গীতি কাব্য: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

গীতি কাব্য অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ বলে সাধারণতঃ দীর্ঘকায় হয় না। কারণ কোন অনুভূতিই দীর্ঘকাল স্থায়ী নয়। কিন্তু কোন কবি যদি গীতি কবিতায় তাঁরতার ব্যক্তি-অনুভূতিকে একান্ত আন্তরিকতার সাথে অনায়াসে দীর্ঘকারে বর্ণনা করতে পারেন, তবে তার মূল [[রস (কাব্য|রস]] ক্ষুণ্ন হয় না। কবির আন্তরিকতাই শ্রেষ্ঠ গীতি কবিতা বা গীতি কাব্যের একমাত্র কষ্টি-পাথর।

শব্দ চয়নের ব্যাপারে [[গান]] রচয়িতার স্বাধীনতা নাই। কারণ, সুরাত্মক ও সহজে উচ্চারণ করা যায় এমন শব্দই তাঁরতার পক্ষে উপযোগী। গানে ছন্দেবৈচিত্র্য সম্ভব নয়, কারণ কোন বিশিষ্ট ছন্দের পুণরাবৃত্তির সাহায্যে গান রচয়িতা গানের মূল ভাবটিকে গভীরতর করে তোলেন। এগুলো ছাড়াও গানে সুরের প্রাধান্য থাকে; গীতিকবিতায় কথা ও সুরের সমন্বয় থাকে। গানে একাধিক ভাব-কল্পনা সম্ভব নয; গীতি কাব্যে ভাব-কল্পনার বিচিত্রতা ও সুর-সঙ্গতি শুধু সম্ভবপর নয়, সুসাধ্যও বটে।

যে-কবিতায় কবির আত্মনুভূতি বা একান্ত ব্যক্তিগত বাসনা-কামনা ও আনন্দ-বেদনা তাঁরতার প্রাণের অন্তঃস্থল থেকে আবেগ-কম্পিত সুরে অখণ্ড ভাবমূর্ত্তিতে আত্মপ্রকাশ করে, তাকেই ''গীতি-কাব্য'' বা ''গীতিকবিতা'' বলে। এতে পরিপূর্ণ মানবজীবনের ইঙ্গিত নাই; এটি একক পুরুষের একান্ত ব্যক্তিগত আনন্দ-বেদনায় পরিপূর্ণ। কবি এখানে আত্ম-বিমুগ্ধ, তাই সমস্তটি কবিতাব্যাপী তাঁরতার প্রাণ-স্পন্দন অনুভব করা যায়। কবি তাঁরতার ব্যক্তি-অনুভূতি অথবা বিশিষ্ট মানসিকতা একে স্নিগ্ধ কান্তি দান করে। তাঁরতার চরিত্রের কমনীয়তা, নমনীয়তা বা দৃঢ়তা এতে প্রতিফলিত হয়। সংক্ষেপে বলা যায়, ''গীত কবিতা কবির আত্ম-মুকুর বিশেষ''। [[রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর|রবীন্দ্রনাথ]] বলেন,

একজন গীতিকবি যেমন আত্মসচেতন, মহাকবিও তেমনই আত্মসচেতন। তাঁদেরতাদের মধ্যেকার পার্থক্য শ্রেণীগত নয, ভাবগত কারণে। গীতি কবি আপনাকে কেন্দ্র করে নিজের উপলদ্ধ জগৎ সৃষ্টি করেন। [[মহাকবি|মহাকবির]] ব্যক্তি-পরায়ণতা আরও বিস্তৃত। গীতিকবি অন্ধ, মহাকবি সহস্র-চক্ষু, গীতিকবি আত্মরতিসম্পন্ন, মহাকবি স্বকীয় কল্পনার আলোকে নির্বাচিত বিষয়বস্তু অবলম্বনে সর্বজনীন মানবতাকে নিরীক্ষণ করেন। [[জন মিল্টন|মিল্টন]] [[কিথা আর্থার|আর্থারের]] কাহিনী পরিত্যাগ করে [[বাইবেল|বাইবেল-বর্ণিত]] আদিম মানবের পতন কাহিনীকেই [[মহাকাব্য|মহাকাব্যের]] সামগ্রীরূপে গ্রহণ করেছিলেন। কারণ এটি তাঁরতার বিপুল ব্যক্তিত্বের রসে রসায়িত হয়ে এমন [[কাব্য]] রচনার সাহায্য করবে, যাতে তিনি ঐশ্বরিক বিধানকে মানবভাগ্যের সাথে সংযুক্ত করে দেখাতে পারবেন। মধুসূদনও [[রামায়ণ|রামায়ণের]] যে-কাহিনী গ্রহণ করেছেন, তার ব্যঞ্জনা ব্যক্তি-নির্বিশেষ হলেও তা [[মাইকেল মধুসূদন দত্ত|মাইকেল মধুসূদন দত্তের]] কবি-মানসের ও জীবনদর্শনের সহায়ক।