ইয়াসুনি জাতীয় উদ্যান

ইকুয়েডরের জাতীয় উদ্যান

ইয়াসুনি জাতীয় উদ্যান (স্পেনীয়: Parque Nacional Yasuní) ইকুয়েডরে অবস্থিত।[১] আমাজনীয় ইকুয়েডরের নাপোপাস্তাজা প্রদেশের নাপোকুরারে নদীর মধ্যবর্তী এলাকায় এর অবস্থান। এ উদ্যানের আয়তন প্রায় ৯,৮২০ বর্গকিলোমিটার। মূলতঃ বৃষ্টিবহুল বনাঞ্চলে জাতীয় উদ্যানটি গড়ে তোলা হয়েছে। রাজধানী কিটো থেকে প্রায় ২৫০ কিলোমিটার দূরত্বে এ উদ্যানটি অবস্থিত। ১৯৮৯ সালে ইউনেস্কো বায়োস্পেফার সংরক্ষণ হিসেবে এ উদ্যানকে ঘোষণা করেছে। হুয়াওরানি আদিবাসী জনগোষ্ঠী এখানে বসবাস করে থাকে। এছাড়াও, তাগেইরিতারোমেনানে নামের দু'টি জনবিচ্ছিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠীরও আবাস এখানে।[২]

ইয়াসুনি জাতীয় উদ্যান
মানচিত্র
ইয়াসুনি জাতীয় উদ্যান (ঘন সবুজ)
অবস্থান ইকুয়েডর
নাপোপাস্তাজা প্রদেশ
স্থানাঙ্ক১°৫′ দক্ষিণ ৭৫°৫৫′ পশ্চিম / ১.০৮৩° দক্ষিণ ৭৫.৯১৭° পশ্চিম / -1.083; -75.917
আয়তন৯,৮২৩ বর্গকিলোমিটার (৩,৭৯৩ বর্গমাইল)
স্থাপিত২৬ জুলাই ১৯৭৯

জীববৈচিত্র্য সম্পাদনা

নিঃসন্দেহে বিশ্বের সর্বাপেক্ষা জীববৈচিত্র্যের অধিকারী উদ্যান হিসেবে ইয়াসুনি জাতীয় পার্কের সুখ্যাতি রয়েছে। উদ্যানটি ছোট্ট অঞ্চলের কেন্দ্রস্থলে গড়ে উঠেছে। উভচর প্রাণী, পাখি, স্তন্যপায়ী প্রাণী, স্বরীসৃপ, বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদের বৈচিত্রপূর্ণ সমাহার রয়েছে যা পশ্চিম গোলার্ধের সর্বাধিক বসবাস উপযোগী পরিবেশ বিদ্যমান। ১০০ বর্গ কিলোমিটারের কম এলাকায় স্থানীয় প্রজাতির গাছ, উভচর প্রাণী ও বাদুড় প্রজাতির বসবাসে উদ্যানটি বিশ্বরেকর্ড ভঙ্গ করেছে।[৩] এছাড়াও বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ স্থান হিসেবে স্থানীয় প্রজাতিরসহ পাখি ও স্তন্যপায়ী প্রাণীদের বিশাল সম্ভার রয়েছে।

ভূমির অবস্থানে তুলনামূলকভাবে ১৫০ প্রজাতির উভচর প্রাণী বসবাস করছে যা বিশ্বরেকর্ড। অন্যান্য স্থান বিশষতঃ পশ্চিম আমাজনে বসবাসরত উভচর প্রাণীর তুলনায়ও এটি শীর্ষস্থানে অবস্থান করছে।[৩] এমনকি সর্বমোট উভচর প্রাণীর সংখ্যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার সম্মিলিত সংখ্যার চেয়েও বেশি। পার্কে অবস্থানরত সরীসৃপ প্রজাতির প্রাণীর সংখ্যাও বেশ উচ্চ পর্যায়ের। কাগজপত্রে ১২১ প্রজাতির কথা লিপিবদ্ধ রয়েছে। আমাজন অববাহিকার তুলনায় আয়তনে মাত্র ০.১৫% ভাগ হওয়া স্বত্ত্বেও ইয়াসুনিতে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ উভচর ও সরীসৃপ প্রজাতির প্রাণীর আবাসস্থল। এছাড়াও, উদ্যানের জলাভূমিতে মাছের বৈচিত্রতাও সবিশেষ উল্লেখ্যযোগ্য। পরিচিত ৩৮২ প্রজাতির মাছ রয়েছে এখানে। এই সংখ্যা পুরো মিসিসিপি নদীর অববাহিকা পাওয়া মৎস্য প্রজাতির পরিমাণের চেয়েও অনেক বেশি। ইয়াসুনিতে কমপক্ষে ৫৯৬ প্রজাতির পাখি রয়েছে যা আমাজনের সাথে তুলনান্তে এক-তৃতীয়াংশ। উদ্যানে অগণিত বাদুড় প্রজাতিরও সমৃদ্ধ ভাণ্ডার। আঞ্চলিক মানদণ্ডে আমাজন অববাহিকায় ১১৭ প্রজাতির বাদুড় থাকলেও ইয়াসুনি তুলনামূলকভাবে অধিক সমৃদ্ধ। ইয়াসুনির এক হেক্টর ভূমিতে ১,০০,০০০-এর অধিক বিভিন্ন প্রজাতির পোকামাকড়ের বাসস্থান। যা খসড়াভাবে উত্তর আমেরিকার সবগুলো মিলিয়ে একই সংখ্যায় দাঁড়াবে। এছাড়াও উদ্যানে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ পর্যায়ের রক্তচোষা গাছপালা রয়েছে। বিশ্বের নয়টি জায়গার মধ্যে একটি হিসেবে প্রতি ১০,০০০ বর্গকিলোমিটারে ৪,০০০ অধিক রক্তচোষা গাছ বিদ্যমান। উদ্যানে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ, ঝোপঝাড় রয়েছে। এরফলে প্রামাণ্য দলিলে উদ্যানটি কমপক্ষে চারটি বিশ্বরেকর্ড ধারণ করে আছে। এছাড়াও, অরণ্যময় উদ্ভিদ প্রজাতিতে পুষ্পলতায় সমৃদ্ধ থাকায় বৈচিত্রতার দিক দিয়েও তিনটি বিশ্বরেকর্ডের অধিকারী এলাকাটি। উদ্যানে মেরুদণ্ডী প্রজাতির প্রাণীও রয়েছে। ৪৩টি বিভিন্ন প্রজাতির মেরুদণ্ডী প্রাণী ও ২২০-৭২০ জাতের বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে।[৩] লফোস্তোমা ইয়াসুনি নামীয় এক প্রজাতির বাদুড় উদ্যানে রোগ ছড়ায়।

তৈল মজুদ সম্পাদনা

ইয়াসুনি জাতীয় উদ্যানে প্রায় ৮০০ মিলিয়ন ব্যারেল অপরিশোধিত তেলের মজুদ রয়েছে। এ পরিমাণ তৈল ইকুয়েডরের সংরক্ষিত তেলের ২০%।[২][৪] ইশপিঙ্গো-তিপুতিনি-তাম্বোকোচা (আইটিটি) তৈলক্ষেত্র এখানেই রয়েছে। তবে, এ সম্পদ অবমুক্ত না করার জন্য জেন গুডয়ল, ই.ও. উইলসন এবং স্টুয়ার্ট পিমের ন্যায় পরিবেশবাদী ও বিজ্ঞানীরা সরকারের প্রতি আবেদন জানিয়েছেন।[৫] এর জবাবে জুন, ২০০৭ সালে রাষ্ট্রপতি রাফায়েল কোরেয়া উদ্যানের প্রাকৃতিক সম্পদের রক্ষা করার জন্য ইয়াসুনি-আইটিটি পদক্ষেপ উদ্বোধন করেন। এর বিনিময়ে উদ্যানের অবন্টিত সম্পদ রক্ষার্থে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের কথা বলেন তিনি।[৬] উদ্যানের কূপ খনন কার্য তৈরি করা হলে বাতাসে ৪০০ মিলিয়ন টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস মিশে যাবে বলে এক কর্মকর্তা জানান।[২] সরকার আশাবাদী যে, লাভের অন্তত ৫০% অর্থ সংগ্রহ করা গেলে তেল মজুদের কাজে লাগানো যাবে। ১২ বছরেরও অধিক সময়কালে সর্বমোট $৩.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সংগৃহীত হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।[৪] এ সময় পরিকল্পনাবিদদের মাধ্যমে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করা যাবে যা বিশ্বের গরিব দেশগুলোর উপর পরিবেশগত সংরক্ষণের ভার কমাতে প্রভূতঃ সহায়তা করবে।[২]

অভিনেতা লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও এবং এডওয়ার্ড নর্টন, চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং বৈশ্বিক পরিবেশবাদী আন্দোলনকর্মী / বিজ্ঞানী মাইকেল চার্লস তোবিয়াস ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক উপ-রাষ্ট্রপতি আল গোর ইকুয়েডর সরকারকে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় সমর্থন দেয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।[৭][৮] তহবিল সংগ্রহের জন্য তুরস্ক, চিলি, কলম্বিয়া, জর্জিয়া, অস্ট্রেলিয়া, স্পেন এবং বেলজিয়াম একযোগে কাজ করে যাচ্ছে। তবে অর্থ সংগ্রহের প্রচেষ্টায় ইকুয়েডর সরকার ইতোমধ্যে জানিয়েছে যে, সরকার একাই অর্থ ব্যয়ের সিদ্ধান্ত নিবে যে কোথায়, কীভাবে তহবিল ব্যয়িত হবে।[২]

জুলাই, ২০১৩ সালে, কোরেয়া ইয়াসুনি-আইটিটি পদক্ষেপ-এর অগ্রগতি মূল্যায়ন করার জন্য একটি কমিশন গঠন করেন। কমিশনের মতে, অর্থনৈতিক অগ্রগতি তেমন যথেষ্ট নয়। ১৫ আগস্ট, কোরেয়া এ পরিকল্পনা সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দূর্বল দৃষ্টিভঙ্গীর কথা তুলে ধরেন।[৪] তিনি বলেন,"বিশ্ববাসী আমাদেরকে নিরাশ করেছে"। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশ কপটাচারীতার আশ্রয় নিয়েছে। তারা গ্রীনহাউজ থেকে নির্গত গ্যাস মোকাবেলার কথা বলছে। অথচ, তার দেশ পরিবেশের জন্য অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে বলিদান করেছে।[২] এরপর তিনি ইয়াসুনি-আইটিটি পদক্ষেপ প্রকল্পটি একটি নির্বাহী আদেশ মাধ্যমে সমাপ্তি ঘোষণা করেন। এ উদ্যোগের ছয় বছরে মাত্র $৩৩৬ মিলিয়ন ডলার অঙ্গীকার করা হয়েছে যাতে তার দেশ মাত্র $১৩.৩ মিলিয়ন ডলার পেয়েছে। [৪]

কোরেয়া আরও বলেন, অর্থনৈতিক, আইনগত ও কারিগরি গবেষণার পর জাতীয় আইনসভায় আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্যানের কূপ খননের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তিনি বলেন, ইকুয়েডর তেল উৎপাদন বিস্তৃতি ঘটানো প্রয়োজন। দেশের অর্থনৈতিক প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে জাতির দারিদ্র মোকাবেলায় সমর্থন জোগাবে ও তা অপরিহার্য ছিল। তিনি বলেন, ইয়াসুনি অববাহিকায় এ কূপ খনন করা হলে তা মাত্র ১% প্রভাব বিস্তার করবে। একজন মুখপাত্র জানান, খনন কার্যটি পরিবেশের কোনরূপ ক্ষতিসাধন ছাড়াই পরিচালিত হতে পারে।

পরিবেশবাদীরা জোরালোভাবে তৈল অবমুক্তির মাধ্যমে উদ্যানের ক্ষতির আশঙ্কা করেন ও তীব্র আপত্তি জানান। কোরেয়া'র ঘোষণার পর শতশত বিক্ষোভকারী রাষ্ট্রপতির প্রাসাদের বাইরে জড়ো হয়।[৪] আদিবাসী জনগোষ্ঠী ও পরিবেশবাদীরা এই বিষয়ে জনমতের কথা জানান। এ জনমতে ইয়াসুনি-আইটিটি পদক্ষেপ ২০০৭ সালে প্রণীত হয়, এবং সারা বিশ্ব থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে প্রায় ১.৭ বিলিয়ন ডলার প্রদানের আশ্বাস দেয়া হয়। এরফলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতায় তহবিল প্রয়োজনীয় অর্থ সম্ভাব্য খাতে ব্যয় করা হবে।[৯] উল্লেখ্য যে, ইকুয়েডরের জাতীয় বাজেটের এক-তৃতীয়াংশ অর্থেরই যোগান আসে তৈল উৎপাদন থেকে।[২][১০]

অন্যান্য হুমকি সম্পাদনা

বর্তমানে এ উদ্যানে ক্রমবর্ধমান বসতভিটা স্থাপন, বৃক্ষহীনতা, অবৈধভাবে গাছ কেটে ফেলা এবং অনিয়ন্ত্রিতভাবে শিকার কার্যক্রম পরিচালিত হওয়ায় জীববৈচিত্র্যে ব্যাপক হুমকির মুখে ফেলছে।[১১]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "A Durable Yet Vulnerable Eden in Amazonia"nytimes.com। ২ এপ্রিল ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৪ মার্চ ২০১৫ 
  2. "Yasuni: Ecuador abandons plan to stave off Amazon drilling"The Guardian। Associated Press। আগস্ট ১৫, ২০১৩। আগস্ট ১৬, ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ আগস্ট ১৭, ২০১৩ 
  3. Margot S. Bass; Matt Finer; Clinton N. Jenkins; Holger Kreft; Diego F. Cisneros-Heredia; Shawn F. McCracken; Nigel C. A. Pitman; Peter H. English; Kelly Swing; Gorky Villa; Anthony Di Fiore; Christian C. Voigt; Thomas H. Kunz (2010)। Hector, Andy, সম্পাদক। "Global Conservation Significance of Ecuador's Yasuní National Park"Public Library of Science5 (1): e8767। ডিওআই:10.1371/journal.pone.0008767। সংগ্রহের তারিখ 06-07-2011  এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |সংগ্রহের-তারিখ= (সাহায্য)
  4. Alexandra Valencia (আগস্ট ১৬, ২০১৩)। "Ecuador to open Amazon's Yasuni basin to oil drilling"। Reuters। জানুয়ারি ১২, ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ আগস্ট ১৭, ২০১৩ 
  5. Yasuni Rainforest Campaign - Leading Scientists Letter ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১৮ এপ্রিল ২০১৬ তারিখে. Saveamericasforests.org (2005-02-14). Retrieved on 2013-08-22.
  6. Finer, M., R. Moncel, C.N. Jenkins. 2010. Leaving the Oil Under the Amazon: Ecuador's Yasuní-ITT Initiative.[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ], Biotropica 42:63-66.
  7. "Leonardo DiCaprio and Edward Norton join Sea Eco-Conference"। Contactmusic। ২০১০-০৪-১৩। সংগ্রহের তারিখ ২০১২-০৩-১৪ 
  8. "Al Gore viajará a Ecuador para respaldar iniciativa ecuatoriana Yasuní-ITT"। americaeconomia.com। ২০১০-১১-০৪। ২০১৪-০৩-১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১২-০৩-১৪ 
  9. Temper, L., Yánez, I., Sharife, K., Ojo, G., Martinez-Alier, J., CANA, Combes, M., Cornelissen, K., Lerkelund, H., Louw, M., Martínez, E., Minnaar, J., Molina, P., Murcia, D., Oriola, T., Osuoka, A., Pérez, M. M., Roa Avendaño, T., Urkidi, L., Valdés, M., Wadzah, N., Wykes, S. 2013. Towards a Post-Oil Civilization: Yasunization and other initiatives to leave fossil fuels in the soil. EJOLT Report No. 6, 204 p.
  10. "Ecuador approves Yasuni park oil drilling in Amazon rainforest"। ১৭ জানুয়ারি ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০ মে ২০১৬ 
  11. Finer M, Vijay V, Ponce F, Jenkins CN, and Kahn TR. 2009. Ecuador's Yasuní Biosphere Reserve: a brief modern history and conservation challenges[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ], Environmental Research Letters 4: 034005.

আরও পড়ুন সম্পাদনা

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা