উইলিয়াম মরিস ডেভিস

আমেরিকান ভূগোলবিদ


উইলিয়াম মরিস ডেভিস (ইংরাজী: William Morris Davis) (ফেব্রুয়ারি ১২, ১৮৫০ - ফেব্রুয়ারি ৫, ১৯৩৪) একজন আমেরিকান ভূগোলবিদ, ভূমিরূপবিদ, এবং আবহাওয়াবিদ ছিলেন। তাঁকে প্রায়ই "আমেরিকান ভূগোল-এর জনক" বলা হয়।

উইলিয়াম মরিস ডেভিস
জন্ম(১৮৫০-০২-১২)১২ ফেব্রুয়ারি ১৮৫০
মৃত্যু৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৪(1934-02-05) (বয়স ৮৩)
জাতীয়তাযুক্তরাষ্ট্র
পরিচিতির কারণক্ষয় চক্র; পেনেপ্লেইন; প্রায়ই বলা হয় "আমেরিকান ভূগোল-এর জনক"
আত্মীয়এডওয়ার্ড এম. ডেভিস (পিতা)
মারিয়া মট ডেভিস (মাতা)
পুরস্কারহেডেন মেমোরিয়াল ভূতাত্ত্বিক পুরস্কার (১৯১৭)
ভেগা পদক (১৯২০)
পেনরোজ পদক (১৯৩১)
বৈজ্ঞানিক কর্মজীবন
কর্মক্ষেত্রভূগোল, ভূরূপ গঠন বিদ্যা (জিওমরফোজি), ভূতত্ব, আবহাওয়াবিদ্যা[১]
যাদেরকে প্রভাবিত করেছেনচার্লস কটন[২]
জোভান সিভিজিক[৩]
ডগলাস উইলসন জনসন[৪]
ওয়ালথার পেনচক[৫]
হান্স রিউশ্চ[৬]
ওয়াল্টার রেক[৭]

তিনি ফিলাডেলফিয়া, পেনসিলভানিয়ার এক বিশিষ্ট কোকার পরিবারে জন্মে ছিলেন। তিনি ছিলেন এম. ডেভিস এবং মারিয়া মট ডেভিস (মহিলাবিষয়ক আইনজীবী লুক্রিয়াতি মট-এর কন্যা) এর পুত্র। তিনি হার্ভার্ডের লরেন্স সায়েন্টিফিক স্কুলে ভূতত্ত্ব এবং ভূগোল অধ্যয়ন করেছিলেন। তারপর তিনি কলোরাডো অঞ্চলে হার্ভার্ডের পৃষ্ঠপোষকতায় চালিত ভৌগোলিক অন্বেষণকারী দলে যোগ দেন। এতে নেতৃত্বে দিয়েছিলেন ভূতত্ত্বের সূচনকারী স্টারগিস-হুপার অধ্যাপক জোশিয়া ডুইট হুইটনিয়ে। ১৮,০০০ ফুট বা তারও উচ্চ শিখরের রকি পর্বতমালা সম্পর্কিত বুনো গল্পগুলি লুইসিয়ানা ক্রয়-এর পর প্রচার শুরু হয়েছিল। হার্ভার্ড অভিযানে সে সব কিছুরই বাস্তবতা খুঁজে পাওয়া যায় নি। তবে তাঁরা "১৪ইআরএস" (১৪,০০০-প্লাস ফিট) সন্ধান পেয়েছিলে। তিনি ১৮৬৯ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন এবং পরের বছরে মাইনিং ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের স্নাতকোত্তর লাভ করেন। [৮] ডেভিস ফিল্ড সহকারী হিসাবে নাথানিয়েল শালার-এর হয়ে কাজ করেছিলেন এবং পরে হার্ভার্ডে পড়ানোর কাজে নিযুক্ত হন। [৮] যদিও তাঁর বিষয় ছিল ভূমিরূপ গঠনবিদ্যা, তা সত্ত্বেও প্রাকৃতিক ভূগোল সম্পর্কে তাঁর লেখায় বৈজ্ঞানিক বর্ণবাদের তত্ত্বগুলিকে আরও উন্নত করেছিলেন। [৯]

তাঁর প্রথম স্ত্রী মারা যাওয়ার পরে ডেভিস ১৯১৪ সালে ম্যাসাচুসেটসের কেমব্রিজ বাসিন্দা মেরি এম. উইম্যানকে বিয়ে করেন। তাঁরও মৃত্যুর পরে তিনি ১৯৮৮ সালে ম্যাসাচুসেটসের মিল্টন নিবাসী লুসি এল. টেন্যান্টকে বিয়ে করেন।

তাঁর ৮৪ তম জন্মদিনের কিছু আগে ক্যালিফোর্নিয়ার প্যাসাডেনায় মৃত্যু হয়। তাঁর কেমব্রিজের বাড়িটি এখন একটি জাতীয় ঐতিহাসিক ল্যান্ডমার্ক

বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি সম্পাদনা

আবহাওয়াবিদ্যা সম্পাদনা

ডেভিস প্রথমে আর্জেন্টিনার কর্ডোবায় তিন বছরের জন্য আবহাওয়াবিদ হিসাবে কাজ করেছিলেন। নাথানিয়েল শালার-এর সহকারী হিসাবে কাজ করার পরে, তিনি ১৮৭৯ সালে হার্ভার্ডে ভূতত্ত্বের প্রশিক্ষক হন। একই বছর তিনি ম্যাসাচুসেটসের স্প্রিংফিল্ড-এর অধিবাসী এলেন বি. ওয়ার্নারকে বিয়ে করেন। ডেভিস কখনও তাঁর পিএইচডি সম্পূর্ণ করেন নি। তবুও তিনি ১৮৯০ সালে প্রথম পূর্ণ অধ্যাপক হিসাবে নিযুক্ত হন এবং সারা জীবন একাডেমিয়ায় এবং শিক্ষকতায় যুক্ত ছিলেন।

ক্ষয় চক্র তত্ত্ব সম্পাদনা

ডেভিসের ছিল একাগ্র এবং তীক্ষ্ণ প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা। তিনি ছিলেন সুদক্ষ যৌক্তিক বিশ্লেষক এবং দুঃসাহসী পর্যবেক্ষণ ও ধ্যান-ধারণা বিশিষ্ট বুদ্ধিমান সংশ্লেষক।[৮] তাঁর নিজস্ব ক্ষেত্র পর্যবেক্ষণ এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর পশ্চিমী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল সমীক্ষকদের তৈরি গবেষণা থেকে তিনি তার সবচেয়ে প্রভাবশালী বৈজ্ঞানিক অবদান: "ভৌগোলিক চক্র" রচনা করেছিলেন। ১৮৮৯ সালে তাঁর নিবন্ধ দ্য রিভারস অ্যান্ড ভ্যালিজ অফ পেনসিলভেনিয়া-তে প্রথম তাঁর তত্ত্বটিকে রূপদান করেন।[১] তাতে তিনি দেখিয়েছিলেন কি ভাবে নদী ক্ষয়ের মাধ্যমে উচ্চভূমির উপাদানকে নিম্ন ভূমি তে বয়ে নিয়ে আসে। তিনি এরাসমাস এবং চার্লস ডারউইন এবং জ্যঁ-ব্যাপটিস্ট ল্যামার্ক-এর কাজে অনুপ্রাণিত হওয়ার কারণে এতে একটি জোরালো বিবর্তনীয় ছাপ ছিল ব'লে লক্ষ্য করা যায়। তাঁর ক্ষয় চক্রের প্রস্তাব মতো (বৃহত্তর) নদীগুলির বিকাশের তিনটি প্রধান পর্যায় রয়েছে - যৌবন, পরিণত এবং বার্ধক্য।[১০] প্রতিটি পর্বে সুনির্দিষ্ট ভূমিরূপ-এর বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায় এবং সেসব ঘটতে পারে নদীর উপরের, মধ্যের এবং নিম্নের গতিপথে।

যদিও ক্ষয়চক্রটি ভূমিরূপ গঠনবিদ্যায় তাঁর একটি প্রাথমিক অবদান ছিল, ভূদৃশ্যের বিবর্তন সম্পর্কিত ডেভিসের অনেক তত্ত্ব, যাকে কখনও কখনও 'ডেভিসিয়ান ভূমিরূপ গঠনবিদ্যা' বলা হয়, সে সব পরবর্তী ভূমিরূপ গঠনবিদ্যা বিশেষজ্ঞদের দ্বারা তীব্র সমালোচিত হয়েছিল। ১৯১১ সালে ডেভিস যখন হার্ভার্ড থেকে অবসর গ্রহণ করেন, তখন ভূদৃশ্য বিবর্তনের অধ্যয়নটিতে তাঁর তত্ত্বগুলির প্রায় একচেটিয়া আধিপত্য ছিল। ডেভিসের বৈশিষ্ট্য ছিল, সমালোচনার প্রতি রূঢ় ও ঘৃণাপূর্ণ প্রতিক্রিয়া দেখানো। বিশেষ করে ওয়ালথার পেনক-এর নেতৃত্বে ১৯২০ এর দশকে জার্মান সমালোচনার প্রতি এমনই বৈরী ছিলেন। তিনি সেইসব সমালোচনার সবচেয়ে দুর্বল দিকগুলিকে বাছাই করে আক্রমণ করতেন এবং সেটিই ছিল তাঁর বিশেষ বৈশিষ্ট্য। [১১] সেই সময় থেকে, কিছুটা স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি এবং বৃহত্তর জ্ঞান নিয়ে, কিছু লেখক লক্ষ্য করেন, আধুনিক টেকটোনিক তত্ত্বর আবির্ভাবে পেনক এবং ডেভিসের ধারণাটি আরও সুসংগত এবং এমনকি পরস্পরের পরিপূরক হয়ে উঠেছে। তাঁদের দাবি যে ডেভিসের ধারণাগুলি সক্রিয় সীমানার কাছে আরও প্রযোজ্য যেখানে টেকটোনিক্সগুলি "বিপর্যয়কর" অবস্থায় রয়েছে এবং পেনকের ধারণাগুলি নিষ্ক্রিয় সীমানা এবং মহাদেশীয় প্ল্যাটফর্মগুলির মডেলে আরও ভালভাবে খাপ খায়। [১২]

প্রাকৃতিক ভূগোল ও বৈজ্ঞানিক বর্ণবাদে অবদান সম্পাদনা

তিনি ১৯০৪ সালে আমেরিকান জিওগ্রাফার্স অ্যাসোসিয়েশন-এর একজন প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন এবং প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক বছরগুলিতে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির সাথে প্রচুরভাবে জড়িত ছিলেন। ঐ পত্রিকার জন্য বেশ কয়েকটি নিবন্ধ লিখেছিলেন। ডেভিস ১৯১১ সালে হার্ভার্ড থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ১৯১১ সালে আমেরিকান জিওলজিকাল সোসাইটির সভাপতি হিসাবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন।[১৩][১৪] ১৯১৯ সালে তিনি রয়্যাল জিওগ্রাফিকাল সোসাইটির প্যাট্রনস স্বর্ণপদক লাভ করেন।[১৫]

তাঁর পাঠ্যপুস্তক এলিমেন্টাল ফিজিক্যাল জিওগ্রাফি তে "মানবজাতির অগ্রগতিতে ভৌগোলিক সহায়তা (জিওগ্রাফিক্যাল এইড ইন হিউম্যান প্রগ্রেস)" শীর্ষক একটি অধ্যায় অন্তর্ভুক্ত করেছেন। সেখানে ডেভিস বিবরণ দিয়েছেন, কীভাবে ভূদৃশ্যে প্রাকৃতিক ভূগোলের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে "বর্বরতা থেকে মানুষের সভ্য রাষ্ট্রের দিকে অগ্রগতি" ঘটেছে। ডেভিস সেখানে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে "[ইউরোপীয়] জাতির শীর্ষস্থানীয় দেশগুলি বিশ্বের সর্বাধিক উন্নত জাতি" এবং "জাতিগুলির মধ্যে কয়েকটি মাত্র [কালো, বাদামী এবং লাল] জাতি সভ্যতার দিকে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি অর্জন করেছে।"[১৬] পাঠ্যপুস্তকের এই অধ্যায় থেকে উদাহরণ হিসাব দেখা যায়: ডেভিস কীভাবে বৈজ্ঞানিক বর্ণবাদ-এর তত্ত্ব প্রচার করেছিলেন। এই বিষয়ের একই মত প্রকাশ করেছেন তাঁর পরামর্শদাতা এবং সহকর্মী নাথানিয়েল শ্যালারও এবং সম্ভবত তাঁর দ্বারা তিনি প্রভাবিত হয়েছিলেন। ডেভিস ডারউইনের জীববৈজ্ঞানিক ধারণাগুলি থেকে ধার নিয়ে এই সব প্রাকৃতিক ভূদৃশ্য এবং জলবায়ুর ক্ষেত্রে এক প্রকার সামাজিক ডারউইনবাদী চিন্তায় প্রয়োগ ঘটিয়ে তার নামকরণ করেছিলেন পরিবেশগত নির্ধারণবাদ" বলে। তাঁর কাজ ভূগোলবিদ এবং লেখক এলসওয়ার্থ হান্টিংটন-এর উপর প্রভাব ফেলেছিল। হার্ভার্ডে ডেভিসের ছাত্র হিসাবে তিনি জলবায়ু ও ভূগোল দ্বারা মানব সংস্কৃতিতে পার্থক্য ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছিলেন। উদাহরণ হিসাবে কানাডা ও বাহামায় ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত সম্প্রদায়ের তুলনা করেছেন এবং সিদ্ধান্ত টেনেছেন ইঙ্গ বাহামিয়ানদের ধীরগতির কারণ তাদের সেখানের জলবায়ু এবং কৃষ্ণাঙ্গদের সাথে তাদের সান্নিধ্য। [৯]

