থানা (থানে) এজেন্সির একমাত্র রাজ্য ছিলো এটি৷ রাজ্যটি শেষ মহাদেব কোলী শাসক ছিলেন মহারাজ পঞ্চম পতঙ্গ শাহ, তিনি লেফটেন্যান্ট হিসাবে যশবন্তরাও মার্তণ্ডরাও মুকনে নামেও পরিচিত ছিলেন৷[৩][৪]

জওহার রাজ্য
जव्हार
ব্রিটিশ ভারত দেশীয় রাজ্য
১৩৪৩–১৯৪৭
Jawhar পতাকা
পতাকা
Jawhar প্রতীক
প্রতীক

ব্রিটিশ ভারতের থানা এজেন্সির অন্তর্গত জওহার রাজ্য
রাজধানীজওহার
আয়তন 
• ১৯০১
৮০৪.৪৫ বর্গকিলোমিটার (৩১০.৬০ বর্গমাইল)
জনসংখ্যা 
• ১৯০১
৪৭,৫৩৮
সরকার
 • ধরনপূর্ণ রাজতন্ত্র
 • নীতিবাক্যজয় মলহার ও হর হর মহাদেব
ঐতিহাসিক যুগখ্রিস্টীয় ঊনবিংশ শতাব্দী
• প্রতিষ্ঠিত
১৩৪৩
১৯৪৭
উত্তরসূরী
ভারত
বর্তমানে যার অংশমহারাষ্ট্র,  ভারত
১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে জওহার রাজ্যের মানচিত্র
ইম্পেরিয়াল গেজেটিয়ার অব ইন্ডিয়া থেকে প্রাপ্ত জওহার রাজ্যের মানচিত্র

রাজ্যটির প্রতীকে ছিলো একটি ঢাল দুটি ঈশান-বায়ু, অগ্নি-নৈঋত কোণে আনত একজোড়া তীর এবং অনুভূমিক ভাবে থাকা একটি ধনুক, মাঝের একটি হাত এই তীর ধনুকগুলিকে ধরে রয়েছে, উত্তর-দক্ষিণে দক্ষিণমুখী একটি তরোয়াল, তীর দুটির মুখ ছিলো বায়ু ও অগ্নি কোণে৷ নীচে লাতিন হরফে লেখা ছিলো জওহর রাজ্যের নাম৷ রাজ্যের পতাকায় ছিলো একটি গেরুয়া আয়তক্ষেত্রের ডান দিকে অনুভূমিক বামমুখী শীর্ষযুক্ত সাদা ত্রিভূজ এবং বাম দিকে উপর দিকে গেরুয়া রঙের মধ্যে হলুদ রঙা একাদশ সূচীমুখ আকৃতির সূর্য চিহ্ন৷

ইতিহাস সম্পাদনা

 
পিমরিতে অবস্থিত হযরত সদরুদ্দিন চিশতীর দরগা। এখান থেকে রাজা জয়দেবরাও মুকনে ৬০০ বছর পূর্বে আশীর্বাদ ধন্য হন এবং নতুন রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন
 
জওহার রাজ্যের শেষ মহারাজা যশবন্তরাও মার্তণ্ডরাওয়ের মূর্তি
 
জওহার রাজ্যের শেষ মহারাণী প্রিয়ম্বন্দে

১২৯৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রথম মহামেডান আক্রমণের পূর্ব অবধি কোঙ্কণ উপকূলের উত্তরাংশ কোলী এবং বরলী শাসকদের দ্বারা শাসিত হতো। জওহার রাজ্য ছিল একজন বরলী শাসকের অধীন, কিন্তু তিনি অপুত্রক অবস্থায় মারা গেলে এটি কোলী শাসক পৌপেরার নিকট হস্তান্তরিত হয়ে যায়। কোলীদের শ্রুতি অনুসারে পৌপেরার (যিনি জয়ব নামেও পরিচিত ছিলেন) থলঘাট গিরিপথ-এর নিকট মুকনেতে একটি কাদামাটি নির্মিত দুর্গ ছিল। পিমপ্রির হযরত সদরুদ্দিন চিশতীর দরগায় তিনি দর্শনে গেলে পাঁচজন ভিক্ষাজীবী কোলী বংশীয় তাকে জওহার রাজ্যের শাসক হিসেবে নির্বাচিত করেন। তারপর পৌপেরার কিছু কোলী সমর্থক, উত্তরে বসবাসকারী কিছু বণিক সম্প্রদায়কে একত্রিত করে পেইন্ত ও ধরমপুরে শাসক স্বীকৃতি পান। তিনি উত্তরের সুরাট এবং আরো উত্তরে কাথিয়াবাড়ের উত্তর প্রান্ত অবধি অভিযান করেন এবং সেখানে সাত বছর কাটান। কাথিয়াবাড় থেকে ফেরত এসে তিনি জওহারের বরলী প্রধান কে বলেন এক পাল মহিষ রাখার সমতুল্য জমি তাকে দান করতে। সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে বরলীর প্রধানের সমস্ত জমি হস্তান্তরিত হয়ে যায়। জওহার থেকে বারো মাইল উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত গম্ভীরগড়ে বরলীদের স্থানান্তরিত করা হয় এবং ‌জওহারে কোলীরাই সর্বেসর্বা হয়ে উঠেন।[৫]

১৩০৬ শতাব্দী ৬ জুন তারিখে জয়ব মুকনে জওহারের দুর্গে অভিযান চালান। তার জ্যেষ্ঠপুত্র দুর্লভরাও তার পিতার রাজ্য বিস্তার করতে সক্ষম হন এবং একটি বিশাল অঞ্চলে নিজের আধিপত্য স্থাপন করেন। তার রাজ্যে ছিল বাইশটি দুর্গ যা বর্তমানে মহারাষ্ট্র রাজ্যের নাশিক এবং থানে জেলায় অবস্থিত। সেই সময় মোট রাজস্বের পরিমাণ ছিল ৯০,০০০ মুদ্রা। ১৩৪৩ খ্রিস্টাব্দের ৫ই জুন তারিখে তিনি সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলকের নিকট থেকে পূর্ণ শাসনাধিকার এবং রাজা নিমশাহ উপাধি পান। এই ঘটনার ফলে স্থানীয় অঞ্চলের একটি নতুন পঞ্জিকার সূত্রপাত হয় যা পরবর্তী ছয়শ বছরে এখানকার স্থানীয় মানুষ ব্যবহার করতেন।[৬]

নিমশাহের পৌত্র দেওবররাও বহমনীর শাসক প্রথম আহমদ শাহ ওয়ালির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন৷ তার বিদার আক্রমণের সময়ে তিনি সুলতানের কন্যার প্রেমে পড়েন৷ দেওবররাও ধর্ম পরিবর্তন করে মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করেন ও মহম্মদ শাহ নাম নিলে তাবের বিবাহ সম্পন্ন হয়৷ তিনি জওহার ফেরত আসেন এবং অনুত্যক্তভাবে আমৃত্যু শাসনকার্য নির্বাহ করেন৷ তার মূত্যুর পর ক্ষমতাবান হিন্দু পণ্ডিত ও সর্দাররা তার মুসলমনান ধর্মীয় পুত্রকে অস্বীকার করে নিমশাহের ভ্রাতা হোলকাররাওয়ের পৌত্রকে সিংহাসনে বসান৷ এরপর থেকে রাজার হিন্দু উত্তরসূরীরাই রাজ সিংহাসনে শাসনভার গ্রহণ করেন৷[৬]

১৬৬৪ খ্রিস্টাব্দে রাজা প্রথম বিক্রমশাহ সুরাট অভিযানের সময়ে শিরপৌমালের নিকট শিবাজীর সঙ্গে সাক্ষাৎকার করেন৷ তারা এক সাথে সুরাট লুঠও করেন কিন্তু এই পরবর্তীকালে রাজ্যে আসে চরম দুর্গতি৷ মারাঠারা ধীরে ও চতুরতার সাথে মুকনে শাসকদের নিজের কবজা করতে থাকেন এবং একের পর এক জেলা মারাঠা সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করতে থাকেন৷ তারা ১৭৪২, ১৭৫৮ ও ১৭৬১ খ্রিস্টাব্দে জওহার রাজ্য দখল করেন৷ প্রতিবার ঐ রাজ্য মুকনে পরিবারের হাতে তুলে দিলে রাজ্য কিছুটা করে জমি হারায় ও নতুন নতুন কর আরোপিত হতে থাকে৷ ১৭৮২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে রাজা মারাঠা পরিবেষ্ঠিত একটি পর্বতে আবদ্ধ হয়ে যান যার বার্ষিক আয় ছিলো ১,৫০০ থেকে ২,০০০ ভারতীয় মুদ্রা পরিমাণ৷

ব্রিটিশ আধিপত্য এই রাজ্যটির পুনর্প্রতিষ্ঠার অন্যতম অস্ত্র ছিলো৷ যদিও উন্নয়ন ধীর গতিতে সম্পন্ন হয়েছিলো তবুও এই অনিশ্চিত প্রশাসকরা মারাঠা অত্যাচার থেকে মুক্তি পান৷ রাজা পতঙ্গ শাহ চতুর্থের সময়কালে প্রশাসনিক দক্ষতা ফিরে আসে, সড়ক, বিদ্যালয়, চিকিৎসালয়ে উন্নতি হয়৷ ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে তার মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত রাজ্যের হাল অভূতপূর্বভাবে ফিরে আসে৷

রাজার দুই পুত্র পঞ্চম কৃষ্ণশাহ ও পঞ্চম বিক্রমশাহও ছিলেন পিতার মতো৷ বিক্রমশাহ রাজ্যে কৃষি, নির্মাণ, অধিকার ও পরিকাঠামোগত উন্নতিসাধন করেন৷ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে রাজার সাহায্যের কারণে ব্রিটিশ সরকার রাজ্যটিকে ৯ তোপ সেলামী সম্মানিত করেন৷ ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে তার অকালমৃত্যুর পর তার পুত্র সমর্থ রাজা ঘোষিত হওয়া অবধি রাজ্যে দশ বছরের জন্য রাজ প্রতিনিধি নিযুক্ত ছিলো৷

পতঙ্গশাহ পঞ্চম বিক্রমশাহ মুকনে (যশবন্তরাও) ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে মহারাজা উপাধি পান৷[৭]

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতের স্বাধীনতা লাভের পর জওহার রাজ্যের শাসক ভারতীয় অধিরাজ্যে যোগদানের ইচ্ছা প্রকাশ করে একীভূতকরণের দলিল স্বাক্ষর করলে ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসের রাজ্যটিকে ভারতের বম্বে রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করা হয়৷[৮] এটি বর্তমানে মহারাষ্ট্রে পালঘর জেলায় অবস্থিত (থানে জেলা দ্বিখণ্ডিত হওয়ার পর)৷

শাসকবর্গ সম্পাদনা

  • ১২৯৪ – ১৪০০ জয়দেবরাও মুকনে
  • ১৪০০ – ১৪২২ প্রথম নেমশাহ দুর্লভরাও মুকনে
  • ১৪২২ – ১৪৩৫ ভীমরাও মুকনে
  • ১৪৩৫ – ১৪৯০ দেওবারাও মুকনে
  • ১৪৯০ – ১৫** কৃষ্ণশাহ প্রথম কৃষ্ণরাও মুকনে
  • ১৫** – ১৬০০ নেমশাহ দ্বিতীয় কৃষ্ণরাও মুকনে
  • ১৬৪০ – ১৬৭৮ বিক্রমশাহ প্রথম নেমশাহ মুকনে
  • ১৯৭৮ – ১৭** পতঙ্গশাহ প্রথম বিক্রমশাহ মুকনে
  • ১৭** – ১৭৪২ কৃষ্ণশাহ দ্বিতীয় পতঙ্গশাহ মুকনে
  • ১৭৪২ – ১৭৫৮ বিক্রমশাহ দ্বিতীয় কৃষ্ণশাহ মুকনে
  • ১৭৫৮ - ১৭৬৫ কৃষ্ণশাহ তৃতীয় বিক্রমশাহ মুকনে
  • ১৭৬৮ - ১৭৯৮ পতঙ্গশাহ দ্বিতীয় কৃষ্ণশাহ মুকনে
  • ১৭৯৮ – ১৮২১ বিক্রমশাহ তৃতীয় পতঙ্গশাহ মুকনে
  • ১৮২১ – জুন ১৮৬৫ পতঙ্গশাহ তৃতীয় বিক্রমশাহ মুকনে
  • ২৯ জুন ১৮৬৫ - জুলাই ১৮৬৫ বিক্রমশাহ চতুর্থ পতঙ্গশাহ মুকনে
  • জুলাই ১৮৬৫ – ১৯০৫ পতঙ্গশাহ চতুর্থ বিক্রমশাহ মুকনে
  • ১৯০৫ – ১৯১৭ কৃষ্ণশাহ পঞ্চম পতঙ্গশাহ মুকনে
  • ১৯১৭ – ১০ ডিসেম্বর ১৯২৭ বিক্রমশাহ পঞ্চম পতঙ্গশাহ মুকনে
  • ১০ ডিসেম্বর ১৯২৭ – ১৫ আগস্ট ১৯৪৭ পতঙ্গশাহ পঞ্চম বিক্রমশাহ মুকনে (যশবন্তরাও)[৯][১০]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Administration
  2. চিসাম, হিউ, সম্পাদক (১৯১১)। "Jawhar"। ব্রিটিশ বিশ্বকোষ15 (১১তম সংস্করণ)। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস। পৃষ্ঠা 294। 
  3. Elison, William (২০১৮)। The Neighborhood of Gods: The Sacred and the Visible at the Margins of Mumbai (ইংরেজি ভাষায়)। University of Chicago Press। আইএসবিএন 9780226494906 
  4. Tribhuwan, Robin D.; Savelli, Laurence (২০০৩)। Tribal Masks and Myths (ইংরেজি ভাষায়)। Discovery Publishing House। আইএসবিএন 9788171416363 
  5. https://gazetteers.maharashtra.gov.in/cultural.maharashtra.gov.in/english/gazetteer/Thana%20District/Thane-II/jawhar.html#7
  6. "Imperial Gazetteer2 of India, Volume 14, page 87 -- Imperial Gazetteer of India -- Digital South Asia Library"dsal.uchicago.edu। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৮-১৭ 
  7. Not Available (১৯৩১)। List Of Ruling Princes And Chiefs In Political Relations 
  8. Wiki Source, White Paper on Indian States (1950)/Part 4/Instrument of Accession 
  9. "Indian Princely States before 1947 A-J"www.worldstatesmen.org। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৮-১৭ 
  10. "Indian states before 1947 A-J"rulers.org। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৮-১৭