আবদুল হালিম গজনবী

বাঙালী রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী

স্যার আবু হুসাইন আবদুল হালিম খান গজনবী (১১ নভেম্বর ১৮৭৬ - ১৮ জুন ১৯৫৩) ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের একজন রাজনীতিবিদ, জমিদার ও শিল্পপতি। বাংলা এবং ব্রিটিশ ভারতের কেন্দ্রীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তিনি সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন।[১]

স্যার

আবদুল হালিম গজনভি
জন্ম(১৮৭৬-১১-১১)১১ নভেম্বর ১৮৭৬
মৃত্যু১৮ জুন ১৯৫৩(1953-06-18) (বয়স ৭৬)
নাগরিকত্ব ব্রিটিশ ভারত (১৮৭৬-১৯৪৭)
 পাকিস্তান (১৯৪৭-১৯৫৩)
মাতৃশিক্ষায়তনসেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ, কলকাতা
পেশারাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী
প্রতিষ্ঠানসেন্ট্রাল ন্যাশনাল মোহামেডান এসোসিয়েশন
উল্লেখযোগ্য কর্ম
দি মুসলমান
দ্য স্টার অব ইন্ডিয়া
রাজনৈতিক দলভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস,
নিখিল ভারত মুসলিম লীগ
পিতা-মাতাআবদুল হাকিম খান গজনভি (বাবা)
করিমুন নেসা খানম চৌধুরানী (মা)
আত্মীয়স্যার আবদুল করিম গজনভি (ভাই),
বেগম রোকেয়া (খালা),
আবুল আসাদ মুহাম্মদ ইবরাহিম সাবের (মামা),
আবু জায়গাম মুহাম্মদ খলিল সাবের (মামা)
পুরস্কারনাইট (১৯৩৫)

প্রারম্ভিক ও শিক্ষাজীবন সম্পাদনা

আবদুল হালিম খান গজনভি ১৮৭৬ সালের ১১ নভেম্বর বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার গ্রামের জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা আবদুল হাকিম খান গজনভি এবং মা করিমুন নেসা খানম চৌধুরানী। আবদুল হাকিম খান গজনভি ছিলেন দেলদুয়ারের জমিদার[১]

আবদুল হালিম কলকাতার সিটি কলেজ স্কুল ও সেন্ট জেভিয়ার্স‌ কলেজে লেখাপড়া করেছেন।[১]

রাজনীতি সম্পাদনা

বঙ্গভঙ্গের সময় তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। তবে ইতিপূর্বে ১৯০০ সালে তিনি কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। তিনি স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার প্রতিনিধি, ময়মনসিংহ পৌরসভার চেয়ারম্যান, স্থানীয় বোর্ডের সদস্য এবং অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। কলকাতায় তার ব্যবসা ছিল। কংগ্রেসের নেতা অশ্বিনী কুমার দত্ত, বিপিন চন্দ্র পাল, সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী‌, চিত্তরঞ্জন দাশ, অরবিন্দ ঘোষের কাছ থেকে তিনি রাজনীতির অনুপ্রেরণা লাভ করেছিলেন। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন ও স্বদেশী আন্দোলনে তিনি ১৯০৫-১৯০৬ সালে কিছুকাল নেতৃত্ব দিয়েছেন। ১৯০৫ সালের ২৭ আগস্ট ঢাকার জগন্নাথ কলেজের প্রাঙ্গণে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। আনন্দ চন্দ্র রায় ছিলেন এর সভাপতি। আবদুল হালিম গজনভি সমাবেশে বক্তৃতা দেন। এতে তিনি বিলেতি দ্রব্য বর্জন এবং হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের প্রতি গুরুত্ব প্রদান করেন।[১]

১৯০৬ সালের ১৪ ও ১৫ এপ্রিল বরিশালে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস সম্মেলনে অংশ নেন। পরের বছর ১৯০৭ সালের ২৬ ও ২৭ ডিসেম্বর সুরাটে অনুষ্ঠিত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ২৩তম অধিবেশনে তিনি যোগ দেন। এসময় কংগ্রেসের ভাঙ্গন দেখা দেয়ায় তিনি কংগ্রেস ত্যাগ করে নিখিল ভারত মুসলিম লীগে যোগ দেন। ১৯১২ সালের ২ মার্চ কলকাতার ডালহৌসী স্কোয়ারে অনুষ্ঠিত বাংলার মুসলিম নেতাদের এক গুরুত্বপূর্ণ সভায় তিনি অংশ নেন। নবাব সলিমুল্লাহ ছিলেন সভার সভাপতি। ১৯২৬ সালের ২৯ ও ৩০ ডিসেম্বর দিল্লিতে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত মুসলিম লীগের ১৮তম বার্ষিক অধিবেশনে রাজকীয় কমিশনের নিকট পরিকল্পনা জমা দেয়ার জন্য গঠিত বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিটিতে তিনি অন্যতম সদস্য ছিলেন। তিনি মুসলিম লীগ কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন। কেন্দ্রীয় আইন পরিষদে তিনি মুসলিম লীগ সদস্য ছিলেন।[১]

১৯২৭ সালে তিনি ঢাকা বিভাগের মুসলিম গ্রামীণ এলাকা এবং ১৯৩১ ও ১৯৩৫ সালে ঢাকা-ময়মনসিংহ মুসলিম গ্রামীণ এলাকা থেকে ভারতীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত তিনি এই পদে ছিলেন। ১৯২৯ সালে তিনি কানপুরে অনুষ্ঠিত মুসলিম কনফারেন্সে সভাপতি ছিলেন। শাসন সংস্কারের জন্য অনুষ্ঠিত গোলটেবিল বৈঠকসমূহে তিনি প্রতিনিধি ছিলেন। কলকাতা পৌরসভায় তিনি শেরিফ হিসেবে দায়িত্বপালন করেছেন। সম্রাট পঞ্চম জর্জের রাজত্বকালের ২৫ বছরপূর্তি-উৎসব পালনের জন্য গঠিত বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিটিতে তিনি সহসভাপতি ছিলেন। এছাড়া তিনি সেন্ট্রাল ন্যাশনাল মোহামেডান এসোসিয়েশনের সভাপতি ও ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশনের সহসভাপতি ছিলেন।[১]

এ কে ফজলুল হকের পরে ১৯৪৩ সালের ২৪ এপ্রিল খাজা নাজিমউদ্দিন নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করার পর একই দিন কলকাতার টাউন হলে আবদুল হালিমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় তিনি এই মন্ত্রিসভার বিরোধিতা করেন। কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপক সভার নির্বাচনে তিনি ১৯৪৫ সালের ডিসেম্বর ঢাকা-ময়মনসিংহ এলাকা থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তার প্রতিপক্ষ ছিলেন মৌলভি তমিজউদ্দিন খান। নির্বাচনে আবদুল হালিম পরাজিত হন। এর মাধ্যমে তার রাজনৈতিক জীবনের ইতি ঘটে।[১]

ব্যবসা সম্পাদনা

আবদুল হালিম গজনভি একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি যথাক্রমে কলকাতার মুসলিম চেম্বার অব কমার্স (১৯৩৯-১৯৪০) ও ইন্ডিয়া চেম্বার অব কমার্সের (১৯৪৫-১৯৪৬) সভাপতি ছিলেন। বেশ কয়েকবার তিনি ইন্ডিয়া স্টিমশিপ কোম্পানির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্বপালন করেছেন। এসময় তিনি জলযান নির্মাণশিল্পের উন্নতিতে অবদান রেখেছেন। তিনি জড়িত ছিলেন এমন সংগঠনের মধ্যে রয়েছে কলকাতার এক্সপোর্ট এডভাইজারি কমিটি, ইন্ডিয়ান সেন্ট্রাল জুট কমিটি, রেলওয়ে এডভাইজারি কমিটি (১৯২৭-১৯৩২), রেলওয়ে স্ট্যান্ডিং ফিনান্স কমিটি (১৯২৭-১৯৩২), বার্মা সেপারেশন কমিটি (১৯৩৪), ফ্র্যাঞ্চাইজ কমিটি (১৯৩০), ফেডারেল ফিনান্স কমিটি (১৯৩২), কনসাল্টেটিভ কমিটি (১৯৩৩), মাইনরিটিজ কমিটি (১৯৩০-১৯৩২), পাবলিক একাউন্টস কমিটি (১৯৩৩) ইত্যাদি। ১৯৩৩ সালে বিশ্ব অর্থনৈতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী ভারতীয় প্রতিনিধিদলের উপদেষ্টা বোর্ডে তিনি অন্যতম সদস্য ছিলেন।[১]

শিক্ষাক্ষেত্র সম্পাদনা

তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো ছিলেন। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোর্ট এবং আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয় কোর্টের সদস্য ছিলেন। তিনি বেঙ্গল রয়েল এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য এবং কলকাতা সিটি কলেজের গভর্নিং বডির সদস্য কাজ করেছেন।[১]

পত্রিকা সম্পাদনা

ব্যারিস্টার আবদুর রসুলের সাথে তিনি যৌথভাবে দি মুসলমান প্রকাশে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। তিনি খাজা নাজিমুদ্দিনের সাথে দ্য স্টার অব ইন্ডিয়া পত্রিকা প্রকাশ করেছেন। বাংলার মুসলিমদের জাগরণের ক্ষেত্রে এই দুই পত্রিকার বিশেষ ভূমিকা ছিল।[১]

সম্মাননা সম্পাদনা

আবদুল হালিম গজনভি ১৯৩৫ সালে নাইট খেতাব পান।[১]

ব্যক্তিগত জীবন সম্পাদনা

স্যার আবদুল করিম গজনভি ছিলেন তার বড় ভাই। নারী শিক্ষার অগ্রদূত বেগম রোকেয়া তার খালা ছিলেন। আবুল আসাদ মুহম্মদ ইবরাহিম সাবের ও আবু জায়গাম মুহম্মদ খলিল সাবের ভ্রাতৃদ্বয় তার মামা ছিলেন।[২]

১৯৪৮ সালে তিনি তার ব্যক্তিগত সম্পদ থেকে তহবিল গঠন করেন। এতে সিটি কলেজ-স্কুলের জন্য বার্ষিক দুইটি রৌপ্য পদক প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছিল।[১]

মৃত্যু সম্পাদনা

আবদুল হালিম গজনভি দেশবিভাগের পরে পূর্ব পাকিস্তান চলে আসেন। এরপর আমৃত্যু তিনি দেলদুয়ারের পৈতৃক বাড়িতে কাটান। ১৯৫৩ সালের ১৮ জুন দেলদুয়ার গ্রামের বাড়িতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।[১]

আরও দেখুন সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা