কমিউন দ্যু পারি

পারির বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক সরকার

কমিউন দ্যু পারি (ফরাসি: Commune de Paris) বা ইংরেজিতে প্যারিস কমিউন [ফরাসি commune শব্দের অর্থ শহর বা জেলা] হচ্ছে ১৮৭১ সালের ১৮ মার্চ থেকে ২৮ মে পর্যন্ত প্যারিস পরিচালনাকারী বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক সরকার। প্যারিসের মজুরদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত শ্রমিক শ্রেণির এই বিপ্লবী সরকার ৭৩ দিন টিকে থাকে। কমিউনের নির্বাচন ২৬ মার্চ অনুষ্ঠিত হয় এবং উক্ত নির্বাচনে ২০,০০০ অধিবাসীর বিপরীতে একজন হিসেবে ৯২ সদস্যের একটি কমিউন কাউন্সিল নির্বাচিত করা হয়।[৭] প্যারিস কমিউন রাষ্ট্র থেকে গির্জা এবং গির্জা থেকে স্কুলকে বিচ্ছিন্ন করে, স্থায়ী সৈন্যবাহিনীর বদলে আনে সর্বজনীন রূপে সশস্ত্র জনগণকে, জনগণ কর্তৃক বিচারক ও রাষ্ট্রের কর্মচারীদের নির্বাচন চালু করে, স্থির করে রাষ্ট্রের কর্মচারীদের বেতন শ্রমিকদের বেতনের বেশি হওয়া চলবে না, শ্রমিক ও শহুরে গরিবদের অর্থনৈতিক অবস্থা উন্নয়নে একগুচ্ছ ব্যবস্থা ইত্যাদি নেয়।[৮] কার্ল মার্কসের ভাষায় প্যারিস কমিউন ছিল প্রথম শ্রেনীহীন রাষ্ট্র, যেখানে সর্বহারার একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা হয়। মার্ক্স ধারণা করেছিলেন কমিউনের পতন ঘটতে পারে কারণ উপযুক্ত সময় এবং পরিস্থিতি ব্যতিরেকে এই সশস্ত্র সংগ্রামে শ্রমিক শ্রেনী সাময়িক বিজয়ী হয়েছে। এতদসত্ত্বেও তিনি মনে করেছেন সমাজতান্ত্রিক ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে কমিউনের গুরুত্ব অপরিসীম।[৯]

কমিউন দ্যু পারি
মূল যুদ্ধ: ফ্রাঙ্কো-প্রুশিয়ান যুদ্ধে প্যারিস অবরোধের পরের অংশ

A barricade on Rue Voltaire, after its capture by the regular army during the Bloody Week
তারিখ১৮ মার্চ - ২৮ মে ১৮৭১
অবস্থান
প্যারিস, ফ্রান্স
ফলাফল বিদ্রোহ দমন
বিবাদমান পক্ষ

ফ্রান্স French Republic

Communards
National Guards
সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী
ফ্রান্স Patrice de MacMahon, Duke of Magenta
শক্তি
১৭০, ০০০[১] On paper, 200,000; in reality, probably between 25,000 and 50,000 actual combatants[২]
হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি
৮৭৭ নিহত, ৬,৪৫৪ আহত এবং ১৮৩ নিখোঁজ রয়েছে[৩] ৬,৬৬৭ জন নিহত এবং সমাহিত নিশ্চিত হয়েছিল;[৪] unconfirmed estimates between 10,000[৫] and 20,000[৬] killed

প্যারিস কমিউনের বৈশিষ্ট্য সম্পাদনা

প্যারিস কমিউন ছিল পৃথিবীর প্রথম প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্বের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন এক রাষ্ট্র। ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের রাষ্ট্র ও বিপ্লব নামক বইটি পাঠ করলেও বোঝা যাবে যে ১৮৭১ সালের প্যারিস কমিউনের অভিজ্ঞতার আলোকে শ্রমিক শ্রেণির একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার শর্তগুলো তিনি কীভাবে উপস্থাপন করেছেন। ইতিহাসের সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠিত শ্রমিক রাষ্ট্র প্যারিস কমিউনের প্রধান চারটি র্শত ছিল, যেমন,[১০]

  1. কোন প্রকার স্থায়ী সেনাবাহিনী থাকবে না বরং সাধারণ জনগনের দ্বারাই তৈরী হবে সশস্ত্র বাহিনী। ‘কমিউনের প্রথম ডিক্রিই ছিল স্থায়ী সৈন্যবাহিনীর বিলোপ ও সশস্ত্র জনগণ দিয়ে তার স্থান পূরণ’।
  2. একজন দক্ষ শ্রমিকের চেয়ে কোনো অবস্থাতেই কোনো সরকারি র্কমকর্তা বেশি বেতন পাবেন না। ‘রাষ্ট্রের বড় চাকুরেদের সংগে সংগে তাদের সমস্ত বিশেষ সুবিধা ও প্রতিনিধিত্ব ভাতাও দূর’ করা হয়েছিল। ‘রাষ্ট্রের সমস্ত পদাধিকারীর বেতন হবে মজুরের বেতনের সমান’।
  3. সরকারে সকল স্তরের র্কমকর্তাগণ অবশ্যই জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হবেন এবং প্রয়োজনে তাদেরকে অপসারণের অধিকারও থাকবে। ‘কমিউন গঠিত হয় প্যারিসের বিভিন্ন পল্লীতে সর্বজনীন ভোটে নির্বাচিত পৌর পরিষদ সভ্যদের নিয়ে। তারা ছিল জবাবদিহিতে বাধ্য এবং যে কোনো সময়ে অপসারণীয়। স্বভাবতই তাদের অধিকাংশই ছিল শ্রমিক, অথবা শ্রমিক শ্রেণির স্বীকৃত প্রতিনিধি।
  4. নির্ধারিত সময়ান্তে প্রত্যেক ব্যক্তিই অর্থনীতি ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে পরিচালনার কাজে অংশগ্রহণ করবেন। লেনিনের কথায়, ‘যদি প্রত্যেকেই আমলা হয়ে যান, তবে আর কেহই আমলা থাকবেন না’। ‘রাষ্ট্রক্ষমতার কাজগুলো যত চালাবে সর্বজনগণ, ততই হ্রাস পাচ্ছে সে ক্ষমতার প্রয়োজনীয়তা’। মার্কস লেখেন, ‘কমিউনের অস্তিত্বটাই ছিলো স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে, স্থানীয় আত্মশাসনের সংগে জড়িত’।

বিপ্লব দমন সম্পাদনা

১৮৭১ সালের ২১ মে তিয়েরের প্রতিবিপ্লবী সৈন্য প্যারিস প্রবেশ করে ও প্যারিস শ্রমিকদের ওপর নিষ্ঠুর দমননীতি চালায়। প্রায় ৩০,০০০ জন নিহত, ৫০,০০০ জন ধৃত ও হাজার হাজার লোক কারাদণ্ডিত হয়।[৮] বুর্জোয়া সেনাপতিবৃন্দের ঘোষিত নীতি ছিল 'কোনো দয়ামায়া দেখানো চলবে না'। কমিউনার্ড বা কমিউনের সেনানীদের দমন করতে তারা যে ভয়াবহ অত্যাচার ও বর্বরতার পরিচয় দিয়েছিল তা বর্ণনাতীত। যত্রতত্র গুলি করে, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে, আগুন দিয়ে ইত্যাকার উপায়ে ভার্সাই সেনারা হত্যা করে সাধারন মানুষদের। এমনকি এই গনহত্যা থেকে নারী, শিশু, বৃদ্ধরাও ছাড় পায়নি।[৯]

আরো দেখুন সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "Les aspects militaires de la Commune par le colonel Rol-Tanguy"। Association des Amies et Amis de la Commune de Paris 1871। ৪ মার্চ ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৪ 
  2. Milza, 2009a, p. 319
  3. উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; Versailles1875 নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি
  4. Tombs, Robert, "How Bloody was la Semaine sanglante of 1871? A Revision". The Historical Journal, September 2012, vol. 55, issue 03, pp. 619–704
  5. Rougerie, Jacques, La Commune de 1871," p. 118
  6. উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; Lissagaray1 নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি
  7. Rougerie, Jacques, La Commune de Paris. Paris: Presses Universitaires de France. আইএসবিএন ৯৭৮-২-১৩-০৬২০৭৮-৫.
  8. লেনিন, মার্কস-এঙ্গেলস-মার্কসবাদ, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, ১৯৭৫, পৃষ্ঠা-১৫১
  9. অমলেন্দু সেনগুপ্ত (১৯৮৭)। প্যারী কমিউন। কলকাতা: মনীষা গ্রন্থালয়। পৃষ্ঠা ১৬৭, ১৯০। 
  10. সাদি, অনুপ (ফেব্রুয়ারি ২০১৫)। সমাজতন্ত্র (১ সংস্করণ)। ঢাকা: ভাষাপ্রকাশ। পৃষ্ঠা ৮৫–৯০। আইএসবিএন 978-984-91013-8-3 

পুস্তকসমূহ সম্পাদনা

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা