কাসপার ডাভিড ফ্রিডরিখ

জার্মান চিত্রশিল্পী

কাসপার ডাভিড ফ্রিডরিখ (৫ সেপ্টেম্বর ১৭৭৪ - ৭ মে ১৮৪০) ঊনবিংশ শতকের জার্মানির একজন রোমান্টিক ল্যান্ডস্কেপ চিত্রকর, সাধারণভাবে যিনি তার প্রজন্মের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ জার্মান শিল্পী হিসেবে স্বীকৃত।[২] তিনি তার মধ্যযুগীয় রূপকধর্মী (allegorical) ভূপ্রাকৃতিক দৃশ্যাবলীর চিত্রকর্মের জন্য সর্বাধিক পরিচিত। তার এসব শিল্পকর্মে রাতের আকাশ, সকাল বেলার কুয়াশা, নিষ্ফলা বৃক্ষ কিংবা গথিক জাতির ধ্বংসাবশেষের আড়ালে সচরাচর গভীর ধ্যানে নিমজ্জমান ছায়ামূর্তিকে সিলুয়েশনের মাধ্যমে চিত্রায়িত করা হয়েছে। [৩] ফ্রিডরিখ মূলত প্রকৃতির গহীন ধ্যানমগ্নতা নিয়ে কাজ করেছেন। ফ্রিডরিখের প্রায়-প্রতীকী ও প্রথা বিরোধী (anti-classical) চিত্রকর্ম প্রাকৃতিক জগতে একটি বিষয়ভিত্তিক ও আবেগময় প্রতিক্রিয়া পৌঁছে দিতে চেয়েছে। গুণগতভাবে ফ্রিডরিখের চিত্রকর্মগুলো সুবিস্তৃত ভূপ্রাকৃতিক দৃশ্যের মাঝে একটি মানবিক সত্ত্বার উপস্থিতিকে ক্ষুদ্রায়িত পার্সপেক্টিভে[৪] উপস্থাপন করে থাকে। এ উপস্থাপনা এমনই যে এখানে ছায়ামূর্তিগুলোকে একটি মাত্রায় হ্রাস করা হয় যেগুলোকে কলা ইতিহাসবিদ ক্রিস্টোফার জন মারে “আধ্যাত্মিকতার প্রতি দর্শকের নিমগ্নদৃষ্টি” বলে মূল্যায়ন করেছেন।[৫]

কাসপার ডাভিড ফ্রিডরিখ
গেরহার্ড ভন কুগেলগেনের তুলিতে কাসপার ডাভিড ফ্রিডরিখের প্রতিকৃতি (আনু. ১৮১০-১৮২০); ৫৩.৩ × ৪১.৫ সে.মি; তৈলচিত্র।
জন্ম(১৭৭৪-০৯-০৫)৫ সেপ্টেম্বর ১৭৭৪
মৃত্যু৭ মে ১৮৪০(1840-05-07) (বয়স ৬৫)
জাতীয়তাজার্মান
পরিচিতির কারণচিত্রাঙ্কন
উল্লেখযোগ্য কর্ম
দ্য মঙ্ক বাই দ্য সি (১৮০৮–১৮১০), চক ক্লিফস অন রগ্যান (১৮১৮), ওয়ান্ডারার অ্যাভব দ্য সি ফগ (১৮১৮), মুনরাইজ ওভার দ্য সী (১৮২২)
আন্দোলনরোমান্টিকতা
ক্রিস্টয়ান গটলিব কুনের ছোঁয়ায় কাসপার ডাভিড ফ্রিডরিখ (১৮০৭); আলবার্টিনাম জাদুঘর, ড্রেসডেন
ওয়ান্ডারার অ্যাভব দ্য সি অব ফগ (১৮১৮); ৯৪.৮ × ৭৪.৮ সে.মি; কুনসথাল্যা, হামবুর্গ। ইতিহাসবিদ জন লুইস গাডিস সুপরিচিত এই বিশেষ রোমান্টিক মাস্টারপিস সম্পর্কে পরস্পরবিরোধী অনুভূতি প্রকাশ করে বলেন, "একটি ভূপ্রাকৃতিক দৃশ্যের উপর আধিপত্যসূচক এবং এর মাঝে স্বতন্ত্র কারও অর্থহীন ও নগণ্য উপস্থিতি ইঙ্গিতকারী এ চিত্রে আমরা কোন মুখচ্ছবি দেখছিনা, তাই যুবকটির মুখোমুখি হয়ে সে প্রীতিপ্রদায়ক না আতঙ্কজনক না দুটোই তার কোনটিই উদ্‌ঘাটন করা সম্ভব নয়।"[১]

ফ্রিডরিখের জন্ম বাল্টিক সাগরের তীরবর্তী গ্রাইফসওয়াইল্ড (Greifswald) শহরে যা ছিল তৎকালীন সুইডিশ পমরনিয়ার (Pomerania) অন্তর্ভুক্ত। ড্রেসডেনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে তিনি ১৭৯৮ সাল পর্যন্ত কোপেনহেগেনে অধ্যয়ন করেন। তিনি এমনই এক সময়ে বয়ঃপ্রাপ্ত হন যখন ইউরোপ জুড়ে মোহমুক্তির বর্ধিঞ্চু একটি ভাবধারাকে বস্তুবাদী সমাজ সমেত আধ্যাত্মিকতার নতুন এক উপলব্ধিতে উত্তরণের ইন্ধন যোগানো হচ্ছিল। আদর্শের এই পরিবর্তনকে সচরাচর প্রাকৃতিক জগতের পুনর্মূল্যায়নের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে, যেখানে ফ্রিডরিখ, জে.এম.ডব্লিউ টার্নার এবং জন কনস্টাবলের মতো শিল্পীরা প্রকৃতিকে "মানব সভ্যতার কৃত্রিমতার বিরুদ্ধে একটি স্বর্গীয় সৃষ্টি" রূপে প্রকাশে উদগ্রীব ছিলেন।[৬]

ফ্রিডরিখের সৃষ্টিকর্ম ক্যারিয়ারের শুরুতে তাকে খ্যাতি এনে দেয় এবং সমকালীন ব্যক্তিত্বদের মধ্যে ভাস্কর ডাভিড ডি'অ্যাঙ্গাজ তাকে এমনই এক ব্যক্তি হিসেবে অবিহিত করেছেন যিনি আবিষ্কার করেছেন "ল্যান্ডস্কেপের করুন পরিণতি” (the tragedy of landscape)।[৭] সে যাই হোক, শেষ বয়সে তার সৃষ্টিকর্ম জনপ্রিয়তা হারায়, আর তিনি সকলের অগোচরে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন।[৮] বিগত ঊনবিংশ শতকে যখন জার্মানি আধুনিকায়নের দিকে ধাবিত হচ্ছিল, তখন জরুরী প্রয়োজনীয়তার এক নব চেতনা তার নিজস্ব ললিতকলার বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে আর ফ্রিডরিখের নিস্তব্ধতার ধ্যানমগ্ন চিত্রায়ন প্রতিভাত হয়ে পড়ে অতীত যুগের সৃষ্টিরূপে। দীর্ঘদিন ধরে তিনি ছিলেন সকলে অগোচরে। বার্লিনে ১৯০৬ সালে ফ্রিডরিখের বত্রিশটি চিত্রের একটি প্রদর্শনী বিংশ শতকের গোড়ায় তার চিত্রকর্মের পুননবায়নকৃত উপলব্ধি ও পুনর্মূল্যায়নকেই বহন করে নিয়ে আসে। ১৯২০ এর দশকের মধ্যেই অভিব্যক্তিবাদীদের দ্বারা শিল্পীর চিত্রকর্মসমূহ আবিষ্কৃত হয় এবং ১৯৩০ এর দশকে ও ১৯৪০ এর দশকের শুরুতে অধিবাস্তববাদীরাঅস্তিত্ববাদীরা তার সৃষ্টি হতে ধারণা নিতেন। আবার ১৯৩০ এর দশকের গোড়ায় নাৎসিবাদের উত্থানও ফ্রিডরিখের জনপ্রিয়তার পুনর্জাগরণ ঘটায়, কিন্তু তার কাজে একটি জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি বিদ্যমান নাৎসি আন্দোলনের মাধ্যমে এমনভাবে ব্যাখ্যা করা হলে ঐ জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়ে যায়।[৯] এমতবস্থা গত ১৯৭০ এর দশক পর্যন্ত বজায় ছিল যতক্ষণ পর্যন্ত না তিনি একজন জার্মান রোমান্টিক আইকন ও আন্তর্জাতিকভাবে একজন গুরুত্বপূর্ণ চিত্রশিল্পী হিসেবে পুনরায় খ্যাতি অর্জন করলেন।

জীবন সম্পাদনা

প্রথম জীবন ও পরিবার সম্পাদনা

কাসপার ডাভিড ফ্রিডরিখ জার্মানির বাল্টিকসাগরের তীরবর্তী পূর্বতন সুইডিশ ডোমিনিয়নের পমরনিয়ার (Pomerania) গ্রাইফসওয়াইল্ডে ১৭৭৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বরে জন্ম গ্রহণ করেন।[১০] মোমবাতি ও সাবান প্রস্তুতকারী পিতা এডলফ গটলেইব ফ্রিডরিখের কঠোর লুথেরান ধর্মবিশ্বাস অনুসারে তিনি বেড়ে ওঠেন। তিনি তার পিতামাতার দশজন সন্তানের মধ্যে ষষ্ঠ।[৬] তাদের পারিবারিক অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে পাওয়া তথ্যসমূহ পরস্পরবিরোধী; কিছু সূত্র মোতাবেক এই সন্তানেরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে শিক্ষা লাভ করেছেন, আবার কিছু সূত্র বলছে তারা অনপেক্ষ দারিদ্র্যের মধ্যে বড় হয়েছেন, যেখানে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি কিনতেই তাদের হিমশিম খেতে হত।[১১] অল্প বয়সেই তিনি মৃত্যুর সাথে পরিচিত হয়ে ওঠেন। ১৭৮১ সালে যখন তার বয়স সাত বছর তার মা সফি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।[১২] এক বছর পর তার বোন এলিজাবেথ মারা যান[১৩] এবং দ্বিতীয় বোন মারিয়া টাইফাস জ্বরে ভুগে ১৭৯১ সালে মারা যান।[১১] ১৭৮৭ সালে যখন তার ভাই জোহান ক্রিস্টোফার মারা গেল, তের বছর বয়সে তিনি যখন এই ছোট ভাইকে জমাটবাঁধা হ্রদের বরফে পরে ডুবে যাওয়ার মর্মান্তিক র্ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হলেন তখন যুক্তিযুক্তভাবেই তার শৈশবে ঘটে গেল সবচেয়ে ভয়ংকর ট্রাজেডি।[১৪] কিছু বিবরণ অনুযায়ী, কাসপার ডাভিড নিজেও বরফে বিপদে পড়েছিলেন আর তাকে উদ্ধার করতে গিয়ে জোহান ক্রিস্টোফার অকালে ঝরে পড়েন।[১৫]

 
আত্ম-প্রতিকৃতি (১৮০০); ৪২ × ২৭.৬ সে.মি; রয়াল মিউজিয়াম অব ফাইন আর্টস, কোপেনহেগেন; ছাব্বিশ বছর বয়সে শিল্পীর আঁকা চক-ড্রয়িং, এ সময় তিনি কোপেনহেগেনের রয়াল অ্যাকাডেমিতে অধ্যয়ন করছিলেন।[১৬]

ফ্রিডরিখ ১৭৯০ সালে তার নিজ শহরের গ্রাইফসওয়াইল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে শিল্পী জোহান গটফ্রাইড কুইস্ট্রপের ব্যক্তিগত ছাত্র হিসেবে কলাশাস্ত্রে আনুষ্ঠানিক অধ্যয়ন শুরু করেন। বর্তমানে তার সম্মানার্থে বিশ্ববিদ্যালয়টির কলা বিভাগের নামকরণ করা হয়েছে কাসপার-ডাভিড-ফ্রিডরিখ-ইনস্টিটিউট। কুইস্ট্রপ তার ছাত্রদেরকে বহির্বিভাগ অঙ্কন ভ্রমণে নিয়ে যেতেন, যার ফল স্বরূপ ফ্রিডরিখ তার জীবনের শুরুতেই জীবন হতে অঙ্কনে উদ্বুদ্ধ বা প্রণোদিত হয়েছেন। ধর্মতত্ত্ববিদ লডউইগ গটহার্ড কোসেগার্টেন যিনি শিখিয়েছিলেন যে, প্রকৃতি হচ্ছে ঈশ্বরের প্রকাশ, কুইস্ট্রপের মাধ্যমে ফ্রিডরিখ তার সাক্ষাৎ পান এবং পরবর্তীতে তার দ্বারা প্রভাবিত হন। ১৭শ শতকের জার্মান শিল্পী অ্যাডাম এলশেইমার যার শিল্পকর্মে ল্যান্ডস্কেপের আয়ত্তাধীন ধর্মীয় বিষয়াবলী ও রাত্রি সংক্রান্ত বিষয়াবলী প্রায়শই অন্তর্ভুক্ত থাকত, তার কাজের সাথে কুইস্ট্রপ ফ্রিডরিখকে পরিচয় করিয়ে দেন। এছাড়াও এ সময়ে তিনি সুইডিশ অধ্যাপক থমাস থরিল্ড এর সাথে সাহিত্যনন্দনতত্ত্ব নিয়ে অধ্যয়ন করেন। চার বছর পর ফ্রিডরিখ প্রখ্যাত কোপেনহেগেন অ্যাকাডেমিতে প্রবেশ করেন, এখানে তিনি জীবন হতে চিত্রাঙ্কন কাজের পূর্বে প্রাচীন ভাস্কর্যসমূহের ছাঁঁচের নকল বা প্রতিরূপ তৈরির মাধ্যমে তার শিক্ষা শুরু করেন। কোপেনহেগেন শহরে বসবাস তরুণ এ চিত্রশিল্পীকে রয়াল পিকচার গ্যালারির ১৭শ শতকের ডাচ ল্যান্ডস্কেপ চিত্র সংগ্রহে প্রবেশের সুযোগ প্রদান করে। এই শিক্ষায়তনে তিনি ক্রিস্টোফার অগাস্ট লরেন্টজেন এবং ল্যান্ডস্কেপ চিত্রশিল্পী জেন্স জু (Jens Juel) এর ন্যায় শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে অধ্যয়ন করেন। এই শিল্পীগণ ছিলেন স্টার্ন উন্ড ড্র্যাং (Sturn und Drang বা ঝড় ও পীড়ন) আন্দোলন দ্বারা প্রভাবিত এবং স্ফুটনোন্মুখ রোমান্টিক নন্দনতত্ত্ব ও ক্ষীয়মাণ নব্য-ধ্রুপদী ভাবাদর্শের নাটকীয় প্রবলতা ও গূঢ়ার্থবাচক রীতির (expressive manner) মধ্যবিন্দুকে তারা প্রতিনিধিত্ব করতেন। এহেন পরিবেশে মেজাজ ছিল সর্বোচ্চ আর অনুভাব (influence) ছিল আইসল্যান্ডিয় কিংবদন্তি এদ্যা (Edda), ওসিয়েননস পুরাণের (Ossian and Norse mythology) কবিতার মত নির্ঝর দ্বারা চিত্রায়িত।

