অনন্ত সিং

বাঙালি বিপ্লবী

অনন্ত সিং বা অনন্ত লাল সিং (জন্ম ১লা ডিসেম্বর, ১৯০৩ - মৃত্যু ২৫শে জানুয়ারি, ১৯৭৯), চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার আক্রমণের অন্যতম নায়ক এবং ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতিবিদ ছিলেন।[১]

অনন্ত সিং
অনন্ত লাল সিং
জন্ম(১৯০৩-১২-০১)১ ডিসেম্বর ১৯০৩
মৃত্যু২৫ জানুয়ারি ১৯৭৯(1979-01-25) (বয়স ৭৫)
কলকাতা, ভারত, (বর্তমান ভারত ভারত)
জাতীয়তাব্রিটিশ ভারতীয়
নাগরিকত্ব ব্রিটিশ ভারত
পরিচিতির কারণচট্টগ্রামের অস্ত্রগার আক্রমণের ব্যক্তি
উল্লেখযোগ্য কর্ম
কেউ বলে ডাকাত কেউ বলে বিপ্লবী
রাজনৈতিক দলঅনুশীলন সমিতি, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি
আন্দোলনভারতের বিপ্লবী স্বাধীনতা আন্দোলন
আত্মীয়অনিমা সিং

শৈশব সম্পাদনা

১৯০৩ সালের, ১লা ডিসেম্বর তিনি চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ছিল গোলাপ সিং, এবং মাতার নাম রাজকুমারী দেবী। তারা তিন ভাই বোন ছিলেন (দিদি ইন্দুমতী, দাদা নন্দলাল ও অনন্তলাল) এবং তিনি সর্বকনিষ্ঠ ছিলেন। তার পূর্বপুরুষ ভারতের আগ্রা অঞ্চলের অধিবাসী ছিলেন। অনন্ত সিং-এর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা খুব বেশি ছিল না। বিদ্যালয়ে পড়ার সময় তিনি সূর্য সেনের (মাষ্টারদা) সংস্পর্শে আসেন। অনন্ত সিং ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলা ও শরীরচর্চায় পারদর্শী ছিলেন। সূর্য সেন তার অসাধারণ সাহস, সাংগঠনিক দক্ষতা, বুদ্ধিমত্তা, কর্মোদ্যোগ দেখে মুগ্ধ হন। অচিরেই তিনি সূর্য সেনের একজন ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বাসভাজন সহকর্মীর পদমর্যাদা লাভ করেন।[২]

বিপ্লবী কর্মকাণ্ড সম্পাদনা

১৯২১ সালে তারই ‌উদ্যোগে তার স্কুলের ছেলেরা অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেয়। এই আন্দোলন প্রত্যাহার করা হলে তিনি বিপ্লবী আন্দোলনকে জোরদার করার জন্য সচেষ্ট হন। তিনি বিপ্লবী দলে পরিচিত হন প্রমোদরঞ্জন সেনগুপ্তের মাধ্যমে এবং তার হাত ধরে দলে যোগ দেন গণেশ ঘোষ, তারকেশ্বর দস্তিদার, জীবন ঘোষালের মতো বিপ্লবীরা। একবার বিপ্লবীদের জন্য অর্থ সংগ্রহের উদ্দ্যেশ্যে আসাম-বাংলা রেলওয়ে কোম্পানীর অর্থ লুঠ করার সময় তিনি ও তার সঙ্গীরা পুলিসকে পরাভুত করে পাহাড়ে পালিয়ে যান। ১৯২৪ সালে বিপ্লবী কাজকর্মের জন‌্য গ্রেপ্তার হয়ে চার বছর কারাগারে থাকেন। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে তিনি ব্যয়ামাগার স্থাপন করে বিপ্লবী সংগঠনকে শক্তিশালী করার জন্য ও তরুণদের দলে আনার জন্য সচেষ্ট হন। তার এই অক্লান্ত পরিশ্রম, সংগঠননৈপুণ্য ও পরিকল্পনা চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার আক্রমণকে অনেকাংশে সফল করে তোলে। ঐ সময় চট্টগ্রাম শহর চারদিনের জন্য বৃটিশশাসনমুক্ত ছিল।ফেনী স্টেশনে ধরা পড়ার উপক্রম হলে অনন্ত সিংহ সাহসিকতার সাথে দুই হাতে গুলি চালিয়ে পুলিশ বাহিনীকে একাকী ছত্রভঙ্গ করেন ও কয়েকজন সহকর্মী সহ সেখান থেকে পালিয়ে এসে ফরাসী অধিকৃত চন্দননগরে আশ্রয় নেন। তার অন্যান্য সহকর্মীদের বিচার ও জেলে নির্যাতনের সংবাদে বিচলিত হয়ে ২৮ শে জুন, ১৯৩০ কলিকাতা পুলিশ কমিশনার লোম্যানের কাছে এসে আত্মসমর্পণ করেন। তিনি শরৎচন্দ্র বসুর নির্দেশে জেলের ভিতর সুড়ঙ্গ তৈরি করে বিস্ফোরক দিয়ে জেল উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন, যদিও ডিনামাইট পাতার সময় পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিলেন। এই ঘটনার ফলে সরকার ভীত হয়ে বিপ্লবীদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে বাধ্য হয়। অনেকের মতেই এই আলোচনার ফলেই চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের মামলায় কারও ফাঁসি হয়নি। বিচারে অনন্ত সিং-এর এবং অন্য এগারজনের দ্বীপান্তর হয়। ১৯৩২ সালে আন্দামান সেলুলার জেলে অনশন ধর্মঘট শুরু হলে রবীন্দ্রনাথ, গান্ধীজী প্রমুখের চেষ্টায় বন্দীদের আন্দামান থেকে স্বদেশে ফিরিয়া আনা হয়। অনন্ত সিং ১৯৪৬ সালে মুক্তিলাভ করেন। উল্লেখ্য, তার বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে সহায়তা করার জন্য তার জ্যেষ্ঠা ভগিনী ইন্দুমতী সিংহও জেল খেটেছেন।

চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন মামলায় যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত বিপ্লবীগণ সম্পাদনা

চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার আক্রমণ মামলায় অনন্ত সিং, লোকনাথ বল, গণেশ ঘোষ, লালমোহন সেন, সুবোধ চৌধুরী, ফণিভূষণ নন্দী, আনন্দ গুপ্ত, ফকির সেন, সহায়রাম দাস, বনবীর দাসগুপ্ত, সুবোধ রায়(ঝুংকু) এবং সুখেন্দু দস্তিদারের যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর দণ্ড হয়।[৩]

শেষ জীবন সম্পাদনা

জেলে থাকাকালীন সময়ে তিনি মার্কসবাদী দর্শন পাঠ করে তার দিকে আকৃষ্ট হন ও বাইরে এসে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করেন। কিছুদিন তিনি চলচ্চিত্র ও মোটর গাড়ির ব্যবসা করে রাজনীতি থেকে কিছুটা দূরে থাকেন। তার প্রযোজিত অন্যতম চলচ্চিত্র , ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় অভিনীত যমালয়ে জীবন্ত মানুষ। ৭০ দশকে এম. এম. জি বা ম্যান মানি গান নামক নকশালপন্থী বিপ্লবী গ্রুপ তৈরী করেছিলেন। ১৯৬০ সালের কলকাতায় ধারাবাহিক ব্যাংক ডাকাতির অভিযোগে তাকে ঝাড়খণ্ডের জদুগড় থেকে গ্রেপ্তার করা হয় ও তাকে আট বছর (১৯৬৯ - ১৯৭৭) জেলে থাকতে হয়। 'শেষ জীবনে তিনি একজন বিতর্কিত ব্যক্তি ছিলেন' এমনটা বলা হয়ে থাকে। কিন্তু আসল সত্যি হল এই -

১৯৫৯ সালে খাদ্য আন্দোলনে অসংখ্য অসহায় মানুষদের সাহায্যার্থে অনন্ত সিংহ সংগঠন গড়ে দরিদ্র দেশের মানুষের সেবা করার কাজ শুরু করেছিলেন। এই কাজ করতে গিয়ে তিনি নিজে একপ্রকার নিঃস্ব হয়ে গেছিলেন। তিনি দেখলেন দেশে একদলের কাছে শুধু টাকা আর টাকা, অন্যদিকে একদল প্রায় খেতেই পায়না, অথচ স্বাধীন দেশের সরকার কোনও বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিচ্ছে না। স্বাধীন দেশেই অসহায় মানুষ শুধু না খেতে পেয়ে একটু একটু করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে- এই স্বাধীনতা তারা চাননি বলেই অনন্ত সিংহের মনে হয়েছিল। কিন্তু সময় তখন অনেক দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। নতুন ভাবে সংগঠন তৈরি করে দরিদ্র মানুষের দুঃখ দূর করার সঙ্কল্প নিয়েই তিনি ব্যাঙ্ক ডাকাতির রাস্তায় যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। তিনি নিজে সশরীরে সরাসরি ডাকাতিতে যুক্ত ছিলেন না, পরিকল্পনা তৈরি করে দিয়েছিলেন। ইতিহাস যাঁরা জানেন কিন্তু অন্তর দিয়ে বোঝেন না, তারা অনন্ত সিংহের এই কাজের জন্য শ্রদ্ধা জানান না। অনন্তলাল সিংহের নিজের কথায়, 'তবু অপরাধ তো অপরাধই হয়, সে যে জন্যেই হোক, কারণটা কেউই বুঝবে না।'

রচনা সম্পাদনা

অনন্ত সিং তার জীবনের বহুমূখী অভিজ্ঞতা দিয়ে যেসব গ্রন্থ রচনা করেন সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: চট্টগ্রাম যুববিদ্রোহ (দুই খন্ড), অগ্নিগর্ভ চট্টগ্রাম (দুই খন্ড), সূর্য সেনের স্বপ্ন ও সাধনা, আমি সেই মেয়ে, কেউ বলে ডাকাত কেউ বলে বিপ্লবী প্রভৃতি।

মৃত্যু সম্পাদনা

হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ১৯৭৯ সালের ২৫শে জানুয়ারি অনন্ত সিং মৃত্যুবরণ করেন।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. বসু, অঞ্জলি (নভেম্বর ২০১৩)। বসু, অঞ্জলি; সেনগুপ্ত, সুবোধচন্দ্র, সম্পাদকগণ। সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান (পঞ্চম সংস্করণ, দ্বিতীয় মুদ্রণ সংস্করণ)। কলকাতা: সাহিত্য সংসদ। পৃষ্ঠা ১৭-১৮। আইএসবিএন 978-8179551356 
  2. অনন্ত সিং, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান
  3. ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী, জেলে ত্রিশ বছর, পাক-ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম, ধ্রুপদ সাহিত্যাঙ্গণ, ঢাকা, ঢাকা বইমেলা ২০০৪, পৃষ্ঠা ১৭৮।

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা