চাবিফলক বাদ্যযন্ত্র

সাঙ্গীতিক চাবিফলক ব্যবহার করে বাজানো বাদ্যযন্ত্রের শ্রেণী

চাবিফলক বাদ্যযন্ত্র (ইংরেজি: Keyboard instrument) বলতে সেইসব বাদ্যযন্ত্রকে বোঝায়, যেগুলিকে একটি সাঙ্গীতিক চাবিফলক (musical keyboard) ব্যবহার করে বাজানো হয়। চাবিফলকটি হল অনেকগুলি চাবির একটি সারি বা সজ্জা, যে চাবিগুলিকে আঙুল দিয়ে চাপ দিতে হয়; চাবিগুলি উত্তোলক তথা লিভারের মতো আচরণ করে। সবচেয়ে প্রচলিত চাবিফলক বাদ্যযন্ত্রগুলির মধ্যে আছে পিয়ানো, হারমোনিয়াম, অর্গান, এবং বিভিন্ন ধরনের বৈদ্যুতিন চাবিফলক বাদ্যযন্ত্র, যেমন ধ্বনি-সংশ্লেষক (সিনথেসাইজার) ও বৈদ্যুতিন পিয়ানো (ডিজিটাল পিয়ানো)। এছাড়া কিছু ঘনযন্ত্র যেমন সেলেস্তাক্যারিয়ন রয়েছে, যেগুলিকে চাবিফলক ব্যবহার করে আঘাত করা হয়। ক্যারিয়ন সাধারণত গির্জা বা পৌরভবনগুলির ঘণ্টাবুরূজে স্থাপিত থাকে।[১]

পিয়ানো একটি অতিপ্রচলিত চাবিফলক বাদ্যযন্ত্র
হ্যামন্ড অর্গান, সাথে একটি লেজলি স্পিকারের অংশ
বান্দোনেওন

বর্তমানে চাবিফলক বাদ্যযন্ত্র বলতে প্রায়শই চাবিফলকবিশিষ্ট ধ্বনি-সংশ্লেষককে নির্দেশ করা হয়। একজন সংবেদনশীল পরিবেশনশিল্পীর আঙুলের নিচে চাবিফলককে এমনভাবে ব্যবহার করা সম্ভব, যাতে বাদ্যযন্ত্রের নকশা ও অন্তর্নিহিত ক্ষমতার উপর নির্ভর করে সাঙ্গীতিক গতিময়তা (musical dynamics), সাঙ্গীতিক রূপায়ন (musical phrasing), সাঙ্গীতিক আভাপ্রদান (shading), সাঙ্গীতিক প্রকাশভঙ্গি (articulation) ও সাঙ্গীতিক অভিব্যক্তির অন্যান্য উপাদান নিয়ন্ত্রণ করা যায়।[১]

পাশ্চাত্যের ঐতিহাসিক সঙ্গীততত্ত্বে "চাবিফলক" একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিভাষা। এক্ষেত্রে পরিভাষাটি দ্বারা এমন একটি বাদ্যযন্ত্রকে বোঝায়, যার পরিচয় সঠিকভাবে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। বিশেষত ১৮শ শতকে হার্পসিকর্ড, ক্লাভিকর্ড ও পিয়ানোর আদিরূপটি ছিল তিন ধরনের চাবিফলক যন্ত্র, যেগুলিতে একই সঙ্গীতখণ্ড তিনভাবে বাজানো যেত। মোৎসার্টকে পিয়ানোবাদক নয়, বরং চাবিফলক যন্ত্রবাদক হিসেবে নির্দেশ করা হত, যার মধ্যে পিয়ানো ছাড়াও উপরোক্ত দুইটি যন্ত্রও অন্তর্ভুক্ত ছিল।

"চাবিফলক" পরিভাষাটি বাদক কীভাবে বাজাচ্ছেন, সে ব্যাপারটি নির্দেশ করে, কিন্তু যন্ত্রটিতে কীভাবে শব্দ বা ধ্বনি উৎপাদিত হচ্ছে, তা নির্দেশ করা হয় না। তাই চাবিফলক বাদ্যযন্ত্রগুলিকে নিম্নের পরিবারগুলিতে শ্রেণীবদ্ধ করা সম্ভব।

ইতিহাস সম্পাদনা

সিরিয়ার মারিয়ামিন শহরের একটি বাইজেন্টীয় ভিলাতে ৪র্থ শতকের শেষভাগের একটি মোজাইক বা পচ্চিকারি চিত্র যাতে নারী বাদকদের চিত্রিত করা হয়েছে।

