মাটির গভীর থেকে কয়লা নিষ্কাশন করার পদ্ধতিই হলো কয়লা খনন। কয়লা তার মধ্যে বিদ্যমান প্রচুর শক্তির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে পরিচিত এবং ১৮৮০ সাল থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ব্যাপকভাবে ব্যবহার হয়ে আসছে। এছাড়াও লোহা এবং সিমেন্ট শিল্পে কয়লার ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। মূলত লোহার আকরিক হতে লোহা নিষ্কাশন এবং সিমেন্ট উৎপাদনে কয়লা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যুক্তরাজ্য ও দক্ষিণ আফ্রিকাতে কয়লা এবং এর গঠনকে কয়লার খনি এবং কয়লার খনিতে প্রবেশের গর্ত পথকে পিট বলা হয়। অস্ট্রেলিয়াতে কয়লার খনি বলতে মাটির নিচে অবস্থিত কয়লার আকরিককে এবং যুক্তরাষ্ট্রে কয়লাখনি শব্দটি দ্বারা কয়লা উত্তোলনের পদ্ধতিকে বুঝানো হয়। বর্তমানে এ শব্দটির আর তেমন প্রচলন নেই।

ভার্জিনিয়ার একটি কয়লা খনি থেকে শ্রমিকদের বেরিয়ে আসার দৃশ্য (১৯৭৪)

একসময় কয়লা খনন করা একটি অন্যতম জটিল, ঝুঁকিপূর্ণ, সময় সাপেক্ষ এবং ব্যায়বহুল কাজ ছিলো। তখন কেবল মানব শ্রমিক দ্বারা হাতুড়, কোরাল এবং বেলচার সাহায্যে কয়লা খনন করা হতো। বর্তমানে প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে কয়লা খনন ও উত্তোলনের কাজ সহজ হতে সহজতর হয়েছে। এখন নানা ধরনের যন্ত্র যেমন: ট্রলার, ট্রাক, কয়লা কাটার যন্ত্র ইত্যাদি ব্যবহৃত হচ্ছে।

ইতিহাস সম্পাদনা

ক্ষুদ্র পরিসরে কয়লা খনন শুরু হয় আজ থেকে হাজার বছর আগেই। দ্বিতীয় শতকের শেষের দিকে ব্রিটেনের রোমানরা বড় বড় কয়লার খনি আবিষ্কার করে এবং তার ব্যবহার শুরু করে। ১৮ শতকে ব্রিটেনে এবং তার পরবর্তী সময়ে ইউরোপউত্তর আমেরিকায় শিল্প বিপ্লবের সূচনা হয়। এই শিল্প বিপ্লবের পেছনে মূল অবদানই ছিলো কয়লা ব্যবহার করে বাষ্প ইঞ্জিন চালনা করা। যখন থেকে রেলগাড়ি ও জাহাজে কয়লা চালিত বাষ্প ইঞ্জিনের ব্যবহার শুরু হয় তখন থেকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ব্যাপকভাবে প্রসার লাভ করে।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে কয়লা খনন করা হতো শুধু কোরাল এবং বেলচা ব্যবহার করে আবার সে সময় ছোট ছোট শিশুদের বিপদজ্জনক কাজ করার জন্য মাটির নিচে পাঠানো হতো। কয়লা কাঁটার জন্য নানা ধরনের যন্ত্র আবিষ্কৃত হয় ১৮৪০ সালের দিকে এবং ১৯১২ সালের দিকে সেগুলো মাঠ পর্যায় ব্যবহার শুরু হয়।

নিষ্কাশন পদ্ধতি সম্পাদনা

কয়লা নিষ্কাশনের জন্য নানা ধরনের পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে। এর মধ্যে কয়লার স্তর, গুণমান যাচাই, অর্থনৈতিক বিষয়াদি-লাভের পরিমান এবং ভৌগোলিক ও পরিবেশের অবস্থা বিবেচনার মাধ্যমে বিভিন্ন কয়লার খনির ক্ষেত্রে বিভিন্ন পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। এছাড়াও কয়লা ভূ পৃষ্ঠের উপরিতল থেকে নাকি গভীর থেকে নিষ্কাশন করা হবো তার ওপর ভিত্তি করে নিষ্কাশন পদ্ধতি পৃথক করা হয়।

নানা ধরনের নিষ্কাশন পদ্ধতির মধ্যে কিছু পদ্ধতি সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো:

পৃষ্ঠ খনন সম্পাদনা

যখন কয়লা পৃষ্ঠ ত্বকের খুব কাছাকাছি থাকে তখন বাণিজ্যিকভাবে পৃষ্ঠ খনন করার মাধ্যমে কয়লা নিষ্কাশন করা হয়। এক্ষেত্রে কয়লা কেঁটে উত্তোলন করা হয়। মূলত মাটির গভীর থেকে কয়লা নিষ্কাশনের চেয়ে পৃষ্ঠ থেকে কয়লা নিষ্কাশন বেশি লাভজনক হওয়ায় এই পদ্ধতিটি বহুল ব্যবহৃত। কেননা মাটির গভীরে কয়লার অবস্থান সম্পর্কে সঠিকভাবে আগাম ধারণা পাওয়া সম্ভব না এবং মাটির গভীর থেকে কয়লা নিষ্কাশনে যন্ত্রপাতির ব্যবহারে অনেক বেশি খরচ হয়।

কয়লা নিষ্কাশনের কার্যপদ্ধতি

১। প্রথমে কয়লার ওপরের মাটি এবং অন্যান্য স্তর সরানোর জন্য এগুলোকে চূর্ণ করা হয়।

২। চূর্ণ করার জন্য নানা ধরনের বিষ্ফোরক ব্যবহার করা হয়।

৩। এরপর খননকারীরা বেলচা দিয়ে চূর্ণ বিচূর্ণ অংশগুলো একটি ট্রাকে পূর্ণ করে অন্যত্র অপসারণ করে।

৪। উন্মুক্ত কয়লার স্তরকে এবার নানাভাবে কেঁটে ছোট ছোট অংশে পরিণত করা হয় এবং এগুলোকে ট্রাকে করে কয়লার প্লান্টে বা যেখানে ব্যবহার করা হবে সরাসরি সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্যে বিটুমিনাস কয়লা নিষ্কাশনে এ পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও কানাডা,  অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকাতে তরল ও কঠিন উভয় কয়লা নিষ্কাশনে এই পদ্ধতি বহুল ব্যবহৃত। পৃষ্ঠ খননের মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়াতে প্রায় ৮০ শতাংশ,  যুক্তরাষ্ট্রে ৬৭ শতাংশ এবং সমগ্র বিশ্বে প্রায় ৪০ শতাংশ কয়লা নিষ্কাশন করা হয়।

ফালা করে খনন

কয়লাকে কয়েকটি স্তরে ভাগ করে এক অংশ এক অংশ করে নিষ্কাশন করার পদ্ধতিই হলো ফালা করে নিষ্কাশন বা Strip Mining। এই পদ্ধতিতে প্রথমে একটি অংশের ওপরের মাটি অপসারণ করা হয়। এলক্ষ্যে প্রথমে মাটিতে কিছু গর্ত করে তার মধ্যে নানা ধরনের বিষ্ফোরক দ্বারা পূর্ণ করা হয়। এরপর এগুলো বিষ্ফোরিত হলে মাটি ফেটে আলগা হয়ে যায়। অতঃপর খননকারীরা বেলচা দিয়ে মাটি কেঁটে ট্রাকে ভর্তি করে এবং খনন এলাকার বাইরে অনত্র্য ফেলে দেয়। এক্ষেত্রে যন্ত্র দ্বারা বা খননকারীরা নিজ হস্তে কয়লা টুকরা করে এবং ঐ স্থান হতে ট্রাকে করে নিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে অর্থাৎ কয়লা প্লান্টে বা যেখানে ব্যবহার করা হবে সেখানে সরাসরি নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর তার পাশের অংশ থেকে মাটি সরিয়ে সেগুলো পূর্ব কয়লা নিষ্কাশন কৃত অংশে ফেলা হয়। এভাবে পর্যায় ক্রমে এই কাজ চলতে থাকে। সমভূমি হতে কয়লা নিষ্কাশনের জন্য এ পদ্ধতিটি সবচেয়ে বেশি কার্যকর এবং সেই সব এলাকায় কয়লার বয়স কমপক্ষে ৫০ বছর বা তার ঊর্ধ্বে।

সীমার মধ্যে খনন

দুইটি পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থান বা পাহাড়ের চারদিক হতে কয়লা নিষ্কাশনের জন্য এ পদ্ধতিটি ব্যবহৃত হয়। এই পদ্ধতিতে কয়লা নিষ্কাশনের জন্য প্রথমে কয়লার ওপর থেকে মাটি এবং অন্যান্য উপাদানগুলো নির্দিষ্ট নকশা বা পরিকল্পনা অনুসারে অপসারণ করা হয়। এই পদ্ধতি একদা খাড়া বা উঁচু ভূমির মাটি সরানোর জন্য ব্যবহৃত হতো। কিন্তু এই পদ্ধতিতে নানা ধরনের অসুবিধার সৃষ্টি হয়। কয়লার স্তর আছে এমন অংশ বাদ দিয়েও আশেপাশে বৃহৎ অংশের প্রয়োজন হয়। আবার মাটি সরানোর ফলে পাহাড়ের ক্ষয় সাধিত হয় এবং ভূমি ধসের মতো সমস্যার সঞ্চার করে। ফলস্বরূপ এই সমস্যাগুলো প্রকোপ কমানোর জন্য নানা ধরনের বিকল্প পদ্ধতি আবিষ্কার করার চেষ্টা করা হয়। এই নতুন গবেষণার মূল লক্ষ্য ছিলো এমন পদ্ধতি আবিষ্কার করা যাতে কয়লা নিষ্কাশন করার পর ওই অঞ্চল সাথে সাথে পুনরায় মাটি দ্বারা পূরণ করে ভুমি ধস রোধ করা সম্ভব হয়।

এই পদ্ধতিতে কয়লা নিষ্কাশন করার সময় ইচ্ছা করেই ১৫ থেকে ২০ ফিট কয়লার স্তর রেখে দিতে হয় যাতে ভূমি ধস না হয় এবং এর ওপর মাটি দিলে তা আকড়ে রাখতে পারে। এই পদ্ধতিতে কয়লা নিষ্কাশন অর্থমৈতিক ও বাণিজ্যিকভাবে খুব একটা লাভ জনক না। যখন কাজ পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে নির্দিষ্ট সীমানায় পৌঁছে যায় তারপর আর কয়লা নিষ্কাশন করা হয় না। ফলে অনেক কয়লা নিষ্কাশিত হয় না এবং লাভের পরিমান আশানুরূপ হয় না।

পাহাড়ের চূড়া সরিয়ে খনন

পাহাড়ের চূড়া সরিয়ে খনন করার পদ্ধতিটি মূলত পৃষ্ঠ খননের অনুরূপ। এই পদ্ধতিতে কয়লা নিষ্কাশনের জন্য পাহাড়ের চূড়াকে যন্ত্র দ্বারা সমান্তরালে কেঁটে অন্যত্র পার্শ্ববর্তী সমান্তরাল ভূমিতে  রাখা হয়। কয়লার স্তর দৃশ্যমান হলে পৃষ্ঠখনন পদ্ধতির অনুরূপে কয়লা কেঁটে টুকরো টুকরো করে নিষ্কাশন করা হয়। কয়লা নিষ্কাশন শেষে ঐ অংশটি পুনরায় কেঁটে রাখা মাটি দ্বারা পূর্ণ করা হয়। এই পদ্ধতিতে কয়লা নিষ্কাশন অনেক বিতর্কিত কেননা এক্ষেত্রে পাহাড়ের অনেক ক্ষতি সাধন হয়।

আরও দেখুন সম্পাদনা