কৈলাসে কেলেংকারী: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

বিষয়বস্তু বিয়োগ হয়েছে বিষয়বস্তু যোগ হয়েছে
NahidSultanBot (আলোচনা | অবদান)
বট নিবন্ধ পরিষ্কার করেছে। কোন সমস্যায় এর পরিচালককে জানান।
নকীব বট (আলোচনা | অবদান)
বানান সংশোধন
৫০ নং লাইন:
ফেলুদা এতক্ষণ চুপ করে ভাবছিল। এবার বলল, সেই আমেরিকান ভদ্রলোকের নামটা জেনেছিলেন কি?
জেনেছি বইকী। এই যে তার কার্ড।
সিধুজ্যাঠা তার পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা ভিজিটিং কার্ড বার করে ফেলুদাকে দিল। উঠে গিয়ে দেখলাম তাতে নাম ছাপা রয়েছে–সল সিলভারস্টাইন–আর তার নীচেনিচে
ইহুদি, সিধুজ্যাঠা বললেন।—স্টাইন দেখলেই বুঝবে ইহুদি। লোকটা ডাকসাইটে ধনী। তাতে সন্দেহ নেই। হাতে একটা ঘড়ি পরেছিল। তেমন ঘড়ি বাপের জন্মে দেখিনি। তারই দাম বোধহয় হাজারখানেক ডলার।
ভদ্রলোক ক’দিন থাকবেন কিছু বলেছিলেন?
১৮৪ নং লাইন:
আমাদের ট্যাক্সিও গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকাল। একটা প্ৰকাণ্ড খোলা জায়গা; তার মাঝখানে একটা পার্ক, আর চারদিকে ঘিরে রয়েছে পাঁচ-ছাতলা উঁচু সব বাড়ি। পর্কের চারদিকে গাড়ি পার্ক করা রয়েছে, তার মধ্যে আবার দু-একটা স্কুটারও রয়েছে; আমাদের ডান দিকে কুইনস ম্যানসন। আমরা ট্যাক্সি দাঁড় করলাম, নীল গাড়ি কিছু দূরে একেবারে শেষ মাথায় গিয়ে থামল। আমরা গাড়ির ভিতরে বসে আছি কী হয় দেখার জন্য।
ভদ্রলোক একটা কালো ব্যাগ হাতে নিয়ে নামলেন, দরজার কাচ তুললেন, দরজা লক করলেন, তারপর ডান দিকে গিয়ে একটা বড় দরজা দিয়ে কুইনস ম্যানসনে ঢুকে গেলেন।
এক মিনিট অপেক্ষা করে ফেলুদাও ট্যাক্সি থেকে নামল আমি তার পিছনে। সোজা চলে গেলাম সেই দরজার দিকে। একটা ঘড় ঘড় শব্দ আগেই কানে এল; গিয়ে দেখি দরজা দিয়ে ঢুকেই একটা আদ্যিকালের লিফট, সেটা সবেমাত্র নীচেনিচে নেমেছে। ঝটপটাং শব্দ করে লোহার কোলাপসিবল দরজা খুলে বুড়ো লিফটম্যান খাঁচা থেকে বেরিয়ে এল। ফেলুদা হঠাৎ একটা ব্যস্ততার ভাব করে তাকে জিজ্ঞেস করল, মিস্টার সেনগুপ্ত এইমাত্র ওপরে গেলেন না?
সেনগুপ্ত কোন?
এইমাত্র যিনি ওপরে গেলেন?
২৬২ নং লাইন:
বৈষ্ণব ধর্মের খুব প্রভাব শোনা যাচ্ছে? ফেলুদা একটু ঠাট্টার সুরেই প্রশ্নটা করেছিল। ভদ্রলোক হেসে বললেন, হরেকৃষ্ণর কথা বলছেন তো? জানি। তবে ওরা কিন্তু খুব সিরিয়াস। মাথা মুড়িয়ে ফোঁটা কেটে ধূতির কোঁচটা দুলিয়ে কেমন খোল করতাল বাজায় দেখেছেন তো? চোখে না দেখে দূর থেকে শুনলে খাঁটি কীর্তনের দল বলে ভুল হবে…
এয়ারলাইনস আপিসের পাশেই আওরঙ্গাবাদ হাটেল, পৌঁছতে লাগল। মাত্র পনেরো মিনিট। ছোট হাটেল, তবে থাকার ব্যবস্থা বেশ ভাল। খাতায় নামষ্টাম লিখিয়ে আমরা দুজন গেলাম। এগারো নম্বর ঘরে, লালমোহনবাবু চোদ্দেয়। ফেলুদা স্যান্টাক্রজ থেকে একটা বম্বের কাগজ কিনেছিল, রেস্টোরান্টে খাবার সময় ওটা পড়তে দেখেছিলাম। এবার ঘরে এসে চেয়ারে বসে মাঝখানকার একটা পাতায় কাগজটা খুলে আমায় জিজ্ঞেস করল, ভ্যান্ডালিজম মানে জানিস? পরিষ্কার না জানলেও, আবছা আবছা জানতাম। গুণ্ডামি ধরনের কোনও ব্যাপার কি? ফেলুদা বলল, পঞ্চম শতাব্দীতে যে বর্বর জাতি রোম শহরকে ধ্বংস করেছিল তাদের বলত ভ্যান্ডালস। সেই থেকে ভ্যান্ডালিজম বলতে বোঝায় কোনও সুন্দর জিনিসকে নির্মমভাবে ধ্বংস করা। ,
কথাটা বলে ফেলুদা কাগজটা আমার হাতে দিল। তাতে খবর রয়েছে—মোর ভ্যান্ডালিজম। তার নীচেনিচে বলছে-মধ্যপ্রদেশের খাজুরাহাতে ত্রিংশ শতাব্দীর কান্ডারিয়া মেহাদেও মন্দিরের গা থেকে একটা মেয়ের মূর্তির মাথা কে বা কারা যেন ভেঙে নিয়ে গেছে। বরোদার এক আর্ট স্কুলের চারজন ছাত্র মন্দিরটা দেখতে গিয়েছিল, তারাই নাকি প্রথম ব্যাপারটা লক্ষ করে। গত এক মাসে এই নিয়ে নাকি তিনবার এই ধরনের ভ্যান্ডালিজমের খবর জানা গেছে। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে এই মূর্তির টুকরোগুলোকে নিয়ে ব্যবসা করা হচ্ছে।
আমি খবরটা হজম করার চেষ্টা করছি এমন সময় ফেলুদা গন্তীর গলায় বলল, যদ্দূর মনে হয়-অক্টোপাস একটাই। তার শুড়গুলো ভারতবর্ষের এদিক-ওদিকে ছড়িয়ে এ-মন্দির ও-মন্দির থেকে মূর্তি সরাচ্ছে। যে-কোনও একটা গুঁড়কে জখম করতে পারলেই সমস্ত শরীরটা ধড়ফড় করে উঠবে। এই জখম করাটাই হবে আমাদের লক্ষ্য।
 
৪৫২ নং লাইন:
বম্ব? আমি আর ফেলুদা একসঙ্গে প্রশ্ন করে উঠলাম। কথাটা বিশ্বাস হচ্ছিল না।
বম্ব টু বোমা।
লালমোহনবাবু তাঁর সুটকেসের দিকে এগিয়ে গেছেন। —আমাদের পাড়ার দ্বিজেন তরফদারের ছেলে উৎপল আর্মিতে আছে। সে মার্চ মাসে এসেছিল। এইটে আমায় এনে দিয়ে বললে-কাকাবাবু দেখুন। আপনার জন্য কী এনিচি! বড় বড় যুদ্ধে ব্যবহার হয়। –ছোঁড়া আমার লেখার খুব ভক্ত। একটা মাঝারি সাইজের টর্চলাইটের মতো লম্বা খয়েরি রঙের একটা বেশ ভারী পাইপ জাতীয় জিনিস লালমোহনবাবু সুটকেস থেকে বের করে ফেলুদার হাতে দিলেন। ফেলুদা সেটা কিছুক্ষণ নেড়ে-চেড়ে দেখে বলল, এটা আমার কাছেই থাক। আপনার পক্ষে জিনিসটা বড় বেশি ডেঞ্জারাস। কত মেটাগন হবে বলুন তো? কথাটা আসলে মেগাটন, আর সেটা ব্যবহার হয় অ্যাটমবোমা সম্পর্কে। এক মেগাটন মানে দশ লক্ষ টন। ফেলুদা লালমোহনবাবুর প্রশ্নে কান না দিয়ে বামাটা ঝোলায় পুরে বলল, একবার বেরোনো দরকার। সবাই বেরিয়েছে, আমাদের ঘরে বসে থাকার কোনও মানে হয় না। ডাক বাংলো থেকে যখন বেরোলাম তখন সাড়ে এগারোটা। বিক্সিটা এখনও ডাকছে। চাঁদের আলো কমছে-বাড়ছে, কারণ আকাশ টুকরো টুকরো চলন্ত মেঘে ছেয়ে গেছে। গেস্ট হাউসের একটা ঘরে দেখলাম আলো জুলছে। সেটা নাকি সেই আমেরিকগনের ঘর; কে কোন ঘরে থাকে সেটাও নাকি ফেলুদা ম্যানেজারের কাছ থেকে জেনে নিয়েছে। মল্লিক আর শুভঙ্কর ফিরেছে কি না বোঝা গেল না। কিছুক্ষণ থেকেই ঘন ঘন মেঘ ডাকছিল; যখন বড় রাস্তার উপর এসে পড়েছি তখন একটা বড়ুরকম গর্জন শুনে আকাশের দিকে চেয়ে দেখি পুব দিকটা কালো হয়ে আসছে। এই মরেছে। বৃষ্টি আসবে নাকি? বলে উঠলেন লালমোহনবাবু! এত গুহা থাকতে বৃষ্টি এলে আশ্রয়ের অভাব হবে না, বলল ফেলুদা। কৈলাসের দিকে উঠে গিয়ে মন্দিরে ঢোকার কোনও চেষ্টা না করে ফেলুদা বা দিকের পথ ধরল। কিন্তু সে পথেও বেশি দূর না। খানিকটা গিয়েই সে দেখি পথ ছেড়ে পাহাড়ের গা বেয়ে উপরে উঠতে আরম্ভ করেছে। ওর কায়দাকানুন একটু আধটু জানি বলে আন্দাজ করলাম যে সামনের দিক দিয়ে ছাড়া গুহায় ঢ়োকার কোনও রাস্তা আছে কি না সেটাই ও একটু ঘুরে দেখতে চাইছে। আশেপাশে ঝোপঝাড় আর পাথরের টুকরো, কিন্তু এখনও চাঁদের আলো থাকায় সেগুলো কোনও বাধার সৃষ্টি করছে না। এইবার ফেলুদা ডান দিকে মোড় নিল। বুঝলাম য়ে-দিক থেকে এসেছি সেদিকেই ফিরে যাচ্ছি, কিন্তু রাস্তা দিয়ে নয়; পাহাড়ের গা দিয়ে-রাস্তা থেকে অনেকটা ওপরে। খানিকটা গিয়েই ফেলুদা হঠাৎ থেমে গেল। তার দৃষ্টি ডান দিকে। আমরা থেমে সেইদিকে দেখলাম। দূরে পশ্চিম দিকে ঠিক যেন মনে হচ্ছে জমির উপর একটা সিস্কের ফিতে বিছিয়ে রাখা হয়েছে। আসলে সেটা শহরে যাবার রাস্তা, চাঁদের আলোয় চিক চিক করছে। সেই রাস্তা দিয়ে একজন লোক দ্রুত পায়ে হেঁটে চলেছে গেস্ট হাউসের দিকে। অথবা বাংলোর দিকে। কারণ রাস্তা একটাই। মিস্টার রক্ষিত নন, ফিসফিস করে বললেন লালমোহনবাবু। কী করে বুঝলেন? চাপা গলায় জিজ্ঞেস করল ফেলুদা। রক্ষিতের গায়ে রেনকোট ছিল। কথাটা ঠিকই বলেছেন লালমোহনবাবু। লোকটা একটা মোড় ঘুরে অদৃশ্য হয়ে গেল। আমরা আবার এগিয়ে চললাম। খস্‌স্‌…খস্‌স্‌…খস্‌স্‌…খস্‌স্‌… একটা অদ্ভুত আওয়াজ শুনে আমরা তিনজন আবার থেমে গেলাম। কোথেকে আসছে অ্যাওয়াজটা? ফেলুদা বসে পড়ল। আমরাও। সামনে একটা প্রকাণ্ড মনসার ঝোপ। সেটা আমাদের আড়াল করে রেখেছে। আওয়াজটা আরও কিছুক্ষণ চলে থামল। তারপর সব চুপ। এ কী-চারদিক হঠাৎ অন্ধকার হয়ে গেল কেন? আকাশের দিকে চেয়ে দেখি সেই কালো মেঘট চাঁদটাকে ঢেকে ফেলেছে। আমরা ঝোপের পিছন থেকে বেরিয়ে এগিয়ে চললাম। খানিকটা হাঁটার পর ডানদিকে কৈলাসের খাদটা পড়ল। খাদের পাশেই…ওঁই যে মন্দির। মন্দিরের চূড়ো এখন আমাদের সঙ্গে সমান লেভেলে। চূড়োর পিছনে বেশ খানিকটা নিচুতে একটা ছাত—তার মাথায় চারটে সিংহ চারিদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। ওই যে নীচে দূরে হাতি দুটো দেখা যাচ্ছে। আমরা আরও এগিয়ে চললাম। আওয়াজটা এদিক থেকেই এসেছে সেটা বুঝেছিলাম, কিন্তু সন্দেহজনক কিছুই চোখে পড়ল না। হয়তো আছে, অন্ধকার বলে দেখা যাচ্ছে না। আমি জানি ফেলুদা টর্চ জ্বালাবে না, কারণ তা হলে অন্য লোক আমাদের কথা জেনে যাবে। কৈলাসের খাদের পর কিছু দূর গিয়ে আরেকটা খাদ। এটা পনেরো নম্বর গুহা। সেটা ছাড়িয়ে তার পরের গুহাটার দিকে এসেছি। এমন সময় ফেলুদা হঠাৎ থেমে টান হয়ে গেল। তারপর ফিসফিস কথা– টর্চ জ্বেলেছে। পনেরো নম্বর গুহার ভিতরে। তার ফলে গুহার বাইরের আলোটা একটু বেড়েছে। আমি ব্যাপারটা লক্ষ করিনি। লালমোহনবাবুও না। ফেলুদার চোখই আলাদা। দু মিনিট প্রায় নিশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপর ফেলুদা একটা ব্যাপার করল। একটা ছোট্ট নুড়ি পাথর কুড়িয়ে নিয়ে সেটাকে ওপর থেকে গুহার সামনের চাতালটায় ফেলল। টুপ করে একটা শব্দ পেলাম। তারপর বুঝতে পারলাম চাতালটা হঠাৎ যেন আরও বেশি অন্ধকার হয়ে গেল। তার মানে টৰ্চটা নিভল। আর তার পরেই একটা লোক নিঃশব্দে চোরের মতো গুহা থেকে বেরিয়ে পালিয়ে গেল। মিস্টার রক্ষিত না, আবার ফিসফিস করে বললেন লালমোহনবাবু। লোকটাকে চিনতে না পারলেও, তার গায়ে যে রেনকোট নেই সেটা আমিও বুঝেছিলাম। এরপর এল আমার জীবনের সবচেয়ে লোমখাড়া করা সময়। ফেলুদা ইতিমধ্যে নীচে যাবার একটা রাস্তা বার করে ফেলেছে। রাস্তা না বলে বোধ হয় উপায় বলা উচিত। খানিকটা লাফিয়ে, খানিকটা হামাগুড়ি দিয়ে, খানিকটা বাঁদরের মতো ঝুলে, খানিকটা মাটির উপর ঘষটে, সে দেখতে দেখতে নীচে গুহার সামনেটায় পৌঁছে গেল। লালমোহনবাবু চাপা। গলায় বললেন, গোয়েন্দাগিরিতে ফেল করলে সাকাসের চাকরি বাঁধা। পরমুহূর্তেই দেখলাম সে অদৃশ্য হয়ে গেল। তার মানে গুহার ভিতর ঢুকেছে। আমার কিন্তু ঘাম ছুটে লোমটোম খাড়া হয়ে গেছে। প্রায় তিন মিনিট (মনে হচ্ছিল তিন ঘণ্টা) পরে আবার দেখতে পেলাম ফেলুদাকে। তারপর আরম্ভ হল উলটো কসরত। উপর থেকে নীচের বদলে নীচের থেকে উপরে। এক হাতে টর্চ কাঁধে ব্যাগ আর কোমরে রিভলভার নিয়ে কীভাবে এরকম ওঠা নামা সম্ভব তা ও-ই জানে। উপরে উঠে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, এটার নাম দশাবতার গুহা। দোতলা। দুন্দর্যন্ত সব মূর্তি আছে। লোভনীয়। লোকটা কে ছিল বুঝলে?-ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম। ফেলুদার মুখ গভীর হয়ে গেল! বলল, যত সহজ ভাবছিলাম, তা নয়। পাঁচ আছে। রহস্য আছে। মাথা খাটাতে হবে। পাহাড় থেকে নেমে এসে বুঝলাম তদন্ত এখনও শেষ হয়নি। ফেলুদা কৈলাসের সামনে গিয়ে পাহারাদারের সঙ্গে দেখা করল। তাকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল সে গত ঘণ্টাখানেকের মধ্যে কোনও গোলমেলে ব্যাপার লক্ষ করেনি। অবিশ্যি ও যেখানে পায়চারি করছে সেখান থেকে খাদের উপরটা দেখা যায় না; মন্দিরের চূড়োয় ঢাকা পড়ে। কোনও শব্দ-টব্দ শোনোনি?-ফেলুদা হিন্দিতে জিজ্ঞেস করল। না, শব্দও শোনেনি। এমনিতেই মেঘ ডাকছে ঘন ঘন, শব্দ কী করে শুনবে? একবার মন্দিরের ভেতরে ঢুকে দেখতে পারি? জানতাম লোকটা না বলবে, আর বললেও তাই। নেহি বাবু, অর্ডার নেহি হ্যায়। ফেরার পথে বাংলোর কাছাকাছি এসে একটা অদ্ভুত জিনিস দেখলাম। আমরা আসছিলাম পুব দিক দিয়ে। বাংলোর পুব দিকের দেয়ালে দুটো জানালা রয়েছে-একটা রক্ষিতের ঘরের, একটা ফেলুদার ঘরের। ফেলুদার ঘরটা অন্ধকার। কিন্তু রক্ষিতের ঘরের ভেতর একটা আলোর তাণ্ডব চলেছে। বেশ বোঝা যাচ্ছে সেটা টর্চের আলো, কিন্তু সেটা কেন যে পাগলের মতো এদিক ওদিক করছে সেটা বোঝা মুশকিল। একবার আলোটা জানালার কাছে এল। বুঝলাম সেটা গেস্ট হাউসের দিকে ফেলা হচ্ছে। আলোটা ঝোপঝাড়ের উপর ঘোরাফেরা করে আবার ঘরে ফিরে গেল। ফেলুদা চাপা গলায় মন্তব্য করল, হাইলি ইন্টারেস্টিং। আমরা নিঃশব্দে এগিয়ে গেলাম বাংলোর দিকে। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়ছে। চারদিকে ঘুরাঘুট্টি অন্ধকার। আমি অনেক সময় দেখেছি যে আমাদের অ্যাডভেঞ্চারগুলো কখন যে কোন রাস্তায় চলবে সেটা আগে থেকে বোঝা ভারী মুশকিল হয়। কিছুদূর হয়তো আন্দাজ-মাফিক গেল, তারপর হঠাৎ এমন একটা ঘটনা ঘটল। যার জন্য রাস্তার মোড় গেল ঘুরে; ফেলুদার মাথা আশ্চর্য ঠাণ্ডা বলে ও বাধা পেলেও বা বেকায়দায় পড়লেও কখনও দিশেহারা হয় না। কিন্তু আজি একটা ব্যাপারে তাকে বেশ বিরক্ত হতে দেখলাম। কাল রাত্রে কৈলাসের ওপরে গিয়ে যে শব্দটা শুনেছিলাম, সে ব্যাপারে একটু তদন্তের দরকার বলে আমরা ঠিক করেছিলাম ভোরে ভোরেই কৈলাস চলে যাব। ফেলুদা রাত্রে মেক-আপ তুলে শুয়েছিল, আজ সকালে আমাদেরও আগে উঠে সে তৈরি হয়ে নিয়েছে, আর আমিও সিঁথিটা ডান দিকে করে নিয়েছি। লালমোহনবাবুও কোনও একটা কিছু মেক-আপ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ফেলুদা বারণ করাতে চুপ করে গেলেন। সূযোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে গুহাঁ খুলে যায়, লোক ঢুকে দেখতে পারে। সাড়ে পাঁচটায় চা খেয়ে বেরিয়ে ছাঁটার মধ্যে গুহায় পৌঁছে বাইরে বড় বড় গাড়ি আর লোকজনের ভিড় দেখে একেবারে তাজব বনে গেলাম। আরেকটু কাছে গিয়েই বুঝতে পারলাম ব্যাপারটা কী। ফিল্ম কোম্পানি এসেছে, কৈলাসে শুটিং হবে। একবার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সামনে শুটিং দেখেছিলাম, তখন রিফ্লেক্টর জিনিসটা দেখে চিনে রেখেছিলাম; এবারও সেই রিফ্লেক্টর দেখেই শুটিং-এর ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম। ফেলুদা বলল, সেরেছে—এরা আর জায়গা পেল না? শেষটায় কৈলাসের শ্ৰাদ্ধ করতে এসেছে? জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম যে দলটা বোম্বাই থেকে এসেছে, হিন্দি ফিল্মের শুটিং হচ্ছে। যারা অ্যাকটিং করবে তারা নাকি এখনও এসে পৌঁছয়নি, তবে অন্য সব কাজের লোক বেশির ভাগই এসে পড়েছে। একজন ইয়ং ছেলের প্যান্টের পকেট থেকে একটা বাংলা ফিল্ম পত্রিকার খানিকটা বেরিয়ে রয়েছে দেখে লালমোহনবাবু তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, কী বই হচ্ছে ভাই? ছেলেটি বলল, ক্রোড়পতি। কে কে পার্ট করতে? টপ কাস্টিং। এখানে আসছে রূপা, অৰ্জ্জুন মেরহাত্রা আর বলবন্ত চোপরা। হিরোইন, হিরো আর ভিলেন। অৰ্জ্জুনের নাম শুনেই বোধহয় লালমোহনবাবু হঠাৎ সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। জিজ্ঞেস করলেন, গান হবে নাকি ভাই? না। ফাইট। স্টান্টম্যান, ডাবল–সব এসেছে। হিরো ভিলেনকে চেজ করবে, ভিলেন গুহা থেকে মন্দিরের ভেতর ঢুকে যাবে। আর হিরোইন? হিরোইন সাইডের একটা কেভের মধ্যে রয়েছে। ওখানে ভিলেন ওকে অ্যাটাক করছে। হিরো এসে পড়ছে, ভিলেন পালাচ্ছে। ক্লাইম্যাক্স মন্দিরের চূড়োয়। চূড়োয়! চূড়োয়। পরিচালক কে? মোহন শর্মা। কিন্তু এই শুটিংটায় থাকছে ফাইট ড্রাইরেক্টর আপ্পারাও। আরও জিজ্ঞেস করে জানলাম যে শুটিং হতে হতে দশটা, আর দুপুরেই কাজ শেষ। তার মানে আজকের দিনটা এরাই কৈলাসটা দখল করে রাখবে। তাজ্জব ব্যাপার! ফেলুদা বলল।–এই পারমিশনটা পাওয়া কীভাবে সম্ভব হল জানতে ইচ্ছে করে। টাকায় কীই না করে। ভেতরে না ঢুকতে পারলেও কাল রাত্রে যেখানে পাহাড়ের উপরে খাদের পাশটায় গিয়েছিলাম, সেখানে যেতে আশা করি কোনও অসুবিধা নেই। তাই ভেবে কৈলাসের বাঁ দিক দিয়ে আমরা উপরে উঠতে লাগলাম। কিন্তু সে গুড়েও বালি! আমাদের আগেই ফিল্মের দলের কিছু লোক সেখানে হাজির হয়ে গেছে। তার মধ্যে একজন বোধহয় ক্যামেরাম্যান, কারণ সে ডান হাতের আঙুলগুলো ফুটাস্কোপের মতো করে চোখের সামনে পাকিয়ে ধরে মন্দিরের চুড়োর দিকে দেখছে। মন্দিরের ভিতর কিন্তু এখনও কোনও লোক ঢোকেনি। নীচে থাকতেই জেনেছিলাম। পারমিশনের চিঠিটা নাকি অন্য গাড়িতে আসছে। দারোয়ান যতক্ষণ না চিঠিটা দেখছে। ততক্ষণ কাউকে ভিতরে ঢুকতে দেবে না। ফেলুদা জিভ দিয়ে বিরক্তিসূচক একটা শব্দ করে বলল, সময় নষ্ট করে লাভ নেই। এরা আমাদের কাজটা পণ্ড করতেই এসেছে। চল, একবার পনেরো নম্বর গুহাটায় যাই।–ভাল মূর্তি আছে। এই উদাত্ত পরিবেশে ফিল্ম কোম্পানির কচকচ ভাল লাগছে না। আমরা যেদিক দিয়ে উঠেছিলাম তার উলটোদিক দিয়ে নেমে পনেরো নম্বর গুহার দিকে যাচ্ছি, এমন সময় দেখলাম মেন রোড দিয়ে একটা প্ৰকাণ্ড হলদে আমেরিকান গাড়ি কৈলাসের দিকে আসছে। বুঝলাম হিরো হিরোইন ভিলেন আর ফাইট ডাইরেক্টর এসে গেছেন। পনেরো নম্বর গুহাই হল দশাবতার গুহা। তার সামনে পৌঁছানোর আগেই দুই অবতারের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। একজন হলেন মিস্টার রক্ষিত, আর অন্যজন মিস্টার লুইসন। গুহার মুখটাতে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন দুজন, তার মধ্যে দ্বিতীয়টিকে বেশ উত্তেজিত বলে মনে হল। আমরা একটু এগিয়ে যেতেই কথা বন্ধ হয়ে গেল, আর আমেরিকানটি, আই সি নো · পয়েন্ট ইন মাই স্টেইং হিয়ার এনি লঙ্গার বলে আমাদের পাশ দিয়ে বেরিয়ে চলে গেলেন। মিস্টার রক্ষিত আমাদের দিকে এগিয়ে এসে ঘাড় ঝাঁকুনি দিয়ে তেতো হাসি হেসে বললেন, এখানকার অ্যারেঞ্জমেন্ট সম্বন্ধে কমপ্লেন করছিল। বলছে ডিমটা পর্যন্ত ঠিক করে ভাজতে জানে না, আর আশা করে যে আমরা এখানে এসে ডলার ঢেলে দিয়ে যাব। টাকার গরম আর কী! ফেলুদা বলল, আশ্চর্য তো। শুনেছিলাম আর্টের সমঝদার, আর এখানে এসে ডিম ভাজার কথাটাই মনে হল? রক্ষিত কী জানি একটা উত্তর দিতে গিয়ে আর দিতে পারলেন না। কৈলাসের দিক থেকে একটা বিকট চিৎকার এসে আমাদের সকলেরই পিলে চমকে দিয়েছে। লালমোহনবাবু পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে লাফিয়ে উঠে বললেন, ফাইট শুরু হয়ে গেছে মশাই! ভিলেন চ্যাঁচাচ্ছে! চিৎকারের পর আরও অন্য গলায় চোচামেচি শুরু হয়েছে। ফাইট হলে এত লোক চেচাবে কেন? আমরা ফেলুদার পিছন পিছন ব্যস্তভাবে কৈলাসের দিকে এগিয়ে গেলাম। এত ছুটোছুটি গোলমাল কীসের জন্য? যখন গেটের কাছাকাছি এসে গেছি তখন দেখলাম চার-পাঁচজন লোক চ্যাংদোলা করে একটি বেগুনি হাওয়াইয়ান শার্ট পরা লোককে হলদে গাড়িটার দিকে নিয়ে গেল। তারপর বেরিয়ে এল হিরো হিরোইন আর ভিলেন। এদের তিনজনেরই মুখ চেনা। রূপা অৰ্জ্জুনের কাঁধে ভর করে এগিয়ে আসছে, বলবন্ত তাদের পাশেই মাথা হেঁট করে রূপার কাঁধে একটা হাত দিয়ে যেন তাকে সাস্তুনা দিচ্ছে। এবারে সেই বাঙালি ছেলেটিকে দেখে আমরা চারজনেই তার দিকে এগিয়ে গেলাম। কী হয়েছে মশাই? লালমোহনবাবু প্রশ্ন করলেন। লাশ পড়ে আছে। মন্দিরের পেছন দিকে… হরিবল ব্যাপার…হাড়গোড় সব…. চ্যাংদোলা করে নিয়ে গেল কাকে? আপ্পারাও। উনিই প্রথম দেখলেন, আর দেখেই সেনসলেস। ফেলুদা আর মিস্টার রক্ষিত আগেই মন্দিরে ঢুকে গিয়েছিল। এবার আমরা দুজনও গেলাম; ফিল্মের লোকজন সব বেরিয়ে আসছে, বুঝলাম শুটিং আর হবে না। মন্দিরের বাঁ দিকের প্যাসেজ দিয়ে আমরা এগিয়ে চলেছি, ডানদিকে কৈলাসের নীচের দিকটায় সারি সারি হাতি আর সিংহের মূর্তি; মনে হয় তারাই যেন মন্দিরটাকে কাঁধে করে রয়েছে। সামনে মাড় ঘুরে ডান দিকে গিয়েই বাধহয় মৃতদেহ, কারণ সেখানে কিছু লোক দাঁড়িয়ে নীচের দিকে চেয়ে রয়েছে। আমরা পৌঁছানোর আগেই মিস্টার রক্ষিত ভিড় থেকে বেরিয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে এসে বললেন, ওদিকে যাবেন না। বিশ্ৰী ব্যাপার। আমারও যে খুব একটা যাবার ইচ্ছে ছিল তা নয়, কারণ এ ধরনের রক্তাক্ত দৃশ্য দেখতে ভাল লাগে না; তবু কে মারা গেছে জানার ভীষণ কৌতুহল হচ্ছিল। সে কৌতুহলটা মিটিয়ে দিল ফেলুদা। মিস্টার রক্ষিত চলে আসবার এক মিনিটের মধ্যেই ফেলুদাও ফিরে এসে বলল, শুভঙ্কর বোস। মনে হয় পাহাড়ের উপর থেকে সোজা পড়েছেন পাথরের মাটিতে। লালমোহনবাবু শুনলাম বিড়বিড় করে বলছেন, আশ্চর্য। ঠিক এইভাবেই মরবার কথা ঘনশ্যাম কর্কটের। ফেলুদা আবার বাইরের দিকে চলেছে, আমরা দুজন তাঁর পিছনে। মিস্টার রক্ষিত এগিয়ে গিয়েছিলেন, আমাদের আসতে দেখে থেমে বললেন, কাল রাত্রে যখন এদিকটায় বেড়াতে আসি, তখনই দেখলাম ভদ্রলোক পাহাড়ের উপর উঠছেন। আমি বারণ করেছিলাম। ভদ্রলোক আমার কথায় কানই দিলেন না। তখন কি জানি যে লোকটা আত্মহত্যা করতে যাচ্ছে? মিস্টার রক্ষিত চলে গেলেন। একটা নতুন কথা বলে গেলেন বটে। ভদ্রলোক। আত্মহত্যার কথাটা আমার মনেই হয়নি। ফেলুদা মিস্টার রক্ষিতের কথায় যেন আমল না। দিয়েই আবার কৈলাসের বাঁ দিক দিয়ে পাহাড়ে উঠতে আরম্ভ করল। আধঘণ্টা আগেই দেখেছিলাম খাদের পাশে লোকজন দাঁড়িয়ে আছে, এখন দেখছি একটি লোকও নেই। মনে মনে বললাম শুভঙ্কর বাস মরে গিয়ে আমাদের কাজের সুবিধে করে দিয়েছেন। ফেলুদা দেখলাম বেশ বেপরোয়াভাবে এগিয়ে গিয়ে খাদের ধারে দাঁড়িয়ে ঘাড় নিচু করে মন্দিরের পিছনে যেখানে মৃতদেহ পড়ে আছে সেখানটা দেখছে। যেখান থেকে পড়েছেন শুভঙ্কর বাস, সেই জায়গাটা আন্দাজ করে ও খাদের আশপাশটা খুব ভাল করে দেখতে লাগল। মাটিতে একটা গর্ত। লোক চলাচলে মাটি ঢুকে সেটা খানিকটা বুজে এসেছে, কিন্তু তাও ব্যাগ থেকে ভাঁজ করা স্কেলটা খুলে তার মধ্যে ঢোকাতে সেটা প্রায় দেড় হাত ভেতরে চলে গেল। গর্তটা খাদ থেকে হাত তিনেক দূরে। এবার ফেলুদা গর্তটার ঠিক সামনে খাদের ধারটা পরীক্ষা করতে লাগল। আমি আর লালমোহনবাবুও দেখছি আর বেশ বুঝতে পারছি কোন জিনিসটা ফেলুদার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। খাদের ধারের মাটির উপর একটা গভীর খাঁজ পড়েছে। কিছু বুঝতে পারছিস, তোপসে? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল। আমি চুপ করে আছি দেখে সে নিজেই উত্তর দিল— এটা দড়ির দাগ। একটা শাবল গোছের জিনিস গভীরভাবে পুঁতে সেটায় একটা দড়ি বেঁধে খাদের ভিতর ঝুলিয়ে সেটা ধরে কেউ নেমেছিল বা নামতে চেষ্টা করেছিল। কাল রাত্রে খস খসি শব্দটা মনে পড়ছে? সেটা ছিল দড়িটাকে টেনে তোলার শব্দ। সামনে দিয়ে ঢোকার উপায় নেই, তাই পিছন দিয়ে ঢোকার এই ব্যবস্থা। লালমোহনবাবু বললেন, কিন্তু দড়ি হলে…একশো ফুট.মানুষ ধরে নামবে…সে তো মোক্ষম দড়ি হতে হবে মশাই। নাইলনের দড়ি। হালকা, অথচ প্ৰচণ্ড শক্ত, বলল ফেলুদা। আমি বললাম, তার মানে তো শুভঙ্কর বোস ছাড়া আরেকজন লোক ছিল? ন্যাচারেলি। সেই লোকই দড়ি টেনে তুলেছে, সেই শাবল-দড়ি সরিয়ে ফেলেছে। সে শুভঙ্কর বোসের শত্রু বা মিত্র সেটা এখনও ষোলো আনা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না, তবে একটা কারণে শত্রু বলেই মনে হয়। আমরা ফেলুদার দিকে চাইলাম। ফেলুদা তার শার্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা ছোট্ট জিনিস বার করে হাতের তেলোয় ধরে আমাদের দেখাল। একটা ছেঁড়া কাপড়ের টুকরো। নীল রঙের কাপড়। কাল কাকে দেখেছি নীল শার্ট গায়ে? মিস্টার জয়ন্ত মল্লিক। কোথায় পেলে ওটা?—কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলাম। ফেলুদা বলল, উপূড় হয়ে পড়েছিল শুভঙ্কর বাস। হাত দুটো ছড়ানো। বাঁ হাতটা মুঠো অবস্থায়। দু আঙুলের মাঝখান দিয়ে টুকরোটা বেরিয়ে ছিল। দুজনে ধস্তাধস্তি হয় খাদের ধারে। শুভঙ্কর শার্ট খামচিয়ে ধরে। তারপর পড়ে যায়। টুকরোটা হাতে ছিঁড়ে আসে। ওপর থেকে ঠেলে ফেলে দিয়েছিল কি? লালমোহনবাবু প্রশ্ন করলেন। ত্‌তার মানে তো ম্‌-মাডার। ফেলুদা লালমোহনবাবুর কথায় কোনও মন্তব্য না করে গভীরভাবে বলল, একটা কথা বলতেই হবে—কৈলাস এখনও অক্ষত রয়েছে, আর সেটার জন্য দায়ী শুভঙ্কর বোস। তিনি মরলেন বলেই মূর্তি চারকে কাজ না সেরেই পালাতে হল। আর সেই সঙ্গে লালমোহনবাবুর ভবিষ্যদ্বাণীও ফলে গেল। কৈলাসে সত্যিই লাশ পাওয়া গেল! খাদের মাথা থেকে যখন নীচে নামলাম ততক্ষণে ফিল্ম কোম্পানির লোকেরা সরে পড়েছে। তার বদলে এখন স্থানীয় লোকের ভিড়। আর আমেরিকান গাড়ির বদলে রয়েছে একটা জিপ। একজন বছর পয়ত্ৰিশের স্মার্ট ভদ্রলোক ফেলুদাকে দেখে এগিয়ে এলেন। ইনিই নাকি মিস্টার কুলকার্নি-টুরিস্ট গেস্ট হাউসের ম্যানেজার। ফেলুদার সঙ্গে ইংরেজিতে কথা হল। ভদ্রলোক বললেন, কাল রাত্রে যে মিস্টার বোস ফেরেননি। সেটা আজ ভোরে জানা গেছে। একটি বেয়ারাকে পাঠিয়েছিলাম ওর খোঁজ করতে, সে না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে আসে। এখন কী ব্যবস্থা হচ্ছে? ফেলুদা প্রশ্ন করল। কুলকার্নি বললেন, আওরঙ্গাবাদে খবর পাঠানো হয়েছে। সি ডি ভ্যান আসছে, ডেডবডি মর্গে নিয়ে যাবে। মিস্টার বোসের ভাই আছেন দিল্লিতে। লাশ সনাক্ত করার ব্যাপারে তাকে খবর পাঠানো হচ্ছে। …ভেরি স্যাড! ভদ্রলোক সত্যিই পণ্ডিত ছিলেন। আগেও একবার এসেছিলেন—সিকসটি এইটে। গেস্ট হাউসেই ছিলেন। এলোরার ওপর বই লিখছিলেন। আপনাদের এখানে থানা নেই? একটা পুলিশ আউটপোস্ট আছে। ছোট জায়গা তো! একজন অ্যাসিসন্টান্ট সাব-ইনসাপেক্টর চার্জে আছেন। মিস্টার ঘোটে। আপাতত ডেডবডি ইনসাপেক্ট করছেন। আমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে পারেন? সার্টেনলি!…ভাল কথা— কুলকার্নি কী যেন একটা গোপনীয় কথা বলতে চাইছেন, কিন্তু আমরা দুজন বাইরের লোক রয়েছি বলে ইতস্তত করছেন। ফেলুদা বলল, আপনি এদের সামনে বলতে পারেন। কুলকার্নি আশ্বস্ত হয়ে বললেন, আজ সকালে বম্বেতে একটা ট্রাঙ্ক কল হয়েছে। মল্লিক? হ্যাঁ। কী বলল নোট করেছেন? কুলকার্নি পকেট থেকে একটা কাগজের স্লিপ বার করে সেটা থেকে পড়ে বললেন, মে বালু আচে। আজ রওয়ানা হচি। মেয়ে ভাল আছে, আজ রওনা হচ্ছি। আবার সেই মেয়ের ব্যাপার। যাবার কথা বলেছে কিছু? ফেলুদা চাপা উত্তেজনার সঙ্গে প্রশ্ন করল। কুলকার্নি বললেন, উনি তো আজই সকলে যেতে চাইছিলেন, কিন্তু আমি আপনার কথা ভেবেই একটা ফন্দি বার করে যাওয়াটা পিছিয়ে দিয়েছি। ওর ট্যাক্সির ড্রাইভারকে টিপে দিয়েছি। ডিফারেনসিয়াল গণ্ডগোল—গাড়ি সারাতে টাইম লাগবে। ব্রাভো! আপনি অত্যন্ত বুদ্ধিমানের কাজ করেছেন। ফেলুদার তারিফে কুলকার্নির চোখ খুশিতে জ্বলজ্বল করে উঠল। ফেলুদা একটা চারমিনার ধরিয়ে বলল, ভাল কথা-আপনার এই ঘোটে লোকটি কেমন? বেশ লোক। তবে মনমরা হয়ে থাকে। এ জায়গা তার ভাল লাগে না। কবে। প্রোমোশন হবে, আওরঙ্গাবাদে পোস্টেড হবে, তাই দিন গুনছে। …আসুন না, আলাপ করিয়ে দিই। মিস্টার ঘোটে কেভ থেকে বেরিয়ে এসেছেন, কাছাকাছির মধ্যেই ছিলেন, কুলকার্নি তাঁকে ডেকে এনে ফেলুদাকে বিখ্যাত প্রাইভেট ডিটেকটিভ বলে তাঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। ভদ্রলোক লম্বায় সাড়ে পাঁচ ফুট, চওড়াতেও প্রায় ততখানিই বলে মনে হয়, তার উপরে আবার চার্লি চ্যাপলিনের মতো গোঁফ। কিন্তু মোটা হলে কী হবে, হাঁটাচলা বেশ চটপটে। ঘোটের সঙ্গে কথা বলার আগে ফেলুদা আমাদের দিকে ফিরে বলল, তোরা বরং বাংলোয় ফিরে যা-আমি ভদ্রলোকের সঙ্গে একটু কথা বলে আসছি। কী আর করি। গেলাম ফিরে বাংলোয়। ভোরে শুধু চা খেয়ে বেরিয়েছিলাম, তাই বেশ খিদে পাচ্ছিল। বারান্দায় গিয়ে চৌকিদারকে হাঁক দিয়ে দুজনের জন্য ডিমরুটি করতে বলে দিলাম। ঘরে ফিরে এসে দেখি লালমোহনবাবু কেমন যেন বোকা বোকা ভাব করে খাটে বসে আছেন। আমার্কে দেখে বললেন, আমরা কি বেরোবার সময় ঘরের দরজা বন্ধ করে। গিয়েছিলাম? আমি বললাম, না তো। নেবার মতো কীই বা আছে বলুন! তা ছাড়া এরা তো সকালবেলা ঘর ঝাড়পোছ করে, তাই…কেন, কিছু হারিয়েছে নাকি? না, কিন্তু জিনিসপত্তর সব ওলট-পালট হয়ে আছে। আমার খাটে বসে আমার বাক্স ঘেঁটেছে। এই কিছুক্ষণ আগে। খাট এখনও গরম হয়ে আছে। তোমার বাক্সটা দেখো তো। সুটকেসটা খোলামাত্র বুঝতে পারলাম সেটা কেউ ঘাঁটাঘাঁটি করেছে। যেটা যেখানে ছিল সেটা সেখানে নেই। শুধু বাক্স না, বালিশ-টালিশও এদিক ওদিক হয়ে আছে। এমন কী থাটের তলাতেও যে খুঁজেছে সেটা আমার চটি জোড়া যেভাবে রাখা হয়েছে তার থেকে বুঝতে পারছি। লালমোহনবাবু বললেন, কীসের জন্য সবচেয়ে ভয় ছিল জান? আমার নেটবুকটা। সেটা দেখছি নেয়নি। অন্য কিছু নিয়েছে নাকি? কই, কিছুই তো নিয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। তোমার? আমারও তাই। কিছুই নেয়নি। যে এসেছিল সে বিশেষ কোনও একটা জিনিস খুঁজতে এসেছিল। সেটা পায়নি। একবার চৌকিদারকে জিজ্ঞেস করলে হয় না? কিন্তু চৌকিদারকে জিজ্ঞেস করে কোনও ফল হল না। সে বাজার করতে গিয়েছিল, তখন যদি কেউ এসে থাকে। এখানে কোনওদিন কিছু চুরিটুরি যায় না, কাজেই বাইরের লোক এসে ঘরে ঢুকে জিনিসপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে যাবে এটা তার কাছে খুবই আশ্চর্য লাগল। হঠাৎ মনে হল ফেলুদার ঘরে লোক ঢুকেছিল কি না জানা দরকার। গিয়ে দেখি ফেলুদা দরজা লক করে গেছে। সেটার অবিশ্যি একটা কারণ আছে। ও নিজে ছদ্মবেশে রয়েছে বলে ওর একটু সাবধান হতে হয়। লালমোহনবাবু বললেন, একবার মিস্টার রক্ষিতকে জিজ্ঞেস করবে নাকি? কাল–রাত্রে জানাল দিয়ে টর্চের খেলা দেখে আমার এমনিই রক্ষিত সম্বন্ধে একটা কৌতূহল হচ্ছিল, তাই লালমোহনবাবুর প্রস্তাবটা মেনে নিয়ে দুজনে ভদ্রলোকের দরজায় গিয়ে আস্তে করে টাকা মারলাম। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই দরজা খুলে গেল। কী ব্যাপার? ভেতরে এসে। ভদ্রলোক যে খুব একটা খুশি খুশি ভাব দেখালেন তা নয়; তাও যখন ডাকছেন তখন গেলাম। আপনার ঘরেও কি লোক ঢুকেছিল? লালমোহনবাবু ঢুকেই প্রশ্ন করলেন। ভদ্রলোক লালমোহনবাবুর দিকে তাকাতেই বুঝলাম ভাবগতিক ভাল না। চাপা অথচ ঝাঁঝালো গলায় বললেন, আপনাকে বলে তো লাভ নেই, কারণ আপনি কানে শোনেন না, কাজেই আপনার ভাগনেটিকেই বলছি। —লোক শুধু ঢোকেনি, আমার একটি অত্যন্ত কাজের জিনিস সযত্নে তুলে নিয়ে গেছে। কী জিনিস? আমি ভয়ে ভায়ে জিজ্ঞেস করলাম। আমার রেনকোট। বিলিতি রেনকোট। আজ পঁচিশ বছর ধরে ব্যবহার করছি। মেজোমামা চুপ। কালা সেজে আছেন। আমি খুব জোরে চেঁচিয়ে তাকে খবরটা দিয়ে দিলাম। লালমোহনবাবু বললেন, কাল রাত্রে নিয়েছিল কি? কাল দেখলুম। আপনি কী যেন খুঁজছেন। আপনার টর্চটা… না। কাল রাত্রে একটা চামচিকে ঘরে ঢুকেছিল। বাতি নিভিয়ে টর্চ জেলে সেটাকে তাড়াতে চেষ্টা করছিলুম। কাল আমার কোনও জিনিস খোয়া যায়নি। গেছে আজ। সকালে। আর আমার ধারণা সেটা নিয়েছে চৌকিদারের ওই ছেলেটা। এ কথাটাও চেঁচিয়ে মেজোমামাকে শুনিয়ে দিলাম। উনি বললেন, শুনে দুঃখিত হলাম। ছেলেটির দিকে চোখ রাখতে হয় এবার থেকে। এর পরে আর কিছু বলার নেই। আমরা ভদ্রলোককে ডিসটর্ব করার জন্য ক্ষমা চেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। চৌকিদার ডিমরুটি এনে দিয়েছিল, দুজনে খাবার ঘরে বসে খেলাম। আমেরিকায় ডিম কী করে ভজে জানি না, আমাদের এই খুলদাবাদের ডিম ফ্রাই বেশ ভালই লাগছিল। ঘরে কে ঢুকে থাকতে পারে সেটা ভাবতে মনটা খচা খচা করছিল, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সেটা হয়তো সত্যিই চৌকিদারের ওই ছেলেটা! ও মাঝে মাঝে বাংলোর পশ্চিমদিকের মাঠাঁটায় পায়চারি করে, আর পদার ফাঁক দিয়ে আমাদের দিকে আড়চোখে দেখে, সেটা লক্ষ করেছি। যদিও ফেলুদা বাংলোয় ফিরে যেতে বলেছিল, তার মানে যে ঘরেই বসে থাকতে হবে এমন কোনও কথা আছে কি? চাবি দিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে আমরা বাংলোর বাইরে রাস্তায় এলাম। বাংলোর ঠিক সামনে থেকে গেস্ট হাউসটা দেখা যায় না, একটা অচেনা গাছ সামনে পড়ে। গাড়ি স্টার্ট দেবার একটা শব্দ পেয়ে একটু এগিয়ে গেলাম। এবার গেস্ট হাউসটা দেখা যাচ্ছে। আওরঙ্গাবাদ থেকে যে ট্যাক্সিটা মিস্টার রক্ষিত আর লুইসনকে নিয়ে এসেছিল, সেটা যাবার জন্য তৈরি, ছাতের উপর মাল চাপানো রয়েছে, আমেরিকান ক্রোড়পতি মিস্টার স্যাম ল্যুইসন বেয়ারাকে বকশিশ দিচ্ছেন। কিন্তু ইনি আবার কে? আরেকটি লোক গেস্ট হাউস থেকে বেরিয়ে এসেছেন, লুইসনের সঙ্গে হাত নেড়ে কথা বলছেন। লুইসন দুবার মাথা নাড়ল। তার মানে কোনও একটা প্রস্তাবে রাজি হল। এবার অন্য ভদ্রলোকটি আরার গেস্ট হাউসে ঢুকে একটা সুটকেস হাতে নিয়ে বেরোলেন। ড্রাইভার গাড়ির পিছনের ডালা খুলে দিল। বাক্স ভিতরে ঢুকে গেল। ডালা বন্ধ হল। আমার বুকের ভিতর ভীষণ ধুকপুকুনি। লালমোহনবাবু আমার হাত খামচে ধরলেন। জয়ন্ত মক্সিক নিজের গাড়ির জন্য অপেক্ষা না করে আমেরিকানের সঙ্গ নিয়ে পালাচ্ছেন। ড্রাইভার তার জায়গায় গিয়ে বসল। চৌকিদারের সাইকেল?-আমি চেঁচিয়ে উঠলাম। ট্যাক্সি স্টার্ট দেবার শব্দ পেলাম। আমি ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে গিয়ে কোনও রকমে টেনে হিঁচড়ে সাইকেলটাকে বাইরে আনলাম। উঠে পড়ুন। লালমোহনবাবুর ভাব দেখে মনে হল তিনি জীবনে এই প্রথম সাইকেলের পিছনে চাপলেন। আমি জানি অন্য সময় হলে চাপতেন না-কিন্তু অপরাধী পালিয়ে যাচ্ছে, এ ছাড়া গতি নেই। ট্যাক্সি বেরিয়ে চলে গেছে। আমি প্ৰাণপণে পোডাল করে চলেছি। জটায়ু আমার কোমর খামচে ধরেছেন। সাত বছর বয়সে সাইকেল চালাতে শিখেছি। ফেলুদাই শিখিয়েছিল। অ্যাদ্দিনে সেটা কাজে দিল। বিশ মিনিটের পথ পাঁচ মিনিটে পৌঁছে গেলাম। ওই যে ফেলুদা-ওই যে ঘোটে, কুলকার্নি। ফেলুদা! মিস্টার মল্লিক পালিয়েছেন-সেই আমেরিকানের ট্যাক্সিতে-এই পাঁচ মিনিট আগে? এই একটা খবরের দরুন কয়েক মুহূর্তের মধ্যে এত রকম ঘটনা ঘটে গেল যে, এখনও ভাবতে মাথা ভোঁ ভোঁ করে। জিপিও যে ইচ্ছে করলে ঘণ্টায় ষাট মাইল স্পিড়ে ছুটতে পারে সেটা এই প্রথম জানলাম। আমি আর জটায়ু পিছনে ঘাপটি মেরে বসে আছি, সামনে ড্রাইভারের পাশে ঘোটে আর ফেলুদা, দেখতে দেখতে ট্যাক্সি কাছে চলে আসছে, তারপর হর্ন দিতে দিতে সেটাকে ছাড়িয়ে এগিয়ে গিয়ে থামল, ক্রোড়পতি লুইসনের চোখরাঙনি আর ১ বাছাই বাছাই মার্কিনি গালির বিস্ফোরণ, আর তারই মধ্যে মল্লিকের ফ্যাকাসে মুখ, একবার বাধা দিতে গিয়ে কেঁচো হয়ে যাওয়া, আর তারপর ঘোটে তার সুটকেস খুলল, আর তা থেকে টার্কিশ টাওয়েলের প্যাঁচ খুলে বেরোল যক্ষীর মাথা, আর লালমোহনবাবুর হাফ ছেড়ে বলা এন্ডস ওয়েল দ্যাট অলস ওয়েল, আর লুইসনের হা হয়ে যাওয়া আর দুবার বাট…বাট বলা, আর সবশেষে লুইসন ট্যাক্সি করে আওরঙ্গাবাদ, আর আমরা বামাল সমেত চোর গ্রেপ্তার করে খুলদাবাদ। মল্লিক অবিশ্যি এখন ঘোটের জিম্মায়। অৰ্থাৎ তিনি এখন খুলদাবাদ পুলিশ আউটপোস্টের বাসিন্দা। ভদ্রলোক এত হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন যে, কোনও কথাই বলতে পারেননি। ঘোটে আমাদের গেস্ট হাউসে নামিয়ে দিলেন, কারণ কুলকার্নি ওখানে উৎসুক হয়ে অপেক্ষা করছিলেন। মিশন সাকসেসফুল শুনে কুলকার্নি অবিশ্যি দারুণ খুশি হলেন, কিন্তু ফেলুদা যেন তার উৎসাহে খানিকটা ঠাণ্ডা জল ঢেলেই বলল যে, এখনও কাজ বাকি আছে। -আর তা ছাড়া আপনি বম্বের ওই নাম্বারটা নিয়ে কিন্তু এনকোয়ারিটা করবেন, আর খবর পেলেই আমাকে জানাবেন। শেষের ইনস্ট্রাকশনটার ঠিক মানে বোঝা গেল না, তবে এটা নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনও প্রয়োজন আছে বলেও মনে হল না। কুলকার্নি সকলের জন্য কফি বলেছিলেন, সেটা খেতে খেতে হঠাৎ মনে পড়লে আমাদের ঘরে যে লোক ঢুকে জিনিসপত্তর ঘাঁটাঘাঁটি করেছে, আর রক্ষিতের ঘর থেকে রেনকোট চুরি গেছে, সে খবরটা ফেলুদাকে দেওয়া হয়নি। সেটা ওকে বলতে ও কয়েক মুহূর্ত ভুকুটি করে ভাবল। তারপর কুলকার্নিকে জিজ্ঞেস করল চৌকিদার লোকটি কেমন। কে, মোহনলাল? ভেরি গুড ম্যান। সতেরো বছর চৌকিদারি করছে, কোনও দিন কেউ কমপ্লেন করেনি। ফেলুদা আরেকটু ভেবে বলল, কোনও জিনিস নেয়নি বলছিস? আমি বেশ জোরের সঙ্গে মাথা নেড়ে না বললাম, আর সেই সঙ্গে এটাও বললাম যে রক্ষিত চৌকিদারের ছেলেকে সন্দেহ করছে। চলুন, লালমোহনবাবু-আপনি বলছেন লোকটা আপনার খাটে বসে খাট গরম করে দিয়েছিল—আপনার বাক্সে কী আছে একবার দেখে আসি; আমরা চলি, মিস্টার কুলকার্নি। এটা আপাতত আপনার জিন্মাতেই থাক। তোয়ালেতে মোড়া যক্ষীর মাথাটা ফেলুদা কুলকার্নিকে দিয়ে দিল। তিনি সেটা তাঁর আপিসের সিন্দুকে ঢুকিয়ে দিয়ে তাতে চাবি দিয়ে দিলেন। ফেলুদা বলে এল সে অল্পক্ষণের মধ্যেই ফিরবে। বাংলোয় এসে আমাদের ঘরের দরজা বন্ধ করে ফেলুদা আমার আর লালমোহনবাবুর জিনিস খুব ভাল করে ঘেঁটে দেখল। জামাকাপড় ছাড়া লালমোহনবাবুর সুটকেসে যা ছিল তা হল একটা হামিওপ্যাথিক ওষুধের বাক্স, দু খণ্ড অপরাধ-বিজ্ঞান, তাঁর নোটবুক, আর বেলুচিস্তানের বিষয়ে একটা ইংরেজি বই। নোটবুকটা ফেলুদা এতক্ষণ ধরে উলটে পালটে দেখল কেন সেটা বুঝতে পারলাম না। সব দেখাটেখা হয়ে গেলে বলল, যা আন্দাজ করছি তা যদি ঠিক হয়, তা হলে এসপার ওসপার যা হবার আজই হবে। আর তাই যদি হয়, তা হলে মনে হচ্ছে তোদের একটা জরুরি ভূমিকা নিতে হবে। সব সময় মনে রাখবি যে আমি আছি পেছনে, ভয়ের কিছু নেই। মল্লিকের অ্যারেস্টের কথা কাউকে বলবি না, এখন ঘর থেকে বেরোবি না। এমনিতেও হয়তো বেরোতে পারবি না, কারণ, মনে হয় বৃষ্টি আসছে। ফেলুদা কথাগুলো বলতে বলতে জানালার দিকে মুখ ফিরিয়েছিল, এখন দেখলাম ও নিঃশব্দে হেঁটে জানালার কাছটায় গিয়ে দাঁড়াল! আমারও চোখ গেল জানালার দিকে। এটা পশ্চিম দিক। এদিকে খানিক দূর ঘাস জমির পরে কতগুলো বড় বড় গাছ, তার মধ্যে ইউক্যালিপটাস গাছটা আমার চেনা। একজন লোককে গাছপালার পিছন থেকে বেরিয়ে এসে ঘাস পেরিয়ে আমাদের বাংলোর সামনের দিকে চলে আসতে দেখলাম। তার এক মিনিট পরেই লোকটা আমাদের খাবার ঘরে এসে ঢুকল, আর তার পরেই একটা দরজা চাবি দিয়ে খোলা, আর তারপর সেটাকে ভিতর থেকে বন্ধ করার শব্দ পেলাম। ফেলুদা দুবার মাথা নেড়ে চাপা গলায় বলল-ঠিক আছে, ঠিক আছে। লোকটা আর কেউ নন-আমাদের প্রতিবেশী মিস্টার রক্ষিত। আমার কাছ থেকে সময় মতো নির্দেশ পাধি, সেই অনুযায়ী কাজ করবি। এই শেষ কথাটুকু বলে ফেলুদা ঘর থেকে বেরিয়ে চলে গেল। আমরা দুজনে ঘরে বসে রইলাম। বাইরে মেঘের গর্জন শোনা যাচ্ছে। বাধহয় কালো মেঘে। সূৰ্যটা ঢেকে দিয়েছে বলে আলো কমে এসেছে। বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ কেন জানি মনে হল যে, মিস্টার রক্ষিতের চেয়ে বেশি। রহস্যময় লোক আর কেউ নেই, কারণ ওর সম্বন্ধে আমরা প্রায় কিছুই জানতে পারিনি। আর মল্লিক? মল্লিক, সম্বন্ধেও কি সব জেনে ফেলেছি? জানি না। হঠাৎ মনে হচ্ছে কিছুই জানি না। মনে হচ্ছে যে অন্ধকারে ছিলাম, এখনও সেই অন্ধকারেই আছি। বারোটার পর থেকেই তুমুল বৃষ্টি শুরু হল, আর তার সঙ্গে মেঘের গর্জন। ফেলুদা বলে গেছে আজকেই ক্লাইম্যাক্স, আর তাতে আমাদের হয়তো একটা ভূমিকা নিতে হবে। আমার কাছে সবই অন্ধকার, লালমোহনবাবুর কাছেও তাই। কাজেই ভূমিকাটা যে কী হতে পারে সেটা ভেবে কোনও লাভ নেই। মল্লিক অ্যারেস্টেড, যক্ষীর মাথা সিন্দুকে বন্দি, এর পরেও যে আর কী ঘটনা থাকতে পারে সেটা ভেবে বার করার সাধ্যি আমাদের নেই। একটার সময় চৌকিদার এসে বলল খান তৈয়ার হ্যাঁয়। ফেলুদাকে ছাড়াই খেতে গেলাম। সে নিশ্চয়ই গেস্ট হাউসের বাবুর্চির রান্না খাচ্ছে। আমরা দুজনে টেবিলে বসার কয়েক মিনিটের মধ্যেই মিস্টার রক্ষিতও এসে পড়লেন। সকালে তাকে গোমড়া মনে হচ্ছিল, এখন দেখছি বেশ স্বাভাবিক মেজাজ। বললেন, এমন দিনে চাই খিচুড়ি। বাংলাদেশের খিচুড়ি কি আর এরা করতে জানে? সঙ্গে ইলিশ মাছ ভাজা, ডিমের বড়া, বেগুনি.এ খাওয়ার জুড়ি নেই। এলাহাবাদেও আমি বাংলাদেশের অভ্যাস ছাড়িনি। ভদ্রলোক যে খেতে ভালবাসেন সেটা বেশ বোঝা যায়। লালমোহনবাবুও তাঁর চেহারার অনুপাতে ভালই খান, তবে এখানের চালে কাঁকরটা তাঁর একেবারেই বরদাস্ত হচ্ছে না। দাঁতে পড়লেই এমন ভাব করছেন যেন মাথায় বাজ পড়ল। ডালটা শেষ করে যখন মাংসটা পাতে ঢেলেছি তখন একটা গাড়ির আওয়াজ পেলাম। আর তারপরেই খ্যানখ্যানে গলায় চৌকিদার বলে একটা হাঁক। চৌকিদার ব্যস্তভাবে একটা ছাতা নিয়ে বাইরে চলে গেল। মিস্টার রক্ষিত হাতের রুটিতে মাংস পুরে মুখে দিয়ে বললেন, এই দুযোগের দিনে আবার টুরিস্ট। সাদা গোঁফ সাদা ফ্রেঞ্চকটি দাড়িওয়ালা চশমা পরা একজন ভদ্রলোক ক্ষতি খুলতে খুলতে ভেতরে এসে ঢুকলেন। পিছনে চৌকিদার, তার হাতে কুমিরের চামড়ার, একটা আদ্যিকালের সুটকেস। ভদ্রলোক হিন্দিতে বলে দিলেন তিনি লাঞ্চ করে এসেছেন, তার জন্যে আর কোনও হাঙ্গাম করতে হবে না। তারপর আমাদের দিকে ফিরে বাংলায় বললেন, কাকে নাকি অ্যারেস্ট করেছে শুনলাম? ফেলুদার বারণ, তাই আমরা বোকার মতো চুপ করে রইলাম। রক্ষিত যেন একটু অবাক হয়েই বললেন, কাকে? কখন? সাম ভ্যান্ডাল। গুহার ভেতর থেকে মূর্তির মুণ্ডু ভেঙে নিচ্ছিল-ধরা পড়েছে। অ্যাদ্দূর এসে যদি দেখি কেভে ঢুকতে দিচ্ছে না তা হলেই তো চিত্তির। আপনারা এখনও কিছু শোনেননি? রক্ষিত বললেন, এখনও খবরটা এসে পৌঁছয়নি বাংলোয়। এনিওয়ে-ধরা যে পড়েছে সেইটেই বড় কথা। এখানকার পুলিশের এলেম আছে বলতে হবে। ভদ্রলোক তাঁর ঘরে ঢুকে যাবার বেশ কিছুক্ষণ পর অবধি শুনলাম। তিনি আপন মনে বকবক করছেন। ছিটগ্ৰস্ত। আড়াইটে নাগাদ বৃষ্টি থামল। তিনটের কিছু পরে পশ্চিমের জানালা দিয়ে দেখলাম সেই ফ্রেঞ্চকটি দাড়ি দূরের ইউক্যালিপটাস গাছটার দিকে যাচ্ছে। পাঁচ মিনিট পরে দেখলাম তিনি ফিরে আসছেন। প্রায় সাড়ে চারটের সময় যখন চা নিয়ে এল তখন হঠাৎ খেয়াল করলাম যে দরজার সামনে মেঝেতে একটা ভাঁজ করা সাদা কাগজ পড়ে আছে। খুলে দেখলাম সেটা ফেলুদার মেসেজ– পনেরো নম্বর গুহায় যাবি সন্ধ্যা সাতটায়। দোতলায় দক্ষিণ-পূর্ব কোণে অপেক্ষা করবি। ফেলুদা নেপথ্যে থেকে ক্যামপেন চালিয়ে যাচ্ছে। এ এক নতুন ব্যাপার বটে। এ জিনিস এর আগে কখনও হয়নি। বৃষ্টি আর নামেনি। সাড়ে ছটায় যখন বাংলো থেকে বেরোচ্ছি। তখন ফ্রেঞ্চকািট আর রক্ষিত দুজনেই যে-যার ঘরে রয়েছে, কারণ দুটো ঘরেই বাতি জ্বলছে। রাস্তায় বেরিয়ে এসে লালমোহনবাবু বার আষ্টেক বিড়বিড় করে দুর্গ দুর্গ বললেন। আমার নিজের মনের ভগব আমি লিখে বোঝাতে পারব না, তাই চেষ্টাও করব না। হাত দুটো ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল তাই পকেটের ভিতর গুঁজে দিলাম। সাতটা বাজতে দশ মিনিটে আমরা কৈলাসের কাছে পৌঁছলাম। পশ্চিমের আকাশে এখনও যথেষ্ট আলো রয়েছে, কারণ জুন মাসে এখানে সাড়ে ছটার পরে সূৰ্য্যস্ত হয়। যেদিকে পাহাড় আর গুহা সেদিকটা অন্ধকার হয়ে এসেছে, তবে আকাশে মেঘ নেই। আমরা কৈলাস থেকে ডানদিকে মোড় নিলাম। পরের গুহাটাই পনেরো নম্বর গুহা। দশাবতার গুহা। খাদের উপর থেকে এরই সামনে ফেলুদা নুড়ি পাথর ফেলেছিল। গুহার সামনে পাহারা নেই। আমরা দুজনে এগিয়ে গেলাম। প্রথমে একটা প্ৰকাণ্ড চাতাল, তার মাঝখানে একটা ছোট্ট মন্দির। আশেপাশে দেখার সময় নেই, তাই আমরা চাতাল পেরিয়ে বেশ কয়েক ধাপ সিঁড়ি উঠে গুহার মধ্যে ঢুকলাম। এটা নীচের তলা। আমাদের যেতে হবে দোতলায়! সঙ্গে টর্চ, আছে, কিন্তু এখনও তার প্রয়োজন হচ্ছে না। উত্তর-পশ্চিম কোণে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি। আর কেউ গুহার মধ্যে আছে কি না জানি না, তাই যতটা সম্ভব শব্দ না করে আমরা দোতলায় উঠতে লাগলাম। দেড়তলায় উঠে একটা খোলা জায়গা। সেখানে দেয়ালের গায়ে দেবদেবীর মূর্তি রয়েছে। আরও খানিকটা উঠে গিয়ে আমরা তিন দিক বন্ধ একটা প্ৰকাণ্ড হল ঘরে পৌঁছলাম। সারি সারি কারুকার্য করা থাম হলের ছাতটাকে মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। উত্তর আর দক্ষিণের দেয়ালে আশ্চর্য সব পৌরাণিক দৃশ্য খোদাই করা। ফেলুদার নির্দেশ অনুযায়ী আমরা দক্ষিণ-পূর্ব কোণের দিকে এগিয়ে চললাম। এদিকটা ক্ৰমে আলো থেকে দূরে সরে এসেছে, তাই টর্চ জ্বলিতে হল। নিশ্চয় আর কেউ নেই, অন্তত শত্রুপক্ষের কেউ নেই, না হলে ফেলুদা আমাদের আসতে বলত না—এই ভরসাতেই আমরা টর্চ জ্বেলেছি। ওই যে থামের ডানদিকের পিছনে দেখা যাচ্ছে অন্ধকার ঘুপচি কোণ। আমরা এগিয়ে গেলাম। নীচে সিঁড়ি ওঠার আগেই পা থেকে স্যান্ডাল খুলে নিয়েছিলাম, এখন দেখছি পাথর বেশ ঠাণ্ডা। জায়গায় পৌঁছে আবার স্যান্ডাল পরে নিলাম। তেরোশো বছর আগে পাহাড়ের গা কেটে তৈরি খোদাই করা পৌরাণিক দৃশ্যে ভরা গুহার ভেতর কী ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে তার কোনও ধারণা এখন পর্যন্ত করে উঠতে পারিনি। কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে জানি না; একটানা দাঁড়িয়ে থাকলে পা ধরে যাবে বলে আমরা দুজনেই গুহার কোণে দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসেছি, এমন সময় একটি জিনিসে চোখ পড়াতে বুকের ভিতরটা ধক করে উঠল। আমাদের সামনে হাত পাঁচেক দূরে একটা থামের পাশে আবছা অন্ধকারে একটা আলগা জিনিস পড়ে আছে। একটা লাল রঙের জিনিস। আর তার তলায় চাপা দেওয়া একটা চৌকো সাদা জিনিস। লালমোহনবাবু ফিস ফিস করে বললেন, একটা কাগজ বলে মনে হচ্ছে। দুজনে এগিয়ে গিয়ে যা দেখলাম তাতে মাথাটা বেশ কয়েকবার ঘুরে গেল, আর সেই সঙ্গে রহস্যটাও আরও ভালভাবে জটি পাকিয়ে গেল। তলার জিনিসটা কাগজই বটে, আর পেপার ওয়েট-টা হল-ভুবনেশ্বরের যক্ষীর মাথা!—যেটা আজই সকলে মল্লিকের সুটকেস থেকে বেরিয়ে কুলকার্নির সিন্দুকে লুকিয়ে ছিল। অন্ধকার বেশ বেড়েছে, তাই কাগজের লেখাটা পড়তে আবার টর্চ জ্বালতে হল। মাথাটা আপনার কাছে রাখুন। চাইলে দিয়ে দেবেন। এটা ফেলুদা লালমোহনবাবুকে উদ্দেশ করে লিখেছে। লালমোহনবাবু ধরা গলায় জয় মা তারা বলে মাথাটাকে দুহাতে তুলে নিয়ে বগলদাবী করে নিজের জায়গায় নিয়ে এলেন। আমি কাগজটা পকেটে পুরলাম। বাইরে ফিকে চাঁদের আলো! থামের ফাঁক দিয়ে পশ্চিমের আকাশ দেখা যাচ্ছে, সে আকাশের রং এখন আশ্চর্যরকম বেগুনি। ক্ৰমে সে রং বদলাল। চাঁদ বোধহয় বেশ ভাল ভাবে উঠেছে। গুহার মধ্যে জমাট বাঁধা অন্ধকারটা আর নেই। আটটা -লালমোহনবাবু যেন অনেকক্ষণ চেপে রাখা নিশ্বাস ছেড়ে কথাটা বললেন। একটা অতি ক্ষীণ শব্দ। সিঁড়ি দিয়ে কে যেন উঠছে। ধীরে ধীরে অতি সাবধানে পা ফেলছে। এইবার শব্দ বদলাল। এবার সমতল মেঝেতে হাঁটছে। এবারে দুই থামের ফাঁক। দিয়ে দেখা গেল। লোকটা থেমেছে-এদিক ওদিক দেখছে। একটা খচ শব্দের সঙ্গে সঙ্গে একটা লাইন্টার জ্বলে উঠল। এক সেকেন্ডের আলো, কিন্তু তাতেই মুখ চেনা হয়ে গেছে। জয়ন্ত মল্লিক। আবার মাথা গণ্ডগোল হয়ে গেল। এবার যদি মরা মানুষ শুভঙ্কর বোসও এসে হাজির হন। তা হলেও আশ্চর্য হব না। মল্লিক এগিয়ে এলেন, তবে আমাদের দিকে নয়। তিনি অন্য দিকের কোণে যাচ্ছেন। উত্তর-পূর্ব দিক। ওদিকে গাঢ় অন্ধকার। ভদ্রলোক সেই দিকে এগিয়ে গিয়ে অন্ধকারে হারিয়ে গেলেন। আমাদের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে, আর আমার মন বলছে-ফেলুদা কোথায়?…ফেলুদা কোথায়?…ফেলুদা কোথায়?… লালমোহনবাবু বাক্স রহস্যের ঘটনার পর বলেছিলেন ডিটেকটিভ উপন্যাস লেখা ছেড়ে দেবেন, কারণ বাস্তব জীবনে বানানো গল্পের চেয়ে অনেক বেশি অবিশ্বাস্য আর রোমাঞ্চকর সব ঘটনা ঘটে। এই যক্ষীর মাথার ঘটনার পরে উনি কী বলবেন কে জানে! চাঁদের আলো বেড়েছে। দূরে একটা কুকুর ডাকল। তারপর আরেকটা। তারপর থমথমে চুপ। তারপর আরেকটা শব্দ। এবার মেঝে দিয়ে হাঁটছে। এবার দুই থামের ফাঁক দিয়ে দেখা গেল তাকে। এখনও চেনা যাচ্ছে না। এবার সে লোক এগিয়ে এল। এবার আমাদেরই দিকে। প্রায় নিঃশব্দে এগিয়ে আসছে। এক পা এক পা করে। হঠাৎ চোখের সামনে চোখধাঁধানো আলো। লোকটা টর্চ জ্বেলেছে। শুধু টর্চই দেখছি, লোকটাকে দেখছি না। টৰ্চটা আমাদের উপর ফেলা। সেটা এগিয়ে এল। থামল। তারপর একটা চেনা গলার স্বর-চাপা, কিন্তু কথাগুলো ভীষণ স্পষ্ট– বামন হয়ে চাঁদে হাত? অ্যাঁ, বাছাধন? আবার হুমকি দিয়ে চিঠি লিখতে শেখা হয়েছে?–দশাবতার গুহায় আটটার সময় আসিবেন, সঙ্গে পাঁচশত টাকা আনিবেন।.তবে আপনার যাহা খেয়া গিয়াছে তাহ পাইবেন, নতুবা.-এ সব কেথেকে শেখা হল, ইতিহাসের অধ্যাপক? কথাগুলো কানে ঢুকছে না, এখনও কালা সেজে বসে আছ? এই ব্যাপারে তুমি জড়ালে কী করে? খাতায় আবার নোট করা রয়েছে দেখলাম।–ফকার ফ্রেন্ডশিপ ক্র্যাশ, ভুবনেশ্বরের যক্ষী, কৈলাসের মন্দির, প্লেনের টাইম…। আবার সঙ্গে একটা নাবালককে রেখেছি কেন? ও কি তোমার বডিগার্ড? আমার ডান হাতে কী আছে দেখতে পাচ্ছ কি? মিস্টার রক্ষিত। এক হাতে পিস্তল, এক হাতে টর্চ। লালমোহনবাবু দুবার আমি আমি বলে থেমে গেলেন। রক্ষিতের চাপা হুমকিতে গুহার ভেতরটা কেঁপে উঠিল– আমি আমি ছাড়ো। আসল মাল কোথায়? এই যো। আপনার জন্যই… লালমোহনবাবু যক্ষীর মাথাটা রক্ষিতের দিকে এগিয়ে দিলেন। ভদ্রলোক পিস্তলের হাত ঠিক রেখে, টর্চের হাত দিয়ে মাথাটাকে বগলদাবা করে নিয়ে ঝাঁঝালো সুরে বললেন, এ সব ব্যবসা সকলকে মানায় না, বুঝেছি? যেমন ছোট মুখে বড় কথা মানায় না, তেমন ছোট বুকে বড় সাধ মানায় না। মিস্টার রক্ষিতের কথা হঠাৎ থেমে গেল। কারণ, একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটছে। গুহার ভিতর। –বাইরের দিক থেকে একটা ধোঁয়ার কুণ্ডলী গুহার ভিতর ঢুকে চারদিক ছেয়ে ফেলছে, আর তার ফলে কালো কালো থামগুলো যেন তালগোল পাকিয়ে অদৃশ্য হয়ে আসছে। সেই ধোঁয়ার ভিতর থেকে হঠাৎ একটা গমগমে গলার স্বর শোনা গেল। ফেলুদার গলা; পাথরের মতো ঠাণ্ডা আর কঠিন সে গলা– মিস্টার রক্ষিত, আপনার দিকে, একটি নয়, এক জোড়া পিস্তল সোজা ত্যাগ করা রয়েছে। আপনি নিজের পিস্তলটা নামিয়ে ফেলুন। কী ব্যাপার? এ সবের অর্থ কী? মিস্টার রক্ষিত কাঁপা গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন। অর্থ খুবই সহজ, ফেলুদা বলল-আপনার অপরাধের শাস্তি দিতে এসেছি আমরা। অপরাধ একটা নয়—অনেকগুলো। প্রথম হল—ভারতের অমূল্য শিল্পসম্পদকে নির্মমভাবে ধ্বংস করা; দ্বিতীয়, এই শিল্পসম্পদকে অর্থের লোভে বিদেশিদের কাছে বিক্রি করা; আর তৃতীয়-শুভঙ্কর বোসকে নির্মমভাবে হত্যা করা। মিথ্যে! মিথ্যে।-রক্ষিত চিৎকার করে উঠলেন। -শুভঙ্কর বোস খাদের উপর থেকে পা হড়কে… মিথ্যেটা আমি বলছি না, বলছেন। আপনি। যে শাবল দিয়ে আপনি তাকে মেরেছিলেন। সেই শাবল রক্তমাখা অবস্থায় খাদ থেকে পঞ্চাশ হাত দূরে একটা মনসার ঝোপের ভিতর পাওয়া গেছে। শুভঙ্কর বোস জ্যান্ত অবস্থায় খাদে পড়লে তিনি নিশ্চয় চিৎকার করতেন; অথচ কৈলাসের পাহারাদার কোনও চিৎকার শোনেনি। আর তা ছাড়া আপনার একটা নীল শার্ট আপনি বাংলোর পূর্বদিকে গাছপালার মধ্যে লুকিয়ে রেখে এসেছিলেন। সেটা আমিই গিয়ে উদ্ধার করি। এই শার্টের একটা অংশ একটু ছেড়া। মিলিয়ে দেখলে দেখা যাবে যে শুভঙ্কর বোসের- মিস্টার রক্ষিত হঠাৎ একটা লাফ দিয়ে ধোঁয়ার মধ্যে দিয়ে পালাবার চেষ্টা করতেই নিমেষের মধ্যে তিনজন জাঁদরেল লোকের হাতে বন্দি হয়ে গেলেন। ডানদিকে জয়ন্ত মল্লিকের টর্চ জ্বলে উঠল। সেই আলোতে দেখলাম মেক-আপ ছাড়া ফেলুদাকে, মিস্টার ঘোটেকে, আর আরেকটি লোক, যে মিস্টার ঘোটের হুকুমে রক্ষিতের হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিল। ফেলুদা এবার জয়ন্ত মল্লিকের দিকে ফিরে বলল, মিস্টার মল্লিক, এবার আপনাকে একটা কাজ করতে হবে। ওই যে পিছনের গুহাটা দেখছেন, ওর মধ্যে গিয়ে দেখুন, বাঁদিকের কোনায় মিস্টার রক্ষিতের রেনকোটটা রয়েছে। ওটা নিয়ে আসুন। আয় তপসে–এই ধোঁয়ার মধ্যে আর বেশিক্ষণ থাকা চলবে না। আসুন লালমোহনবাবু! গেস্ট হাউসের ডাইনিং টেবিলে বসে ডিনার খেতে খেতে ফেলুদা আমাদের মনের ধোঁয়া দূর করছে। আমরা তিনজন ছাড়া রয়েছে মিস্টার মল্লিক, কুলকার্নি আর ঘোটে। হিন্দি আর ইংরেজি মিশিয়ে কথা হচ্ছে, আমি সেটা বাংলাতেই লিখছি। ফেলুদা বলল প্রথমেই বলে রাখি মিস্টার রক্ষিতের আসল নাম হল চট্টোরাজ। উনি একটি গ্যাং বা দলের সভ্য, যার ঘাঁটি হল দিল্লি। এই দলের উদ্দেশ্য হল ভারতের ভাল ভাল মন্দির থেকে মূর্তি বা মূর্তির মাথা ভেঙে নিয়ে বিদেশিদের কাছে বিক্রি করা। এই ধরনের দল হয়তো আরও আছে। আপাতত এই একটি দলকে শায়েস্তা করার রাস্তা আমরা পেয়েছি, কারণ চট্টোরাজকে আমরা এই ঘাঁটির হদিস এবং এর অন্যান্য সভ্যদের নাম বলতে বাধ্য করেছি। ভুবনেশ্বরের যক্ষীর মাথা চট্টোরাজই চুরি করেন, চট্টোরাজই সেটা কলকাতায় আনেন, চট্টোরাজই সেটা সিলভারস্টাইনের কাছে বিক্রি করেন, আবার প্লেন ক্র্যাশ হবার পর চট্টোরজই সিদিকপুরে গিয়ে পানু নামক ছেলেটির কাছ থেকে দশ টাকা দিয়ে সেটা উদ্ধার করে আনেন, এবং সেই মূর্তি সমেত চট্টোরাজই লুইসনকে ধাওয়া করে এলোরায় আসেন। এখানে আসার কারণ হল এক টিলে দুই পাখি মারা। এক পাখি হল লুইসনের কাছে সেটা বিক্রি করা, আর দ্বিতীয় হল কৈলাস থেকে আরেকটি কোনও টাটকা নতুন মাথা সরিয়ে নিয়ে যাওয়া। আমরা জানি এই দুটোর একটা উদ্দেশ্যও সফল হয়নি। লুইসন মূর্তি কিনতে রাজি হন, কিন্তু সেটা তাঁকে দেবার আগেই চট্টোরাজের হাত ছাড়া হয়ে যায়, ফলে তাকে ল্যুইসনের গালিগালাজ শুনতে হয়। আর মূর্তি চুরির ব্যাপারটা ভঙুল হয় একবার শুভঙ্কর বোসের অতর্কিত আবির্ভাবে, আর তার কিছু পরেই দশাবতার গুহার সামনে একটি নুড়ি পাথর ফেলার দরুন। ফেলুদা বোধহয় দম নেবার জন্য চুপ করল। আমার মাথা গুলিয়ে গেছে। আমি না। বলে পারলাম না-আর মিস্টার মল্লিক? ফেলুদা তার একপেশে হাসি হেসে বলল, মিস্টার মল্লিকের ব্যাপারটা খুবই সহজ। এতই সহজ যে প্রথমে আমিও ধরতে পারিনি। মিস্টার মল্লিক। চট্টোরাজকে ধাওয়া করছিলেন। কেন? যে কারণে আমি মিস্টার মল্লিককে ধাওয়া করছিলাম, ঠিক সেই একই কারণে। অৰ্থাৎ তিনিও মূর্তিটাকে উদ্ধার করতে চাচ্ছিলেন। অবিশ্যি এইখানেই মিলের শেষ নয়। ওঁর আর আমার পেশাও এক। উনিও আমারই মতো একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ। আমি অবাক হয়ে মিস্টার মল্লিকের দিকে চাইলাম। ভদ্রলোকের ঠোঁটের কোণে হাসি, তাঁর দৃষ্টি ফেলুদার দিকে। ফেলুদা বলে চলল, আমরা ফোন করে জেনেছি উনি বম্বের ভার্গব এজেন্সি নামে একটা প্রাইভেট ডিটেকটিভ কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত। এই কোম্পানির মালিক বাঙালি, নাম ঘোষ। এদেরই একটা তদন্তের ব্যাপারে মল্লিক কিছুদিন হল কলকাতায় আসেন, ওঁর এক বন্ধুর অবর্তমানে কুইনস ম্যানসনে তাঁর ফ্লাটে থাকেন, তাঁর গাড়ি ব্যবহার করেন। এই সব এজেন্সি সাধারণত মামুলি অপরাধের তদন্তু করে থাকে। কিন্তু মিস্টার মল্লিকের তাতে মন ভরছিল না। তিনি চাইছিলেন গোয়েন্দা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করতে। তাই না, মিস্টার মল্লিক? মিস্টার মল্লিক বললেন, ঠিক কথা। আর সেই সুযোগটা এসে যায় খুব আশ্চর্যভাবে। তদন্তের ব্যাপারেই গত বিষ্ণুদবার গিয়েছিলাম নগরীমলের দোকানে। সেখানে আমারই সামনে একটি মার্কিন ভদ্রলোক নগরমলকে একটা মূর্তির মাথা দেখালেন। আমার আর্ট সম্বন্ধে একটু আধটু জ্ঞান আছে, কিন্তু মাথাটা তখন আমার মনে কোনও দাগ কটেনি। শুধু জেনেছিলাম যে সাহেবের নাম সিলভারস্টাইন, আর উনি অত্যন্ত ধনী। পরদিন সকালে কাগজে ভুবনেশ্বরের মন্দিরের খবরটা পড়ি, আর তার আধা ঘণ্টার মধ্যে রেডিয়োতে শুনি যে সিলভারস্টাইন সিদিকপুরের কাছে প্লেন ক্র্যাশে মারা গেছে। তখনই মনে হয় মূর্তিটাকে উদ্ধার করতে পারলে আমার নাম হতে পারে। সে কথা তক্ষুনি বম্বেতে ফোন করে আমার বসকে জানিয়ে দিই। উনি তাতে রাজি হন। বলেন-কী হয় আমাকে ফোন করে জানিয়া। আমি কাজে লেগে যাই। কিন্তু আমার ভাগ্য খারাপ। আমি সিদিকপুরে পৌঁছানার পাঁচ মিনিট আগে আরেকটি ভদ্রলোক গিয়ে গ্রামের ছেলেদের কাছ থেকে মূর্তি আদায় করে নেন। ঘটনাটি ঘটে আমার চোখের সামনে, কিন্তু তখন আমার পক্ষে এ বিষয়ে কিছু করার উপায় ছিল না। আমি ঠিক করি ভদ্রলোককে ফলো করব। কিন্তু— ভদ্রলোকের গাড়ির রংটা মনে আছে?-ফেলুদা মল্লিকের কথার উপর প্রশ্ন করল। আছে বইকী। নীল রঙের ফিয়ার্ট গাড়ি। সেটাকে ফলে করলাম, কিন্তু সেখানেও ব্যাড় লোক-বারাসতের কাছাকাছি টায়ার পাংচার হয়ে গেল, ভদ্রলোক তখনকার মতো আমার হাতছাড়া হয়ে গেলেন। কিন্তু ততক্ষণে আমার গোঁ চেপে গেছে। আমি জানি উনি আবার মূর্তিটা বেচবেন। চলে গেলাম গ্র্যান্ড হাটেলে। শেষ পর্যন্ত ভদ্রলোকের দেখা পেলাম, তাকে ধাওয়া করে রেলওয়ে আপিসে গিয়ে তার দেখাদেখি আওরঙ্গাবাদের টিকিট কিনলাম। তার হাতের ব্যাগের ওজন দেখে মনে হচ্ছিল তিনি তখন পর্যন্ত মূর্তিটা বিক্রি করতে পারেননি। টিকিট কিনে বম্বেতে আমার আপিসে খবরটা জানিয়ে দিলাম। ফেলুদা বলল, জানি। আপনি বলেছিলেন মেয়ে বাপের বাড়ি চলে এসেছে। বাপ যে আসলে চট্টোরাজ, আপনি নন, সেটা তখন বুঝতে পারিনি। মল্লিক বললেন, যাই হোক এখানে এসে প্রথম থেকেই আমি মূর্তিটা হাত করার সুযোগ খুজি। আমি জানতাম যে চোরাই মাল উদ্ধার করার সঙ্গে সঙ্গে যদি চোরকে ধরে দিতে পারি। তা হলে আরও বেশি নাম হবে; কিন্তু সেটা সাহসে কুলোল না। যাই হাক।–কাল রাত্রে কৈলাসের কাছে গিয়ে লুকিয়ে ছিলাম। যখন দেখলাম একে একে বাংলোর সবাই ঘুরতে বেরিয়েছে, তখন বাংলোয় গিয়ে জমাদারের দরজা দিয়ে চট্টোরাজের ঘরে ঢুকে মাথাটা নিয়ে আসি। ফেলুদা বলল, আপনার পেছনেও যে একজন গোয়েন্দা লেগেছে সেটা বুঝতে পেরেছিলেন কি? মোটেই না; আর সেজন্যেই তো হঠাৎ ধরা পড়ে এত বোকা হয়ে গিয়েছিলাম! মিস্টার ঘোটে হা হা করে হেসে উঠলেন। ফেলুদা বলল, যখন দেখলাম। আপনি এতখানি পথ লুইসনের সঙ্গে গিয়েও তাকে মূর্তিটা গছাননি, তখনই প্রথম বুঝতে পারলাম যে আপনি নিদোষ। তার আগে পর্যন্ত, আপনি গোয়েন্দা জেনেও, আপনার উপর থেকে। আমার সবটুকু সন্দেহ যায়নি। কিন্তু আপনি তো চট্টোরীজকে সন্দেহ করেছিলেন, তাই না?–প্রশ্ন করলেন মিস্টার মল্লিক। ফেলুদা বলল, হ্যাঁ, কিন্তু প্ৰথমে সেটা ছিল শুধু একটা খটকা। যখন দেখলাম একটা পুরনো সুটকেসে নতুন করে নাম লেখা হয়েছে আর এন রক্ষিত, তখনই সন্দেহ হল-~~নামটা ঠিক তো? তারপর কাল রাত্রে উনি রেনকোট পরে বেরিয়েছিলেন সে কথা লালমোহনবাবুর কাছে শুনি। পনেরো নম্বর গুহাতে একজন লোক ঢুকেছে। সন্দেহ করে ওপর থেকে গুহার সামনে একটা নুড়ি পাথর ফেলি। ফলে অন্ধকারে লোকটা পালায়। ভেতরে গিয়ে খোঁজাখুঁজি করতে পেছন দিকের একটা ছোট গুহায় দেখি রেনকোট, আর তার বিরাট স্পেশাল পকেটে হাতুড়ি, ছেনি। আর নাইলনের দড়ি। আমি ওগুলো সেইখানেই রেখে আসি। বুঝতে পারি চট্টোরাজ হলেন মূর্তিচোর। সেই রাত্রেই দেখলাম চট্টোরাজ তার ঘরে পাগলের মতে কী জানি খুঁজছেন। পরদিন সকালে শুনলাম। আপনি বম্বেতে টেলিফোন করেছেন-মেয়ে ভাল আছে। বুঝলাম মূর্তি এখন আপনার কাছে। অথচ মুশকিল। এই যে, মূর্তিটা হাত ছাড়া হলে আসল চারকে শায়েস্তা করা যাবে না। তাই আপনাকে অ্যারেস্ট করতে হল। এ দিকে শুভঙ্কর বোসের অপঘাত মৃত্যু হয়েছে। তার ডেডবডি দেখতে গিয়ে হাতের মুঠো থেকে নীল কাপড়ের টুকরো পাওয়া গেল। আপনি রাত্রে নীল শার্ট পরেছিলেন, কিন্তু এদিকে আমার সন্দেহ চট্টোরাজের উপর পড়েছে! আসলে আমারও আগে চট্টোরাজ পৌঁছেছিলেন ডেডবডির কাছে। উনিই নাড়ি দেখার ভান করে নিজের একটা নীল শার্ট থেকে ছেঁড়া টুকরো শুভঙ্করের হাতে গুঁজে দেন—কারণ শুভঙ্করের মৃত্যুর জন্য অন্য কাউকে দায়ী করার প্রয়োজন ছিল। উনি নিজের শর্টটি অবিশ্যি পরে বাংলোর পশ্চিম দিকে গাছপালায় ভর্তি একটা নিরিবিলি জায়গায় লুকিয়ে রাখেন, আর আমি গিয়ে সেটা উদ্ধার করি। কিন্তু এত করেও যে সমস্যাটা বাকি রইল, সেটা হল কী করে চট্টোরাজকে ধরা যায়। একটা পথ পেলাম যখন শুনলাম যে কে জানি লালমোহনবাবুর ঘরে ঢুকে বাক্স ঘাঁটাঘাঁটি করেছে। এ ব্যক্তি নিঃসন্দেহে চট্টোরাজ, কারণ তারই একটি মূল্যবান জিনিস খোওয়া গেছে। লালমোহনবাবুর বাক্সে লালমোহনবাবুর নোটবই ছিল, এবং তাতে যক্ষীর মাথা, প্লেন ক্র্যাশ ইত্যাদির উল্লেখ ছিল। এই খাতা চট্টোরাজ না পড়ে পারেন না। এই আন্দাজে আমি লালমোহনবাবুর হাতের লেখা নকল করে চট্টোরাজকে যে চিঠিটা লিখলাম সেটার কথা জানেন। তার আগেই আমি চট্টোরাজকে নিশ্চিন্ত করার জন্য জানিয়ে দিলাম যে মূর্তি চোর ধরা পড়েছে- সেই ফ্রেঞ্চকটি দাড়ি?–আমি আর লালমোহনবাবু একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলাম। হ্যাঁ?-ফেলুদা হেসে বলল। -সেটা আমার দু নম্বর ছদ্মবেশী! তোদের কাছাকাছি থাকার দরকার হয়ে, পড়েছিল, কারণ লোকটা ডেঞ্জারাস। যাই হাক–চিঠির টোপ উনি বেমালুম গিলে ফেললেন। এবং তার ফলে যে কী হল সেটা আপনারা সকলেই জানেন। এবার এইটুকুই বলতে বাকি যে, এই যে গ্যাংটা ধরা হল, এর কৃতিত্বের অংশীদার ভার্গব এজেন্সির মিস্টার মল্লিক যাতে উপযুক্ত স্বীকৃতি পান সেটা আমি নিশ্চয় দেখব, আর-মিস্টার ঘোটের যাতে পদোন্নতি হয় সেটাও একান্তভাবে কামনা করব। মিস্টার কুলকার্নির ভূমিকাও যে সামান্য নয়। সেটা কলাই বাহুল্য, আর সাহসের জন্য যদি মেডাল দিতে হয় তা হলে সেটা অবশ্যই পাবেন শ্ৰীমান তপেশ ও শ্ৰীযুক্ত লালমোহন গাঙ্গুলী। সকলের হাততালি শেষ হলে জটায়ু একটা কিন্তু কিন্তু ভাব করে বললেন, আমার বোমটা তা হলে আর কোনও কাজে লাগল না বলছেন? ফেলুদা চোখ গোল গোল করে বলল, সে কী মশাই-এত যে ধোঁয়া হল সেটা এল কোখোঁকে? ওটা তো আর এমনি এমনি বোমা নয়-একেবারে তিনশো ছাপ্পান্ন মেগাটন খাস মিলিটারি স্মোক-বম্ব।লালমোহনবাবু তাঁর সুটকেসের দিকে এগিয়ে গেছেন। —আমাদের পাড়ার দ্বিজেন তরফদারের ছেলে উৎপল আর্মিতে আছে। সে মার্চ মাসে এসেছিল। এইটে আমায় এনে দিয়ে বললে-কাকাবাবু দেখুন। আপনার জন্য কী এনিচি! বড় বড় যুদ্ধে ব্যবহার হয়। –ছোঁড়া আমার লেখার খুব ভক্ত। একটা মাঝারি সাইজের টর্চলাইটের মতো লম্বা খয়েরি রঙের একটা বেশ ভারী পাইপ জাতীয় জিনিস লালমোহনবাবু সুটকেস থেকে বের করে ফেলুদার হাতে দিলেন। ফেলুদা সেটা কিছুক্ষণ নেড়ে-চেড়ে দেখে বলল, এটা আমার কাছেই থাক। আপনার পক্ষে জিনিসটা বড় বেশি ডেঞ্জারাস। কত মেটাগন হবে বলুন তো? কথাটা আসলে মেগাটন, আর সেটা ব্যবহার হয় অ্যাটমবোমা সম্পর্কে। এক মেগাটন মানে দশ লক্ষ টন। ফেলুদা লালমোহনবাবুর প্রশ্নে কান না দিয়ে বামাটা ঝোলায় পুরে বলল, একবার বেরোনো দরকার। সবাই বেরিয়েছে, আমাদের ঘরে বসে থাকার কোনও মানে হয় না। ডাক বাংলো থেকে যখন বেরোলাম তখন সাড়ে এগারোটা। বিক্সিটা এখনও ডাকছে। চাঁদের আলো কমছে-বাড়ছে, কারণ আকাশ টুকরো টুকরো চলন্ত মেঘে ছেয়ে গেছে। গেস্ট হাউসের একটা ঘরে দেখলাম আলো জুলছে। সেটা নাকি সেই আমেরিকগনের ঘর; কে কোন ঘরে থাকে সেটাও নাকি ফেলুদা ম্যানেজারের কাছ থেকে জেনে নিয়েছে। মল্লিক আর শুভঙ্কর ফিরেছে কি না বোঝা গেল না। কিছুক্ষণ থেকেই ঘন ঘন মেঘ ডাকছিল; যখন বড় রাস্তার উপর এসে পড়েছি তখন একটা বড়ুরকম গর্জন শুনে আকাশের দিকে চেয়ে দেখি পুব দিকটা কালো হয়ে আসছে। এই মরেছে। বৃষ্টি আসবে নাকি? বলে উঠলেন লালমোহনবাবু! এত গুহা থাকতে বৃষ্টি এলে আশ্রয়ের অভাব হবে না, বলল ফেলুদা। কৈলাসের দিকে উঠে গিয়ে মন্দিরে ঢোকার কোনও চেষ্টা না করে ফেলুদা বা দিকের পথ ধরল। কিন্তু সে পথেও বেশি দূর না। খানিকটা গিয়েই সে দেখি পথ ছেড়ে পাহাড়ের গা বেয়ে উপরে উঠতে আরম্ভ করেছে। ওর কায়দাকানুন একটু আধটু জানি বলে আন্দাজ করলাম যে সামনের দিক দিয়ে ছাড়া গুহায় ঢ়োকার কোনও রাস্তা আছে কি না সেটাই ও একটু ঘুরে দেখতে চাইছে। আশেপাশে ঝোপঝাড় আর পাথরের টুকরো, কিন্তু এখনও চাঁদের আলো থাকায় সেগুলো কোনও বাধার সৃষ্টি করছে না। এইবার ফেলুদা ডান দিকে মোড় নিল। বুঝলাম য়ে-দিক থেকে এসেছি সেদিকেই ফিরে যাচ্ছি, কিন্তু রাস্তা দিয়ে নয়; পাহাড়ের গা দিয়ে-রাস্তা থেকে অনেকটা ওপরে। খানিকটা গিয়েই ফেলুদা হঠাৎ থেমে গেল। তার দৃষ্টি ডান দিকে। আমরা থেমে সেইদিকে দেখলাম। দূরে পশ্চিম দিকে ঠিক যেন মনে হচ্ছে জমির উপর একটা সিস্কের ফিতে বিছিয়ে রাখা হয়েছে। আসলে সেটা শহরে যাবার রাস্তা, চাঁদের আলোয় চিক চিক করছে। সেই রাস্তা দিয়ে একজন লোক দ্রুত পায়ে হেঁটে চলেছে গেস্ট হাউসের দিকে। অথবা বাংলোর দিকে। কারণ রাস্তা একটাই। মিস্টার রক্ষিত নন, ফিসফিস করে বললেন লালমোহনবাবু। কী করে বুঝলেন? চাপা গলায় জিজ্ঞেস করল ফেলুদা। রক্ষিতের গায়ে রেনকোট ছিল। কথাটা ঠিকই বলেছেন লালমোহনবাবু। লোকটা একটা মোড় ঘুরে অদৃশ্য হয়ে গেল। আমরা আবার এগিয়ে চললাম। খস্‌স্‌…খস্‌স্‌…খস্‌স্‌…খস্‌স্‌… একটা অদ্ভুত আওয়াজ শুনে আমরা তিনজন আবার থেমে গেলাম। কোথেকে আসছে অ্যাওয়াজটা? ফেলুদা বসে পড়ল। আমরাও। সামনে একটা প্রকাণ্ড মনসার ঝোপ। সেটা আমাদের আড়াল করে রেখেছে। আওয়াজটা আরও কিছুক্ষণ চলে থামল। তারপর সব চুপ। এ কী-চারদিক হঠাৎ অন্ধকার হয়ে গেল কেন? আকাশের দিকে চেয়ে দেখি সেই কালো মেঘট চাঁদটাকে ঢেকে ফেলেছে। আমরা ঝোপের পিছন থেকে বেরিয়ে এগিয়ে চললাম। খানিকটা হাঁটার পর ডানদিকে কৈলাসের খাদটা পড়ল। খাদের পাশেই…ওঁই যে মন্দির। মন্দিরের চূড়ো এখন আমাদের সঙ্গে সমান লেভেলে। চূড়োর পিছনে বেশ খানিকটা নিচুতে একটা ছাত—তার মাথায় চারটে সিংহ চারিদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। ওই যে নিচে দূরে হাতি দুটো দেখা যাচ্ছে। আমরা আরও এগিয়ে চললাম। আওয়াজটা এদিক থেকেই এসেছে সেটা বুঝেছিলাম, কিন্তু সন্দেহজনক কিছুই চোখে পড়ল না। হয়তো আছে, অন্ধকার বলে দেখা যাচ্ছে না। আমি জানি ফেলুদা টর্চ জ্বালাবে না, কারণ তা হলে অন্য লোক আমাদের কথা জেনে যাবে। কৈলাসের খাদের পর কিছু দূর গিয়ে আরেকটা খাদ। এটা পনেরো নম্বর গুহা। সেটা ছাড়িয়ে তার পরের গুহাটার দিকে এসেছি। এমন সময় ফেলুদা হঠাৎ থেমে টান হয়ে গেল। তারপর ফিসফিস কথা– টর্চ জ্বেলেছে। পনেরো নম্বর গুহার ভিতরে। তার ফলে গুহার বাইরের আলোটা একটু বেড়েছে। আমি ব্যাপারটা লক্ষ করিনি। লালমোহনবাবুও না। ফেলুদার চোখই আলাদা। দু মিনিট প্রায় নিশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপর ফেলুদা একটা ব্যাপার করল। একটা ছোট্ট নুড়ি পাথর কুড়িয়ে নিয়ে সেটাকে ওপর থেকে গুহার সামনের চাতালটায় ফেলল। টুপ করে একটা শব্দ পেলাম। তারপর বুঝতে পারলাম চাতালটা হঠাৎ যেন আরও বেশি অন্ধকার হয়ে গেল। তার মানে টৰ্চটা নিভল। আর তার পরেই একটা লোক নিঃশব্দে চোরের মতো গুহা থেকে বেরিয়ে পালিয়ে গেল। মিস্টার রক্ষিত না, আবার ফিসফিস করে বললেন লালমোহনবাবু। লোকটাকে চিনতে না পারলেও, তার গায়ে যে রেনকোট নেই সেটা আমিও বুঝেছিলাম। এরপর এল আমার জীবনের সবচেয়ে লোমখাড়া করা সময়। ফেলুদা ইতিমধ্যে নিচে যাবার একটা রাস্তা বার করে ফেলেছে। রাস্তা না বলে বোধ হয় উপায় বলা উচিত। খানিকটা লাফিয়ে, খানিকটা হামাগুড়ি দিয়ে, খানিকটা বাঁদরের মতো ঝুলে, খানিকটা মাটির উপর ঘষটে, সে দেখতে দেখতে নিচে গুহার সামনেটায় পৌঁছে গেল। লালমোহনবাবু চাপা। গলায় বললেন, গোয়েন্দাগিরিতে ফেল করলে সাকাসের চাকরি বাঁধা। পরমুহূর্তেই দেখলাম সে অদৃশ্য হয়ে গেল। তার মানে গুহার ভিতর ঢুকেছে। আমার কিন্তু ঘাম ছুটে লোমটোম খাড়া হয়ে গেছে। প্রায় তিন মিনিট (মনে হচ্ছিল তিন ঘণ্টা) পরে আবার দেখতে পেলাম ফেলুদাকে। তারপর আরম্ভ হল উলটো কসরত। উপর থেকে নিচের বদলে নিচের থেকে উপরে। এক হাতে টর্চ কাঁধে ব্যাগ আর কোমরে রিভলভার নিয়ে কীভাবে এরকম ওঠা নামা সম্ভব তা ও-ই জানে। উপরে উঠে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, এটার নাম দশাবতার গুহা। দোতলা। দুন্দর্যন্ত সব মূর্তি আছে। লোভনীয়। লোকটা কে ছিল বুঝলে?-ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম। ফেলুদার মুখ গভীর হয়ে গেল! বলল, যত সহজ ভাবছিলাম, তা নয়। পাঁচ আছে। রহস্য আছে। মাথা খাটাতে হবে। পাহাড় থেকে নেমে এসে বুঝলাম তদন্ত এখনও শেষ হয়নি। ফেলুদা কৈলাসের সামনে গিয়ে পাহারাদারের সঙ্গে দেখা করল। তাকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল সে গত ঘণ্টাখানেকের মধ্যে কোনও গোলমেলে ব্যাপার লক্ষ করেনি। অবিশ্যি ও যেখানে পায়চারি করছে সেখান থেকে খাদের উপরটা দেখা যায় না; মন্দিরের চূড়োয় ঢাকা পড়ে। কোনও শব্দ-টব্দ শোনোনি?-ফেলুদা হিন্দিতে জিজ্ঞেস করল। না, শব্দও শোনেনি। এমনিতেই মেঘ ডাকছে ঘন ঘন, শব্দ কী করে শুনবে? একবার মন্দিরের ভেতরে ঢুকে দেখতে পারি? জানতাম লোকটা না বলবে, আর বললেও তাই। নেহি বাবু, অর্ডার নেহি হ্যায়। ফেরার পথে বাংলোর কাছাকাছি এসে একটা অদ্ভুত জিনিস দেখলাম। আমরা আসছিলাম পুব দিক দিয়ে। বাংলোর পুব দিকের দেয়ালে দুটো জানালা রয়েছে-একটা রক্ষিতের ঘরের, একটা ফেলুদার ঘরের। ফেলুদার ঘরটা অন্ধকার। কিন্তু রক্ষিতের ঘরের ভেতর একটা আলোর তাণ্ডব চলেছে। বেশ বোঝা যাচ্ছে সেটা টর্চের আলো, কিন্তু সেটা কেন যে পাগলের মতো এদিক ওদিক করছে সেটা বোঝা মুশকিল। একবার আলোটা জানালার কাছে এল। বুঝলাম সেটা গেস্ট হাউসের দিকে ফেলা হচ্ছে। আলোটা ঝোপঝাড়ের উপর ঘোরাফেরা করে আবার ঘরে ফিরে গেল। ফেলুদা চাপা গলায় মন্তব্য করল, হাইলি ইন্টারেস্টিং। আমরা নিঃশব্দে এগিয়ে গেলাম বাংলোর দিকে। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়ছে। চারদিকে ঘুরাঘুট্টি অন্ধকার। আমি অনেক সময় দেখেছি যে আমাদের অ্যাডভেঞ্চারগুলো কখন যে কোন রাস্তায় চলবে সেটা আগে থেকে বোঝা ভারী মুশকিল হয়। কিছুদূর হয়তো আন্দাজ-মাফিক গেল, তারপর হঠাৎ এমন একটা ঘটনা ঘটল। যার জন্য রাস্তার মোড় গেল ঘুরে; ফেলুদার মাথা আশ্চর্য ঠাণ্ডা বলে ও বাধা পেলেও বা বেকায়দায় পড়লেও কখনও দিশেহারা হয় না। কিন্তু আজি একটা ব্যাপারে তাকে বেশ বিরক্ত হতে দেখলাম। কাল রাত্রে কৈলাসের ওপরে গিয়ে যে শব্দটা শুনেছিলাম, সে ব্যাপারে একটু তদন্তের দরকার বলে আমরা ঠিক করেছিলাম ভোরে ভোরেই কৈলাস চলে যাব। ফেলুদা রাত্রে মেক-আপ তুলে শুয়েছিল, আজ সকালে আমাদেরও আগে উঠে সে তৈরি হয়ে নিয়েছে, আর আমিও সিঁথিটা ডান দিকে করে নিয়েছি। লালমোহনবাবুও কোনও একটা কিছু মেক-আপ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ফেলুদা বারণ করাতে চুপ করে গেলেন। সূযোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে গুহাঁ খুলে যায়, লোক ঢুকে দেখতে পারে। সাড়ে পাঁচটায় চা খেয়ে বেরিয়ে ছাঁটার মধ্যে গুহায় পৌঁছে বাইরে বড় বড় গাড়ি আর লোকজনের ভিড় দেখে একেবারে তাজব বনে গেলাম। আরেকটু কাছে গিয়েই বুঝতে পারলাম ব্যাপারটা কী। ফিল্ম কোম্পানি এসেছে, কৈলাসে শুটিং হবে। একবার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সামনে শুটিং দেখেছিলাম, তখন রিফ্লেক্টর জিনিসটা দেখে চিনে রেখেছিলাম; এবারও সেই রিফ্লেক্টর দেখেই শুটিং-এর ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম। ফেলুদা বলল, সেরেছে—এরা আর জায়গা পেল না? শেষটায় কৈলাসের শ্ৰাদ্ধ করতে এসেছে? জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম যে দলটা বোম্বাই থেকে এসেছে, হিন্দি ফিল্মের শুটিং হচ্ছে। যারা অ্যাকটিং করবে তারা নাকি এখনও এসে পৌঁছয়নি, তবে অন্য সব কাজের লোক বেশির ভাগই এসে পড়েছে। একজন ইয়ং ছেলের প্যান্টের পকেট থেকে একটা বাংলা ফিল্ম পত্রিকার খানিকটা বেরিয়ে রয়েছে দেখে লালমোহনবাবু তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, কী বই হচ্ছে ভাই? ছেলেটি বলল, ক্রোড়পতি। কে কে পার্ট করতে? টপ কাস্টিং। এখানে আসছে রূপা, অৰ্জ্জুন মেরহাত্রা আর বলবন্ত চোপরা। হিরোইন, হিরো আর ভিলেন। অৰ্জ্জুনের নাম শুনেই বোধহয় লালমোহনবাবু হঠাৎ সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। জিজ্ঞেস করলেন, গান হবে নাকি ভাই? না। ফাইট। স্টান্টম্যান, ডাবল–সব এসেছে। হিরো ভিলেনকে চেজ করবে, ভিলেন গুহা থেকে মন্দিরের ভেতর ঢুকে যাবে। আর হিরোইন? হিরোইন সাইডের একটা কেভের মধ্যে রয়েছে। ওখানে ভিলেন ওকে অ্যাটাক করছে। হিরো এসে পড়ছে, ভিলেন পালাচ্ছে। ক্লাইম্যাক্স মন্দিরের চূড়োয়। চূড়োয়! চূড়োয়। পরিচালক কে? মোহন শর্মা। কিন্তু এই শুটিংটায় থাকছে ফাইট ড্রাইরেক্টর আপ্পারাও। আরও জিজ্ঞেস করে জানলাম যে শুটিং হতে হতে দশটা, আর দুপুরেই কাজ শেষ। তার মানে আজকের দিনটা এরাই কৈলাসটা দখল করে রাখবে। তাজ্জব ব্যাপার! ফেলুদা বলল।–এই পারমিশনটা পাওয়া কীভাবে সম্ভব হল জানতে ইচ্ছে করে। টাকায় কীই না করে। ভেতরে না ঢুকতে পারলেও কাল রাত্রে যেখানে পাহাড়ের উপরে খাদের পাশটায় গিয়েছিলাম, সেখানে যেতে আশা করি কোনও অসুবিধা নেই। তাই ভেবে কৈলাসের বাঁ দিক দিয়ে আমরা উপরে উঠতে লাগলাম। কিন্তু সে গুড়েও বালি! আমাদের আগেই ফিল্মের দলের কিছু লোক সেখানে হাজির হয়ে গেছে। তার মধ্যে একজন বোধহয় ক্যামেরাম্যান, কারণ সে ডান হাতের আঙুলগুলো ফুটাস্কোপের মতো করে চোখের সামনে পাকিয়ে ধরে মন্দিরের চুড়োর দিকে দেখছে। মন্দিরের ভিতর কিন্তু এখনও কোনও লোক ঢোকেনি। নিচে থাকতেই জেনেছিলাম। পারমিশনের চিঠিটা নাকি অন্য গাড়িতে আসছে। দারোয়ান যতক্ষণ না চিঠিটা দেখছে। ততক্ষণ কাউকে ভিতরে ঢুকতে দেবে না। ফেলুদা জিভ দিয়ে বিরক্তিসূচক একটা শব্দ করে বলল, সময় নষ্ট করে লাভ নেই। এরা আমাদের কাজটা পণ্ড করতেই এসেছে। চল, একবার পনেরো নম্বর গুহাটায় যাই।–ভাল মূর্তি আছে। এই উদাত্ত পরিবেশে ফিল্ম কোম্পানির কচকচ ভাল লাগছে না। আমরা যেদিক দিয়ে উঠেছিলাম তার উলটোদিক দিয়ে নেমে পনেরো নম্বর গুহার দিকে যাচ্ছি, এমন সময় দেখলাম মেন রোড দিয়ে একটা প্ৰকাণ্ড হলদে আমেরিকান গাড়ি কৈলাসের দিকে আসছে। বুঝলাম হিরো হিরোইন ভিলেন আর ফাইট ডাইরেক্টর এসে গেছেন। পনেরো নম্বর গুহাই হল দশাবতার গুহা। তার সামনে পৌঁছানোর আগেই দুই অবতারের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। একজন হলেন মিস্টার রক্ষিত, আর অন্যজন মিস্টার লুইসন। গুহার মুখটাতে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন দুজন, তার মধ্যে দ্বিতীয়টিকে বেশ উত্তেজিত বলে মনে হল। আমরা একটু এগিয়ে যেতেই কথা বন্ধ হয়ে গেল, আর আমেরিকানটি, আই সি নো · পয়েন্ট ইন মাই স্টেইং হিয়ার এনি লঙ্গার বলে আমাদের পাশ দিয়ে বেরিয়ে চলে গেলেন। মিস্টার রক্ষিত আমাদের দিকে এগিয়ে এসে ঘাড় ঝাঁকুনি দিয়ে তেতো হাসি হেসে বললেন, এখানকার অ্যারেঞ্জমেন্ট সম্বন্ধে কমপ্লেন করছিল। বলছে ডিমটা পর্যন্ত ঠিক করে ভাজতে জানে না, আর আশা করে যে আমরা এখানে এসে ডলার ঢেলে দিয়ে যাব। টাকার গরম আর কী! ফেলুদা বলল, আশ্চর্য তো। শুনেছিলাম আর্টের সমঝদার, আর এখানে এসে ডিম ভাজার কথাটাই মনে হল? রক্ষিত কী জানি একটা উত্তর দিতে গিয়ে আর দিতে পারলেন না। কৈলাসের দিক থেকে একটা বিকট চিৎকার এসে আমাদের সকলেরই পিলে চমকে দিয়েছে। লালমোহনবাবু পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে লাফিয়ে উঠে বললেন, ফাইট শুরু হয়ে গেছে মশাই! ভিলেন চ্যাঁচাচ্ছে! চিৎকারের পর আরও অন্য গলায় চোচামেচি শুরু হয়েছে। ফাইট হলে এত লোক চেচাবে কেন? আমরা ফেলুদার পিছন পিছন ব্যস্তভাবে কৈলাসের দিকে এগিয়ে গেলাম। এত ছুটোছুটি গোলমাল কীসের জন্য? যখন গেটের কাছাকাছি এসে গেছি তখন দেখলাম চার-পাঁচজন লোক চ্যাংদোলা করে একটি বেগুনি হাওয়াইয়ান শার্ট পরা লোককে হলদে গাড়িটার দিকে নিয়ে গেল। তারপর বেরিয়ে এল হিরো হিরোইন আর ভিলেন। এদের তিনজনেরই মুখ চেনা। রূপা অৰ্জ্জুনের কাঁধে ভর করে এগিয়ে আসছে, বলবন্ত তাদের পাশেই মাথা হেঁট করে রূপার কাঁধে একটা হাত দিয়ে যেন তাকে সাস্তুনা দিচ্ছে। এবারে সেই বাঙালি ছেলেটিকে দেখে আমরা চারজনেই তার দিকে এগিয়ে গেলাম। কী হয়েছে মশাই? লালমোহনবাবু প্রশ্ন করলেন। লাশ পড়ে আছে। মন্দিরের পেছন দিকে… হরিবল ব্যাপার…হাড়গোড় সব…. চ্যাংদোলা করে নিয়ে গেল কাকে? আপ্পারাও। উনিই প্রথম দেখলেন, আর দেখেই সেনসলেস। ফেলুদা আর মিস্টার রক্ষিত আগেই মন্দিরে ঢুকে গিয়েছিল। এবার আমরা দুজনও গেলাম; ফিল্মের লোকজন সব বেরিয়ে আসছে, বুঝলাম শুটিং আর হবে না। মন্দিরের বাঁ দিকের প্যাসেজ দিয়ে আমরা এগিয়ে চলেছি, ডানদিকে কৈলাসের নিচের দিকটায় সারি সারি হাতি আর সিংহের মূর্তি; মনে হয় তারাই যেন মন্দিরটাকে কাঁধে করে রয়েছে। সামনে মাড় ঘুরে ডান দিকে গিয়েই বাধহয় মৃতদেহ, কারণ সেখানে কিছু লোক দাঁড়িয়ে নিচের দিকে চেয়ে রয়েছে। আমরা পৌঁছানোর আগেই মিস্টার রক্ষিত ভিড় থেকে বেরিয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে এসে বললেন, ওদিকে যাবেন না। বিশ্ৰী ব্যাপার। আমারও যে খুব একটা যাবার ইচ্ছে ছিল তা নয়, কারণ এ ধরনের রক্তাক্ত দৃশ্য দেখতে ভাল লাগে না; তবু কে মারা গেছে জানার ভীষণ কৌতুহল হচ্ছিল। সে কৌতুহলটা মিটিয়ে দিল ফেলুদা। মিস্টার রক্ষিত চলে আসবার এক মিনিটের মধ্যেই ফেলুদাও ফিরে এসে বলল, শুভঙ্কর বোস। মনে হয় পাহাড়ের উপর থেকে সোজা পড়েছেন পাথরের মাটিতে। লালমোহনবাবু শুনলাম বিড়বিড় করে বলছেন, আশ্চর্য। ঠিক এইভাবেই মরবার কথা ঘনশ্যাম কর্কটের। ফেলুদা আবার বাইরের দিকে চলেছে, আমরা দুজন তাঁর পিছনে। মিস্টার রক্ষিত এগিয়ে গিয়েছিলেন, আমাদের আসতে দেখে থেমে বললেন, কাল রাত্রে যখন এদিকটায় বেড়াতে আসি, তখনই দেখলাম ভদ্রলোক পাহাড়ের উপর উঠছেন। আমি বারণ করেছিলাম। ভদ্রলোক আমার কথায় কানই দিলেন না। তখন কি জানি যে লোকটা আত্মহত্যা করতে যাচ্ছে? মিস্টার রক্ষিত চলে গেলেন। একটা নতুন কথা বলে গেলেন বটে। ভদ্রলোক। আত্মহত্যার কথাটা আমার মনেই হয়নি। ফেলুদা মিস্টার রক্ষিতের কথায় যেন আমল না। দিয়েই আবার কৈলাসের বাঁ দিক দিয়ে পাহাড়ে উঠতে আরম্ভ করল। আধঘণ্টা আগেই দেখেছিলাম খাদের পাশে লোকজন দাঁড়িয়ে আছে, এখন দেখছি একটি লোকও নেই। মনে মনে বললাম শুভঙ্কর বাস মরে গিয়ে আমাদের কাজের সুবিধে করে দিয়েছেন। ফেলুদা দেখলাম বেশ বেপরোয়াভাবে এগিয়ে গিয়ে খাদের ধারে দাঁড়িয়ে ঘাড় নিচু করে মন্দিরের পিছনে যেখানে মৃতদেহ পড়ে আছে সেখানটা দেখছে। যেখান থেকে পড়েছেন শুভঙ্কর বাস, সেই জায়গাটা আন্দাজ করে ও খাদের আশপাশটা খুব ভাল করে দেখতে লাগল। মাটিতে একটা গর্ত। লোক চলাচলে মাটি ঢুকে সেটা খানিকটা বুজে এসেছে, কিন্তু তাও ব্যাগ থেকে ভাঁজ করা স্কেলটা খুলে তার মধ্যে ঢোকাতে সেটা প্রায় দেড় হাত ভেতরে চলে গেল। গর্তটা খাদ থেকে হাত তিনেক দূরে। এবার ফেলুদা গর্তটার ঠিক সামনে খাদের ধারটা পরীক্ষা করতে লাগল। আমি আর লালমোহনবাবুও দেখছি আর বেশ বুঝতে পারছি কোন জিনিসটা ফেলুদার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। খাদের ধারের মাটির উপর একটা গভীর খাঁজ পড়েছে। কিছু বুঝতে পারছিস, তোপসে? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল। আমি চুপ করে আছি দেখে সে নিজেই উত্তর দিল— এটা দড়ির দাগ। একটা শাবল গোছের জিনিস গভীরভাবে পুঁতে সেটায় একটা দড়ি বেঁধে খাদের ভিতর ঝুলিয়ে সেটা ধরে কেউ নেমেছিল বা নামতে চেষ্টা করেছিল। কাল রাত্রে খস খসি শব্দটা মনে পড়ছে? সেটা ছিল দড়িটাকে টেনে তোলার শব্দ। সামনে দিয়ে ঢোকার উপায় নেই, তাই পিছন দিয়ে ঢোকার এই ব্যবস্থা। লালমোহনবাবু বললেন, কিন্তু দড়ি হলে…একশো ফুট.মানুষ ধরে নামবে…সে তো মোক্ষম দড়ি হতে হবে মশাই। নাইলনের দড়ি। হালকা, অথচ প্ৰচণ্ড শক্ত, বলল ফেলুদা। আমি বললাম, তার মানে তো শুভঙ্কর বোস ছাড়া আরেকজন লোক ছিল? ন্যাচারেলি। সেই লোকই দড়ি টেনে তুলেছে, সেই শাবল-দড়ি সরিয়ে ফেলেছে। সে শুভঙ্কর বোসের শত্রু বা মিত্র সেটা এখনও ষোলো আনা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না, তবে একটা কারণে শত্রু বলেই মনে হয়। আমরা ফেলুদার দিকে চাইলাম। ফেলুদা তার শার্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা ছোট্ট জিনিস বার করে হাতের তেলোয় ধরে আমাদের দেখাল। একটা ছেঁড়া কাপড়ের টুকরো। নীল রঙের কাপড়। কাল কাকে দেখেছি নীল শার্ট গায়ে? মিস্টার জয়ন্ত মল্লিক। কোথায় পেলে ওটা?—কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলাম। ফেলুদা বলল, উপূড় হয়ে পড়েছিল শুভঙ্কর বাস। হাত দুটো ছড়ানো। বাঁ হাতটা মুঠো অবস্থায়। দু আঙুলের মাঝখান দিয়ে টুকরোটা বেরিয়ে ছিল। দুজনে ধস্তাধস্তি হয় খাদের ধারে। শুভঙ্কর শার্ট খামচিয়ে ধরে। তারপর পড়ে যায়। টুকরোটা হাতে ছিঁড়ে আসে। ওপর থেকে ঠেলে ফেলে দিয়েছিল কি? লালমোহনবাবু প্রশ্ন করলেন। ত্‌তার মানে তো ম্‌-মাডার। ফেলুদা লালমোহনবাবুর কথায় কোনও মন্তব্য না করে গভীরভাবে বলল, একটা কথা বলতেই হবে—কৈলাস এখনও অক্ষত রয়েছে, আর সেটার জন্য দায়ী শুভঙ্কর বোস। তিনি মরলেন বলেই মূর্তি চারকে কাজ না সেরেই পালাতে হল। আর সেই সঙ্গে লালমোহনবাবুর ভবিষ্যদ্বাণীও ফলে গেল। কৈলাসে সত্যিই লাশ পাওয়া গেল! খাদের মাথা থেকে যখন নিচে নামলাম ততক্ষণে ফিল্ম কোম্পানির লোকেরা সরে পড়েছে। তার বদলে এখন স্থানীয় লোকের ভিড়। আর আমেরিকান গাড়ির বদলে রয়েছে একটা জিপ। একজন বছর পয়ত্ৰিশের স্মার্ট ভদ্রলোক ফেলুদাকে দেখে এগিয়ে এলেন। ইনিই নাকি মিস্টার কুলকার্নি-টুরিস্ট গেস্ট হাউসের ম্যানেজার। ফেলুদার সঙ্গে ইংরেজিতে কথা হল। ভদ্রলোক বললেন, কাল রাত্রে যে মিস্টার বোস ফেরেননি। সেটা আজ ভোরে জানা গেছে। একটি বেয়ারাকে পাঠিয়েছিলাম ওর খোঁজ করতে, সে না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে আসে। এখন কী ব্যবস্থা হচ্ছে? ফেলুদা প্রশ্ন করল। কুলকার্নি বললেন, আওরঙ্গাবাদে খবর পাঠানো হয়েছে। সি ডি ভ্যান আসছে, ডেডবডি মর্গে নিয়ে যাবে। মিস্টার বোসের ভাই আছেন দিল্লিতে। লাশ সনাক্ত করার ব্যাপারে তাকে খবর পাঠানো হচ্ছে। …ভেরি স্যাড! ভদ্রলোক সত্যিই পণ্ডিত ছিলেন। আগেও একবার এসেছিলেন—সিকসটি এইটে। গেস্ট হাউসেই ছিলেন। এলোরার ওপর বই লিখছিলেন। আপনাদের এখানে থানা নেই? একটা পুলিশ আউটপোস্ট আছে। ছোট জায়গা তো! একজন অ্যাসিসন্টান্ট সাব-ইনসাপেক্টর চার্জে আছেন। মিস্টার ঘোটে। আপাতত ডেডবডি ইনসাপেক্ট করছেন। আমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে পারেন? সার্টেনলি!…ভাল কথা— কুলকার্নি কী যেন একটা গোপনীয় কথা বলতে চাইছেন, কিন্তু আমরা দুজন বাইরের লোক রয়েছি বলে ইতস্তত করছেন। ফেলুদা বলল, আপনি এদের সামনে বলতে পারেন। কুলকার্নি আশ্বস্ত হয়ে বললেন, আজ সকালে বম্বেতে একটা ট্রাঙ্ক কল হয়েছে। মল্লিক? হ্যাঁ। কী বলল নোট করেছেন? কুলকার্নি পকেট থেকে একটা কাগজের স্লিপ বার করে সেটা থেকে পড়ে বললেন, মে বালু আচে। আজ রওয়ানা হচি। মেয়ে ভাল আছে, আজ রওনা হচ্ছি। আবার সেই মেয়ের ব্যাপার। যাবার কথা বলেছে কিছু? ফেলুদা চাপা উত্তেজনার সঙ্গে প্রশ্ন করল। কুলকার্নি বললেন, উনি তো আজই সকলে যেতে চাইছিলেন, কিন্তু আমি আপনার কথা ভেবেই একটা ফন্দি বার করে যাওয়াটা পিছিয়ে দিয়েছি। ওর ট্যাক্সির ড্রাইভারকে টিপে দিয়েছি। ডিফারেনসিয়াল গণ্ডগোল—গাড়ি সারাতে টাইম লাগবে। ব্রাভো! আপনি অত্যন্ত বুদ্ধিমানের কাজ করেছেন। ফেলুদার তারিফে কুলকার্নির চোখ খুশিতে জ্বলজ্বল করে উঠল। ফেলুদা একটা চারমিনার ধরিয়ে বলল, ভাল কথা-আপনার এই ঘোটে লোকটি কেমন? বেশ লোক। তবে মনমরা হয়ে থাকে। এ জায়গা তার ভাল লাগে না। কবে। প্রোমোশন হবে, আওরঙ্গাবাদে পোস্টেড হবে, তাই দিন গুনছে। …আসুন না, আলাপ করিয়ে দিই। মিস্টার ঘোটে কেভ থেকে বেরিয়ে এসেছেন, কাছাকাছির মধ্যেই ছিলেন, কুলকার্নি তাঁকে ডেকে এনে ফেলুদাকে বিখ্যাত প্রাইভেট ডিটেকটিভ বলে তাঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। ভদ্রলোক লম্বায় সাড়ে পাঁচ ফুট, চওড়াতেও প্রায় ততখানিই বলে মনে হয়, তার উপরে আবার চার্লি চ্যাপলিনের মতো গোঁফ। কিন্তু মোটা হলে কী হবে, হাঁটাচলা বেশ চটপটে। ঘোটের সঙ্গে কথা বলার আগে ফেলুদা আমাদের দিকে ফিরে বলল, তোরা বরং বাংলোয় ফিরে যা-আমি ভদ্রলোকের সঙ্গে একটু কথা বলে আসছি। কী আর করি। গেলাম ফিরে বাংলোয়। ভোরে শুধু চা খেয়ে বেরিয়েছিলাম, তাই বেশ খিদে পাচ্ছিল। বারান্দায় গিয়ে চৌকিদারকে হাঁক দিয়ে দুজনের জন্য ডিমরুটি করতে বলে দিলাম। ঘরে ফিরে এসে দেখি লালমোহনবাবু কেমন যেন বোকা বোকা ভাব করে খাটে বসে আছেন। আমার্কে দেখে বললেন, আমরা কি বেরোবার সময় ঘরের দরজা বন্ধ করে। গিয়েছিলাম? আমি বললাম, না তো। নেবার মতো কীই বা আছে বলুন! তা ছাড়া এরা তো সকালবেলা ঘর ঝাড়পোছ করে, তাই…কেন, কিছু হারিয়েছে নাকি? না, কিন্তু জিনিসপত্তর সব ওলট-পালট হয়ে আছে। আমার খাটে বসে আমার বাক্স ঘেঁটেছে। এই কিছুক্ষণ আগে। খাট এখনও গরম হয়ে আছে। তোমার বাক্সটা দেখো তো। সুটকেসটা খোলামাত্র বুঝতে পারলাম সেটা কেউ ঘাঁটাঘাঁটি করেছে। যেটা যেখানে ছিল সেটা সেখানে নেই। শুধু বাক্স না, বালিশ-টালিশও এদিক ওদিক হয়ে আছে। এমন কী থাটের তলাতেও যে খুঁজেছে সেটা আমার চটি জোড়া যেভাবে রাখা হয়েছে তার থেকে বুঝতে পারছি। লালমোহনবাবু বললেন, কীসের জন্য সবচেয়ে ভয় ছিল জান? আমার নেটবুকটা। সেটা দেখছি নেয়নি। অন্য কিছু নিয়েছে নাকি? কই, কিছুই তো নিয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। তোমার? আমারও তাই। কিছুই নেয়নি। যে এসেছিল সে বিশেষ কোনও একটা জিনিস খুঁজতে এসেছিল। সেটা পায়নি। একবার চৌকিদারকে জিজ্ঞেস করলে হয় না? কিন্তু চৌকিদারকে জিজ্ঞেস করে কোনও ফল হল না। সে বাজার করতে গিয়েছিল, তখন যদি কেউ এসে থাকে। এখানে কোনওদিন কিছু চুরিটুরি যায় না, কাজেই বাইরের লোক এসে ঘরে ঢুকে জিনিসপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে যাবে এটা তার কাছে খুবই আশ্চর্য লাগল। হঠাৎ মনে হল ফেলুদার ঘরে লোক ঢুকেছিল কি না জানা দরকার। গিয়ে দেখি ফেলুদা দরজা লক করে গেছে। সেটার অবিশ্যি একটা কারণ আছে। ও নিজে ছদ্মবেশে রয়েছে বলে ওর একটু সাবধান হতে হয়। লালমোহনবাবু বললেন, একবার মিস্টার রক্ষিতকে জিজ্ঞেস করবে নাকি? কাল–রাত্রে জানাল দিয়ে টর্চের খেলা দেখে আমার এমনিই রক্ষিত সম্বন্ধে একটা কৌতূহল হচ্ছিল, তাই লালমোহনবাবুর প্রস্তাবটা মেনে নিয়ে দুজনে ভদ্রলোকের দরজায় গিয়ে আস্তে করে টাকা মারলাম। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই দরজা খুলে গেল। কী ব্যাপার? ভেতরে এসে। ভদ্রলোক যে খুব একটা খুশি খুশি ভাব দেখালেন তা নয়; তাও যখন ডাকছেন তখন গেলাম। আপনার ঘরেও কি লোক ঢুকেছিল? লালমোহনবাবু ঢুকেই প্রশ্ন করলেন। ভদ্রলোক লালমোহনবাবুর দিকে তাকাতেই বুঝলাম ভাবগতিক ভাল না। চাপা অথচ ঝাঁঝালো গলায় বললেন, আপনাকে বলে তো লাভ নেই, কারণ আপনি কানে শোনেন না, কাজেই আপনার ভাগনেটিকেই বলছি। —লোক শুধু ঢোকেনি, আমার একটি অত্যন্ত কাজের জিনিস সযত্নে তুলে নিয়ে গেছে। কী জিনিস? আমি ভয়ে ভায়ে জিজ্ঞেস করলাম। আমার রেনকোট। বিলিতি রেনকোট। আজ পঁচিশ বছর ধরে ব্যবহার করছি। মেজোমামা চুপ। কালা সেজে আছেন। আমি খুব জোরে চেঁচিয়ে তাকে খবরটা দিয়ে দিলাম। লালমোহনবাবু বললেন, কাল রাত্রে নিয়েছিল কি? কাল দেখলুম। আপনি কী যেন খুঁজছেন। আপনার টর্চটা… না। কাল রাত্রে একটা চামচিকে ঘরে ঢুকেছিল। বাতি নিভিয়ে টর্চ জেলে সেটাকে তাড়াতে চেষ্টা করছিলুম। কাল আমার কোনও জিনিস খোয়া যায়নি। গেছে আজ। সকালে। আর আমার ধারণা সেটা নিয়েছে চৌকিদারের ওই ছেলেটা। এ কথাটাও চেঁচিয়ে মেজোমামাকে শুনিয়ে দিলাম। উনি বললেন, শুনে দুঃখিত হলাম। ছেলেটির দিকে চোখ রাখতে হয় এবার থেকে। এর পরে আর কিছু বলার নেই। আমরা ভদ্রলোককে ডিসটর্ব করার জন্য ক্ষমা চেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। চৌকিদার ডিমরুটি এনে দিয়েছিল, দুজনে খাবার ঘরে বসে খেলাম। আমেরিকায় ডিম কী করে ভজে জানি না, আমাদের এই খুলদাবাদের ডিম ফ্রাই বেশ ভালই লাগছিল। ঘরে কে ঢুকে থাকতে পারে সেটা ভাবতে মনটা খচা খচা করছিল, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সেটা হয়তো সত্যিই চৌকিদারের ওই ছেলেটা! ও মাঝে মাঝে বাংলোর পশ্চিমদিকের মাঠাঁটায় পায়চারি করে, আর পদার ফাঁক দিয়ে আমাদের দিকে আড়চোখে দেখে, সেটা লক্ষ করেছি। যদিও ফেলুদা বাংলোয় ফিরে যেতে বলেছিল, তার মানে যে ঘরেই বসে থাকতে হবে এমন কোনও কথা আছে কি? চাবি দিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে আমরা বাংলোর বাইরে রাস্তায় এলাম। বাংলোর ঠিক সামনে থেকে গেস্ট হাউসটা দেখা যায় না, একটা অচেনা গাছ সামনে পড়ে। গাড়ি স্টার্ট দেবার একটা শব্দ পেয়ে একটু এগিয়ে গেলাম। এবার গেস্ট হাউসটা দেখা যাচ্ছে। আওরঙ্গাবাদ থেকে যে ট্যাক্সিটা মিস্টার রক্ষিত আর লুইসনকে নিয়ে এসেছিল, সেটা যাবার জন্য তৈরি, ছাতের উপর মাল চাপানো রয়েছে, আমেরিকান ক্রোড়পতি মিস্টার স্যাম ল্যুইসন বেয়ারাকে বকশিশ দিচ্ছেন। কিন্তু ইনি আবার কে? আরেকটি লোক গেস্ট হাউস থেকে বেরিয়ে এসেছেন, লুইসনের সঙ্গে হাত নেড়ে কথা বলছেন। লুইসন দুবার মাথা নাড়ল। তার মানে কোনও একটা প্রস্তাবে রাজি হল। এবার অন্য ভদ্রলোকটি আরার গেস্ট হাউসে ঢুকে একটা সুটকেস হাতে নিয়ে বেরোলেন। ড্রাইভার গাড়ির পিছনের ডালা খুলে দিল। বাক্স ভিতরে ঢুকে গেল। ডালা বন্ধ হল। আমার বুকের ভিতর ভীষণ ধুকপুকুনি। লালমোহনবাবু আমার হাত খামচে ধরলেন। জয়ন্ত মক্সিক নিজের গাড়ির জন্য অপেক্ষা না করে আমেরিকানের সঙ্গ নিয়ে পালাচ্ছেন। ড্রাইভার তার জায়গায় গিয়ে বসল। চৌকিদারের সাইকেল?-আমি চেঁচিয়ে উঠলাম। ট্যাক্সি স্টার্ট দেবার শব্দ পেলাম। আমি ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে গিয়ে কোনও রকমে টেনে হিঁচড়ে সাইকেলটাকে বাইরে আনলাম। উঠে পড়ুন। লালমোহনবাবুর ভাব দেখে মনে হল তিনি জীবনে এই প্রথম সাইকেলের পিছনে চাপলেন। আমি জানি অন্য সময় হলে চাপতেন না-কিন্তু অপরাধী পালিয়ে যাচ্ছে, এ ছাড়া গতি নেই। ট্যাক্সি বেরিয়ে চলে গেছে। আমি প্ৰাণপণে পোডাল করে চলেছি। জটায়ু আমার কোমর খামচে ধরেছেন। সাত বছর বয়সে সাইকেল চালাতে শিখেছি। ফেলুদাই শিখিয়েছিল। অ্যাদ্দিনে সেটা কাজে দিল। বিশ মিনিটের পথ পাঁচ মিনিটে পৌঁছে গেলাম। ওই যে ফেলুদা-ওই যে ঘোটে, কুলকার্নি। ফেলুদা! মিস্টার মল্লিক পালিয়েছেন-সেই আমেরিকানের ট্যাক্সিতে-এই পাঁচ মিনিট আগে? এই একটা খবরের দরুন কয়েক মুহূর্তের মধ্যে এত রকম ঘটনা ঘটে গেল যে, এখনও ভাবতে মাথা ভোঁ ভোঁ করে। জিপিও যে ইচ্ছে করলে ঘণ্টায় ষাট মাইল স্পিড়ে ছুটতে পারে সেটা এই প্রথম জানলাম। আমি আর জটায়ু পিছনে ঘাপটি মেরে বসে আছি, সামনে ড্রাইভারের পাশে ঘোটে আর ফেলুদা, দেখতে দেখতে ট্যাক্সি কাছে চলে আসছে, তারপর হর্ন দিতে দিতে সেটাকে ছাড়িয়ে এগিয়ে গিয়ে থামল, ক্রোড়পতি লুইসনের চোখরাঙনি আর ১ বাছাই বাছাই মার্কিনি গালির বিস্ফোরণ, আর তারই মধ্যে মল্লিকের ফ্যাকাসে মুখ, একবার বাধা দিতে গিয়ে কেঁচো হয়ে যাওয়া, আর তারপর ঘোটে তার সুটকেস খুলল, আর তা থেকে টার্কিশ টাওয়েলের প্যাঁচ খুলে বেরোল যক্ষীর মাথা, আর লালমোহনবাবুর হাফ ছেড়ে বলা এন্ডস ওয়েল দ্যাট অলস ওয়েল, আর লুইসনের হা হয়ে যাওয়া আর দুবার বাট…বাট বলা, আর সবশেষে লুইসন ট্যাক্সি করে আওরঙ্গাবাদ, আর আমরা বামাল সমেত চোর গ্রেপ্তার করে খুলদাবাদ। মল্লিক অবিশ্যি এখন ঘোটের জিম্মায়। অৰ্থাৎ তিনি এখন খুলদাবাদ পুলিশ আউটপোস্টের বাসিন্দা। ভদ্রলোক এত হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন যে, কোনও কথাই বলতে পারেননি। ঘোটে আমাদের গেস্ট হাউসে নামিয়ে দিলেন, কারণ কুলকার্নি ওখানে উৎসুক হয়ে অপেক্ষা করছিলেন। মিশন সাকসেসফুল শুনে কুলকার্নি অবিশ্যি দারুণ খুশি হলেন, কিন্তু ফেলুদা যেন তার উৎসাহে খানিকটা ঠাণ্ডা জল ঢেলেই বলল যে, এখনও কাজ বাকি আছে। -আর তা ছাড়া আপনি বম্বের ওই নাম্বারটা নিয়ে কিন্তু এনকোয়ারিটা করবেন, আর খবর পেলেই আমাকে জানাবেন। শেষের ইনস্ট্রাকশনটার ঠিক মানে বোঝা গেল না, তবে এটা নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনও প্রয়োজন আছে বলেও মনে হল না। কুলকার্নি সকলের জন্য কফি বলেছিলেন, সেটা খেতে খেতে হঠাৎ মনে পড়লে আমাদের ঘরে যে লোক ঢুকে জিনিসপত্তর ঘাঁটাঘাঁটি করেছে, আর রক্ষিতের ঘর থেকে রেনকোট চুরি গেছে, সে খবরটা ফেলুদাকে দেওয়া হয়নি। সেটা ওকে বলতে ও কয়েক মুহূর্ত ভুকুটি করে ভাবল। তারপর কুলকার্নিকে জিজ্ঞেস করল চৌকিদার লোকটি কেমন। কে, মোহনলাল? ভেরি গুড ম্যান। সতেরো বছর চৌকিদারি করছে, কোনও দিন কেউ কমপ্লেন করেনি। ফেলুদা আরেকটু ভেবে বলল, কোনও জিনিস নেয়নি বলছিস? আমি বেশ জোরের সঙ্গে মাথা নেড়ে না বললাম, আর সেই সঙ্গে এটাও বললাম যে রক্ষিত চৌকিদারের ছেলেকে সন্দেহ করছে। চলুন, লালমোহনবাবু-আপনি বলছেন লোকটা আপনার খাটে বসে খাট গরম করে দিয়েছিল—আপনার বাক্সে কী আছে একবার দেখে আসি; আমরা চলি, মিস্টার কুলকার্নি। এটা আপাতত আপনার জিন্মাতেই থাক। তোয়ালেতে মোড়া যক্ষীর মাথাটা ফেলুদা কুলকার্নিকে দিয়ে দিল। তিনি সেটা তাঁর আপিসের সিন্দুকে ঢুকিয়ে দিয়ে তাতে চাবি দিয়ে দিলেন। ফেলুদা বলে এল সে অল্পক্ষণের মধ্যেই ফিরবে। বাংলোয় এসে আমাদের ঘরের দরজা বন্ধ করে ফেলুদা আমার আর লালমোহনবাবুর জিনিস খুব ভাল করে ঘেঁটে দেখল। জামাকাপড় ছাড়া লালমোহনবাবুর সুটকেসে যা ছিল তা হল একটা হামিওপ্যাথিক ওষুধের বাক্স, দু খণ্ড অপরাধ-বিজ্ঞান, তাঁর নোটবুক, আর বেলুচিস্তানের বিষয়ে একটা ইংরেজি বই। নোটবুকটা ফেলুদা এতক্ষণ ধরে উলটে পালটে দেখল কেন সেটা বুঝতে পারলাম না। সব দেখাটেখা হয়ে গেলে বলল, যা আন্দাজ করছি তা যদি ঠিক হয়, তা হলে এসপার ওসপার যা হবার আজই হবে। আর তাই যদি হয়, তা হলে মনে হচ্ছে তোদের একটা জরুরি ভূমিকা নিতে হবে। সব সময় মনে রাখবি যে আমি আছি পেছনে, ভয়ের কিছু নেই। মল্লিকের অ্যারেস্টের কথা কাউকে বলবি না, এখন ঘর থেকে বেরোবি না। এমনিতেও হয়তো বেরোতে পারবি না, কারণ, মনে হয় বৃষ্টি আসছে। ফেলুদা কথাগুলো বলতে বলতে জানালার দিকে মুখ ফিরিয়েছিল, এখন দেখলাম ও নিঃশব্দে হেঁটে জানালার কাছটায় গিয়ে দাঁড়াল! আমারও চোখ গেল জানালার দিকে। এটা পশ্চিম দিক। এদিকে খানিক দূর ঘাস জমির পরে কতগুলো বড় বড় গাছ, তার মধ্যে ইউক্যালিপটাস গাছটা আমার চেনা। একজন লোককে গাছপালার পিছন থেকে বেরিয়ে এসে ঘাস পেরিয়ে আমাদের বাংলোর সামনের দিকে চলে আসতে দেখলাম। তার এক মিনিট পরেই লোকটা আমাদের খাবার ঘরে এসে ঢুকল, আর তার পরেই একটা দরজা চাবি দিয়ে খোলা, আর তারপর সেটাকে ভিতর থেকে বন্ধ করার শব্দ পেলাম। ফেলুদা দুবার মাথা নেড়ে চাপা গলায় বলল-ঠিক আছে, ঠিক আছে। লোকটা আর কেউ নন-আমাদের প্রতিবেশী মিস্টার রক্ষিত। আমার কাছ থেকে সময় মতো নির্দেশ পাধি, সেই অনুযায়ী কাজ করবি। এই শেষ কথাটুকু বলে ফেলুদা ঘর থেকে বেরিয়ে চলে গেল। আমরা দুজনে ঘরে বসে রইলাম। বাইরে মেঘের গর্জন শোনা যাচ্ছে। বাধহয় কালো মেঘে। সূৰ্যটা ঢেকে দিয়েছে বলে আলো কমে এসেছে। বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ কেন জানি মনে হল যে, মিস্টার রক্ষিতের চেয়ে বেশি। রহস্যময় লোক আর কেউ নেই, কারণ ওর সম্বন্ধে আমরা প্রায় কিছুই জানতে পারিনি। আর মল্লিক? মল্লিক, সম্বন্ধেও কি সব জেনে ফেলেছি? জানি না। হঠাৎ মনে হচ্ছে কিছুই জানি না। মনে হচ্ছে যে অন্ধকারে ছিলাম, এখনও সেই অন্ধকারেই আছি। বারোটার পর থেকেই তুমুল বৃষ্টি শুরু হল, আর তার সঙ্গে মেঘের গর্জন। ফেলুদা বলে গেছে আজকেই ক্লাইম্যাক্স, আর তাতে আমাদের হয়তো একটা ভূমিকা নিতে হবে। আমার কাছে সবই অন্ধকার, লালমোহনবাবুর কাছেও তাই। কাজেই ভূমিকাটা যে কী হতে পারে সেটা ভেবে কোনও লাভ নেই। মল্লিক অ্যারেস্টেড, যক্ষীর মাথা সিন্দুকে বন্দি, এর পরেও যে আর কী ঘটনা থাকতে পারে সেটা ভেবে বার করার সাধ্যি আমাদের নেই। একটার সময় চৌকিদার এসে বলল খান তৈয়ার হ্যাঁয়। ফেলুদাকে ছাড়াই খেতে গেলাম। সে নিশ্চয়ই গেস্ট হাউসের বাবুর্চির রান্না খাচ্ছে। আমরা দুজনে টেবিলে বসার কয়েক মিনিটের মধ্যেই মিস্টার রক্ষিতও এসে পড়লেন। সকালে তাকে গোমড়া মনে হচ্ছিল, এখন দেখছি বেশ স্বাভাবিক মেজাজ। বললেন, এমন দিনে চাই খিচুড়ি। বাংলাদেশের খিচুড়ি কি আর এরা করতে জানে? সঙ্গে ইলিশ মাছ ভাজা, ডিমের বড়া, বেগুনি.এ খাওয়ার জুড়ি নেই। এলাহাবাদেও আমি বাংলাদেশের অভ্যাস ছাড়িনি। ভদ্রলোক যে খেতে ভালবাসেন সেটা বেশ বোঝা যায়। লালমোহনবাবুও তাঁর চেহারার অনুপাতে ভালই খান, তবে এখানের চালে কাঁকরটা তাঁর একেবারেই বরদাস্ত হচ্ছে না। দাঁতে পড়লেই এমন ভাব করছেন যেন মাথায় বাজ পড়ল। ডালটা শেষ করে যখন মাংসটা পাতে ঢেলেছি তখন একটা গাড়ির আওয়াজ পেলাম। আর তারপরেই খ্যানখ্যানে গলায় চৌকিদার বলে একটা হাঁক। চৌকিদার ব্যস্তভাবে একটা ছাতা নিয়ে বাইরে চলে গেল। মিস্টার রক্ষিত হাতের রুটিতে মাংস পুরে মুখে দিয়ে বললেন, এই দুযোগের দিনে আবার টুরিস্ট। সাদা গোঁফ সাদা ফ্রেঞ্চকটি দাড়িওয়ালা চশমা পরা একজন ভদ্রলোক ক্ষতি খুলতে খুলতে ভেতরে এসে ঢুকলেন। পিছনে চৌকিদার, তার হাতে কুমিরের চামড়ার, একটা আদ্যিকালের সুটকেস। ভদ্রলোক হিন্দিতে বলে দিলেন তিনি লাঞ্চ করে এসেছেন, তার জন্যে আর কোনও হাঙ্গাম করতে হবে না। তারপর আমাদের দিকে ফিরে বাংলায় বললেন, কাকে নাকি অ্যারেস্ট করেছে শুনলাম? ফেলুদার বারণ, তাই আমরা বোকার মতো চুপ করে রইলাম। রক্ষিত যেন একটু অবাক হয়েই বললেন, কাকে? কখন? সাম ভ্যান্ডাল। গুহার ভেতর থেকে মূর্তির মুণ্ডু ভেঙে নিচ্ছিল-ধরা পড়েছে। অ্যাদ্দূর এসে যদি দেখি কেভে ঢুকতে দিচ্ছে না তা হলেই তো চিত্তির। আপনারা এখনও কিছু শোনেননি? রক্ষিত বললেন, এখনও খবরটা এসে পৌঁছয়নি বাংলোয়। এনিওয়ে-ধরা যে পড়েছে সেইটেই বড় কথা। এখানকার পুলিশের এলেম আছে বলতে হবে। ভদ্রলোক তাঁর ঘরে ঢুকে যাবার বেশ কিছুক্ষণ পর অবধি শুনলাম। তিনি আপন মনে বকবক করছেন। ছিটগ্ৰস্ত। আড়াইটে নাগাদ বৃষ্টি থামল। তিনটের কিছু পরে পশ্চিমের জানালা দিয়ে দেখলাম সেই ফ্রেঞ্চকটি দাড়ি দূরের ইউক্যালিপটাস গাছটার দিকে যাচ্ছে। পাঁচ মিনিট পরে দেখলাম তিনি ফিরে আসছেন। প্রায় সাড়ে চারটের সময় যখন চা নিয়ে এল তখন হঠাৎ খেয়াল করলাম যে দরজার সামনে মেঝেতে একটা ভাঁজ করা সাদা কাগজ পড়ে আছে। খুলে দেখলাম সেটা ফেলুদার মেসেজ– পনেরো নম্বর গুহায় যাবি সন্ধ্যা সাতটায়। দোতলায় দক্ষিণ-পূর্ব কোণে অপেক্ষা করবি। ফেলুদা নেপথ্যে থেকে ক্যামপেন চালিয়ে যাচ্ছে। এ এক নতুন ব্যাপার বটে। এ জিনিস এর আগে কখনও হয়নি। বৃষ্টি আর নামেনি। সাড়ে ছটায় যখন বাংলো থেকে বেরোচ্ছি। তখন ফ্রেঞ্চকািট আর রক্ষিত দুজনেই যে-যার ঘরে রয়েছে, কারণ দুটো ঘরেই বাতি জ্বলছে। রাস্তায় বেরিয়ে এসে লালমোহনবাবু বার আষ্টেক বিড়বিড় করে দুর্গ দুর্গ বললেন। আমার নিজের মনের ভগব আমি লিখে বোঝাতে পারব না, তাই চেষ্টাও করব না। হাত দুটো ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল তাই পকেটের ভিতর গুঁজে দিলাম। সাতটা বাজতে দশ মিনিটে আমরা কৈলাসের কাছে পৌঁছলাম। পশ্চিমের আকাশে এখনও যথেষ্ট আলো রয়েছে, কারণ জুন মাসে এখানে সাড়ে ছটার পরে সূৰ্য্যস্ত হয়। যেদিকে পাহাড় আর গুহা সেদিকটা অন্ধকার হয়ে এসেছে, তবে আকাশে মেঘ নেই। আমরা কৈলাস থেকে ডানদিকে মোড় নিলাম। পরের গুহাটাই পনেরো নম্বর গুহা। দশাবতার গুহা। খাদের উপর থেকে এরই সামনে ফেলুদা নুড়ি পাথর ফেলেছিল। গুহার সামনে পাহারা নেই। আমরা দুজনে এগিয়ে গেলাম। প্রথমে একটা প্ৰকাণ্ড চাতাল, তার মাঝখানে একটা ছোট্ট মন্দির। আশেপাশে দেখার সময় নেই, তাই আমরা চাতাল পেরিয়ে বেশ কয়েক ধাপ সিঁড়ি উঠে গুহার মধ্যে ঢুকলাম। এটা নিচের তলা। আমাদের যেতে হবে দোতলায়! সঙ্গে টর্চ, আছে, কিন্তু এখনও তার প্রয়োজন হচ্ছে না। উত্তর-পশ্চিম কোণে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি। আর কেউ গুহার মধ্যে আছে কি না জানি না, তাই যতটা সম্ভব শব্দ না করে আমরা দোতলায় উঠতে লাগলাম। দেড়তলায় উঠে একটা খোলা জায়গা। সেখানে দেয়ালের গায়ে দেবদেবীর মূর্তি রয়েছে। আরও খানিকটা উঠে গিয়ে আমরা তিন দিক বন্ধ একটা প্ৰকাণ্ড হল ঘরে পৌঁছলাম। সারি সারি কারুকার্য করা থাম হলের ছাতটাকে মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। উত্তর আর দক্ষিণের দেয়ালে আশ্চর্য সব পৌরাণিক দৃশ্য খোদাই করা। ফেলুদার নির্দেশ অনুযায়ী আমরা দক্ষিণ-পূর্ব কোণের দিকে এগিয়ে চললাম। এদিকটা ক্ৰমে আলো থেকে দূরে সরে এসেছে, তাই টর্চ জ্বলিতে হল। নিশ্চয় আর কেউ নেই, অন্তত শত্রুপক্ষের কেউ নেই, না হলে ফেলুদা আমাদের আসতে বলত না—এই ভরসাতেই আমরা টর্চ জ্বেলেছি। ওই যে থামের ডানদিকের পিছনে দেখা যাচ্ছে অন্ধকার ঘুপচি কোণ। আমরা এগিয়ে গেলাম। নিচে সিঁড়ি ওঠার আগেই পা থেকে স্যান্ডাল খুলে নিয়েছিলাম, এখন দেখছি পাথর বেশ ঠাণ্ডা। জায়গায় পৌঁছে আবার স্যান্ডাল পরে নিলাম। তেরোশো বছর আগে পাহাড়ের গা কেটে তৈরি খোদাই করা পৌরাণিক দৃশ্যে ভরা গুহার ভেতর কী ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে তার কোনও ধারণা এখন পর্যন্ত করে উঠতে পারিনি। কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে জানি না; একটানা দাঁড়িয়ে থাকলে পা ধরে যাবে বলে আমরা দুজনেই গুহার কোণে দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসেছি, এমন সময় একটি জিনিসে চোখ পড়াতে বুকের ভিতরটা ধক করে উঠল। আমাদের সামনে হাত পাঁচেক দূরে একটা থামের পাশে আবছা অন্ধকারে একটা আলগা জিনিস পড়ে আছে। একটা লাল রঙের জিনিস। আর তার তলায় চাপা দেওয়া একটা চৌকো সাদা জিনিস। লালমোহনবাবু ফিস ফিস করে বললেন, একটা কাগজ বলে মনে হচ্ছে। দুজনে এগিয়ে গিয়ে যা দেখলাম তাতে মাথাটা বেশ কয়েকবার ঘুরে গেল, আর সেই সঙ্গে রহস্যটাও আরও ভালভাবে জটি পাকিয়ে গেল। তলার জিনিসটা কাগজই বটে, আর পেপার ওয়েট-টা হল-ভুবনেশ্বরের যক্ষীর মাথা!—যেটা আজই সকলে মল্লিকের সুটকেস থেকে বেরিয়ে কুলকার্নির সিন্দুকে লুকিয়ে ছিল। অন্ধকার বেশ বেড়েছে, তাই কাগজের লেখাটা পড়তে আবার টর্চ জ্বালতে হল। মাথাটা আপনার কাছে রাখুন। চাইলে দিয়ে দেবেন। এটা ফেলুদা লালমোহনবাবুকে উদ্দেশ করে লিখেছে। লালমোহনবাবু ধরা গলায় জয় মা তারা বলে মাথাটাকে দুহাতে তুলে নিয়ে বগলদাবী করে নিজের জায়গায় নিয়ে এলেন। আমি কাগজটা পকেটে পুরলাম। বাইরে ফিকে চাঁদের আলো! থামের ফাঁক দিয়ে পশ্চিমের আকাশ দেখা যাচ্ছে, সে আকাশের রং এখন আশ্চর্যরকম বেগুনি। ক্ৰমে সে রং বদলাল। চাঁদ বোধহয় বেশ ভাল ভাবে উঠেছে। গুহার মধ্যে জমাট বাঁধা অন্ধকারটা আর নেই। আটটা -লালমোহনবাবু যেন অনেকক্ষণ চেপে রাখা নিশ্বাস ছেড়ে কথাটা বললেন। একটা অতি ক্ষীণ শব্দ। সিঁড়ি দিয়ে কে যেন উঠছে। ধীরে ধীরে অতি সাবধানে পা ফেলছে। এইবার শব্দ বদলাল। এবার সমতল মেঝেতে হাঁটছে। এবারে দুই থামের ফাঁক। দিয়ে দেখা গেল। লোকটা থেমেছে-এদিক ওদিক দেখছে। একটা খচ শব্দের সঙ্গে সঙ্গে একটা লাইন্টার জ্বলে উঠল। এক সেকেন্ডের আলো, কিন্তু তাতেই মুখ চেনা হয়ে গেছে। জয়ন্ত মল্লিক। আবার মাথা গণ্ডগোল হয়ে গেল। এবার যদি মরা মানুষ শুভঙ্কর বোসও এসে হাজির হন। তা হলেও আশ্চর্য হব না। মল্লিক এগিয়ে এলেন, তবে আমাদের দিকে নয়। তিনি অন্য দিকের কোণে যাচ্ছেন। উত্তর-পূর্ব দিক। ওদিকে গাঢ় অন্ধকার। ভদ্রলোক সেই দিকে এগিয়ে গিয়ে অন্ধকারে হারিয়ে গেলেন। আমাদের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে, আর আমার মন বলছে-ফেলুদা কোথায়?…ফেলুদা কোথায়?…ফেলুদা কোথায়?… লালমোহনবাবু বাক্স রহস্যের ঘটনার পর বলেছিলেন ডিটেকটিভ উপন্যাস লেখা ছেড়ে দেবেন, কারণ বাস্তব জীবনে বানানো গল্পের চেয়ে অনেক বেশি অবিশ্বাস্য আর রোমাঞ্চকর সব ঘটনা ঘটে। এই যক্ষীর মাথার ঘটনার পরে উনি কী বলবেন কে জানে! চাঁদের আলো বেড়েছে। দূরে একটা কুকুর ডাকল। তারপর আরেকটা। তারপর থমথমে চুপ। তারপর আরেকটা শব্দ। এবার মেঝে দিয়ে হাঁটছে। এবার দুই থামের ফাঁক দিয়ে দেখা গেল তাকে। এখনও চেনা যাচ্ছে না। এবার সে লোক এগিয়ে এল। এবার আমাদেরই দিকে। প্রায় নিঃশব্দে এগিয়ে আসছে। এক পা এক পা করে। হঠাৎ চোখের সামনে চোখধাঁধানো আলো। লোকটা টর্চ জ্বেলেছে। শুধু টর্চই দেখছি, লোকটাকে দেখছি না। টৰ্চটা আমাদের উপর ফেলা। সেটা এগিয়ে এল। থামল। তারপর একটা চেনা গলার স্বর-চাপা, কিন্তু কথাগুলো ভীষণ স্পষ্ট– বামন হয়ে চাঁদে হাত? অ্যাঁ, বাছাধন? আবার হুমকি দিয়ে চিঠি লিখতে শেখা হয়েছে?–দশাবতার গুহায় আটটার সময় আসিবেন, সঙ্গে পাঁচশত টাকা আনিবেন।.তবে আপনার যাহা খেয়া গিয়াছে তাহ পাইবেন, নতুবা.-এ সব কেথেকে শেখা হল, ইতিহাসের অধ্যাপক? কথাগুলো কানে ঢুকছে না, এখনও কালা সেজে বসে আছ? এই ব্যাপারে তুমি জড়ালে কী করে? খাতায় আবার নোট করা রয়েছে দেখলাম।–ফকার ফ্রেন্ডশিপ ক্র্যাশ, ভুবনেশ্বরের যক্ষী, কৈলাসের মন্দির, প্লেনের টাইম…। আবার সঙ্গে একটা নাবালককে রেখেছি কেন? ও কি তোমার বডিগার্ড? আমার ডান হাতে কী আছে দেখতে পাচ্ছ কি? মিস্টার রক্ষিত। এক হাতে পিস্তল, এক হাতে টর্চ। লালমোহনবাবু দুবার আমি আমি বলে থেমে গেলেন। রক্ষিতের চাপা হুমকিতে গুহার ভেতরটা কেঁপে উঠিল– আমি আমি ছাড়ো। আসল মাল কোথায়? এই যো। আপনার জন্যই… লালমোহনবাবু যক্ষীর মাথাটা রক্ষিতের দিকে এগিয়ে দিলেন। ভদ্রলোক পিস্তলের হাত ঠিক রেখে, টর্চের হাত দিয়ে মাথাটাকে বগলদাবা করে নিয়ে ঝাঁঝালো সুরে বললেন, এ সব ব্যবসা সকলকে মানায় না, বুঝেছি? যেমন ছোট মুখে বড় কথা মানায় না, তেমন ছোট বুকে বড় সাধ মানায় না। মিস্টার রক্ষিতের কথা হঠাৎ থেমে গেল। কারণ, একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটছে। গুহার ভিতর। –বাইরের দিক থেকে একটা ধোঁয়ার কুণ্ডলী গুহার ভিতর ঢুকে চারদিক ছেয়ে ফেলছে, আর তার ফলে কালো কালো থামগুলো যেন তালগোল পাকিয়ে অদৃশ্য হয়ে আসছে। সেই ধোঁয়ার ভিতর থেকে হঠাৎ একটা গমগমে গলার স্বর শোনা গেল। ফেলুদার গলা; পাথরের মতো ঠাণ্ডা আর কঠিন সে গলা– মিস্টার রক্ষিত, আপনার দিকে, একটি নয়, এক জোড়া পিস্তল সোজা ত্যাগ করা রয়েছে। আপনি নিজের পিস্তলটা নামিয়ে ফেলুন। কী ব্যাপার? এ সবের অর্থ কী? মিস্টার রক্ষিত কাঁপা গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন। অর্থ খুবই সহজ, ফেলুদা বলল-আপনার অপরাধের শাস্তি দিতে এসেছি আমরা। অপরাধ একটা নয়—অনেকগুলো। প্রথম হল—ভারতের অমূল্য শিল্পসম্পদকে নির্মমভাবে ধ্বংস করা; দ্বিতীয়, এই শিল্পসম্পদকে অর্থের লোভে বিদেশিদের কাছে বিক্রি করা; আর তৃতীয়-শুভঙ্কর বোসকে নির্মমভাবে হত্যা করা। মিথ্যে! মিথ্যে।-রক্ষিত চিৎকার করে উঠলেন। -শুভঙ্কর বোস খাদের উপর থেকে পা হড়কে… মিথ্যেটা আমি বলছি না, বলছেন। আপনি। যে শাবল দিয়ে আপনি তাকে মেরেছিলেন। সেই শাবল রক্তমাখা অবস্থায় খাদ থেকে পঞ্চাশ হাত দূরে একটা মনসার ঝোপের ভিতর পাওয়া গেছে। শুভঙ্কর বোস জ্যান্ত অবস্থায় খাদে পড়লে তিনি নিশ্চয় চিৎকার করতেন; অথচ কৈলাসের পাহারাদার কোনও চিৎকার শোনেনি। আর তা ছাড়া আপনার একটা নীল শার্ট আপনি বাংলোর পূর্বদিকে গাছপালার মধ্যে লুকিয়ে রেখে এসেছিলেন। সেটা আমিই গিয়ে উদ্ধার করি। এই শার্টের একটা অংশ একটু ছেড়া। মিলিয়ে দেখলে দেখা যাবে যে শুভঙ্কর বোসের- মিস্টার রক্ষিত হঠাৎ একটা লাফ দিয়ে ধোঁয়ার মধ্যে দিয়ে পালাবার চেষ্টা করতেই নিমেষের মধ্যে তিনজন জাঁদরেল লোকের হাতে বন্দি হয়ে গেলেন। ডানদিকে জয়ন্ত মল্লিকের টর্চ জ্বলে উঠল। সেই আলোতে দেখলাম মেক-আপ ছাড়া ফেলুদাকে, মিস্টার ঘোটেকে, আর আরেকটি লোক, যে মিস্টার ঘোটের হুকুমে রক্ষিতের হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিল। ফেলুদা এবার জয়ন্ত মল্লিকের দিকে ফিরে বলল, মিস্টার মল্লিক, এবার আপনাকে একটা কাজ করতে হবে। ওই যে পিছনের গুহাটা দেখছেন, ওর মধ্যে গিয়ে দেখুন, বাঁদিকের কোনায় মিস্টার রক্ষিতের রেনকোটটা রয়েছে। ওটা নিয়ে আসুন। আয় তপসে–এই ধোঁয়ার মধ্যে আর বেশিক্ষণ থাকা চলবে না। আসুন লালমোহনবাবু! গেস্ট হাউসের ডাইনিং টেবিলে বসে ডিনার খেতে খেতে ফেলুদা আমাদের মনের ধোঁয়া দূর করছে। আমরা তিনজন ছাড়া রয়েছে মিস্টার মল্লিক, কুলকার্নি আর ঘোটে। হিন্দি আর ইংরেজি মিশিয়ে কথা হচ্ছে, আমি সেটা বাংলাতেই লিখছি। ফেলুদা বলল প্রথমেই বলে রাখি মিস্টার রক্ষিতের আসল নাম হল চট্টোরাজ। উনি একটি গ্যাং বা দলের সভ্য, যার ঘাঁটি হল দিল্লি। এই দলের উদ্দেশ্য হল ভারতের ভাল ভাল মন্দির থেকে মূর্তি বা মূর্তির মাথা ভেঙে নিয়ে বিদেশিদের কাছে বিক্রি করা। এই ধরনের দল হয়তো আরও আছে। আপাতত এই একটি দলকে শায়েস্তা করার রাস্তা আমরা পেয়েছি, কারণ চট্টোরাজকে আমরা এই ঘাঁটির হদিস এবং এর অন্যান্য সভ্যদের নাম বলতে বাধ্য করেছি। ভুবনেশ্বরের যক্ষীর মাথা চট্টোরাজই চুরি করেন, চট্টোরাজই সেটা কলকাতায় আনেন, চট্টোরাজই সেটা সিলভারস্টাইনের কাছে বিক্রি করেন, আবার প্লেন ক্র্যাশ হবার পর চট্টোরজই সিদিকপুরে গিয়ে পানু নামক ছেলেটির কাছ থেকে দশ টাকা দিয়ে সেটা উদ্ধার করে আনেন, এবং সেই মূর্তি সমেত চট্টোরাজই লুইসনকে ধাওয়া করে এলোরায় আসেন। এখানে আসার কারণ হল এক টিলে দুই পাখি মারা। এক পাখি হল লুইসনের কাছে সেটা বিক্রি করা, আর দ্বিতীয় হল কৈলাস থেকে আরেকটি কোনও টাটকা নতুন মাথা সরিয়ে নিয়ে যাওয়া। আমরা জানি এই দুটোর একটা উদ্দেশ্যও সফল হয়নি। লুইসন মূর্তি কিনতে রাজি হন, কিন্তু সেটা তাঁকে দেবার আগেই চট্টোরাজের হাত ছাড়া হয়ে যায়, ফলে তাকে ল্যুইসনের গালিগালাজ শুনতে হয়। আর মূর্তি চুরির ব্যাপারটা ভঙুল হয় একবার শুভঙ্কর বোসের অতর্কিত আবির্ভাবে, আর তার কিছু পরেই দশাবতার গুহার সামনে একটি নুড়ি পাথর ফেলার দরুন। ফেলুদা বোধহয় দম নেবার জন্য চুপ করল। আমার মাথা গুলিয়ে গেছে। আমি না। বলে পারলাম না-আর মিস্টার মল্লিক? ফেলুদা তার একপেশে হাসি হেসে বলল, মিস্টার মল্লিকের ব্যাপারটা খুবই সহজ। এতই সহজ যে প্রথমে আমিও ধরতে পারিনি। মিস্টার মল্লিক। চট্টোরাজকে ধাওয়া করছিলেন। কেন? যে কারণে আমি মিস্টার মল্লিককে ধাওয়া করছিলাম, ঠিক সেই একই কারণে। অৰ্থাৎ তিনিও মূর্তিটাকে উদ্ধার করতে চাচ্ছিলেন। অবিশ্যি এইখানেই মিলের শেষ নয়। ওঁর আর আমার পেশাও এক। উনিও আমারই মতো একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ। আমি অবাক হয়ে মিস্টার মল্লিকের দিকে চাইলাম। ভদ্রলোকের ঠোঁটের কোণে হাসি, তাঁর দৃষ্টি ফেলুদার দিকে। ফেলুদা বলে চলল, আমরা ফোন করে জেনেছি উনি বম্বের ভার্গব এজেন্সি নামে একটা প্রাইভেট ডিটেকটিভ কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত। এই কোম্পানির মালিক বাঙালি, নাম ঘোষ। এদেরই একটা তদন্তের ব্যাপারে মল্লিক কিছুদিন হল কলকাতায় আসেন, ওঁর এক বন্ধুর অবর্তমানে কুইনস ম্যানসনে তাঁর ফ্লাটে থাকেন, তাঁর গাড়ি ব্যবহার করেন। এই সব এজেন্সি সাধারণত মামুলি অপরাধের তদন্তু করে থাকে। কিন্তু মিস্টার মল্লিকের তাতে মন ভরছিল না। তিনি চাইছিলেন গোয়েন্দা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করতে। তাই না, মিস্টার মল্লিক? মিস্টার মল্লিক বললেন, ঠিক কথা। আর সেই সুযোগটা এসে যায় খুব আশ্চর্যভাবে। তদন্তের ব্যাপারেই গত বিষ্ণুদবার গিয়েছিলাম নগরীমলের দোকানে। সেখানে আমারই সামনে একটি মার্কিন ভদ্রলোক নগরমলকে একটা মূর্তির মাথা দেখালেন। আমার আর্ট সম্বন্ধে একটু আধটু জ্ঞান আছে, কিন্তু মাথাটা তখন আমার মনে কোনও দাগ কটেনি। শুধু জেনেছিলাম যে সাহেবের নাম সিলভারস্টাইন, আর উনি অত্যন্ত ধনী। পরদিন সকালে কাগজে ভুবনেশ্বরের মন্দিরের খবরটা পড়ি, আর তার আধা ঘণ্টার মধ্যে রেডিয়োতে শুনি যে সিলভারস্টাইন সিদিকপুরের কাছে প্লেন ক্র্যাশে মারা গেছে। তখনই মনে হয় মূর্তিটাকে উদ্ধার করতে পারলে আমার নাম হতে পারে। সে কথা তক্ষুনি বম্বেতে ফোন করে আমার বসকে জানিয়ে দিই। উনি তাতে রাজি হন। বলেন-কী হয় আমাকে ফোন করে জানিয়া। আমি কাজে লেগে যাই। কিন্তু আমার ভাগ্য খারাপ। আমি সিদিকপুরে পৌঁছানার পাঁচ মিনিট আগে আরেকটি ভদ্রলোক গিয়ে গ্রামের ছেলেদের কাছ থেকে মূর্তি আদায় করে নেন। ঘটনাটি ঘটে আমার চোখের সামনে, কিন্তু তখন আমার পক্ষে এ বিষয়ে কিছু করার উপায় ছিল না। আমি ঠিক করি ভদ্রলোককে ফলো করব। কিন্তু— ভদ্রলোকের গাড়ির রংটা মনে আছে?-ফেলুদা মল্লিকের কথার উপর প্রশ্ন করল। আছে বইকী। নীল রঙের ফিয়ার্ট গাড়ি। সেটাকে ফলে করলাম, কিন্তু সেখানেও ব্যাড় লোক-বারাসতের কাছাকাছি টায়ার পাংচার হয়ে গেল, ভদ্রলোক তখনকার মতো আমার হাতছাড়া হয়ে গেলেন। কিন্তু ততক্ষণে আমার গোঁ চেপে গেছে। আমি জানি উনি আবার মূর্তিটা বেচবেন। চলে গেলাম গ্র্যান্ড হাটেলে। শেষ পর্যন্ত ভদ্রলোকের দেখা পেলাম, তাকে ধাওয়া করে রেলওয়ে আপিসে গিয়ে তার দেখাদেখি আওরঙ্গাবাদের টিকিট কিনলাম। তার হাতের ব্যাগের ওজন দেখে মনে হচ্ছিল তিনি তখন পর্যন্ত মূর্তিটা বিক্রি করতে পারেননি। টিকিট কিনে বম্বেতে আমার আপিসে খবরটা জানিয়ে দিলাম। ফেলুদা বলল, জানি। আপনি বলেছিলেন মেয়ে বাপের বাড়ি চলে এসেছে। বাপ যে আসলে চট্টোরাজ, আপনি নন, সেটা তখন বুঝতে পারিনি। মল্লিক বললেন, যাই হোক এখানে এসে প্রথম থেকেই আমি মূর্তিটা হাত করার সুযোগ খুজি। আমি জানতাম যে চোরাই মাল উদ্ধার করার সঙ্গে সঙ্গে যদি চোরকে ধরে দিতে পারি। তা হলে আরও বেশি নাম হবে; কিন্তু সেটা সাহসে কুলোল না। যাই হাক।–কাল রাত্রে কৈলাসের কাছে গিয়ে লুকিয়ে ছিলাম। যখন দেখলাম একে একে বাংলোর সবাই ঘুরতে বেরিয়েছে, তখন বাংলোয় গিয়ে জমাদারের দরজা দিয়ে চট্টোরাজের ঘরে ঢুকে মাথাটা নিয়ে আসি। ফেলুদা বলল, আপনার পেছনেও যে একজন গোয়েন্দা লেগেছে সেটা বুঝতে পেরেছিলেন কি? মোটেই না; আর সেজন্যেই তো হঠাৎ ধরা পড়ে এত বোকা হয়ে গিয়েছিলাম! মিস্টার ঘোটে হা হা করে হেসে উঠলেন। ফেলুদা বলল, যখন দেখলাম। আপনি এতখানি পথ লুইসনের সঙ্গে গিয়েও তাকে মূর্তিটা গছাননি, তখনই প্রথম বুঝতে পারলাম যে আপনি নিদোষ। তার আগে পর্যন্ত, আপনি গোয়েন্দা জেনেও, আপনার উপর থেকে। আমার সবটুকু সন্দেহ যায়নি। কিন্তু আপনি তো চট্টোরীজকে সন্দেহ করেছিলেন, তাই না?–প্রশ্ন করলেন মিস্টার মল্লিক। ফেলুদা বলল, হ্যাঁ, কিন্তু প্ৰথমে সেটা ছিল শুধু একটা খটকা। যখন দেখলাম একটা পুরনো সুটকেসে নতুন করে নাম লেখা হয়েছে আর এন রক্ষিত, তখনই সন্দেহ হল-~~নামটা ঠিক তো? তারপর কাল রাত্রে উনি রেনকোট পরে বেরিয়েছিলেন সে কথা লালমোহনবাবুর কাছে শুনি। পনেরো নম্বর গুহাতে একজন লোক ঢুকেছে। সন্দেহ করে ওপর থেকে গুহার সামনে একটা নুড়ি পাথর ফেলি। ফলে অন্ধকারে লোকটা পালায়। ভেতরে গিয়ে খোঁজাখুঁজি করতে পেছন দিকের একটা ছোট গুহায় দেখি রেনকোট, আর তার বিরাট স্পেশাল পকেটে হাতুড়ি, ছেনি। আর নাইলনের দড়ি। আমি ওগুলো সেইখানেই রেখে আসি। বুঝতে পারি চট্টোরাজ হলেন মূর্তিচোর। সেই রাত্রেই দেখলাম চট্টোরাজ তার ঘরে পাগলের মতে কী জানি খুঁজছেন। পরদিন সকালে শুনলাম। আপনি বম্বেতে টেলিফোন করেছেন-মেয়ে ভাল আছে। বুঝলাম মূর্তি এখন আপনার কাছে। অথচ মুশকিল। এই যে, মূর্তিটা হাত ছাড়া হলে আসল চারকে শায়েস্তা করা যাবে না। তাই আপনাকে অ্যারেস্ট করতে হল। এ দিকে শুভঙ্কর বোসের অপঘাত মৃত্যু হয়েছে। তার ডেডবডি দেখতে গিয়ে হাতের মুঠো থেকে নীল কাপড়ের টুকরো পাওয়া গেল। আপনি রাত্রে নীল শার্ট পরেছিলেন, কিন্তু এদিকে আমার সন্দেহ চট্টোরাজের উপর পড়েছে! আসলে আমারও আগে চট্টোরাজ পৌঁছেছিলেন ডেডবডির কাছে। উনিই নাড়ি দেখার ভান করে নিজের একটা নীল শার্ট থেকে ছেঁড়া টুকরো শুভঙ্করের হাতে গুঁজে দেন—কারণ শুভঙ্করের মৃত্যুর জন্য অন্য কাউকে দায়ী করার প্রয়োজন ছিল। উনি নিজের শর্টটি অবিশ্যি পরে বাংলোর পশ্চিম দিকে গাছপালায় ভর্তি একটা নিরিবিলি জায়গায় লুকিয়ে রাখেন, আর আমি গিয়ে সেটা উদ্ধার করি। কিন্তু এত করেও যে সমস্যাটা বাকি রইল, সেটা হল কী করে চট্টোরাজকে ধরা যায়। একটা পথ পেলাম যখন শুনলাম যে কে জানি লালমোহনবাবুর ঘরে ঢুকে বাক্স ঘাঁটাঘাঁটি করেছে। এ ব্যক্তি নিঃসন্দেহে চট্টোরাজ, কারণ তারই একটি মূল্যবান জিনিস খোওয়া গেছে। লালমোহনবাবুর বাক্সে লালমোহনবাবুর নোটবই ছিল, এবং তাতে যক্ষীর মাথা, প্লেন ক্র্যাশ ইত্যাদির উল্লেখ ছিল। এই খাতা চট্টোরাজ না পড়ে পারেন না। এই আন্দাজে আমি লালমোহনবাবুর হাতের লেখা নকল করে চট্টোরাজকে যে চিঠিটা লিখলাম সেটার কথা জানেন। তার আগেই আমি চট্টোরাজকে নিশ্চিন্ত করার জন্য জানিয়ে দিলাম যে মূর্তি চোর ধরা পড়েছে- সেই ফ্রেঞ্চকটি দাড়ি?–আমি আর লালমোহনবাবু একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলাম। হ্যাঁ?-ফেলুদা হেসে বলল। -সেটা আমার দু নম্বর ছদ্মবেশী! তোদের কাছাকাছি থাকার দরকার হয়ে, পড়েছিল, কারণ লোকটা ডেঞ্জারাস। যাই হাক–চিঠির টোপ উনি বেমালুম গিলে ফেললেন। এবং তার ফলে যে কী হল সেটা আপনারা সকলেই জানেন। এবার এইটুকুই বলতে বাকি যে, এই যে গ্যাংটা ধরা হল, এর কৃতিত্বের অংশীদার ভার্গব এজেন্সির মিস্টার মল্লিক যাতে উপযুক্ত স্বীকৃতি পান সেটা আমি নিশ্চয় দেখব, আর-মিস্টার ঘোটের যাতে পদোন্নতি হয় সেটাও একান্তভাবে কামনা করব। মিস্টার কুলকার্নির ভূমিকাও যে সামান্য নয়। সেটা কলাই বাহুল্য, আর সাহসের জন্য যদি মেডাল দিতে হয় তা হলে সেটা অবশ্যই পাবেন শ্ৰীমান তপেশ ও শ্ৰীযুক্ত লালমোহন গাঙ্গুলী। সকলের হাততালি শেষ হলে জটায়ু একটা কিন্তু কিন্তু ভাব করে বললেন, আমার বোমটা তা হলে আর কোনও কাজে লাগল না বলছেন? ফেলুদা চোখ গোল গোল করে বলল, সে কী মশাই-এত যে ধোঁয়া হল সেটা এল কোখোঁকে? ওটা তো আর এমনি এমনি বোমা নয়-একেবারে তিনশো ছাপ্পান্ন মেগাটন খাস মিলিটারি স্মোক-বম্ব।
 
== চলচ্চিত্রে রূপায়ণ ==