বিষয়শ্রেণী:সাহিত্য: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

বিষয়বস্তু বিয়োগ হয়েছে বিষয়বস্তু যোগ হয়েছে
Rajibul Hasan (আলোচনা | অবদান)
revert
Aunarjo (আলোচনা | অবদান)
সম্পাদনা সারাংশ নেই
২ নং লাইন:
 
[[Category:সংস্কৃতি]]
 
 
== '''আফ্রিকান সাহিত্য''' ==
'''উপনিবেশোত্তর আফ্রিকান সাহিত্য'''
 
 
 
== '''অ ব নি অ না র্য''' ==
একটি দেশে উপনিবেশ গড়বার পর আধিপত্যবাদী শক্তি যা যা করে আফ্রিকার ক্ষেত্রেও সেটার কিছুমাত্র কম হয়নি। আধিপত্যবাদী শক্তি অধীন দেশের সবচেয়ে স্পর্শকাতর এবং গুরুত্বপূর্ণ সত্তা, সংস্কৃতির একেবারে গোড়ায় আঘাত হানে। শুধু সেটাই নয়, পুরো দেশের রাজনীতিক-আর্থনীতিক-সামাজিক কাঠামো আগ্রাসী শক্তির কাঠামো কতর্ৃক প্রতিস্থাপিত হয়, শিক্ষাব্যবস্থা হয়ে পড়ে স্থানীয়সমাজবিচ্ছিন্ন। ইতিহাস আমাদের এই শিক্ষা দেয়। ইতিহাস আমাদের এও জানান দেয় যে, কতর্ৃত্বের পরাজয় একদিন ঘটে, কিন্তু ধর্ষণের পর যদি ধর্ষিতা গর্ভবতী হয়ে পড়ে তখন ধর্ষণের কষ্ট ছাপিয়ে যেমন আরো তীব্র হয় 'ধর্ষণের ফল' টানার লাঞ্ছনা, তেমনই আধিপত্যবাদ নিজের পরাজয়ের আগে অধীন দেশের গর্ভে দিয়ে যায় পররমুখাপেক্ষী-আর্থনীতিক কাঠামো, নিজের পছন্দ মতো তাঁবেদার স্থানীয় শাসক, সমাজবাস্তবতাবর্জিত শিক্ষাব্যবস্থা এবং শ্রেণীবৈষম্যের বীজ। কালে কালে সেই পাপের ফল টানতে হয় ধর্ষিতা ভূখণ্ডকে। আফ্রিকার ক্ষেত্রে এসব জানবার জন্য ইতিহাস জানার প্রয়োজন সীমিত, তাদের সাহিত্য বরং আমাদের সাহায্য করবে ইতিহাস আসলে কেমন হয় সেটা জানতে। আফ্রিকান সাহিত্যিকদের সৃষ্টিকর্মের দার্শনিক-সমাজতাত্তি্বক আলোচনা ব্যাপক ভাবে করেছেন রডনি, ক্যাবরাল এবং গুগি। তাঁরা খুব চমৎকার ভাবে রাজনীতিক, আর্থনীতিক এবং সামাজিক প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিয়েছেন কিভাবে এগুলো আফ্রিকার সাহিত্যিকদের চেতনাকে জারিত করেছে। আর এভাবে তাঁরা আফ্রিকার সাহিত্য সৃষ্টি-পরিচিতির পেছনকার মানসগঠন এবং চিন্তাচেতনার ধারা সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। পাশাপাশি ঔপন্যাসিকদের সমাজগঠন চিত্রণে আফ্রিকার সামাজিক সম্পর্ক, রাজনীতিক বিন্যাস এবং আর্থনীতিক বিষয়াশয় সদ্সদ্রূপে এসেছে কিনা সে-সম্পর্কে সিদ্ধান্তে আসার ক্ষেত্রেও পাঠকদের এ-কাজগুলো সহযোগিতা করবে। আফ্রিকার সাহিত্যের সংজ্ঞানির্ধারনী বিতর্কেও এ-সমালোচনাগুলো কাজে আসবে। কেননা যে, এগুলো আফ্রিকার সাহিত্যের প্রাক-উপনিবেশ, উপনিবেশ এবং উত্তর-উপনিবেশ ধাপগুলোর ঐতিহাসিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করেছে, যাতে করে আফ্রিকার সাহিত্যের বিশ্লেষণের কাজটি সহজ হয়। রডনি, ক্যাবরাল এবং গুগি দাবি করেন যে, আফ্রিকার সাহিত্যের একটি ঐতিহাসিক ধারা আছে। উদাহরণ দিয়েছেন এইভাবে- নয়াউপনিবেশবাদ এখনো আফ্রিকাতে আছে এইজন্য যে, ঔপনিবেশিককালে প্রতিষ্ঠিত আর্থনীতিক, রাজনীতিক এবং সামাজিক ধারাগুলো স্বাধীনতা পরবতর্ী সময়েও বর্তমান। নয়াউপনিবেশবাদের বোঝাপড়া এবং একে চ্যালেঞ্জ করবার জন্য ঔপনিবেশিক যুগের প্রতিষ্ঠিত আর্থনীতিক, রাজনীতিক এবং সামাজিক পরস্পরবিরোধিতাগুলোর বিশ্লেষণ জরুরি। কেননা ওই বৈপরিত্যসমূহ আজও আফ্রিকার সমাজের নির্মম বাস্তবতা। রডনির মতে উপনিবেশবাদই আন্তজর্াতিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থার কাছে আফ্রিকার অর্থনীতিকে নির্ভরশীল করে নয়াউপনিবেশবাদের শিকড় তৈরি করে দিয়ে গেছে। উৎপাদন এবং বণ্টনের পুঁজিবাদী সম্পর্ক, যেমন- ইণ্টারন্যাশনাল ট্রেড কমোডিটি এক্সচেঞ্জ সিস্টেমস এণ্ড ভ্যালুজ, এ-পরমূখিতার সৃষ্টি করেছে। রডনি বলছেন- 'উপনিবেশবাদ কোনোরকম ক্ষতিপূরণ ছাড়াই আফ্রিকার উন্নয়নকে করেছে স্থুল, খণ্ডিত এবং পশ্চাৎমুখী।'
আফ্রিকান সাহিত্যে এইসব শোষণের এবং পুঁজিবাদি অর্থনীতির প্রবেশের নান্দনিক উপস্থাপন আছে, এভাবে না বলে বলা ভালো সাহিত্যের ওইসব নান্দনিক চিত্রণ থেকেই এসব আলোচনা হয়েছে, সম্ভব হয়েছে। রডনি কিছু উদাহরণ দিয়েছেন। যেমন, মেয়মবিতে আছে- আমার জমি কফিতে ভরপুর অথচ বাবা আমার গরিব চাষি ছিলেন চিরকাল...। দেম্বসএ আছে- 'অনেক ধনের মাঝে লোক বাঁচে দীনহীন হালে। সর্বত্র কফি আর কফি, গাছে গাছে বিপুল সম্ভারে। ওরা দাম দিয়ে ওইসব চুরি করেছিলো, ঘামের দাম দিয়েছে অথর্ব পয়সা দিয়ে।'(পেপেটেলা:১৯৮৬:১৮/১৫৬)
ফার্দিনান্দ ওয়োনোর দ্য ওল্ড ম্যান এণ্ড দ্য মেডেল এর মূলচরিত্র মেকা এবং অন্যান্য চাষিরা নারকেল ফলিয়েছে ফ্রান্সে রপ্তানি করবার জন্য। চিনুয়া আসিবির থিংস ফল্ অ্যাপার্টএ বাণিজ্যকেন্দ্র স্থাপন এবং মিষ্টিআলু বিক্রয় পুঁজিবাদী অর্থনীতির প্রবেশ নির্দেশ করে। একইভাবে মঙ্গো বেটির মিশন টু কালা, দ্য পুওর ক্রাইস্ট অব বোমবা এণ্ড কিং ল্যাজারাসএ রপ্তানীউদ্দেশ্যে নারকেল উৎপাদন আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদী অর্থনীতির প্রবেশ নির্দেশ করে, আফ্রিকার জন্য যা অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। উপনিবেশ যুগের "মেরুকরণ" আফ্রিকার উৎপাদন ব্যবস্থাকে পুঁজিবাদের মুখাপেক্ষী করে নিঃস্ব করে দিয়েছে। স্থানীয় কলকারখানার উন্নতি হয়েছে যৎসামান্য (যা আজো বর্তমান)। আই'ল ম্যারি হোয়েন আই ওয়াণ্ট এ গিকামবা বলছেন: 'সবকিছু মেনে নেবো গিথোনির ছেলে/
শ্রমঘাম বেচে তাও/ গাঁয়ের কিছুটা যদি উন্নতি হয়/ আহারে! দেখো তো গাঁয়ের একি হাল!'
 
রডনি উল্লেখ করেন- 'রাস্তাগুলো তৈরি করা হয়েছিলো ওদের ব্যবসার সুবিধার্থে' আর যুক্তি দেখান_'আফ্রিকার স্বার্থে যদিবা কিছু গিয়ে থাকে সেটা নেহাতই অনিচ্ছাকৃত, দুর্ঘটনাবশত।' উদাহরণস্বরূপ মঙ্গো বেটির রিমেম্বার রু্যবেনএ ভাষ্যকার বলছেন- 'রাস্তাগুলো কোনোভাবেই আমাদের ইচ্ছাতে তৈরি হয়নি, ওগুলো আমাদের দুনিয়া থেকে ঢের বেশি দূরে ।' ফার্দিনান্দ ওয়োনোর দ্য ওল্ড ম্যান এণ্ড দ্য মেডেলএ ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর খাটিয়ে কালোশ্রমে রাস্তা নির্মাণ আফ্রিকাতে ইওরোপের শোষণেরই চিত্রণ। রডনি আরো উল্লেখ করেন যে, উপনিবেশ যুগে দখলদাররা নিজেদের মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখবার জন্য যেসব সামাজিক সেবা দিয়েছে সেগুলো তাদের শোষণ এবং আধিপত্যের ধরণের বহিঃপ্রকাশ। মেয়মবিতে ভাষ্যকার বলছেন- 'সারাদিন কুড়ালে কাঠ কেটে তুমি পাচ্ছো বিশ পয়সা... আর তোমার মালিক কতো পাচ্ছে জানো? এককাঁড়ি টাকা। এই টাকা আয়ের জন্য তোমার মালিক কী করেছে? কিছুই না, একদম কিচ্ছু না... তো সে কিভাবে দিনে হাজার হাজার আয় করবে আর তোমাকে দেবে মাত্র বিশ পয়সা? কী অধিকার তার আছে? এটাই ঔপনিবেশিক শোষণ।'(পেপেটেলা: ১৯৮৩: ১৯)
রডনি দাবি করছেন এভাবেই আফ্রিকার উন্নয়নের পথ বন্ধ হয়ে গেছে।
রডনি লক্ষ্য করেছেন যে, আফ্রিকার এই ইওরোপ-মুখাপেক্ষিতাই সৃষ্টি করেছে নয়াঔপনিবেশিক শ্রেণীবৈষম্য আর সেই আফ্রিকান শ্রেণী যারা ঔপনিবেশিক আর্থনীতিক কাঠামোকে তাদের স্বার্থে ব্যবহার করছে। মিশন টু কালাতে ঔপনিবেশিক প্রভূরা ভিমিলাই এর প্রধানকে নির্বাচিত করে এবং সে জণগনের জীবনের দামে যাপন করতো এক অভিজাত জীবন: 'ঔপনিবেশিক প্রভূরা (যারা তাকে নির্বাচিত করেছিলো) ওর মুখে মাখন তুলে দিয়েছিলো। এর বিনিময়ে সে রোবটের মতো তাদের নির্দেশ পালন করতো আর জানতো যে, তারা ওকে জঞ্জালে ফেলে দেবে না। যখন জোর করে খাটিয়ে কাজ করানো হচ্ছিলো তখন সবাই ওকে ভয় করে চলতো, কেননা ও ছিলো দলচূ্যত আর শত্রুপক্ষের গোয়েন্দা। ও নিজের স্বার্থের প্রয়োজনে আমাদের প্রথাগত চেইন অব কমাণ্ড মেনে চলতো, আর ওর প্রয়োজন না হলে নির্দ্বিধায় ওসব ভঙ্গ করতো।'(বেটি: ১৯৬৪: ১৮)
কালার কেন্দ্রিয় চরিত্র সমাজকে ধ্বংস করার জন্য ঔপনিবেশিক প্রভূদের হয়ে কাজ করতো। অভাবী ঋণগ্রস্তদের কাছ থেকে টাকা আর গবাদি নিয়ে ধনী বনে যান মেদজার বাবা। মেদজার মতে ইনিই হচ্ছেন আফ্রিকার বুদ্ধিজীবির জগতে পশ্চিমা ভণ্ডামি এবং ব্যবসায়িক বাস্তুববাদের স্বার্থক প্রতিস্থাপকের পরাকাষ্ঠা। এই পেটি-বূজের্ায়া আর শিক্ষিত কালো শ্রেণীই নয়াউপনিবেশবাদের ভিত্তি স্থাপন করেছে।
উপনিবেশযুগের শিক্ষাপদ্ধতি কিভাবে আফ্রিকানদেরকে উপনিবেশ ব্যবস্থার তাঁবেদার বানিয়েছে রডনি সেসম্পর্কে বিশদ ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলছেন, নয়াউপনিবেশবাদের সূচনা যে-শ্রেণীবৈষম্য দিয়ে সেটার শুরু হয়েছে শিক্ষার সংগে বস্তুগত প্রাপ্তির সম্পর্কের মধ্য দিয়ে। রডনি বিশেষভাবে বলতে চান যে, একটি সমাজের বাসিন্দাদের জীবন এবং সে-সমাজের অবকাঠামো রক্ষার জন্য শিক্ষা অতিঅবশ্য জরুরি। উপনিবেশপূর্বযুগের আফ্রিকার শিক্ষাপদ্ধতির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক এই যে, শিক্ষার সংগে আফ্রিকার জনগণের সম্পর্ক, যেটা উপনিবেশযুগে হয়েছে ঠিক তার উল্টো। উপনিবেশযুগের শিক্ষাপদ্ধতির একটাই উদ্দেশ্য- পুরো মহাদেশের উপর আধিপত্য কায়েমের ক্ষেত্রে আফ্রিকানদেরকে সংশ্লিষ্ট করার জন্য এদেরকে উপযুক্ত করে গড়ে তোলা। ঔপনিবেশিক শিক্ষার শিক্ষা হচ্ছে তাঁবেদার হবার শিক্ষা, শোষণের শিক্ষা, মানসিক সংশয়-সংকটের সৃষ্টি আর অনুন্নয়ন।
মিশন টু কালাতে মেদজার ঔপনিবেশিক শিক্ষা তাকে রাজনীতিক এবং আর্থনীতিকভাবে বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত সরকারি চাকুরের জীবন এনে দেয়, ফলে ঐ দেশের জনগণের সম্পূর্ণ স্বার্থবিরোধী কাজ করতেও এতটুকু কষ্ট হয় না। ঔপনিবেশিক শিক্ষা এইভাবে অভিজাত কালোশ্রেণী তৈরি করেছে যেন স্বাধীনতাপরবতর্ী সময়েও তার রাজনীতিক এবং আর্থনীতিক স্বার্থ পুরোপুরি অক্ষুন্ন থাকে।
রডনি আরো লক্ষ্য করেছেন যে, ঔপনিবেশিক শক্তি একটা বিরোধী অভিজাত শ্রেণী তৈরি করেছে যা স্বাধীনতাপরবতর্ী সময়ে ওখানে সামরিক একনায়কতন্ত্রের শাসন কায়েম করেছে। আসিবির অ্যানথিলস অব সাভানাহর সামরিক একনায়ক স্যাম এক্ষেত্রে খুব ভালো উদাহরণ।
রডনি আরো প্রত্যক্ষ করেছেন, শিক্ষিত আফ্রিকানরা উপমহাদেশে সবচেয়ে বেশি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। শিক্ষার প্রতিটি স্তরে তারা আরও বেশি করে জর্জরিত হয়েছে এবং শাদা পুঁজিবাদের প্রতি অনুরক্ত হয়েছে, মোটা অংকের মজুরি পেয়ে ভিনদেশী জীবনযাপন পদ্ধতিতে আসক্ত হয়ে পড়েছে। পরবতর্ীতে যা তাদের মানসকিতাকেই পাল্টে ফেলেছে।
