কাঁথা বা খেতা বা কেন্থা বা শুজনি প্রধানত গ্রামবাংলার (বাংলাদেশভারতের পশ্চিমবঙ্গ) হাতে সেলাইয়ের কাজ করা আচ্ছাদন বস্ত্র।[১][২][৩] এটি কম্বলের তুলনায় পাতলা। প্রধানত শয্যাকালে গাত্র আচ্ছাদন হিসাবে এটি ব্যবহার করা হয়। সাধারণত: একাধিক পুরোনো শাড়ীর পরত দিয়ে কাঁথা তৈরী করা হয়। ফলে কাঁথা হয় মোলায়েম। এ কারণে ছোট বাচ্চাদের কাঁথায় জড়িয়ে রাখা হয়। কাঁথা লোকশিল্প হিসাবেও পরিগণিত। কাঁথায় যদি নকশাদার কাজ থাকে তবে তাকে নকশি কাঁথা বলে। পশ্চিমবঙ্গে অবশ্য নকশার কাজ করা বা না করা সব কাঁথাকেই কাঁথা বলে, যদিও ইদানীং নকশি কাঁথা শব্দের প্রচলন ঘটেছে [৪]

নির্মাণশৈলী সম্পাদনা

 
কাছে থেকে দেখা রাজশাহীর কাঁথা। বাম ও নিচের দিক জুড়ে কাঁথার পাড় দেখা যাচ্ছে। কাঁথার জমিনে সাধারণ কাঁথা ফোঁড়ে সাদা সুতা দিয়ে তরঙ্গ আকারে সেলাই দেয়া হয়েছে।

গ্রামাঞ্চলের নারীরা পাতলা কাপড়, প্রধানত পুরানো কাপড় স্তরে স্তরে সজ্জিত করে সেলাই করে কাঁথা তৈরি করে থাকেন। কাঁথা মিতব্যয়ীতার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ, এখানে একাধিক পুরানো জিনিস একত্রিত করে নতুন একটি প্রয়োজনীয় জিনিস তৈরি করা হয়। কাঁথা তৈরির কাজে পুরানো শাড়ি, লুঙ্গি, ধুতি ইত্যাদি ব্যবহৃত হয়। প্রয়োজন অনুযায়ী কাঁথার পুরুত্ব কম বা বেশি হয়। পুরুত্ব অনুসারে তিন থেকে সাতটি শাড়ি স্তরে স্তরে সাজিয়ে নিয়ে স্তরগুলোকে সেলাইয়ের মাধ্যমে জুড়ে দিয়ে কাঁথা তৈরি করা হয়। সাধারণ বা কাঁথাফোঁড়ে তরঙ্গ আকারে সেলাই দিয়ে শাড়ীর স্তরগুলোকে জুড়ে দেয়া হয়। বিভিন্ন রঙের পুরানো কাপড় স্তরীভূত করা থাকে বলে কাঁথাগুলো দেখতে বাহারী রঙের হয়। সাধারণত শাড়ীর রঙ্গীন পাড় থেকে তোলা সুতা দিয়ে কাঁথা সেলাই করা হয় এবং শাড়ীর পাড়ের অনুকরণে কাঁথাতে নকশা করা হয়। তবে কোন কোন অঞ্চলে (প্রধানত রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকায়) কাপড় বোনার সুতা দিয়েও কাঁথাতে নকশা করা হয়ে থাকে[৫]। সাধারণ কাঁথা কয়েক পাল্লা কাপড় কাঁথাফোঁড়ে সেলাই করা হলেও এই ফোঁড় দেয়ার নৈপুণ্যের গুণে এতেই বিচিত্র বর্ণের নকশা, বর্ণিল তরঙ্গ ও বয়নভঙ্গির প্রকাশ ঘটে। নকশার সাথে মানানোর জন্য বা নতুন নকশার জন্য কাঁথার ফোঁড় ছোট বা বড় করা হয় অর্থাৎ ফোঁড়ের দৈর্ঘ্য ছোট-বড় করে বৈচিত্র্য আনা হয়। উনিশ শতকের কিছু কাঁথায় কাঁথাফোঁড়ের উদ্ভাবনী প্রয়োগকে কুশলতার সাথে ব্যবহার করার ফলে উজ্জ্বল চিত্রযুক্ত নকশা দেখা যায়[৬]। কাঁথাফোঁড়ের বৈচিত্র্য আছে এবং সেই অনুযায়ী এর দুটি নাম আছেঃ পাটি বা চাটাই ফোঁড় এবং কাইত্যা ফোঁড়[৭]

