আবর্জনা কুড়ানো ব্যক্তি

যে ব্যক্তি অন্য লোকের ফেলে দেওয়া আবর্জনা থেকে পুনরায় ব্যবহারযোগ্য বা পুনঃচক্রায়নযোগ্য বস্ত

একজন আবর্জনা কুড়ানো ব্যক্তি বলতে এমন একজন ব্যক্তিকে বোঝায় যে অন্য লোকের ফেলে দেওয়া বর্জ্য বস্তু বা আবর্জনা সংগ্রহ করে, সেগুলি থেকে বাছাই করে পুনরায় ব্যবহারযোগ্য বা পুনঃচক্রায়নযোগ্য বস্তু বা পদার্থ উদ্ধার করে এবং পরে সেগুলিকে হয় ব্যক্তিগতভাবে ভোগ করে কিংবা কম দামে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে।[১] বাংলা ভাষায় এদেরকে "কুড়ানি", "টোকাই", ইত্যাদি নেতিবাচক নামেও ডাকা হয়। সারা বিশ্ব জুড়ে বহু কোটি আবর্জনা কুড়ানো ব্যক্তি রয়েছে। এদের সিংহভাগই উন্নয়নশীল দেশগুলিতে বাস করে। তবে শিল্পোত্তর দেশগুলিতেও এদের সংখ্যা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে।[২]

ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তা নগরীতে আবর্জনা কুড়ানো ব্যক্তিরা আবর্জনা কুড়াচ্ছেন

প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন উপায়ে আবর্জনা কুড়ানোর প্রচলন হয়ে এসেছে। তবে আধুনিক যুগের আবর্জনা কুড়ানোর ঐতিহ্যটি মূলত ১৯শ শতকের শিল্পায়নের যুগে শেকড় গেড়েছিল।[৩] বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে এসে এবং একবিংশ শতাব্দীর শুরুতেও নগরায়ন, বিষাক্ত উপনিবেশবাদ এবং বৈশ্বিক আবর্জনা বাণিজ্যের কারণে আবর্জনা কুড়ানোর পেশাটি উন্নয়নশীল বিশ্বে ব্যাপকভাবে বিস্তারলাভ করেছে।[৪] বহু নগরীতে কেবল কঠিন আবর্জনা সংগ্রহের ব্যবস্থা আছে।[৫] কিছু কিছু দেশের আবর্জনা কুড়ানো ব্যক্তিরা শক্ত আবর্জনা সংগ্রহের সিংহভাগ বা পুরোটাই সম্পাদন করেন। ফলে সর্বব্যাপী জনগণের সুবিধা হয় এবং উচ্চহারের পুনঃচক্রায়ন সম্ভব হয়।

আবর্জনা কুড়ানো ব্যক্তিরা স্থানীয় অর্থনীতি, জনস্বাস্থ্যনিরাপত্তা, টেকসই পরিবেশ, ইত্যাদিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। কিন্তু বেশিরভাগ দেশেই আবর্জনা কুড়ানো ব্যক্তিদের সামাজিক মর্যাদা অত্যন্ত নিম্ন, তাদের কাজের ও বসবাসের পরিবেশ অস্বাস্থ্যকর ও অপর্যাপ্ত। তারা স্থানীয় প্রশাসনের কাছ থেকেও খুবই কম সুবিধা ভোগ করে। তাদেরকে অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির অংশ হিসেবে গণ্য করা হয়। তারা সাধারণত বস্তিবাসী হয় এবং জীবিকা উপার্জনের আর কোনও উপায় খুঁজে না পেয়ে এই অনানুষ্ঠানিক পেশাতে কাজ করতে আসে। ইদানীং শক্তিশালী ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলিও আবর্জনা সংগ্রহের ব্যাপারে উৎসুক হয়েছে বলে সেগুলির সাথে তাদেরকে সংগ্রাম করে চলতে হচ্ছে।

২০০৮ সালে দক্ষিণ আমেরিকার কলম্বিয়ার রাজধানী বোগোতা শহরে আবর্জনা কুড়ানো ব্যক্তিদের প্রথম বিশ্ব সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে "আবর্জনা কুড়ানো ব্যক্তি" বা ইংরেজিতে "ওয়েস্ট পিকার" (Waste picker) পরিভাষাটি গৃহীত হয়। স্পেনীয় ভাষায় এদেরকে এখন রেসিক্লাদোর (Reciclador "পুনঃচক্রায়ক") নামে ডাকা হয়।

আবর্জনা কুড়ানো ব্যক্তিরা গৃহস্থালি, ব্যবস্থা ও শিল্পকারখানার বর্জ্য পদার্থ সংগ্রহ করে। তারা ব্যক্তিগত আবর্জনাধার (ডাস্টবিন, ডাম্পস্টার) থেকে, সড়কের বা জলপ্রবাহ বা জলাশয়ের ধার থেকে কিংবা আবর্জনাক্ষেত্র থেকেও এগুলি সংগ্রহ করতে পারে। কেউ প্রয়োজনীয় দ্রব্যের খোঁজে এ কাজ করে। আবার কেউ পুনঃচক্রায়নযোগ্য বস্তু মধ্যসত্ত্বভোগী কিংবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করে।

অর্থনৈতিক প্রভাব সম্পাদনা

২০০৭ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণা গ্রন্থ অনুযায়ী, ভারতের মুম্বই নগরীতে ৩০ হাজার আবর্জনা কুড়ানো ব্যক্তি ছিল, যারা প্রায় ৪ শত অতিক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করে ঐ সব বর্জ্য প্রক্রিয়াজাত করে ভোগ্য পণ্য তৈরি করে বিক্রি করত। এইসব কর্মকাণ্ডের বাৎসরিক মূল্য ছিল প্রায় ১০০ কোটি মার্কিন ডলার। একই সময়ে দক্ষিণ আমেরিকার আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনোস আইরেস নগরীতে প্রায় ৪০ হাজার আবর্জনা কুড়ানো ব্যক্তি কার্ডবোর্ড ও অন্যান্য পুনঃচক্রায়নযোগ্য বস্তু রাস্তা থেকে সংগ্রহ করত, যার অর্থনৈতিক প্রভাবের মূল্যমান প্রায় ১৭ কোটি ৮০ লক্ষ মার্কিন ডলার। ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তাতে আবর্জনা কুড়ানো ব্যক্তিরা নগরীর বর্জ্যের প্রায় এক-চতুর্থাংশ পুনরুদ্ধার করে, যার ওজন বাৎসরিক প্রায় ৩ লক্ষ ৭৮ হাজার টন; এতে জাকার্তা নগরীর প্রতি মাসে ৩ লক্ষ মার্কিন ডলার সাশ্রয় হয় এবং অর্থনীতিতে এই কাজের প্রভাবের মূল্য প্রায় ৫ কোটি মার্কিন ডলার।[৬]

আবর্জনা কুড়ানো ও অবৈধ শিশুশ্রম সম্পাদনা

প্রায়শই হতদরিদ্র পরিবারের শিশুরা আবর্জনা কুড়ানোর কাজে নিয়োজিত হয়। তারা নিজের জীবন বাঁচাতে কিংবা পরিবারের আয়ে অবদান রাখতে এই কাজ করে থাকে। উন্মুক্ত আবর্জনাক্ষেত্রে এই ধরনের কর্মকাণ্ডকে বিশ্ব ব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে শিশুশ্রমের সর্বনিকৃষ্ট একটি রূপ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এর ফলে শিশুর স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয় এবং তাদের দৈহিক ও মানসিক বিকাশ ব্যহত হয়।[৭]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Srinivas, Hari। "Solid Waste Management: Glossary"। The Global Development Research Center। সংগ্রহের তারিখ ১৩ নভেম্বর ২০১১ 
  2. Gowan, Teresa (১৯৯৭)। "American Untouchables: Homeless Scavengers in San Francisco's Underground Economy"। International Journal of Sociology and Social Policy17 (3/4): 159–190। ডিওআই:10.1108/eb013304 
  3. Martin, Medina (২০০৭)। The World's Scavengers: Salvaging for Sustainable Consumption and Production। New York: Altamira Press। 
  4. Wilson, D. C., Velis, C., Cheeseman, C. (২০০৫)। Role of informal sector in recycling in waste management in developing countries। London: Department of Civil and Environmental Engineering, Centre for Environmental control and Waste Management। 
  5. Scheinberg; Justine Anschütz (ডিসেম্বর ২০০৭)। "Slim pickin's: Supporting waste pickers in the ecological modernisation of urban waste management systems"। International Journal of Technology Management and Sustainable Development5 (3): 257–27। ডিওআই:10.1386/ijtm.5.3.257/1 
  6. Martin Medina (২০০৭), The World’s Scavengers: Salvaging for Sustainable Consumption and Production., Lanham, MD 
  7. Martin Medina (২০০৮), The informal recycling sector in developing countries, Private Participation in Infrastructure (PPI) - World Bank Group 

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা