উসুলে ফিকহ: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

বিষয়বস্তু বিয়োগ হয়েছে বিষয়বস্তু যোগ হয়েছে
সম্পাদনা সারাংশ নেই
আশরাফ উদ্দীন খান-এর সম্পাদিত সংস্করণ হতে AftabBot-এর সম্পাদিত সর্বশেষ সংস্করণে ফেরত
ট্যাগ: পুনর্বহাল
৯ নং লাইন:
উসুল আল ফিকহতে সাধারনত শরয়তি হুকুম, হাকিম, মাহকুম-আলাইহি, মাহকুম-ফিহ, শরিয়াতের মূল ও আনুসঙ্গিক (মুত্তাকাফ-মুখতালাফ ফিহ) উৎস, উৎসের প্রামানিকতা, সেখান থেকে মাসালা ইসতিমবাত করার শর্তাবলী, মাসালা ইসতিমবাত করার পদ্ধতি অর্থাৎ ভাষা ভিত্তিক মূলনীতি, নসুসের মূলনীতি, ইজতিহাদ-তাকলিদ, মুজতাহিদ-মুকাল্লিদ, এদের অবস্থা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা করে থাকে। শরিয়াতের মৌলিক উৎস হচ্ছেঃ [[কুরআন]], [[হাদিস]], [[ইজমা]], [[কিয়াস]] আর অমৌলিক উৎস হচ্ছে একাধিক তবে প্রসিদ্ধ মত হচ্ছে সাতটি যথাঃ মাসালিহে মুরসালা, ইসতিহসান, উ’রফ, সাহাবীর বক্তব্য, পুর্ববর্তী শরিয়াত, সাদ্দে-যারাইয় ও ইসতিসহাব। আর ফিকাহের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে কুরান-হাদিসের মাধ্যমে প্রমানিত বান্দার আমল, অর্থাৎ [[নামাজ]], [[রোজা]], [[যাকাত]] ইত্যাদি।
 
<!--উসুলে ফিকহঃ পরিচয়, ইতিহাস ও ধারা
'''উসুলে ফিকহের আলোচ্য বিষয়ঃ'''
আমাদের ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের তালিকায় “ইলমে-ফিকহ” ও “ইলমে-উসুলে-ফিকহ” নামে দুইটি শাস্ত্র রয়েছে। মুসলমান হিসাবে আমাদের জন্যে যে সকল ইবাদাত করনীয় তার বিবরন বা শিক্ষা দেওয়া হয় ফিকাহ শাস্ত্রে। এই সকল ইবাদাত, মুয়ামালাত, মুয়াশারাত আমরা কুরান-হাদিসের নস বা ভাষ্য থেকে আহরন করে থাকি। কুরান-হাদিসের নস থেকে মাসালা ইসতিমবাত বা উদ্ঘাটন করার পথ-পদ্ধতি নিয়ে উসুলে ফিকাহতে আলোচনা করা হয়। সেই হিসাবে উসুলে ফিকাহ হচ্ছে ফিকাহ শাস্ত্রের মুলনীতি।
 
বর্তমান গ্রবন্ধে আমরা নিম্মোক্ত বিষয় ( ) নিয়ে আলোচনা করবো ইনশা আল্লাহঃ
হানাফি আলেমদের মতে উসুলে ফিকহের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে শারিয়াতের হুকুম-আহকাম অর্থাৎ ওয়াজিব, মুস্তাহাব, হারাম, মাকরুহ, মুবাহ। হানাফি মাজহাবের আরেকদল আলেমের মতে আলোচ্য বিষয় হচ্ছে শারিয়াতের দলিল-প্রমান যার মাধ্যমে হুকুম-আহকাম সাব্যস্ত হয়ে থাকে। পক্ষান্তরে অধিকাংশ আলেমের মতে আলোচ্য বিষয় হচ্ছে শারিয়াতের দলিল-প্রমান বা উৎসের প্রকার, তাদের তারতম্য বা স্তর, এই উতস থেকে হুকুম উদ্ঘাটন বা ইসতিমবাত করার পদ্ধতি। এবং উসুলে ফিকহের প্রকৃতির দিকে খেয়াল করে বলা যায় যে, এই তৃতীয় মতটাই অধিক গ্রহনযোগ্য। এর উদাহরন হিসাবে উল্লেখ করা যায় যে, উসুলবিদ এই আলোচনা করে থাকেন যে, সামনে উল্লেখিত আয়াতে বর্নিত “আমর” উজুবের অর্থ সাব্যস্ত করেঃ
উসুলে ফিকহের সংজ্ঞা
উসুলে ফিকহের আলোচ্য বিষয়
উসুলে ফিকহের উতস
উসুলে ফিকহের শুরুর কথা ও উসুলের ফিকহের রচনা
উসুলে ফিকহের পুর্ববর্তী গবেষকদের গবেষণা-ধারা
বর্তমান গবেষকদের গবেষণা ও রচনা-পদ্ধতি
(আলোচনাটি তৈরীতে “তারিখে ইলমে উসুলিল ফিকহ – ডঃ তাহির আল-আতবানী” ও “উসুলুল ফিকহ ওয়া মাদারিসুল বাহসি ফিহি- ডাঃ ওয়বাহ জুহাইলি” প্রবন্ধ থেকে সাহায্য নেওয়া হয়েছে)
 
অর্থাৎ ফিকাহ শাস্ত্রের দলিল-প্রমান জানা অর্থ এই বিষয় জানা যে, কুরান-হাদিস, ইজমা-কিয়াসের মাধ্যমে শরিয়াতের বিধান সাব্যস্ত হয়, শরিয়াতের নসুস বা ভাষ্যে উল্লেখিত “আমর” ওয়জিবের জন্যে, “নাহি” তাহরিমের জন্যে – যদি এই আমর-নাহীর সাথে অন্যে কোন আলামাত যুক্ত না হয়। নসুসের “আম” শব্দের মাধ্যমে তার সকল সদস্যকে বুঝানো হয় –তাতে “তাখসিস” না হলে ইত্যাদি বিষয় বুঝানো হয়েছে।
{وأقيموا الصلاة}
 
দলিল-প্রমান থেকে মাসালা উদ্ঘাটন করার পদ্ধতি সম্পর্কে জানা এর মাধ্যমে এই দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, এই সমস্ত দলিল-প্রমান থেকে কিভাবে শরিয়াতের প্রয়োগিক মাসালা উদ্ঘাটন করতে হয় তার পদ্ধতি সম্পর্কে জানা থাকতে হবে। সুতরাং ইসতিদলাল-ইসতিমবাত সম্পর্কে জ্ঞান থাকতে হবে, যেমন “নস” “জাহিরের” উপর প্রাধান্য পাবে, “মুতাওয়তির” “আহাদের” উপর প্রাধান্য পাবে ইত্যাদি।
অর্থঃ কারন এখানে আমরের মৌলিক অর্থের সাথে অন্য কোন আলামত যুক্ত হয়নি। দ্বিতীয় উদাহরনঃ সামনের আয়াতে বর্নিত “নাহি” হুরমাতের অর্থ প্রদান করছে, কারন এখানেও নাহির মুল অর্থের সাথে অন্য কোন আলামাত যুক্ত হয়নি।
 
বান্দার অবস্থা জানা, অর্থাৎ বান্দা মুজতাহিদ হলে তার কি শর্ত আর মুজতাহিদ না হয়ে মুকাল্লিদ হলে তার কি শর্ত এই সকল শর্ত নিয়ে এই শাস্ত্রে আলোচনা করা হয়ে থাকে। অর্থাৎ কখন একজন মুজতাহিদের ইজতিহাদ করা মাসায়িল আমাদের জন্যে বা মুকাল্লিদের জন্যে অনুসরন করা অপরিহার্য হবে ইত্যাতি বিষয় নিয়ে এখানে আলোচনা হয়ে থাকে।
{ولا تقتلوا النفس}
সুতরাং উসুলে ফিকহের সংজ্ঞা হবে “ফিকাহ শাস্ত্রের দলিল-প্রমান সম্পর্কে জানা, এরপর সেই দলিল-প্রমান থেকে হুকুম-আহকাম উদ্ঘাটন করার পদ্ধতি সম্পর্কে জানা এবং কারা মাসায়া উদ্ঘাটন করতে পারবে বা কাদের উদ্ঘাটন করা মাসালা সাধারন মুসলমানদের জন্য অপরিহার্য হবে সেই সম্পর্কে জানা”।
 
