আলিঙ্গন হচ্ছে শারীরিক অন্তরঙ্গতার একটি অংশ। যা সার্বজনীনভাবে মনুষ্য সম্প্রদায়েই দেখা যায়। আলিঙ্গনের মাধ্যমে দুই বা তার অধিক ব্যক্তি একে অপরকে ঘাড়ে, পশ্চাতে অথবা কোমড়ে; বাহু দ্বারা ঘনিষ্ঠভাবে বেষ্টন করে। যদি দুইয়ের অধিক ব্যক্তি এই আলিঙ্গনে জড়িত থাকে তাহলে তাকে দলগত আলিঙ্গন বলা হয়।

ওয়েডিং অনুষ্ঠানে দুটি বন্ধবীর মধ্যে এক আনন্দঘন আলিঙ্গন

শব্দের ব্যুৎপত্তি সম্পাদনা

বাংলায় শব্দটির উৎপত্তি সংস্কৃত আ + √লিনগ্ + অন থেকে।

বৈশিষ্ট্য সম্পাদনা

 
লুইস এলিজাবেথ ভিগে লি ব্রুন দ্বারা ১৭৮৯ সালে অঙ্কিত মাদাম ভিগে লেব্রুন এট সা ফিলে

আলিঙ্গনের সাথে চুমু দেওয়া ইশারায় বাতচিৎ করার একটা অংশ বলে ধরা হয়। তবে এ বিষয়টা নির্ভর করে সেই সমাজের সংস্কৃতি, স্থান-কাল-পাত্র, উভয় ব্যক্তির মাঝে আন্তঃসম্পর্কের উপর। আলিঙ্গন ভালোবাসা, স্নেহ, বন্ধুত্ব, ভ্রাতৃত্ব অথবা সহমর্মিতার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়।[১] আলিঙ্গন; বিশেষ করে শব্দের মাধ্যমে ভাব প্রকাশে অসমর্থ হলে সমর্থন, স্বাচ্ছন্দ্য এবং শান্তনার একটা রুপ হয়ে উঠতে পারে। আলিঙ্গন স্নেহ এবং আবেগের উষ্ণতা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কখনো কখনো অনেকদিন পর কারো সাথে দেখা হলে বা পুনর্মিলন হলে আনন্দ এবং সুখবোধের প্রতীক হিসেবে এই আলিংগন করা হয়ে থাকে। অন্যের সম্মতির তোয়াক্কা না করে একক ইচ্ছায় আলিঙ্গন করলে সম্পর্কে সমস্যা হতে পারে। একটি আলিঙ্গন; বাহুদ্বয় দ্বারা বন্ধুকে পূর্ণ পরিবেষ্টিত না করে স্বল্প এক সেকেন্ডের চাপ থেকে শুরু করে দীর্ঘায়িত সময় পর্যন্ত ব্যাপ্ত হতে পারে। আলিঙ্গনের এই সময়সীমা পরিস্থিতিভেদে সামাজিক এবং সাংস্কৃতিকভাবে নির্ধারিত হয়ে থাকে। অনেকসময় প্রেমিক-প্রেমিকার ক্ষেত্রে এই আলিঙ্গনের সময় উভয়ের দ্বারা হিপে চাপ দেওয়া হয়ে থাকে।

অন্য কোন ধরনের শারীরিক সংস্পর্ষের মত না হয়ে সকলের সামনে ও গোপনে, বিভিন্ন দেশে ধর্মে, সংস্কৃতিতে, বয়স ও লিঙ্গের ঊর্ধ্বেই কোন রকম গোঁড়ামি ছাড়াই আলিঙ্গন এর চর্চা করা যায়। কিন্তু সাধারণভাবে এর দ্বারা প্রকাশিত হয় যে, আলিঙ্গনকারীগণ একে অপরের পরিচিত ।[২] হ্যান্ডশেকের সম্পর্ক থেকে আলিঙ্গনের সম্পর্কে প্রত্যাবর্তন, ঘনিষ্ঠ বন্ধু হওয়ার প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

 
খেলায় বিজয় পরবর্তী আলিঙ্গন

একটি অনাকাঙ্ক্ষিত আলিঙ্গনকে একজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে আক্রমণ হিসেবে ধরা হয়, কিন্তু যদি উভয়েই একে অপরকে আলিঙ্গন করে অর্থাৎ আলিঙ্গনের বিনিময় ঘটে, তাহলে এর দ্বারা সুচিত হয় যে; পূর্বোক্ত আলিঙ্গনটি স্বাগত হয়েছে। কিছু পাশ্চাত্য বিশ্লেষক পরামর্শ দিয়েছেন, জনসম্মুখে বা কর্মক্ষেত্রে অস্বস্তিকর পরিস্থিতি এড়াতে আলিঙ্গন না করতে; বিশেষ করে তাদের সাথে যারা আলিঙ্গন অপছন্দ করে।[৩]শিশুরা তাদের খেলার পুতুল বা কৃত্রিম পশুকে আলিঙ্গন করে থাকে। তরুণরা তাদের পিতা-মাতাকে কোনো কিছুর ভয়ে ভীত হলে; অভয় প্রদানের উদ্দেশ্যে অনেক সময় আলিঙ্গন করে থাকে। যদিও এটাকে ঠিক আলিঙ্গন হিসেবে বর্ণনা করা ঠিক নয়, এ আলিঙ্গনের দ্বারা এটা বুঝানো হয়, সন্তান তার পিতা-মাতাকে ভবিষ্যৎ অনাগত বিপদ থেকে প্রতিরক্ষা দিবে।

সাংস্কৃতিক প্রভাব সম্পাদনা

খুব একটা দেখা না গেলেও, কিছু সমাজে আলিঙ্গন একটা স্বাভাবিক প্রথার অংশ। যেমনঃ ফ্রান্স, স্পেইন এবং ল্যাটিন আমেরিকার সংস্কৃতির প্রথায়; পুরুষ বন্ধুদের আনন্দময় অভিবাদনের সময়, আলিঙ্গন (একইসাথে তাদের পিছন থেকে চাপড়েও দেওয়া হয়) করা হয়।[৪] পশ্চিমা সমাজে নারীরা পার্টিতে বা অন্য কোথাও একত্রিত হলে আলিঙ্গনের পাশাপাশি গালে (cheek) চুমু খেতে দেখা যায়। পর্তুগাল এবং ব্রাজিলের অধিকাংশ পুরুষদের মধ্যে চিঠি বা ইমেইল প্রেরকের নামের স্বাক্ষরের নিচে Um abraço বা Abraço ব্যবহার করতে দেখা যায়। মৌখিক কথোপকথনের ক্ষেত্রেও একই ফর্মুলা ব্যবহৃত হতে পারে। রোমান ক্যাথলিকের হলি মাস অনুষ্ঠানে কিস অব পিচ নামক ধর্মীয় রীতি পালনের সময় আলিঙ্গন; চুমু অথবা হ্যান্ডশেকের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।

 
তরুণরা তাদের নিজেদের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব প্রকাশের জন্য দলবদ্ধভাবে আলিঙ্গন করছে

২০০৯ সালের মে মাসে নিউ ইয়র্ক টাইমস প্রতিবেদনে উল্লেখ করে বলে "যুক্তরাষ্ট্রের কিশোরদের মধ্যে সামাজিক অভিবাদন হিসেবে আলিঙ্গনের সংস্কৃতি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।"[৫] যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কিছু বিদ্যালয়ে জনসম্মুখে আলিঙ্গনের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয়েছে। এর প্রতিবাদে কিছু স্কুলের শিক্ষার্থী রা বিক্ষোভ-আন্দোলন করেছে।[৬][৭]

২০১৫ সালে একজন কানাডিয়ান সাংবাদিক তার তদন্তে উল্লেখ করে বলেন, ব্রুমান্সে আলিঙ্গনের সংস্কৃতি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। কিউবেকের ফ্রান্স ভাষীদের মধ্যেও এই আলিঙ্গনের প্রথা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।[৮]

কিছু সংস্কৃতি যেমনঃ নামিবিয়ার হিম্বা জনগণ আলিঙ্গনকে ভালোবাসা, স্নেহের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করে না।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] ইসলামের রোজা রাখার মাস রমজানের পরে আলিঙ্গন করা হালাল। কিন্তু যদি কামোবাসনার উদ্দেশ্যে এই আলিঙ্গন করা হয়, তবে তা হারাম (পাপ)।[৯]

স্বাস্থ্যকর উপযোগিতা সম্পাদনা

আলিঙ্গনের যে স্বাস্থ্যকর উপযোগিতা আছে, তা প্রমাণিত হয়েছে। একটি গবেষণা থেকে দেখা গিয়েছে আলিঙ্গন অক্সিটোসিন নিঃসরণের মাত্রা বাড়ায় এবং রক্তচাপ হ্রাস করে।[১০]

সুনির্দিষ্ট গবেষণার উপর থেকে নির্ভর করে এটা বলা যায় যে ২০ সেকেন্ড বা তার থেকে অধিক সময়ের আলিঙ্গন অক্সিটোসিন নিঃসরণ করে,[১১] লিও বাস্কাগ্লিয়া লোকজনকে উৎসাহিত করে বলেন, ২১ দিন ধরে ধারাবাহিকভাবে আলিঙ্গন করতে এবং প্রতিটা আলিঙ্গন যেন অন্ততপক্ষে ২১ সেকেন্ড স্থায়ী হয়। তার ভাষায় "আলিঙ্গনেই নিজেকে হারিয়ে ফেলুন ", "আলিঙ্গনের যে শক্তি, তাকে বর্তমান সময়ে ব্যবহার করুন"।

দলগত আলিঙ্গন সম্পাদনা

দলগত আলিঙ্গন গ্রুপ থেরাপির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ। এই আলিঙ্গন কোনো অধিবেশনের পর; অধিবেশনে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে শক্ত বন্ধন তৈরীতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।[১২] যদিও এটা যেসব ব্যক্তি শারীরিক সংস্পর্শে আসতে লজ্জ্বাবোধ করে, তাদের জন্য অস্বস্তির কারণ হতে পারে।[১২]

কোলে নিয়ে আদর করা (cuddling) সম্পাদনা

কাডলিং হচ্ছে শারীরিক ঘনিষ্ঠতার একটি অংশ, যেখানে দুইজন ব্যক্তির একজন অপরকে বাহু বেষ্টনী দ্বারা সম্পুর্ণভাবে আচ্ছাদিত করে ফেলে। কাডলিং বা কোলে নেওয়ার বিষয়টি হতে পারে;- পরিবারের সদস্যদের সাথে, বন্ধুর সাথে অথবা ভালোবাসার মানুষের সাথে। ২০১৪ সালে, ব্রিটিশ সমাজবিজ্ঞানী এরিক এণ্ডারসন এবং মার্ক এমসি.করম্যাক একটি গবেষণা প্রকাশ করেন, যেখানে দেখা যায়, ব্রিটিশ বিসমকামী শিক্ষার্থীদের ৯৩ শতাংশ এথলেটস(শারীরবিদ) তাদের পুরুষ বন্ধুদের সাথে বন্ধুত্বের প্রতীক হিসেবে প্রণয়াবিষ্ট আচরণ করে অথবা তাদের কোলে তুলে নেয়।[১৩][১৪] আলিঙ্গনের চেয়ে জড়িয়ে ধরে আদর করা- আরও অধিক স্নেহপ্রবণ, আরও অধিক ঘনিষ্ঠ। সাধারণত এটা দীর্ঘসময় ধরে (সচরাচর কয়েক মিনিট থেকে কয়েক ঘণ্টা) হয়ে থাকে।আলিঙ্গন ইশারামুলক অভিবাদন বা ঐতিহ্যমুলক বিদায়ী সংস্কৃতি হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে, পক্ষান্তরে কাডলিং হয়ে থাকে দুইজন ব্যক্তির মধ্যে, যখন তারা একত্রে শয়ন করে বা ঘনিষ্ঠভাবে কোথাও অবস্থান করে। আলিঙ্গনের ন্যায়, কাডলিং এও অক্সিটোসিন হরমোন নিঃসরণ হয়; যার প্রকরণভেদে বিশেষ প্রভাব আছে।

আরও দেখুন সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Kathleen Keating (১৯৯৪)। The Hug Therapy Book। Hazelden PES। আইএসবিএন 1-56838-094-1 
  2. Duranti, Alessandro (জুন ১৯৯৭)। "Universal and Culture-Specific Properties of Greetings"। Journal of Linguistic Anthropology7 (1): 63–97। 
  3. "A New Rule For The Workplace: 'Hug Sparingly'"। NPR। ২০১৪-০১-১১। 
  4. William Cane, The Art of Hugging: The World-Famous Kissing Coach Offers Inspiration and Advice on Why, Where, and How to Hug, St. Martin's Griffin, USA, 2013
  5. Kershaw, Sarah (২০০৯-০৫-২৭)। "For Teenagers, Hello Means 'How About a Hug?'"The New York Times। জুলাই ১৪, ২০১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৯-০৫-২৯ 
  6. Grant, Denise (২০১০-০৪-১৫)। "Students pan hugging ban"। ২০১২-০৩-২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। 
  7. "School Bans Hugs Over 2 Seconds"। ২০০৮-০৩-০২। মে ১৬, ২০০৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। 
  8. Lili Boisvert, radio-canada.ca, Bromance : ces gars qui craquent pour leurs amis ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৬ তারিখে, Canada, January 19, 2015
  9. "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ২০ অক্টোবর ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৬ নভেম্বর ২০১৭ 
  10. "How hugs can aid women's hearts"। BBC News। আগস্ট ৮, ২০০৫। সংগ্রহের তারিখ ২০০৮-১১-২৮ 
  11. "The health benefits of hugging" 
  12. Albert Pesso, Movement in Psychotherapy: Psychomotor Techniques and Training (1969), p. 92-93.
  13. Eric Anderson, Mark McCormack, Journal Men and Masculinities, Cuddling and Spooning: Heteromasculinity and Homosocial Tactility among Student-athletes, UK, March 12, 2014
  14. HENRY ALFORD, Journal nytimes.com, The Bro Hug: Embracing a Change in Custom, USA, September 26, 2014

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা

  •   উইকিমিডিয়া কমন্সে আলিঙ্গন সম্পর্কিত মিডিয়া দেখুন।