কৃষ্ণচন্দ্র দে

বাংলা কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী, সিনেমা ও থিয়েটার অভিনেতা, থিয়েটার প্রযোজক, সঙ্গীত পরিচালক ও দক্ষ

কৃষ্ণচন্দ্র দে (২৪ আগস্ট ১৮৯৩ - ২৮ নভেম্বর ১৯৬২) ছিলেন বাংলা সঙ্গীতের একজন আদি ও প্রবাদ পুরুষ, কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী, সিনেমা ও থিয়েটার অভিনেতা, থিয়েটার প্রযোজক, সঙ্গীত পরিচালক ও দক্ষ সংগীত শিক্ষক। তিনি মুম্বইয়ের সঙ্গীতজগতে সঙ্গীতাচার্য ‘কে.সি. দে’ নামেও সুপরিচিত। বাংলার অপর এক কিংবদন্তি শচীন দেব বর্মণের প্রথম সঙ্গীত শিক্ষক ছিলেন তিনি। তার ভ্রাতুষ্পুত্র হলেন বৈচিত্র্যের বিচারে সর্বকালের অন্যতম সেরা কণ্ঠশিল্পী মান্না দে। 

কৃষ্ণচন্দ্র দে
প্রাথমিক তথ্য
উপনামকে.সি. দে
জন্ম(১৮৯৩-০৮-২৪)২৪ আগস্ট ১৮৯৩
কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
মৃত্যু২৮ নভেম্বর ১৯৬২(1962-11-28) (বয়স ৬৯)
কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
ধরননেপথ্য কণ্ঠশিল্পী
পেশাগায়ক
কার্যকাল১৯১০– ১৯৬২
দাম্পত্যসঙ্গীতারকবালা
পিতা-মাতাশিবচন্দ্র দে (পিতা)
রত্নমালা দেবী (মাতা)
আত্মীয়মান্না দে (ভ্রাতুষ্পুত্র)

জন্ম ও প্রারম্ভিক জীবন সম্পাদনা

কৃষ্ণচন্দ্রের জন্ম বৃটিশ ভারতে কলকাতার সিমলে পাড়ার মদন ঘোষ লেনে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দের ২৪ অগস্ট। জন্মাষ্টমীতে জন্ম বলেই তার নামকরণ হয়েছিল কৃষ্ণচন্দ্র। তবে ডাকনাম ছিল বাবু। তার পিতা শিবচন্দ্র দে এবং মাতা রত্নমালা দেবী। কৃষ্ণচন্দ্র চোদ্দ বৎসর বয়সে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন। কিন্তু দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে যেন অন্তর্দৃষ্টিতে পেলেন সুরসাধনার প্রতি এক ঐশ্বরিক আকর্ষণ। তার মাও লক্ষ্য করেছিলেন ছেলের সঙ্গীতের প্রতি আগ্রহ। তাই মায়ের উৎসাহেই শুরু হল তার সঙ্গীতচর্চা।[১] ষোল বৎসর বয়সে সে সময়ের বিখ্যাত খেয়ালিয়া শশীমোহন দে-র শিষ্যত্ব গ্রহণ করে সংগীত চর্চা শুরু করেন। ক্রমে টপ্পাচার্য মহেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, সতীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সরোদিয়া কেরামৎউল্লা, ওস্তাদ বাদল খাঁ, শিবসেবক মিশ্র, দবীর খাঁ, দর্শন সিং, জমিরুদ্দিন খাঁ, কীর্তনীয়া রাধারমণ দাস প্রমুখ গুণীদের কাছে সংগীত শিক্ষা করেন।[২] অত্যন্ত পরিশ্রম ও দক্ষতায় আয়ত্ত করলেন সবকিছু। হিন্দি ও উর্দু সঠিক ভাবে উচ্চারণের জন্য মৌলবির কাছে সে বিষয়ে শিক্ষা নেন।

সংগীত জীবন সম্পাদনা

সঙ্গীতের গুণীজনের কাছে সঙ্গীত শিক্ষার পাশাপাশি তিনি কলকাতা ও মফস্বলের গানের অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করতে শুরু করেন। দরাজ ও মিষ্টি গলার অন্ধগায়ক অচিরেই বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেন। মাত্র ১৮ বৎসর বয়সেই এইচ.এম.ভি থেকে তার প্রথম গানের রেকর্ড প্রকাশিত হয়। যখন জনপ্রিয়তা শীর্ষে পৌঁছালেন তখন প্রতি মাসেই একটি করে রেকর্ড বের হতে লাগল। পঙ্কজ মল্লিকের কথায় তিনি-

সে যুগের শ্রেষ্ঠ পুরুষ গায়ক কৃষ্ণচন্দ্র দে"

এবং কালক্রমে তিনি এক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিলেন।

১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে শিশিরকুমার ভাদুড়ীর আমন্ত্রণে মঞ্চে আসেন অভিনয়ের সাথে কণ্ঠশিল্পী হিসাবেও। অ্যালফ্রেড থিয়েটারে "বসন্তলীলা" নাটকে বসন্তদূতের ভূমিকায় অভিনয় ও 'সীতা' নাটকে তার কণ্ঠের গান 'অন্ধকারের অন্তরেতে অশ্রু বাদল ঝরে' দর্শকদের মোহিত করেছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিসর্জন নাটকে অন্ধ ভিখারির চরিত্র অভিনয় করেন। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত রঙমহল থিয়েটারের পরিচালকদের অন্যতম ছিলেন তিনি। রঙমহল, মিনার্ভা ও অন্যান্য থিয়েটারে মঞ্চস্থ বহু নাটকে তার দেওয়া সুর বিশেষ জনপ্রিয় হয়েছিল। তিরিশের দশকেই মঞ্চের পাশাপাশি চলচ্চিত্রেও গান গাওয়া শুরু করেন কৃষ্ণচন্দ্র। বাংলা চলচ্চিত্র তখন নির্বাক হতে সবাক হতে শুরু করেছে আর তিনি একের পর এক ছায়াছবি - 'ভাগ্যচক্র', 'দেবদাস', 'গৃহদাহ', 'বিদ্যাপতি', 'চাণক্য', 'আলোছায়া', 'পূরবী', 'বামুনের মেয়ে', 'মীনাক্ষী' ইত্যাদিতে নেপথ্যে কণ্ঠদান করে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। তবে ছবিগুলিতে সুরকার ও গীতিকারদের ভূমিকা ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কেননা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নজরুল ইসলাম, বাণীকুমার, চণ্ডীদাস, হেমেন্দ্রকুমার রায়, অজয় ভট্টাচার্য, শৈলেন রায় প্রণব রায় প্রমুখ গীতিকার রচনায় এবং পঙ্কজকুমার মল্লিক রাইচাঁদ বড়ালের সুরারোপে গানগুলি আজও অবিস্মরণীয়। "স্বপন যদি মধুর হয়", "তোমার কাজল আঁখি", "তুমি গো বহ্নিমান শিখা", "মুক্তির মন্দির সোপান তলে কত প্রাণ হল বলিদান" - এমন বহু কালজয়ী গান লোকমুখে আজো শোনা যায়। বহু ছায়াছবিতে তিনি নিজেও সুর করেছিলেন। তার নিজের মালিকানায় কে সি দে প্রোডাকশনের গানের ছবি “পূরবী” এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এই ছবিতে তিনি ও তার ভ্রাতুষ্পুত্র প্রণব দে সঙ্গীত পরিচালনা করেন এবং তিনি নিজে অভিনয় করেন। প্রসঙ্গত, তার সঙ্গীতের উত্তরাধিকারী হতে পেরেছিলেন তিন ভ্রাতুষ্পুত্র - প্রণব দে, প্রবোধ দে (মান্না দে নামে খ্যাতিমান) ও প্রভাস দে। বিংশ শতকের ভারতীয় বাংলা ও হিন্দি গানের কিংবদন্তি সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব শচীন দেব বর্মনও তার কাছে বেশ কিছু দিন (১৯২৫-৩০) সঙ্গীত শিক্ষা নেন। উদ্বোধনের দিন থেকে অল ইন্ডিয়া রেডিওর সাথে তার সুসম্পর্ক ছিল। ৮ ই জুন ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে যেদিন আনুষ্ঠানিক ভাবে কলকাতা কেন্দ্রের যাত্রা শুরু হল, তিনি দ্বিতীয় শিল্পী হিসাবে একটানা ধ্রুপদী সঙ্গীত পরিবেশন করেন। তার গানগুলো লোকসঙ্গীত আশ্রিত হওয়ায় সকল শ্রোতার হৃদয় স্পর্শ করে যায়। তার কীর্তণ বাউল ভাটিয়ালি গানগুলি ভীষণ জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং তার হাত ধরেই বাংলা গানে ঠুমরি, দাদরা, গজলের প্রচলন হয়। কৃষ্ণচন্দ্র মূলতঃ, ক্ল্যাসিক্যাল শিল্পী হলেও জনপ্রিয় কীর্তনীয়া ছিলেন তিনি। অসংখ্য কীর্তণ বা কীর্তণ অঙ্গের গান গেয়েছেন। কীর্তন সম্পর্কে তার নিজের বক্তব্য হল -

কলকাতার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থানকালে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে তিনি মুম্বই গেলেন দুই ভ্রাতুষ্পুত্র - প্রণব ও প্রবোধকে নিয়ে হিন্দি ছায়াছবিতে সুর করতে। সেখানে বাড়ি কিনে হিন্দি চলচ্চিত্রে মনোনিবেশ করেন এবং যথারীতি অভিনয়, কণ্ঠদান ও সঙ্গীত পরিচালনা করতে থাকেন। সেই বৎসরেরই সঙ্গীত পরিচালক হয়ে "তমন্না" ছবিতে সুরাইয়ার সাথে দ্বৈতকণ্ঠে গান গাওয়ালেন মান্নাকে। সেখানেও অভিনয়ের পাশাপাশি হিন্দি ছবির অসংখ্য জনপ্রিয় গানের সুরারোপ ও সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন। জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী মোহাম্মদ রফি মুকেশ, কিশোর কুমার সহ অনেকেই গেয়েছেন সেসব গান। মুম্বইয়ের চলচ্চিত্র জগতে তিনি পরিচিত ছিলেন 'কে সি দে'নামে। বাংলা ছাড়াও হিন্দি উর্দু ও গুজরাটি ভাষায় তার সহস্রাধিক গানের রেকর্ড আছে। তবে তিনি নিজে পারফেকশনিস্ট ছিলেন। শেষে তিনি মুম্বইতে নানাভাবে প্রতারিত হয়ে অনেক ব্যথা নিয়ে কলকাতায় ফিরে এসেছিলেন ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে। বাংলা চলচ্চিত্রে পরপর সফলতার সাথে প্রযোজনা পর তিনি শেষবারের মত ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে 'একতারা' ছায়াছবিতে অতিথি শিল্পী হিসাবে পর্দায় আবির্ভূত হয়েছিলেন।

ব্যক্তিগত জীবন সম্পাদনা

একান্ত ব্যক্তিগত জীবনে সকলে তাঁকে ব্যাচেলর হিসাবে জানলেও, তিনি রঙমহল থিয়েটারে তার সহ-অভিনেত্রী তারকবালাকে (মিস লাইট নামে পরিচিত) বিবাহ করেছিলেন শাস্ত্রমতে গোপনে। অবশ্য অল ইন্ডিয়া রেডিও কলকাতা কেন্দ্রেই পরিচয় হয়েছিল চারুচন্দ্র বসুর কন্যা তারকবালা সাথে। বিবাহের পর তার নাম হয় রমা দে। তাঁদের একমাত্র পুত্রসন্তান ১৪ বৎসর বয়সেই মারা যায়। পুত্রের অকাল মৃত্যুর শোক সামলাতে পারেন নি তিনি। অন্যদিকে স্ত্রীর ভবিষ্যৎ নিয়েও চিন্তিত ছিলেন।

জীবনাবসান সম্পাদনা

১৯৬২ খ্রিস্টাব্দের ২৮ শে নভেম্বর ৬৯ বৎসর বয়সে কলকাতাতেই তিনি পরলোক গমন করেন।

স্মৃতিচারণা সম্পাদনা

কৃষ্ণচন্দ্র সম্পর্কে এক স্মৃতিচারণায় চলচ্চিত্র পরিচালক অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন, প্রবীণ বয়সে এক বার একটি গান রেকর্ড করানো হয় কৃষ্ণচন্দ্রকে দিয়ে। কিন্তু গানটি কর্তৃপক্ষের পছন্দ না হওয়ায়, সেটি পুনরায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে দিয়ে নতুন করে গাওয়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। হেমন্ত জানতেন না যে গানটি আগে কৃষ্ণচন্দ্র গেয়েছেন। কিন্তু রেকর্ডিংয়ের আগে কোনও ভাবে তিনি বিষয়টি জানতে পারেন এবং আগের রেকর্ডিংটি শুনতে চান। কৃষ্ণচন্দ্রের গাওয়া গানটি তাঁকে শোনানো হলে, তিনি কিছুক্ষণ নিবিষ্ট মনে বসে থাকেন এবং শেষে বলেন

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "অন্তর্দৃষ্টি দিয়েই তিনি সুরসাধনা"। সংগ্রহের তারিখ ২৪ আগস্ট ২০২০ 
  2. সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, প্রথম খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, আগস্ট ২০১৬ পৃষ্ঠা ১৪৮, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৭৯৫৫-১৩৫-৬
  3. সংগ্রহের-তারিখ = ২৪ আগস্ট ২০২০ "সম্পাদক সমীপেষু: কৃষ্ণচন্দ্র সম্পর্কে" |ইউআরএল= এর মান পরীক্ষা করুন (সাহায্য)