উত্তরাধিকার সম্পাদনা

নাথার্স্ট ল্যান্ড-এর স্পিটসবার্জেন, সোভালবার্ড-এ অবস্থিত ডেভিসডালেন উপত্যকাটির নামকরণ করা হয়েছে তাঁরই নামে।[১৭]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Pruyne, John; Jon T. Kilpinen (১৯৯৬-১১-০২)। "William Morris Davis"। Valparaiso University Department of Geography and Meteorology। ২০১০-০৮-২৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১০-০৮-১৮Davis' contributions cover the separate fields of geography, geology, and meteorology. 
  2. Chorley, Richard J.; Beckinsale, Robert P.; Dunn, Antony J. (২০০৫) [1973]। "Chapter Twenty-Two"। The History of the Study of Landforms। Volume Two। Taylor & Francis e-Library। পৃষ্ঠা 569। 
  3. Ford, Derek (২০০৭)। "Jovan Cvijić and the founding of karst geomorphology"Environmental Geology51: 675–684। ডিওআই:10.1007/s00254-006-0379-x 
  4. Walter H. Bunch (১৯৪৬)। "Biographical Memoir of Douglas Wilson Johnson 1878–1944" (পিডিএফ)। National Academy Of Sciences। সংগ্রহের তারিখ ২০১৭-০৯-২০ 
  5. Chorley et al. 2005, p. 614
  6. Gjessing, Just (১৯৬৭)। "Norway's Paleic Surface"। Norsk Geografisk Tidsskrift21 (2): 69–132। ডিওআই:10.1080/00291956708621854 
  7. Lidmar-Bergströrm, Karna (১৯৯৬)। "Long term morphotectonic evolution in Sweden"Geomorphology। Elsevier। 16: 33–59। 
  8. Koch, Philip। "William Morris Davis: Brief live of a pioneering geomorphologist: 1850-1934"Harvard Magazine। Harvard। সংগ্রহের তারিখ ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮ 
  9. Frazier, John W. (২০১৯-০৫-২০)। Race And Place: Equity Issues In Urban America (ইংরেজি ভাষায়)। Routledge। আইএসবিএন 9780429977510 
  10. Robert L Bates, Julia A Jackson, ed. Dictionary of Geological Terms: Third Edition, p. 125 (1984) American Geological Institute
  11. Chorley et al. 2005, p. 519
  12. Saadi, Allaoua (২০১৩), "Modelos morfogenéticos e tectônica global: Reflexőes conciliatórias", Geonomos (Portuguese ভাষায়), 6 (2): 55–63, ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা, সংগ্রহের তারিখ ২২ সেপ্টেম্বর ২০২০ 
  13. Fairchild, Herman LeRoy, 1932, The Geological Society of America 1888-1930, a Chapter in Earth Science History: New York, The Geological Society of America, 232 p.
  14. Eckel, Edwin, 1982, GSA Memoir 155, The Geological Society of America — Life History of a Learned Society: Boulder, Colorado, Geological Society of America Memoir 155, 168 p., আইএসবিএন ০-৮১৩৭-১১৫৫-X.
  15. "List of Past Gold Medal Winners" (পিডিএফ)। Royal Geographical Society। ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১১ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৪ আগস্ট ২০১৫ 
  16. Davis, William Morris (১৯০২)। Elementary physical geography। Boston: Ginn। 
  17. "Davisdalen (Svalbard)"Norwegian Polar Institute। ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