কালো মৃত্যু

মহামারি

কালো মৃত্যু বা কালো মড়ক মানবসভ্যতার ইতিহাসে একটি বীভৎস, অমানবিক ও কালো ইতিহাস বহন করছে। পৃথিবীব্যাপি ছড়িয়ে পড়া এই মহামারীর কবলে পড়ে ১৩৪৬-১৩৫৩ সালের মধ্যে ইউরোপ এবং এশিয়া মহাদেশের (ইউরেশিয়া) ৭৫ থেকে ২০০ মিলিয়ন মানুষ মৃত্যুবরণ করে।[১][২][৩] কালো মৃত্যু এর কারণ সম্পর্কে বিভিন্ন তত্ত্ব রয়েছে। ২০১০ এবং ২০১১ সালে বিশেষজ্ঞরা এই মহামারী’র শিকার হওয়া উত্তর ও দক্ষিণ ইউরোপের অধিবাসীদের ডিএনএন বিশ্লেষণ প্রকাশ করেন। এতে ইয়েরসিনিয়া পেস্টিস ব্যাকটেরিয়া’র (প্লেগ রোগ বিশেষ) জন্য রোগ সংক্রামক জীবাণু প্যাথোজেন’কে দায়ী করা হয়।[৪][৫]

মধ্য এশিয়ার সমভূমিতে এই রোগের উৎপত্তি বলে ধারণা করা হয়। এরপর এটি সিল্ক রোড হয়ে ১৩৪৩ সালের দিকে এটি ক্রিমিয়া পর্যন্ত পৌছায়।[৬] বণিকদের জাহাজে বসবাস করা ‘কালো ইঁদুর’ ও ‘ইঁদুর মাছি’ নামক দুইটি প্রজাতির মাধ্যমে এটি ভূমধ্যসাগর এবং ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে।

ইউরোপের মোট জনসংখ্যার ৩০-৬০ ভাগ মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়।[৭] এই মহামারীর কবলে পড়ে ১৪’শ শতাব্দীতে বিশ্বের জনসংখ্যা ৪৫০ মিলিয়ন থেকে ৩৫০-৩৭৫ মিলিয়নে নেমে আসে।[৮] ১৭’শ শতক পর্যন্ত প্লেগ পরবর্তী সময়েও এই সংখ্যা আর পুনরুদ্ধার হয়নি।[৯] এমনকি ১৯’ শতকেও এটি ইউরোপের কিছু কিছু জায়গায় দেখা গিয়েছিল।

এই মহামারী ইউরোপের ইতিহাসে ব্যাপক ধর্মীয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছিল।

কালপঞ্জি সম্পাদনা

রোগের মূল সম্পাদনা

ইরসিনিয়া পেস্টিস, পার্বত্য ইঁদুর সহ এমনি ইঁদুর, বাহিত অসংখ্য মাছির মধ্যে যেটি এঞ্জুটিক(সাধারণভাবে থাকে) দ্বারা সৃষ্ট প্লেগ রোগ যেটি মধ্য এশিয়া, কুর্দিস্তান, পশ্চিম এশিয়া, উত্তর ভারত এবং উগান্ডার বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা দেয়। [১০] এশিয়ার জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে, ইঁদুর ঘাস জমিওয়ালা, বেশি জনবহুল এলাকায় পালিয়ে যেতে শুরু করে এবং রোগ ছড়ায়। কিরগিজস্তানের ইশিকি হ্রদের কুলের কাছাকাছি ১৩৩৮-১৩৩৯ খ্রিষ্টাব্দের নেস্টোরিয়ান কবরগুলিতে মহামারীটির উল্লেখ খোদিত আছে এবং বহু মহামারীবিদরা মহামারী প্রাদুর্ভাবের লক্ষ্যে চিন্তিত ছিলেন, যে এটি সহজেই চীন ও ভারত ছড়িয়ে পড়তে পারে। [১১] অক্টোবর ২০১০ সালে, চিকিৎসা প্রজননশাস্ত্রবিদ্গন বলেছিল যে, এই মহামারীটির তিনটি বড় প্রাদুর্ভাব চীনে সূত্রপাত হয়েছে। [১২] চীনে, ১৩ তম শতাব্দীতে মঙ্গলদের বিজয়ে চাষের এবং ট্রেডিংয়ের পতন ঘটে। তবে, ১৪ তম শতাব্দীর শুরুতে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার দেখা যায়। ১৩৩০-এর দশকে বেশ কয়েকটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও মহামারীর ফলে ১৩৩১ সালে ব্যাপক দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি হয়, যার পরপরই একটি মারাত্মক মহামারী আসে। [১৩] ১৫ বছর ধরে ১৩৪৭ সালে কনস্ট্যান্টিনোপেল পৌঁছানোর আগে মহামারীটিতে আনুমানিক ২৫ মিলিয়ন চীনা ও অন্যান্য এশিয়বাসীরা নিহত হয়েছিল। [১৪][১৫]

এই রোগটি মঙ্গোল বাহিনী এবং ব্যবসায়ীদের সাথে সিল্ক রোডের পথে এসে থাকতে পারে বা এটি জাহাজের মাধ্যমে আসতে পারে।[১৬] ১৩৪৬ সালের শেষ নাগাদ, প্লেগ মহামারীর প্রতিবেদনগুলি ইউরোপের সমুদ্রবন্দরগুলিতে পৌঁছয়: "ভারত জনসংখ্যা ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে, তাতারস্তান, মেসোপটেমিয়া, সিরিয়া, আর্মেনিয়া মৃতদেহে ভরে গেছে"।[১৭]

১৩৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ক্রিমিয়ার কফার বন্দর নগরীতে জেনোইসের ব্যবসায়ীদের দ্বারা প্লেগ বাহিত হয় বলে জানা যায়। দীর্ঘস্থায়ী অবরোধের পরে, যার সময় জনি বেগের অধীনে মঙ্গোল বাহিনী রোগে ভুগছিল, সেনাবাহিনী কাফার শহরের দেয়ালের উপরে সংক্রমিত মৃতদেহ ছড়িয়ে ছিল, অধিবাসীদের সংক্রমিত করার জন্য। জেনুইস ব্যবসায়ীরা পালিয়ে গেলেন, জাহাজের মাধ্যমে সিসিলিতে এবং ইউরোপের দক্ষিণে সংক্রমণ নিয়ে, উত্তরে এটি কিরূপে ছড়িয়ে পড়েছিল, .[১৮] আদৌ ছড়িয়েছিল অথবা না এই ধারনাটি সঠিক কিনা বা তবে এটা স্পষ্ট যে যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ ও আবহাওয়ার মতো বিদ্যমান অবস্থাগুলি কালো মৃত্যুের তীব্রতাতে অবদান রাখে।

ইউরোপীয় প্রাদুর্ভাব সম্পাদনা

ইউরোপে বেশ কয়েকটি সূত্রপাত হয়েছিল বলে মনে হয়। অক্টোবর ১৩৪৭, এই মহামারী সিসিলিতে পৌঁছায়, বারোটি জেনোজ জাহাজ নিয়ে [১৯] এবং দ্রুত দ্বীপ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। ১৩৪৮ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারিতে জাহাজগুলি কফার থেকে জেনোয়া এবং ভেনিস পৌঁছয়, তবে কয়েক সপ্তাহ পরই পিসাতে প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল যেটি উত্তর ইতালির প্রবেশ পথ ছিল। জানুয়ারি শেষে, ইতালি থেকে বহিষ্কৃত একটি জাহাজ মার্সেইলে পৌঁছয়।[২০]

