কাজী আরেফ আহমেদ

মুক্তিযোদ্ধা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও জাতীয় পতাকার অন্যতম রূপকার

কাজী আরেফ আহমেদ (৮ এপ্রিল ১৯৪২ - ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯) বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। তিনি ১৯৬২ সালে ছাত্রলীগের গোপন সংগঠন 'স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের কেন্দ্রীয় নিউক্লিয়াসের সদস্য ছিলেন।[১] তিনি বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার রূপকারদের মধ্যে অন্যতম। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ[২] বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বিএলএফ) বা মুজিব বাহিনী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।[৩]

কাজী আরেফ আহমেদ
জন্ম(১৯৪২-০৪-০৮)৮ এপ্রিল ১৯৪২
মৃত্যু১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯(1999-02-16) (বয়স ৫৬)
কালিদাসপুর, কুষ্টিয়া
মৃত্যুর কারণহত্যা
নাগরিকত্ববাংলাদেশবাংলাদেশী
পেশাবাংলাদেশরাজনীতিবিদ
পরিচিতির কারণমুক্তিযুদ্ধের সংগঠক এবং
জাতীয় পতাকার অন্যতম রূপকার
রাজনৈতিক দলজাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ
দাম্পত্য সঙ্গীরওশন জাহান সাথী

কাজী আরেফ ছিলেন ছাত্রলীগের সমন্বয়ক ও বিএলএফ-এর গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে গঠিত জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠাতা। তিনি জাসদের কৃষক ফ্রন্ট জাতীয় কৃষক লীগের সভাপতি ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের কার্যকরী সভাপতি ছিলেন।[৪]

জন্ম ও শিক্ষা সম্পাদনা

কাজী আরেফের পৈত্রিক নিবাস কুষ্টিয়া জেলার মীরপুর উপজেলার খয়েরপুর গ্রামে। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর বাবার সাথে ঢাকায় চলে আসেন। ১৯৬০ সালে পুরান ঢাকার কলেজিয়েট স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন পাশ করেন। পরে জগন্নাথ কলেজে উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণিতে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে ১৯৬৬ সালে স্নাতক অর্জন করেন। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূগোল বিভাগে স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে ভর্তি হন। পাকিস্তান সরকার বিরোধী আন্দোলনের কারণে তিনি কালো তালিকাভুক্ত হন। ফলে তাকে স্নাতকোত্তর চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশ নিতে দেওয়া হয়নি।[৫]

রাজনীতি সম্পাদনা

কাজী আরেফ ১৯৬০ সালে জগন্নাথ কলেজের ছাত্রাবস্থায় রাজনীতিতে জড়িত হন। ১৯৬২ সালে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরেুদ্ধে আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। এ বছরই তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৩ সালে ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত তিনি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন।

পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক ও আরেফ ১৯৬২ সালে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে গোপন সংগঠন ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ গঠন করেন। পরবর্তীতে শাখাটি ‘নিউক্লিয়াস’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। তিন সদস্য বিশিষ্ট পরিষদটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের লক্ষ্যে যাবতীয় নীতি-কৌশল প্রনয়ণের কাজে নিয়োজিত হয়।[৬] ১৯৬৪ সালে আরেফের পৈত্রিক নিবাস পুরনো ঢাকার ১৪/৩ অভয় দাস লেনের বাড়িতে একটি সাইক্লোস্টাইল মেশিন স্থাপন করা হয়। এ মেশিনে মূদ্রিত ‘জয়বাংলা’ ও ‘বিপ্লবী বাংলা’[৬] নামে স্বাধীনতার ইশতেহার[৬] প্রচার করা হতো।

কাজী আরেফ বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর জাসদে যোগদান করেন। তিনি জাসদের মুখপত্র গণকণ্ঠ পত্রিকার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৭৮ সালে জাসদের কৃষক সংগঠন জাতীয় কৃষক লীগের সভাপতি এবং ১৯৭৯ সালে জাসদ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮৬ সালে তিনি জাসদ কেন্দ্রীয় প্রেসিডিয়ামের সদস্য নির্বাচিত হন। এরশাদের সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার সময় গ্রেফতার হন এবং ১৯৮৮ সালের ৩১ মার্চ মুক্তি পান। ১৯৯০-এর দশকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধীতাকারীদের বিচারের দাবিতে আন্দোলনেও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।[৭]

