গ্রন্থাগার বা প্রকৃত অর্থে "পাঠাগার" হলো বই, পুস্তিকা ও অন্যান্য তথ্য সামগ্রির একটি সংগ্রহশালা, যেখানে পাঠকের প্রবেশাধিকার থাকে এবং পাঠক সেখানে পাঠ, গবেষণা কিংবা তথ্যানুসন্ধান করতে পারেন।[১] বাংলা 'গ্রন্থাগার' শব্দটির সন্ধি বিচ্ছেদ করলে গ্রন্থ+আগার এবং 'পাঠাগার' শব্দটির সন্ধি বিচ্ছেদ করলে পাঠ+আগার পাওয়া যায়। অর্থাৎ গ্রন্থসজ্জিত পাঠ করার আগার বা স্থান হলো গ্রন্থাগার। গ্রন্থাগারের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দ্বায়িত্বশীল ব্যক্তি হলেন গ্রন্থাগারিক

যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড গ্রন্থাগারে সাজিয়ে রাখা বই।

ইতিহাস সম্পাদনা

গ্রন্থাগারের ইতিহাসের শুরু ২৬০০ খ্রীষ্ট্রপূর্বাব্দে[২], প্রাগৈতিহাসিক থেকে ঐতিহাসিক যুগের সন্ধিক্ষনে।[৩][৪] প্রথম লাইব্রেরিগুলি ছিল লেখার প্রাচীনতম ফর্মের সংরক্ষণাগার- যেমন ২৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের সুমেরে আবিষ্কৃত কিউনিফর্ম লিপিতে মাটির ট্যাবলেট এর সংরক্ষণাগার। নিনেভেতে আশুরবানিপালের লাইব্রেরি থেকে ৩০০০০ টির ও বেশি মাটির ট্যাবলেট আবিষ্কৃত হয়েছে[৫]। আবিষ্কারের মধ্যে ছিল সৃষ্টির ব্যাবিলনীয় মহাকাব্য এনুমা ইলিশ, গিলগামেশের মহাকাব্য,[৬] এনুমা আনু এনলিল , "ওমেন টেক্সট"। জ্যোতির্বিদ্যা/জ্যোতিষ সংক্রান্ত পাঠ্য,দ্বিভাষিক শব্দভাণ্ডার, চিকিৎসা নির্ণয়ের তালিকা ও রয়েছে।[৭]

তক্ষশীলা ও নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে অতীব সমৃদ্ধ গ্রন্থাগারের অস্তিত্ব মিলেছে। তিব্বতি সূত্র অনুসারে, নালন্দার গ্রন্থাগারটির নাম ছিল ‘ধর্মগঞ্জ’ ।তিনটি বহুতলবিশিষ্ট ভবনে এই গ্রন্থাগারটি অবস্থিত ছিল। ভবনগুলির নাম ছিল ‘রত্নসাগর’ , ‘রত্নোদধি’ ও ‘রত্নরঞ্জক’ । রত্নোদধি ছিল নয়টি তলবিশিষ্ট ভবন।[৮][৯] নালন্দা মহাবিহারের গ্রন্থাগারে লক্ষাধিক গ্রন্থ ছিল। [১০] গ্রন্থাগারে ধর্মগ্রন্থের পুথি, ব্যাকরণ, ন্যায়শাস্ত্র, সাহিত্য, জ্যোতিষবিদ্যা, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও ভেষজবিদ্যা-সংক্রান্ত গ্রন্থাবলি ছিল।[১১]

খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতাব্দীতে গ্রীসে, লিখিত বই দিয়ে তৈরি ব্যক্তিগত লাইব্রেরি আবির্ভূত হয়। ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে ভূমধ্যসাগরীয় কনস্টান্টিনোপল এবং আলেকজান্দ্রিয়ায় বিশ্বের মহান গ্রন্থাগার তৈরি হয় ।[১২]

পৌরাণিক দার্শনিক লাওজি চীনের ইম্পেরিয়াল ঝো রাজবংশের প্রাচীনতম লাইব্রেরিতে বইয়ের রক্ষক ছিলেন।এছাড়াও, ধ্বংসপ্রাপ্ত কিছু প্রাচীন গ্রন্থাগারে পাওয়া ক্যাটালগ লাইব্রেরিয়ানদের উপস্থিতির চিত্র তুলে ধরে।

ফাতিমিদের ( ৯০৯) অনেক বড় লাইব্রেরি ছিল। ঐতিহাসিক ইবনে আবি তাইয়ি তাদের প্রাসাদ গ্রন্থাগারকে বর্ণনা করেছেন, যেটিতে সম্ভবত সেই সময়ে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সাহিত্য সংগ্রহ ছিল।

চতুর্দশ শতাব্দীতে, টিম্বাক্টুর গ্রন্থাগারগুলি প্রতিষ্ঠিত হয়।[১৩]

বিবরণ সম্পাদনা

গ্রন্থাগারের মূল লক্ষ্য থাকে তথ্যসংশ্লিষ্ট উপাদান সংগ্রহ, সংরক্ষণ, সংগঠন, সমন্বয় এবং পাঠকের জন্য তা উন্মুক্ত করা।

ধরন সম্পাদনা

গণগ্রন্থাগার সম্পাদনা

সাধারণ সকল জনগণের জন্য উন্মুক্ত গ্রন্থাগারকে গণগ্রন্থাগার বলা হয়। স্বাভাবিকভাবে এধরনের গ্রন্থাগার অন্যান্য সকল গ্রন্থাগার থেকে আকার এবং সংগ্রহের দিক দিয়ে যথেষ্ট বড় হয়ে থাকে। বাংলাদেশের ঢাকায় রয়েছে এরকম একটি গণগ্রন্থাগার, যা পাবলিক লাইব্রেরি নামে বহুল পরিচিত।

বিদ্যালয় গ্রন্থাগার সম্পাদনা

বিভিন্ন স্কুলে ছাত্র ও শিক্ষকদের জ্ঞানপিপাসা মেটাবার জন্য এবং তাদেরকে জ্ঞানের সাথে সংশ্লিষ্ট রাখার জন্য আকর্ষণীয় করে এধরনের পাঠাগার প্রস্তুত করা হয়। আন্তর্জাতিক গ্রন্থগার পরিষদ ও প্রতিষ্ঠান ও সংঘ বা IFLA বিদ্যালয় গ্রন্থাগার ইস্তাহার ১৯৯৯-তে বিদ্যালয় গ্রন্থাগার সম্পর্কে যে দিকনির্দেশ করা হয়েছে তা এই রকম- " সকলের শিক্ষাদান ও শিক্ষণের নিমিত্ত বিদ্যালয় গ্রন্থাগার। আজকের তথ্য এবং জ্ঞান-নির্ভর সমাজে সফলভাবে কর্মনির্বাহের জন্য মৌলিক তথ্য ও ধারণাসমূহ বিদ্যালয় গ্রন্থাগার যোগান দেয়। বিদ্যালয় গ্রন্থাগার বিদ্যার্থীদের আজীবন জ্ঞানার্জনের দক্ষতাসমূহ গড়ে তোলে এবং তাদের কল্পনাশক্তিকে উন্নত করে, যাতে তারা দায়িত্বশীল নাগরিকের জীবন নির্বাহ করতে সক্ষম হয়।"

কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার সম্পাদনা

বিদ্যালয় গ্রন্থাগার থেকে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভিন্নতর। সাধারণত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ছাত্র-শিক্ষকদের জন্য এধরনের গ্রন্থাগার উচ্চমানসম্পন্ন তথ্য উপাদান সংরক্ষণ করে থাকে। বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারটি এরকমই একটি সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার।

গবেষণা গ্রন্থাগার সম্পাদনা

বিশেষ কোনো বিষয়ে গবেষণার প্রয়োজনে আলাদা যে গ্রন্থাগার খোলা হয়, তাকে গবেষণা গ্রন্থাগার বলে। বাংলাদেশের ঢাকার বিজ্ঞানবিষয়ক এরকম একটি গ্রন্থাগার হলো ব্যান্সডক লাইব্রেরী

বিশেষ গ্রন্থাগার সম্পাদনা

বিভিন্ন ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, জাদুঘর, ধর্মীয় সংগঠন তাদের নিজস্ব গ্রন্থাগার পরিচালনা করে থাকে, যেগুলো তাদের কর্মী বা সদস্যদের জন্য প্রয়োজনীয় আলাদা উপকরণ সংরক্ষণ করে।

সরকারি গ্রন্থাগার সম্পাদনা

পৃথিবীর অনেক দেশের সরকার থেকে বিশেষ কিছু গ্রন্থাগার পরিচালনা করা হয় দেশের এমনকি সরকারি পর্যায়ের কর্মকর্তাদের প্রয়োজনে তথ্য সরবরাহের স্বার্থে,যেগুলো সরকার ও দেশ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দেশী-বিদেশী তথ্য সংরক্ষণ করে থাকে।

ভ্রাম্যমাণ গ্রন্থাগার সম্পাদনা

বিভিন্ন দেশেই গাড়িতে করে বহনযোগ্য গ্রন্থাগার রয়েছে, যেগুলো পাঠকের দ্বারে দ্বারে তথ্যসামগ্রি পৌঁছে দেয়। বাংলাদেশে এই কাজটি প্রথম চালু করে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রভেনিজুয়েলায় মমবয় বিশ্ববিদ্যালয় দুটি খচ্চরকে ভ্রাম্যমাণ গ্রন্থাগার হিসেবে ব্যবহার করে পাহাড়ি গ্রামের মানুষদের বই সরবরাহ করে থাকে, গ্রামের লোকেরা যাকে বলে "বিবিলোমুলাস" (বাংলায়: বইয়ের খচ্চর)।

সামাজিক গ্রন্থাগার সম্পাদনা

একটি সমাজের সংঘবদ্ধ মানুষেরা তাদের কল্যাণার্থে এ ধরনের গ্রন্থালয় প্রতিষ্ঠা করে।তারা সদস্যদের দ্বারা বাড়িতে বাড়িতে বই পৌঁছে দেয়।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "Library – Definition and More from the Free Merriam-Webster Dictionary"merriam-webster.com 
  2. Maclay, Kathleen (৬ মে ২০০৩)। "Clay cuneiform tablets from ancient Mesopotamia to be placed online"। সংগ্রহের তারিখ ৫ মার্চ ২০১২ 
  3. Renfrew, Colin. Prehistory The Making of the Human Mind, New York: Modern Library, 2008.
  4. Roberts, John Morris (১৭ জুলাই ১৯৯৭)। A short history of the world। Oxford University Press। পৃষ্ঠা 35। সংগ্রহের তারিখ ৭ মার্চ ২০১২ 
  5. "'Assurbanipal Library Phase 1', British Museum One". Britishmuseum.org. Retrieved 21 June 2013.
  6. "Epic of Gilgamesh," in Dalley, Stephanie. Myths from Mesopotamia. Oxford, 1989; pp. 50–135
  7. Van De Mieroop, Marc (2007). A History of the Ancient Near East ca. 3000–323 BC. Oxford, UK: Blackwell Publishing. p. 263
  8. Scharfe, Hartmut (২০০২)। Education in Ancient India। Handbook of Oriental Studies। 16। Brill। আইএসবিএন 9789004125568।
  9. Monroe, Paul (২০০০)। Paul Monroe's encyclopaedia of history of education, Volume 1। Genesis Publishing। আইএসবিএন 8177550918। সংগ্রহের তারিখ ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৪।
  10. Khurshid, Anis (জানুয়ারি ১৯৭২)। "Growth of libraries in India"। International Library Review। 4 (1): 21–65। ডিওআই:10.1016/0020-7837(72)90048-9। সংগ্রহের তারিখ ১ ডিসেম্বর ২০১৪।
  11. Bhatt, Rakesh Kumar (১৯৯৫)। History and Development of Libraries in India। Mittal Publications। আইএসবিএন 8170995825।
  12. Weitemeyer, M. (1956). Archive and library technique in ancient Mesopotamia. Libri: International Journal of Libraries, 6(3). 217–238.
  13. Singleton, Brent D. (2004). "African Bibliophiles: Books and Libraries in Medieval Timbuktu". Libraries & Culture. 39 (1): 1–12. doi:10.1353/lac.2004.0019. JSTOR 25549150. S2CID 161645561. Archived from the original on 19 August 2020. Retrieved 19 January 2022.