আলবার্ট ভন কলিকার

একজন সুইস শারীরস্থানবিদ, শারীরবৃত্তবিদ এবং কলাস্থানবিদ।

আলবার্ট ভন কলিকার (জন্ম রুডলফ আলবার্ট কলিকার; ৬ জুলাই ১৮১৭ – ২ নভেম্বর ১৯০৫) ছিলেন একজন সুইস শারীরস্থানবিদ, শারীরবৃত্তবিদ এবং কলাস্থানবিদ

রুডলফ আলবার্ট ভন কলিকার
জন্ম
রুডলফ আলবার্ট কলিকার

(১৮১৭-০৭-০৬)৬ জুলাই ১৮১৭
মৃত্যু২ নভেম্বর ১৯০৫(1905-11-02) (বয়স ৮৮)
জাতীয়তাসুইজারল্যান্ড
মাতৃশিক্ষায়তনজুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়
বন বিশ্ববিদ্যালয়
বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়
পরিচিতির কারণপ্রাণিবিদ্যায় অবদান
পুরস্কারকপলি পদক(১৮৯৭),
লিনিয়ান পদক (১৯০২)
বৈজ্ঞানিক কর্মজীবন
কর্মক্ষেত্রঅ্যানাটমি, ফিজিওলজি
ডক্টরাল উপদেষ্টাইয়োহানেস পিটার মুলার,
ফ্রিডরিখ গুস্টাভ জাকব হেনলে

জীবনী সম্পাদনা

আলবার্ট কলিকারের জন্ম সুইজারল্যান্ডের জুরিখে। তাঁর প্রাথমিক পড়াশোনা জুরিখে সম্পন্ন হয় এবং তিনি ১৮৩৬ সালে সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তবে দুই বছর পর তিনি বন বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং পরবর্তীতে বার্লিনে চলে আসেন এবং বিশিষ্ট ফিজিওলজিস্ট ইয়োহানেস পিটার মুলার ও ফ্রিডরিখ গুস্টাভ জাকব হেনলের শিষ্য হন। তিনি ১৮৪১ সালে জুরিখে দর্শনে এবং ১৮৪২ সালে হাইডেলবার্গে চিকিৎসাবিদ্যাতে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন। তাঁর প্রথম একাডেমিক পদটি ছিল ফ্রিডরিখ হেনেলের অধীনে অ্যানাটমির প্রসেক্টর পদ। তবে এই অফিসে তাঁর মেয়াদ কাল ছিল অল্প। ১৮৪৪ সালে জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে এসে তিনি ফিজিওলজি এবং তুলনামূলক অ্যানাটমির বিশিষ্ট অধ্যাপকের আসনে অধিষ্ঠিত হন। এখানেও তাঁর অবস্থানকাল ছিল সংক্ষিপ্ত। তাঁর উদীয়মান খ্যাতির জন্য ১৮৪৭ সালে তাঁকে ভুরৎসবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিজিওলজি বিভাগের এবং মাইক্রোস্কোপিকাল ও তুলনামূলক অ্যানাটমি বিভাগের অধ্যাপক পদে যোগ দানের প্রস্তাব দেওয়া হয়। তিনি পদটি গ্রহণ করেন এবং অত্যন্ত লোভনীয় সব অফার পাওয়া সত্ত্বেও, তিনি এই বেভারিয়ান শহরের শান্ত একাডেমিক জীবন ছেড়ে আর যান নি কোথাও। মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর বাকি জীবন তিনি ভুরৎসবুর্গেই কাটিয়ে দেন।[১]

জুরিখ এবং পরে ভুরৎসবুর্গে, কলিকারের উপর অর্পিত দায়িত্ব ছিল তুলনামূলক শারীরস্থান বিষয়ে পাঠদান করা। তাঁর প্রকাশিত অসংখ্য স্মরণিকাতে, (তাঁর রচিত প্রথমটি সহ) এবং যেসব ১৮৪১ সালে স্নাতক ডিগ্রী অর্জনের আগে আগে প্রকাশিত হয়েছিল, সেসবে তিনি বিচিত্রসব প্রাণীর গঠন সংক্রান্ত আলোচনা করেছিলেন। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল মেডুসি এবং সে জাতীয় প্রাণীর বিষয়ে তাঁর রচনাবলি। এসব বিষয়ে কাজ করার তাগিদে তিনি ভূমধ্যসাগর এবং স্কটল্যান্ডের উপকূলে প্রাণিবিদ্যা সংক্রান্ত সফরে যান। এর পাশাপাশি তাঁর বন্ধু কার্ল থিওডর আর্নস্ট ভন সিবোল্ডের সাথে যৌথভাবে ১৮৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত "বৈজ্ঞানিক প্রাণীবিদ্যা জার্নাল" (Zeitschrift für Wissenschaftliche Zoologie) এর সম্পাদনার দায়িত্ব নেন এবং এটিকে তিনি একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রাণিবিদ্যা সংক্রান্ত সাময়িকী হিসেবে পরিচালনা করতে থাকেন।[১]

কলিকারের হাতের এক্স-রে তাঁর বন্ধু ভিলহেল্ম র‌ন্টগেনের একেবারে শুরুর দিকে করা এক্স-রে গুলির মধ্যে একটি।[২]

 
কলিকারের হাতের এক্স-রে, যা ভিলহেল্ম র‌ন্টগেন ১৮৯৬ সালের ২৩ জানুয়ারি প্রস্তুত করেছিলেন।

কাজ সম্পাদনা

কলিকার প্রাণিবিদ্যা সংক্রান্ত গবেষণায় অবদান রেখেছিলেন। প্রথম দিকে তিনি কাজ করেন অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের নিয়ে এবং সেফালোপডদের উপর তাঁর রচিত স্মৃতিকথা (১৮৪৪ সালে প্রকাশিত) একটি ধ্রুপদী রচনা হিসেবে পরিগণিত হয়। তবে, অল্প সময় পরেই তিনি মেরুদণ্ডীদের দিকে ঝুঁকে পড়েন এবং উভচরস্তন্যপায়ীদের ভ্রূণের উপরে অধ্যয়ন করেন। গোড়ার দিকে যাঁরা জৈবিক অনুসন্ধানের এই শাখায় নতুন নতুন অণুবীক্ষণিক কৌশল, যেমন- হার্ডেনিং (কঠিনীকরণ), সেকশনিং (ভাগ ভাগ করা) এবং স্টেইনিং (রঞ্জন) পদ্ধতি প্রবর্তন করেছিলেন, তাঁদের ভিতর তিনি ছিলেন অন্যতম। এসব করার মাধ্যমে, তিনি কেবল নিজেরই নয় বরং অন্যদেরও একই প্রকার অগ্রগতির ধারা গতিশীল করেছিলেন। উনিশ শতকের মাঝামাঝি এবং শেষ দিকে ভ্রূণবিদ্যার যে অগ্রসর ঘটেছিল, তার সাথে কলিকারের নাম চিরকাল জড়িত থাকবে। ১৮৬১ সালে প্রকাশিত তাঁর লেকচারস অন ডেভেলপমেন্ট , খুবই অল্প সময়ের ভিতর একটি প্রামাণ্য রচনায় পরিণত হয়।[৩]

তবে প্রাণিবিদ্যা কিংবা ভ্রূণবিদ্যা, কোনটাই কলিকারের খ্যাতি লাভের প্রধান কারণ নয়। বিজ্ঞানের এই শাখাগুলোর জন্য তিনি যতটা না করেছেন, তার থেকে বেশি করেছেন হিস্টোলজির জন্য। তাঁর শুরুর দিককার কাজগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে- ১৮৪৭ সালে তিনি প্রদর্শন করেন যে, মসৃণ বা ঐচ্ছিক পেশি নিউক্লিয়াসযুক্ত পেশি কোষের পৃথক পৃথক ইউনিট দ্বারা গঠিত হয়। এই কাজে তিনি তাঁর গুরু হেনেলের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছিলেন। এর কয়েক বছর আগে, ধমনির প্রাচীরে পেশি রয়েছে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ ছিল। এছাড়াও, সংবহনতন্ত্রের উপর স্নায়ুতন্ত্রের প্রভাব সম্পর্কে ধারণাগুলোর সপক্ষেও সঠিক হিস্টোলজিকাল ভিত্তি ছিল না। তবে অচিরেই এসব প্রমাণাদি প্রকাশিত হয় এবং ফিজিওলজির অগ্রগতিতে বিরাট প্রভাব ফেলে।[১]

হিস্টোলজিতে কলিকারের ব্যাপক অবদান রয়েছে। কলিকার মসৃণ পেশি, রৈখিক পেশি, ত্বক, অস্থি, দাঁত, রক্তনালি এবং ভিসেরা সবকিছুতেই অনুসন্ধান চালিয়েছিলেন এবং সেগুলোর প্রতিটি থেকেই নতুন নতুন কোন না কোন সত্য আবিষ্কার করেছিলেন। তিনি যেসব সিদ্ধান্তে উপনীত হতেন তার কিছু অংশ লিপিবদ্ধ হয় পৃথক স্মৃতিগ্রন্থাবলিতে, আর কিছু অংশ অণুবীক্ষণিক শারীরস্থানের উপরে তাঁর রচিত দুর্দান্ত পাঠ্যপুস্তকটিতে, যা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৫০ সালে।[১]

আলবার্ট লেনিঙার দাবি করেছিলেন যে, প্রথম কয়েকজনের মধ্যে কলিকারও একজন ছিলেন, যিনি ১৮৫০ সালের দিকে শুরু করে বছরখানেক যাবত রৈখিক পেশির সারকোপ্লাজমের ভিতর গ্র্যানুলের বিন্যাস লক্ষ করেন। পরবর্তীতে এই গ্র্যানুলগুলোকে ১৮৯০ সালে রেতসিউস সারকোজোম নাম দেন। এই সারকোজোমগুলো কোষের পাওয়ার হাউস তথামাইটোকন্ড্রিয়া হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। লেনিঙারের ভাষায়, "কলিকারকে সর্বপ্রথম কোষের কাঠামো থেকে মাইটোকন্ড্রিয়া পৃথক করার জন্যও ক্রেডিট দেওয়া উচিত। ১৮৮৮ সালে তিনি এই গ্র্যানুলগুলোকে কীটপতঙ্গের পেশী থেকে আলাদা করেন, যেখানে এগুলো প্রচুর পরিমাণে থাকে। তিনি দেখেন যে এগুলো পানিতে রাখলে ফুলে যায় এবং একটি ঝিল্লি ধারণ করে।"[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

প্রায় প্রতিটি টিস্যুর ক্ষেত্রে- আমাদের বর্তমান যে জ্ঞান রয়েছে, তার কোন না কোন তথ্য প্রথম কলিকারের আবিষ্কৃত - স্নায়ুতন্ত্রের উপর কাজ করার জন্যই তাঁর নামটি সবচেয়ে বেশি স্মরণীয় হয়ে রয়েছে। সেই ১৮৪৫ সালের দিকেই, জুরিখে থাকা অবস্থায়, তিনি স্পষ্ট প্রমাণ দেন যে, স্নায়ু তন্তুগুলো স্নায়ুকোষগুলোর সাথে অবিচ্ছিন্ন অবস্থায় থাকে এবং এর মাধ্যমে তিনি কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের কার্যকলাপ সংক্রান্ত সকল প্রকার সঠিক অনুমানের জন্য অত্যাবশ্যকীয় ভিত্তি প্রদান করেন।[১]

সেই থেকেই তিনি স্নায়ুতন্ত্রের হিস্টোলজিতে নিরলসভাবে শ্রম দেওয়া শুরু করেন, এবং বিশেষ করে যেসব কঠিন সমস্যাগুলোতে মস্তিষ্ক এবং সুষুম্নাকাণ্ডে স্নায়ু তন্তু ও স্নায়ুকোষগুলোর পেঁচিয়ে থাকার জটিল বিন্যাস প্রতীয়মান হত। তাঁর শুরুর দিকের দিনগুল থেকেই পদ্ধতির একজন ওস্তাদ হিসেবে, তিনি কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের অনুসন্ধান কার্যে এবং বিজ্ঞানের বৃহত্তর স্বার্থে নব্য গলগি স্টেইনিং পদ্ধতির মূল্য এক ঝলক দেখেছিলেন। পড়তি বয়সে তিনি আরও একবার তা গ্রহণ করেন, তবে একটি নতুন উপায়ের সাহায্য নিয়ে, তা হল যেসব অধ্যয়নের জন্য যৌবনে তিনি এত কিছু করেছিলেন। কলিকার মস্তিষ্কের অভ্যন্তরীণ কাঠামো সংক্রান্ত জ্ঞানের ক্ষেত্রে ব্যাপক অবদান রেখেছিলেন।[১][৪] ১৮৮৯ সালে তিনি স্নায়ুবিজ্ঞানের জনক সান্তিয়াগো রামন ই কাহালের হিস্টোলজিকাল প্রস্তুতিসমূহ পুনরুৎপাদন করেন এবং নিউরোনিজম তত্ত্বকে নিশ্চিত করেন।

সম্মাননা সম্পাদনা

১৮৯৭ সালে বেভারিয়ার প্রিন্স রিজেন্ট লুইটপোল্ড কলিকারকে মহিমান্বিত করেন (ennoblement), ফলে তিনি তাঁর পদবিতে "ভন" উপাধি যুক্ত করার অনুমতি পান।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] তাকে বহু দেশের বিজ্ঞ সমাজের সদস্য করা হয়েছিল। ইংল্যান্ডে তিনি একাধিকবার ভ্রমণ করেছিলেন। রয়েল সোসাইটি ১৮৬০ সালে তাঁকে ফেলোশিপ প্রদান করে এবং ১৮৯৭ সালে তাঁকে সর্বোচ্চ সম্মাননা কপলি পদকে ভূষিত করে।[১]

টিকটিকির একটি প্রজাতি Hyalosaurus koellikeri তাঁর সম্মানে নামকরণ করা হয়েছে।[৫]

মন্তব্য সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

আরও পড়ুন সম্পাদনা