গণতন্ত্রের ইতিহাস

ইতিহাসের বিভিন্ন দিক

গণতন্ত্র হল এমন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা, বা কোনও প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা বা একটি দেশের মধ্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণের এমন ব্যবস্থা, যেখানে সমস্ত সদস্যই ক্ষমতার সমান অংশীদার ।[১] আধুনিক গণতন্ত্রকে দুটি বৈশিষ্ট্য দ্বারা চিহ্নিত করা হয় যা তাদের প্রাচীনকালের সরকারগুলি থেকে পৃথক করে: তাদের নিজস্ব সমাজে হস্তক্ষেপ করার ক্ষমতা আছে ও একইভাবে সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলির দ্বারা বানানো আন্তর্জাতিক আইনত কাঠামোর দ্বারা তাদের সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি আছে । গণতান্ত্রিক সরকার সাধারণত বহুতান্ত্রিক ও রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার থেকে পৃথক , যা যথাক্রমে সংখ্যালঘু এবং একক রাজার দ্বারা শাসিত হয়।

গণতন্ত্র সাধারণত প্রাচীন গ্রীক এবং রোমানদের সাথে জড়িত, যাদেরকে ১৮ শতাব্দীর বুদ্ধিজীবীরা পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে বিবেচনা করেন এবং যারা এই প্রাথমিক গণতান্ত্রিক পরীক্ষাগুলিকে নতুন ধাঁচে ফেলে রাজতান্ত্রিক সংস্থার পরবর্তী রাজনৈতিক সংস্থা হিসাবে স্থাপন করার চেষ্টা করেছিল।[২] এই অষ্টাদশ শতাব্দীর গণতান্ত্রিক পুনর্জাগরণবাদীরা পরবর্তী গ্রীক ও রোমানদের গণতান্ত্রিক আদর্শকে পরবর্তী ৩০০ বছরের প্রভাবশালী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে কি পরিমাণে সফল হয়েছিলেন তা সম্ভবত বিতর্কযোগ্য নয়, কিন্তু তারা প্রায়শই যে নৈতিক ব্যখ্যা দিয়েছিলেন , তা হতে পারে। তবুও, গণতান্ত্রিক আদর্শ এবং সংস্থাগুলির পুনরুত্থানের ফলে উদ্ভূত গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণ পরবর্তী শতাব্দীগুলিতে আমূল পরিবর্তন এনেছিল যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে সাম্রাজ্যবাদের শেষ অবশেষটুকু ভেঙে যাওয়ার পর থেকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রাধান্য পেয়েছিল ।

আধুনিক প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রগুলি  সামাজিক চুক্তি যা কিনা নাগরিকদের অধিকার দেয় , রাষ্ট্রের ক্ষমতা হ্রাস করে, এবং ভোটাধিকারের  অধিকার দেয় - এসকলের মাধ্যমে হব্বিসীয় ' প্রকৃতির রাষ্ট্র 'এবং কর্তৃত্ববাদী দখলের মধ্যেকার সেতুবন্ধনে সাহায্য করে ।[৩] যদিও তারা জনসাধারণকে কিছুটা সিদ্ধান্ত গ্রহণে আগ্রহী করে , তবুও তারা জনগণের প্রার্থীদের সম্পর্কে সরাসরি সিদ্ধান্ত নেওয়ার বা বিষয়ভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতার উপর  অবিশ্বাসের ভিত্তিতে সংজ্ঞায়িত হয়।

প্রাচীনত্ব সম্পাদনা

ঐতিহাসিক উৎস সম্পাদনা

নৃতাত্ত্বিকরা আদি-গণতন্ত্রের এমন কয়েকটি রূপ চিহ্নিত করেছেন যা শিকারী-সংগ্রহকারীদের ছোট ছোট দলগুলির থেকে শুরু করে কৃষিভিত্তিক, স্থায়ী সমাজ প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত বিস্তৃত এবং যা আজও বিচ্ছিন্ন আদিবাসী গোষ্ঠীতে কার্যত অপরিবর্তিত রয়েছে। সাধারণত ৫০ - ১০০ জনের এই গোষ্ঠীগুলিতে, যেগুলি প্রায়শই পারিবারিক বন্ধনের মাধ্যমে ঘনিষ্ঠভাবে আবদ্ধ ছিল, সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হত ঐক্যমত্য বা সংখ্যাগরিষ্ঠতার দ্বারা এবং বহুক্ষেত্রে কোনও নির্দিষ্ট প্রধানের নির্বাচন ছাড়াই। যেহেতু এর গতিশীলতা আজও চলমান, এটা ধারণা করাই  যায় যে গণতন্ত্র যে কোনও রূপেই হোক, কোনও দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ  গোষ্ঠী বা উপজাতি থেকে স্বাভাবিকভাবেই উৎপত্তি হয়েছিল।

এই জাতীয় গণতন্ত্রকে সাধারণত উপজাতীয়তা বা আদিম গণতন্ত্র হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। এই অর্থে, গণতন্ত্র রূপ পায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী বা গ্রামে যখন কোনও গ্রাম সভায় মুখোমুখি আলোচনা হয় বা গ্রামের প্রবীণদের সমর্থন রয়েছে এমন কোনও নেতা বা সরকারের অন্যান্য সমবায়  রূপগুলিতে ।[৪] এটি বৃহত্তর আকারে আরও জটিল হয়ে ওঠে, যখন কোনো গ্রাম এবং শহরবাসীদের রাজনৈতিক সম্প্রদায় হিসাবে আরও বিস্তৃতভাবে দেখা হয়। রাজতন্ত্র, স্বৈরশাসন, অভিজাততন্ত্র ও গোষ্ঠীশাসনতন্ত্র সহ অন্যান্য সমস্ত শাসনব্যবস্থার বেশিরভাগ শহুরে কেন্দ্রগুলিতে বিকশিত হয়েছিল, যেগুলি প্রায়শই  ঘনবসতিপূর্ণ৷[৫]

প্রাচীন এথেন্সে প্রায় ৪০৮ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে সরকারের রূপ হিসাবে গণতন্ত্র এবং সংবিধানের ধারণা (এবং নামের) উৎপত্তি হয়েছিল ৷ প্রাচীন গ্রীসে, যেখানে বিভিন্ন ধরনের সরকার চালিত নগর-রাজ্য ছিল, গণতন্ত্রের পাশাপাশি অভিজাতদের দ্বারা (অভিজাততন্ত্র), একক ব্যক্তিবিশেষ দ্বারা (রাজতন্ত্র), স্বৈরাচারী দ্বারা (স্বৈরতন্ত্র)  ইত্যাদি শাসনব্যবস্থারও প্রচলন ছিল ৷

আদি-গণতান্ত্রিক সমাজসমূহ সম্পাদনা

সাম্প্রতিক দশকগুলির  পণ্ডিতরা এই সম্ভাবনাটি সন্ধান করেছেন যে প্রথমে গণতান্ত্রিক সরকারের দিকে অগ্রগতি অন্য কোথাও ঘটেছিল (মানে গ্রিস ব্যতীত), কারণ গ্রীসে  জটিল সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলির বিকাশ মিশর এবং নিকট প্রাচ্যের প্রাচীনতম সভ্যতার আবির্ভাবের অনেক পরে ঘটেছিল।[৬]

মেসোপটেমিয়া সম্পাদনা

 
গিলগামেশের মহাকাব্য সমৃদ্ধ লিপিফলক

থারকিল্ড জ্যাকবসেন প্রাক-ব্যাবিলনীয় মেসোপটেমিয়া, সুমেরীয় মহাকাব্য, পুরাকথা ও ঐতিহাসিক নিদর্শন অধ্যয়ন করে এমনকিছু পেয়েছেন যাকে তিনি আদিম গণতন্ত্র বলে চিহ্নিত করেছেন । এর দ্বারা, জ্যাকবসেন চিহ্নিত করেছেন এমন একটি সরকারকে যেখানে চূড়ান্ত ক্ষমতা মুক্ত (কৃতদাস নয় এমন) পুরুষ নাগরিকদের উপর নির্ভরশীল, যদিও "সরকারের বিভিন্ন কাজ স্পষ্ট বর্ণিত নয় এবং ক্ষমতার কাঠামোটিও  শিথিল"। প্রাচীন সুমেরে,  গিলগামেশের মতো রাজারা  স্বৈরাচারী শক্তির অধিকারী ছিলেন না এবং পরবর্তীকালের মেসোপটেমিয়ার শাসকরা প্রবর্তন করেছিলেন। বরং প্রধান শহর-রাজ্যগুলি প্রবীণ ও "যুবকদের" (সম্ভবত মুক্ত  অস্ত্র বহনকারী পুরুষরা) পরিষদ দ্বারা পরিচালিত হত যাদের চূড়ান্ত রাজনৈতিক কর্তৃত্ব  ছিল এবং যুদ্ধের মতো সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে  তাদের পরামর্শ নেওয়া হত।[৭][৮]

উপর্যুক্ত ধারণাটি সামান্যই গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। পণ্ডিতেরা এই প্রসঙ্গে "গণতন্ত্র" শব্দটি ব্যবহারের সমালোচনা করেছেন কারণ একই নিদর্শনকে আদিম রাজতন্ত্র ও অভিজাত শ্রেণীর মধ্যে একটি শক্তি সংগ্রাম হিসাবেও ব্যখ্যা করা যায় , যে লড়াইয়ে সাধারণ মানুষ  সার্বভৌম কর্তৃত্বের বদলে একপ্রকার গুটির  মতো ব্যবহৃত হয়।[৯] জ্যাকবসেন স্বীকার করেছেন যে এই প্রমাণের অস্পষ্টতা মেসোপটেমিয় গণতন্ত্রের থেকে আদিম  বহুতন্ত্রের পৃথকীকরণে বাধা দেয়।[১০]

ভারতীয় উপমহাদেশ সম্পাদনা

প্রাথমিক গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের আরেকটি নিদর্শন আসে ভারতের স্বাধীন "প্রজাতন্ত্র", সংঘ এবং গণ থেকে, যা খ্রীস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে শুরু করে কিছু কিছু অঞ্চলে চতুর্থ শতাব্দী অবধি  বিদ্যমান ছিল। এর সপক্ষে বিক্ষিপ্ত প্রমাণ রয়েছে যদিও সেই সময়ের কোনও খাঁটি ঐতিহাসিক উৎস বিদ্যমান নেই। অধিকন্তু, ডায়োডরাস — এক গ্রীক ঐতিহাসিক যিনি আলেকজান্ডার দ্বারা ভারত আক্রমণের  দুই শতাব্দী পরে লিখেছিলেন - কোনও বিশদ বিবরণ না দিয়েই উল্লেখ করেছিলেন যে স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলি ভারতে বিদ্যমান ছিল।[১১] আধুনিক পণ্ডিতেরা খ্রীস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীর  সময়ে গণতন্ত্র শব্দটি চিহ্নিত করেছেন  যা পরে অবক্ষয়ের মুখোমুখি হয়েছিল এবং এর অর্থ হতে পারে, কোনও স্বায়ত্তশাসিত রাষ্ট্র তা সে যতই বহুতান্ত্রিক প্রকৃতিরই হোক না কেন।[১২][১৩]

 
জনপদ সেই যুগের ষোলটি শক্তিশালী এবং বিস্তৃত রাজত্ব এবং প্রজাতন্ত্র ছিল, প্রাচীন ভারতের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ জুড়ে প্রসারিত বেশ কয়েকটি ছোট ছোট রাজ্যও ছিল। মহাজনপদ এবং ছোট ছোট রাজ্যের মধ্যে শাক্য, কলিয়া, মল্ল এবং লিচ্ছবিরা প্রজাতান্ত্রিক সরকার স্থাপন করেছিল।

গণের মূল বৈশিষ্ট্য হল এটি  একজন সম্রাট ( যাকে  রাজা বলা হত ) এবং একটি সুচিন্তিত সমাবেশ  নিয়ে গঠিত ছিল । সমাবেশটি নিয়মিত সভা করত I এটি রাষ্ট্রের সমস্ত বড়  সিদ্ধান্তগুলি নিয়ে আলোচনা করত । অন্তত কয়েকটি রাজ্যে সমস্ত মুক্ত পুরুষদের জন্য সভার দ্বার  উন্মুক্ত ছিল। এই সংস্থাটির পূর্ণ আর্থিক, প্রশাসনিক এবং বিচারবিভাগীয় অধিকার ছিল। অন্যান্য কর্মকর্তারা ( যাদের খুব কমই  উল্লেখ পাওয়া যায় ) সমাবেশের সিদ্ধান্ত মেনে চলতেন । গণ দ্বারা নির্বাচিত  রাজা সর্বদা ক্ষত্রিয় বর্ণের অভিজাত পরিবারের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন । সম্রাট ,  সমাবেশের সাথে তার কার্যক্রমের সমন্বয় রেখে চলতেন ; কিছু রাজ্যে তিনি অন্যান্য আভিজাত ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত পরিষদের সাহায্যে এটি করতেন ৷ [১৪] লিচ্ছবিদের একটি প্রধান পরিচালনা পর্ষদ ছিল যাতে ৭০৭৭ রাজা ছিলেন , প্রত্যেকেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পরিবারের প্রধান ছিলেন । অন্যদিকে, গৌতম বুদ্ধের সমসাময়িককালে শাক্য , কলিয় , মল্ল এবং লিচ্ছবিদের ক্ষেত্রে সমৃদ্ধ-দরিদ্র সকল পুরুষের জন্য এই সমাবেশের দ্বার খোলা ছিল । [১৫] প্রথম "প্রজাতন্ত্র" বা গণ সংঘ [১৬] যেমন মল্লদের ক্ষেত্রে কুশীনগর শহরকে কেন্দ্র করে ,  এবং ভাজ্জি ( বা বৃজি ) সংঘটি  বৈশালী শহরকে কেন্দ্র করে  খ্রিস্টপূর্ব  ষষ্ঠ শতাব্দীতে গড়ে উঠেছিল এবং  চতুর্থ শতাব্দী অবধি কিছু অঞ্চলে স্থায়ী হয়েছিল । [১৭] ভাজ্জি মহাজনপদের ক্ষমতাসীন মৈত্রীবদ্ধ বংশগুলির মধ্যে সর্বাধিক বিখ্যাত বংশটি ছিল লিচ্ছবিরা । [১৮] মগধ রাজ্যে প্রজাতান্ত্রিক সম্প্রদায় যেমন রাজাকুমার সম্প্রদায় অন্তর্ভুক্ত ছিল।  গ্রামগুলিতে গ্রামক নামক স্থানীয় প্রধানদের অধীনে নিজস্ব সমাবেশ ছিল। তাদের প্রশাসনিক কাজকর্মগুলি  কার্যনির্বাহী , বিচারবিভাগীয় এবং সামরিক কার্যক্রমে বিভক্ত ছিল।

এই সরকারগুলিকে কীভাবে সর্বোত্তমভাবে বর্ণনা করা যায় সে সম্পর্কে বিদ্বানরা ভিন্নমত পোষণ করেন এবং প্রমাণের অস্পষ্টতা ও বিক্ষিপ্ততার কারণে মতবিরোধ রয়ে যায় । কেউ কেউ সমাবেশগুলির কেন্দ্রীয় ভূমিকার উপর জোর দেয় এবং তাই এগুলিকে গণতন্ত্র হিসাবে চিহ্নিত করে ; অন্যান্য বিদ্বানরা নেতৃত্বক্ষেত্রে উচ্চ-শ্রেণির আধিপত্য এবং সমাবেশের  উপর তাদের নিয়ন্ত্রণের দিকে জোর দেন এবং একে গোষ্ঠীশাসনতন্ত্র হিসাবে দেখেন। [১৯][২০] সমাবেশের প্রভূত ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও , এটির গঠন এবং অংশগ্রহণ সত্যিই সার্বভৌম ছিল কিনা এ বিষয়ে সংশয় থেকে যায় । প্রথম প্রধান বাধা হল সমাবেশের জনপ্রিয় শক্তির বর্ণনা করার ক্ষেত্রে প্রমাণের অভাব ।   এক প্রাচীন পুস্তক অর্থশাস্ত্রে রাজাদের কীভাবে দক্ষতার সাথে শাসন করতে হবে সেই বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে । সংঘের সাথে কীভাবে  ব্যবহার করতে হবে সেই সম্পর্কে এই বইতে একটি অধ্যায় রয়েছে , যার মধ্যে বড় নেতাদের সাথে কারসাজি করার উপর নিষেধাজ্ঞাসমূহ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে , তবে জনগণকে কীভাবে প্রভাবিত করা যায় তা উল্লেখ করা হয়নি - যদি অভিজাত পরিবারগুলি নয় , বরং গণতান্ত্রিক সংস্থাগুলিই   সক্রিয়ভাবে  প্রজাতান্ত্রিক সরকারকে পরিচালনা করত , তবে আশ্চর্যজনকভাবে এই বিষয়টি উল্লেখিত হয়নি । [২১] আরেকটি বিষয় হল চার-স্তরযুক্ত বর্ণপ্রথার অবস্থিতি [১৯] প্রতিটি নির্দিষ্ট বর্ণের সদস্যদের কর্তব্য ও সুযোগ-সুবিধাগুলি - এক বর্ণের  কাউকে অন্য বর্ণের সাথে একসাথে বসে খাবার ভাগাভাগি করে খেতে নিষেধ করার মতন যথেষ্ট কঠোর - প্রতিষ্ঠানগুলির আনুষ্ঠানিকতা নির্বিশেষে রাষ্ট্রে সদস্যদের যে ভূমিকা পালন করতে হবে বলে আশা করা যায় তাকে প্রভাবিত করে থাকতে পারে বলে মনে হয় । গণতন্ত্রের একটি মূল বৈশিষ্ট্য হল সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ভাগ করে নেওয়া । জাতিভেদ প্রথার কারণে নাগরিক সমতার কোনও দৃঢ় ধারণা না থাকায় অনেক পণ্ডিত দাবি করেন  যে গণ এবং সংঘের  প্রকৃতি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের সাথে তুলনীয় নয়। [২০]

স্পার্টা সম্পাদনা

 
লাইকারগাসের আবক্ষ মূর্তি, ২৩ প্রধান আইন প্রণয়কের অন্যতম, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি দের সভাগৃহে প্রদর্শিত আছে৷


প্রাচীন গ্রিস, প্রথমদিকে পোলিস নামক স্বাধীন নগররাষ্ট্র নিয়ে সৃষ্ট একটি আলগা সমষ্টি ছিল৷ এই পোলিসগুলির মধ্যে অনেকগুলিই ছিল গোষ্ঠীশাসনতন্ত্র নির্ভর।[২২] সর্বাধিক বিশিষ্ট গ্রীক বহুতন্ত্র , এবং যে রাষ্ট্রের সাথে গণতান্ত্রিক এথেন্সের প্রায়শই  তুলনা করা হয়, তা ছিল স্পার্টা। যদিও স্পার্টা, প্রাথমিক সামাজিক বিভেদকারক মানদন্ড হিসাবে ব্যক্তিগত সম্পদকে প্রত্যাখ্যান করত, এটিকে  একটি বিচিত্র ধরনের গোষ্ঠীশাসনতন্ত্র[২৩] বলা যায় এবং কিছু পণ্ডিত গণতন্ত্রের সাথে এর সাদৃশ্য খুঁজে পান ৷[২৪][২৫] স্পার্টার সরকারে রাজনৈতিক শক্তি চারটি সংস্থার মধ্যে বিভক্ত ছিল: স্পার্টার দুটি রাজা (দ্বৈতশাসন), গেরোসিয়া (দুটি রাজা সহ প্রবীণদের পরিষদ), ইফোর (রাজাদের তত্ত্বাবধানকারী এবং নাগরিকদের প্রতিনিধি) এবং অ্যাপেলা (স্পার্টার অধিবাসীদের সমাবেশ)৷

দুই রাজা সরকারের প্রধানের দায়িত্ব পালন করতেন। তারা একই সাথে শাসন করতেন, তবে তারা দুটি পৃথক শাখা থেকে এসেছিলেন। দ্বৈতশাসন কার্যনির্বাহী দপ্তরের কার্যকরী ক্ষমতাকে হ্রাস করে দিয়েছিল। রাজারা গেরোসিয়াসের অন্যান্য সদস্যদের সাথে তাদের বিচার বিভাগীয় কাজগুলি ভাগ করে নিয়েছিলেন। গেরোসিয়ার সদস্যরা ৬০ বছরের বেশি বয়সী হতেন এবং আজীবনের জন্য নির্বাচিত হতেন। তত্ত্বগতভাবে, সেই বয়সের বেশি যে কোনও স্পার্টাবাসী নির্বাচনে দাঁড়াতে পারতেন। যাইহোক, বাস্তবে, তারা ধনী, অভিজাত পরিবার থেকে নির্বাচিত হতেন। গেরোসিয়ার আইন প্রণয়নের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা ছিল। সবচেয়ে গণতান্ত্রিক বিভাগ বা অ্যাপেলা এমন এক সমাবেশ ছিল যেখানে ৩০ বছরের চেয়ে বেশি বয়সী স্পার্টাবাসীরা গেরোসিয়া এবং ইফোরের সদস্যদের নির্বাচিত করতেন এবং গেরোসিয়ার প্রস্তাবগুলি গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান করতেন।[২৬] অবশেষে, পাঁচটি ইফোরে  ছিল স্পার্টাবাসীরা যারা অ্যাপেলায় নির্বাচিত হয়েছিলেন  এবং তারা রাজা ও  অন্যান্য সরকারী আধিকারিকদের ক্রিয়াকলাপ তদারকি করতেন  এবং প্রয়োজনে তাদের অপসারণও করতে পারতেন। তারা এক বছরের জন্য দায়িত্ব পালন করতেন এবং দ্বিতীয়বারের জন্য পুনর্নির্বাচিত হতে পারতেন না। বছরের পর বছর ধরে, ইফোররা বৈদেশিক নীতি গঠনে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল এবং রাজ্যের প্রধান নির্বাহী সংস্থা হিসাবে কাজ করেছিল। অধিকন্তু, তাদের উপর স্পার্টার শিক্ষাব্যবস্থার জন্য সম্পূর্ণ দায়িত্ব ছিল, যা স্পার্টার সেনাবাহিনীর উচ্চমান বজায় রাখার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ  ছিল। যেমন এরিস্টটল বলেছিলেন, ইফোরগুলি রাজ্যের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা ছিল, তবে প্রায়শই তাদের সমগ্র সামাজ থেকে নিয়োগ করা হত যার ফলে খুব দরিদ্র লোকেরা পদে অধিষ্ঠিত হতেন, যার ফলে তাদের সহজেই ঘুষ দেওয়া সম্ভবপর ছিল।[২৭][২৮]

স্পার্টার আইন ব্যবস্থার স্রষ্টা ছিলেন কিংবদন্তি আইনপ্রণয়ক লাইকারগাস। তিনি খ্রিস্টপূর্ব ৭ম শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে হেলট বিদ্রোহের পরে স্পার্টায় যে আমূল সংস্কার  হয়েছিল , তার সাথে জড়িত। আরও এক হেলোট বিদ্রোহ রোধ করতে লাইকারগাস উচ্চ সাম্প্রদায়িক সামরিক ব্যবস্থা তৈরি করেছিলেন যা স্পার্টাকে গ্রীসের অন্যান্য নগর-রাজ্যেগুলির থেকে পৃথক করে তুলেছিল। তাঁর সমস্ত সংস্কারগুলি তিনটি স্পার্টান গুণের দিকে জোর দিয়েছিল: সাম্যতা (নাগরিকদের মধ্যে), সামরিক যোগ্যতা এবং পবিত্রতা । এটাও সম্ভব যে লাইকারগাস স্পার্টার সরকারের দুটি চিরাচরিত অঙ্গ - গেরোসিয়া এবং অ্যাপেলার মধ্যে ক্ষমতার বিভাজন করে দিয়েছিলেন। [২৯]

লাইকারগাসের সংস্কারগুলি বৃহৎ রেট্রা নামে পরিচিত বিধি / আইনের তালিকা হিসাবে প্রণীত হয়েছিল , এটি হল বিশ্বের প্রথম লিখিত সংবিধান । [৩০] পরবর্তী শতাব্দীতে , স্পার্টা একটি সামরিক শক্তি হয়ে ওঠে এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য এর রাজনৈতিক ব্যবস্থা গ্রীক বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত হয়। [৩১] বিশেষত  সাম্যতার ধারণাটি স্পার্টার সমাজে গুরুত্বপূর্ণ  প্রভাব ফেলেছিল । স্পার্টানরা নিজেদেরকে όμοιοι ( হোমোইওই , সমান মর্যাদার পুরুষ ) হিসাবে উল্লেখ করত । এটি প্রতিফলিত হয়েছিল স্পার্টার নাগরিক শিক্ষাব্যবস্থায় ( আগোগে ) , যেখানে বিত্ত বা সামাজিক মর্যাদা নির্বিশেষে সকল নাগরিকের শিক্ষাক্ষেত্রে  সমান অধিকার  ছিল। [২৫] সমকালীন বিশ্ববাসীরা , হেরোডোটাস এবং জেনোফোনের মতো ঐতিহাসিকরা থেকে শুরু করে প্লেটো এবং এরিস্টটলের মতো দার্শনিকরা এই বিষয়টির প্রভূত প্রশংসা করেছিলেন । তদতিরিক্ত , স্পার্টার মহিলারা উত্তরাধিকারের অধিকার , সম্পত্তির মালিকানা এবং শিক্ষার অধিকার সহ " সমস্ত ধরনের বিলাসিতা এবং সুযোগ-সুবিধা " ভোগ করতেন যা অন্যত্র দেখা যায় না । [৩২]

সামগ্রিকভাবে, স্পার্টাবাসীরা তাদের রাজাদের সমালোচনা করতে পারতেন এবং তারা তাদের ক্ষমতাচ্যুত ও নির্বাসিতও করতে পারতেন । তবে, স্পার্টার সংবিধানে এইসকল গণতান্ত্রিক উপাদানগুলি থাকা সত্ত্বেও দুটি গুরুত্বপূর্ণ সমালোচনা রয়েছে , স্পার্টাকে একটি গোষ্ঠীশাসনতন্ত্রে পরিণত করে তোলা। প্রথমত, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা সীমাবদ্ধ ছিল , যেমন প্লুতার্ক লিখেছেন "নিজেদের ইচ্ছামতো কাউকে বাঁচতে দেওয়া হয়নি", এবং "সামরিক শিবিরের " মতো সকলকেই তাদের পোলিসের জনসেবাতে নিযুক্ত থাকতে হত । দ্বিতীয়ত ,  বিভিন্ন সরকারী সংস্থাগুলির মধ্যে গেরোসিয়াই ক্ষমতার বৃহত্তম অংশটি দখল করে রেখেছিল । [৩৩][৩৪]

স্পার্টার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অন্যতম কারণ ছিল এই যে সংবিধানে কোনও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন করা হয়নি । স্পার্টায় গোষ্ঠীশাসনতান্ত্রিক উপাদানগুলি আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল , বিশেষত পারস্য যুদ্ধগুলিতে বিজয়ের ফলে প্রাপ্ত স্বর্ণ ও রৌপ্যের আগমনের পরে। তদুপরি , পারস্য যুদ্ধের পরে এথেন্স গ্রীক বিশ্বে আধিপত্যবাদী শক্তি হয়ে দেখা দিয়েছিল এবং স্পার্টা এবং অ্যাথেন্সের মধ্যে আধিপত্য বিষয়ে মতপার্থক্য দেখা দিতে শুরু করে । এর ফলে পেলোপনেসীয় যুদ্ধ নামে পরিচিত একাধিক সশস্ত্র সংঘাতের সূত্রপাত ঘটে , স্পার্টা শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হয় । যাইহোক, যুদ্ধের ফলে উভয় পোলিস এবং স্পার্টা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল এবং ফলশ্রুতিতে লিউকট্রার যুদ্ধে খ্রিস্টপূর্ব ৩৭১ সালে থেবেস স্পাটাকে পরাজিত করে । কয়েক বছর পরে এ সবের অবসান হয় , যখন ম্যাসিডনের দ্বিতীয় ফিলিপ তার দক্ষিণের গোষ্ঠীভিত্তিক নগর-রাজ্যগুলির শক্তি খর্ব করেছিলেন।

অ্যাথেন্স

 
লিও ভন ক্লেঞ্জের আঁকা অ্যাথেন্সের নগরদূর্গ

অ্যাথেন্সকে সাধারণত গণতন্ত্রের জন্মস্থান হিসাবে বিবেচনা করা হয় এবং গণতন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ মানদন্ড হিসাবে দেখা হয়। অ্যাথেন্সের গণতন্ত্র সম্পর্কে বহু শতাব্দী জুড়ে বিস্তৃত প্রারম্ভিক রচনা রয়েছে যেমন প্লেটোর রিপাবলিকএরিস্টটলের পলিটিক্স , নিক্কোলো মাকিয়াভেল্লির ডিসকোর্সেস অন লিভাই ইত্যাদি।

অন্যান্য পোলিসগুলির মতো অ্যাথেন্স খ্রিস্টপূর্ব  সপ্তম শতাব্দীতে একটি প্রভাবশালী ও শক্তিশালী অভিজাততন্ত্র হিসাবে উদয় হয়েছিল।[৩৫]  এই আধিপত্য শোষণের কারণ হয়ে ওঠে এবং তাৎপর্যপূর্ণ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক সমস্যা তৈরি করে। এই সমস্যাগুলি ষষ্ঠ শতাব্দীর গোড়ার দিকে আরও বেড়ে যায়; এবং "অনেক লোক অল্প কয়েকজনের দাসত্বে থাকার কারণে বহু লোক উল্লেখযোগ্যদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল"। [৩৬] একই সময়ে, বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় বিপ্লব ঐতিহ্যবাহী আভিজাততন্ত্রগুলিকে উৎখাত করে। এর মধ্যে ছিল খ্রিস্টপূর্ব সপ্ত​​ম শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধের স্পার্টা। স্পার্টায় লাইকারগাস কর্তৃক প্রণীত সাংবিধানিক সংস্কারগুলি এমন একটি হপলাইট রাষ্ট্রের সূচনা করে যা এটা দেখায় যে কীভাবে উত্তরাধিকার সূত্রে গঠিত সরকারগুলি  পরিবর্তিত হতে পারে এবং সামরিক বিজয়ের দিকে এগিয়ে যেতে পারে। [৩৭] ধনী-দরিদ্রদের মধ্যে একপ্রস্থ সাময়িক অস্থিরতার পরে, সমস্ত শ্রেণির অ্যাথেন্সবাসীরা প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলির মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসাবে কাজ করার জন্য সোলোনের দ্বারস্থ হয়েছিল এবং তাদের সমস্যার একটি সন্তোষজনক সমাধানে পৌঁছতে পেরেছিল। [৩৮]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "democracy, n."OED Online.। Oxford University Press। সংগ্রহের তারিখ ২৮ নভেম্বর ২০১৪ 
  2. Morris I. The Measure Of Civilization : How Social Development Decides The Fate Of Nations [e-book]. Princeton: Princeton University Press; 2013. Available from: eBook Academic Collection (EBSCOhost), Ipswich, MA. Accessed May 18, 2017.
  3. Olson, M. (1993). Dictatorship, Democracy, and Development. American Political Science Review, 87(03), 567-576.
  4. Political System Encyclopædia Britannica Online
  5. Democracy Encyclopædia Britannica Online
  6. Robinson, 1997, pp. 16–17
  7. Jacobsen, 1943, pp. 159–172
  8. Isakhan, B. (2007). Engaging "Primitive Democracy," Mideast Roots of Collective Governance. Middle East Policy, 14(3), 97–117.
  9. Bailkey, 1967, pp. 1211–1236
  10. Robinson, 1997, p. 20
  11. Diodorus 2.39
  12. Larsen, 1973, pp. 45–46
  13. de Sainte, 2006, pp. 321–3
  14. Robinson, 1997, p. 22
  15. Robinson, 1997, p. 23
  16. Thapar, Romila (২০০২)। Early India: From the Origins to AD 1300। University of California। পৃষ্ঠা 146–150। আইএসবিএন 9780520242258। সংগ্রহের তারিখ ২৮ অক্টোবর ২০১৩ 
  17. Raychaudhuri Hemchandra (1972), Political History of Ancient India, Calcutta: University of Calcutta, p.107
  18. Republics in ancient India। Brill Archive। পৃষ্ঠা 93–। GGKEY:HYY6LT5CFT0। 
  19. Bongard-Levin, 1996, pp. 61–106
  20. Sharma 1968, pp. 109–22
  21. Trautmann T. R., Kautilya and the Arthashastra, Leiden 1971
  22. Ostwald 2000, pp. 21–25
  23. Cartledge 2001, p. xii, 276
  24. Plato, Laws, 712e-d
  25. Aristotle, Politics, 1294b
  26. Pomeroy, 1999, pp. 149–153
  27. Buckley, 1996, p. 76
  28. Rhodes 1981, pp. 498–502
  29. Lycurgus Encyclopædia Britannica Online
  30. Raaflaud 2007, p. 37
  31. Buckley, 1996, pp. 65–85
  32. Pomeroy, 1999, p. 143
  33. Pomeroy, 1999, p. 152
  34. Raaflaub 2007, pp. 40–1
  35. Pomeroy, 1999, pp. 159–164
  36. Raaflaub, 2007, p. 50
  37. Raaflaub, 2007, p. 51
  38. Pomeroy, 1999, pp. 164–5