ঔপনিবেশিক শিক্ষা আফ্রিকানদের চিন্তা-চেতনার জগতকে কলুষিত করার চাইতেও বেশি যে-ক্ষতি করেছে সেটা হলো অস্বাভাবিক জটিলতা-আক্রান্ত করে তাদেরকে অ-আফ্রিকান করে ফেলেছে এবং নিজস্ব পারিপাশ্বর্িকতা থেকে আরো আরো বিচ্ছিন্ন করেছে। নিজের সমাজজীবন এবং উন্নয়নের পথে যে-দিকনির্দেশনার প্রয়োজন, আফ্রিকান বুদ্ধিজীবিদের সে শক্তি পুরোপুরি কেড়ে নিয়েছে ঔপনিবেশিক শিক্ষা। উদাহরণস্বরূপ দাম্বুজো ম্যারেশেরার হাউজ অব হাঙ্গারর কথক সাংস্কৃতিকভাবে বিচ্ছিন্ন কেননা সে পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত। মিশন টু কালার মেদজার রোল মডেল আমেরিকা। নিজের সমাজোপযোগি কোনো সিদ্ধান্ত সে নিতে পারে না, এমনকি আফ্রিকার সমাজসংশ্লিষ্ট কোনো নতুন দৃষ্টিভঙ্গিও তার নেই: 'তো আমার ধারনা আরো বেশি বোধগম্য করার উদ্দেশ্যে উদাহরণ দিয়ে ওদের সামনে তুলে ধরবো বলে সিদ্ধান্ত নিলাম। আশ্চর্য যে, আমি ওইসব সাধারণ মানুষকে নিউইয়র্ক সম্পর্কে বলতে লাগলাম... নিউইয়র্ক সম্পর্কে বলাটা একটা ছেলেমানুষি ছাড়া আর কিছুই না, কেননা যে ওটা সম্পর্কে আমার যতটা জ্ঞান তা ওই সিনেমা দেখেই।'(বেটি: ১৯৬৪: ৬৫)
ঔপনিবেশিক শিক্ষা মেদজাকে যা যা শিখিয়েছে সবই আফ্রিকার সমাজ বহির্ভূত। চার্লস মঙ্গোশির ওয়েটিং ফর দ্য রেইনএ লুসিফারও ঔপনিবেশিক শিক্ষার ফলে নিজের সমাজ থেকে বিচ্ছিন্নতা অনুভব করে। পি'বিটেক একটা চিত্রকল্প এঁকেছেন- যেখানে ঔপনিবেশিক শিক্ষা আফ্রিকান অভিজাতদের খোজা করে দিয়েছে: 'আমার স্বামীর ঘর অন্ধকার বইয়ের জঙ্গল.../ তাদের পুরুষত্ব শ্রেণীকক্ষেই নিঃশেষিত, বড় বড় বই ওদের অণ্ডকোষ পিষে ফেলেছে।'(পি'বিটেক: ১৯৮৫: ১১৭)
গুগি লক্ষ্য করেছেন ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা এবং আফ্রিকার বাস্তবতার মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণেই জনগণ বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। আর সে কারণেই নিগ্রো কবিরা সবসময়েই বিচ্ছিন্নতাবিরোধী থেকেছেন আফ্রিকার পরিচয়, আফ্রিকান মূল্যবোধ এবং আফ্রিকার শেকড়সংশ্লিষ্ট থেকে। পাগলের মতো খুঁজেছেন তাঁদের হারানো পরিচয়, হারানো আফ্রিকান ঐতিহ্য। লিয়ন দুমাস লেখেন- '(শাদারা) আমার জায়গাটুকু চুরি করেছিলো।' চিকায়া উ'তামসি বর্ণনা করেছেন_ '(শাদারা কালোদেরকে ফেলে গেছে) অন্ধকার কোনো এক কোণে... চলে গেছে সেই দেবী একদা যে নেচেছিলো গেয়েছিলো বনে... মহান পশ্চিম টাকা দিয়ে বেঁধেছে আমায়... আমার যেসব ছিলো হারিয়েছে সব চিরতরে।'
ধর্মের ব্যবহার উপনিবেশবাদের ধর্ম। আফ্রিকাতে হয়েছে খ্রিস্টানধর্মের ব্যবহার । রডনি খ্রিস্টানধর্ম, ঔপনিবেশিক শিক্ষাপদ্ধতি এবং প্রশাসনিক পদ্ধতির আন্তঃসম্পর্ক নিয়েও বিশ্লেষণ করেছেন। হোমকামিং এ গুগি বলছেন- 'গ্রহণযোগ্যতা অর্জন এবং চিরস্থায়ী করবার জন্য ঔপনিবেশিকরা খ্রিস্টানধর্মের সেবা দিয়েছে আর শিক্ষাকে করেছে খ্রিস্টানধর্ম ভিত্তিক... মন এবং আত্মা দুটোকেই গ্রাস করার জন্য... (১৯৮২)।' আসিবির থিংস ফল অ্যাপার্টএ নতুন ধর্মান্তরিত খ্রিস্টানরা তাদের চিরাচরিত জীবনযাপন পদ্ধতি পাল্টে ঔপনিবেশিকতাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলো। ওয়োনোর দ্য ওল্ডম্যান এণ্ড দ্য মেডেলএ মেকা তার সমস্ত সম্পত্তি পাদরিকে দান করে: 'আর এখন সে থাকে খ্রিস্টান গোরস্তানের পাদদেশে অবস্থিত একটা হতদরিদ্র গ্রাম্যকুটিরে যার নামও দেয়া হয়েছে মিশনারিরই নামে।'(ওয়োনো: ১৯৬৭: ৯)
হাউজবয়এ ঔপনিবেশিক গির্জাপ্রধান ফাদার গিলবার্ট এর পক্ষে গিয়ে নিজের জন্মদাতাকেই অস্বীকার করে টুণ্ডি। বেটির পুওর ক্রাইস্ট অব বোমবা এণ্ড কিং ল্যাজারাসএ ফাদার ড্রুমণ্ট এবং ফাদার লি গুয়েন খ্রিস্টানধর্মকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে স্থানীয় জনগণের ওপর পুরো কর্তৃত্ব নিয়ে নেয়, আর এভাবে শোষকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। আই'ল ম্যারি হোয়েন আই ওয়াণ্ট এ গিকামবা বলেন: 'স্রষ্টা আর ধর্ম এক জিনিস নয়।/ ১৮৯৫এ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা যখন এখানে আসে/ সব গির্জার সব পাদরির/ বাম হাতে ছিলো বাইবেল/ আর ডান হাতে রাইফেল/ শাদারা চেয়েছে/ মাতাল করতে ধর্ম দিয়ে/ আর তেনারা এইসময়ে/ নকশা এবং দখল করছে আমার জমি/ কারখানা আর ব্যবসা ফাঁদছে আমার ঘামে।' (গুগি: ১৯৮২: ৫৬-৭)