পাশ্চাত্যে এ পর্যন্ত জ্ঞাত সবচেয়ে প্রাচীন চাবিফলক বাদ্যযন্ত্রটি হল প্রাচীন গ্রিক হাইড্রলিস যন্ত্রটি। এটি ছিল খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতকে উদ্ভাবিত এক ধরনের নল অর্গান[২] এর চাবিগুলি সম্ভবত ভারসাম্যকৃত ছিল এবং এগুলি হালকা চাপ দিয়ে বাজাতো হত। ৪র্থ শতকের শেষভাগে রোমান কবি ক্লাউদিয়ানের রচিত একটি কবিতাতে এর ইঙ্গিত পাওয়া যায়, যেখানে তিনি লেখেন "মাগনা লেভি দেত্রুদেন্স মুরমুরা তাকতু...ইন্তোনেত" (magna levi detrudens murmura tactu . . . intonet) অর্থাৎ "তাকে বজ্রের মতো এগোতে দাও, যখন সে হালকা স্পর্শে মহাগর্জন সৃষ্টি করে"।(Paneg. Manlio Theodoro, 320–22) এরপর খ্রিস্টীয় চতুর্দশ শতকে অর্গান নামক চাবিফলক বাদ্যযন্ত্রটি উদ্ভাবিত হয়, যা ছিল বহুদিন ধরে পাশ্চাত্যের একমাত্র চাবিফলক বাদ্যযন্ত্র। অনেকসময় অর্গানগুলিতে কোনও চাবিফলকও থাকত না, বরং বোতাম থাকত, কিংবা বৃহৎ উত্তোলকযন্ত্র থাকত, যেগুলিকে আঙুল দিয়ে নয়, বরং পুরো হাত ব্যবহার করে চালনা করতে হত। ১৫শ শতক পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি চাবিফলক বাদ্যযন্ত্রতেই প্রতিটি অষ্টকে সাতটি স্বাভাবিক স্বর থাকত।[৩]

চতুর্দশ শতকে ক্লাভিসিম্বালাম, ক্লাভিকর্ডহার্পসিকর্ড নামক বাদ্যযন্ত্রগুলির আবির্ভাব ঘটে। এদের মধ্যে ক্লাভিকর্ড সম্ভবত অধিক প্রাচীন। তখন থেকে ১৮শ শতক পর্যন্ত ক্লাভিকর্ড ও হার্পসিকর্ড অতিপ্রচলিত চাবিফলক বাদ্যযন্ত্র ছিল। ১৮শ শতকে এসে এগুলির জনপ্রিয়তা হ্রাস পায় এবং এদের পরিবর্তে সর্বত্র ব্যাপকভাবে পিয়ানো নামক চাবিফলক বাদ্যযন্ত্রটি গৃহীত হতে শুরু করে। পিয়ানো ছিল একটি বৈপ্লবিক চাবিফলক বাদ্যযন্ত্র, কারণ একজন পিয়ানোবাদক চাবিকে জোরে বা হালকা করে চাপ দিয়ে পিয়ানোর উৎপাদিত ধ্বনির তীব্রতা বা জোরালোতা (গতিময়তা) সূক্ষ্মভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। পিয়ানোর পূর্ণ ইতালীয় নাম হল গ্রাভিচেম্বালো কন পিয়ানো এ ফোর্তে (gravicèmbalo con piano e forte) যার অর্থ হল "মৃদু ও জোরালো ধ্বনিসহ হার্পসিকর্ড"। এটিকে প্রথমে সংক্ষেপে ইতালীয় ভাষায় "পিয়ানো-ফোর্তে" (অর্থাৎ "মৃদু-জোরালো") বলে ডাকা হত। শেষে আরও সংক্ষিপ্ত "পিয়ানো" নামটি টিকে আছে। পিয়ানো যন্ত্রের অনেক বিবর্তন ঘটেছে। বর্তমানে যে পিয়ানো ব্যবহার করা হয়, তা মূলত ১৯শ শতকের শেষভাগের একটি সংস্করণ। এটির সাথে মোৎসার্ট, হাইডন ও বেটহোফেনের বাজানো পিয়ানোগুলির সাথে ধ্বনি ও বহিরাবয়বে প্রচুর পার্থক্য আছে। বাস্তবিকভাবে আধুনিক পিয়ানোর সাথে ১৯শ শতকে লিস্ট, শোপাঁ বা ব্রামসের বাজানো পিয়ানোগুলিরও বহু তাৎপর্যপূর্ণ পার্থক্য আছে।[১]

২০শ শতকের শুরু থেকেই চাবিফলক বাদ্যযন্ত্রগুলির আরও বিকাশ সাধন করা হয়। ২০শ শতাব্দীর শুরুর দিকে প্রাথমিক বৈদ্যুতিক-যান্ত্রিক যন্ত্রগুলির আবির্ভাব ঘটে, যাদের মধ্যে উদাহরণ হিসেবে ওঁদ মার্ত্যনো-র (Ondes Martenot) নাম উল্লেখ করা যায়।

আধুনিক চাবিফলক যন্ত্রসমূহ সম্পাদনা

পিয়ানোর মত শুনতে হয়, কিন্তু পিয়ানোর মত বড় আকারের বা ভারী নয়, এরূপ বাদ্যযন্ত্র সৃষ্টি করার পেছনে অনেক প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। বৈদ্যুতিক পিয়ানোবৈদ্যুতিন পিয়ানো (ইলেকট্রনীয় পিয়ানো) যন্ত্র দুইটি ছিল প্রথম দিকের এরূপ দুইটি প্রচেষ্টা। এগুলি উপকারী যন্ত্র হলেও পিয়ানোর ধ্বনিগুণ (টিম্বার) এগুলি মনপূঃতভাবে পুনরুৎপাদন করতে ব্যর্থ হয়।[৪] প্রায় একই সময় বৈদ্যুতিক ও বৈদ্যুতিন অর্গান যন্ত্রগুলি নির্মাণ করা হয়। সাম্প্রতিককালে এসে বৈদ্যুতিন চাবিফলক বাদ্যযন্ত্রগুলির নকশায় দ্বি-আঙ্কিক নমুনা (ডিজিটাল স্যাম্পল) ও পরিগণকীয় প্রতিমান (কম্পিউটার মডেল) ব্যবহার করে নির্দিষ্ট নির্মিতি ও প্রতিমানের পিয়ানোর ধ্বনি অনুকরণ করার জোর চেষ্টা করা হয়।

অবৈদ্যুতিক (অ্যাকুস্টিক) চাবিফলক বাদ্যযন্ত্রগুলিতে ৮৮টি চাবি থাকে। তবে অপেক্ষাকৃত হ্রস্ব চাবিফলকও প্রচলিত আছে, যেগুলিতে ৬১টি চাবি থাকে।[৫]

বৈদ্যুতিন চাবিফলক বাদ্যযন্ত্রের চাবির চাপের অনুভূতি (অ্যাকশন) সম্পাদনা

একট সরল বৈদ্যুতিন চাবিফলক বাদ্যযন্ত্রে হালকা প্লাস্টিকনির্মিত চাবি থাকে, যার নিচে স্থিতিস্থাপক কুণ্ডলী বা স্প্রিং বসানো থাকে। ফলে চাবিতে চাপ দেওয়ার পরে সেটি আবার আদি অবস্থানে ফেরত আসে। চাবির চাপের অনুভূতি একটি অ-অবৈদ্যুতিক অর্গান বাজানোর অনুভূতির মত। কিছু কিছু বৈদ্যুতিন চাবিফলক বাদ্যযন্ত্রের চাবিগুলি "ওজনযুক্ত" (weighted keys) হয়ে থাকে, যাতে চাবিতে চাপ দেওয়ার অনুভূতি একটি অবৈদ্যুতিক স্বাভাবিক পিয়ানোর চাবিফলকের অনুভূতির মতো মনে হয়।

আরও দেখুন সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Kelzenberg, David। "What are Historical Keyboard Instruments?"। ২০১৩-০২-১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১২-১০-২৫ 
  2. Apel, W.; Tischler, H. (১৯৯৭)। The History of Keyboard Music to 1700। Indiana University Press। পৃষ্ঠা 9। আইএসবিএন 978-0-253-21141-5। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৩-২৫According to almost unanimous reports, Ctesibios, a Greek engineer who lived in Alexandria during the 3rd century B.C., was the inventor of the first organ, the so-called hydraulis. 
  3. "Keyboard instrument"britannica.com 
  4. “Digital Pianos and Electronic Keyboards: What's the Difference between Pianos vs Keyboards?” acoustic bridge.com. February 18, 2019.
  5. “Best keyboards and pianos for beginners" ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২ অক্টোবর ২০১৯ তারিখে thehub.musiciansfriend.com

আরও দেখুন সম্পাদনা

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা

টেমপ্লেট:Instrument tunings টেমপ্লেট:Musical instruments in classical music টেমপ্লেট:Musical keyboards