ব্যবহার সম্পাদনা

 
শিশুকে জড়িয়ে রাখার কাজে ব্যবহৃত কাঁথা

কাঁথার ব্যবহার বহুবিধ। বিছানা হিসেবে এবং অল্প শীতে গায়ে দেয়ার চাদর হিসেবে কাঁথার ব্যবহার সর্বাধিক[৮]। এছাড়াও নবজাতক ও ছোট শিশুদেরকে শুইয়ে রাখার জন্য এবং তাদের শরীরে পেঁচিয়ে বা জড়িয়ে রাখার জন্য নরম কাপড়ের তৈরি কাঁথা ব্যবহার হয়। আয়না, কাজলদানি (অনেক সময়ে টেবিল ঢাকার কাজেও) জাতীয় হালকা জিনিসের ঢাকনা থেকে শুরু করে কাপড়চোপড় বা ভারী কিছুর ঢাকনি হিসেবেও কাঁথা ব্যবহৃত হয়। এমনকি জায়নামাজ হিসেবেও কাঁথার ব্যবহার রয়েছে[৯]

প্রকারভেদ সম্পাদনা

কাঁথা তৈরির সময় যে ফোঁড় দেয়া হয় তার নকশার উপরে নির্ভর করে কাঁথার তিন প্রকার রূপ রয়েছে।

  • নকশি কাঁথা - সাধারণত বিশেষ উপলক্ষে ব্যবহৃত এই কাঁথাগুলোর নকশা নৈপূণ্যের সাথে কূশলী হাতে করা হয় এবং পুরূষানুক্রমিকভাবে এই কাঁথা সংরক্ষণ করা হয়। জসীমউদ্‌দীনের কাব্যগ্রন্থ নকশি কাঁথার মাঠ (প্রথম প্রকাশ ১৯২৯) থেকে বাংলাদেশে এই নামকরণ জনপ্রিয় হয়েছে[৪]
  • পাড়তোলা কাঁথা - এই কাঁথার পুরোটাতেই শাড়ির পাড়ের মত নকশা করা থাকে।
  • লহরী বা লোহিরা কাঁথা - এই কাঁথায় মোটা সুতা দিয়ে ঘন কাজ করা থাকে।

ব্যবহারভেদে কাঁথার প্রকারও বিভিন্ন হয়। ব্যবহারভেদে কাঁথার বিভিন্ন নামকরণও হয়েছে। বিভিন্ন প্রকারের কাঁথার নাম ও ব্যবহার নিম্নরূপ[৮][৯]

  • লেপ-কাঁথা - আকারে বড় ও মোটা হয়।
  • শুজনি কাঁথা - লেপ কাঁথার মত বড় আকারের, তবে এই কাঁথা পাতলা হয়।
  • রূমাল কাঁথা - সাধারণত এক বর্গফুট আকারের কাঁথা।
  • আসন কাঁথা - বসার কাজে ব্যবহৃত হয়।
  • বস্তানি বা গাত্রি - ভারী ও মূল্যবান জিনিসপত্র এবং কাপড় চোপড় ঢেকে রাখার জন্য ব্যবহৃত হয়।
  • আর্শিলতা - আর্শি (আরশি) বা আয়না, চিরুনি ইত্যাদি ঢেকে রাখার কাজে ব্যবহার হয়।
  • দস্তরখান - খাবার সময় মেঝেতে পেতে তার উপরে খাবার দাবার ও বাসনপত্র রাখা হয়।
  • গিলাফ - খাম আকারের এই কাঁথার মধ্যে কোরআন শরীফ রাখা হয়।
 
বিছানাতে পাতার কাজে ব্যবহৃত কাঁথা


আরও দেখুন সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Zaman, Niaz. (১৯৯৩)। The art of kantha embroidery (২য় সংস্করণ)। Dhaka, Bangladesh: University Press। আইএসবিএন 984-05-1228-5ওসিএলসি 30159129 
  2. Dhamija, Jasleen (২০০৪)। Asian Embroidery (ইংরেজি ভাষায়)। Abhinav Publications। আইএসবিএন 978-81-7017-450-9 
  3. Kantha : the embroidered quilts of Bengal from the Jill and Sheldon Bonovitz collection and the Stella Kramrisch collection of the Philadelphia Museum of Art। Mason, Darielle., Ghosh, Pika, 1969-। Philadelphia, PA: Philadelphia Museum of Art। ২০০৯। আইএসবিএন 978-0-87633-218-4ওসিএলসি 326626421 
  4. "বাংলাপিডিয়া নকশী কাঁথা নিবন্ধ ১ম প্যারা"। ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১১ জুলাই ২০০৯ 
  5. "বাংলাপিডিয়া নকশী কাঁথা নিবন্ধ ২য় প্যারা"। ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১১ জুলাই ২০০৯ 
  6. "বাংলাপিডিয়া নকশী কাঁথা নিবন্ধ ৪র্থ প্যারা"। ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১১ জুলাই ২০০৯ 
  7. "বাংলাপিডিয়া নকশী কাঁথা নিবন্ধ ৫ম প্যারা"। ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১১ জুলাই ২০০৯ 
  8. আর্কাইভ ডট কম
  9. "বাংলাপিডিয়া নকশী কাঁথা নিবন্ধ ৩য় প্যারা"। ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১১ জুলাই ২০০৯