আগভান দোর্জিয়েভ (১৮৫৪-১৯৩৮) তিব্বতী বৌদ্ধধর্মের দ্গে-লুগ্স সম্প্রদায়ের একজন রুশ বৌদ্ধ ভিক্ষু ছিলেন। তিনি ত্রয়োদশ দলাই লামার একজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী এবং তার সঙ্গে রুশ সাম্রাজ্যের কূটনৈতিক সমন্বয়কারী ছিলেন।[n ১] তিব্বতে রুশ নাগরিক হিসেবে তার উপস্থিতি ভারতে অবস্থিত ব্রিটিশদের মধ্যে প্রাচ্যে রুশ সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণ সম্বন্ধে আশঙ্কার সৃষ্টি করে। সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরে দাতসান গুঞ্জেচোইনেই রাশিয়ার প্রথম বৌদ্ধ মন্দির স্থাপন এবং ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে মঙ্গোলিয়া ও তিব্বত সরকারের মধ্যে মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য তিনি বিখ্যাত।

আগভান দোর্জিয়েভ

তিব্বতে বৌদ্ধধর্ম শিক্ষা সম্পাদনা

আগভান দোর্জিয়েভ ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দে উনিশ বছর বয়সে তিব্বতের দ্রেপুং বৌদ্ধবিহার বিশ্ববিদ্যালয়ের গোমাং মহাবিদ্যালয়ে বৌদ্ধধর্ম সম্বন্ধে শিক্ষালাভের জন্য ভর্তি হন।[২] পনেরো বছর শিক্ষালাভের পর তিনি ত্সানিদ খেনপো উপাধলাভ করেন।[৩][৪] ১৯১০-এর দশকের শেষ ভাগ পর্যন্ত তিনি ত্রয়োদশ দলাই লামার আধ্যাত্মিক উপদেষ্টা এবং বিতর্কের সঙ্গী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে তার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ একজন সহযোগীতে পরিণত হন।[৫][৬]:১৮৬

দলাই লামার দূত সম্পাদনা

১৮৯৮ খ্রিষ্টাব্দে আগভান দোর্জিয়েভ গোমাং মহাবিদ্যালয়ের জন্য অর্থসাহায্যের জন্য সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরে গেলে[৭] প্রাচ্যবিদ এস্পার উখটমস্কির সংস্পর্শে আসেন, যিনি তাকে জারের সঙ্গে সাক্ষাত ঘটাতে সাহায্য করেন।[৬]:১৮৭[৮]:৩৫ ১৮৯০-এর দশক থেকে দোর্জিয়েভ রাশিয়াকে উত্তর দিকে কিংবদন্তি রাজ্য শম্ভালের সঙ্গে তুলনা করে কাহিনী প্রচার করতে শুরু করেন যে জার দ্বিতীয় নিকোলাস তিব্বতে বৌদ্ধধর্ম রক্ষা করতে চান। ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দের বসন্তকালে ত্রয়োদশ দলাই লামা দোর্জিয়েভের সঙ্গে ছয়জনের একটি প্রতিনিধিদলকে জারের নিকট প্রেরণ করেন। তারা জারের সঙ্গে ক্রিমিয়ার লিভাদিয়া প্রাসাদে জারের সঙ্গে সাক্ষাত করেন এবং সেখান থেকে রুশ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে লাসা ফিরে আসেন।[n ২]

ব্রিটিশদের সন্দেহ সম্পাদনা

১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের গভর্নর-জেনারেল লর্ড কার্জন বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে রাশিয়া ও তিব্বতের মধ্যে গোপণ চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে, যার ফলশ্রুতিতে ভারতে ব্রিটিশ রাজ বিপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি তিব্বতে উপস্থিত আগভান দোর্জিয়েভকে রুশ সরকারের কর্মচারী ও গুপ্তচর বলে সন্দেহ প্রকাশ করেন।[n ৩] [৬]:১৮৮[৮]:৩৭ তিব্বতের ওপর প্রভাব বিস্তার করে রাশিয়া মধ্য এশিয়ার বাণিজ্যপথগুলি নিজের অধীনস্থ করতে চায়, এই আশঙ্কায় ব্রিটিশদের তিব্বত অভিযান সংগঠিত হয়। ১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দে দোর্জিয়েভ ত্রয়োদশ দলাই লামাকে মঙ্গোলিয়ার উর্গা শহরে পালিয়ে যেতে রাজী ক্রাতে সক্ষম হন।[৬]:২৫৮ ব্রিটিশদের তিব্বত অভিযানের সময় দোর্জিয়ভ লাসার অস্ত্রাগার ও গ্যানৎসে শহরের দুর্গ থেকে সামরিক কার্যকলাপের দায়িত্বে ছিলেন বলে খবর ছড়িয়ে পড়ে।[৬]:২৩৩ কিন্তু দোর্জিয়েভ প্রকৃতই একজন রুশ গুপ্তচর ছিলেন কিনা এবিষয়ে তথ্যপ্রমাণের অভাব রয়েছে।[৬]:২৪১

নির্মাণ সম্পাদনা

১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে জারের অনুমতিতে তিনি সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরে দাতসান গুঞ্জেচোইনেই নামে একটি বৌদ্ধ মন্দির নির্মাণ করেন। এছাড়া ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি আতসাগাতের বিহারে একটি চিকিৎসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ করেন, যা দ্রুত বুরয়াতিয়ায় তিব্বতী চিকিৎসাশাস্ত্র চর্চার একটিই কেন্দ্র হয়ে ওঠে।

তিব্বত-মঙ্গোলিয়া চুক্তি সম্পাদনা

১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে দোর্জিয়েভ ও দুইজন তিব্বতী প্রতিনিধি[১১] উর্গা শহরে মঙ্গোলিয়া ও তিব্বত সরকারের মধ্যে মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তির মাধ্যমে তিব্বতমঙ্গোলিয়া উভয় রাষ্ট্র একে অপরকে স্বীকৃতি প্রদান করে এবং চীনের শাসনাধীনে না থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি স্বাক্ষরের ব্যাপারে আদৌ দোর্জিয়েভের ওপর সরকারিভাবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল কিনা, তা এখনো বিতর্কিত বিষয়।

বিপ্লবোত্তর রাশিয়ায় সম্পাদনা

রুশ বিপ্লবের পরে দোর্জিয়েভকে গ্রেপ্তার করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, কিন্তু সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরের কয়েকজন বন্ধুদের সাহায্যে তিনি ছাড়া পান। তার নির্মিত দাতসান গুঞ্জেচোইনেই বৌদ্ধ মন্দিরটিতে লুঠপাট চালানো হয়। দ্রুত পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শান্তি স্থাপনের উদ্দেশ্যে দোর্জিয়েভ বৌদ্ধবিহারগুলিকে সমবায় খামারে পরিণত পরিকল্পনা জমা দেন। ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে বুরয়াতিয়ার সকল বিহারকে জাতীয়করণ করে ভিক্ষুদের হাত থেকে প্রশাসনিক ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে সাধারণ মানুষের সংগঠনগুলিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।[৮]:৩৫

১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ই নভেম্বর জোসেফ স্তালিনের মহান শুদ্ধিকরণের সময় তাকে আবার গ্রেপ্তার করা হয়। তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতা, সশস্ত্র বিদ্রোহের চক্রান্ত এবং মঙ্গোলঙ্গো জাপানীদের হয়ে গুপ্তচরগিরির অভিযোগ আনা হয়। ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৯শে জানুয়েরী পুলিশ হেপাজতে জেল হাসপাতালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তার মৃত্যু হয়।[৬]:২৫৯, ২৬০ তাকে চেলুতাইয়ের নিকটের জঙ্গলে একটি গুপ্ত সমাধিস্থানে সমাহিত করা হয়। তার মৃত্যুর বাহান্ন বছর পরে ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ই মে তথ্যপ্রমাণের অভাবের কারণে তার বিরুদ্ধে মামলা রদ করে দেওয়া হয়।[১২]:২৫২

পাদটীকা সম্পাদনা

  1. One man in particular was to play an important role in building communications between Lhasa and the Russian Czar. This was Tsanzhab Ngawang Lobzang, a Mongolian monk who had graduated with high honors from the Gomang Departments of Drepung Monastery, and who was one of the seven dialectical instructors or Tsanzhabs to the Dalai Lama. Popularly known to the Tibetans as Tsennyi Khenpo, or "Master of Dialectics," he became famed to both the British and the Russians by the simpler name of Dorjieff (from the Tibetan Dorjey). Born in the Buriyat region of the Mongolian territories that had in recent times been acquired by the Czar, Dorjieff was therefore a Russian citizen."[১]
  2. When they returned they brought to Lhasa a supply of Russian arms and ammunition as well—paradoxically enough—as a magnificent set of Russian Episcopal robes as a personal present for the Dalai Lama."[৯]
  3. Obviously," the [Fourteenth] Dalai Lama said, "the Thirteenth Dalai Lama had a keen desire to establish relations with Russia, and I also think he was a little skeptical toward England at first. Then there was Dorjiev. To the English he was a spy, but in reality he was a good scholar and a sincere Buddhist monk who had great devotion to the Thirteenth Dalai Lama."[১০]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Mullin, Glenn H. (2001). The Fourteen Dalai Lamas: A Sacred Legacy of Reincarnation", p. 400. Clear Light Publishers, Santa Fe, New Mexico. আইএসবিএন ১-৫৭৪১৬-০৯২-৩.
  2. Chö-Yang: The Voice of Tibetan Religion and Culture. Year of Tibet Edition, p. 80. 1991. Gangchen Kyishong, Dharamsala, H.P., India.
  3. "Ostrovskaya-Junior, Elena A. "Buddhism in Saint Petersburg.""। ১৭ জুলাই ২০০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৯ ডিসেম্বর ২০১৪ 
  4. Snelling, John. (1990). The Sacred Mountain: The Complete Guide to Tibet's Mount Kailas. (1983). Revised and Enlarged Edition (1990), p. 232. London and The Hague: East-West Publications. আইএসবিএন ০-৮৫৬৯২-১৭৩-৪.
  5. Hundley, Helen. (1993). "Tibet's part in the 'great game.' (Agvan Dorjiev)." History Today, Vol. 43 (Oct. 1993), pp. 45-50. Downloaded from: http://ccbbs.ntu.edu.tw/FULLTEXT/JR-EPT/helen.htm[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ].
  6. French, Patrick. Younghusband: The Last Great Imperial Adventurer (1994). Reprint: Flamingo, London. আইএসবিএন ৯৭৮-০-০০-৬৩৭৬০১-৯.
  7. Richardson, Hugh E. (1984) Tibet and its History. Second Edition, p. 81. Revised and Updated, p. 106. Shambhala, Boston & London. আইএসবিএন ০-৮৭৭৭৩-৩৭৬-৭.
  8. Saxer, Martin (2004). Journeys with Tibetan Medicine: How Tibetan Medicine came to the West: The Story of the Badmayev Family. Masters Thesis, University of Zurich.
  9. Chapman, Spencer. (1940). Lhasa: The Holy City, p. 131. Readers Union Ltd., London.
  10. Laird, Thomas (2006). The Story of Tibet: Conversations with the Dalai Lama, p. 221. Grove Press, N.Y. আইএসবিএন ৯৭৮-০-৮০২১-১৮২৭-১.
  11. Udo B. Barkmann, Geschichte der Mongolei, Bonn 1999, p380ff
  12. Snelling, John. (1993). Buddhism in Russia: The Story of Agvan Dorzhiev : Lhasa's Emissary to the Tsar. Element Books. আইএসবিএন ৯৭৮-১-৮৫২৩০-৩৩২-৭.

আরো পড়ুন সম্পাদনা