কাব আহবার (আরবি: كعب الأحبار, পুরো নাম আবু ইসহাক কাব ইবনে মানি' আল-হিময়ারী (আরবি: ابو اسحاق كعب بن مانع الحميري) ছিলেন "যী রাঈন" (আরবি: ذي رعين) এর আরব গোত্রের একজন ৭ম শতাব্দীর ইয়েমেনি ইহুদি।[১][২] যিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তাকে ইসরাইলিয়্যাত এবং দক্ষিণ আরবের বিদ্যার প্রথম কর্তৃত্বধারী বলে মনে করা হয়।[৩][৪] ইসলামী বর্ণনা অনুসারে, তিনি মদিনা থেকে জেরুজালেম সফরে উমরের সাথে ছিলেন। পরবর্তীতে উসমানের সমর্থন করেন। তিনি ৬৫২ থেকে ৬৫৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে হিমসে মারা যান।[৩]

আবু ইসহাক কাব ইবনে মানি' আল-হিময়ারী
মৃত্যু৩২-৩৫ হি./৬৫২-৬৫৬ খ্রি.
যুগখিলাফতে রাশিদাহ
প্রধান আগ্রহ
ইসরাইলিয়্যাত

নাম সম্পাদনা

আহবার শব্দটি হিবর বা হাবর শব্দের বহুবচন। হিব্রুতে মূল শব্দটি হাওয়ের। আহবার শব্দটি ব্যাবিলনীয় ইহুদীরা রব্বির উচ্চতর পদাধিকারীদের জন্য উপাধি হিসেবে ব্যবহার করেন।[৩]

জীবনী সম্পাদনা

কাব সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়। তবে বর্ণনা অনুসারে, তিনি উমরের রাজত্বকালে মদিনায় আসেন। এরপর তিনি উমরের সাথে জেরুজালেমে তার যাত্রায় সঙ্গী হন। বর্ণিত আছে যে, উমর যখন সৈন্যদল নিয়ে জেরুজালেমে যাত্রা করেন, তখন তিনি কাবকে জিজ্ঞাসা করেন: "আপনি আমাকে কোথায় মসজিদ নির্মাণের পরামর্শ দেন?" কাব টেম্পল রকের দিকে ইঙ্গিত করেছিলেন, তখন বৃহস্পতির মন্দির থেকে ধ্বংসাবশেষের একটি বিশাল স্তূপ হয়েছিল। [৫] কাব ব্যাখ্যা করেছেন, ইহুদিরা ২৫ বছর আগে (যখন পারস্যিকরা সিরিয়া দখল করেছিল) সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য তাদের পুরানো রাজধানী ফিরে পেয়েছিল। কিন্তু তারা মন্দিরের স্থানটি পরিষ্কার করতে পারেনি, কারণ বাইজেন্টাইনরা শহরটি পুনরায় দখল করেছিল। এরপর উমর টেম্পল রকের আবর্জনা নাবাতিয়ানদের দ্বারা অপসারণ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং তিনবার প্রবল বর্ষণে শিলাকে পরিষ্কার করার পর তিনি সেখানে প্রার্থনা শুরু করেছিলেন। উমর এটিকে বেষ্টনী দিয়েছিলেন বলে জানা যায়। কিছুকাল পরে, উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ান আকসা প্রাঙ্গণের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে নির্মাণ-ভূমির উপরে কুব্বাত আস সাখরা তৈরি করেছিলেন। আজপর্যন্ত, জায়গাটি কুব্বাত আল-সাখরা (শিলার গম্বুজ) নামে পরিচিত।

বর্ণনা অনুসারে, কাব বিশ্বাস করতেন যে "পৃথিবীর যেকোনো পাদদেশে সংঘটিত বা সংঘটিত হবে এমন প্রতিটি ঘটনাই তাওরাতে লেখা আছে, যা ঈশ্বর তাঁর নবী মূসার উপর অবতীর্ণ করেছিলেন"।[৬] তিনি তাওরাতের জ্ঞান দ্বারা উমরের মৃত্যুর ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন বলে কথিত আছে। একটি বর্ণনা অনুসারে, কাব উমরকে বলেছিলেন "আপনি আপনার ওয়াসিয়াত লিখে নিন। কারণ, আপনি তিন দিনের মধ্যে মারা যাবেন।" উমর জবাব দিলেন "আমি কোন ব্যথা বা অসুস্থতা অনুভব করছিনা"। দেখা গেল, এই ঘটনার আবু লুলু দুদিন পর উমরের উপর গুপ্ত আক্রমণ চালিয়ে তাকে নিহত করে।[৭]

উমরের মৃত্যুর পর, কাব জোরালোভাবে উসমানকে সমর্থন করেছিলেন। পরবর্তীকালে, গভর্নর মুয়াবিয়া কাবকে দামেস্কে তার পরামর্শদাতা হতে বলেছিলেন, কিন্তু তিনি সম্ভবত হিমসে ফিরে যেতে চাচ্ছিলেন। সেখানে তিনি ৬৫২ থেকে ৬৫৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ইন্তেকাল করেন। তার কাছে প্রত্যাহার করতে পছন্দ করেন, যেখানে তিনি 652-6 খ্রিস্টাব্দে মারা যান, বিভিন্ন বিবরণ অনুসারে। তার কবর স্থান নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।[৩] শিয়া সূত্র অনুসারে, কাব ছিলেন একজন ইহুদি রাব্বি, যিনি ইয়েমেন থেকে বিলাদ আল-শাম (সিরিয়া) চলে আসেন।[৮] তিনি যু রাঈন বা যুল কিলা বংশের ছিলেন। উমরের সময় কাব মদিনায় আসেন যেখানে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। উসমানের যুগ পর্যন্ত তিনি সেখানে বসবাস করেন।[৯]

সুন্নি দৃষ্টিভঙ্গি সম্পাদনা

১৪শ শতকের সুন্নি শাফেয়ী বিদ্যান ইবনে হাজার আসকালানি লিখেছেন,

কাব ইবনে মাতি আল-হিমিয়ারী, আবু ইসহাক, কাব আল-আহবার নামে পরিচিত। তিনি বিশ্বস্ত (সিকাহ)। তিনি ২য় [তাবাকাহ] এর অন্তর্ভুক্ত। তিনি জাহিলিয়াত ও ইসলাম উভয় যুগই পেয়েছেন। শামে [~সিরিয়া] যাওয়ার আগে তিনি ইয়েমেনে থাকতেন। তিনি উসমানের খিলাফতের সময় ১০০ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। তার কোনো বর্ণনাই বুখারীতে নেই। মুসলিমে আবু হুরায়রা থেকে তার একটি বর্ণনা রয়েছে তার থেকে আবু সালেহ থেকে আল-আমাশ থেকে।[৮]

আল-তাবারি তার নবী ও রাজাদের ইতিহাসে কাব সম্পর্কে অনেকবার উদ্ধৃত করেছেন।[১০] অন্যান্য সুন্নি লেখকরাও কাবের সাথে খলিফা উমর, উসমান এবং মুয়াবিয়ার ঘটনা বর্ণনা করেছেন।[১১]

কাতারের আওকাফ এবং ইসলাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পরিচালিত এবং মালিকানাধীন একটি ওয়েবসাইটে কাব আহবার সম্পর্কে একটি ফতোয়া উপলব্ধ রয়েছে।[১২]

হাদীসের উল্লেখ সম্পাদনা

কাব আহবার কিছু হাদীস সংকলনে উল্লেখিত হয়েছেন। যেমন: সহীহ মুসলিম এবং মুয়াত্তা মালিক ইত্যাদি। এমনকি একটি হাদিসে বর্ণিত হয়েছে যে, খলিফা উমর ইবনুল খাত্তাব তাকে ব্যক্তিগতভাবে সকল মুসলিমের আমির হিসেবে অভিষিক্ত করেছিলেন।

বারো শিয়াদের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পাদনা

শিয়াদের বর্ণনায় কাবকে একজন অনির্ভরযোগ্য ব্যক্তি হিসেবে দেখানো হয়েছে। মুহাম্মাদ তিজানি, বিংশ শতাব্দীর একজন শিয়া পণ্ডিত লিখেছেন যে, সে ছিল একজন ইহুদী। যে উমর ইবনুল খাত্তাবের সময় ইয়েমেন থেকে মদিনায় এসেছিল এবং ইসলাম গ্রহণের ভান করেছিল।[১৩] মুহাম্মাদ জাওয়াদ চিররি একটি হাদিস উদ্ধৃত করে লিখেছেন, এই আলোচনার দ্বারা কাবের বিভ্রান্তিকর শয়তানী পরামর্শের ব্যাপারে আমাদের সতর্ক থাকা উচিত। এর দ্বারা মুসলিম এবং ইসলামের বহু ক্ষতি সাধিত হয়েছে।[১৪] কাবের ব্যক্তিত্বকে শিয়া ইসলামে খর্ব করা হয়েছে।[১৩][১৪]

ইহুদি পক্ষপাতের অভিযোগ সম্পাদনা

কিছু বর্ণনা তাকে ইসলামে ইহুদি বর্ণনা প্রচারের জন্য অভিযুক্ত করেছে।[৩] উদাহরণতঃ আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসকাবের একটি মতকে নিয়ে বিতর্ক করেছেন। কাব বলেছিলেন, বিচার দিবসে সূর্য ও চন্দ্রকে দুটি বোকা ষাঁড়ের চেহারা প্রদান করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। আত তাবারির মতে, ইবেন আব্বাস উত্তর দিয়েছিলেন: "কাব কথাটি মিথ্যা বলেছে।" তিনি কুরআনের তিনটি আয়াত দিয়ে প্রমাণ করেন যে, সূর্য ও চন্দ্র আল্লাহর অনুগত। তিনি কাবকে ইহুদি শ্রুতিকথা প্রচারের চেষ্টা করার জন্য অভিযুক্ত করে থাকবেন।[১৫]

ইহুদি-খ্রিস্টান কিংবদন্তি সম্পাদনা

উনবিংশ শতাব্দির রব্বি জোসেফ সুয়ার্জ বলেন, তিনি সুন্নি বর্ণনাগুলো উন্নয়নের সাথে যুক্ত।[১৬][১৭][১৮] ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের লিরান ইয়াগদার বলেছেন যে, কাবের সুন্নি বর্ণনাগুলোর ক্ষেত্রে খুব বেশি প্রভাব ছিল না এবং বলেছেন "খ্রিস্টান ও ইহুদিরা ইসলামের উত্থানের বিষয়ে কাবকে তাদের কিংবদন্তিতে গ্রহণ করেছিল, ইহুদি ধর্মান্তরিতদের উল্লেখ করে কুরআনের বিশ্বাসযোগ্যতা খণ্ডন করতে চেয়ে তাদের কিংবদন্তিতে যুক্ত করেছিল। যেমন, কাব যিনি কা' শাস্ত্রকে ভেতর থেকে কলুষিত করেছেন"।[১৯]

আরও দেখুন সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. العيني, محمود بن أحمد العينتابي/بدر الدين (২০০৬-০১-০১)। مغاني الأخيار في شرح أسامي رجال معاني الآثار 1-3 ج3 (আরবি ভাষায়)। Dar Al Kotob Al Ilmiyah دار الكتب العلمية। 
  2. "Composition of Hadith and Its Causes"Al-Islam.org (ইংরেজি ভাষায়)। ২০১৬-১২-১৩। ২০১৯-০৩-২৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৩-২০ 
  3. Encyclopaedia of Islam Schmitz, M. (1974). "Kaʿb al-Aḥbār". Encyclopaedia of Islam. 4 (2nd ed.). Brill. pp. 316–317. ISBN 9004057455.
  4. Ṭabarī (১৯৯৯-১১-০৪)। The History of Al-Tabari: The Sasanids, the Lakhmids, and Yemen। SUNY Press। পৃষ্ঠা 146। আইএসবিএন 978-0-7914-4356-9 
  5. The History of al-Tabari, vol. XII, Albany: State University of New York Press 2007, pp. 194-195
  6. Yusuf ibn Abd-al-Barr - al-Istiab, v3, p1287 Printed in Cairo 1380 A.H
  7. Tarikh al-Tabari v4, p191 Printed by Dar al-Maarif - Cairo
  8. Ibn Hajar Asqalani, Taqrib al-Tahdhib, Op Cit., p. 135.
  9. "The Companions and the Jewish Influence Part 1"Al-Islam.org। ৪ অক্টোবর ২০০৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। 
  10. See: Tarikh al-Tabari v4, p191, v1, p62-63. Printed by Dar al-Maarif – Cairo.
  11. See: Mahmood Abu Rayyah, in his book Adhwa (lights) on AI-Sunnah AI-Muhammadiyyah, reported that Ibn Hajar Al-‘Asqalani, recorded in his book (Al-Isabah, part 5, page 323). Also, Yusuf ibn Abd-al-Barr – al-Istiab, v3, p1287 Printed in Cairo 1380 A.H
  12. "Kab al-Ahbar"। ১৮ আগস্ট ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। 
  13. The Shi'a: The Real Followers of the Sunnah by Muhammad al-Tijani chapter "Is it "the Book of Allah and my Progeny" or "the Book of Allah and my Sunnah"? ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২৮ সেপ্টেম্বর ২০০৭ তারিখে" on Al-Islam.org
  14. Chirri, Muhammad Jawad (১৯৮৬)। Did Muslims Other Than Shi'ites Borrow Religious Teachings from Jews?The Shi'ites Under Attackআইএসবিএন 0-942778-04-9। ২৬ জানু ২০০১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৮ সেপ্টেম্বর ২০০৭ – Al-Islam.org-এর মাধ্যমে। 
  15. Tabari - History of al-Tabari, v1, p62 - 63
  16. "Archived copy"। ১৮ আগস্ট ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২২ আগস্ট ২০১৭ 
  17. "Yakub of Syria (Ka'b al-Ahbar) Last Jewish Attempt at Islamic Leadership - Alsadiqin English"www.alsadiqin.org। ১৩ মে ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। 
  18. "KA'B AL-AḤBAR - JewishEncyclopedia.com"www.jewishencyclopedia.com। ১২ আগস্ট ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। 
  19. "The Ka'b al-Ahbar legends among Muslims, Christians and Jews"। ২২ আগস্ট ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১১ জানুয়ারি ২০২২