লোকসংস্কৃতি: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য
বিষয়বস্তু বিয়োগ হয়েছে বিষয়বস্তু যোগ হয়েছে
ট্যাগ যোগ করা হয়েছে ট্যাগ: পুনর্বহালকৃত |
ট্যাগ: পুনর্বহালকৃত |
||
১১ নং লাইন:
প্রাকৃতিক পরিবেশে বসবাসরত অক্ষরজ্ঞানহীন ও ঐতিহ্যানুসারী বৃহত্তর গ্রামীণ জনসমষ্টিকে ‘লোক’ বলে অভিহিত করা হয়। এই অভিধাভুক্ত বিশ্বের অধিকাংশ জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা, সমাজব্যবস্থা, বিশ্বাস-সংস্কার ও প্রথা-প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে বিকশিত সংস্কৃতিতে বিস্ময়কর মিল আছে। লোককলাবিদ স্টিথ থমসন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের লোককাহিনী ও পুরাণকে অবলম্বন করে ৬ খন্ডে যে মোটিফ ইন্ডেক্স রচনা করেছেন, তা থেকেই বিশ্বের এই লোক-মানসিকতার অভিন্ন গতি-প্রকৃতি সম্বন্ধে ধারণা করা যায়। বাংলার কৃষক ফসল তোলার সময় এক গোছা ধান মাঠ থেকে এনে ঘরের চালে ঝুলিয়ে রাখে। একে বলা হয় ‘লক্ষ্মীর ছড়’। বিশ্বের নানা দেশের কৃষকসমাজেও একই প্রথা চালু আছে; কোথাও তা ‘শস্যরাণী’, কোথাও ‘শস্যপুতুল’, কোথাও বা ‘শস্যমাতা’ নামে অভিহিত। বিষয়, চিন্তা-ভাবনা ও আবেদনের দিক থেকে লোকসংস্কৃতির একটা বিশ্বজনীন ও সর্বকালীন রূপ আছে।
লোকসংস্কৃতির অজস্র উপাদানের রূপ-প্রকৃতির বিচার করে একে চারটি প্রধান ধারায় ভাগ করা হয়: বস্ত্তগত (material), মানসজাত (formalised), অনুষ্ঠানমূলক (functional) এবং প্রদর্শনমূলক (performing)। লোকসমাজ জীবনধারণের জন্য যেসব দ্রব্য ব্যবহার করে সেসব বস্ত্তগত সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত, যেমন: বাড়ি-ঘর, দালান-কোঠা, আসবাবপত্র, তৈজসপত্র, যানবাহন, সকল পেশার যন্ত্রপাতি, কুটিরশিল্প, সৌখিন দ্রব্য, পোশাক-পরিচ্ছদ, খাদ্যদ্রব্য, ঔষধপত্র ইত্যাদি। এর প্রত্যেকটির আবার বহুবিধ প্রকারভেদ আছে। যেমন কৃষক প্রায় সব ধরনের ফসল উৎপাদন করে, তাঁতি সব
বাংলার তাঁতিরা মসলিন তৈরি করে এককালে বিশ্বজোড়া খ্যাতি লাভ করেছিল। জামদানি বস্ত্রের সুনাম এখনও আছে। কুমার নির্মিত মাটির দেবদেবীর মূর্তি এখনও মৃৎশিল্পের অনন্য নিদর্শন। তারা সখের হাঁড়ি, মনসার ঘট, লক্ষ্মীর সরা ইত্যাদি তৈরি করে অনন্য শিল্পীমনের পরিচয় দিয়েছে। ছুতার প্রাচীন কাল থেকেই কাঠের খাট-পালঙ্ক, দরজা, চৌকাঠ, নৌকা ইত্যাদি দক্ষতার সঙ্গে নির্মাণ করে আসছে। এক সময় বাংলার ময়ূরপঙ্খি, সপ্তডিঙ্গা, চৌদ্দডিঙ্গা প্রভৃতি সমুদ্রগামী নৌকার সুনাম ছিল। বাঁশ, বেত, কাঠ, পাট ও শোলা দিয়ে নানারকমের নিত্য ব্যবহার্য ও সৌখিন দ্রব্য তৈরি হয়। সিলেটের নকশি পাটির সুনাম দীর্ঘকালের।
পাটের তৈরি নকশি শিকা আন্তর্জাতিক বাজারে সৌখিন পণ্যরূপে সমাদর পাচ্ছে। নকশি পাখা, শিকা ইত্যাদি পল্লীর রমণীরাই তৈরি করে। তারা বিচিত্র
মৌখিক ধারার লোকসাহিত্যকে মানসজাত লোকসংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এর সঙ্গে কিছু চিত্রকর্মকেও যুক্ত করা যায়। অনুমান হলেও সত্য যে, মানুষ যখন থেকে ভাষা পেয়েছে তখন থেকেই কিছু না কিছু সৃষ্টি করে আসছে। এ অর্থে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের লোকসাহিত্যও বেশ প্রাচীন। বিশ্বের প্রায় সব ধারার লোকসাহিত্যের উপাদানই বাংলা ভাষায় বিদ্যমান। বাংলায় লোককাহিনী, লোকসঙ্গীত, লোকগাথা, লোকনাট্য, ছড়া, ধাঁধা, মন্ত্র, প্রবাদ-প্রবচন প্রভৃতি গদ্যে-পদ্যে রচিত মৌখিক ধারার সাহিত্যের প্রচলন আছে। বাঙালি আবেগপ্রবণ জাতি। পলি দ্বারা গঠিত বাংলার নরম মাটি, শ্যামল প্রকৃতি, ঋতুবৈচিত্র্য, কৃষি-অর্থনীতি, দীর্ঘস্থায়ী সামন্ত সমাজব্যবস্থা ইত্যাদি কারণে বাংলা লোকসাহিত্যের ভান্ডার অত্যন্ত সমৃদ্ধ হয়েছে। মুখ্যত কৃষকসমাজই লোকসাহিত্যের স্রষ্টা ও ধারক-বাহক। এর সঙ্গে গো-মহিষের রাখাল, নৌকার মাঝি-মাল্লা, গায়ক সম্প্রদায় বাউল, ভিক্ষোপজীবী ফকির-বৈরাগী ও পেশাজীবী বেদে-বেদেনিরা লোকসঙ্গীতের চর্চা করে থাকে। লোকচিকিৎসার সঙ্গে জড়িত ওঝা ও মন্ত্রগুপ্তিরা মন্ত্রের চর্চা করে। সাপের ওঝা সর্পবিষের ও ভূতের ওঝা তথাকথিত ভূত-প্রেতাক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা করে। শিরালি মন্ত্রগুণে আকাশের মেঘ-শিলাবৃষ্টি পর্যন্ত বিতাড়িত করতে পারে বলে লোকসমাজ বিশ্বাস করে।
|