১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা সম্পাদনা

কাজী আরেফ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন মুজিব বাহিনীর হয়ে যুদ্ধে অংশ নেন। মুজিব বাহিনীর অন্যতম সংগঠক ছিলেন কাজী আরেফ আহমেদ। ভারতের কালসিতে "এইটটি লিডার্স"এর নেতৃত্ব পর্যায়ে ট্রেনিং গ্রহণ করেন তিনি। পরবর্তীতে পশ্চিমাঞ্চলীয় সেক্টরে মুজিব বাহিনীর উপপ্রধান হিসাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি বিএলএফ বা মুজিব বাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান ছিলেন এবং ছাত্রলীগের সমন্বয়কের দায়িত্বও পালন করতেন।[৮]

মৃত্যু ও হত্যার বিচার সম্পাদনা

কাজী আরেফ ১৯৯৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি কুষ্টিয়ার কালিদাসপুরে একটি জনসভায় বক্তব্যরত অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।[৯] দীর্ঘ বিচার শেষে ২০১৬ সালের ৭ জানুয়ারি রাতে কাজী আরেফ হত্যার ৩ আসামী কুষ্টিয়ার মিরপুরের রাজনগর গ্রামের হাবিবুর রহমান, কুর্শা গ্রামের আনোয়ার হোসেন ও রাশেদুল ইসলামের ফাঁসি কার্যকর হয়। [১০] [১১]

 
মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে কাজী আরেফের কবর

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. আহমেদ, শফি (১৬ জানুয়ারি ২০১৭)। "জাতীয় বীর কাজী আরেফ আহমেদ"। সংগ্রহের তারিখ ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ – newspaper-এর মাধ্যমে। 
  2. নুর, হোসাইন মোল্লা (২০ মার্চ ২০১৭)। "স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ বা নিউক্লিয়াস গঠন —-নূর হোসাইন মোল্লা"উৎস হিসাবে ব্যবহার। ২২ মার্চ ২০১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৪ মার্চ ২০১৮ – newspaper-এর মাধ্যমে। 
  3. লেখা (২০২১-০২-১৭)। "আত্মনিবেদিত জাতীয় বীর কাজী আরেফ"Prothomalo। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৬-০৯ [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  4. আম্বিয়া, শরীফ নুরুল (১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৪)। "কাজী আরেফ আহমেদ :কিছু স্মৃতি কিছু কথা"। ৪ মে ২০২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। 
  5. "কাজী আরেফ আহমেদের সজ্ঞা ও প্রজ্ঞা | Purboposhchimbd"Purboposchim। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৬-০৯ 
  6. ষাট দশকের ছাত্ররাজনীতি ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি লেখক কে বি এম মফিজুর রহমান খান
  7. BonikBarta। "কাজী আরেফ হত্যাকাণ্ড একজন প্রত্যক্ষদর্শীর স্মৃতিচারণ"কাজী আরেফ হত্যাকাণ্ড একজন প্রত্যক্ষদর্শীর স্মৃতিচারণ (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৬-০৯ 
  8. "কাজী আরেফ: যে আদর্শের মৃত্যু নেই"চ্যানেল আই অনলাইন (ইংরেজি ভাষায়)। ২০২৩-০২-১৬। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৬-০৯ 
  9. প্রতিবেদক, জ্যেষ্ঠ। "রওশন যে কাজী আরেফ হত্যার আসামি, জানত না সন্তানরা"bdnews24। ২০২৩-০৬-০৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৬-০৯ 
  10. প্রতিবেদক, নিজস্ব (২০১৬-০১-০৮)। "তিনজনের ফাঁসি কার্যকর"Prothomalo। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৬-০৯ 
  11. "কাজী আরেফ হত্যা মামলায় ফাঁসি কার্যকর আজ রাতে"BBC News বাংলা। ২০১৬-০১-০৭। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৬-০৯