মধ্যপ্রাচ্যের প্রাদুর্ভাব সম্পাদনা

এই মহামারী মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে আঘাত হেনেছিল, যার ফলে গুরুতর জনশূন্যতা এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক উভয় কাঠামোর মধ্যে স্থায়ী পরিবর্তন ঘটেছিল। এটি চীন থেকে ক্রিমিয়াতে কফফা নামক একটি ট্রেডিং পোস্টে মঙ্গলদের সাথে ছড়িয়ে পড়ে,যেটি জেনোয়া প্রজাতন্ত্রের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সেখানে থেকে রোগ, সংক্রমিত ইঁদুর থেকে নতুন ইঁদুর সংক্রমিত হয়, দক্ষিণ রাশিয়া থেকেো এই অঞ্চলে রোগটি প্রবেশ করে। ১৩৪৭ সালের শরত্কাল অবধি কনস্ট্যান্টিনোপলের সাথে বন্দরের বাণিজ্যের মাধ্যমে এবং ব্ল্যাক সি এর মাধ্যমে মহামারীটি মিশরে আলেকজান্দ্রিয়ায় পৌছায়। ১৩৪৭ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে, পূর্বদিকে গাজা এবং উত্তর বরাবর পূর্ব উপকূলে আশঙ্কন,একর, জেরুজালেম, সিডন, দামাস্কাস, হোমস এবং আলেপ্পো সহ ছড়িয়ে পড়ে লেবানন, সিরিয়া ও প্যালেস্টাইন শহরে। ১৩৪৮-১৩৪৯ সালে, এই রোগটি আন্তিয়খে পৌঁছায়। শহরের বাসিন্দারা উত্তর দিকে পালিয়ে যায়, তবে তাদের বেশির ভাগই পালাবার সময় পথে মারা যায়।[২১]

১৩৪৯ খ্রিষ্টাব্দে মক্কা সংক্রামিত হয়ে ওঠে। একই বছরেই মওসিল (মোসুল) শহরে একটি বৃহৎ মহামারী আকার ধারণ করে, এবং বাগদাদের শহর দ্বিতীয় বারের জন্য আক্রান্ত হয়।

কালো মৃত্যুের লক্ষণ সম্পাদনা

 
কালো মৃত্যুে আক্রান্ত ব্যক্তির হাত

প্রথমে এই রোগে আক্রান্ত নারী ও পুরুষ কবজি বা বগলের কোন স্থানে টিউমারের মত কোন কিছুর অস্তিত্ব অনুভব করে। ধীরে ধীরে সেটি বড় হতে থাকে। এক পর্যায়ে এটি আপেল বা ডিমের আকৃতির মত ধারণ করে ও ছড়িয়ে পড়তে থাকে। কালো রঙ্গের এই ফোঁড়া অত্যন্ত বেদনাদায়ক হয়। রোগাক্রান্ত ব্যক্তি তার সারা শরীরে এটি দেখতে পায়। এক পর্যায়ে এগুলো পচে যায় ও পুঁজ বের হতে থাকে এবং মাত্র তিন থেকে সাতদিনের মধ্যে মৃত্যু। 

কালো মৃত্যুের কারণ সম্পাদনা

 
কালো ইঁদুর বা ইঁদুর মাছি
 
প্রেগ রোগ বহনকারী ব্যাকটেরিয়া

Oriental rat flea কালো ইঁদুর বা ইদুর মাছি তার রক্তে এই রোগ বহন করেছিল। তাদের রক্তে বাহিত হওয়া Yersinia pestis ইয়েরসেনিয়া পেস্টিস ব্যাকটেরিয়া (প্লেগ রোগ বহনকারী জীবাণু) কালো মৃত্যু বা বুবোনিক প্লেগ এর উত্তরসূরি। বেশিরভাগ নারী ও পুরুষ এই পতঙ্গের কামড়ে বুবোনিক প্লেগে আক্রান্ত হয়েছিল।  

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. ABC/Reuters (২৯ জানুয়ারি ২০০৮)। "Black death 'discriminated' between victims (ABC News in Science)" (ইংরেজি ভাষায়)। Australian Broadcasting Corporation। সংগ্রহের তারিখ ৩ নভেম্বর ২০০৮ 
  2. "Health. De-coding the Black Death" (ইংরেজি ভাষায়)। BBC। ৩ অক্টোবর ২০০১। সংগ্রহের তারিখ ৩ নভেম্বর ২০০৮ 
  3. "Black Death's Gene Code Cracked"Wired (ইংরেজি ভাষায়)। ৩ অক্টোবর ২০০১। সংগ্রহের তারিখ ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ 
  4. Haensch S, Bianucci R, Signoli M, Rajerison M, Schultz M, Kacki S, Vermunt M, Weston DA, Hurst D, Achtman M, Carniel E, Bramanti B (২০১০)। Besansky, Nora J, সম্পাদক। "Distinct clones of Yersinia pestis caused the black death"PLoS Pathog. (ইংরেজি ভাষায়)। 6 (10): e1001134। ডিওআই:10.1371/journal.ppat.1001134পিএমআইডি 20949072পিএমসি 2951374  
  5. Bos KI, Schuenemann VJ, Golding GB, Burbano HA, Waglechner N, Coombes BK, McPhee JB, DeWitte SN, Meyer M, Schmedes S, Wood J, Earn DJ, Herring DA, Bauer P, Poinar HN, Krause J (১২ অক্টোবর ২০১১)। "A draft genome of Yersinia pestis from victims of the Black Death"Nature (ইংরেজি ভাষায়)। 478 (7370): 506–10। ডিওআই:10.1038/nature10549পিএমআইডি 21993626পিএমসি 3690193  
  6. "BBC – History – Black Death" (ইংরেজি ভাষায়)। BBC। ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১১। 
  7. Austin Alchon, Suzanne (২০০৩)। A pest in the land: new world epidemics in a global perspective (ইংরেজি ভাষায়)। University of New Mexico Press। পৃষ্ঠা 21। আইএসবিএন 0-8263-2871-7 
  8. "Historical Estimates of World Population" (ইংরেজি ভাষায়)। Census.gov। জুলাই ৯, ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ নভেম্বর ১২, ২০১৬ 
  9. Wheeler, Dr. L. Kip। "The Black Plague: The Least You Need to Know"Dr. Wheeler's website (ইংরেজি ভাষায়)। Dr. L. Kip Wheeler। সংগ্রহের তারিখ ৯ আগস্ট ২০১৫ 
  10. Ziegler 1998, পৃ. 25।
  11. Raoult; Drancourt (২০০৮)। "Paleomicrobiology: Past Human Infections" (ইংরেজি ভাষায়)। Springer: 152 
  12. Nicholas Wade (৩১ অক্টোবর ২০১০)। "Europe's Plagues Came From China, Study Finds"The New York Times (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ১ নভেম্বর ২০১০ 
  13. The Cambridge History of China: Alien regimes and border states, 907–1368, p. 585.
  14. Kohn, George C. (২০০৮)। Encyclopedia of plague and pestilence: from ancient times to the present (ইংরেজি ভাষায়)। Infobase Publishing। পৃষ্ঠা 31। আইএসবিএন 0-8160-6935-2 
  15. Sussman GD (২০১১)। "Was the black death in India and China?"। Bulletin of the history of medicine (ইংরেজি ভাষায়)। 85 (3): 319–55। ডিওআই:10.1353/bhm.2011.0054পিএমআইডি 22080795 
  16. "Black Death may have originated in China"The Daily Telegraph (ইংরেজি ভাষায়)। ১ নভেম্বর ২০১০। 
  17. Hecker 1859, পৃ. 21 cited by Ziegler, p. 15.
  18. "Channel 4 – History – The Black Death" (ইংরেজি ভাষায়)। Channel 4। ২৫ জুন ২০০৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩ নভেম্বর ২০০৮ 
  19. Michael of Piazza (Platiensis) Bibliotheca scriptorum qui res in Sicilia gestas retulere Vol 1, p. 562, cited in Ziegler, 1998, p. 40.
  20. De Smet, Vol II, Breve Chronicon, p. 15.
  21. https://www.thegreatcourses.com/courses/an-economic-history-of-the-world-since-1400.html