আবদুল মোনেম খান

পাকিস্তানি রাজনীতিবিদ

আবদুল মোনেম খান (২৮ জুন ১৮৯৯ – ১৩ অক্টোবর ১৯৭১) ছিলেন বাঙালি রাজনীতিবিদ, আইনজীবী ও পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর। তিনি ২৮ অক্টোবর ১৯৬২ থেকে ২৩ মার্চ ১৯৬৯ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরদের মধ্যে তার মেয়াদ সবচেয়ে দীর্ঘ ছিল।[১] তিনি আইয়ুব খানের ঘনিষ্ঠ সহায়তাকারী ছিলেন। শাসনকালে বাঙালি জাতীয়তাবাদিদের প্রতি বিরূপ আচরণের জন্য তাকে দোষারোপ করা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করায় যুদ্ধ চলাকালে ঢাকায় নিজ বাসভবনে মুক্তিবাহিনীর হাতে তিনি নিহত হন।

আবদুল মোনেম খান
পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর
কাজের মেয়াদ
২৮ অক্টোবর ১৯৬২ – ২৩ মার্চ ১৯৬৯
রাষ্ট্রপতিআইয়ুব খান
পূর্বসূরীগোলাম ফারুক খান
উত্তরসূরীমির্জা নূরুল হুদা
ব্যক্তিগত বিবরণ
জন্ম২৮ জুন ১৮৯৯
কিশোরগঞ্জ, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি, ব্রিটিশ ভারত,
(বর্তমান  বাংলাদেশ)
মৃত্যু১৩ অক্টোবর ১৯৭১(1971-10-13) (বয়স ৭২)
ঢাকা, পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান  বাংলাদেশ)
সমাধিস্থলবনানী কবরস্থান, ঢাকা
নাগরিকত্ব ব্রিটিশ ভারত (১৯৪৭ সাল পর্যন্ত)
 পাকিস্তান
রাজনৈতিক দলমুসলিম লীগ
প্রাক্তন শিক্ষার্থীকলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
পেশাআইনজীবী, রাজনীতিবিদ
ধর্মইসলাম

জন্ম সম্পাদনা

আবদুল মোনেম খান ১৮৯৯ সালের ২৮ জুন কিশোরগঞ্জ জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম মৌলভি কমর আলি খান ও মায়ের নাম নাসিমা খাতুন।[১][২]

শিক্ষাজীবন সম্পাদনা

তিনি ১৯১৬ সালে ময়মনসিংহ জিলা স্কুল হতে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। এরপর ১৯২০ সালে ঢাকা কলেজ থেকে বি.এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯২২ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এল ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯২৪ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পুনরায় বি.এল. ডিগ্রি লাভ করেন।[২]

কর্মজীবন সম্পাদনা

আবদুল মোনেম খান ১৯২৭ সালে ময়মনসিং জেলা বারে আইনজীবী হিসেবে যোগ দেন। ১৯৩০ সালে উত্তর বঙ্গে সংঘটিত বন্যার সময় তিনি সুভাষ চন্দ্র বসুর সাথে ত্রাণ বিতরণে অংশ নিয়েছেন। ১৯৩২ সালে তিনি ময়মনসিংহের আঞ্জুমান-ই-ইসলামিয়ার সহকারী সচিব নির্বাচিত হন। তিনি একজন ক্রীড়া সংগঠকও ছিলেন। তিনি ময়মনসিংহ মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের সদস্য ছিলেন। ১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত তিনি ময়মনসিংহ জিলা স্কুল বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্বপালন করেছেন। ১৯৪৮ সালে পূর্ব বাংলার প্রাথমিক শিক্ষাবোর্ডের সদস্য নির্বাচিত হন।[২]

রাজনীতি সম্পাদনা

তিনি ১৯৩৫ সালে নিখিল ভারত মুসলিম লীগে যোগ দেন। তিনি ময়মনসিংহ জেলার মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারি ছিলেন। ১৯৩৬ সালে তার আমন্ত্রণে মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ ময়মনসিংহ সফরে আসেন। এই সফরে জিন্নাহ বেশ কয়েকটি জনসভায় বক্তৃতা দিয়েছেন।[২] ১৯৪৭ সালে তিনি পুনরায় জেলা মুসলিম লীগের সেক্রেটারি নির্বাচিত হন এবং ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত এই পদে ছিলেন।[১]

১৯৪৫ সালে তিনি ময়মনসিংহ জেলা বোর্ডের সদস্য হন। পরবর্তী কয়েকবছর তিনি এই পদে ছিলেন। পৌরসভার ওয়ার্ড কমিশনার হিসেবে তিনি অনেক সামাজিক কর্মকাণ্ড করেছেন। ১৯৪৬ সালে তিনি ময়মনসিংহ জেলার ন্যাশনাল গার্ডকে সংগঠিত করেন। তিনি সংগঠনের সালার-ই-জেলা নিযুক্ত হন।[২]

১৯৪৭ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য হন। একই বছরে নিখিল পাকিস্তান মুসলিম লীগের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। ১৯৪৮ সালে তিনি পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য হন। ১৯৫০ সালে তিনি বেঙ্গল ডিফেন্স কমিটি ও প্রভিন্সিয়াল আর্মড সার্ভিসেস বোর্ডের সদস্য হন।[২] ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে তিনি অনেক ভোট হারান।[১]

১৯৬২ সালে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্ব্বিতায় পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। সেই বছর আইয়ুব খান তাকে কেন্দ্রের স্বাস্থ্য, শ্রম ও সমাজ কল্যাণ মন্ত্রী নিযুক্ত করেন।[১] কয়েক মাস পরে তাকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিযুক্ত করা হয়।[১] ১৯৬২ সালের ২৮ অক্টোবর থেকে ১৯৬৯ সালের ২৩ মার্চ তিনি এই পদে ছিলেন। তার শাসনামলে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, ব্যবসা, কৃষি ও শিল্পক্ষেত্রে বিশেষ অগ্রগতি হয়েছিল। ১৯৬৩ সালে চট্টগ্রামে সংঘটিত জলোচ্ছ্বাস এবং ১৯৬৫ সালের সাইক্লোনের পর তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন। তার শাসনামলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, ইন্সটিটিউট অব পোস্ট-গ্রেজুয়েট মেডিসিন এন্ড রিসার্চ (বর্তমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) এবং কয়েকটি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রেখেছেন। ১৯৬৭ সালে তিনি দিঘাপতিয়ার রাজবাড়িকে উত্তরা গভর্নর হাউসে রূপান্তর করেন।[১]

তিনি আইয়ুব খানের একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন। আইয়ুব খান প্রবর্তিত মৌলিক গণতন্ত্রের পক্ষে তিনি কাজ করেছেন এবং ১৯৬৫ সালের নির্বাচনে আইয়ুব বিরোধী জোটের (কপ) প্রার্থী ফাতেমা জিন্নাহর সাথে প্রতিদ্বন্দ্ব্বীতায় তিনি আইয়ুব খানকে সহায়তা করেছেন। তার শাসনামলে ব্যাপক ছাত্র বিক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছিল।[১] তিনি শিক্ষা আন্দোলন, ছয় দফা ও এগারো দফা দাবি এসবের বিরোধী ছিলেন। ফলে তাকে নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরী হয়।[২]

মৃত্যু সম্পাদনা

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করেছিলেন। ১৯৭১ সালের ১৩ অক্টোবর মুক্তিযোদ্ধারা তার বনানীর বাড়িতে আক্রমণ করে। এসময় তিনি গুলিবিদ্ধ হন। আহত অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।[২] ঢাকার বনানীর যে বাড়িতে ঢুকে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল হক রাজাকার মোনায়েমকে হত্যা করেন, সেই বাড়ি রাজাকার মোনায়েমের পরিবারের দখলেই ছিল। যা পরে বাংলাদেশ সরকার দখল করে।[৩]

[৪]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "Governors and Acting Governors of East Bengal/ East Pakistan 1947-1971 ২০ জুলাই ২০১৬ তারিখে সংগৃহীত"। ১৪ এপ্রিল ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০ জুলাই ২০১৬ 
  2. আবদুল মোনেম খান, বাংলাপিডিয়া
  3. রায়, অঞ্জন। "ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক গভর্নর মোনায়েম খানের বাড়ির বরাদ্দ বাতিল"anandabazar.com (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৭-১২ 
  4. "মোনায়েমের হত্যাকারী দুঃসাহসী মোজাম্মেল হকের স্মৃতিচারণ"anandabazar.com (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-১০-১২ 
রাজনৈতিক দপ্তর
পূর্বসূরী
গোলাম ফারুক খান
পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর
২৮ অক্টোবর ১৯৬২ – ২৩ মার্চ ১৯৬৯
উত্তরসূরী
মির্জা নূরুল হুদা