প্রথমে বলেছিলাম যে, উসুলে ফিকহের সংজ্ঞা দুইভাবে প্রদান করা হয়েছে। প্রথম সংজ্ঞা ইতিপুর্বে উল্লেখ করেছি, এবার দেখি দ্বিতীয় সংজ্ঞা কিভাবে প্রদান করা হয়েছে।
আবার কখনো তারা আলোচনা করেন যে, “মুমিনুন” আম শব্দটি ইমানদার বলতে যত মানুষ আছেন তাদের সবাইকে বুঝিয়ে থাকে, (রাকাবাহ) এই মুতলাক শব্দটি যে কোন রাকাবার অর্থকেই অন্তর্ভুক্ত করে, এখানে ইমানের শর্ত অন্তর্ভুক্ত করে না। এই ধরনের মুলনীতি ব্যাপক মুলনীতি, প্রথম প্রকারের মুলনীতির মত বিশেষ কোন অবস্থার সাথে সীমাবদ্ধ না। তাই দেখা যায় যে, উসুলে ফিকহার কিতাবে সাধারনত শারয়ি হুকুম, হাকিম, মাহকুম-আলাইহি, মাহকুম-ফিহ, শারিয়াতের মূল ও আনুসংগিক (মুত্তাকাফ-মুখতালাফ ফিহ) উতস, উৎসের প্রামানিকতা, সেখান থেকে মাসালা ইসতিমবাত করার শর্তাবলী, মাসালা ইসতিমবাত করার পদ্ধতি অর্থাৎ ভাষা ভিত্তিক মুলনীতি, নসুসের মুলনীতি, ইজতিহাদ-তাকলিদ, মুজতাহিদ-মুকাল্লিদ, এদের অবস্থা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা করে থাকে। শারিয়াতের মৌলিক উতস হচ্ছেঃ কুরান, হাদিস, ইজমা, কিয়াস আর অমৌলিক উতস হচ্ছে একাধিক তবে প্রসিদ্ধ মত হচ্ছে সাতটি যথাঃ মাসালিহে মুরসালা, ইসতিহসান, উ’রফ, সাহাবীর বক্তব্য, পুর্ব্বর্তী শারিয়াত, সাদ্দে-যারাইয় ও ইসতিসহাব। আর ফিকাহের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে কুরান-হাদিসের মাধ্যমে প্রমানিত বান্দার আমল, অর্থাৎ নামাজ, রোজা, যাকাত ইত্যাদি।  
 
এই সংজ্ঞার মাধ্যমে এই দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, একজন উসুলবিদ কোন বিশেষ নস বা নসের ইসতিদলাল নিয়ে আলোচনা করেন না। অর্থাৎ উসুলবিদের আলোচনাতেই এই প্রসঙ্গ আসবে না যেঃ
{وأحل الله البيع وحرَّم الربا..}
{فمن شَهِد منكم الشهر فليصمه}
উল্লেখিত আয়াতের মাধ্যমে সুদের অবৈধতা আবার রোজার আবশ্যকতা প্রমান হয়, বরং তিনি শারিয়াতের মৌলিক নীতিমালা নিয়ে আলোচনা করবেন, অর্থাৎ তার আলোচনাতে আসবে যে, কুরান-হাদিস শারিয়াতের উতস এখান থেকে মাসয়ালা ইসতিমবাত করার পদ্ধতি, নাসকে “জাহির” এর উপর অগ্রাধিকার দেওয়া হবে, “মুতাওয়াতির” “আহাদের” উপর অগ্রাধিকার পাবে, “মুতলাক”কে মুকাইয়িদের” সাথে মিলানো হবে, শারিয়াতের সমস্ত “আমর” উজুবের অর্থে ইত্যাদি ধরনের মৌলিক নীতিমালা নিয়ে একজন উসুলবিদ আলোচনা করে থাকেন।
الأدلة التفصيلية أو الجزئية و الأدلة الكلية أو الإجمالية:
এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ইসলামী ফিকাহ বা উসুলে ফিকাহতে আমাদের সামনে দুই ধরনের দলিল রয়েছে। এক ধরনের দলিল কোন একটি বিশেষ অবস্থা বা বিধানের সাথে জড়িত, যেমন কুরানের আয়াতঃ
{حُرّمت عليكم أمهاتكم وبناتُكم..}
{ولا تقربوا الزنى..}
প্রথম আয়াতটির মাধ্যমে একটি বিশেষ হুকুম অর্থাৎ উল্লেখিত মাহরামের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করা অবৈধ সাব্যস্ত হয় আর দ্বিতীয় আয়াতের মাধ্যমে সাব্যস্থ হয় যে, জিনা হারাম। একই সাথে শারিয়াতে এরেক প্রমাক দলিল রয়েছে যেগুলো বিশেষ একক কোন অবস্থা বা হুকুমের সাথে সম্পর্ক রাখে না, বরং সেগুলোর সম্পর্ক একাধিক হুকুমের সাথে, যেমন কুরান-সুন্নাত, ইজমা-কিয়াস, আমর উজুবের অর্থ প্রদান করে, নাহি হুরমতের অর্থ প্রদান করে ইত্যাদি, এই সকল মুলনীতি উসুলবিদের আলোচনার বিষয়। পক্ষান্তরে প্রথম প্রকারের দলিল ফকিহ বা ফিকাহ বিশারদের আলোচনার বিষয়।
 
উসুলে ফিকহের আলোচ্য বিষয়ঃ
 
উসুলে ফিকহের উতস মুলঃ
কুরান-সুন্নাহ উসুলে ফিকহের মুল উতস, কারন এই দুই উতস থেকেই মুজতাহিদগণ ইসলামী বিধি-বিধান ইসতিমবাত করার পথ-পদ্ধতি সম্পর্কে ধারনা লাভ করেছেন। কুরান-সুন্নাহের পরে আসে আরবী ভাষার গুরুত্ব, যেহেতু কুরান-হাদিস আরবী ভাষায় অবতীর্ন হয়েছে এবং এর প্রামানিক ও প্রয়োগিক ব্যাখ্যাও আরবীতেই হয়েছে সেজন্য আরবী ভাষার সাধারণ নিয়ম-কানুন ও ব্যকরান জ্ঞানের বিস্তারিত আলোচনা যেমনঃ আম-খাস, সরিহ-কিনায়াহ, মুতলাক-মুকাইয়াদ, হাকিকত-মাযাজ, মানতুক-মাফহুম ইত্যাদি ভাষা-সংক্রান্ত বিষয় উসুলে ফিকহের মৌলিক আলোচনা হিসাবে গন্য হয়েছে।
 
উসুলে ফিকহের শুরুর ইতিহাস ও রচনা শুরুঃ
এই বিষয়ে কোন সন্দেহে নেই যে, ইলমে ফিকহের সাথে সাথেই ইলমে উসুলে ফিকহের উতপত্তি ঘটে। তবে একটি স্বতন্ত্র শাস্ত্র হিসাবে এর পঠন-পাঠন, এই বিষয়ে গবেষণা, ও আদালা গ্রন্থ রচনা ইমাম শাফী রাঃ এর মাধ্যমে দ্বিতীয় হিজরি সালের পর থেকেই শুরু হয়। বর্তমান প্রবন্ধতে আমরা ইসলামী এই শাস্ত্রের উত্তপত্তি ও ক্রম-বিকাশ নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করতে চাই। আমাদের আলোচনার শিরোনাম হবে নিম্নরুপঃ
উসুলে ফিকহের উতপত্তি
উসুলে ফিকহের রচনা-গবেষণা
উসুলে ফিকহের গবেষনা-পদ্ধতি
উসুলে ফিকহের মৌলিক রচনাবলী
 
উসুলে ফিকহের উতপত্তিঃ
ইলমে ফিকাহ যতদিনের পুরাতন শাস্ত্র ঠিক তেমনি ইলমে উসুলে ফিকহও ততদিনের পুরানো, কারন এটা যুক্তি সম্মত নয় যে, ফিকহের মাসালা উদ্ঘাটন করার পদ্ধতি সম্পর্কে ধারনা ছাড়াই (ইসতিম্বাতে মাসায়িল) ফিকাহ শাস্ত্র অস্তিত্ব লাভ করবে। তবে উসুলে ফিকাহ একদিনে আজকের অবস্থানে এসে পৌছেনি, বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য স্তর অতিক্রম করে উসুলে ফিকাহ এই অবস্থায় এসে পৌছেছে। তাই আমরা যখন উসুলে ফিকাহের ইতিহাত নিয়ে আলোচনা করি তখন আমাদেরকে সেই স্তর বা পর্ব নিয়ে আলোচনা করতে হয়। সেই হিসাবে আমরা বলতে পারি উসুলে ফিকাহ নিচে বর্নিত যুগ বা স্তর অতিক্রম করে আজকের অবস্থানে এসে পৌছেছেঃ
 
একঃ নবুওয়াত-যুগঃ
নবুওয়াতের যুগে ইসলামী বিধান বা তাশরীর উতস ছিল স্বয়ং আল্লাহর রাসুল, যেকোন বিষয় বা সমস্যা দেখা দিলে সাহাবায়ে কেরাম আল্লাহর রাসুলের কাছে উপস্থিত হয়ে তা উল্লেখ করতেন, এরপর আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হয়ত কুরানের ওহীর মাধ্যমে বা তার হাদিসের মাধ্যমে সেই বিষয়ে ইসলামী সমাধান প্রদান করতেন। সুতরাং কুরান-হাদিসের নসের মাধ্যমে ইসলামী ফিকাহের মৌলিক অংশ নবুওয়াতের যুগে ভিত্তি পায়। আল্লাহর রাসুলের হাদিস আল্লাহর অনুমোদনের মাধ্যমে উম্মতের সামনে এসেছে। আর হাদিসের মধ্যে তিন ধরনের বিষয় পাওয়া যায়ঃ রাসুলের নিজের কর্ম, রাসুলের কথা বা বক্তব্য আর রাসুলের অনুমোদন অর্থাৎ কোন সাহাবীকে কোন কাজ করতে দেখে তিনি যদি চুপ থেকে তার অনুমোদন করে থাকেন তাহলে সেখান থেকে সেই কাজের বৈধতা প্রমানিত হয়ে যায়। আল্লাহর রাসুল তার একাধিক সাহাবীর ইজতিহাদকে অনুমোদন দিয়েছেন, উদাহরন হিসাবে হযরত মুয়াজ ইবনে জাবালের প্রসঙ্গ উল্লেখ করা যেতে পারে। হযরত মুয়াজকে যখন আল্লাহর রাসুল গভর্নর হিসাবে ইয়ামেনে প্রেরন করলেন, তখন তাকে জিজ্ঞাসা করেলেনঃ
فقد سأله النبي - صلى الله عليه وسلم -: ((بِمَ تقضي إذا عُرض لك قضاء؟))، قال معاذ: أقضي بكتاب الله، قال: ((فإن لم تجد؟))، قال: أقضي بسُنَّة رسول الله، قال: ((فإن لم تجد؟))، قال: أجتهدُ رأيي ولا آلو، قال: ((الحمد لله الذي وفَّق رسولَ رسولِ الله لما يرضي الله ورسوله))
মুয়াজ, বিচার কার্য কিভাবে পরিচালনা করবে? তিনি উত্তরে বললেনঃ আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী বিচার করবো, আল্লাহর রাসুল বললেনঃ যদি আল্লাহর কিতাবে সেই বিষয়ের সমাধান না থাকে? আল্লাহর রাসুলের হাদিস অনুযায়ী বিচার করবো, যদি আল্লাহর রাসুলের হাদিসেও সেই সমাধান না থাকে? তাহলে ইজতিহাদ করে ফয়সালা দিবো আর এই ইজতিহাদের ব্যাপারে কোন ত্রুটি করবো না। আল্লাহর রাসুল তার এই উত্তর শুনে বললেনঃ “সমস্ত প্রশংসা মহান আল্লাহর যিনি তার রাসুলের রাসুলকে এমন কথা বলার তৌফিক দিয়েছেন যাতে তার রাসুল সন্তুষ্ট হয়েছেন” ।
সুতরাং এই বর্নানার মাধ্যমে আমরা এই ধারনাতে আসতে পারি যে, নবুওয়াতের যুগে ইসলামী বিধানের প্রধান উতস যদিও ছিল কুরান-হাদিস, তথাপি সেই যুগেও ইজতিহাদের অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল।
 
দুইঃ সাহাবী-যুগঃ
আল্লাহর রাসুলের ইন্তেকালের পরে আসে সাহাবীদের যুগ। সাহাবায়ে কিরামের যুগের সাধারণ অবস্থা ছিল এই যে, এই যুগে তাদের হাতে বিরাট সংখ্যক মাসায়িল বা বিধান মাওজুদ ছিল আল্লাহর কিতাব ও তার রাসুলের হাদিসের ভাষ্য বা নসের মধ্যে। কিন্তু সেই সাথে তাদের সময়ে এমন অনেক বিষয় বা সমস্যা দেখে দিল যা আল্লাহর রাসুলের যুগে ছিল না বিধায় তার সমাধানও তাদের সামনে উপস্থিত ছিল না। তাই তাদের জন্যে এবার আবশ্যক হয়ে পরল যে তারা এ সমস্ত উদ্ভূত বিষয়ে ইজতিহাদ বা গবেষনা করে তার সমাধান উদ্ঘাটন করবেন। তাই তারা তাদের ইজতিহাদ করা শুরু করলেন, রাসুলের যুগে ঘটেছে বা সেখানে তার বিধান আছে এমন বিষয়ের সাথে সদৃশ্য বিষয়কে তার সাথে যুক্ত করে অনুরুপ বিধান ইস্তিম্বাত করতেন, আর যে বিষয়ে পুর্বে কোন সাদৃশ পাওয়া না যায় সেখানে তারা শরীয়াতের সাধারন “মাসলাহাত” বা উদ্দেশ্যে সামনে রেখে গবেষণা করে সমাধান পেশ করতেন।
 
সাহাবায়ে কেরাম ও পরবর্তী মুজতাহিদের মাঝে যে পার্থক্য বা ব্যবধান তা ছিল নিম্নরুপ, প্রথমত সাহাবায়ে কেরাম ছিলেন আরবী ভাষার অধিকারী, আবার তারা ছিলেন ওহীর প্রত্যক্ষদর্শী, ওহীর প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ার কারনে তাদের সামনে হাদিসের ইসনাদ বা বর্ননা-ধারা, হাদিস-বর্ননাকারীর অবস্থা, ইত্যাদি বিষয়ের আলোচনা তাদের জন্য প্রয়োজনীয় কোন বিষয় ছিল না। তাদের সামনে ছিল শুধু “আল্লাহর কিতাবে বলা হয়েছে…” আল্লাহর রাসুল বলেছেন …”।
 
এরই প্রেক্ষিতে দেখা যায় হযরত আবু বকরের খিলাফাত কালে তার সামনে যখন কোন মাসয়ালা আসত, তখন তিনি কিতাবুল্লাহতে তার সমাধান তালাশ করে দেখতেন, সেখানে যদি কোন সমাধান পেতেন তাহলে সেই অনুযায়ী ফয়সালা প্রদান করতেন, যদি কিতাবুল্লাহতে তার সমাধান না পেতেন তাহলে আল্লাহর রাসুলের হাদিসে তার সমাধান তালাশ করতেন, সেখানে যদি তার সমাধান পেতেন তাহলে সেই অনুযায়ী ফয়সালা করতেন, যদি হাদিসে কোন সমাধান না পেতেন তাহলে সাহাবীদেরদে জিজ্ঞাসা করতেন যে তারা কি এই বিষয়ে আল্লাহর রাসুলকে কিছু বলতে বা কোন ফয়সালা প্রদান করতে শুনেছেন, তার উত্তরে যদি কেউ বলত যে হ্যা তিনি এই বিষয়ে আল্লাহর রাসুলকে এমন ফয়সালা প্রদান করতে শুনেছেন এবং তার দাবী তার কাছে গ্রহনযোগ্য মনে হত, তাহলে তিনি সেই অনুযায়ী ফয়সালা প্রদান করতেন, যদি রাসুলের হাদিসে কোন সমাধান না পেতেন তাহলে ফকিহ সাহাবীদের একত্রিত করে তাদের পরামর্শ জানতে চাইতেন, যদি সেখান থেকে কোন সম্মিলিত মত বের হত তাহলে সেই অনুযায়ী ফয়সালা প্রদান করতেন।
 
হযরত আবু বকরের পরে হযরত উমর ফারুক রাঃও এইভাবে ফয়সালা প্রদান করতেন। কুরান-হাদিসে কোন ফয়সালা না পেলে তিনি সাহাবীদের জিজ্ঞাসা করতেন এই ব্যাপারে হযরত আবু বকরের পক্ষ থেকে কোন ফয়সালা আছে কি না, যদি হযরত আবু বকরের কোন ফয়সালা থাকত তাহলে তিনি সেই অনুযায়ী ফয়সালা প্রদান করতেন। অন্যথায় ফকিহ সাহাবীদের সমেবত করে তাদের সাথে পরামর্শ করে ফয়সালা প্রদান করতেন। হযরত উমর ফারুক তার নিযুক্ত গভর্নর ও বিচারকদেরকে এই পদ্ধতি অনুসরন করার আদেশ দিতেন, তিনি তাদেরকে বলতেন আল্লাহর কিতাব ও রাসুলের হাদিসে কোন সমাধান না পেলে ইজতিহাদ করতে।
 
এইভাবে সাহাবায়ে কেরামের ইজতিহাদের মাধ্যমে আমাদের সামনে উতস থেকে কিভাবে মাসালা উদ্ঘাটন করতে হবে তার পথ-পদ্ধতির রুপরেখা উঠে আসে। সামনে আমরা সাহাবায়ে কেরামের ইজতিহাদ থেকে ইসতিমবাত করা কিছু ফিকহি কায়েদা উল্লেখ করছিঃ
 
প্রথম কায়েদাঃ
সাহাবায়ে কিরামের পদ্ধতি থেকে আমাদের সামনে এই বিষয়টি পরিস্কার হয়ে উঠে যে, ইজতিহাদের পুর্বেই সর্বপ্রথম স্থান দিতে হবে কুরান-হাদিসকে, কুরান-হাদিসে কোন সমাধান থাকলে ইজতিহাদের বৈধতা নেই। হযরত আবু বকর ও হযরত উমরের আমল থেকে এই বিষয়টি অত্যন্ত স্পষ্ট। কুরান-হাদিসে না থাকলে তারা ফকিহ সাহাবায়ে কেরামকে একত্রিত করে তাদের মতামত গ্রহণ করতেন, যদি এখানে কোন সম্মিলিত মত পাওয়া যেত তাহলে সেই মতকেই অগ্রাধিকার দেওয়া হত, সম্মিলিত মতে না পৌছলে সেখান থেকে কোন একটি মত গ্রহণ করা হত। সম্মিলিত মতের গ্রহণ বর্তমান সময়ে আমাদের ফিকাহ একাডেমীর সাথে অনেকটা সাদৃশ্য রাখে।
 
দ্বিতীয় কায়েদাঃ
সাহাবীদের যুগে শরীয়াতের দলীল হিসাবে “ইজমার” আত্বপ্রকাশ হয়। হযরত আবু বকর ও হযরত উমরের পক্ষ থেকে ফকিহ সাহাবাদেরকে একত্রিত করে তাদের থেকে পরামর্শ নেওয়া হত এবং তারা কোন বিষয়ে একমত হলে সেই অনুযায়ী ফয়সালা গ্রহন করা হত। এর মাধ্যমে ইজমার ধারনাটি স্পষ্ট হয়ে উঠে।
 
তৃতীয় কায়েদাঃ
একই বিষয়ে যদি দুইটি পরস্পর বিরোধি নস পাওয়া যায় এবং তাদের মধ্যে কে অগ্রবর্তী আর কোনটি পরবর্তী তা নিশ্চিতভাবে জানা থাকে তাহলে এখানে পরবর্তী নসকে “নাসেখ” ধরা হবে আর পুর্ব্বর্তী নস “মানসুখ” হয়ে যাবে। যদি নস দুইটির কালিক অবস্থান জানা না যায় তাহলে উভয়ের মাঝে সম্বনয় সাধানের চেষ্টা করা হবে, কারন যেহেতু উভয়ের মর্যাদা এক স্থরের তাই একটিকে বাদ দিয়ে আরেকটির উপর আমল করার যুক্তিকতা নেই। এর উদাহরন হিসাবে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদের ইস্তিম্বাত পেশ করা যেতে পারে।
 
স্বামীর ইন্তেকালের পর গর্ভবতী স্ত্রীর ইদ্দত পালনের মাসয়ালাঃ
عن محمد بن سيرين، قال: لقيتُ مالك بن عامر، أو مالك بن عوف، قلت: كيف كان قول ابن مسعود في المتوفى عنها زوجها وهي حامل؟ فقال: قال ابن مسعود: أتجعلون عليها التغليظ، ولا تجعلون لها الرخصة؟ أنزلتْ سورة النساء القصرى بعد الطولى"[3].
মুহাম্মাদ ইবনে সিরিন থেকে বর্নিত, তিনি বলেন আমি মালেক বিন আমের বা মালেক বিন আউফের সাথে সাক্ষাত করে তাকে জিজ্ঞাসা করলামঃ স্বামীর ইন্তেকালের পরে গর্ভবতী স্ত্রীর ইদ্দতের ব্যাপারে হযরত ইবনে মাসউদের বক্তব্য কি ছিল? তিনি বললেনঃ ইবনে মাসউদ বলেছেনঃ “তার উপর কি কঠোরতা আরোপ করবে, তাকে কি সহজতার সুযোগ প্রদান করবে না, সুরা তালাকের আয়াত সুরা নিসার আয়াতের পরে অবতীর্ন হয়েছে”।
অর্থাৎ ইবনে মাসউদ মনে করেন যে, পবিত্র কুরানের আয়াতঃ
﴿ وَأُولَاتُ الْأَحْمَالِ أَجَلُهُنَّ أَنْ يَضَعْنَ حَمْلَهُنَّ ﴾
অর্থঃ “গর্ভবতী মহিলাদের ইদ্দতের মেয়াদ হবে তাদের গর্ভপাত হওয়া পর্যন্ত” (সুরা তালাকঃ৪)
আয়াতটি সুরা বাকারার আয়াতঃ
﴿ وَالَّذِينَ يُتَوَفَّوْنَ مِنْكُمْ وَيَذَرُونَ أَزْوَاجًا يَتَرَبَّصْنَ بِأَنْفُسِهِنَّ أَرْبَعَةَ أَشْهُرٍ وَعَشْرًا ﴾
অর্থঃ “তোমাদের মধ্য থেকে যারা মারা যায় ও তাদের স্ত্রীদেরকে রেখে যায় তারা (স্ত্রীরা তাদের স্বামীদের মৃত্যুর পর) চার মাস দশ দিন অপেক্ষা করবে”। (সুরা বাকারাঃ ২৩৪)
আয়াতটিকে মানসুখ করে দিয়েছে।
 
কারন বাকারার আয়াত দ্বারা বুঝা যায় যে, স্বামীর মৃত্যুর পরে স্ত্রীর ইদ্দতের সময়সীমা হচ্ছে ৪ মাস ১০ দিন, চাই স্ত্রী গর্ভবতী হোক অথবা গর্ভবতী না হোক, আর সুরা তালাকের আয়াত দ্বারা বুঝা যায় যে, গর্ভবতী স্ত্রী ইদ্দত পালন করবে সন্তান প্রসাব করা পর্যন্ত, চাই তার ইদ্দতের কারন স্বামীর ইন্তেকাল হয়ে থাক বা অন্য কোন কারন হয়ে থাক, (অর্থাৎ তালাক দিয়ে থাক)
 
অন্যান্য সাহাবীগনের মন্তব্য হচ্ছে এই যে, উভয় আয়াতের মাঝে সম্বনয় সাধন করা হবে এইভাবে যে স্বামীর মৃত্যুর পরে স্ত্রীর ইদ্দের সময়কাল হবে দুরবর্তী সময়, অর্থাৎ ৪ মাস ১০ দিন আর প্রসাবের মধ্যে যে সময়টি অধিক সময়ের হবে সেই সময় পর্যন্ত তার ইদ্দত চলবে ।
 
চতুর্থ কায়েদাঃ
এক ধরনের বিষয়কে ইল্লতের ভিত্তিতে এক করে তার বিধান নির্ণয় করা হয়েছে। এই উদাহরন হিসাবে মদ্যপের হদ্দের মাসালা উল্লেখ করা যায়ঃ হযরত আলী থেকে বর্নিত যে তিনি হযরত উমর ফারুক রাঃ কে বলেনঃ “মানুষ মদ পান করার পরে মাতাল হয়ে পরে, আর মাতাল হলে আবল- তাবল বকতে থাকে, আর আবল-তাবল বলায় অবস্থায় অন্যকে অপবাদ দিয়ে থাকে আর অন্যকে অপবাদ দিলে তার উপর ৮০ দোরররা লাগানো হয়”। যখন হযরত উমর রঃ তার কাছে মদ্যপের হদ্দের ব্যাপারে জানতে চাইলেন, কারন হযরত উমরের ধারণা হচ্চিল যে, মানুষ মদ পানে থেকে বেচে থাকার ব্যাপারে শিথীলতা দেখাচ্ছে। এই ধরনের ইস্তিম্বাতকে উসুলের পরিভাষায় “কিয়াস” বলা হয়ে থাকে।
 
পঞ্চম কায়েদাঃ
অনেক সময় সাহাবায়ে কেরাম শুধুমাত্র “মাসলাহা” কে কোন বিধান বা হুকুমের ভিত্তি বানিয়ে সমাধান প্রদান করেছেন, যেমন, একজন শ্রমিক যে কাজ করছে যদি সেই কাজে সে কোন ক্ষতি করে ফেলে তাহলে সে তার ক্ষতিপুরন দিতে বাধ্য থাকবে কি না, হযরত আলীর মতে দিতে বাধ্য থাকবে, কারন এই বাধ্যকতা না থাকলে শ্রমিকেরা অন্যেক জিনিস নিয়ে অবহেলা দেখাবে, হযরত আলীর বক্তব্যঃ
"لا يصلح الناس إلا ذاك" ।
অর্থঃ “এছাড়া অন্য কিছু মানুষের উপযুক্ত হবে না”।
অর্থাৎ এই মাসালা থেকে স্পষ্টত বুঝা যায় যে, সাহাবায়ে কেরাম নসের অনপুস্থিতিতে “মাসলাহার” ব্যবহার করতেন।
 
এইভাবেই সাহাবায়ে কেরামের যুগ অতিবাহিত হয়ে যায়, সাহাবায়ে কেরামের যুগে মাসালা ইস্তিম্বাত করার বেশ কিছু কায়েদা বা মুলনীতি নির্ধারিত হয়। তবে এটা ঠিক যে, তাদের যুগে সেই সকল মুলনীতি গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করা শুরু হয়নি। তবে মুলনীতিগুলো লিপিবদ্ধ না হলেও সাহাবায়ে কেরামের ইস্তিম্বাত-ফাতওয়া থেকে এই ধরনের কায়েদা উদ্ঘাটন করা যায়।
 
তিনঃ তাবেয়ী-যুগঃ
সাহাবায়ে কেরামের যুগের পরে আসে “তাবেয়ী-যুগ” তারাও সাহাবায়ে কেরামের অনুসৃত পথ-পদ্ধতি অনুসরন করেন। তাবেয়ী-যুগে তিন ধরনের বিধান পাওয়া যায়ঃ
একঃ পবিত্র কুরানের বিধান
দুইঃ রাসুলের সুন্নতের বিধান
তিনঃ সাহাবায়ে কেরামের বিচার, ফায়সালা ও তাদের ফতওয়া
 
রাসুলের মাদিনাতে এই যুগে সাত ফকিহ নামে সাতজন প্রসিদ্ধ ছিলেন, তারা হলেনঃ (সাইদ ইবনে আল-মুসাইয়িব, উরওয়া ইবনে যুবাইর, কাসেম ইবনে মুহাম্মাদ, খারিজা ইবনে যায়েদ, আবু বকর ইবনে আব্দুর রাহমান, সুলাইমান ইবনে ইসার, উবাইদুল্লাহ ইবনে উবাইদুল্লাহ ইবনে আতাবা ইবনে মাসউদ) এই সময়ে ইরাকে প্রসিদ্ধ ছিলেন হযরত ইব্রাহীম আন-নাখয়ী, যিনি ছিলেন হযরত ইবনে মাসউদের ছাত্র। এইভাবে প্রত্যেক স্থানে তাবেয়ী ফাকিহ ছিলেন যারা তাদের পুর্ব্বর্তী প্রজন্ম সাহাবায়ে কেরামের ইলম, ফিকহ প্রচার-প্রসারে এবং উদ্ভূত বিষয়ে ইজতিহাদে মশগুল ছিলেন।
 
এই যুগে ইসলামী বিজয় দিক-বিদিক ছড়িয়ে পরে, ইসলামী সাম্রাজ্যের পরিধি বিস্তৃত হয়, ইসলামের ছায়া তলে অসংখ্য মানুষ আশ্রয় গ্রহন করেন। এই প্রেক্ষিতে নতুন নতুন বিষয়ে ইজতিহাদ-ইস্তিম্বাতের প্রয়োজন দেখা দেয়। এজন্যে তাবেয়ীগন কুরান-সুন্নাহের পাশাপাশি তাবেয়ীদের ফাতওয়ার উপর ভিত্তি করে মাসালা ইস্তিম্বাত শুরু করেন, ফলশ্রুতিতে ফিকহের পরিধি বিস্তৃত হয়ে যায়।
 
এই যুগে ইসলামী ফিকহের বিধানাবলী ছিল নিম্নরুপঃ
একঃ কুরানের বিধান
দুইঃ সুন্নাতের বিধান
তিনঃ সাহাবায়ে কেরামের ফাতওয়া-ইজতিহাদ
চারঃ তাবেয়ীদের ফাতওয়া-ইজতিহাদ
 
এই যুগে –ইজতিহাদের ব্যাপক ব্যবহারের কারনে- ইজতিহাদ-তাখরিজের বিভিন্ন পথ-পদ্ধতি প্রকাশ পায়, তবে ফিকাহ ও উসুলে ফিকাহের মুলনীতি এখনো গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ হয়নি, হতে পারে ব্যক্তিগত পর্যায়ে কেউ হয়ত লিপিবদ্ধ করেছেন কিন্তু তার কোন নুসখা আমাদের হাতে এসে পৌছেনি। তবে এই যুগে এসে হযরত উমর ইবনে আব্দুল আযিযের পৃষ্ঠপোষকতায় হাদিস সংকলনের অভিযান শুরু হয়
 
চারঃ মুজতাহিদ ইমামদের যুগঃ
তাবেয়ী ও তাবে-তাবেয়ীদের যুগের পরে আসে মুজতাহিদ ইমাম অর্থাৎ ইমাম মালিক, আবু হানিফা, শাফেয়ীদের মত ইমামদের যুগ। এই যুগেই ফিকাহ শাস্ত্রে গ্রন্থ রচনা শুরু হয়। প্রথম দিকের লিপিবদ্ধ গ্রন্থ বা ইলমের মধ্য থাকে আমাদের হাতে যা পৌছেছে তার প্রথম রচনা হচ্ছে ইমাম মালিক ইবনে আনাসের “মুয়াত্তা” কিতাব। ইমাম মালিক তার মুয়াত্ত কিতাবে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিস, সাহাবীদের আকওয়াল, (ফতওয়া) তাবেয়ীদের ফিকহ-আকওয়াল একত্রিত করেন। সেই হিসাবে বলা যায় যে, ইমাম মালিকের “মুয়াত্তা” ছিল হাদিস-ফিকহের সম্বনয়। আর ইমাম মালিক এই গ্রন্থ রচনা করেন খলিফা মানসুরের ফরমানের ভিত্তিতে।
ইমাম মালিকের পরে, ইমাম মুহাম্মাদ বিন হাসান সাইবানী গ্রন্থ প্রনয়ন শুরু করেন, এই সময়ে “জাহির-রিওয়াহ” নামে ছয়টি কিতাব রচনা করেন। সেই ছয়টি কিতাব হচ্ছেঃ
আল-মাবসুত ওয়াল-যিয়াদাত (المبسوط والزيادات)
আল-জামে আল-কাবির
আল-জামে আস-সাগির
আস-সিয়ার আল-কাবির
আস-সিয়ার আস-সাগির
জাহির-রিওয়াহ নাম করনের কারন এই যে, এই কিতাবগুলো তার নির্ভরযোগ্য ছাত্রদের থেকে বর্নিত হয়েছে, তাই এই কিতাবগুলো তার থেকে প্রমানিত “তাওয়াতুর” বা মাশহুরের সাথে। এই যুগে মাসয়ালার তাখরীজ, ফকিহদের ইস্তিদলাল-ইস্তিম্বাত-মুনাকাশায় মাধ্যমে উসুলে-ফিকহের পরিধি সম্প্রসারিত হতে শুরু করে।
 
ইমাম আবু হানিফা ও ইমাম বাকির রাঃ এর আলোচনা নিচে উল্লেখ করা হলঃ
ইমাম বাকির রাঃ – আপনি কুরান-হাদিস দ্বারা প্রমানিত দ্বীনকে কিয়াস/যুক্তি-বুদ্ধির অনুগত বানিয়েছেন
ইমাম আবু হানিফা রাঃ – যথাযত সম্মান প্রদর্শন পুর্বক ইমাম বাকির রাঃ কে তিনটি পালটা প্রশ্ন করলেনঃ
প্রথম প্রশ্নঃ পুরুষ দুর্বল না মহিলা
ইমাম বাকির রাঃ মহিলা দুর্বল
ইমাম আবু হানিফাঃ মিরাসের পুরুষের অংশ কতটুকু আর মহিলার অংশ কতটুকু
ইমাম বাকির রাঃ পুরুষের দুইভাগ আর মহিলার একভাগ
ইমাম আবু হানিফাঃ আমি যদি কিয়াসের ভিত্তিতেই মাসালা উদ্ঘাটন করতাম তাহলে আমি বলতাম মিরাসে পুরুষের অংশ হবে একভাগ আর মহিলার অংশ হবে দুইভাগ
দ্বিতীয় প্রশ্নঃ
ইমাম আবু হানিফাঃ নামাজ গুরুত্বপুর্ন বা রোজা
ইমাম বাকিরঃ নামাজ
ইমাম আবু হানিফাঃ যদি আমি কিয়াসের ভিত্তিতে ফতোয়া প্রদান করতাম তাহলে বলতামঃ হায়েজ থেকে পবিত্র হওয়ার পর মহিলারা নামাজের কাযা করবে, রোজার কাযা করবে না, কিন্তু এখানে কুরান-হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী রোজার কাযা আদায় করা হয়, নামাজের কাযা আদায় হয় না
তৃতীয় প্রশ্নঃ
ইমাম আবু হানিফাঃ প্রশ্রাব বেশি নাপাক না বীর্য বেশি নাপাক
ইমাম বাকিরঃ প্রশ্রাব বেশি নাপাক
ইমাম আবু হানিফাঃ যদি কিয়াসের ভিত্তিতেই আমি ফতওয়া প্রদান করতাম তাহলে আমার ফতোয়া হত প্রশ্রাবের পরে গোছল কর, আর বীর্যপাতের পরে ওজু কর
এই আলোচনার পরে ইমাম বাকির রাঃ ইমাম আবু হানিফার ইলেম-তাকওয়া সম্পর্কে জানতে পেরে বসা থেকে উঠে তাকে শ্রদ্ধার সাথে আলিঙ্গন করলেন, এবং তাকে সন্মানের চুম্বন দিলেন।
 
এক পর্যায়ে যখন আহলে-রায় ও আহলে হাদিসের মধ্যে ইখতিলাফ দেখা দিল, ইজতিহাদের যোগ্য না এমন ব্যাক্তির মাধ্যমে ইজতিহাদ হতে শুরু হল, তখন এমন কিছু কায়েদা-মুলনীতির তীব্র প্রয়োজন দেখা দিল যার মাধ্যমে ইজতিহাদ নিয়ন্ত্রিত হবে। সেই প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে ইমাম শাফেয়ী রাঃ উসুলে ফিকহের বিষয়ে প্রথম কিতাব রচনা করেন। ইমাম শাফেয়ীর ফিকাহ সম্পর্কিত কিতাব “আল-উম্ম” এর ভুমিকায় যে রিসালা যোগ করেছেন তার ছিল মুলত উসুলে ফিকহ বিষয়ক আলোচনা।
উসুলে ফিকহ সংকলনঃ
ধারনা করা যায় যে, ইলমে উসুলে ফিকহ প্রাথমিক পর্যায়ে ফকিহদের আলোচনাতে সাধারন কায়েদা হিসাবে প্রকাশ পায়, কারন দেখা যায় যে, একজন ফকিহ যখন তার ফতওয়া উল্লেখ করতেন তখন তার সাথে এর দলিল, এবং এই দলিল থেকে এই মাসায়ালা উদ্ঘাটনের পদ্ধতির দিকে ইঙ্গিত করতেন, আবার দুই ফকিহের মাঝে কখনো ইখতিলাফ দেখে দিলে উভয়ে তার বক্তব্যকে বিভিন্ন উসুল দ্বারা প্রমান করার চেষ্ঠ করতেন। তবে সর্বপ্রথম কে এই উসুলে ফিকহের রচনা শুরু করেন এই ব্যাপারে গবেষকদের মাঝে মতবিরোধ রয়েছে, যেমন কারো মতে উসুলে ফিকহের গোড়া পত্তন করেন ইমাম জাফর সাদিক, আবার কারো মতে ইমাম আবু হানিফার বিশিষ্ট ছাত্র আবু ইউসুফ, কিন্তু এদের কারো রচনাই আমাদের হাতে পৌছে নি। তাই অধিকাংশ গবেষক আলেমদের মত এটাই যে উসুলে ফিকহ নিয়ে প্রথম রচনা শুরু করেন ইমাম শাফেয়ী রাঃ।
আর-রিসালাহ এর সার-সংক্ষেপঃ
ইমাম শাফেয়ী রাঃ উসুলে ফিকহের বাব-ফসল অর্থাৎ বিভিন্ন মাসালা ও অধ্যায় একত্রিত করেন, তিনি কিতাবুল্লাহ, সুন্নাতে রাসুল নিয়ে আলোচনা করেন, এবং তিনি দেখান সেখান থেকে মাসালা উদ্ঘাটন করার পথ-পদ্ধতি, কুরান-হাদিসের পরস্পর সম্পর্ক। কুরান-হাদিসের শাব্দিক অর্থ অর্থাৎ আম-খাস, মুশতারাক-মুজমাল-মুফাসসাল, নিয়ে আলোচনা করেন, ইজমা, ইজমার হাকিকত, কিয়াস, ইস্তিহসান নিয়ে তিনি এমনভাবে আলোচনা করেন যেভাবে তার পুর্বে আর কাউকে আলোচনা করতে দেখা যায়নি। এইভাবে বলা যায় যে, ইমাম শাফেয়ী রাঃ উসুলে ফিকহের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিশদ আলোচনা করেন। এই ক্ষেত্রে ইমাম শাফেয়ী ছিলেন প্রথম পথিক, কিংবা এতটুকু বলা যায় যে, তিনি এই পথের প্রথম পথিক না হলে অন্য কারো রচনা আমাদের হাতে এসে পৌছেনি। এর অর্থ এই না যে, ইমাম মালিকের “মুয়াত্তা” ইমাম আবু হানিফার চেয়ে ইমাম শাফেয়ী এগিয়ে গেছেন, অন্যান্য ইমামদের মৌলিক অবদান থাকা স্বত্বেও ইমাম শাফেয়ীকে এই ক্ষেতে অগ্রগণ্য ধরা হয় কারন তার পুর্ব্বর্তীদের সময়ে তাদভীন বা রচনার সুগোগ তখনও সৃষ্টি হয়নি। আবার ইমাম শাফেয়ীর ব্যাপারে এই বলা যায় না যে, তিনি এই বিষয়ে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিয়েছেন বা সর্ব দিকে নিয়ে আলোচনা করেছেন, এমন না বরং ইমাম শাফেয়ির পরেও এমন অনেক আলেম এসেছেন যারা উসুলে ফিকাহতে অনেক নতুন বিষয়ের সংযুক্তি করেছেন।
 
উসুলে ফিকাহের গবেষণা-রচনা পদ্ধতিঃ
ইলমে উসুলে ফিকহের গবেষণা ও রচনাতে ভিন্ন ভিন্ন কয়েকটি ধারা-পদ্ধতি লক্ষ্য করা যায়। ইমাম শাফী রাঃ তার রিসালতে যে সকল ধারণা পেশ করেছেন তার সাথে অধিকাংশ মুজতাহিদ ফকিহ একমত হলেও বেশ কিছু ক্ষেত্রে তারা তার সাথে মতবিরোধ করেছেন, উদাহরন হিসাবে বলা যায় যে, ইসতিহসানের ক্ষেত্রে হানাফি মাজহাবের মতবিরোধ রয়েছে, আবার মদিনাবাসীদের আমল, যারায়ি, মাসলাহা মুরসালার ক্ষেত্রে মালিকি মাজহাবের মতবিরোধ রয়েছে। এই হিসাবে উসুলে ফিকহের গবেষনাতে একধিক পদ্ধতি দেখা যায়। এই সকল পদ্ধতির মধ্য থেকে উল্লেখযোগ্য পদ্ধতি হচ্ছে দুইটি পদ্ধতিঃ
একঃ ইমাম শাফেয়ী বা মুতাকাল্লিমিনদের পদ্ধতি
দুইঃ হানাফি পদ্ধতি
প্রথম পদ্ধতিঃ শাফেয়ী পদ্ধতিঃ
শাফী, মালিকি ও হামবালী মাজহাবের অধিকাংশ আলেম এই পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন, তাই এই পদ্ধতিকে “জুমহুর” আলেমের পদ্ধতিও বলা হয়ে থাকে। এই পদ্ধতির প্রধান বৈশিষ্ট এই যে এখানে উসুলকে ফিকাহ থেকে আলাদা করে গবেষণা করা হয়েছে। এই পদ্ধতিতে উসুলকে ফুরুর সাথে সম্পৃক্ত না রেখে তাত্বিক ভাবে শুধুমাত্র মুলনীতি (উসুল) নিয়েই আলোচনা হয়েছে। উসুলকে সাব্যস্ত করা হয়েছে এতে ফুরুর সাথে উসুলের মিল থাকুক বা না থাকুক সেই দিকে মনোযোগ প্রদান করা হয়নি। এই পদ্ধতিকে “মুতাকাল্লিমিনদের” পদ্ধতি আখ্যা দেওয়া হয়েছে কারন এই পদ্ধতিতে যারা গবেষণা করেছেন তাদের বেশির ভাগই ছিলেন ইলমে কালামে পারদর্শি বা বিশেষজ্ঞ আলেম। তাই উসুলের আলোচনাতে তারা কালামের আলোচনার ধারায় আলাচনা করেছেন বলে স্পষ্ট লক্ষ্য করা যায়, যেমন তাদের আলোচনাতে “আকলি-তাহসিন”, “আকলি-তাকবিহ”, ইবাদাত ছাড়া অন্যান্য আহকাম মুয়াল্লাল বা উদ্দেশ্যের সাথে এসেছে বা তার কারন আমাদের বোধগম্য ইত্যাদি বিষয় উসুলে সন্নিবেশিত হয়েছে। এভাবে ইলমে-কালামের প্রভাবে উসুলে ফিকহের মধ্যে এমন অনেক বিষয় এসে পরেছে যার সম্পর্ক মোটেও উসুলের সাথে থাকার কথা ছিল না। উদাহরন হিসাবে “আল-মুসতাসফা” কিতাবের কথা উল্লেখ করা যায়। ইমাম গাজালী রাঃ তার এই কিতাবে কিতাবুল্লাহর ভুমিকাতে মানতিক, বুরহান নিয়ে প্রায় ৫০ পৃষ্ঠা আলোচনা করেছেন, এরপর কিতাবের বিভিন্ন স্থানে এমন অনেক আলোচনা করেছেন যার শুরুতে তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন যে এই আলোচনা উসুলে ফিকহের সাথে সম্পর্ক রাখে না তবে তিনি প্রয়োজনের খাতিরে আলোচনার অবতারনা করেছেন। এই পদ্ধতির একটি বড় বৈশিষ্ট এই যে, এখানে উসুলকে কখনো ফুরুর অনুগত করার চেষ্ঠা করা হয়নি, বরং উসুলের আলোচনাতে মাজহাবের মাসালা বা ফতওয়ার দিকে কোন খেয়াল না করে শুধুমাত্র উসুলের দিকেই খেয়াল রাখা হয়েছে।
 
এই পদ্ধতির কিছু উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট হচ্ছেঃ
- মাজহাবের ফুরুর সাথে উসুলের মিল থাকা বা মিল না থাকার দিকে এখানে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি, এখানে প্রধান ও একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল আকলী-নাকলী দলিল-প্রমানের ভিত্তিতে উসুল সাবেত করা
- কায়েদা বা মুলনীত নির্নয়ে মাজহাবের সাথে সীমাবদ্ধ থাকা হয়নি
- উসুল বর্ননা করার ক্ষেত্রে শুধুমাত্র উদাহরন বা স্পষ্ট করার উদ্দেশ্যেই ফুরু উল্লেখ করা হয়েছে, এবং এখানে উসুলের মাধ্যমে ফুরুর শুদ্বতা-অশুদ্বতার প্রমান পেশ করা হয়েছে, ফুরুর মাধ্যমে উসুলের শুদ্ধতার প্রমান পেশ করা হয়নি
- উসুলের আলোচনাতে ইলমে –কালামের বিভিন্ন মাসয়ালা উত্থাপন করা হয়েছে
ডাঃ যুহাইলীর মতে “এই পদ্ধতির বৈশিষ্ট তিনটিঃ
- শুধুমাত্র বুদ্ধি-বৃত্তিক (আকলী) প্রামানিকতা পেশ করা হয়েছে
- ফিকহী মাজহাবের কারনে এদের উসুল কোনরুপ প্রভাবিত হয়নি
- ফুরুর আলোচনা শুধুমাত্র উসুলের উদাহরন হিসাবে বা বিশদ ব্যাখ্যার কারনে এসেছে”
দ্বিতীয় পদ্ধতিঃ হানাফী পদ্ধতিঃ
এই পদ্ধতিতে উসুলের আলোচনা করা হয়েছে মুলত ফুরুর ভিত্তিতে, অর্থাৎ পুর্ব্ববর্তী মুজতাহিদের ফাতওয়া-মাসায়িল সামনে রেখে সেখান থেকে তাদের ইসতিমবাতের কায়েদা বা মুলনীতি উদ্ঘাটন করার চেষ্ঠা করা হয়েছে। কারন হানাফী মাজহাবের মুজতাহিদ আলেমগন ইসতিমবাতের বিশেষ কোন পথ-পদ্ধতি লিপিবদ্ধ করে যাননি, তাই তাদের পরবর্তী আলেমগন তাদের ইজতিহাদ করা মাসায়িল থেকে, কিসের ভিত্তিতে তারা (পুর্ব্বর্তীগন) এই ফতওয়া দিয়েছিলেন তার ভিত্তি পেশ করতে চেয়েছেন এবং এর মাধ্যমে তাদের মুলনীতি উল্লেখ করতে চেয়েছে।
এই পদ্ধতির বিশেষ বৈশিষ্ট নিম্মরুপঃ
- এখানে প্রয়োগিক ইজতিহাদের মুলনীতি উল্লেখ করা হয়েছে
- এই পদ্ধতি মুলত প্রায়োগিক ফুরুর পদ্ধতি, এটা তাত্বিক কোন আলোচনা নয়
- ফুরু থেকে এখানে উসুল উদ্ঘাটন করা হয়েছে, তাই এখানে মাজহাবের মাসায়িলের মাঝে সীমিত থাকার প্রবনতা লক্ষ্য করা যায়
- অতিতিক্ত ফুরু, উদাহরন ও শাহেদ উল্লেখ করা হয়েছ
- কায়েদার উপর ভিত্তি করে, এই পদ্ধতিতে একাধিক “তাখরিজ”-“তাফরি” বের হয়েছ।
 
উভয় পদ্ধতির একটি মুলনীতির উদাহরনঃ
মুতাকাল্লীম ও হানাফী পদ্ধতির পার্থক্য উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের মাঝে বিদ্যমান পার্থক্য নিম্মের উদাহরনের মাধ্যমে স্পষ্ট করার চেষ্টা করা হলঃ
প্রত্যেক নামাজের জন্যে শারিয়াতে একটি দীর্ঘ সময় নির্ধারন করা হয়েছে, এবং নামাজ ওয়াজিব হওয়ার সাবাব বা কারন এই ওয়াক্ত। যেমন উদাহরন স্বরুপ যুহরের নামাজের সময় বেলা ১২ টা থেকে শুরু হয়ে বিকাল ৩টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। তবে এখন প্রশ্ন হল ওয়াক্তের কোন অংশ নামাজ ওয়াজিব হওয়ার সাবাব বা কারন। মুতাকাল্লীমদের মতে নামাজ ওয়াজিব হওয়ার সাবাব ওয়াক্তের প্রথম অংশ, এর প্রমান হিসাবে তারা কুরানের আয়াত পেশ করে থাকেনঃ
{أقم الصلاة لدلوك الشمس}[21]
অর্থঃ “নামাজ কায়েম কর সুর্য হেলে পরার সময়”।
“দুলুক” শব্দ দ্বারা মধ্য আকাশ থেকে সুর্যের ঢলে পরা বুঝানো হয়, এবং এর মাধ্যমে যুহরের নামাজ ওয়াজিব হওয়া বুঝানো হয়েছে। যেহেতু এখানে যুহরের ওয়াক্তের প্রথম অংশ উল্লেখ করার মাধ্যমে নামাজের ওয়াজিব হওয়ার দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে তার তাদের সিদ্ধান্ত হয়েছে যে ওয়াক্তের প্রথম অংশই নামাজ ওয়াজিব হওয়ার সাবাব। মুতাকাল্লীমদের এই সিদ্ধান্ত দ্বারা বুঝা যায় যে, মুলনীতি গৃহিত হবে শারিয়াতের ভাষ্য থেকে, মাজহাবের কোন ফুরুর দিকে খেয়াল করে মুলনীতি নির্ধারিত হবে না।
একই বিষয়ে হানাফী আলেমদের বক্তব্য হচ্ছে যে, নামাজ ওয়াজিব হওয়ার সাবাব ওয়াক্তের সেই অংশ যা নামাজ আদায় করার সাথে লাগানো, ওয়াক্ত যখন তার সর্বশেষ অংশে এসে যাবে তখন ওয়াক্তের সেই অংশ নামাজ ওয়াজিব হওয়ার সাবাব হবে। আর যদি নামাজের পুরা সময় অতিবাহিত হয়ে যায়, নামাজ আদায় না হয়, তাহলে নামাজের পরিপুর্ন ওয়াক্ত নামাজ ওয়াজির হওয়ার সাবাব হিসাবে সাব্যস্ত হবে। হানাফী মাজহাবের আসরের নামাজের ফতোয়ার দিকে খেয়াল করে পরবর্তি আলেমগন এই মুলনীতি উল্লেখ করেছেন। তাদের এই মুলনীতি থেকে ফুরুর প্রভাব বুঝা যায়।
এই দুই পদ্ধতিকে সামনে রেখে গবেষক আলেমগন মন্তব্য করেন যে, শাফেয়ী পদ্ধতিতে ইসতিমবাতের মানহাজ-মুলনীতি পাওয়া যায়, তাদের উসুল ছিল ফুরুর নিয়ন্ত্রন কারী, পক্ষান্তরে হানাফী পদ্ধতি ছিল মাসায়িল থেকে আহরিত পদ্ধতি, তাই অনেক ক্ষেত্রে মাসায়িলের তারতম্যের কারনে মুলনীতি এক রকম থাকে নি, তাতে পরিবর্তন ঘটেছে। তবে তাদের উভয়ের উদ্দেশ্য ছিল অভিন্ন, আর তা হচ্ছে কুরান-হাদিস থেকে ইসলামী বিধান উদ্ঘাটন করা।
তিনঃ মুতায়াখখিরদের পদ্ধতিঃ
হিজরী সপ্তম শতাব্দীর দিকে এই দুই পদ্ধতির সম্বনয়ে আরেক নতুন পদ্ধতির প্রচলন শুরু হয়, উভয় পদ্ধতিকে সামনে রেখে এই পদ্ধতিতে তাত্বিক আলোচনার মাধ্যমে এখানে কায়েদা-মুলনীতি নির্নয় করা হয়েছে, আবার ফুরুর মাধ্যমে সেই কায়েদার প্রমান পেশ করা হয়েছে।
এই পদ্ধতির প্রধান বৈশিষ্ট হচ্ছে নিম্নরুপঃ
- এখানে আকলী-নাকলী উভয় প্রকার দলিলের সম্বনয় করা হয়েছে, আবার উসুল নির্নয়ের সময় উসুল-ফুরুকে সামনে রাখা হয়েছে
- এখান দুই দিকে খেয়াল রাখা হয়েছে, ফুরু উল্লেখ করার মাধ্যমে ফিকহের উপকার করা হয়েছ আবার উসুলের আলোচনার মাধ্যমে উসুলে ফিকহের উপকার করা হয়েছে
- মুতাকাল্লিম-হানাফী উভয়ের পদ্ধতিতে রচিত ও আলোচিত সব বিষয় তাদের আলোচনাতে স্থান পেয়েছে
- এই পদ্ধতিতে বিশাদ-বিস্তারিত আলোচনা সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে
চারঃ নতুন পদ্ধতিঃ
উল্লেখিত তিন পদ্ধতির বাইরেও আরেক দল আলেম অন্য পদ্ধতিতে উসুলে ফিকহ নিয়ে গবেষণা-রচনা করেছেন, এই পদ্ধতির ভিত্তি ছিল শরীয়াতের “মাকাসিদ-মাসালিহ”। অর্থাৎ শরীয়াত যে উদ্দেশ্য বা ফায়েদা বাস্তবায়ন করার জন্যে আমাদের কাছে এসেছে সেই উদ্দেশ্যগুলো সামনে রেখে এখানে গবেষনা করা হয়েছে। ইতিপুর্বে উসুলের আলোচনাতে শরীয়াতে মাকাসিদ স্থান পায়নি। ইমাম আবু ইসহাক আশ-শাতিবী (মৃঃ ৭৮০ হিঃ) রাঃ এর মাধ্যমে এই বিষয়ের সুত্রপাত ঘটে। তার রচিত “আল-মুওফাকাত” গ্রন্থটি এই ক্ষেত্রে এক মৌলিক গ্রন্থ।
উসুলে ফিকাহের মৌলিক গ্রন্থাবলীঃ
আমরা ইতিপুর্বে উল্লেখ করেছি যে, উসুলে ফিকহের গবেষনা-রচনাতে একাদিক পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে, সেই হিসাবে উসুলে ফিকহের মৌলিক গ্রন্থাবলীতেও একাধিক শৈলী পাওয়া যায়। সামনে আমরা সকল পদ্ধতির কয়েকটি মৌলিক গ্রন্থের নাম উল্লেখ করবোঃ
একঃ শাফেয়ী পদ্ধতিতে রচিত গ্রন্থাবলীঃ
1- "العهد"؛ للقاضي عبدالجبار المعتزلي، المتوفى (415هـ)
2- "المعتمد"؛ لأبي الحسين البصري المعتزلي، المتوفى (463هـ)
3- "البرهان"؛ لأبي المعالي الجويني الشافعي، المتوفى (478هـ)
4- "المستصفى"؛ لأبي حامد الغزالي الشافعي، المتوفى (505هـ)
5- "المحصول"؛ لفخر الدين الرازي الشافعي، المتوفى (606هـ)
6- "الإحكام"؛ لسيف الدين الآمدي الشافعي، المتوفى (631هـ)
7- "منهاج الوصول"؛ للبيضاوي، المتوفى ( 685 هـ)
8- "التنقيحات"؛ للقرافي المالكي، المتوفى (684هـ)
9- "منتهى السول"؛ لابن الحاجب المالكي، المتوفى (646هـ)
দুইঃ হানাফী পদ্ধতিতে রচিত গ্রন্থাবলীঃ
1- "أصول الكرخي": أبي الحسين بن عبيدالله، المتوفى (340هـ)
2- "أصول الجصاص": أبي بكر أحمد بن علي، المتوفى (378هـ)
3- "تقويم الأدلة"؛ لأبي زيد الدبوسي، المتوفى (340هـ)
4- "تمهيد الفصول"؛ للسَّرَخْسِي محمد بن أحمد، المتوفى ( 428هـ)
5- "الأصول"؛ لعلي بن أحمد البزدوي، المتوفى (482هـ)
6- "كشف الأسرار"؛ لعبدالعزيز البخاري، المتوفى (730هـ)
7- "تخريج الفروع على الأصول"؛ للزنجاني، المتوفى (656هـ)
8- "التمهيد"؛ لجمال الدين الإسْنَوي الشافعي، المتوفى (772هـ)
9- "تنقيح الفصول"؛ للقرافي المالكي، المتوفى (684)
10- "القواعد"؛ لأبي الحسن الحنبلي، المتوفى (830هـ)
পরর্বতীদের পদ্ধতিতে রচিত গ্রন্থাবলীঃ
1- "بديع النظام"؛ لمظفر الدين الساعاتي، المتوفى (694هـ)
2- "جمع الجوامع"؛ للسبكي الشافعي، المتوفى (771هـ)
3- "تنقيح الأصول"؛ لصدر الشريعة الحنفي، المتوفى (654هـ)
4- "التحرير"؛ للكمال بن الهمام الحنفي، المتوفى (861هـ)
5- "مسلم الثبوت"؛ لمحب الدين عبدالشكور، المتوفى (1119هـ)
6- "إرشاد الفحول"؛ للشوكاني، المتوفى (1250هـ)
মাকাসিদে শারিয়াত নিয়ে রচিত গ্রন্থাবলীঃ
1- "الموافقات في أصول الشريعة"؛ للشاطبي المالكي، المتوفى (790هـ)
2- "الأشباه والنظائر"؛ لتاج الدين السبكي، المتوفى (772هـ)
3- "قواعد الأحكام"؛ لعز الدين بن عبدالسلام، المتوفى (660هـ)
4- "القواعد الفقهية"؛ لابن رجب الحنبلي، المتوفى (795هـ)
5- "منثور القواعد"؛ لبدر الدين الزركشي، المتوفى (794هـ)
6- "الأشباه والنظائر"؛ لجلال الدين السيوطي، المتوفى (911هـ)
7- "الفروق"؛ لشهاب الدين القَرافي المالكي، المتوفى (684)
আধুনিক গ্রন্থাবলীঃ
তাকলীদ ও অন্ধ-অনুকরনের যুগের পরে আবার ইসলামী ফিকাহতে প্রানের সঞ্চার শুরু হয়েছে, তাই দেখা যায় আবার নতুন করে উসুলে ফিকাহ নিয়ে উলামায়ে কিরাম গবেষণা শুরু করেছেন এবং তাদের এই গবেষনার ফল হিসাবে বেশ কিছু উপকারী গ্রন্থ উম্মতের সামনে এসেছে, নিচে আমরা তার কয়েকটির নাম উল্লেখ করছিঃ
1- "أصول الفقه"؛ للشيخ محمد الخضري، المتوفى (1345هـ)
2- "علم أصول الفقه"؛ للشيخ عبدالوهاب خلاف، المتوفى (1955م)
3- "أصول الفقه"؛ للأستاذ الشيخ محمد أبي زهرة، المتوفى (1974م)-->
 
==তথ্যসূত্র==