আল-হারিস ইবনে সুরাইজ

আবু হাতিম আল-হারিস ইবনে সুরাইজ ইবনে ইয়াজিদ ইবনে সাওয়া ইবনে ওয়ার্দ ইবনে মুররা ইবনে সুফিয়ান ইবনে মুজাশি[১] (আরবি: أبو حاتم الحارث بن سريج) ছিলেন অষ্টম শতাব্দীর একজন আরব নেতা। তিনি খোরাসানমাওয়ারাননহরে সংঘটিত বৃহদাকার উমাইয়া বিরোধী বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ৭৩৪ খ্রিষ্টাব্দে এই বিদ্রোহ শুরু হয়। আরব ও অনারব উভয় শ্রেণীর মুসলিমদের মধ্যকার ক্ষোভ এই বিদ্রোহ উস্কে দিয়েছিল।

আল-হারিস ইবনে সুরাইজ
মৃত্যুমার্চ ৭৪৬
কর্মজীবন৭২৯–৭৪৬
পরিচিতির কারণখোরাসানমাওয়ারাননহরে উমাইয়া বিরোধী সামাজিক ও ধর্মীয় বিদ্রোহের নেতৃত্বদান
প্রতিদ্বন্দ্বীউমাইয়া খিলাফত

অনারব মুসলিমদেরকে উমাইয়া আমলে সাধারণভাবে আরব মুসলিমদের সমকক্ষ বিবেচনা করা হত না। হারিস তার বিদ্রোহকে ধর্মীয় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। আরব ও অনারব উভয় শ্রেণীর জনতার সমর্থন আদায় করতে তিনি সক্ষম হন। তবে তিনি প্রাদেশিক রাজধানী মার্ভ দখলের দুইবার চেষ্টায় ব্যর্থ হন। শেষপর্যন্ত আসাদ ইবনে আবদুল্লাহ আল-কাসরি ৭৩৬ খ্রিষ্টাব্দে এই বিদ্রোহ দমন করেন। হারিস তার কিছু সমর্থকসহ পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। তিনি তুরগেশ খাগানাতের সাথে মিত্রতা স্থাপন করেন। হারিস তুরগেশদের আরব অঞ্চলে অভিযানে সহায়তা করেন। ৭৩৭ খ্রিষ্টাব্দে খারিস্তানের যুদ্ধে এই অভিযানকে প্রতিহত করা হয়। এরপর হারিস মাওয়ারাননহরে স্থানীয় শাসকদের সমর্থন নিয়ে অবস্থান করতে থাকেন। হারিস ও তার স্থানীয় সমর্থকদের বিরুদ্ধে আসাদের উত্তরসুরি নাসের ইবনে সাইয়ার অভিযান চালায়। কিন্তু আরবদের অন্তর্দ্বন্দ্ব্বে নিজ অবস্থান শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে হারিসকে ব্যবহার করা যেতে পারে বিবেচনা করে নাসের খলিফার কাছ থেকে হারিসের জন্য ক্ষমা মঞ্জুর করিয়ে নেন। হারিস এরপর ৭৪৫ খ্রিষ্টাব্দে মার্ভ‌’য় ফিরে আসেন। অতঃপর দ্রুত তিনি একটি সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন এবং নাসেরের প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠেন। ৭৪৬ খ্রিষ্টাব্দে জুদাই আল-কিরমানির সাথে সংঘর্ষে তিনি মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত এই বৈরীতা বজায় ছিল। তার বিদ্রোহের কারণে মধ্য এশিয়ায় আরব শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং আব্বাসীয় বিপ্লব সংঘটনের পথ প্রশস্ত করে দেয় যার; ফলশ্রুতিতে পরবর্তীতে উমাইয়া খিলাফতের যবনিকাপাত হয়েছিল।

জীবনী সম্পাদনা

প্রারম্ভিক জীবন ও বিদ্রোহের সূচনা সম্পাদনা

হারিস বনু তামিম গোত্রের সদস্য ছিলেন।[২] তার পিতা সুরাইজ বসরায় বসবাস করতেন।[১] ৭২৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম হারিসের সাহসিকতার বর্ণনা পাওয়া যায়। এসময় তিনি বুখারার নিকটে বাইকান্দে সংঘটিত বাইকান্দের যুদ্ধে তুরগেশের বিরুদ্ধে লড়ে আরবদের রক্ষা করেছিলেন।।[১][৩] এরপর ৭৩৩ খ্রিষ্টাব্দে পুনরায় তার নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। এসময় তিনি নিম্ন তুখারিস্তানে প্রদেশ থেকে খোরাসানের রাজধানী মার্ভে সাহায্য পাঠানোর বিপক্ষে একটি প্রতিবাদে নেতৃত্ব দেন। গভর্নর জুনাইদ ইবনে আবদুর রহমান আল-মুররি এই সহায়তা পাঠান। জুনাইদ হারিসকে বেত্রাঘাত করেছিলেন। কিন্তু ৭৩৪ খ্রিষ্টাব্দে জুনাইদের মৃত্যুর পর অসন্তোষ প্রকাশ্য বিদ্রোহে রূপ নেয়। হারিস এর প্রধান ছিলেন।[৪]

 
৮ম শতাব্দীতে খোরাসানমাওয়ারাননহরের মানচিত্র

হারিসের বিদ্রোহের উদ্দেশ্য ও প্রকৃতি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তার জনদাবিগুলো ধর্মীয় পরিভাষায় বিবৃত করা হয়। এতে কুরআনসুন্নাহর প্রয়োগের মাধ্যমে অন্যায় বন্ধের দাবি জানানো হয়। হারিস নিজে মুরজিয়া নামক গোষ্ঠীর সদস্য ছিলেন বলা হয়ে থাকে। আরববিদ মেয়ার জে. কিস্টার বলেন যে, তিনি মুহাম্মদ (সা) ও চার খলিফার মত ন্যায়-ভিত্তিক শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন।[১][২][৫] তার আন্দোলনে তৎকালীন শিয়াখারিজি মতবাদের অনেক আদর্শিক ও প্রতীকী উপাদান গ্রহণ করেছিল। এর মধ্যে ছিল কালো পতাকার ব্যবহার এবং আহলে বাইতের শাসনের দাবি। হারিসের আন্দোলন লক্ষণীয় আদর্শবাদের কারণে পৃথকভাবে চিহ্নিত হয়। তার অণুসারীরা এমনকি যুদ্ধের সময়ও নৈতিক ও ধর্মীয় আহ্বানের মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে নিজ দলে টানত এমন বিবরণ রয়েছে।[১][৬]

হারিস বেশ কিছু সংস্কারের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল অনারব মুসলিমদের আরব মুসলিমদের মত পূর্ণ আইনি সমতা। অনারব মুসলিমদের এসময় জিজিয়া দিতে হত ।[১][৭][৮][৯] ইতিপূর্বে এই প্রথা বন্ধের চেষ্টা চালানো হলেও তা সফলকাম হয়নি। এসবের কারণে ৭২৮ খ্রিষ্টাব্দে আবুল সাইদা সালিহ ইবনে তারিফের নেতৃত্বে প্রথম বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। এই প্রথম বিদ্রোহে অংশ নেয়া অনেক ব্যক্তি ও গোষ্ঠী হারিসের আন্দোলনে অংশ নেয়।হারিসকে অনারবদের অধিকারের বীর হিসেবে দেখা হত। তাদের অনেকে তার পক্ষে অংশ নেয়। তবে আরবদের মধ্যে অসন্তুষ্ট অনেকেও তার পক্ষে অবস্থান নেয়। তার নিজ গোত্র তামিম এবং আজদ এদের মধ্যে ছিল।[১০] ৭৩১ খ্রিষ্টাব্দে তুরগেশ খাগানাতের বিরুদ্ধে সংঘটিত গিরিপথের যুদ্ধে ক্ষয়ক্ষতির কারণে খোরাসানি আরবদের মধ্যেও অসন্তোষ ছিল। এর পাশাপাশি উমাইয়া বিরোধী শিয়া প্রচারণা ছিল।[৪] গিরিপথের যুদ্ধের পর প্রদেশে ২০,০০০ ইরাকি সৈনিক মোতায়েন করা নিয়েও অসন্তোষ বৃদ্ধি পায়। একই সাথে তুরগেশের বিপক্ষে প্রতিরক্ষা জোরদার করার জন্য খলিফা হিশাম ইবনে আবদুল মালিক (শাসনকাল ৭২৩-৭৪৩) কর্তৃক পুরনো আরব বাসিন্দাদেরকে মার্ভ‌ থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার আদেশ দেয়া হয়েছিল।[১১]

জুনাইদের মৃত্যুর সংবাদ গুজগানের আন্দখুই শহরে পৌছে। এটি অন্যতম প্রত্যন্ত আরব ঘাঁটি ছিল। সংবাদ পাওয়ার পর স্থানীয় আরব গেরিসন বিদ্রোহে হারিসকে অণুসরণ করে। জুনাইদের উত্তরসুরি আসিম ইবনে আবদুল্লাহ আল-হিলালি মার্ভ‌ আসার পর বিদ্রোহ নিরসনের চেষ্টা করেন এবং তাদের প্রতি দূত পাঠান। কিন্তু হারিস তাদেরকে বন্দী করেন। বিদ্রোহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়লে হারিস ৪,০০০ লোকের এক বাহিনী নিয়ে তুখারিস্তানের প্রধান শহর বলখের দিকে অগ্রসর হয়। নাসের ইবনে সাইয়ার এসময় ১০,০০০ সৈনিক নিয়ে এর নিয়ন্ত্রণে ছিলেন। নাসের হারিসের আন্দোলনের সমর্থন করেননি। তবে খোরাসানিদের অসন্তষের কারণে তিনি ও তার লোকেরা খুব অল্পমাত্রার বিরোধিতা প্রদর্শন করে। হারিসের বাহিনী খুব সহজেই বলখ দখল করে নেয়। নাসের ও তার সেনারা সেখান থেকে সরে যান। তারা হারিস বা আসিম কারো পক্ষে যোগ দেয়নি।[১২][১৩][১৪] শীঘ্রই মার্ভ‌ আল-রুদের আরব গেরিসন হারিসের সাথে যোগ দেয়। গুজগান, ফারয়াব, ও তালকানের স্বায়ত্তশাসিত হেফথালি রাজারা নিজেদের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার এবং খোরাসানে আরব প্রভাব দূর করার জন্য বিদ্রোহে যোগ দেয়।[১৫]

হারিস এরপর মার্ভ‌ের দিকে দৃষ্টি দেন এবং রাজধানীর দিকে যাত্রা করেন। এখানেও তার সমর্থক ছিল। তবে নিশাপুরের জন্য শহর ত্যাগ ছেড়ে দেবেন এমন ভয় দেখিয়ে আসিম খোরাসানিদের আনুগত্য আদায় করতে সক্ষম হন। সেখানে তিনি কাইস গোত্রীয়দের উপর নির্ভর করেন এবং সিরিয়া থেকে বাড়তি সহায়তা চান। হারিসের বাহিনীতে অনেক স্থানীয় লোক ছিল যার কারণে তা বিদেশি বাহিনীর মত মনে হয়। এ কারণে স্থানীয় আরব অভিজাতরা আসিমের পক্ষে চলে যায়।[১৬][১৭] আল-তাবারির বিবরণ অনুযায়ী হারিসের বাহিনী মার্ভে‌র নিকটবর্তী‌ হওয়ার পর প্রায় ৬০,০০০ মাওয়ালি তার বাহিনীতে যোগ দেয়। আসিমের বাহিনী তুলনামূলকভাবে ছোট ছিল। তাদেরকে লড়াইয়ে নিয়োগ করার জন্য আসিমের অতিরিক্ত অর্থ প্রধান করতে হয়। মার্ভ‌ থেকে বের হওয়ার পর তিনি জার্ক‌ খালের পেছনে অবস্থান নেন এবং সেতুগুলো ধ্বংস করে দেন। হারিসের বাহিনী এগিয়ে এসে সেতুগুলো সংস্কার করে। এসময় হারিসের বাহিনীর স্থানীয় সদস্যদের প্রতি বিশ্বাসের অভাবে ২,০০০ এর বেশি আরব হারিসের বাহিনী ত্যাগ করে আসিমের দলে যোগ দেয়। এরপর সংঘটিত যুদ্ধে আসিম বিজয়ী হন এবং হারিসের অনেক সৈনিক খালে ডুবে যায়।[১৭][১৮] এই ব্যর্থতার কারণে অধিকাংশ মাওয়ালি এবং স্থানীয় রাজারা হারিসের দল ত্যাগ করে। ফলে হারিসের বাহিনীতে অণুগত সেনার সংখ্যা ৩,০০০ এ পৌছায়। এসকল কারণে হারিস আসিমের শান্তি প্রস্তাব মেনে নেন। হারিসও খোরাসানি আরবদের সমর্থনের উপর বেশি সময় ধরে নির্ভর করতে পারছিলেন না। পরের বছর হারিস পুনরায় বিদ্রোহ করেন এবং মার্ভে‌র দিকে অগ্রসর হন। এসময় আসিম খোরাসানিদেরকে তার দলে নিতে পারেননি। ফলে তার বাহিনীতে মাত্র ১,০০০ এর মত সিরিয়ান ও জাজিরান সৈনিক অবশিষ্ট ছিল। হারিসের বাহিনীও বেশি বড় ছিল না। মার্ভে‌র নিকটে আল-দানদানকান গ্রামের যুদ্ধে আসিম পুনরায় জয়ী হন এবং হারিস মার্ভ‌ আল-রুদে পালিয়ে যান।[১৮][১৯]

বিজয়ী হওয়া সত্ত্বেও আসিমের অবস্থান স্থিতিশীল ছিল না। মার্ভ‌ ও পশ্চিম কাইসি অঞ্চলে তার বাহিনীতে সংখ্যা হ্রাস হয়। খলিফাকে লেখা তার এক চিঠিতে তিনি জানান যে তিনি সিরীয় হিসেবে খোরাসানি ও ইরাকিরা তার অধীনে নিজেদের লোকেদের বিপক্ষে লড়াই করতে উৎসাহী না।[২০][২১] আসিম অণুরোধ করেন যাতে খোরাসানকে ইরাকের গভর্নর খালিদ ইবনে আবদুল্লাহ আল-কাসরির অধীনে প্রদান করা হয় এবং সিরিয়ান সৈনিকদেরকে প্রদেশে প্রেরণ করা হয়। এর প্রেক্ষিতে খালিদের ভাই আসাদ ইবনে আবদুল্লাহ আল-কাসরিকে তার স্থানে প্রেরণ করা হয়। আসাদ ইতঃপূর্বে খোরাসানের গভর্নরের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এই সংবাদ এবং সম্ভবত মার্ভ‌ের খোরাসানিদের চাপের কারণে আসিম হারিসের সাথে সন্ধিতে করতে সক্ষম হন। কিছু বিবরণ অনুযায়ী খলিফার কাছে কুরআন ও সুন্নাহর প্রয়োগের দাবির জন্য আসিম এমনকি হারিসের সাথে যোগ দেয়ার প্রস্তাবও করেন। শাবান ঘটনাটি সত্য নয় বললেও ব্লানকানশিপ এই ঘটনাকে বিশ্বাসযোগ্য মনে করেন তবে তার দাবি এটি ছিল আসিমের কৌশলগত চাল।[১][২০][২২]

বিদ্রোহের সমাপ্তি, তুরগেশ হস্তক্ষেপ ও বহিষ্কার সম্পাদনা

আসাদ ২০,০০০ সিরিয়ান সৈনিক নিয়ে খোরাসান আসেন এবং হারিসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। আসাদের অভিযানগুলো ব্যয়বহুল ছিল। কিন্তু তার প্রথম সাফল্যের পর খোরাসানি আরবরা তার পক্ষে যোগ দেয়া শুরু করে। স্থানীয় আরব গোত্রীয় নেতাদের সাথে দীর্ঘ ব্যক্তিগত সম্পর্ক এবং বিভিন্ন গোত্রের মধ্যকার দ্বন্দ্ব্বের কারণে আসাদের সুবিধা হয়। আসাদ তার বাহিনীকে বিভক্ত করে কুফান ও সিরিয়ানদেরকে আবদুর রহমান ইবনে নাইয়ুমের অধীনে মার্ভ‌ রুদে প্রেরণ করেন। এখানে হারিসের মূল বাহিনী অবস্থান করছিল। অন্যদিকে তিনি নিজে বসরা ও বাকি খোরাসানিদের নিয়ে আমুল ও জামের দুর্গের দিকে অগ্রসর হন। আমুলের বিদ্রোহীরা আত্মসমর্পণ করে এবং তাদের ক্ষমা করা হয়। বলখও শীঘ্রই একই পথ অণুসরণ করে। হারিস মার্ভ‌ রুদ ত্যাগ করে আমু দরিয়া পার হয়ে পিছু হটেন এবং তুখারিস্তানের রাজাদের কাছে সহায়তা চান। তাদের সহায়তায় তিনি তিরমিজে আমু দরিয়ার প্রধান পারাপার স্থান অবরোধ করেন। এমতাবস্থায় আসাদের বাহিনী নদী পার না হয়ে বলখে অবস্থান নেয়। তবে তিরমিজের গেরিসন হারিসকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়। এর আগে খুত্তালের রাজার সাথে এক বিবাদের কারণে হারিস কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। হারিস এরপর পূর্বদিকে বাদাখশানের পার্বত্য অঞ্চলে পিছু হটেন। এদিকে আসাদ তার এই সাফল্যের ধারাবাহিকতায় জামের গেরিসনকে ক্ষমা ও দ্বিগুণ বেতনের প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে আত্মসমর্পণ করাতে সক্ষম হন। গিরিপথের যুদ্ধের পর হাতছাড়া হওয়া সমরকন্দ পুনরায় দখলের জন্য আসাদ অভিযান চালিয়েছিলেন, তবে তিনি ব্যর্থ হন।[২৩][২৪][২৫]

পরের বছর ৭৩৬ খ্রিষ্টাব্দে আসাদের বাহিনী উচ্চ তুখারিস্তানের পার্বত্য অঞ্চলে হারিসের বাকি সমর্থকদের উৎখাত করে। তুখারিস্তানের দুর্গে হারিসের অনেক অণুসারী ও আত্মীয় আশ্রয় নিয়েছিল। জুদাই আল-কিরমানি এই দুর্গ অবরোধ করেন। তাদের আত্মসমর্পণের পর অধিকাংশকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয় এবং বাকিদেরকে দাস হিশেবে বিক্রি করে দেয়া হয়। হারিস পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।[১][২৬] ৭৩৭ খ্রিষ্টাব্দে আসাদ আমু দরিয়ার উত্তরে খুত্তালের বিরুদ্ধে অভিযান চালান। খুত্তালের রাজা এসময় হারিস ও তুরগেশ খাগানাত উভয়ের সাথে মিত্রতা স্থাপন করেছিল। আরব বাহিনীর আগমনের প্রেক্ষিতে খুত্তালের রাজা সাহায্যের আবেদন জানালে সুলুক খাগান আসাদের বাহিনীর উপর হামলা চালায়। এরপর তুরগেশ খাগানাত এগিয়ে আসে। দুই পক্ষের যুদ্ধে তুরগেশরা আরবদের পরাজিত করে। এরপর হারিস আত্মগোপন ছেড়ে বেরিয়ে আসেন এবং খাগানের সাথে যোগ দেন।[২৭][২৮][২৯]

হারিস এসময় খাগানকে পরামর্শ দেন যাতে তারা আরব বাহিনীর শীতকালীন আবাসের দিকে যাত্রার সুবিধা গ্রহণ করে। তার উপদেশ অনুযায়ী ডিসেম্বরের প্রথম দিকে খাগান তুরগেশ সেনাবাহিনীকে বলখের পাশ দিয়ে গুজগানের দিকে নিয়ে যায়। এতে মাওয়ারাননহর ও উচ্চ তুখারিস্তানের প্রত্যেক স্থানীয় শাসক থেকে নেয়া প্রায় ৩০,০০০ সৈনিক ছিল। তাদের আশা ছিল যে নিম্ন তুখারিস্তানের হেফথালি রাজারা বিদ্রোহে যোগ দেবে। তবে এই পদক্ষেপ ব্যর্থ হয়। গুজগানের রাজা আসাদের পক্ষে যোগ দেন। আসাদের বাহিনী হারিস ও খাগানের বাহিনীকে ধরাশায়ী করে। খারিস্তানের নিকটে আসাদ তাদের মুখোমুখি হন। এসময় তার মাত্র ৪,০০০ সৈনিক ছিল। এখানে সংঘটিত খারিস্তানের যুদ্ধে আসাদ তুরগেশদের পরাজিত করেন। হারিস ও খাগান উভয় পক্ষ পালিয়ে আমু দরিয়ার উত্তরে চলে যেতে সক্ষম হন।[৩০][৩১][৩২][৩৩] খারিস্তানে আসাদের বিজয়ের ফলে মধ্য এশিয়ায় আরব শাসন টিকে থাকে। আমু দরিয়ার দক্ষিণে তুরগেশ বাহিনীকে জুদাই আল-কিরমানি ধ্বংস করে দেন। ফলে খোরাসানের হুমকির ইতি ঘটে এবং তুখারিস্তানের স্থানীয় শাসকদের আনুগত্য আদায় করা সম্ভব হয়। খাগানের পরাজয়ের ফলে তাদের অভ্যন্তরীণ প্রতিপক্ষরা উৎসাহিত হয়। এদের পেছনে চীনাদের গোপন ইন্ধন ছিল। ৭৩৮ খ্রিষ্টাব্দের শুরুর দিকে তারখান কুরসুল সুলককে হত্যা করে। এরপর তুরগেশ খাগানাত গৃহযুদ্ধে বিধ্স্ত হয়। সে বছর আসাদও মারা যান এবং নাসের ইবনে সাইয়ার তার উত্তরসুরি হন।[১][৩৪][৩৫]

এর পরের দুই বছর হারিসের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানা যায় না। তবে তিনি স্পষ্টত উত্তর মাওয়ারাননহরের আল-শাশে (তাশখন্দ) ছিলেন ও তুরগেশের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল এমন হতে পারে। ৭৪০ বা ৭৪১ খ্রিষ্টাব্দে খোরাসানে নিজ কর্তৃত্ব মজবুত এবং কর ব্যবস্থার সংস্কার করার পর নাসের ইবনে সাইয়ার মধ্য সির দরিয়া উপত্যকায় অভিযান চালান। এই অভিযান মাওয়ারাননহরে নাসেরের আরব নিয়ন্ত্রণ পুনপ্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টার অংশ ছিল। তবে এইচ. এ. আর. গিব ও কিস্টারের মতানুযায়ী এর মূল উদ্দেশ্য ছিল তুরগেশ ও স্থানীয় রাজাদেরকে আরবদের বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ করার সম্ভাবনার কারণে হারিসকে শাশ থেকে উৎখাত করা। এসময় তুরগেশ, শাস ও হারিসের অণুসারীদের নিয়ে গঠিত এক বাহিনী নাসেরকে সির দরিয়া অতিক্রম করতে বাধা প্রদান করে। আলোচনার পর নাসেরের বাহিনী ফিরে যেতে বাধ্য হয়। আলচনার অন্যতম শর্ত ছিল হারিস ও তার অণুসারীদের দূরবর্তী ফারাব শহরে অপসারণ করা।[১][৩৬][৩৭][৩৮]

খোরাসানে প্রত্যাবর্তন, দ্বিতীয় বিদ্রোহ ও মৃত্যু সম্পাদনা

নাসেরের অভিযান ও সংস্কারের ফলে খোরাসান ও মাওয়ারাননহরে মুসলিম শাসন সুসংহত হয়। তবে এই সাফল্য মজবুত ছিল না। স্থানীয় রাজারা তাদের শাসন হারিয়ে ফেলে এবং সাহায্যের জন্য চীনা রাজদরবারে দূত পাঠায়। অন্যদিকে এসময় মুদারি ও ইয়েমেনি গোত্রগুলোর মধ্যকার প্রতিদ্বন্দ্ব্বীতা আরবদেরকে বিভক্ত করে।[৩৯][৪০] ইয়েমেনিপন্থি খলিফা তৃতীয় ইয়াজিদ ক্ষমতালাভ করার পর খোরাসানি ইয়েমেনিরা জুদাই আল-কিরমানিকে গভর্নর হিসেবে সমর্থন দেয়। কিন্তু তেমনটা না হওয়ায় তারা বিদ্রোহ করে। আল-কিরমানির সাথে হারিসের শত্রুতার কারণে নাসের অণুভব করেন যে তার নিজ অবস্থানকে শক্তিশালী করা এবং আরেকটি বিদেশি আক্রমণ দূর করার জন্য হারিসকে নিজ দলে আনা প্রয়োজন। নাসের খলিফা ইয়াজিদের কাছ থেকে হারিস ও তার অণুসারীদের জন্য পূর্ণ ক্ষমার নিশ্চয়তা নিতে সক্ষম হন। তাদের বাজেয়াপ্ত সম্পত্তি ফিরিয়ে দেয়া হয় এবং খলিফা কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী শাসন করার প্রতিশ্রুতি দেন।[১][৪১][৪২][৪৩]

৭৪৫ খ্রিষ্টাব্দের জুলাইয়ের প্রথমদিকে যখন হারিস মার্ভ পৌছান তখন অবশ্য পরিস্থিতি বদলে যায়। খলিফা তৃতীয় ইয়াজিদ মারা যান, সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হয় এবং গভর্নরের পদে থাকা সত্ত্বেও নাসের ইবনে সাইয়ারের কর্তৃত্ব হ্রাস পায়। তিনি দ্বিতীয় মারওয়ানকে খলিফা মেনে নিলেও তার অধিকাংশ অণুসারী মারওয়ানকে খলিফা মানতে চায়নি।[৪৪][৪৫] হারিস দ্রুত নিজেকে নাসেরের কাছ থেকে সরিয়ে নেন। তিনি একটি জেলার গভর্নরের পদের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন এবং তাকে দেয়া উপহারগুলো সমর্থকদের বণ্টন করে দেন।[১][৪৫] হারিস দ্বিতীয় মারওয়ানকে খলিফা হিসেবে অস্বীকার করেন। বনু তামিমের প্রায় ৩,০০০ ব্যক্তি তার সাথে যোগ দেয়। তার সচিব জাহম ইবনে সাফওয়ান আরো সমর্থন লাভের জন্য প্রচেষ্টা চালান। অল্প সময়ের মধ্যে তিনি আল-কিরমানির চেয়ে নাসেরের জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠেন। এই সমস্যা নিরসনের জন্য শুরু হওয়া আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার পর ৭৪৬ খ্রিষ্টাব্দের মার্চে নাসের হারিসের বাহিনীর উপর হামলা চালান এবং বিজয়ী হন। জাহম ইবনে সাফওয়ান পরাজিত হন। এসময় আল-কিরমানি হারিসের সাথে যোগ দেন। তারা নাসেরকে মার্ভ ছেড়ে নিশাপুরে যেতে বাধ্য করেন। হারিস ও আল-কিরমানি খোরাসানের রাজধানীতে প্রবেশ করেন তবে কিছুদিনের পর তাদের মধ্যে বিবাদ সৃষ্টি হয় এবং তারা একে অন্যের বিপক্ষে লড়াইয়ে নামেন। সংঘর্ষে হারিস মারা যান ফলে আল-করমানি একা শহরের নিয়ন্ত্রণ লাভ করেন।[৪৬][৪৭][৪৮] নাসের ও আল-কিরমানির মধ্যকার সংঘাত চলতে থাকে। তবে গৃহযুদ্ধ, খোরাসানে আবু মুসলিমের নেতৃত্বে আব্বাসীয়দের উমাইয়া বিরোধী বিদ্রোহ, এসব ঘটনার ফলে পরিস্থিতি বদলে যায়। নাসের ইবনে সাইয়ার আল-কিরমানির সাথে মিত্রতা স্থাপন করতে চেয়েছিলেন। তবে হারিসের এক ছেলে আল-কিরমানিকে প্রতিশোধ হিসেবে হত্যা করায় নাসের ব্যর্থ হন। আবু মুসলিম এই পরিস্থিতিকে নিজ প্রয়োজনে ব্যবহার করতে সক্ষম হন। ৭৪৮ খ্রিষ্টাব্দের প্রথমদিকে তার লোকেরা মার্ভে প্রবেশ করে। দুই বছর পর উমাইয়াদের পতন ও আব্বাসীয়দের উত্থানে এটি ছিল প্রথম পদক্ষেপ।[৪৯][৫০][৫১]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Kister (1986), পৃ. 223–224
  2. Hawting (2000), পৃ. 86
  3. Gibb (1923), পৃ. 70
  4. Gibb (1923), পৃ. 76
  5. Blankinship (1994), পৃ. 176
  6. Sharon (1990), পৃ. 28–31
  7. Blankinship (1994), পৃ. 177, 332 (Note 57)
  8. Hawting (2000), পৃ. 80, 85–86
  9. Sharon (1990), পৃ. 27–28
  10. Sharon (1990), পৃ. 31
  11. Shaban (1979), পৃ. 114–118
  12. Blankinship (1994), পৃ. 177
  13. Gibb (1923), পৃ. 76–77
  14. Shaban (1979), পৃ. 118
  15. Shaban (1979), পৃ. 118–119
  16. Blankinship (1994), পৃ. 177–178
  17. Shaban (1979), পৃ. 119
  18. Blankinship (1994), পৃ. 178
  19. Shaban (1979), পৃ. 119–121
  20. Blankinship (1994), পৃ. 178–179
  21. Shaban (1979), পৃ. 120
  22. Shaban (1979), পৃ. 120–121
  23. Blankinship (1994), পৃ. 179–180
  24. Gibb (1923), পৃ. 77–78
  25. Shaban (1979), পৃ. 121–122
  26. Blankinship (1994), পৃ. 180
  27. Blankinship (1994), পৃ. 180–181
  28. Gibb (1923), পৃ. 81–83
  29. Shaban (1979), পৃ. 124
  30. Blankinship (1994), পৃ. 181–182
  31. Gibb (1923), পৃ. 83–84
  32. Shaban (1979), পৃ. 125–126
  33. Hawting (2000), পৃ. 87
  34. Gibb (1923), পৃ. 84–85
  35. Blankinship (1994), পৃ. 182
  36. Blankinship (1994), পৃ. 183–184
  37. Gibb (1923), পৃ. 90–91
  38. Shaban (1979), পৃ. 130
  39. Gibb (1923), পৃ. 92–93
  40. Hawting (2000), পৃ. 107
  41. Hawting (2000), পৃ. 107–108
  42. Shaban (1979), পৃ. 134–136
  43. Sharon (1990), পৃ. 42–45
  44. Shaban (1979), পৃ. 136
  45. Sharon (1990), পৃ. 45
  46. Hawting (2000), পৃ. 108
  47. Shaban (1979), পৃ. 136–137
  48. Sharon (1990), পৃ. 45–46
  49. Hawting (2000), পৃ. 108–109, 116–118
  50. Shaban (1979), পৃ. 137ff.
  51. Sharon (1990), পৃ. 49ff.

উৎস সম্পাদনা