ড্রেসডেনে গমন সম্পাদনা

ফ্রিডরিখ ১৭৯৮ সাল থেকে ড্রেসডেনে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। প্রথম দিকে তিনি এচিংয়ের মাধ্যমে ছাপচিত্র তৈরির[১৭] এবং কাঠখোদাইয়ের নকশার পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান; খোদাইয়ের কাজটা তার আসবাবপত্র নির্মাতা ভাই করে দিত। ১৮০৪ সালের মধ্যেই তিনি আঠারোটি এচিং ও চারটি খোদাই কাঠের চিত্র তৈরি করেন; স্পষ্টতই এগুলো খুবই কম তৈরি করা হয় আর বিতরণ করা হয় শুধু বন্ধুদের মধ্যেই।[১৮] শিল্পের অন্যান্য ক্ষেত্রে তার এসব হঠাৎ হঠাৎ অভিযান সত্ত্বেও তিনি মূলত কালি, জলরঙসেপিয়া নিয়ে কাজের প্রতি ঝুঁকে পড়েন। প্রথম দিকে ল্যান্ডস্কেপ উইথ টেম্পল ইন রুইনস (১৭৯৭) এর মত কিছু ব্যতিক্রমী কাজ করলেও তার সুনাম আরও ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত না পাওয়া পর্যন্ত তিনি তেলরঙ নিয়ে বিস্তারিতভাবে কাজ করেন নি।[১৯] ভূপ্রাকৃতিক দৃশ্য তথা ল্যান্ডস্কেপ ছিল তার সর্বাধিক প্রিয় ও অগ্রগণ্য বিষয়। ১৮০১ সালের শুরুতে বাল্টিক উপকূল, বোহেমিয়া ভূখণ্ড, কেরকোনশ্যে পাহাড় এবং হাৎস পর্বতমালায় ঘন ঘন যাওয়া-আসার ফলে তিনি এসবের প্রতি অনুপ্রাণিত হন।[২০] মূলত উত্তর জার্মানির ভূপ্রাকৃতিকদৃশ্য নির্ভর তার এসব চিত্রকর্মে ক্ষুদ্র বন, পাহাড়, পোতাশ্রয়, সকালের কুয়াশা এবং প্রকৃতির এক ঘনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণভিত্তিক আলোর অন্যান্য ইফেক্টগুলো চিত্রিত হয়েছে। রুগেন দ্বীপের খাড়া উঁচু পাহাড়, ড্রেসডেনের চারপাশ ও এলব্যা (Elba) নদীর মত মনোরম দৃশ্যাবলীর স্কেচ এবং গভীর অনুসন্ধানের ভিত্তিতে এসব শিল্পকর্ম গড়ে উঠেছে। ফ্রিডরিখ প্রায়ই একচেটিয়াভাবে পেন্সিলের মাধ্যমে তার অনুসন্ধানী কার্যাদি পরিচালনা করেছেন, উপরন্তু তিনি সেগুলো করেছেন ভূসংস্থানিক তথ্যাদি প্রদানের মাধ্যমে। তথাপি ফ্রিডরিখের মধ্যযুগীয় চিত্রকর্মগুলোর বৈশিষ্ট্য নির্ধারকরূপে আকাশের যে সূক্ষ্ম ইফেক্টসমূহ দেখা যায় সেগুলো ছিল স্মৃতি থেকে আহরিত।[২১] মেঘ ও জলে চন্দ্র-সূর্যের আলো ও আলোকসজ্জার চিত্রায়নের মাধ্যমে এই ইফেক্টসমূহ তাদের শক্তি পেয়েছে; বাল্টিক উপকূলের অনন্য আলোকীয় প্রপঞ্চ এই ইফেক্টসমূহ এর আগে কখনোই এত জোরালোভাবে চিত্রিত করা হয়নি।[২২]

 
ক্রস ইন দ্য মাউনটেনস (তেৎসেন অল্টার) (১৮০৮); ১১৫ × ১১০.৫ সে.মি; গাল্যারি নয় মায়স্তার, ড্রেসডেন। ফ্রিডরিখের প্রথম বড় শিল্পকর্ম; বেদীশিল্পের প্রথাগত চিত্রায়নের ব্যতিক্রম ঘটিয়ে ক্রুশিফিকশনকে এই চিত্রকর্মে ভূপ্রাকৃতিক দৃশ্যের মাঝে দেখানো হয়েছে।

জোহান উল্ফগ্যাং ভন গ্যোটে কর্তৃক আয়োজিত ওয়েমার প্রতিযোগিতায় তিনি ১৮০৫ সালে পুরস্কার অর্জন করলে একজন শিল্পী হিসেবে তার সুনাম প্রতিষ্ঠিত হয়। ঐ সময়ে ওয়েমার প্রতিযোগিতাটি মাঝারি মানের ও এখন-বিস্মৃত শিল্পীদেরকে নব্য ধ্রুপদী ও ছদ্মবেশী গ্রিক ধারার মধ্যে অমৌলিক মিশ্রণের মাধ্যমে আঁকতে উদ্বুদ্ধ করে তোলে। প্রতিযোগিদের তালিকার নিম্ন মান গোয়েথের সুনামের জন্য ক্ষতিকর প্রতিভাত হওয়া শুরু করে। যার ফলে ফ্রিডরিখ তার প্রসেশন অ্যট ডন (Procession at Dawn) ও ফিশার-ফোক বাই দ্য সি (Fisher-Folk by the Sea) এ দুটো সেপিয়া অঙ্কন নিয়ে প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করলে এই কবি (গোয়েথে) অত্যন্ত উৎসাহের সাথে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন আর লেখেন, “ আমরা অবশ্যই নিরপেক্ষভাবে এই ছবিতে শিল্পীর সম্পদশালী উপস্থিতির প্রশংসা করব। অঙ্কনটিতে খুব ভাল কাজ করা হয়েছে, এর অগ্রগমণ সুনিপুণ আর যথাযথ..... তাঁর বর্ণনায় সমন্বিত হয়েছে স্থৈর্য, অধ্যবসায় ও পরিচ্ছন্নতার এক চমৎকার কাজ..... সুনিপুণ জল রঙ..... এছাড়াও তা প্রশংসাযোগ্য।

১৮০৮ সালে চৌত্রিশ বছর বয়সে, ফ্রিডরিখ তার প্রধান চিত্রশিল্পের প্রথমটি শেষ করেন। বলা হয়ে থাকে যে, বেদীশিল্পের (altarpiece) অন্তর্ভুক্ত ক্রস ইন দ্য মাউনটেনস (Cross in the Mountains) চিত্রকর্মটি যা এখন তেৎসেন বেদী (Tetschen Altar) নামে পরিচিত তা পরে বোহেমিয়া অঞ্চলের তেৎসেন শহরের একটি পারিবারিক ভজনালয়ের (chapel) জন্য অনুমোদন পেয়েছিল। এই ধরনের শিল্পকর্মগুলোতে একাকী ও পাইন বৃক্ষ দ্বারা পরিবেষ্টিত পাহাড়ের শীর্ষদেশের পরিলেখে একটি বধকাষ্ঠ বা ক্রুশের চিত্রায়ণ করা হয়েছে। বিতর্কিতভাবে, খ্রিস্ট্রীয় শিল্পকলায় প্রথমবারের জন্য বেদীশিল্পে একটি ল্যান্ডস্কেপ প্রদর্শিত হল। কলা ইতিহাসবিদ লিন্ডা সীজেলের মতে ফ্রিডরিখ পূর্বে যে বহু সংখ্যক অঙ্কন করেছেন, যেগুলো প্রকৃতির জগতে বধকাষ্ঠ চিত্রায়িত করেছে, ফ্রিডরিখের কলাকৌশল (design) হল তার এসব অঙ্কনেরই "যুক্তিপূর্ণ পরম উৎকর্ষ"।

যদিও ফ্রিডরিখের বেদীশিল্প (altarpiece) খুব সাধারণভাবে উৎসাহহীনতার সাথে গৃহীত হয়, তা সত্ত্বেও ব্যাপক প্রচারণা পাওয়ার জন্য এটিই ছিল তার প্রথম চিত্রশিল্প। শিল্প সমালোচক ব্যাসিলিয়াস ভন র‍্যামড'আর ধর্মীয় প্রেক্ষিতে ফ্রিডরিখের ল্যান্ডস্কেপের প্রয়োগকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে এক দীর্ঘ প্রবন্ধ প্রকাশ করলে শিল্পীর বন্ধুরা প্রকাশ্যে এর প্রতিবাদ করে। ল্যান্ডস্কেপ চিত্রশিল্প অশ্লীল অর্থ বহন করতে পারে এ ধারণা প্রত্যাখ্যান করেন ফ্রিডরিখ একথা লিখেন যে,“এটা হবে এক বাস্তবিক অনুমান, যদি ল্যান্ডস্কেপ চিত্রশিল্প নিঃশব্দে গুটি গুটি পায়ে গীর্জায় প্রবেশ করত আর হামাগুড়ি দিয়ে বেদীতে উঠত।” ফ্রিডরিখ ১৮০৯ সালে একটি কর্মসূচির মাধ্যমে তার অভিপ্রায়ের বিবৃতি দিয়ে সন্ধ্যাকালীন সূর্যরশ্মিকে পবিত্র পিতার (Holy Father) আলোর সাথে তুলনা মাধ্যমে, নিজস্ব প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। এই বিবৃতি সেই সময়কে নির্দেশ করে যখন ফ্রিডরিখ তার নিজ কাজের পুঙ্খানুপুঙ্খ ব্যাখ্যা ও অর্থ নথিভুক্ত করেন এবং সেই সময়কে নির্দেশ করে যখন চিত্রাঙ্কন কিছু দালালি মাঝে সীমাবদ্ধ ছিল ক্রমান্বয়ে তিনিও যা গ্রহণ করেন।

 
রকি ল্যান্ডস্কেপ ইন দ্য এলব্ স্যান্ডস্টোন মাউনটেনস (১৮২৩ ও ১৮২৩ এর মধ্য); ৯৪ × ৭৪ সে.মি; তৈলচিত্র।

প্রুসিয়ান রাজপুত্র কর্তৃক ফ্রিডরিখের দুটি চিত্রশিল্পের ক্রয়ের মাধ্যমে তিনি ১৮১০ সালে বার্লিন অ্যাকাডেমির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৮১৬ সালে তখনও তিনি নিজেকে প্রুশিয়ান কর্তৃপক্ষ হতে দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করতেন এবং ঐ বছরের জুনে তিনি স্যাক্সন নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেন। স্থানান্তরিত হওয়ার এ প্রত্যাশা ফ্রিডরিখের পূরণ হয় নি; যেহেতু স্যাক্সন সরকার ছিল আধা-ফরাসি, অন্যদিকে তার চিত্রকলাকে মোটের উপর স্বাদেশিকরূপে এবং সুস্পষ্টভাবেই ফরাসি বিরোধী হিসেবে দেখা হত। সে যাই হোক, ফ্রিডরিখ তার ড্রেসডেন ভিত্তিক বন্ধু গ্রাফ ভিৎসজিয়াম ভন ইক্সটেট (Graf Vitzthum von Eckstädt) এর সহায়তায় নাগরিকত্ব অর্জন করেন, এবং ১৮১৮ সালে ১৫০ থ্যালারের (thaler) বিনিময়ে স্যাক্সন অ্যাকাডেমির বাৎসরিক সদস্যপদ লাভ করেন। যদিও তিনি পূর্ণাঙ্গ অধ্যাপনা প্রাপ্তির আশা করতেন, তবুও কখনোই তাকে এই পুরস্কারে ভূষিত করা হয়নি, যেহেতু জার্মান লাইব্রেরি অব ইনফরমেশন অনুসারে, "তাঁর চিত্রকলা খুবই ব্যক্তিকেন্দ্রিকরূপে উপলব্ধি হয়েছিল, তাঁর দৃষ্টিকোণ এতই স্বতন্ত্র ছিল যে ছাত্রদের মাঝে তা কার্যকর উদাহরণ হিসেবে সরবরাহ করা যেত না।" রাজনীতিও ফ্রিডরিখের ক্যারিয়ারের বাঁধা হিসেবে ভূমিকা পালন করে থাকতে পারে: এর নিয়ামক ছিল সন্দেহাতীতভবে তার জার্মান বিষয়বস্তু ও বেশভূষা, যুগের কর্তৃত্ববাদী আধা-ফরাসি মনোভাবের সাথে যেগুলো বারংবার সংঘর্ষিত।

বিবাহ সম্পাদনা

 
চক ক্লিফস অন রগ্যান (Chalk Cliffs on Rügen, ১৮১৮); ৯০.৫ × ৭১ সে.মি; মিউজিয়াম ওস্কর রেইনহার্ট আম স্ট্যাডগার্টেন, উইন্টারথুর, সুইজারল্যান্ড। ফ্রিডরিখ ১৮১৮ সালে খ্রীস্টিয়ান ক্যারোলাইন বোমারকে বিয়ে করেন, মধুচন্দ্রিমায় তাঁরা নুইব্রান্ডেনবুর্গগ্রাইফসওয়াইল্ডএ আত্মীয়দের কাছে ঘুরতে যান। এই চিত্রটি এই দম্পতির মিলনকে উদযাপন করছে।[২৩]

১৮১৮ সালের ১৮ জানুয়ারি ফ্রিডরিখ ড্রেসডেন শহরের ডায়ারের পঁচিশ বছর বয়সী মেয়ে ক্যারোলাইন বোমারকে বিয়ে করেন। এই দম্পতির তিনটি সন্তান হয়েছিল; এদের মধ্যে প্রথম জন এমা, ১৮২০ সালে যে মায়ের কোলে আসে। শারীরতত্ত্ববিদ ও চিত্রশিল্পী কার্ল গুস্তাভ ক্যারাস তার জীবনী সংক্রান্ত রচনায় উল্লেখ করেছেন যে, বিবাহ ফ্রিডরিখের জীবন কিংবা ব্যক্তিত্ব কোনটিতেই তেমন কোন প্রভাব ফেলেনি, বরং তখনও ঐ সময়ের ক্যানভাসসমূহ, এমনকি মধুচন্দ্রিমার পরে আঁকা চক ক্লিফস অন রগ্যান চিত্রটিও, চপলতার এক নয়া অনুভূতি প্রদর্শণ করে, যেখানে তার প্যালেট আরও অত্যুজ্জ্বল ও স্বল্প নিরাভরণ হয়েছে। এই সময়ের চিত্রকর্মগুলোতে মানব চরিত্রের উপস্থিতি ক্রমবর্ধমানহারে নজরে পড়ে, সীজেল একে ব্যাখ্যা করেছেন এমন এক প্রতিফলনরূপে যা, "মানব জীবনের, বিশেষত তার পরিবারের গুরুত্ব, এখন যা তার ভাবনাকে উত্তরোত্তর পরিব্যাপ্ত করে রাখে, এবং তার বন্ধুরা, তার স্ত্রী, এবং তার শহরের অধিবাসিরা এগুলোই ফ্রিডরিখের শিল্পকলায় পৌনঃপুনিক বিষয়বস্তু হিসেবে দৃষ্টিগোচর হয়।"

এর কাছাকাছি সময়েই তিনি রাশিয়ায় দুটো উৎস থেকে আনুকূল্য প্রাপ্ত হন। ১৮২০ সালে গ্রান্ড ডিউক নিকোলাই পাভলোভিচ তার স্ত্রী আলেকজান্ডার ফিয়েডোরোভনা'র নির্দেশে ফ্রিডরিখের স্টুডিও ভ্রমণ করেন এবং তার কিছু চিত্রকলা নিয়ে সেন্ট পিটার্সবার্গে ফিরে যান; এই বিনিময় পৃষ্ঠপোষকতার যে সূত্রপাত ঘটায় তা অনেক বছর ধরে অব্যাহত থাকে। এর অনধিক কাল পরেই ১৮২১ সালে দ্বিতীয় আলেকজান্ডার এর শিক্ষক, কবি ভ্যাসিলি জিকভস্কি (Vasily Zhukovsky) ফ্রিডরিখের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং তার মাঝে নিজের আত্মার খোঁজ পান। জিকভস্কি কয়েক দশক ধরে ফ্রিডরিখের শিল্পকর্ম নিজে কিনে এবং রাজ পরিবারে তার শিল্পকর্মের সুপারিশ করে উভয় প্রক্রিয়ায় তাকে সাহায্য করেন, ফ্রিডরিখের ক্যারিয়ারের শেষ পর্যন্ত তার এমন সহযোগিতা দুরবস্থাগ্রস্থ ও দরিদ্র শিল্পীর কাছে অমূল্য প্রমাণিত হয়েছে। জিকভস্কি তার বন্ধুর চিত্রকলা সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, "এগুলো তাদের স্পষ্টতার মাধ্যমে আমাদেরকে পরিতৃপ্ত করে, এদের প্রত্যেকে আমাদের মনে একটি স্মৃতি জাগরূক করে।"

ফ্রিডরিখ রোমান্টিক যুগের আরেক নেতৃস্থানীয় জার্মান চিত্রশিল্পী ফিলিপ অটো রঞ্জ'র সাথেও পরিচিত ছিলেন। এছাড়াও তিনি জর্জ ফ্রিডরিখ কার্স্টিং (Georg Friedrich Kersting) এর বন্ধু ছিলেন এবং তিনি তার অনলঙ্কৃত স্টুডিওতে কার্স্টিংকে তার এক শিল্পকর্মে চিত্রায়িত করেন। এছাড়া নরওয়েজিয়ান চিত্রশিল্পী জোহান ক্রিস্টিয়ান ক্লোসেন ডালের (Johan Christian Clausen Dahl, 1788–1857) সাথেও তার বন্ধুত্ব ছিল। ডাল ফ্রিডরিখের শেষ জীবনে তার সাথে ঘনিষ্ঠ হন এবং ফ্রিডরিখের ছবিগুলোই একমাত্র দুষ্প্রাপ্য বস্তু তিনি শিল্পক্রেতা জনগণের মধ্যে এই বলে আতঙ্ক প্রকাশ করতেন। কবি জিকভস্কি যেমন ফ্রিডরিখের মনস্তাত্ত্বিক থিমের তারিফ করেন, তেমনিভাবে ডাল ফ্রিডরিখের ল্যান্ডস্কেপগুলোর বর্ণনাত্মক বৈশিষ্ট্যের প্রশংসা করেন এই মন্তব্য করে, "শিল্পী ও বোদ্ধাগণ ফ্রিডরিখের শিল্পে কেবল এক প্রকার রহস্যই (mystic) খুঁজে পেয়েছেন, কারণ স্বয়ং তাঁরা শুধু এটাই খুঁজে থাকেন ..... তাঁরা দেখেননি প্রকৃতি নিয়ে ফ্রিডরিখের বিশ্বস্ত ও ন্যায়নিষ্ঠ গবেষণা, যার সবকিছুতে তিনি প্রতিনিধিত্ব করেছেন।"

মৃত্যু ও শেষ জীবনের আবেশকে প্রতিফলনলেন মাধ্যমে এ সময় ফ্রিডরিখ লাগাতার স্মারক স্তম্ভের এবং সমাধিসৌধের ভাস্কর্যের স্কেচ আঁকেন, এমনকি ড্রেসডেনের কবরস্থানের কিছু সমাধিস্তম্ভ শিল্পের (funerary art) নকশাও তিনি তৈরি করেন। ১৯৩১ সালে মিউনিখেরগ্লাস প্যালেস আগুনে পুড়ে ধ্বংস হলে এবং পরবর্তীতে ১৯৪৫ সালে ড্রেসডেনে বোমা হামলা হলে এসব কাজের কিছু কিছু নষ্ট হয়ে যায় তথা হারিয়ে যায়।

শেষ জীবন ও মৃত্যু সম্পাদনা

 
টু মেন কন্টেমপ্লেটিং দ্য মুন (আনু. ১৮২৫–১৮৩০); ৫৩.৫ × ৪১ সে.মি; মেট্রোপলিটান মিউজিয়াম অব আর্ট, নিউ ইয়র্ক
 
কাসপার ডাভিড ফ্রিডরিখ ইন হিস স্টুডিও (১৮১৯); ৫৩.৫ × ৪১ সে.মি; পুরাতন জাতীয় জাদুঘর (Alte Nationalgalerie), বার্লিনজর্জ ফ্রিডরিখ কার্স্টিং এর আঁকা তৈলচিত্র, চিত্রে বৃদ্ধ ফ্রিডরিখ মলস্টিক হাতে তাঁর ক্যানভাসের সামনে দাড়িয়ে।
 
কাসপার ডাভিড ফ্রিডরিখ এর সমাধি; ট্রিনিটাটিস-ফ্রিডহফ, ডেসড্রেন।

ফ্রিডরিখের জীবনের শেষ পনের বছরে অবিচল গতিতে নিশ্চিতরূপে তার খ্যাতির পতন ঘটে। গোড়ার দিকের রোমান্টিসিজমের ভাবাদর্শ সমকালীন ফ্যাশনকে অতিক্রম করে অগ্রসর হলে, শিল্পীকে গুণের সংস্পর্শ হতে বিচ্ছিন্ন অদ্ভুত-খাপছাড়া ও ভগ্নহৃদয় এক চরিত্ররূপেই দেখা হত। ধীরে ধীরে তার পৃষ্ঠপোষকরা দূরে সরে যায়। ১৮২০ সালের পূর্বেই তিনি নিভৃতচারীরূপে বসবাস করতেন এবং বন্ধুরা তাকে বর্ণনা করেন "নিঃসঙ্গদের মধ্যে সর্বাধিক নিঃসঙ্গ" হিসেবে। জীবনের শেষ পর্যন্ত তিনি আপেক্ষিক দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করেন। তিনি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন এবং বনভূমি ও মাঠে একাকী হেঁটে হেঁটে দিন ও রাতের দীর্ঘ সময় পার করতেন, প্রায়শই সূর্যোদয়ের পূর্বে পায়চারি শুরু করতেন।

১৮৩৫ এর জুনে ফ্রিডরিখ তার জীবনে প্রথম স্ট্রোক করেন, এতে তিনি মাইনর লিম্ব প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হয়ে পেইন্টিং করার সামর্থ্য বিপুল পরিমাণে হারান। যার ফল স্বরূপ, তৈলচিত্র নিয়ে কাজের ক্ষেত্রে তিনি একেবারে অপারগ হয়ে পড়েন এবং তৎ পরিবর্তে জল রঙ, সেপিয়া ও পূর্বতন রচনার ঘষামাজার (reworking) মধ্যে তার শিল্পকর্ম সীমাবদ্ধ হয়ে যায়।

হাতের পুরো শক্তি হ্রাস পেলেও তার লক্ষ্য অটুট থেকে যায়। তখনও তিনি সী-শোর বাই মুনলাইট (Seashore by Moonlight, ১৮৩৫-৩৬) এর মত একটি চূড়ান্ত ব্ল্যাক পেইন্টিং তৈরী করতে সক্ষম ছিলেন। ভন (Vaughan) এর বর্ণনা অনুসারে, "এটি শিল্পীর সমুদয় সৈকতের মধ্যে অন্ধকারতম, যার সুরের ঐশ্বর্য তাঁর ভূতপূর্ব চাতুরতার অভাবকে পূরণ করছে।"

এ সময় থেকেই তার অন্য কিছু শিল্পকর্মে মৃত্যুর প্রতীক দৃষ্টিগোচর হয়। স্ট্রোকের কিছু সময় পরেই রাশিয়ার রাজ পরিবার তার প্রথম দিকের কিছু সৃষ্টিকর্ম কিনে নেয়। এ উপার্জন তাকে টেপলিৎজ (বর্তমান চেজ রিপাবলিক) ভ্রমণের ও আরোগ্য লাভের সুযোগ করে দেয়।

১৮৩০ এর মধ্যম পর্যায়ে ফ্রিডরিখ প্রতিকৃতির (portraits) একটি সিরিজ আঁকা শুরু করেন এবং নিজেকে প্রকৃতির মাঝে পর্যবেক্ষণ করতে ফিরে আসেন। যাই হোক শিল্প ইতিহাসবিদ উইলিয়াম ভন (William Vaughan) নীরিক্ষা করেন এভাবে, "তিনি নিজেকে অত্যন্ত পরিবর্তিত একজন মানুষ হিসেবে দেখতে পান। তিনি দেখতে পান যে, তিনি আর আগের মত ঋজুকায়, উদ্দীপক ব্যক্তিত্ব নন; তিনি বৃদ্ধ, স্পন্দনহীন..... তিনি চলাফেরা করেন ন্যুব্জ্য হয়ে; এ উপলব্ধি তাঁর ১৮১৯ সালের টু মেন কন্টেমপ্লেটিং দ্য মুন কাজের মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে।"

১৮৩৮ এর আগে তিনি কেবলমাত্র ক্ষুদ্র পরিসরে কাজ করতে পারতেন। এ সময় তিনি ও তার পরিবার দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করছিলেন আর ক্রমবর্ধমানভাবে বন্ধুদের দয়া-দাক্ষিণ্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছিলেন।

 
সেমেটারি এন্ট্রান্স (১৮২৫); ১৪৩ × ১১০ সে.মি; গ্যালারি নয় মাইস্টার (Galerie Neue Meister), ডেসড্রেন

ফ্রিডরিখ ১৮৪০ এর ৭ মে ড্রেসডেনে মারা যান, এবং শহরের কেন্দ্র হতে পূর্ব দিকের ট্রিনিটি কবরস্থানে (Trinitatis-Friedhof) তাকে সমাহিত করা হয়, যেখানে মূল অ্যাভিনিউএর বৃত্তকার সীমানার কেন্দ্র হতে উত্তর-পশ্চিমে তার সরল সমতল সমাধিপ্রস্তর শুয়ে রয়েছে। পনের বছরের কিছু সময় পূর্বে তিনি এই কবরস্থানেরই সিংহদ্বারের চিত্রাঙ্কন করেন।

মৃত্যুর আগে থেকেই তার সুনাম ও খ্যাতি ক্ষীণ হয়ে হয়ে আসতে থাকে, আর পৃথিবী ছেড়ে তার চলে যাওয়া শৈল্পিক সম্প্রদায়ে খুব সামান্যই নজরে পড়েছে। তার শিল্পকর্ম নিশ্চিতভাবেই তার জীবদ্দশাতেই স্বীকৃতি লাভ করে, কিন্ত তা কখনোই ব্যাপক পরিসরে নয়। তৎকালীন (contemporary) শিল্পকলায় ভূদৃশ্যাবলীর ঘনিষ্ঠ অধ্যয়ন তথা ব্যাপক চর্চা এবং প্রকৃতির আধ্যাত্মিক উপাদানসমূহের প্রতি ঝোঁকপ্রবণতা ছিল মামুলি বিষয়, সেখানে তার শিল্পকর্মগুলো এতই মৌলিক ও স্বকীয় ছিল যে সেগুলো ভালভাবে বোঝাই যেত না। ১৮৩৮ এর আগে তার আর কোন শিল্পকর্ম বিক্রি হয়নি কিংবা সমালোচকদের মনোযোগও আকর্ষণ করতে পারেনি। রোমান্টিক আন্দোলন প্রথম যুগের ভাবাদর্শকে পাশ কাটিয়ে দূরে সরে যায়, যা শিল্পীকে প্রতিষ্ঠা পেতে সহায়তা করে।

ফ্রিডরিখের মৃত্যুর পর কার্ল গুস্তাভ ক্যারস তার সম্মানার্থে কয়েকটি ধারাবাহিক প্রবন্ধ রচনা করেন, এতে তিনি ল্যান্ডস্কেপ চিত্রাঙ্কন নিয়মাবলীর ফ্রিডরিখ-রূপান্তর বর্ণনা করেন। যাই হোক, ক্যারসের প্রবন্ধগুলো ফ্রিডরিখকে দৃঢ়ভাবে তার সময়েই উপন্যস্ত করে, তবে ক্রমপ্রবাহমান ঐতিহ্যে কখনোই নয়। তার শুধুমাত্র একটি চিত্রকর্মই ছাপচিত্র হিসেবে পুনরুৎপাদন করা হয়েছিল এবং এর মাত্র কয়েকটি প্রতিরূপ তৈরি করা হয়েছিল।

বিষয়-বস্তু সম্পাদনা

ল্যান্ডস্কেপ ও সাবলাইম সম্পাদনা