আধিপত্যবাদ যে-সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালিয়েছে সেবিষয়ে আলোচনা করেছেন ক্যাবরাল। তাঁর মতে আদর্শ এবং মতবাদের পর্যায়ে আর্থনীতিক এবং রাজনীতিক কার্যাবলীর চূড়ান্ত ফলাফলই হচ্ছে সংস্কৃতি। একটা সমাজের উৎপাদনীশক্তির পর্যায় এবং এই-উৎপাদনের ওপর আধিপত্যবিস্তারি ধর্মই হচ্ছে সংস্কৃতির ভিত্তি।
ফলে সমাজে বিদ্যমান সম্পর্কগুলোর একদিকে মানুষ (ব্যষ্টিক এবং সামষ্টিক) ও প্রকৃতির সম্পর্ক, অন্যদিকে ব্যক্তিগত দলগত এবং বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে সম্পর্ক, গতিশীল প্রকাশ এবং বিভিন্ন রাজনীতিক ও আর্থনীতিক কর্মকাণ্ডের সজাগ সচেতনতার ফলই সংস্কৃতি (ক্যাবরাল: ১৯৮০: ১৪১)। সংস্কৃতি কেবল তখনই গতিশীল হবে যখন সামাজিক উন্নয়নের প্রক্রিয়াটি নিরবচ্ছিন্ন থাকবে এবং ভিনদেশী আধিপত্যের বিরুদ্ধে একটা শক্ত স্থায়ী দেয়াল দাঁড় করানো যাবে।
ঔপনিবেশিক শক্তি আঘাত করেছে স্বদেশি সংস্কৃতির একেবারে মূলে। এবং আফ্রিকার সাংস্কৃতিক উন্নয়ন ও এর বহিঃপ্রকাশের পথ পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছে। ওয়োনোর হাউজবয়এ টুণ্ডি (যে ফাদারের পক্ষে কথা বলতে গিয়ে নিজের জন্মদাতাকে অস্বীকার করেছিলো) প্রশ্ন করছে- 'আমাদের (কালোদের)কে ফরাসি ডাকলেই কী!' এপ্রশ্ন সে করে যখন সে বুঝতে পারে তার এই 'ফরাসি পরিচিতি' তাকে প্রকারান্তরে ঔপনিবেশিক সংস্কৃতি ও শোষকের পরিচয়ে পরিচিত করায়।
'উপনিবেশবাদ যেমন করে শোষিতের ইতিহাসকে উপেক্ষা করার মাধ্যমে তাদের সংস্কৃতির পথকে রুদ্ধ করে দেয় তেমনই স্বাধীনতাযুদ্ধও শোষকের সংস্কৃতিকে অস্বীকার করার মাধ্যমে আসলে শোষকের ক্ষমতার বিরুদ্ধে এক মহাহুঙ্কার'-ক্যাবরাল। অতএব সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রথম ধাপ হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী সংস্কৃতি পরিহার করে নিজের সংস্কৃতি অন্বেষণ। আফ্রিকার সংস্কৃতির বিদেশি রূপান্তরে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে পুঁজিবাদি অর্থনীতির প্রবেশ, বুজের্ায়া ধর্ম এবং ইওরোপিয়ান শিক্ষাপদ্ধতি। আর এ-বিষয়গুলো খুব সুন্দরভাবে উপস্থাপিত হয়েছে তালা এবং এসাজাম উপন্যাস দুটিতে। ঔপনিবেশিক শক্তি কর্তৃক স্বদেশি সংস্কৃতির বিপর্যয়ের চিত্র অংকিত হয়েছে ওয়োনোর হাউজবয় এবং দ্য ওল্ড ম্যান এণ্ড দ্য মেডেলএ। আর এর বিপরীতে উপনিবেশবাদ দিয়েছে স্কুল, দোকানপাট, রাস্তা, হাসপাতাল যাতে করে আফ্রিকার সংস্কৃতির স্থান দখল করতে পারে ঔপনিবেশিক সংস্কৃতি। ক্যাবরাল বলছেন- '্লনিজেদের সংস্কৃতির দীর্ঘনিরাপত্তার স্বার্থেই ঔপনিবেশিক শক্তি শোষিতের সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে দিয়েছে।' ক্যাবরাল দেখিয়েছেন যে, এ-সংস্কৃতি স্বপ্ন দেখিয়েছে যে-'পেটি বুর্জোয়া' শ্রেণীকে তারা এ-সমাজেরই বাসিন্দা। আফ্রিকার নতুন শাসক গোষ্ঠী অনুন্নত, আর্থনীতিক ক্ষমতা নূ্যনতম। এরা নিজেদেরকে ঔপনিবেশিক শক্তির সংগে একীভূত করে 'সাংস্কৃতিকভাবে মহত্তম' ভাবতে শুরু করে। তাদের এই কৃত্রিমসংস্কৃতি রাজনীতিক এবং আর্থনীতিকভাবে পুরোপুরি বূর্জোয়া সংস্কৃতির উপর নির্ভরশীল। যালা এবং লাস্ট এম্পায়ারএ উসমান সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদের ব্যাপক সমালোচনা করেছেন। উসমান তাঁর যালা (খোজা/পুরুষত্বহীন)তে এল হাজি কাদের বে'র পুরুষত্বহীনতার মধ্য দিয়ে আফ্রিকার নতুন মধ্যবিত্ত শাসকদের উদ্ভাবনীশক্তির অপর্যাপ্ততা এবং আর্থনীতিক পঙ্গুত্বকেই ইঙ্গিত করেছেন। হাজি চেম্বার অব কমার্সকে বলছে: 'আমরা ব্যবসায়ী? ফু! শিশুর পায়ে বাপের জুতার মতো... ঝুড়ির মধ্যে কাঁকড়াবিছার মতো। আমরা কি আগের শাসকদের জায়গা দখল করতে চাই? ... কী পরিবর্তনটা হয়েছে শুনি, সাধারণ বা বিশেষ কিছু? ঔপনিবেশিক শক্তির বীজ আমাদের মধ্যে আজও আছে... আমরা কী! এজেণ্ট! পেটি ব্যবসায়ী! নির্বোধের মতো আমরা আমাদেরকে ভাবছি 'ব্যবসায়ী'! মূলধন ছাড়া ব্যবসায়ী।'(উসমান: ১৯৭৬: ৯১-২)
পূর্ববতর্ী প্রজন্ম যে-বিদেশি আধিপত্যবাদী সংস্কৃতি থেকে মুক্তির উদ্দেশে লড়েছিলো নতুন প্রজন্ম সে-সংস্কৃতিকেই আঁকড়ে ধরেছে। ' ছেঁড়া হোক আর আধুনিক হোক ইওরোপের বসন-বাসন ব্যবহারকেই আফ্রিকানরা ইওরোপিয়ানদের সমতূল্য হবার মাধ্যম হিসেবে নিয়েছে, নিজেদের প্রাপ্তি মনে করেছে'_অধ্যাপক ওয়েস্টারম্যান (আফ্রিকান টুডে: ৩৩১)। আর এগুলোর চমৎকার চিত্রণ উসমান এর দ্য লাস্ট এম্পায়ার (ইওরোপ আমেরিকার কাপড়ের প্রতি ম্যামলেট সুকুবের তীব্র টান), কিংবা ওয়োনোর দ্য ওল্ড ম্যান এণ্ড দ্য মেডেল (ইওরোপিয়ান জুতা জ্যাকেটের প্রতি মেকার আগ্রহ)। ডেভিল অন দ্য ক্রস এ গুগি ব্যঙ্গ করেছেন- ''যা বিদেশি তা-ই শ্রেষ্ঠ, দেশি মাত্রই অপকৃষ্ট, এই হচ্ছে নতুন মধ্যবিত্তশ্রেণীর মানসিকতা (আমাদের দেশেও সচরাচর আমরা কেনাকাটার সময় 'জিনিসটা বাইরের' বললে নিশ্চিন্ত এবং প্রীত হই)।'' মধ্যবিত্ত শাসক শ্রেণীর আরো যে-বিষয়টা গুগি চিত্রিত করেছেন সেটা হচ্ছে এ-শ্রেণী নিজস্ব বিপ্লবীসংস্কৃতিটাকে আর লালন করতে নারাজ, কেননা যে ওরা নিজেরাই এখন শোষকের স্থান দখল করেছে এবং এই অবস্থানের পরিবর্তন ওরা চায় না। এই শিল্পিত চিত্রণের সংগে মিল পাওয়া যায় ক্যাবরালর বিশ্লেষণের- সংস্কৃতির এই শ্রেণীচরিত্র বুঝিয়ে দিচ্ছে যে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের মূল্যায়ন দুই শ্রেণীর কাছে সম্পূর্ণ বিপরীত, একের কাছে অত্যাবশ্যকীয়, অন্যের কাছে অপ্রয়োজনীয়। জাতীয় উন্নয়নের শক্তির স্বাধীনতার ধ্বংসাত্মক জবরদখল করে আধিপত্যবাদ, আর জাতীয় স্বাধীনতা সে-উন্নয়নের শক্তিকে বিদেশি সকল অপশক্তি থেকে মুক্তি দেয়। কিন্তু আফ্রিকান সাহিত্যের গোড়ার দিকে আইনগত স্বাধীনতা এবং আর্থনীতিক মুক্তির বিষয় দুটোর মৌলিক পার্থক্য নিরুপণে আফ্রিকান সাহিত্যিকগণ সফল হননি। যেমন- আধিপত্যবাদবিরোধী সাহিত্য আসিবির থিংস ফল অ্যাপার্টএ আফ্রিকার মূল সমস্যা শ্রেণী সংঘাত চিহ্নিত না হয়ে হয়েছে বর্ণবৈষম্য। স্বাধীনতা যুদ্ধ আসলে তখনই ফলপ্রসূ যখন আফ্রিকান লেখকরা লিখতে শুরু করেন পেটালস অব ব্লাড (গুগি)র মতো লেখা যেখানে আফ্রিকার মূল সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে শ্রেণীসংঘাত। ক্যাবরাল মনে করেন জাতীয় সংস্কৃতির ধারক কৃষকরাও সংস্কৃতির প্রগতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। উন্নততর সংস্কুতির সংস্পর্শে এই কৃষকরাই 'পেটি বুর্জোয়া' ধ্যানধারনা ঝেড়ে ফেলে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে পারেন (আমরা রুশ বিপ্লবের কথা এক্ষেত্রে স্মরণ করতে পারি)। এবং বুজের্ায়া শ্রেণীর বিনাশ তখন অনিবার্য, তারা নিজেদের তখন কৃষকশ্রেণীর কাতারে ভাবতে বাধ্য হবে।
' এক ইতিহাস গড়েছে আমাদের জাতীয় সশস্ত্র মুক্তি আন্দোলন, আমাদের সংস্কৃতি আর আমাদের আফ্রিকান পরিচয়ের চূড়ান্ত প্রকাশ'_ ক্যাবরাল। ক্যাবরাল আরো বলছেন- 'আমাদের সংস্কৃতি আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলনের সংস্কৃতি।' গুগির মাতিগারিতে কেন্দ্রিয় চরিত্র নয়াঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের একজন গেরিলাযোদ্ধা।
গুগির মতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে যেসব আফ্রকান লেখক বেরিয়ে এসেছেন তাঁরা তিনটি ধাপ প্রত্যক্ষ করেছেন- ১. উপনিবেশবিরোধীযুদ্ধ ২. স্বাধীনতা ৩. নয়াউপনিবেশবাদ।
পঞ্চাশের দশকে আফ্রিকার অধিকাংশ দেশই স্বাধীনতা লাভ করে, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী যুদ্ধের জয় হয়। এ-দশকের সাহিত্যিকদের মধ্যে তাই প্রতিশ্রুতি এবং প্রত্যয়ের ছাপ দেখা যায়। জাতিগত মহত্বের দোহাই দিয়ে আধিপত্যবাদী শক্তি নিজের শাসন-শোষণের বৈধতা প্রমাণে সচেষ্ট ছিলো। নতুন আফ্রিকার লেখকগণ নান্দনিক সাহিত্য সৃষ্টি করে দেখিয়ে দিলেন আফ্রিকার ইতিহাস, সংস্কৃতি, সভ্যতা সাম্রাজ্যবাদী শক্তি অপেক্ষা উন্নততর না হোক অন্তত সমান মানের। লেখকগণ প্রত্যক্ষ করলেন যে, উপনিবেশ যুগের আরোপিত বিনিগ্রোকরণ এবং শিকড়হীনতার জটিলতা থেকে সমাজ ধীরে ধীরে মুক্ত হচ্ছে। এসময়ের প্রতিনিধিত্বকারী শিল্পসৃষ্টির নমূনা উমোফিয়া (উপনিবেশপূর্ব কালের স্বাধীন এবং প্রগতিশীল সমাজ)ভিত্তিক সাহিত্যকর্ম আসিবির থিংস ফল অ্যাপার্ট। আফ্রিকার শতচ্ছিন্ন ইতিহাস পুনর্গঠনের কাজ করলেও আসিবি একে আদর্শায়িত করেননি। তিনি দেখিয়েছেন উপনিবেশপূর্ব যুগেও আফ্রিকার নিজস্ব স্ববিরোধিতা এবং আত্মিক সংকট ছিলো। আসিবির শৈলী তাঁর সমসাময়িক নিগ্রো লেখক (সেংহর, লেই প্রমুখ)গণের সম্পূর্ণ বিপরীত, যাঁদের শিল্পীত কাজ আফ্রিকাকে আদর্শায়িত করেছে। এ-লেখকদের আদর্শগত সংশ্লিষ্টতা আফ্রিকান জাতীয়তাবাদেরই বহিঃপ্রকাশ। সাম্রাজ্যবাদ এবং তদ্পরবতর্ী সামাজিক অবস্থার বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে এঁদের ভুল এইযে, শ্রেণীসংঘাত নয় বরং জাতিগত বিভেদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এঁরা আলোচনা করেছেন।
উপনিবেশোত্তর আফ্রিকান সাহিত্যের আরো একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে নিজেদের বিপ্লবাত্মক উদ্দেশ্য সামনে রেখে ইংরেজি ভাষা (লেখ্যরূপ)র খোলনলচে পাল্টে ফেলা। আসিবির থিংস ফল অ্যাপার্ট এবং দ্য অ্যারো অব গড আইবো/ইবো (দক্ষিণ-পূর্ব নাইজেরিয়ান ভাষা) ধাঁচে লেখা। আরো লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে আফ্রিকায় উপন্যাস লেখা হয়েছে একটি শ্রেণীর জন্ম হয়েছে বলে- আসিবি, লেই, গুগি এঁরা প্রত্যেকেই নব্য আফ্রিকান শিক্ষিত অভিজাতশ্রেণীর। এঁদের লেখার টার্গেট শ্রেণী ছিলো একই আর্থ-সামাজিক মর্যাদা সম্পন্ন স্থানীয় এবং আন্তজর্াতিক পাঠক-শ্রোতা।
সত্তরের দশকে আফ্রিকা জুড়ে একনায়কতন্ত্রের আবির্ভাব উপনিবেশ যুগের রাজনীতিক আর্থনীতিক এবং সামাজিক রীতির পুনরাগমণ ঘটায়। তাছাড়া স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে উদ্ভূত নতুন শ্রেণী এবং শ্রেণীর স্ববিরোধিতা ইত্যাদি বিষয় উপনিবেশোত্তর যুগ সম্পর্কে আশাবাদী-সাহিত্যস্রষ্টাদেরকেও হতাশা আক্রান্ত করে। এসময়ের প্রতিনিধিত্বকারী সাহিত্যকর্ম আসিবির আ ম্যান অব দ্য পিপল এবং আরমার দ্য বিউটিফুল ওয়ানস আর নট ইয়েট বর্ন সমাজের বিদ্যমান স্ববিরোধিতাগুলো পুরোপুরি ধরতে পারেনি। ভুলবশতঃ নেতাদের নৈতিক দিকনির্দেশনা প্রদানের অক্ষমতাকে তাঁরা আফ্রিকার মূল সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। লেখকগণ সমাজ এবং নেতৃত্বকে নৈতিক পুনর্জাগরণের মাধ্যমে রূপান্তরের কাজ দায়িত্বজ্ঞান করেন। এসময়ের লেখায় তাই উদার মানবতাবাদী আদর্শের ছাপ দেখা যায়। লেখকগণ নিজেদের লেখার দুঃখ এবং আবেগি শক্তি দ্বারা শোষিতের পক্ষে সমাজের আর্থনীতিক এবং রাজনীতিক পুনর্বিন্যাসের জন্য শোষকগণের দৃষ্টি আকর্ষণে সচেষ্ট হয়েছেন। উপন্যাসের এই রীতি দ্বারা লেখকরা জনগণের আবেগকে চাবুকাঘাত করেছেন যাতে করে বিদ্যমান ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনগণের সোচ্চার অবস্থান হয়- এরকমও বলেছেন অনেক সমালোচক। তবে এসময়েই (সত্তরের দশকে) লেখকগণের উপলব্ধি হয় যে সমাজের স্ববিরোধিতগুলোর শিকড় বর্ণবাদে নয় বরং শ্রেণীসংঘাতে। উল্লেখ করবার মতো কাজ গুগির ডেভিল অন দ্য ক্রস, পেপেটেলার মেয়মবি, সালে সেলাসির ফায়ারব্র্যাণ্ডস। এসব উপন্যাসে সমস্যা চিহ্নিত হয়েছে শ্রেণীসংঘাতের দৃষ্টিকোণ থেকে এবং শোষিতের অর্থাৎ কৃষক-শ্রমিকের অবস্থান থেকে। লেখকরা জনগণকেই বিপ্লবের ঝাণ্ডা বহনের দায়িত্ব দিয়েছেন। শিক্ষিত অভিজাতশ্রেণীর প্রতি লেখকদের ঘেন্না পরিস্ফুটিত যারা সংগ্রামের সূচনা করতে জানে না, তাঁদের অকুণ্ঠ বিশ্বাস প্রান্তিক কৃষক-শ্রমিকদের ওপর। লেখকরা জনগণকে বিপ্লবী সংগ্রামে উদ্বুদ্ধকরণ নিজেদের দায়িত্ব মনে করেছেন । একটি আগ্রাসী সমাজের সবচেয়ে শোষিত অংশ নারী। দেখা যায় গুগির আ গ্রেইন অব হুয়িট এর মুম্বি, ডেভিল অন দ্য ক্রস এর ওয়ারিংগা, ওয়োনোর হাউজবয় এর সোফি এবং উসমান এর যালার আজা আওয়া আসতু এরা সবাই শোষিত নারী। সমাজতান্ত্রিক আদর্শ যদিও এসব লেখার ভিত্তি, তবু শিল্পীত গীতিকবিতা এবং অন্যান্য কথক ভঙ্গিমা নতুন শ্রোতা, কৃষকের উদ্দেশ্যে। এবং শেষোক্ত (কথক ভংগিমা) ধারাটিই বিতর্কের সৃষ্টি করেছে আসলে আফ্রিকান সাহিত্যের মূলধারা কোনটি। ভাষা নিয়েও বিতর্ক আছে। গুগি মনে করেন বিদেশি ভাষায় সাহিত্য রচনা নয়াউপনিবেশবাদের তল্পিবাহক, আর ইংরেজিতে রচিত সকল আফ্রিকান সাহিত্যই প্রকৃতঅর্থে ইওরো-আফ্রিকান, কোনোভাবেই আফ্রিকান নয়। আধিপত্যবাদবিরোধী গুগি তাঁর উপন্যাস ডেভিল অন দ্য ক্রস লিখেছেন গিকুয়ু্যতে। এপ্রসংগে তিনি বলছেন- 'গিকুয়ু্যতে লিখলেও অন্যান্য ভাষা থেকে আমি দূরে সরে যাচ্ছি না কেননা সবসময়েই অনুবাদের সুযোগ থেকেই যাচ্ছে।'
এই জায়গাতে এসে আফ্রিকান সাহিত্য নিয়ে ইংরেজিতে কাজ করা বতসোয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মি. ওমোরেগি আপত্তি করছেন- 'গুগি ভুলে যাচ্ছেন যে অনুবাদে সবসময়েই কিছু না কিছু পরিবর্তন, সংযোজন, বর্জন হয় (বলি, সেইজন্য কি মাতৃভাষা বাদ দিয়া অন্যভাষায় সাহিত্য বানাইতে হবে?)। আর তাছাড়া গিকুয়ু্যতে লিখলে লেখকের উদ্দিষ্ট স্বদেশি এবং বিদেশি দুইধরনের স্রোতা পেতে সমস্যা হবে। সেক্ষেত্রে নিরপেক্ষ ভাষা হচ্ছে ইংরেজি।' ওদিকে গুগি বলছেন: 'জনগণের বাঁচার লড়াইয়ে অংশগ্রহণভিন্ন আশির দশকের লেখকদের অন্যপথ নাই। এঅবস্থায় তাকে জনগণের মুখের ভাষার মুখোমুখি হতে হবে যাদের জন্য তার কলম উৎসগর্ীকৃত। তাকে জনগণের বুলি আর যুদ্ধের ভাষা প্রয়োজনে পুনরাবিস্কার করতে হবে... তাকে হতে হবে জনগণের সংগীতেরই অংশ।'
 
 
[উপাদানঋণ : আরমা, আসিবি, উতামসি, উসমান, ওয়োনো, ওয়েস্টারম্যান, ওমোরেগি, ক্যাবরাল, গুগি, দুমাস, পেপেটেলা, পি'বিটেক, মঙ্গো বেটি, মঙ্গোশি, ম্যারেশেরা, রডনি, সালে সেলাসি প্রমুখ।]
 
--[[ব্যবহারকারী:Aunarjo|Aunarjo]] ০৬:১২, ২১ নভেম্বর ২০০৬ (UTC)