ইহুদি ধর্মে নারী

ইহুদি ধর্মে নারীর ভূমিকা

ইহুদি ধর্মে নারীদের ভূমিকা বিভিন্ন বিষয় দ্বারা নির্ধারিত হয়, যার মধ্যে রয়েছে: তোরাহ, মৌখিক ইহুদি আইন, রীতিনীতি এবং সাংস্কৃতিক বিষয়গুলি যা ধর্মের সাথে ঘনিষ্ঠ বা দূরবর্তী নয়। তা সত্ত্বেও, তোরাহতে অনেক মহিলার উদাহরণ উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ ইহুদি শরীয়তে নারীর প্রতি আচরণ বিভিন্ন পরিস্থিতি অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়। ইহুদি ইতিহাসে একজন ব্যক্তি ইহুদি হিসেবে বিবেচিত হয় না যদি না সে ইহুদি মায়ের কাছে জন্মগ্রহণ করে। যদিও বাবার নাম তোরাহতে ব্যবহৃত হয়। আর এরকম একজন নারীর নাম হচ্ছেন "যাকোবের মেয়ে দিনা"।[১]

প্রাথমিক বাইবেলের যুগ সম্পাদনা

তোরাহতে খুব অল্প সংখ্যক নারীর নাম আছে যাদেরকে সাধারণভাবে কম গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। এসমস্ত নারীর নাম অপ্রচলিত হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন ইবরাহিম নবীর স্ত্রী সাইয়েদা সারা; ইয়াকুব নবীর স্ত্রী রেফকা ও রাহিল; লিয়া, মুসার বোন মারয়াম, কাজি দেবুরাহ, হেলদা নবী, দাউদের স্ত্রী আবিজাইল, রাহাব ও উসতির। ইহুদিরা বিশ্বাস করে যে, এ নারীদের অনেকে উল্লেখযোগ্য কাজে ছিল যা তাদেরকে খ্যাতি দিছে। যেমন মুসা নবীর মারয়াম এবং দাউদ নবীর স্ত্রী। ইবরাহিমের রব আল্লাহ সিনাই পাহাড়ে বনী ইসরাইলের সামনে আগমন করেছিলেন। তাওরাত জোর দিয়ে বলেছে সেখানে নর-নারী সবাই উপস্থিত ছিল। যদিও তাওরাতের এ যায়গায় পুরুষের কথা উল্লেখ আছে এবং পারিবারিক জীবনে পুরুষরা স্ত্রী-সন্তান ও দাসদের দেখাশুনা করবে, আর নারীরা হবে সেখানে আবশ্যকীয় তবে সরাসরি নয়।[২] প্রথমিক তাওরাতীয় যুগে পারিবারিক বিধান ছিল যে পুরুষরা নারীর সাথে ন্যায়বিচার করবে। আর এটা তখনই করবে যখন পুরুষ তাকে বিবাহ করবে। কিন্তু একজন স্ত্রী স্বামীর মতের বাইরে তাকে তালাক দিতে পারত না। বাস্তব কথা হলো যে তাওরাতে বলা আছে একজন নারীর কুমারীত্ব শেষ হলেও পুরুষের কিছু যায় আসে না। এমনিভাবে নারী সম্পর্কে তাওরাতে অনেক বিষয় উল্লেখ আছে। তাওরাতে নারী-পুরুষের এই মতবিরোধ প্রথম যুগ থেকে পাওয়া যায়। আর তা হলো নারী পুরুষের অনুগতা হয়ে থাকবে। কেননা পুরুষ তাদের খাদ্য ও বাসস্থান দিয়ে থাকে।[৩] এটা বাদেও নারীদের আত্মিক জীবনটা ভালো ছিল। তারা উপাসনালায়ে গমন করতে পারত, ঈদের দিনে কুরবানি দিতে পারত, সন্তান জন্মদানের সময় ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে পারত ইত্যাদি। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পুরুষের আধিপত্য ছিল। সম্পদের মালিকানায় নারীর কোন অধিকার ছিল না। তারা মৃত্যু স্বামীর পরিত্যাক্ত সম্পদে অংশ পেত না, যদি সন্তান না থাকত। ইহা সত্ত্বেও একজন নারী অন্য বিবাহ করতে পারত[৩] যেমন বিজ্ঞ ইহুদি জুন বুকার মত দেন। তিনি আরও বলেন যে নারী-পুরুষরা আলাদা আলাদা ভাবে ইবাদতগৃহে উপাসনা করবে। কিন্তু তারা দ্বিতীয় হাইকালে ইবাদতের জন্য যেতে পারবে না।[৪]

মধ্যযুগ সম্পাদনা

 
ইসফাহান শহর থেকে একটি ইহুদি বিবাহ চুক্তি

এ পরিস্থিতিতে ইহুদি নারীদের নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করা কঠিন ছিল, কারণ খ্রিস্টান ও মুসলিম সমাজে ইহুদিদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসাবে বিবেচনা করা হতো। আব্রাহাম গ্রসম্যান তাঁর বই দ্য “পিয়াস অ্যান্ড রেবেলিয়াস”-এ মধ্যযুগীয় ইউরোপে ইহুদি নারীদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রভাবিত করে এমন বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলেছেন এবং তাদের তিনভাগে বিভক্ত করেছেন: বাইবেলীয় ঐতিহ্য, তালমুদীয় ঐতিহ্য এবং ইহুদিদের মাঝে অ-ইহুদি সম্প্রদায় যারা ইহুদি হয়ে জীবনযাপন করে ও ইহুদি কাজ কর্। আর ইহুদিদের অর্থনৈতিক অবস্থা নারীদের ধ্বংস করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখেছিল।[৫]

মধ্যযুগ ছিল ইহুদি নারীদের ধর্মীয় আকাঙ্ক্ষা এবং সেই সময়কার ইহুদি নারীদের বাস্তবতার মধ্যে দ্বন্দ্ব নিয়ে, যা একই সময়ে খ্রিস্টান নারীদের বাস্তবতার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ ছিল।[৬] এই পরিস্থিতির অন্যতম কারণ ছিল মিডওয়াইফারি নারীদের পরিত্যাগ করার জন্য এমনভাবে দাবি করেছিল যে তাদের পুরুষদের সাথে সমতার দিকে নিয়ে আসবে।[৭]

মধ্যযুগে ইহুদি ধর্মে অনেক ধর্মীয় উন্নতি ছিল। আমরা দেখতে পাই যে মহিলাদের তাওরাতের শিক্ষার উপর নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করা হয়েছিল, এবং নারীরা প্রার্থনার সময় দলগতভাবে উপস্থিত হত।[৮] এছাড়া, মহিলারা ইহুদি ধর্মের অনুষ্ঠানগুলিতে প্রকাশ্যে অংশগ্রহণ করতে শুরু করে। এমন কিছু মহিলা ছিল যারা হিব্রুতে কীভাবে আচার অনুষ্ঠান করতে হয় তা শিখেছিল।[৯] পঞ্চদশ শতাব্দীর কিছু আশকেনাজি সম্প্রদায়ের মধ্যে পাদরিদের স্ত্রীরা তাদের স্বামীর মতো পোশাক পরত, এমন কিছু প্রমাণও পাওয়া গেছে।[৭]

পারিবারিক জীবন সম্পাদনা

মধ্যযুগে ইহুদি মনীষীদের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে, নারীরা বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ এবং পারিবারিক সহিংসতার মধ্যে ছিল। প্রকৃতপক্ষে, ইহুদি ধর্মে বিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং পবিত্র বিষয় হিসেবে বিবেচিত এবং ইহুদি মনীষীরা এই বিষয়গুলিতে অনেক আলোচনা করেছেন। পাদরি গেরশোম বেন জুডাহ আশ্কেনাজি ইহুদি সম্প্রদায়ের মধ্যে বহুবিবাহ নিষিদ্ধ করে একটি ডিক্রি জারি করেন। এর পরে, পাদরিরা অনেক কর্মসূচি তৈরি করেছিল যার লক্ষ্য ছিল নারীদের পাদরিদের আদালতে তালাকের জন্য দায়ের করতে সক্ষম করা। মোসা বিন মাইমন তার স্বামীকে ঘৃণা করলে তালাক চাওয়ার নারীর অধিকারের উপর জোর দেন, কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন যে মহিলাটি বন্দীর মতো নয়, তাকে ঘৃণা করে এমন কারো সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের জন্য বাধ্য করা হয়েছে। ইহুদি ধর্মের বিপরীতে, খ্রিস্টান ধর্ম বিবাহ বিচ্ছেদের বিষয়ে সতর্ক করেছিল এবং বিবাহকে একটি পবিত্র ধর্ম বলে মনে করছিল যা সমাধান করা যাবে না, ঈশ্বর যে বিবাহের ব্যবস্থা করেছেন, তা থেকে যেন কোন মানুষ আলাদা না হয়।" [১০] পাদরিরা পারিবারিক সহিংসতার বিষয়ে জোর দিয়েছিলেন। তারপর সে বলে, " স্বামীকে তার স্ত্রীকে মারার অনুমতি কে দিয়েছে?" রথেনবার্গের পাদরি মেইর বলেন: "স্ত্রীকে মারধর করা পৌত্তলিকদের আচরণ, কিন্তু ঈশ্বর আমাদেরকে তা করতে নিষেধ করেন এবং যে তা করে তাকে ইহুদি সম্প্রদায় থেকে বহিষ্কার এবং মারধরের শাস্তি দেওয়া হয়।" একই পাদ রায় দিয়েছিলেন যে একজন স্ত্রী যার স্বামী তাকে গালি দেয় এবং প্রহার করে তার স্বামীকে তালাক দিতে বাধ্য করতে এবং জরিমানা দিতে পিাদরীয় আদালতের আশ্রয় নেওয়ার অধিকার রয়েছে। এই বিধিগুলি সমাজে পাদরিদের দ্বারা করা হয়েছিল যেখানে স্ত্রী-প্রহার ছিল নিত্যনৈমিত্তিক।

শিক্ষা সম্পাদনা

শিক্ষায় ইহুদি নারীদের প্রবেশাধিকার ছিল সীমিত। ইহুদি মহিলাদের কীভাবে পড়া, লিখতে এবং গৃহস্থালি কাজ করতে হয় তা শেখানো হত। ইহুদি মহিলারা ইহুদি আইনের কিছু শিক্ষা পেয়েছিলেন যা দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োজনীয় ছিল, যেমন কোশার খাবার রান্না করা যা [৯] খ্রিস্টান এবং ইহুদি উভয় ধর্মের মেয়েকে তাদের বাড়িতে শেখানো হয়েছিল। কিছু খ্রিস্টান পরিবারে পুরুষ শিক্ষকদের পরিবারের মেয়েদের পড়ানোর অনুমতি ছিল, কিন্তু ইহুদি পরিবারগুলো প্রায়ই পুরুষ শিক্ষকদের অনুমতি দেয়নি। [১১] খ্রিস্টান এবং ইহুদি মেয়েদের জন্য উচ্চশিক্ষা পাওয়া যেত না, কিন্তু খ্রিস্টান মহিলাদের শিক্ষার জন্য মঠে প্রবেশের অধিকার ছিল। অনেক উৎস আছে যা নিশ্চিত করে যে, ইসলামী নিয়ন্ত্রণাধীন ভূমিতে বসবাসকারী ইহুদি মহিলাদের শিক্ষার সুযোগ ছিল। আমরা মধ্যপ্রাচ্যে অনেক শিক্ষিত ইহুদি মহিলাদের খুঁজে পাই। আমরা ইহুদি মহিলাদের দ্বারা লিখিত কিছু কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে অনেক উইল রেকর্ড, আইনি নথি এবং আবেদনপত্র খুঁজে পাই। [১২] আমরা অনেক ইহুদি মহিলাদেরও খুঁজে পাই যারা তাদের স্বামীদের তাদের দৈনন্দিন জীবনে এবং তাদের কাজে সাহায্য করার জন্য শিক্ষিত হয়েছিল।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Bowker, John (1997). World Religions: The Great Faiths Explored & Explained. London: Dorling Kindersley Limited. pp. 121, 131. ISBN 0-7894-1439-2.
  2. Hauptman, Judith. "Women." Etz Hayim: Torah and Commentary. Ed. David L. Lieber. The Jewish Publication Society, 2001. 1356-1359.
  3. Telushkin, Joseph. Biblical Literacy: The Most Important People, Events, and Ideas of the Hebrew Bible. New York: William Morrow and Company, 1997. p. 403.
  4. Bowker, John (1997). World Religions: The Great Faiths Explored & Explained. London: Dorling Kindersley Limited. p. 119. ISBN 0-7894-1439-2.
  5. Grossman, Avraham. Pious and Rebellious: Jewish Women in Medieval Europe. Translated from the Hebrew by Jonathan Chapman. Waltham, Mass: Brandeis University Press, 2004. 1.
  6. Baskin, Judith R. "Jewish Women in the Middle Ages." Jewish Women in Historical Perspective. Ed. Judith R. Baskin. Detroit: Wayne State University Press, 1991. 94.
  7. Ben-Sasson, H. H. "Spiritual and Social Creativity." A History of the Jewish People. Ed. Ben-Sasson. Cambridge, Massachusetts: Harvard University Press, 1976. 612–627. Print.
  8. Steinberg, 157–158.
  9. Baskin, Judith R. (Spring 1991). "Some Parallels in the Education of Medieval Jewish and Christian Women". Jewish History 5 (1): 42. doi:10.1007/bf01679792. Retrieved 21 November 2011.
  10. "إنجيل متى 19."। ১৭ জুন ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২১ 
  11. Baskin, Judith R. (Spring 1991). "Some Parallels in the Education of Medieval Jewish and Christian Women". Jewish History 5 (1): 43. doi:10.1007/bf01679792. Retrieved 21 November 2011.
  12. Melammed, 91–100.