পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত ব্যবস্থা: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

বিষয়বস্তু বিয়োগ হয়েছে বিষয়বস্তু যোগ হয়েছে
NahidSultanBot (আলোচনা | অবদান)
বট নিবন্ধ পরিষ্কার করেছে। কোন সমস্যায় এর পরিচালককে জানান।
NahidSultanBot (আলোচনা | অবদান)
বট নিবন্ধ পরিষ্কার করেছে। কোন সমস্যায় এর পরিচালককে জানান।
১ নং লাইন:
'''পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত ব্যবস্থা''' [[ভারত|ভারতের]] [[পশ্চিমবঙ্গ]] রাজ্যের গ্রামীণ স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থার মূল ভিত্তি। ‘পঞ্চায়েত’ শব্দটির ব্যুৎপত্তি হিন্দি पंचायत থেকে। [[প্রাচীন ভারত|প্রাচীন ভারতে]] পাঁচজন সদস্য নিয়ে যে স্বশাসিত স্বনির্ভর গ্রামীণ পরিষদ গঠিত হত, তাকেই বলা হত পঞ্চায়েত। আধুনিককালে এই শব্দটির সঙ্গে যুক্ত হয় এক সমষ্টিগত চেতনা। ‘পঞ্চায়েত’ শব্দটির লোকপ্রচলিত অর্থ হয়ে দাঁড়ায় ‘পাঁচ জনের জন্য’। সাংবিধানিক স্বীকৃতি পাওয়ার পর বর্তমানে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের তৃতীয় স্তরের সরকার। বর্তমানে গ্রামবাংলাকে কেন্দ্র করে যে প্রশাসনিক, জনকল্যাণমূলক, বিচারবিভাগীয় ও প্রতিনিধিত্বমূলক স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থা পশ্চিমবঙ্গে প্রচলিত, তাকেই '''পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত ব্যবস্থা''' নামে অভিহিত করা হয়। [[১৮৭০]] সালে প্রথম বঙ্গীয় গ্রাম চৌকিদারি আইনের মাধ্যমে আধুনিক গ্রাম পঞ্চায়েত ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। স্বাধীনতার পর গণতান্ত্রিক [[ভারত|ভারতে]] এই ব্যবস্থা তৃণমূলস্তর পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে বিভিন্ন আইন পাস হয় ও সংবিধান সংশোধন করা হয়। [[১৯৫৭]] সালে সর্বপ্রথম পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত আইন বিধিবদ্ধ হয়। ১৯৫৭ ও [[১৯৬৩]] সালের আইন অনুসারে পশ্চিমবঙ্গে চার-স্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থা চালু হয়। এরপর ১৯৭৩ সালে নতুন আইনের মাধ্যমে চালু হয় ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থা। ১৯৯১ সালে [[ভারতীয় সংবিধান|ভারতীয় সংবিধানের]] ৭২তম সংশোধনী অনুসারে ১৯৯২ সালে পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত আইনটিকেও পুনরায় সংশোধিত করা হয়।
 
== ইতিহাস ==
৬ নং লাইন:
 
=== ব্রিটিশ যুগ ===
[[ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি]] [[১৭৬৫]] সালে [[বঙ্গ|বাংলা]], [[বিহার]] ও [[ওড়িশা|উড়িষ্যার]] দেওয়ানি লাভ করে। এর ১০৫ বছর পর [[১৮৭০]] সালে বঙ্গীয় গ্রাম চৌকিদারি আইন বা বেঙ্গল ভিলেজ চৌকিদারি অ্যাক্ট পাস হয়। এই আইন অনুসারে গ্রামাঞ্চলের অপরাধ দমনের লক্ষ্যে বাংলার গ্রামাঞ্চলে স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা হিসাবে চৌকিদারি পঞ্চায়েত নামে একটি কৃত্রিম সংস্থা চালু হয়। জেলাশাসক এই সংস্থার সদস্যদের নিয়োগ করতেন আর গ্রামবাসীদের কাছ থেকে আদায় করা করে এর কাজকর্ম সম্পাদিত হত। বৃহত্তর গ্রামোন্নয়নের সঙ্গে এর প্রত্যক্ষ কোনও যোগাযোগ ছিল না।
 
[[লর্ড রিপন]] (দপ্তরকাল [[১৮৮০]]-[[১৮৮৪|৮৪]]) প্রথম ভাইসরয় যিনি ভারতে একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে আগ্রহী হন। এই ব্যবস্থাকে ‘রাজনৈতিক ও জনশিক্ষার হাতিয়ার’ আখ্যা দিয়ে তিনি এর একটি বিস্তারিত রূপরেখা রচনা করেন। [[১৮৮২]] সালে এই ব্যাপারে রিপনের প্রস্তাব গৃহীতও হয়। [[১৮৮৫]] সালে ব্রিটিশ সরকার দেশে স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তনের লক্ষ্যে প্রথম পদক্ষেপটি গ্রহণ করেন। পাস হয় বঙ্গীয় স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন আইন বা বেঙ্গল সেল্ফ-গভর্নমেন্ট অ্যাক্ট। এই আইনবলে গ্রামীণ স্বায়ত্তশাসনের তিনটি সংস্থা কার্যকর হয় – গ্রাম স্তরে ইউনিয়ন কমিটি, মহকুমা স্তরে স্থানীয় পরিষদ এবং জেলা স্তরে জেলা বোর্ড।
 
এক বা একাধিক গ্রামের জন্য ইউনিয়ন কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটির হাতে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের বিদ্যালয়, পুকুর ও রাস্তা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব অর্পিত হয়। অর্থের জন্য এই কমিটিগুলি জেলাবোর্ডের উপর নির্ভরশীল থাকত ও বোর্ডের অধীনেই নিজের কাজ সম্পাদনা করত। এই ব্যবস্থার ফলে গ্রাম স্তরে দুটি প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে ওঠে – চৌকিদারি পঞ্চায়েত ও ইউনিয়ন কমিটি।
 
মহকুমা স্তরে গঠিত স্থানীয় পরিষদেরও কোনও স্বতন্ত্র ক্ষমতা বা আয় ছিল না এবং এই সংস্থাও সর্ব ব্যাপারে জেলা বোর্ডের উপরেই নির্ভরশীল থাকত। জেলা বোর্ড এদের হাতে কোনও ক্ষমতা বা কর্তৃত্ব অর্পণ করলে, তবেই তারা তা প্রয়োগ করতে সমর্থ হত। তাই বলা যেতে পারে এই পরিষদগুলি জেলা বোর্ডের কমিটি হিসাবেও কাজ করত। <ref>পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত, অসিতকুমার বসু, [[পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি]], [[কলকাতা]], ১৯৯৮, পৃ. ১৭</ref> [[১৯৩৬]] সালে একটি আইন সংশোধনী বলে স্থানীয় পরিষদ বিলুপ্ত করা হয়।
 
প্রতিটি জেলায় একটি করে জেলা বোর্ড গঠিত হয়। বোর্ডের কার্যক্ষেত্র হয় জেলার সমগ্র গ্রামাঞ্চল। চার বছরের মেয়াদকালযুক্ত এই বোর্ডগুলি নয় থেকে ছত্রিশ জন সদস্য নিয়ে গঠিত হত এবং এর সদস্যরা সকলেই নির্বাচিত হতেন। সদস্যদের মধ্য থেকে একজন সভাপতি ও একজন সহসভাপতি নির্বাচিত হতেন। এই জেলা বোর্ডগুলির হাতে বহু দায়িত্ব ন্যস্ত থাকত। এদের প্রধান কাজ ছিল শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও যাতায়াত ব্যবস্থার রক্ষণাবেক্ষণ। জেলা বোর্ডগুলির আয়ের উৎসও ছিল বিভিন্ন। আয়ের প্রধান উৎস ছিল পথ, সেতু, খেয়াঘাট, ডাকবাংলো, খোঁয়াড় প্রভৃতি থেকে প্রাপ্ত কর। সরকারি অনুদানও বোর্ডগুলি পেত। এছাড়া সাধারণের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণের ক্ষমতাও তাদের দেওয়া হয়েছিল। স্বাধীনোত্তর কালে পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত ব্যবস্থার প্রবর্তনের আগে অবধি এই বোর্ডগুলি কাজ করে গিয়েছে।
১৮ নং লাইন:
[[১৮৯৯]] সালে [[লর্ড কার্জন]] ভারতের ভাইসরয় পদে অভিষিক্ত হলে তিনি শাসনব্যবস্থার কেন্দ্রীকরণ ঘটান। কার্জন ভারতবাসীর স্বাধিকারের তীব্র বিরোধী ছিলেন এবং ভারতবাসীকে তিনি আদৌ গণতন্ত্রের উপযুক্ত বলে মনে করতেন না; তা স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের মতো যত সীমাবদ্ধ ক্ষেত্রেই হোক না কেন। তার প্রবর্তিত শাসনব্যবস্থার কেন্দ্রীকরণ রোধ করার জন্য [[লর্ড মর্লি]] ১৯০৭ সালে রাজকীয় বিকেন্দ্রীকরণ কমিশন বা রয়্যাল কমিশন অন ডিসেন্ট্রালাইজেশন গঠন করেন। ১৯০৯ সালে এই কমিশন তার প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এই প্রতিবেদনে চৌকিদারি ও অন্যান্য স্থানীয় কাজের দায়িত্ব একটি একক গ্রামীণ সংস্থার হাতে অর্পণ করার প্রস্তাব রাখা হয় এবং বলা হয় এক-একটি গ্রামকে গ্রামীণ স্বায়ত্তশাসনের ভিত্তি করতে না পারলে এই শাসনব্যবস্থায় গ্রামবাসীদের আগ্রহ সৃষ্টি করা সম্ভব হবে না।
 
এরপর ১৯১৪ সালে তদনীন্তন বাংলা সরকার একটি জেলা প্রশাসন কমিটি বা ডিস্ট্রিক্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কমিটি গঠন করেন। এই কমিটি সুপারিশ করেন গ্রামাঞ্চলে এমন এক শাসন কর্তৃপক্ষ গড়ে তুলতে যার মধ্যে একাধারে ইউনিয়ন কমিটি ও চৌকিদারি পঞ্চায়েতের কাজ করবে এবং একটি গ্রামীণ বিচারব্যবস্থাও তার অন্তর্ভুক্ত হবে। মূলত এই কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতেই গ্রামীণ স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের লক্ষ্যে [[১৯১৯]] সালে পাস হয় বঙ্গীয় গ্রামীণ স্বায়ত্তশাসন আইন বা বেঙ্গল ভিলেজ সেল্ফ-গভর্নমেন্ট অ্যাক্ট। এই আইনবলে চৌকিদারি পঞ্চায়েত ও ইউনিয়ন কমিটি অবলুপ্ত করা হয় এবং উভয়ের ক্ষমতা একাধিক গ্রাম নিয়ে গঠিত ইউনিয়ন বোর্ডের হাতে ন্যস্ত করা হয়। এই বোর্ডগুলি গ্রামবাসীদের প্রয়োজনে নিজ নিজ এলাকায় কর ধার্য করার ক্ষমতা রাখত। এছাড়া এই আইনের ছোটোখাটো দেওয়ানি মামলা বিচারের জন্য ইউনিয়ন কোর্ট ও ছোটোখাটো ফৌজদারি মামলা বিচারের জন্য ইউনিয়ন বেঞ্চও গঠন করা হয়। এই বিচারব্যবস্থার বিচারকগণও ইউনিয়ন বোর্ডের সদস্যদের মধ্য থেকেই নিযুক্ত হতেন।
 
তবে এইসব ইউনিয়ন ও জেলা বোর্ডের কাজকর্ম প্রাথমিক শিক্ষা, জল সরবরাহ, সড়ক ও সেতু নির্মাণ এবং জনস্বাস্থ্যরক্ষা মতো কাজেই সীমাবদ্ধ ছিল। অর্থ ও কর্মীর অভাবে এগুলির দ্বারা গ্রামীণ জীবনের ন্যূনতম চাহিদাগুলি পূরণ করা সম্ভব হত না। যদিও গ্রামবাংলার জনসাধারণকে ভাবী গণতন্ত্রের পথে অনেকটাই শিক্ষিত করে তুলতে সক্ষম হয়েছিল এগুলি।
২৪ নং লাইন:
=== স্বাধীনোত্তর কাল - 'প্রথম প্রজন্ম' (১৯৪৭-১৯৭৭) ===
 
[[১৯৪৭]] সালে [[ভারত]] স্বাধীন হয় ও [[ভারতীয় সংবিধান|দেশের সংবিধান]] রচনার প্রক্রিয়া শুরু হয়। কিন্তু খসড়া সংবিধানে গ্রামীণ স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি যথোচিত গুরুত্ব না পাওয়ায় গান্ধীজি মনোক্ষুণ্ণ হন। তিনি চেয়েছিলেন, ভারতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা হবে গ্রামকেন্দ্রিক আর তাই গ্রাম ভারতের রাজনৈতিক মানচিত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থান অর্জন করবে। বস্তুত, আধুনিক পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মূল ধারণাটি তিনিই প্রথম ভারতবাসীর সামনে তুলে ধরেছিলেন। এরপর সংবিধানের ৪০ নং ধারায় উল্লেখ করা হয়ঃ রাজ্য গ্রাম পঞ্চায়েত গঠনের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এবং পঞ্চায়েতগুলি যাতে স্বায়ত্তশাসনের ইউনিট হিসাবে কাজ করতে পারে সেজন্য প্রয়োজনীয় ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব তাদের হাতে অর্পণ করবে। <ref>ভারতীয় সংবিধান, ধারা ৪০</ref> কিন্তু এখানে মনে রাখা দরকার, ভারতের সংবিধান প্রণেতাগণ পঞ্চায়েত ব্যবস্থার উপর ভিত্তি করে ভারতের প্রশাসনিক কাঠামোটি গড়ে তোলেননি। তাই পঞ্চায়েতের সাংবিধানিক স্বীকৃতি মিললেও এই ধারাটি নির্দেশমূলক নীতির অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় এর বাস্তবায়নে রাজ্য বা কেন্দ্র কেউই বাধ্য ছিল না।
 
তবে এই নির্দেশ অনুসরণ করে ভারতের কোনও কোনও রাজ্যে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। পশ্চিমবঙ্গেও পরীক্ষামূলকভাবে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা চালু হয় [[বারুইপুর]], মহম্মদবাজার, [[সাঁইথিয়া]], নলহাটি, শক্তিগড়, গুসকরা, [[ঝাড়গ্রাম]] ও [[ফুলিয়া]] ব্লক এলাকায়। পরীক্ষামূলক পঞ্চায়েতে কোনও আইনগত সংস্থা না থাকায় এগুলির কাজ চলতে থাকে ইউনিয়ন বোর্ডের অধীনেই। গ্রামবাসীরা এক জায়গায় মিলিত হয়ে হাত তুলে ভোট দিয়ে সদস্য নির্বাচন করতেন ও কার্যালয়ের ব্যয় ও গ্রামোন্নয়ন বাবদ পঞ্চায়েতগুলিকে ১০০ টাকা করে দেওয়া হত। কাজ হত গ্রামবাসীদের দান আর কায়িক শ্রমে।
 
[[১৯৫৭]] সালে প্রকাশিত [[বলবন্তরাই মেহতা কমিটি|বলবন্তরাই মেহতা কমিটির]] সুপারিশক্রমে ভারতের সব রাজ্যেই ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থা চালু হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গে ১৯১৯ সাল থেকে প্রচলিত ইউনিয়ন বোর্ডকে বাদ দিয়ে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা চালু করা সম্ভবপর ছিল না। সেই কারণে এ রাজ্যে চার-স্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থা চালু হয়। ১৯৫৭ সালে পশ্চিমবঙ্গ পঞ্চায়েত আইন বা ওয়েস্ট বেঙ্গল পঞ্চায়েত অ্যাক্টের মাধ্যমে চালু হয় দ্বিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থায় গ্রাম স্তরে গ্রাম পঞ্চায়েত ও পুরনো ইউনিয়ন বোর্ড স্তরে অঞ্চল পঞ্চায়েত গঠিত হয়। [[১৯৫৮]] সালে এই আইন অনুসারে প্রথম নির্বাচন হয়। এরপর [[১৯৬৩]] সালে পশ্চিমবঙ্গ জেলা পরিষদ আইন বা ওয়েস্ট বেঙ্গল জিলা পরিষদ অ্যাক্টের মাধ্যমে [[১৯৬৪]] সালে ব্লক স্তরে আঞ্চলিক পরিষদ ও জেলা স্তরে জেলা পরিষদ গঠিত হয়। এই আইনের উদ্দেশ্য ছিল গ্রামোন্নয়নে স্থানীয় নির্বাচিত সংস্থাকে যুক্ত করা এবং উন্নয়ন ও পরিকল্পনার কাজে গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণ ও জনগণের অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করা। এইভাবে গড়ে ওঠে পশ্চিমবঙ্গের চার-স্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থাঃ
 
* '''চার-স্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থা''' –
৩৬ নং লাইন:
** '''জেলা পরিষদ''' – পূর্বতন জেলা বোর্ড বাতিল করে গঠিত হয় জেলা পরিষদ। একমাত্র [[কোচবিহার জেলা|কোচবিহার জেলায়]] কোনও জেলা বোর্ড না থাকায় সেখানে নতুন করে জেলা পরিষদ গঠন করা হয়।<br />এই জেলা পরিষদ সদস্য ও সহযোগী সদস্য নিয়ে চার বছরের জন্য গঠিত হত। সহযোগী সদস্যদের মধ্যে থাকতেন মহকুমা শাসক, জেলা পঞ্চায়েত আধিকারিক প্রমুখ সরকারি প্রশাসক ও কর্মচারী আর সদস্যদের মধ্যে থাকতেন – (১) আঞ্চলিক পরিষদের সভাপতিগণ (এঁরা পদাধিকার বলে সদস্য হতেন); (২) প্রত্যেক মহকুমা থেকে অধ্যক্ষদের দ্বারা নির্বাচিত দু-জন সদস্য; (৩) জেলায় বসবাসকারী অথবা জেলা থেকে নির্বাচিত অথচ মন্ত্রী নন এমন সাংসদ ও বিধায়ক; (৪) সরকার মনোনীত [[পুরসভা]] বা পৌরসংস্থার চেয়ারম্যান বা মেয়র; (৫) জেলা স্কুল বোর্ডের সভাপতি এবং (৬) সরকার মনোনীত অনধিক দু-জন মহিলা।<br />জেলা পরিষদের প্রথম সভায় একজন চেয়ারম্যান ও একজন ভাইস-চেয়ারম্যানকে নির্বাচিত করা হত। চেয়ারম্যানের উপর ন্যস্ত থাকত আর্থিক ও প্রশাসনিক কাজ পরিচালনার দায়িত্ব। তবে পরিষদের নীতি ও প্রস্তাবগুলি রূপায়ণের দায়িত্ব অর্পিত ছিল একটি প্রশাসনিক যন্ত্রের উপর; যার শীর্ষে থাকতেন কার্যনির্বাহী আধিকারিক। এছাড়াও পরিষদের সচিবের দায়িত্ব সামলাতেন অপর একজন উচ্চপদস্থ আধিকারিক। এঁরা দুজনেই [[পশ্চিমবঙ্গ প্রশাসনিক কৃত্যক]] বা ওয়েস্ট বেঙ্গল সিভিল সার্ভিস (ডাবলিউবিসিএস)-এর সদস্য ছিলেন।<br />জেলা পরিষদের প্রধান কাজ ছিল উন্নয়নমূলক। অন্যান্য কাজের মধ্যে ছিল আঞ্চলিক পরিষদের বাজেট অনুমোদন এবং বিভিন্ন আঞ্চলিক পরিষদের উন্নয়ন প্রকল্পগুলির সমন্বয় সাধন।
 
চার-স্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় গ্রামোন্নয়নের মূল দায়িত্ব গ্রাম পঞ্চায়েতের হাতে ন্যস্ত থাকলেও সাংগঠনিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে গ্রাম পঞ্চায়েতগুলি দুর্বলই থেকে যায় এবং স্বভাবতই এদের কাজকর্ম অবহেলিত হতে থাকে। পূর্বতন ইউনিয়ন বোর্ডের যেসব কাজ ছিল অঞ্চল পঞ্চায়েতকে তার চেয়ে বেশি কাজ করতে হত না। বরং উন্নয়নমূলক কাজকর্মের হাত থেকে অঞ্চল পঞ্চায়েতগুলি রেহাই পেয়েছিল। বাস্তব ক্ষেত্রে গ্রাম ও অঞ্চল পঞ্চায়েত চালাবার মতো দক্ষ কর্মীর অভাবে ভুগছিল বাংলার গ্রামাঞ্চল। তা সত্ত্বেও [[১৯৫৯]] থেকে [[১৯৬৩]] সালের মধ্যে নির্বাচনের মাধ্যমে এই ব্যবস্থা চালু হয়ে যায় পশ্চিমবঙ্গে। সরকার এদের হাতে কিছু প্রকল্পও অর্জন করেন। কিন্তু [[১৯৬৭]] সালে যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় এসে সেসব প্রকল্প প্রত্যাহার করে নেন। এদিকে প্রথম নির্বাচনের পর আর নির্বাচন না হওয়ায় পঞ্চায়েত প্রতিষ্ঠানগুলিও নিষ্ক্রিয় ও জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তাছাড়া বিভিন্ন সময়ে পঞ্চায়েত সংক্রান্ত আইনদুটি প্রণীত হওয়ায় পঞ্চায়েত প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। <ref>পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত, অসিতকুমার বসু, [[পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি]], [[কলকাতা]], ১৯৯৮, পৃ.২৩</ref>
 
এই কারণে পঞ্চায়েত ব্যবস্থার পুনর্গঠনের প্রয়োজন অনুভূত হয়। এই উদ্দেশ্যে ১৯৭৩ সালে পাস হয় পশ্চিমবঙ্গ পঞ্চায়েত আইন বা ওয়েস্ট বেঙ্গল পঞ্চায়েত অ্যাক্ট। এই আইনবলে চার-স্তর পঞ্চায়েতের পরিবর্তে ত্রিস্তর পঞ্চায়েত প্রবর্তিত হয় – পূর্বতন অঞ্চল পঞ্চায়েত স্তরে গ্রাম পঞ্চায়েত, ব্লক স্তরে পঞ্চায়েত সমিতি ও জেলা স্তরে জেলা পরিষদ।