এপিকুরোস

প্রাচীন গ্রিসের দার্শনিক

এপিকুরোস (গ্রিক: Έπίκουρος; পাশ্চাত্যে এপিকিউরাস নামে পরিচিত) (খ্রিস্টপূর্ব ৩৪১ - খ্রিস্টপূর্ব ২৭০) প্রাচীন গ্রিসের বিখ্যাত দার্শনিক ও এপিকুরোসবাদ নামে পরিচিত দার্শনিক ধারার জনক। তার প্রায় ৩০০টি রচনার মধ্যে বর্তমানে মাত্র গুটিকতক অবশিষ্ট আছে। তাই, এপিকুরোস সম্বন্ধে আমরা যা জানি তার অধিকাংশই পরবর্তী দার্শনিকদের লেখা ও ভাষ্যকারদের ভাষ্য থেকে।

Έπίκουρος এপিকুরোস
যুগপ্রাচীন দর্শন
অঞ্চলপাশ্চাত্য দর্শন
ধারাএপিকুরোসবাদ
প্রধান আগ্রহ
পরমাণুবাদ, সুখবাদ
উল্লেখযোগ্য অবদান
'Moving' pleasures (κατὰ κίνησιν ἡδοναί) and 'static' pleasures (καταστηματικαὶ ἡδοναί)[১]

এপিকুরোসের মতে, সুখ-শান্তিই মানব জীবনের পরম লক্ষ্য এবং এটাই পরম শুভ। তার দর্শনে সুখ অর্জনের উপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্বারোপ করা হয়। আপোনিয়া তথা ব্যথা ও ভয় থেকে মুক্তির মাধ্যমেই এই সুখ অর্জন করা সম্ভব। তিনি শিক্ষা দিতেন, ভালোর পরিমাপক হচ্ছে আনন্দ আর মন্দের পরিমাপক হচ্ছে ব্যথা। তার মানে, উনি সব কিছুকে সুখের কষ্টিপাথরে যাচাই করে নিতে বলতেন। তিনি বলতেন, মানুষের বন্ধু-বান্ধবের সাথে মিলেমিশে স্বয়ম্ভর জীবন যাপন করা উচিত। তার মতে, মৃত্যুর মাধ্যমে দেহ এবং আত্মা উভয়ই শেষ হয়ে যায়, সুতরাং একে ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই। তিনি আরও মনে করতেন, মহাবিশ্ব অসীম ও চিরন্তন, এবং এই সুবিশাল মহাবিশ্বের মধ্যে সকল ঘটনাই শূন্যদেশের মধ্যে পরমাণুর চলাচল ও মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে ঘটে।

জীবনী সম্পাদনা

এপিকুরোসের বাবা Neocles এবং মা Chaerestrate দুজনেই এথেন্সের নাগরিক ছিলেন। তার জন্মের ১০ বছর আগে (৩৪১ খ্রিস্টপূর্বাব্দের ফেব্রুয়ারিতে) তার বাবা-মা এথেন্স থেকে আইগায়ো সাগরের এথেনীয় উপনিবেশ সামোস দ্বীপে চলে আসেন। এখানেই ৩৪২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এপিকুরোসের জন্ম হয়। তার শৈশব ও বাল্যশিক্ষা সম্বন্ধে তেমন কিছু জানা যায়নি। দিওগেনেস লায়ের্তিওস তার সম্পর্কে যা লিখে গেছেন তা-ই তার জীবনী সম্পর্কে আমাদের প্রধান অবলম্বন। জানা যায়, বালক এপিকুরোস প্লেটোবাদী শিক্ষক পাম্ফিলোস এর কাছে চার বছর দর্শন পড়েছিলেন।

সামরিক বাহিনীতে দুই বছর সেবা দেয়ার জন্য ১৮ বছর বয়সে এথেন্সে যান। তখন আকাদেমির প্রধান ছিলেন ক্সেনোক্রাতেসএরিস্টটল-ও বেঁচে ছিলেন। ৩২২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তিনি যখন মারা যান তখন এপিকুরোসের বয়স ২০ বছর। সে সময় নাট্যকার মেনান্দ্রোস-ও সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছিলেন। এপিকুরোস ও মেনান্দ্রোস সমবয়সী ছিলেন। এই সময়টাতেই তার দার্শনিক মতাবলীর গঠন প্রক্রিয়া শুরু হয়। এথেন্সের দশন তখন অস্তগামী। কয়েকজন শিক্ষক কেবল লাইসিয়ামে বসে মানুষকে শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন, বাকি অঞ্চলের অবস্থা বেশ খারাপ। এ কারণে দার্শনিকদের সম্বন্ধে এপিকুরোস অনেক বিরূপ ভাব পোষণ করতে শুরু করেন। এরিস্টটলপ্লেটো দুজনেকেই বিদ্রুপ করেন, আর ইরাক্লেইতোস কে বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এটা খুব আশ্চর্যের ব্যাপার যে, গ্রিক দার্শনিকদের প্রবল প্রতাপের যুগে, তিনি প্লেটো ও এরিস্টটলের মতবাদের দ্বারা মোটেই প্রভাবিত হননি।[২]

৩২৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মহামতি আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর তার অন্যতম প্রধান সেনানায়ক পের্দিকাস এথেনীয়দেরকে সামোস থেকে কোলোফন-এ তাড়িয়ে দেন। সামরিক সেবা শেষে এপিকুরোস কোলোফনেই তার পরিবারের সাথে মিলিত হন। এখানেই দেমোক্রিতোসের অনুসারী নাওসিফানেস-এর কাছে পড়াশোনা করেন। ৩১১/৩১০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে মিতিলিনি শহরে শিক্ষকতা শুরু করেন। কিন্তু কিছু বিষয়ে বিবাদের কারণে তাকে এই শহর থেকে চলে যেতে বাধ্য করা হয়। এরপর লাম্প্‌সাকোস শহরে স্কুল খোলেন। ৩০৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এথেন্সে ফিরে আসেন।

এথেন্সে একটি বাগান ক্রয় করেন যার অবস্থান ছিল Stoa of Attalos এবং আকাদেমির মাঝামাঝি স্থানে। শোনা যায়, প্লেটোর আকাদেমি আর এরিস্টটলের লাইসিয়ামের মত এই বাগানেও প্রচুর শিক্ষার্থী আসতো। তাদের সবার কাছেই এপিকুরোস ছিলেন পরম শ্রদ্ধার পাত্র। বাগনটি "এপিকুরোসের বাগান" নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল। দিওগেনেস লিখেন, বিরুদ্ধবাদীরা কিছু অপবাদ রটালেও প্রকৃতপক্ষে এপিকুরোস ছিলেন খুব নরম মনের মানুষ, উদার ও বন্ধুবৎসল। মৃত্যুকালীন উইলে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে তার বন্ধুদের সন্তানদের জন্য অর্থ-সম্পত্তি বরাদ্দ করেন এবং একজন উত্তরসূরী মনোনীত করেন। তার মৃত্যুর পর এপিকুরোসবাদীদের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন এরমার্খোস

এপিকুরোস কোনদিন বিয়ে করেননি, জানা মতে তার কোন সন্তানও ছিল না। কিডনিতে পাথর হয়েছিল। রোগে ভুগে ২৭০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ৭২ বছর বয়সে তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর আগে খুব অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও ইদোমেনেউস-কে লিখেন,

এপিকুরোসের দর্শনের উপর পূববর্তী অনেক দর্শন ও দার্শনিকের প্রভাব আছে। কিন্তু তার কাজের মৌলিকত্বও খুব গুরুত্বপূর্ণ। তিনি দেমোক্রিতোসের দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন ঠিকই, কিন্তু দেমোক্রিতোসের সাথে নিয়তিবাদ বিষয়ে তার বিশাল পার্থক্য ছিল। এপিকুরোস নিজে অবশ্য তার উপর দেমোক্রিতোসের প্রভাব স্বীকার করেননি। তিনি অন্য দার্শনিকদের দ্বিধান্বিত বলে আখ্যায়িত করেছেন এবং নিজেকে স্ব-শিক্ষিত দাবী করেছেন।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Diogenes Laërtius, The Lives and Opinions of Eminent Philosophers, X:136.
  2. ধীমান দাশগুপ্ত, বিজ্ঞানী চরিতাভিধান; বাণীশিল্প, কলকাতা; জানুয়ারি, ১৯৮৬; পৃষ্ঠা-৩১৬-৩১৭

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা