১৮৫৭ সিপাহি বিদ্রোহ: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

বিষয়বস্তু বিয়োগ হয়েছে বিষয়বস্তু যোগ হয়েছে
সম্পাদনা সারাংশ নেই
ট্যাগ: মোবাইল সম্পাদনা মোবাইল ওয়েব সম্পাদনা
সম্পাদনা সারাংশ নেই
ট্যাগ: মোবাইল সম্পাদনা মোবাইল ওয়েব সম্পাদনা
৫৯ নং লাইন:
১৮৫৭ সালে বিদ্রোহ শুরু করেছিল দেশীয় সিপাহীরা। ১৮৫৭ সালের শুরু থেকেই বিদ্রোহের হাওয়া পাওয়া যাচ্ছিল। ১৮৫৭ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাতে চর্বিযুক্ত কার্তুজ নিয়ে সিপাহীদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছিল। ফেব্রুয়ারি মাসে ব্যারাকপুর ও বহরমপুরে বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে। মার্চ মাসে ব্যারাকপুরে মঙ্গলপান্ডে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। ২৯ মার্চ বিদ্রোহের দায়ে মঙ্গল পান্ডেকে ফাঁসি দেওয়া হয়। মূল বিদ্রোহ শুরু হয় মিরাটে, ১০ মে ১৮৫৭ সালে। এ দিন সিপাহীরা বিদ্রোহ করে সেনা ছাউনি থেকে বেরিয়ে যায় এবং শত্রুদের হত্যা করে দিল্লি অভিমুখে যাত্রা করে। ১১ মে তারা দিল্লি দখল করে। এরপর একে একে মথুরা, লক্ষ্ণৌ, ভরতপুর, কানপুর, এলাহাবাদ, ঝাঁসি, ইন্দোরসহ পুরো ভারতেই বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। বিদ্রোহ শুরুর আগে যদিও ব্রিটিশ বিভিন্ন প্রশাসক ও সেনা কর্মকর্তারা সিপাহী ও জনসাধারণের মধ্যে অসন্তোষের ইঙ্গিত দিয়েছিল, কিন্তু ঊর্ধ্বমহল একে ততটা পাত্তা দেয়নি। এ অনেকটা হাইতির বিপ্লবের মতো। হাইতিতে দাসরা যখন প্রথম বিদ্রোহ শুরু করেছিল এবং বিদ্রোহের কয়েকদিন পর এই খবর যখন ফরাসি দেশে এসে পৌঁছে তখন ফরাসি ওপর মহল একে গুজব বলে উড়িয়ে দিতে চেয়েছিল। হাইতিতে বিপ্লবের ঘটনা বিশ্বাস করতে ফরাসিদের প্রায় মাস খানেক সময় লেগেছিল। তাদের ধারণাতেই ছিল না যে দাসরা আবার বিপ্লব করতে পারে! সিপাহীদের বিদ্রোহে অনেকটা সে রকমই বিস্মিত হয়েছিল ব্রিটিশরা। তারা ভেবেছিল মার্চে মঙ্গল পাণ্ডের ফাঁসির ঘটনায় সিপাহীরা দমে যাবে। কিন্তু সেটি হয়নি। বিদ্রোহ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত, এমনকি বহু বছর পরও বিদ্রোহকে খাটো করে উপস্থাপন করা হয়েছিল। ব্রিটিশ প্রশাসক ও ইতিহাসবিদরা বিদ্রোহটিকে শুধু কতিপয় সিপাহীর বিদ্রোহ হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছে। তারা দেখাতে চেয়েছে কিছু উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও পথভ্রষ্ট্র সিপাহী এটি করেছে এর সমুচিত বিচার করা হয়েছে। ব্রিটিশদের রচিত অনেক গ্রন্থে সিপাহীদের নৃশংসতার কথাও তুলে ধরা হয়েছে।
ব্রিটিশদের এই প্রচারে অনেক দেশীয় ইতিহাসবিদও প্রভাবিত হয়েছেন। অনেকেই মহাবিদ্রোহের ইতিহাস লিখতে গিয়ে বিদ্রোহটিকে শুধু সিপাহী বিদ্রোহ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। হাতের কাছেই এর উদাহরণ রতন লাল চক্রবর্তী। তিনি তাঁর বইয়ের নাম রেখেছেন, সিপাহি যুদ্ধ ও বাংলাদেশ। কিন্তু বিদ্রোহটি কি আসলে তাই ছিল? কার্ল মার্ক্স তো ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতাযুদ্ধ হিসেবেই আখ্যায়িত করেছেন। বিদ্রোহের ইতিহাস যদি আমারা পুঙ্খানুপুঙ্খভাব দেখি, দেখব যদিও বিদ্রোহটি শুরু করেছিল সিপাহীরা, এই বিদ্রোহে কৃষক এবং সাধারণ জনতার স্বতঃস্ফূর্ত ও সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। ১৮৫৭ সালের পলাশির যুদ্ধে নবাব সিরাজ-উদ্দৌলাকে পরাজিত করে ব্রিটিশরা বাংলায় তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল। এরপর ১৭৬৫ সালে দেওয়ানি লাভের মাধ্যমে বাংলায় রাজস্ব, অর্থ ও শাসন করার প্রায় পুরো ক্ষমতাই তাদের হাতে চলে যায়। ১৮৫৭ সাল থেকে ১৮৫৮ সাল পর্যন্ত একের পর এক যুদ্ধের মাধ্যমে ব্রিটিশরা প্রায় পুরো ভারতেই তাদের শাসন বিস্তার করেছিল। এমনকি দেশীয় রাজ্যগুলোও তারা দখল করে নিচ্ছিল এবং দখল করার পাঁয়তারা করছিল। ব্রিটিশরা বাংলায় তাদের কর্তৃত্ব শুরু করেই ভূমি কর ও শোষন বৃদ্ধি করেছিল। ব্রিটিশদের ভূমি নীতিতে জমিদার এবং উচ্চ-নিম্নবিত্ত কৃষক সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। কৃষকদের সামনে প্রধান দুই শত্রু ছিল জমিদার- জোতদার ও ব্রিটিশ সরকার। এরিক স্টোকসের মতে কৃষক সমাজই সামরিক বিদ্রোহ এবং গ্রামীণ অসন্তোষ ও বিদ্রোহের মধ্যে যোগাযোগ তৈরি করেছে। স্টোকস মনে করেন, বিদ্রোহটি ছিল মূলত কৃষকদের সেনাবাহিনীরই বিদ্রোহ। তবে তার মতে বিদ্রোহে কৃষকদের চালিত করেছিলেন স্থানীয় ভূস্বামী ও ধনী কৃষকরা। নিজেদের চৈতন্যে তারা কাজ করেনি।
 
Advertisement
 
কৃষক চৈতন্য নিয়ে কাজ করেছেন নিম্নবর্গের ইতিহাসের প্রতিষ্ঠাতা রণজিৎ গুহ। কৃষক চৈতন্যের প্রসঙ্গ আলোচনা করতে গিয়ে এলিমেন্টারি আসপেক্টস অব পিজ্যান্ট ইন্সারজেন্সি ইন কলনিয়াল ইন্ডিয়া গ্রন্থে ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের কথা টেনেছেন। এই বিদ্রোহে কৃষকদের নিজেদের চৈতন্যে সামিল হওয়ার কথা তিনি বলেছেন। তাঁর মতে, কৃষকরা তাদের শোষক ও স্বতন্ত্র স্বত্ত্বা (অটোনমাস আইডেনটিটি) সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহে কৃষকরা ব্রিটিশ কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং আবাদকারীদের (প্লান্টার) যেমন আক্রমণ করেছিল, তেমনি দেশীয় বেনিয়া ও মহাজনরাও আক্রমণের শিকার হয়েছিল। রণজিৎ গুহের মতে, ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহে অংশ নেওয়া গ্রামীণ কৃষকদের মধ্যে চাপাতি এবং গুজব (রিউমার) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। যেকোনো জন আন্দোলনেই গুজব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। রণজিৎ গুহ দেখিয়েছেন উত্তর ভারতে, চালওয়া বা চাপাতি বিশেষ একটি অর্থ বহন করে। যেকোনো মহামারি শুরু হলে চালওয়া বা চাপাতি বিতরণ করা হয়। চালওয়ার মাধ্যমে গ্রামবাসী মহামারি গ্রামের বাইরে বের করতে চায়। বিদ্রোহ শুরু হওয়ার ঠিক আগে উত্তর ভারতের গ্রামগুলোতে চাপাতি বিতরণ করা হয়েছিল। কিন্তু চাপাতি বিতরণকারীর নাম ছিল অজ্ঞাত। ব্রিটিশ সরকার এই চাপাতি বিতরণ বন্ধ করতে অনেক চেষ্টা করেছিল। রণজিৎ গুহের মতে এই চাপাতি বিতরণের মধ্যে বড় একটি রাজনৈতিক সংগ্রামের ইঙ্গিত দিয়েছিল বিদ্রোহীরা এবং চাপাতি বিতরণ থেকে গ্রামবাসী সেই অর্থই করে নিয়েছিল। গ্রামবাসীর মধ্যে গুজব রটেছিল যে ১৮৫৭ সালে ব্রিটিশ শাসন ১০০ বছর পূর্ণ করবে এবং এই ১০০ বছরে এসে বড় একটি বিদ্রোহে ব্রিটিশ শাসন ধসে পড়বে। তাই বিদ্রোহীরা নিজেদের শুধু ভাগ্য বিধাতার ক্রীড়নক হিসেবে উপস্থাপন করেছিল। এ ছাড়া গুজব রটেছিল, ব্রিটিশরা শুধু অস্ত্রে অপবিত্র চর্বিযুক্ত কার্তুজ দিয়ে সিপাহীদের ধর্মই নষ্ট করতে চায় না, তারা পুরো ভারতবাসীরই ধর্ম নষ্ট করতে চায়। ব্রিটিশরা অন্যান্য খাদ্যদ্রব্যেও অপবিত্র জিনিস মিশিয়ে গ্রামবাসীর ধর্ম নষ্ট করছে।
সিপাহীরা বিভিন্ন কারণে বিদ্রোহ শুরু করেছিল। এখানে ধর্ম, আইডেনটিটি, আত্মসম্মান তো কাজ করেছিল বটেই। এ ছাড়া অর্থের ব্যাপারও ছিল। সিপাহীদের মাইনে ও সুবিধা ছিল যৎসামান্য। আর ইউরোপীয়দের তুলনায় তাতো উল্লেখ করার মতোই নয়। সিপাহীরাই প্রথম বিদ্রোহ শুরু করেছিল এটা ঠিক। কিন্তু আমরা দেখেছি, বিদ্রোহ সিপাহীদের মধ্যেই সীমিত ছিল না। ব্রিটিশদের রচিত ইতিহাসে একে ‘সেপয় মিউটিনি’ বলে হেয় করা হয়েছে। সিপাহী বিদ্রোহের সময় দেখা গেছে গ্রামের কৃষক এবং বিভিন্ন আদিবাসী গোষ্ঠী যেমন, ধুনধিরসহ অনেকেই বিদ্রোহে যোগ দিয়েছে। সক্রিয় লড়াই করেছে। শুধু কৃষক নয়, অনেক জমিদার এবং দেশীয় রাষ্ট্রের কর্ণধাররাও এ যুদ্ধে শামিল হয়েছিলেন। তাঁরা সিপাহী ছিলেন না। এর মধ্যে ঝাঁসির রানী এবং নানা সাহেবের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো। ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহে ঝাঁসির রানীর বীরত্ব নিয়ে এখনো ঝাঁসিতে অনেক মিথ প্রচলিত রয়েছে।