আফগানিস্তানে বৌদ্ধধর্ম

বৌদ্ধধর্ম ছিল প্রাক-ইসলামি আফগানিস্তানের অন্যতম প্রধান ধর্ম। এই ধর্মটি হিন্দুকুশ পর্বতমালার দক্ষিণে ব্যাপক প্রসার লাভ করেছিল। ৩০৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রিক সেলুকিড সাম্রাজ্য ভারতীয় মৌর্য সাম্রাজ্যের সঙ্গে মিত্রতায় আবদ্ধ হয়। সেই সময়েই বৌদ্ধধর্ম প্রথম আফগানিস্তানে প্রচারিত হয়েছিল। অধুনা উত্তর পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে গ্রিকো-ব্যাক্ট্রিয়ান রাজ্য (খ্রিস্টপূর্ব ২৫০-১২৫ অব্দ) ও ইন্দো-গ্রিক রাজ্যের (খ্রিস্টপূর্ব ১৮০-১০ অব্দ) অধীনে গ্রিকো-বৌদ্ধ শিল্পকলা বিকাশ লাভ করে। কুষাণ সাম্রাজ্যের অধীনে গ্রিকো-বৌদ্ধধর্ম সমৃদ্ধির শিখরে আরোহণ করে। এই সাম্রাজ্যের এর ব্যাক্ট্রিয়ান ভাষা লেখার জন্য গ্রিক হরফ ব্যবহার করত।

বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তি
প্রাচীন বৌদ্ধ গুহা, জালালাবাদ

অসংখ্য বৌদ্ধ ভিক্ষুকে ধর্মপ্রচারে প্রেরণ করা হয়েছিলজেন বৌদ্ধধর্মের প্রতিষ্ঠাতা বোধিধর্ম চীনে গিয়েছিলেন। শাওলিন কুং ফুর কিংবদন্তি প্রতিষ্ঠাতা লোকক্ষেম (১৭৮ খ্রিষ্টাব্দ) চীনের রাজধানী লোয়াং-এ যান। তিনিই প্রথম মহাযান বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থগুলি চীনা ভাষায় অনুবাদ করেন।[১] মহাবংশ (অধ্যায় ২৯) অনুসারে,[২] মহাধর্মরক্ষিত ৩০,০০০ বৌদ্ধ ভিক্ষুকে “গ্রিক আলাসান্দ্রার শহর” (ককেসাসের আলেকজান্দ্রিয়া, অধুনা আফগানিস্তানের কাবুল থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরে) শ্রীলঙ্কায় নিয়ে আসেন অণুরাধাপুরার মহাস্তুপ স্থাপনের জন্য। গ্রিকো-ব্যাক্ট্রিয়ান রাজা প্রথম মিনান্ডার (পালি: মিলিন্দ) (রাজত্বকাল খ্রিস্টপূর্ব ১৬৫-১৩৫ অব্দ) ছিলেন একজন বিশিষ্ট বৌদ্ধ। তিনি বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ মিলিন্দ পঞহ-এ অমর হয়ে রয়েছেন।

খ্রিস্টীয় ৭ম শতাব্দীতে ইসলামের আবির্ভাবের পর এই অঞ্চলে বৌদ্ধধর্মের পতন শুরু হয়। খ্রিস্টীয় ১১শ শতাব্দীতে গজনবিদের রাজত্বকালে তা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়।[৩]

ইতিহাস সম্পাদনা

আফগানিস্তান সীমান্তের অভ্যন্তরীণ ভূখণ্ডে কয়েক শতাব্দী ধরে অনেক সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় পরিবর্তন ঘটেছে। এই ভূখণ্ডটি ভৌগোলিক দিক থেকে মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ এশীয় ও মধ্য এশীয় সংস্কৃতির কেন্দ্র স্থলে রেশম পথের (পূর্ব এশিয়া ও ভূমধ্যসাগরীয় সভ্যতাগুলির মধ্যে সংযোগরক্ষাকারী, সেই সঙ্গে এই দুই অঞ্চলের মধ্যবর্তী অঞ্চলগুলির মধ্যেও সংযোগরক্ষাকারী) নিকটে অবস্থিত। এই অঞ্চলের স্থানীয় ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক বিকাশের অনেকগুলি স্তর লক্ষিত হয়। এই অঞ্চলে মহামতি আলেকজান্ডারের বিজয়াভিযান বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছিল। এই বিজয় অভিযানের ফলে এই অঞ্চলটি কিছু সময়ের জন্য হেলেনীয় বিশ্বের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল এবং তার ফলে এই অঞ্চলের বৌদ্ধ ধর্মীয় শিল্পকলায় হেলেনীয় শিল্পকলা গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৩০৫ অব্দে সেলুকিড সাম্রাজ্য ভারতীয় মৌর্য সাম্রাজ্যের সঙ্গে মিত্রতায় আবদ্ধ হয়। মৌর্যরা ভারত থেকে বৌদ্ধধর্ম নিয়ে আসেন এবং হিন্দুকুশের দক্ষিণ অঞ্চল খ্রিস্টপূর্ব ১৮৫ অব্দে সাম্রাজ্যের পতন পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করেন।

আলেকজান্ডার এই অঞ্চলগুলি আর্যদের থেকে কেড়ে নিয়েছিলেন এবং নিজস্ব বসতি স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু সেলুকাস নিকাটর বৈবাহিক শর্তে এবং ৫০০ হাতির বিনিময়ে এই অঞ্চলগুলি স্যান্ড্রোকোট্টাসকে (চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য) প্রদান করেন।[৪]

এই সময় এই অঞ্চলের অধিকাংশই ব্যাক্ট্রিয়াসোগডিয়ানা রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। সিথিয়ান জাতি সহ পুশতুনদের অনেক পূর্বপুরুষ ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বাবধি বৌদ্ধধর্মের অনুগামী ছিলেন।

উমায়াদের ইসলামি বিজয়আব্বাসিদ খিলাফতের রাজত্বকালেও বৌদ্ধধর্ম এই অঞ্চলে টিকে ছিল। পরে সাফারিদ রাজবংশ, গজনবিদঘুরি রাজবংশের রাজত্বকালে আফগানিস্তান থেকে বৌদ্ধধর্মকে সফলভাবে উৎখাত করা হয়।[৫][৬]

প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার সম্পাদনা

 
ধ্যানে উপবিষ্ট বোধিসত্ত্ব। আফগানিস্তান, খ্রিস্টীয় ২য় শতাব্দী

বামিয়ান মঠের গ্রন্থাগার সম্পাদনা

আদি বৌদ্ধ সম্প্রদায়গুলির অন্যতম মহাসাংঘিক-লোকত্তরবাদ বামিয়ান অঞ্চলে প্রতিপত্তি বিস্তার করেছিল। চীনা বৌদ্ধ ভিক্ষু হিউয়েন সাং খ্রিস্টীয় ৭ম শতাব্দীতে আফগানিস্তানের বামিয়ানে একটি লোকত্তরবাদ মঠে এসেছিলেন। পরবর্তীকালে পুরাতত্ত্ববিদরা এই মঠটি পুনরাবিষ্কার করেন।[৭] এই মঠের সংগ্রহে বার্চবার্ক ও তালপাতার পুথিতে লেখা অনেকগুলি গ্রন্থ ছিল। এর মধ্যে মহাযান সূত্রগুলিও রয়েছে। এই মঠ থেকে প্রাপ্ত পুথিগুলি এখন সোয়েন সংগ্রহে রাখা আছে। কিছু পুথি গান্ধারী ভাষায় খরোষ্ঠী লিপিতে লিখিত। অন্যগুলি সংস্কৃত ভাষায় গুপ্ত লিপিতে লেখা। এই মঠের সংগ্রহ থেকে যে পাণ্ডুলিপি ও খণ্ডাংশ এখনও রক্ষিত হয়েছে, সেগুলির মধ্যে নিম্নোক্ত মূল ধর্মগ্রন্থ রয়েছে:[৭]

বৌদ্ধ ধ্বংসাবশেষ সম্পাদনা

২০১০ সালের অগস্ট মাসে আফগানিস্তানের লোগার প্রদেশে প্রায় ৪২টি বৌদ্ধ ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে বলে তথ্য নথিভুক্ত হয়। এই অঞ্চলটি কাবুলের দক্ষিণে অবস্থিত। পুরাতত্ত্ববিদদের মতে, এগুলির মধ্যে কিছু সামগ্রী ২য় শতাব্দীর। গজনিতেও কিছু বৌদ্ধ স্থলের ধ্বংসস্তুপ পাওয়া গিয়েছে।[৮] লোগারে প্রাপ্ত সামগ্রীগুলির মধ্যে রয়েছে দুটি বৌদ্ধ মন্দির (স্তুপ), বুদ্ধের মূর্তি, ফ্রেস্কো, সোনা ও রুপোর মুদ্রা এবং মূল্যবান জপমালা।[৯][১০][১১]

সেখানে একটি মন্দির, স্তুপ, সুন্দর কক্ষ, বড়ো ও ছোটো মূর্তি যার উচ্চতা সাত থেকে নয় মিটার, সোনা ও রুপোর মুদ্রাখচিত রঙিন ফ্রেস্কো রয়েছে... কিছু ধ্বংসাবশেষ (খ্রিস্টীয়) ৫ম শতাব্দীর... আমরা জানতে পেরেছিল কিছু সামগ্রী সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব যুগের বা প্রাগৈতিহাসিক কালের... এগুলি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আমরা বিদেশি সাহায্য চাইছি এবং বিদেশের বিশেষজ্ঞদের আরও খননকার্য চালাতে আমাদের সাহায্য করতে বলছি।[১২]

— মহম্মদ নাদের রসৌলি, য়াফগান পুরাতাত্ত্বিক বিভাগ

আরও দেখুন সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Foltz, Religions of the Silk Road, p. 46
  2. Full text of the Mahavamsa Click chapter XXIX
  3. Berzin, Alexander (ডিসেম্বর ২০০৬)। "History of Buddhism in Afghanistan"। সংগ্রহের তারিখ জুন ৫, ২০১৬ 
  4. Nancy Hatch Dupree / Aḥmad ʻAlī Kuhzād (১৯৭২)। "An Historical Guide to Kabul – The Name"। American International School of Kabul। ৩০ আগস্ট ২০১০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ সেপ্টেম্বর ১৮, ২০১০Alexander took these away from the Aryans and established settlements of his own, but Seleucus Nicator gave them to Sandrocottus (Chandragupta), upon terms of intermarriage and of receiving in exchange 500 elephants.  অজানা প্যারামিটার |8= উপেক্ষা করা হয়েছে (সাহায্য); অজানা প্যারামিটার |9= উপেক্ষা করা হয়েছে (সাহায্য)
  5. Amy Romano (২০০৩)। A Historical Atlas of Afghanistan (illustrated সংস্করণ)। The Rosen Publishing Group। পৃষ্ঠা 25। আইএসবিএন 0-8239-3863-8। সংগ্রহের তারিখ ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১১ 
  6. Steven Otfinoski (২০০৪)। Afghanistan (illustrated সংস্করণ)। Infobase Publishing। পৃষ্ঠা 6। আইএসবিএন 0-8160-5056-2। সংগ্রহের তারিখ ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১১ 
  7. "Schøyen Collection: Buddhism"। ১০ জুন ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৩ জুন ২০১২ 
  8. Embassy of the United States, Kabul. Ghazni 10.26.2011 ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২৫ জুন ২০১৬ তারিখে
  9. Embassy of the United States, Kabul. Mes Aynak 10.29.2011 ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১৬ নভেম্বর ২০১৫ তারিখে
  10. "42 Buddhist relics discovered in Logar"Maqsood AziziPajhwok Afghan News। আগস্ট ১৮, ২০১০। ২০১০-০৩-১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১০-০৮-২৩ 
  11. "Afghan archaeologists find Buddhist site as war rages"Sayed Salahuddin। News Daily। আগস্ট ১৭, ২০১০। আগস্ট ১৮, ২০১০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১০-০৮-১৬ 
  12. "Buddhist remains found in Afghanistan"। Press TV। আগস্ট ১৭, ২০১০। আগস্ট ২০, ২০১০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১০-০৮-১৬There is a temple, stupas, beautiful rooms, big and small statues, two with the length of seven and nine meters, colorful frescos ornamented with gold and some coins... Some of the relics date back to the fifth century (AD)... We have come across signs that there are items maybe going back to the era before Christ or prehistory... We need foreign assistance to preserve these and their expertise to help us with further excavations. 

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা