উইকিপিডিয়া: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

[অপরীক্ষিত সংশোধন][অপরীক্ষিত সংশোধন]
বিষয়বস্তু বিয়োগ হয়েছে বিষয়বস্তু যোগ হয়েছে
Afifur rahaman (আলোচনা | অবদান)
সম্পাদনা সারাংশ নেই
Mahir256 (আলোচনা | অবদান)
Afifur rahaman (আলাপ)-এর সম্পাদিত 2950803 নম্বর সংশোধনটি বাতিল করা হয়েছে
ট্যাগ: পূর্বাবস্থায় ফেরত
১ নং লাইন:
{{about|ইন্টারনেট বিশ্বকোষ}}
= '''সাইমুম সিরিজ''' =
 
=== অপারেশন তেলআবিব-১ ===
 
= ১ =
ডাইরীর সাদা বুক। খস্ খস্ শব্দ তুলে এগিয়ে চলেছে একটি কলমঃ
 
‘… সিং কিয়াং-এর ধুসর মরুভূমি। দূরে উত্তর দিগন্তের তিয়েনশান পর্বতমালা কালো রেখার মত দাঁড়িয়ে আছে। অর্থহীনভাবে শুধু চেয়ে থাকি চারিদিকে। কোন কাজ নেই। জীবনের গতি যেন আমাদের স্তব্ধ হয়ে গেছে। আজ ক’দিন হল যুগ-যুগান্তরের ভিটে মাটি ছেড়ে আমরা ৫ হাজার মুসলমান আশ্রয় নিয়েছি আমাদের জাতীয় ভাইদের কাছে এ সুদূর মরুদ্যানে। অত্যাচারীর চকচকে রক্ত পিপাসু বেয়নেট আর রাইফেলের গলিত সীসা ছিনিয়ে নিয়েছে আমাদের বহু ভাই বহু বোনকে। চোখে আর কারো পানি নেই। শুকিয়ে গেছে অশ্রুর ধারা।
 
মরু-ঘেরা এ দূর্গম মরুদ্যানে এসে আমাদের যারা একটুখানি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল, ভুল ভেঙ্গে গেল তাদের অচিরেই। একদিন সকালে উঠে শুনলাম এদেশের সে ফেরাউন বাহিনীও এগিয়ে আসছে এদিকে। আব্ব চিৎকার করে বললেন, ‘আমরা বাঘের মুখ থেকে খসে কশাই এর হাতে পড়েছি। আমাদের মাতৃভূমি তুর্কিস্তানের একখন্ড ভূমিতেও আজ আমাদেরকে দাঁড়িয়ে থাকতে দিবে না শয়তানরা। বুঝলাম আব্বার সহ্য নিঃশেষ হতে চলেছে।
 
আব্বার আয়োজন শুরু হ’ল যাত্রার। নারী আর শিশুদের চোখের পানিতে ভারি হয়ে উঠল মরুভূমির শুষ্ক বাতাস। এবার শুধু আমরাই নই, মরুদ্যান ও আশে পাশের আরো ৪৫ হাজার মুসলিম নর নারীর উদ্বাস্তু মিছিল এসে শামিল হল আমাদের সাথে।
 
আমার চার বছরের ভাই ইউসুফ এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আমরা আবার কোথায় যাব ভাইজান! বাড়ী গেলে সেই মানুষরা যে আবার মারবে আমাদের? আমি অভয় দিয়ে বললাম, ‘না ভাই আমরা বাড়ী যাচ্ছি না।’
 
কিন্তু কোথায় যাচ্ছি বলতে পারলাম না। কোথায় যাব আমরা? তাজিকিস্তান কিংবা উজবেকিস্তান। সেতো আর এক সিংকিয়াং। অবশেষে সবাই বুক ভরা আশা নিয়ে তাকালো দক্ষিণের দিকে। উচ্চারিত হলো ভারতের নাম-মুহাম্মদ বিন কাসিমের এ ভারত, মাহমুদ, বাবর, ঈসা খাঁ, টিপু, তিতুমীরের এ ভারত।
 
মরুভূমির সাদা বালুর উপর দিয়ে এগিয়ে চলল ছিন্নমূল মানুষের আদিগন্ত মিছিল। পিছনে পড়ে রইল সহস্র শতাব্দির স্মৃতি বিজড়িত মাতৃভূমি সিংকিয়াং। কেন এমন হ’ল? কি করেছি আমরা? শুধু তো স্বাধীনভাবে বাঁচতে চেয়েছি। মানুষের এ চাওয়া তো চিরন্তন। মুসলমান হওয়ার অপরাধে কি এ অধিকার আমাদের থাকবে না?
 
কয়েক সপ্তাহ কেটে গেল। ধীরে ধীরে তিব্বতের দিকে এগিয়ে চলেছি আমরা। হঠাৎ একদিন কয়েকটি সামরিক বিমান খুব নীচু দিয়ে আমাদের মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল গোটা কাফেলায়। তাহলে কি ওরা এখনো পিছু ছাড়েনি আমাদের?
 
মরুভূমির নিঝুম-নিস্তব্ধ রাত। বাতাসের একটানা শোঁ শোঁ নিঃশ্বাস নিস্তব্ধতার মাঝে তরঙ্গ তুলছে শুধু। উপরে লক্ষ কোটি তারার মেলা। কাফেলার পরিশ্রান্ত পথিকরা কেউ জেগে নেই বোধ হয়। হঠাৎ উত্তর দিগন্ত থেকে ভেসে এল কয়েকটি জেট ইঞ্জিনের ভয়ঙ্কর শব্দ। তারপর বুম! বুম! বুম……
 
চিৎকার ছুটোছুটি আর্তনাদে গভীর রাত্রির নিশুতি প্রহর ভেঙ্গে পড়ল টুকরো টুকরো হয়ে। ঘুম ভেঙে গেল আমার। বিছানায় উঠে বসেছি। বোবা হয়ে গেছি যেন। আব্বার চিৎকার ছুটে বাইরে বেরিয়ে গেলাম। নিজের চোখকে বিশ্বাস হয় না আমার। কি বিভৎস সে দৃশ্য! আব্বার তাবু জ্বলছে। টলতে টলতে আব্বা ইউসুফকে টেনে নিয়ে আসছেন। ইউসুফের কোমর থেকে পিছন দিকটা নেই, কয়লার মত হয়ে গেছে ওর শরীর। একটি অষ্ফুট চিৎকারই শুধু আমার মুখ থেকে বেরুল …।
 
যখন জ্ঞান ফিরল, বেলা হয়ে গেছে তখন অনেক। আব্বার দিকে চোখ পড়তেই দেখলাম অত্যন্ত ক্ষীণ কণ্ঠে তিনি আমায় ডাকছেন। আমি কাছে যেতেই তিনি বললেন ‘মুসা, কাফেলা নিয়ে যত সত্ত্বর পার এখান থেকে সামনে এগিয়ে যাও। মনে …..?
 
আমি বাধা দিয়ে বললাম, এ সব কি বলছেন আব্বা? আপনি ভাল হয়ে যাবেন। আব্বা ম্লান হাসলেন। বললেন, তাঁর ডাক এলে কেউ সে ডাকে সাড়া না দিয়ে কি পারে মুসা?
 
একটু থেমে তিনি বললেন, মুসা, ইউসুফ নাই; দুঃখ করো না। পৃথিবীর সমস্ত নিপীড়িত শিশুর মাঝে তোমার ইউসুফকে খুঁজে পাবে। তোমার মা, বাবা নেই বলে কখনো ভেবনা, পৃথিবীর নির্যাতিত মানষের মধ্যে তোমার মা-বাবাকে খুঁজে পেতে চেষ্টা করো।’ অত্যন্ত ক্ষীণ হয়ে পড়ল আব্বার কণ্ঠ। আব্বার মুখ থেকে অষ্ফুটে তাঁর কথা বেরিয়ে এল, মনে রেখ মুসা; শুধু সিংকিয়াং এর মুসলমানদের একার এ দূর্দশা নয়, পৃথিবীর কোটি কোটি তোমার ভাই-বোন এমনিভাবেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। আরও মনে রেখ, তোমার এ মজলুম মুসলিম ভাই বোনদের অশ্রু মোছানোর দায়িত্ব, তাদের অবস্থার পারিবর্তন আনার দায়িত্ব তোমাদের মত তরুণদের। তোমরা স্রষ্টার নির্দেশগুলোর আর তোমাদের গৌরবময় ইতিহাসকে সর্বদা সামনে রেখো। খালেদ, তারিক, মুসা, মুহাম্মদ বিন কাসিমের তলোয়ার যেদিন তোমরা আবার হাতে তুলে নিতে পারবে, দেখবে সেদিন আল্লাহর সাহায্য কত দ্রুত নেমে আসে তোমাদের উপর।
 
আব্বা তাঁর নিঃসাড় দুর্বল হাত দিয়ে আমার অশ্রু মোছানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে বললেন, মুসা, অশ্রু তো মুসলমানদের জন্য নয়। তোমরা সেই জাতি যারা হাত কেটে গেলে পা দিয়ে পতাকা ধরে রাখে। পা কেটে গেলে দাঁত দিয়ে পতাকা ধরে রাখে। আমি অশ্রু মুছে বললাম, আব্বা আমি আর কাঁদব না। দোয়া করুন – ঘরের কোণে বসে কাপুরুষের মত যেন না মরি।
 
চারিদিকে চেয়ে দেখলাম, গতকাল যারা দুনিয়ার আলো বাতাসে বিচরণ করেছে, তাদেরই হাজার হাজার বিকৃত লাশে মরুভুমির বুক কালো হয়ে উঠেছে। শত শত পোড়া তাঁবুর খন্ড খন্ড অংশ ছিটিয়ে, ছড়িয়ে পড়ে আছে। শত শত এতিম শিশুর সব হারানোর কান্না চারিদিকে মাতম তুলেছে। আবার যখন আব্বার দিকে চাইলাম, চোখ দু’টি তাঁর বুজে গেছে। চোখ দু‘টি আর কোনদিন চাইবে না পৃথিবীর দিকে। একটি অবরুদ্ধ উচ্ছ্বাস যেন ভেঙ্গে চুরমার করে দিতে চাইল আমার সমগ্র হৃদয়কে। চারিদিক থেকে অন্ধকার এসে সংকীর্ণ করে দিতে চাইল আমার পৃথিবীকে। দাঁতে দাঁত চেপে শক্ত হতে চেষ্টা করলাম আমি।
 
কাঁধের উপর একটি কোমল স্পর্শে চমকে উঠলাম। ফিরে দেখলাম ‘ফারজানা’। শুভ্র গন্ড দু‘টি চোখের পানিতে ভেসে যাচ্ছে তার। অশ্রু-ধোয়া কালো চোখ দু’টিতে কি নিঃসীম মায়া। এমন নিবিড়ভাবে ফারজানাকে কোনদিন আমি দেখিনি। ফারজানা সিংকিয়াং এর প্রধান বিচারপতি আমির হাসানের কন্যা।
 
আমি বললাম, ফারজানা কোন দুঃসংবাদ নেই তো? সে বলল, আমরা ভাল আছি। আব্বা আপানাকে আমাদের তাঁবুতে ডেকেছেন।
 
মরু সূর্য তখন আগুন বৃষ্টি করছে। আমি জানতাম, ফারজানাদের ছোট্ট একটি তাঁবু। আমি বললাম, চারিদিকে চেয়ে দেখো ফারজানা, তাঁবুর ছায়া আমরা কতজনকে দিতে পারব। যা হোক এদিকের একটা ব্যবস্থা করা যাবেই। তুমি যাও ফারজানা। আমি চাচাজানের সাথে পরে দেখা করব।
 
আমরা আমাদের দশ হাজার ভাই বোনকে মরু বালুর অনন্ত শয্যায় ঘুমিয়ে রেখে এগিয়ে চললাম সামনে। একদিন গোধূলী মুহুর্তে আমরা পৌঁছুলাম তিব্বত সীমান্তে। দেখলাম তিব্বত সরকার সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে। জানলাম সিংকিয়াং এর মাটি যাদেরকে আশ্রয় দিতে পারেনি তিব্বতের মাটিতেও তাদের পা রাখবার কোন জায়গা নেই। ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত ছিন্নমূল বনি আদমের কোন আবেদন নিবেদন কোন কাজে এল না। আশা ভঙ্গের চরম হতাশায় মৃত্যুর স্তব্ধতা নেমে এল কাফেলা ঘিরে।
 
এবার কোথায় যাব আমরা? উত্তরে মৃত্যু হাতছানি দিয়ে ডাকছে, দক্ষিণে তিব্বত সীমান্তের দুর্ভেদ্য দেয়াল। আশার একটি ক্ষীণ আলোক বর্তিকা তখন জ্বলছে-কাশ্মীর হয়ে আফগানিস্তান। পথ অত্যন্ত দুর্গম। কিন্তু উপায় নেই তবু।
 
হিমালয়ের ১৮ হাজার ফিট উঁচু বরফ মোড়া মৃত্যু-শীতল পথ ধরে আফগানিস্তানের দিকে যাত্রা শুরু হল আমাদের। দিন, মাস গড়িয়ে চলল। পার্বত্য পথের কষ্টকর আরোহণ অবরোহণ নিঃশেষ করে দিল মানুষের প্রত্যয়ের শেষ সঞ্চয়টুকু। তার উপর দুঃসহ শীত। প্রতিদিনই শত শত পরিশ্রান্ত মানুষের উপর নেমে আসতে লাগলো মৃত্যুর হিমশীতল পরশ। দুর্বল বৃদ্ধ, কোমল দেহ নারী, অসহায় শিশুরাই প্রধান শিকারে পরিণত হল এর। সবার মত ফারজানার বৃদ্ধ পিতাকেও একদিন হিমালয়ের এক অজ্ঞাত গুহায় সমাহিত করে আমরা এগিয়ে চললাম সামনের দিকে। ফারজানার অবস্থাও হয়ে উঠেছে মর্মান্তিক। তার আব্বার মৃত্যুর পর সে পাষাণের মত মৌন হয়ে গেছে। বোবা দৃষ্টির শূন্য চাহনির মাঝে কোন ভাবান্তরই খুঁজে পাওয়া যায় না। ওর একটি হাত ধরে আমি পাশাপাশি চলছিলাম। কয়েকদিন পর হাত ধরে নিয়ে চলাও অসম্ভব হয়ে উঠতে লাগল। ভীষণ জ্বর উঠল ফারজানার। পা দু’টি আর উঠতে চায় না ওর।
 
সেদিন গভীর রাত। ঘুমিয়ে পড়েছে বোধ হয় সবাই। জ্বরের তীব্র ব্যাথায় ফারজানা কাতরাচ্ছে; একটু দূরে বসে অসহায়ভাবে সে দৃশ্য দেখছি আমি। হিমালয়ের নিঃসীম মৌনতার মাঝে ফারজানার অষ্ফুট কাতরানি তীব্র আর্ত বিলাপের মত আমরা সমগ্র হৃদয়কে ক্ষত বিক্ষত করে দিচ্ছে। আমি ধীরে ধীরে উঠে গিয়ে ওর মাথার পাশে বসলাম। ধীরে ধীরে হাত বুলালাম ওর আগুনের মত ললাটে। ওর দুর্বল দু’টি হাত উঠে এল। তুলে নিল আমার হাত ওর দু’হাতের মুঠোয়। তারপর হাত মুখে চেপে ধরে বাঁধ ভাঙা নিঃশব্দ কান্নায় ভেঙে পড়ল ফারজানা। আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললাম, কেঁদোনা ফারজানা, কষ্ট এতে আরও বাড়বে।
 
ফারজানা বলল, আমাকে ভুলাতে চেষ্টা করো না। আমি জানি, আমার সময় ঘনিয়ে এসেছে। তারপর একটু থেমে ধীরে ধীরে বলল, মুসা ভাই, সজ্ঞানে কখনও কোন পাপ করেছি বলে মনে পড়ে না। তুমি কি আমাকে আশ্বাস দিতে পার-অমর জীবনের সেই জগতে আবার আমি তোমাকে খুঁজে পাব। আব্বার কাছে বলেছিলাম, কাঁদব না। কিন্তু চোখের পাতা দু’টি সহসা ভারি হয়ে উঠল। আমি বললাম, একথা শুধু তিনিই জানেন ফারজানা। তবে বলতে পারি আমি- তিনি তাঁর বান্দার কোন একান্ত কামনাকেই অপূর্ণ রাখেন না।
 
ফরজানা যেন গভীর পরিতৃপ্তির সাথে চোখ বুজল। অষ্ফুটে তার মুখ থেকে বেরিয়ে এল, আল্লাহই তো আমাকে সবচেয়ে ভালো জানেন। চোখ দু’টি আর খুললো না ফারজানা। কোনদিনই তা আর খোলার নয়।
 
হিমালয়ের বুক চিরে দীর্ঘ পথ চলার পর আমরা যখন আফগান সীমান্তে পৌঁছলাম, ৫০ হাজার মানুষের মধ্যে আমরা তখন বেঁচেআছি মাত্র ৮৫০ জন……।
 
খস্ খস্ শব্দ বন্ধ হল।
 
হঠাৎ থেমে গেল কলমটি!
 
টেবিলের একপাশে রাখা একটি ক্ষুদ্র যন্ত্রে হঠাৎ লালবাতি জ্বলে উঠল। আর সেই সাথে অয়্যারলেস গ্রাহকযন্ত্র থেকে ‘ব্লিৎস ব্লিৎস’ শব্দ ভেসে এল। আহমদ মুসা লেখা থামিয়ে ডাইরীটা বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল। প্রায় সাড়ে ছ’ফুট লম্বা লোকটি। মধ্য এশিয়ার ঐতিহ্যবাহী তুর্কি স্বাস্থ্য দেহে। সকল প্রকারের কষ্ট এবং যে কোন প্রতিকূল অবস্থা মোকাবিলার যোগ্যতা দিয়ে যেন আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন একে। মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা। চোখ দু’টি উজ্জ্বল এবং দৃষ্টি অতি তীক্ষ্ণ। শান্ত দর্শন মুখাবয়বে অনমনীয় ব্যক্তিত্বের সুস্পষ্ট ছাপ। এ লোকটি বিশ্বের সবচেয়ে বেশী আলোচিত এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মাথা ব্যথা। সাইমুমের মধ্যমনি। মরক্কো থেকে ইন্দোনেশিয়া এবং উত্তর ককেশিয়া থেকে তানজানিয়া পর্যন্ত সুবিস্তৃত মুসলিম সমাজের প্রতিটি মজলুম মানুষ তার নাম গর্বের সাথে স্মরণ করে এবং স্বাধীন দেশ আর স্বাধীন জীবনের স্বপ্ন দেখে। আহমদ মুসা উঠে গিয়ে অয়্যারলেসের কাছে বসল। বলল, আহমদ মুসা স্পিকিং।
 
ওপার থেকে একটি কণ্ঠ ভেসে এল, ‘আমি ফারুক আমিন বলছি।’
 
-কি খবর বল।
 
-বাংলাদেশ সিক্রেট সার্ভিস একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আমাদের দিয়েছে। আমি এক্ষুণি আসতে চাই।
 
– এস। ৪০১১ অপারেশনের খবর?
 
– পনর মিনিট হল ফিরেছে। জেরুজালেমে ক্ষেপনাস্ত্র ঘাঁটি তৈরীর সাধ ওদের অনেক দিনের জন্য মিটে গেছে। মাউন্ট গুলিভিয়রের ক্ষেপণাস্ত্র বেদিটি ধূলা হয়ে গেছে প্রচন্ড ডিনামাইটের বিষ্ফোরণে। আর ইহুদী ক্ষেপণাস্ত্র বিশারদ মাইকেল শার্পের দেহটিও উড়ে গেছে তার সাথে।
 
মুহূর্তের জন্য আহমদ মুসার চোখ দু’টি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, বিজয়ী ভাইদের আমার সালাম দাও ফারুক। আর শোন-কোন প্রকার আত্মতৃপ্তির অবকাশ আমাদের নেই। লক্ষ্য আমাদের বহুদূর পথ অত্যন্ত দূর্গম। এ পর্যন্ত যা আমরা করেছি তার চেয়ে ভবিষ্যতে যা আমাদের করতে হবে তা হাজারো গুণ বেশী। আচ্ছা , তুমি এস।
 
এবার অয়্যারলেসটির কাঁটা ঘুরিয়ে আর একটি চ্যানেল তৈরী করল। নতুন ঠিকানায় কয়েকবার যোগাযোগ করতে চেষ্টা করল। সফল হলো না। উঠে দাঁড়ালো আহমদ মুসা। ভ্রুদু’টি তার কুঞ্চিত হয়ে উঠল। টেলিফোনটি তুলে নিয়ে একটি পরিচিত নাম্বারে ডায়াল করে বলল, শফিক তুমি একটু উপরে এস।
 
আহমদ মুসা খস্ খস্ করে একটি কাগজে লিখলঃ
 
‘‘হাসান তারিকের অয়্যারলেস অস্বাভাবিকভাবে নীরব।
 
সে কোথায় খোঁজ নাও। এখন নয়, আগামিকাল ভোর পাঁচটায় আমাকে হেডকোয়ার্টারে পাবে।’’
 
একটু পরেই নীল বাতি জ্বলে উঠল ঘরে। পর্দা ঠেলে প্রবেশ করল শফিক। সামনের চেয়ারটায় বসতে ইংগিত করল আহমদ মুসা। তারপর চিঠিটি ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, পররাষ্ট্র দফতরের ঠিক বিপরীতে রাস্তার উত্তর পার্শ্বে ৩২২ নং বাড়ী। বাড়ীটিতে ঢুকে সোজা তিন তলায় উঠে যাবে। তাঁর এ চিঠি। সাবধানে যেয়ো।
 
= ২ =
আম্মানের অভিজাত এলাকার একটি দ্বিতল বাড়ী। চারপাশে কোন বাড়ী নেই। আট ফুট উঁচু দেয়ালে ঘেরা বাড়ীটি। বাড়ীর বাইরের সব আলো নিভানো হলেও রাস্তার সরকারী আলোতে বাড়ীর উত্তর দিকের সম্মুখ ভাগটা উজ্জ্বল। রূপালী রং করা লোহার গেটে আলো পড়ে চিক চিক করছে।
 
আহমদ মুসার চিঠি নিয়ে গেট দিয়ে ধীর পদে বেরিয়ে এল শফিক। গাড়ী ষ্টার্ট নিতেই শফিক চকিতে একবার পিছনে ফিরে দেখল, কালো রংএর একটি ল্যান্ড রোভার পাশের অন্ধাকারের বুক থেকে বেরিয়ে এল তাদের পিছনে। সন্দেহ সম্পর্কে নিশ্চত হবার জন্য শফিক ড্রাইভারকে ফুলস্পীডে গাড়ী ছাড়তে বলল, ড্রাইভার আপত্তি জানিয়ে বলল, এ আঁকা বাঁকা রাস্তায় এর চেয়ে বেশী স্পীড দেওয়া সহজ নয় সাহেব।
 
শফিক ড্রাইভারের চোখের সামনে সাংকেতিক চিহ্ন তুলে ধরে বলল, এর প্রয়োজন আছে ড্রাইভার। ড্রাইভার সাইমুমের সাংকেতিক চিহ্ন দেখে মাথা ঝাঁকিয়ে একটি সশ্রদ্ধ সালাম জানিয়ে বলল, এ গাড়ীকে এবং আমাকে এখন থেকে নিজের মনে করুন জনাব।’
 
শফিক রিয়ারভিউয়ে চোখ রেখে বলল, তোমার মত কি এমনি করে সবাই ভাবে ড্রাইভার?
 
-সবাই আরও সুন্দর করে ভাবে। আমার মত হতভাগ্য আর কেউ নেই। একমাত্র পেট পূজা ছাড়া জাতির এই সংকট মুহূর্তে আমার দ্বারা কিছুই হল না।
 
শফিক ড্রাইভারের পিঠে একটি হাত রেখে বলল, কে বলল কিছু করছ না ভাই? তোমাদের সমর্থন আর ভালোবাসাই তো আমাদের শক্তি ও প্রেরণা যোগাচ্ছে।
 
শফিক রিয়ারভিউ থেকে চোখ সরিয়ে বলল, পিছনের গাড়ীটি আমাদের অনুসরণ করছে ড্রাইভার।
 
ড্রাইভার একবার চিন্তিত মুখে ‘রিয়ারভিউ’ এর দিতে তাকিয়ে বলল, শহরের প্রতিটি গলি কুজো পথ আমার নখদপর্ণে, যদি বলেন তো ৫ মিনিটে ওদের এড়িয়ে বেরিয়ে যাব, আমরা।
 
– না তা হয় না ড্রাইভার। শত্রুকে পিঠ দেখানো আমাদের ঐতিহ্যের বিপরীত। সাইমুমের কোন সদস্যই শত্রুকে জীবিত রেখে সামনে এগোয় না। তুমি সামনের গাছটার কাছে মোড় ঘুরবার সময় গাড়ির গতি একটু কমিয়ে দিবে। আমি নেমে গেলে তুমি গাড়ী চালিয়ে যাবে। সুলতান সারাহ উদ্দিন রোডের মুখে আমার জন্য অপেক্ষা করো।
 
গাছটির কাছে একটু অন্ধকার মত জায়গায় খোলা দরজা দিয়ে চলন্ত গাড়ী থেকে ছিটকে বেরিয়ে গেল শফিক। পিছনে তাকিয়ে আশ্বস্ত হল সে। পিছনের গাড়ীর হেড লাইট এখনো অনেক পিছনে। নিশ্চিন্ত মনে পকেট থেকে একটা হ্যান্ড গ্রেনেড বের করে সেফটিপিন ঠিক করে রাখল। অন্য হাতে রিভলভার।
 
সামনের গাড়ী লক্ষ্য করে পিছনের গাড়ীটি নিশ্চিন্তে এগিয়ে যাচ্ছে। গাছের নীচে একটি পাথরের আড়ালে লুকিয়ে রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছে শফিক।
 
গাড়ী গাছের সমান্তরালে আসতেই সাইলেন্সার লাগানো রিভলভার থেকে ধীরে সুস্থে প্রথম গুলিটি ছুঁড়লো সে। দুপ করে মৃদু শব্দ উঠল। প্রচন্ড শব্দে পিছনের একটি টায়ার বার্ষ্ট করল। কিছুদূর যেয়ে থেমে গেল গাড়ীটি।
 
শফিকের ধারণা সত্য হ’ল। সাধারণ টায়ার বার্ষ্ট মনে করে গাড়ীর দু’ধারের দরজা খুলে দু’জন বেরিয়ে এল। একজন বেঁটে ধরণের। নাক চেপ্টা, মুখ গোল, রং হলুদ একবার চাইলেই বোঝা যায় চীনা লোক। আর একজন লম্বা। রং সাদা। দু’জনের পরনে কালো প্যান্ট, কালো কোট। ওরা টায়ার পরীক্ষা করেই চমকে উঠল। মুহুর্তে হাত পকেটে চলে গেল ওদের। কিন্তু দেরী হয়ে গেছে তখন। শফিকের রিভলভার দু’বার মৃদু শব্দ করে উঠল। ঢলে পড়ল দু’টি দেহ।
 
শফিক দ্রুত চলে গেল ওদের কাছে। পকেটে রিভলভার, সিগারেট কেস, লাইটার, হাত বোমা ছাড়া অন্য কোন কাগজ পত্র পেলনা।
 
গাড়ীতে একটি সাব মেশিনগার, একটি চামড়ার ছোট এটাচি কেস পড়ে ছিল। কোন তথ্য পাওয়া যেতে পারে মনে করে এটাচি কেসটি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল শফিক।
 
চলে যাবার আগে মোড়ে ডিউটিরত পুলিশকে দু’টি লাশের কথা জানিয়ে তাড়াতড়ি ওগুলোর ব্যবস্থা করার জন্য বলে গেল।
 
শফিককে পাঠিয়ে দেবার পর আহমদ মুসা অস্থিরভাবে কিছুক্ষণ পায়চারী করল। কি যেন সমাধান খুঁজছে সে মনে মনে। কোন কাজে হঠাৎ করে কোথাও চলে যাওয়াও হাসান তারিকের পক্ষে অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু তাই বা কি করে হয়? এখন রাত ১২টা। তার এখানে পৌঁছবার কথা ছিল ১১ টায়। তাছাড়া সবচেয়ে আশ্চর্য তার অয়্যারলেসের নীরবতা। তাহলে……..ভাবতেই চোখ দু’টি জ্বলে উঠল মুসার। প্রতিশোধের আগুন যেন তাতে ঠিকরে পড়ছে। পরে ধীরে ধীরে সে চোখ নেমে এল অদ্ভুত এক তন্ময়তা। জানালা দিয়ে বাইরে চলে গেল তার চোখ। অন্ধকার দিগন্তের কাল পর্দা ছাড়িয়ে তিবেক, হিন্দুকুশ, কারাকোরাম পর্বতমালা পেরিয়ে ছুটে গেল তার মন। পূর্ব্ব তুর্কিস্তানের কানশু এলাকার একটি সুন্দর জনপদে। কি হাসি -আনন্দ আর সমৃদ্ধি ভরা দিনগুলো। মরুভূমির একখন্ড দুরন্ত হাওয়ার মতই তারা ঘুরে বেড়াত চারিদিকে। কাঁটার ঝোঁপে সারাদিন চলত লুকোচুরি খেলা। রাতের বেলা বাবার উষ্ণ কোলে বসে আকাশের তারার দিকে চেয়ে কত গল্প শুনত। শুনতে শুনতে জগৎ পেরিয়ে মন চলে যেত আর এক জগতে। অন্ধকার গোটা পৃথিবী। একজন মহাপুরুষ এলেন আরব দেশে। তাঁর হাতে নেমে একখন্ড আলো। অনেক ঘৃর্ণাবর্ত আর ঝড়ের মাঝেও তা ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে। তার এক খন্ড এসে ছড়িয়ে পড়ল তুর্কিস্তানেও। অনেক সময় গল্প শেষ না করেই বাবাকে উঠকে হত। মসজিদ থেকে ভেসে আসতো বড় চাচাজনের এক পশলা মিষ্টি সুর। বুঝতো না সে এক বর্ণও কিন্তু ভাল লাগতো খুব। এমনি করে দিন চলে এসেছিল, চলতও এভাবেই কিন্তু সাজানো গোছানো এক জীবনে এল ঝড়। পিছনে অবশিষ্ট থাকল রক্ত, হাহাকার জানালার শিক ধরে দাঁড়িয়ে থাকা আহমদ মুসার মুখ কি এক অব্যক্ত বেদনায় আর দৃঢ়তায় শক্ত হয়ে উঠল। ধীরে ধীরে সে বলল, ‘মধ্য এশিয়া সিংকিয়াংএ, ফিলিপাইনে, ফিলিস্তিনে, ইথিওপিয়ায়, চাদে মুসলমানদের উপর যে নির্যাতন তোমরা চালাচ্ছ তার হিসাব অবশ্যই দিতে হবে। তোমার ‘সিয়াটো’ সেন্টো, ন্যাটো’ গড়তে পারো, ‘ওয়ারস’ চুক্তি করতে পারো, কিন্তু আমরা কিছু করতে গেলেই তা হবে ‘ফ্যানাটিক’ আর ‘গোড়ামি’?
 
জানালার পাল্লা দু’টো টানতে গিয়ে নীচের চোখ পড়তেই চমকে উঠল আহমদ মুসা। বাইরে প্রাচীরের পাশে বিড়ালের চোখের মত এক টুকরো ক্ষীণ আলো হঠাৎ জ্বলে উঠে নিভে গেল। পেন্সিল টর্চ নয়তো। সচকিত হয়ে উঠল আহমদ মুসা। অন্ধকারের জন্য বিশেষভাবে তৈরী বাইনোকুলার চোখে লাগাল দ্রুত। বাইরের অন্ধকার অনেকটা স্বচ্ছ হয়ে উঠল। দেখা গেল হুক লাগানো দড়ি বেড়ে একটি ছায়ামূর্তি প্রাচীরে উঠে বসেছে। কালো পোশাকে আবৃত সর্বাঙ্গ। ছায়ামূর্তিটি ধীরে ধীরে নামল নীচে। তারপর দেয়ালের পাশ ঘেঁষে শিকারী বিড়ালের মত এগিয়ে এল ধীরে নিঃশব্দ গতিতে।
 
প্রস্তুত হয়ে মুসা নেমে এল নীচে। সিঁড়ির মুখে সুইচ বোর্ডের পাশে একটি খামের আড়ালে দাঁড়াল সে।
 
নিঃশব্দ পায়ে ছায়ামূর্তিটি উঠে এল বারান্দায়। তাকে এক খন্ড জমাট অন্ধকার ছাড়া কিছু বুঝবার উপায় নেই। প্রায় দশ বারো হাতের মধ্যে সে চলে এসেছে। হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো ছায়ামূর্তি। আহমদ মুসা বাম হাতের বুড়ো আঙ্গুলের সুইচে চাপ দিয়ে ডানহাতে রিভলভার ধরে বের হয়ে এল আড়াল থেকে। ঘটনার আকস্মিকতায় ছাড়ামূর্তিটি মুহূর্তের জন্য বিহ্বল হয়ে পড়ল। রিভলভারের নলটি স্থির লক্ষ্যে তুলে ধরে মুসা বলল, নিশানা আমার প্রায়ই ভুল হয় না, ফেলে দিন রিভলভার। বোম হাতের পেন্সিল হেডেড রিভলভারটিও ফেলে দিন।
 
ছায়ামূর্তিটি স্থির নিষ্কম্প চোখ দু’টি আহমদ মুসার চোখে কি যেন পাঠ করল। তারপর একটু দ্বিধা করে হাতের দু’টি অস্ত্র ছেড়ে দিল মেঝেয়।
 
পাশে মানুষের একটি ছায়া নড়ে উঠতে দেখে চমকে উঠল আহমদ মুসা। প্রায় ছিটকে এক পাশে শুয়ে পড়ল সে। সঙ্গে সঙ্গে পিছন থেকে দুপ্ করে একটি শব্দ হল,তীব্র আর্তনাদ করে পড়ে গেল সামনের লোকটি। আহমদ মুসার রিভলভারও গর্জে উঠল। কিছু বুঝবার আগেই পিছনের লোকটির হাত থেকে রিভলভার ছিটকে পড়ে গেল। বাম হাতটি উপরে তুলতে চেষ্টা করল লোকটি। আহমদ মুসা গর্জে উঠল। হাত নামিয়ে নাও, নাহলে দ্বিতীয় গুলিটি এবার হাত নয় হৃদপিন্ড ভেদ করে বেরিয়ে যাবে।
 
আদেশ পালন করল লোকটি। তার ডান হাত থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝরে পড়ছিল এ সময় বাইরের গেটে গাড়ী দাঁড়ানোর শব্দ হল। উৎকর্ণ হয়ে উঠল আহমদ মুসা। কিন্তু রিভলভারের নল তার একটুও নড়ল না। বাইরে থেকে একটি পরিচিত সংকেত এল, আহমদ মুসা তার উত্তর দিতেই কয়েক সেকেন্ডর মধ্যে সেখানে হাজির হল ফারুক। এসেই বলল, ঠিক, আমার কান ভুল শোনেনি, যা ভেবেছিলাম তাই।
 
ওসব এ্যানালেসিস পরে করো ফারুক। আগে আমাদের এ মেহমানটির পকেট থেকে দ্বিতীয় রিভলবারটি বের করে নাও। সাবধানে হাত দিও পকেটে হয়তো আরো কিছু থাকতে পারে।
 
রাত তখন একটা। আহমদ মুসা আর ফারুক আমিন মুখোমুখি একটি টেবিলে বসে। আহমদ মুসার সামনে ছোট্ট একটি চিরকুটঃ
 
“A quite new element. WRF is active – Amman being their target at present – two alpin at trouser band as a “v” make their identity”
 
ধীরে ধীরে চিরকুট থেকে মুখ তলে আহমদ মুসা বলল, ইহুদীদের ‘মোসাদ’ আর পশ্চিমা সি, আই, এ, এর সাথে এসে জুটল কে আবার এই WRF? কি চায় ওরা? ফারুকের দিকে চেয়ে মুসা বলল, আমাদের আজকের মেহমান কোন দলের খোঁজ নিলে ফারুক?
 
ফারুক বলল, হ্যাঁ, WRF। ট্রাউজারের ব্যান্ডে ‘ভি’ আকারের দু’টো পিন দেখেছি।
 
ঘড়ির দিকে চেয়ে আহমদ মুসা বলল, সময় বেশী হতে নেই। তাছাড়া ওর ব্যবস্থা এখনই প্রয়োজন – কোন ব্যাপারকেই – বিশেষ করে এসব বিপদজনক বোঝা বেশীদূর টেনে নেওয়া ঠিক নয়। কিন্তু তার আগে চল পরীক্ষা করা যাক লোকটিকে।
 
ডিপ নীল আলো চারদিকে। বক -সাদা দেয়াল সে আলো প্রতিফলিত হয়ে স্বপনের পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। আধ -শোয়া অবস্থায় ইজি চেয়ারে পড়ে থাকা লোটির ডান বাহু থেকে পেন্টাখল ইনজেকশনের সূচ ধীরে ধীরে টেনে বের করল। তারপর মৃদু হেসে আহমদ মুসা বলল, বেশ কিছু একটু ক্লান্তি, একটু একটু ঘুম ঘুম ভাব বোধ করবেন মিনিট খানেক তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে। আগের সবগুলো কথা মনে পড়বে। আর বলতেও কোন কষ্ট হবে না।
 
লোকটির চোখ বুজে গিয়েছিল। আহমদ মুসা একটি চেয়ার টেনে নিয়ে তার সম্মুখে বসল। তারপর ধীরে ধীরে বলল, – চোখ খুলুন, আমার চোখেন দিকে দেখুন। আস্তে আস্তে চোখ খুলে গেল লোকটির। আহমদ মুসা বলল, আপনার নাম কি?
 
-মিখাইল ইয়াকুবভ।
 
-আপনি কোন দেশী?
 
-ইউক্রাইনি।
 
-কিন্তু দেখে তো তুর্কী মনে হয়?
 
-আমার পিতা – মাতা নাকি তুর্কী ছিলেন।
 
-ছিলেন কেমন?
 
-আমি সাইবেরিয়ার শিশু উদ্বাস্তু শিবিরের মানুষ।
 
-আপনার পিতা মাতা কি তাহলে মুসলমান ছিলেন?
 
-জানি না। তবে সেই উদ্বাস্তু শিবিরে আমর ট্রেনিং গ্রহণ কালে একবার অদ্ভুত এক বৃদ্ধ আমাকে বলেছিলেন যে, ১৯১৭ এর অক্টোবর বিপ্লবের পরে যে সব তুর্কী মুসলমানদের কে সাইবেরিয়ার চালান করা হয়েছিল, আমি তাদেরই কোন এক জনের সন্তান।
 
-এখন আপনি কি মনে করেন নিজের পরিচয় সম্বন্ধে?
 
-পূর্ব পরিচয়ে আমার প্রয়োজন নেই।
 
-আচ্ছা WRF কি?
 
-World Red Forces বিশ্ব কম্যুনিস্ট আন্দোলনের অগ্রবাহিনী।
 
-আপনি কি এর সদস্য?
 
-হ্যাঁ।
 
-কেন আপনি এখানে এসেছিলেন আজ?
 
-বহুদিন ধরে WRF আপনাকে খুঁজছে। আমাদের উপর নির্দেশ ছিল আপনাকে হত্যা করার অথবা সম্ভব হলে ধরে নিয়ে যাবার।
 
-সাইমুমের প্রতি আপনাদের এ শুভ দৃষ্টি কেন?
 
-সাইমুম বিশ্ব কম্যুনিষ্ট আন্দোলনের নাম্বার ওয়ান এনিমি।
 
-WRF এর কেন্দ্র কোথায়? কাদের নিয়ে গঠিত?
 
-এর নির্দিষ্ট কোন কেন্দ্র নেই। কেন্দ্রীয় কাউন্সিল যখন যেখানে থাকে সেখানেই এর কেন্দ্র। WRF কমিউনিষ্ট শক্তিগুলোর সম্মিলনে গঠিত একটি বেসরকারী সংস্থা।
 
-আবার কোথায় কিভাবে WRF কাজ করছে?
 
-আমি জানি না। শুধু এটকুই জানি, মুসলিম দেশগুলোকে এজন্য বিভিন্ন ইউনিটে ভাগ করা হয়েছে।
 
-আজকে এখানের খোঁজ কে দিয়েছে আপনাদের?
 
-আমি জানি না। আদেশ পালন করেছি শুধু।
 
-আদেশ কোত্থেকে এসেছে?
 
-আল কবির রোডের ২৩৩ নং বাড়ীর একটি ঘরে রক্ষিত কাঠের বাক্স থেকে নির্দেশ লিখিত চিঠি পেয়েছি?
 
-হাসান তারিককে চিনেন?
 
-নাম শুনেছি।
 
-গত ১০ ঘন্টা থেকে তার খোঁজ নেই। তার সম্বন্ধে কিছু জানেন?
 
-যে টুকুর সাথে আমরা সংশ্লিষ্ট তার বেশী কোন কিছুই আমাদের জানতে দেওয়া হয় না।
 
যেন অসীম ক্লান্তিতে চোখ দু’টি আবার বুজে আসছিল। ফারুকের দিকে তাকিয়ে মুসা বলল, এবার সরিয়ে নিয়ে যাও। হ্যাঁ এদের পূর্ব – পুরুষদের ঐতিহ্যের কথা একে স্মরণ করিয়ে দিয়ে একবার শেষ সুযোগ দিবে।
 
= ৩ =
কৃষ্ণপক্ষের অন্ধকার চারিদিকে। দুর্গম পার্বত্য পথ। পশ্চিম দিক থেকে জর্দান নদীর স্পর্শ চিহ্নিত ঠান্ডা হাওয়া এসে গায়ে শীতল স্পর্শ বুলিয়ে দিচ্ছে। নদীর পূর্ব তীরের বিভিন্ন স্থানে অস্পষ্ট আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে্। ওগুলো জর্দান সীমান্তরক্ষীদের ছাউনি। জর্দান নদীর ওপারে থেকেও ইসরাইলের বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ ঘাটির ক্ষীণ আলোক রেখা দেখা যাচ্ছে।
 
পার্বত্য পথ ধরে ধীর গতিতে এগিয়ে চলেছে চারটি ছায়ামূর্তি। একজন কৃষ্ণাঙ্গ। মাথায় ছোট ছোট কোঁকড়ানো চুল, ঠোঁট পুরু, মুখ লম্বাটে, বিশাল সুগঠিত দেহ। এর নাম আবু বকর সেনৌসি। দ্বিতীয় জন তীর্গ রোদ – পোড়া লাল মুখ, সযত্ব রক্ষিত দাড়ি। এর নাম আবদুর রহমান। এরা হলেন UMLLA (United Muslim Liberation League of Africa ) এর প্রতিনিধি।
 
তৃতীয় জন প্রায় সাড়ে ছ’ফুট উঁচু। রং হলদে, তুর্কী টুপি মাথায়, মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। চোখে মুখে ক্ষীপ্রতার ভাব সব সময় পরিস্ফুট। ইনি হলেন তুরস্ক থেকে আগত তুর্কিস্থান আযাদ আন্দোলনের নেতা মোস্তফা আমিন চুগতাই। এরা এসেছেন আজকে সাইমুমের পর্যালোচনা ও পরিকল্পনা কমিটির বিশেষ বৈঠকে তাদের আবেদন নিয়ে। আর চতুর্থ ব্যক্তি সাইমুমের সদস্য আবদুর রশিদ তাদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছেন।
 
আবদুর রশিদকে খুব চিন্তান্বিত মনে হচ্ছিল। সে হঠাৎ চুগতাই -এর দিকে চেয়ে বলল, আচ্ছা জনাব আমিন, হাসান তারিক চিঠি দেওয়ার পর আপনাকে কি মুখে কিছু বলেনি?
 
আমিন চুগতাই দ্রুত অথচ অত্যন্ত শান্ত কন্ঠে জবাব দিল, হাসান তারিককে অত্যন্ত ব্যস্ত মনে হচ্ছিল, চিঠি দিয়ে ৫ মিনিটের বেশী অপেক্ষা করেনি।
 
আমি তাকে কোন কিছু জিজ্ঞাসা করতেও সংকোচ বোধ করেছি। আজ ভোরে জনাব আলি এফেন্দির কাছে তাঁর নিখোজের খবর শুনে হতবাক হয়েছি। আজ বুঝতে পারছি, তার অস্বাভাবিক অস্থিরতাকে আমাদের অনুসরণ করা উচিৎ ছিল।
 
কিছুক্ষণ পথ চলার পর নীচে পাহাড়ের ঢালুতে অসংখ্য আলো দেখা গেল। ওগুলো আকাশের ছায়াপথের ন্যায় উত্তর দিকে এগিয়ে এক সরল রেখার মত। আবদুর রশিদ ওদিকে আঙ্গুল নির্দেশ করে বলল, ইহুদী বর্বরতার সাক্ষ্য দেখুন। নিজের দেশ, নিজের সকল সম্পদ থেকে বঞ্চিত হয়ে একটুকরো কুঁড়েঘড়ে পশুর মত এরা বাস করছে বছরের পর বছর ধরে। বাস্তুহারা এ লক্ষ লক্ষ মুসলমান জাতিসংঘের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল বিশটি বছর ধরে। অনাহার, অখাদ্য, অপুষ্টি ও অচিকিৎসায় মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছে তারা ক্রমশঃ। কিন্তু এদের আর্তক্রন্দন আর মুমূর্ষ চিৎকার বিশ বছরেও জাতিসংঘের কানে পৌঁছেনি। বলতে বলতে থামল আবদুর রশিদ। তারপর আবার বলল, কিন্তু অপেক্ষার দিন শেষ হয়েছে, ধৈর্য্যের সকল বাদ ভেঙ্গে গেছে। আমরা মানুষের উপর নির্ভর করে খেশারত দিয়েছি বহু। আর নয়। অস্ত্র তুলে নিয়েছি এবার আমরা দু’টো পথ আমাদের সামনে হয় শহীদ না হয় গাজী।
 
আমিন চুগতাই বলল, জনাব রশিদ, আপনাদের উদ্বাস্তুদের মধ্যে শিক্ষা ও সংগঠনের কোন ব্যবস্থা ছিল না বলেই জানি, কিন্তু এমন বিস্ময়করভাবে সংগঠিত হতে পারলেন কেমন করে আর এমন ট্রেনিংইবা পেলেন কোথা থেকে?
 
আবদুর রশিদ মৃদু হেসে বলল, আমাদের শিক্ষা ও সংগঠন সম্বন্ধে আপনার ধারণা কিছুটা সত্য, কিন্তু সবটুকু সত্য নয়। যে সময় হাজার হাজার আহত ও ছিন্নমূল মানুষের স্রোত জর্দান, সিরিয়া, ইরাক আর সিনাইয়ে প্রবেশ করে, তখন আমাদের বিশ্রামের জন্য মাটির শয্যা, খাওয়ার জন্য কুপের পানি ছাড়া আর কিছুই ছিল না। আমাদের এ চরম দুর্দিনে অনেকেই আমাদের সাহায্য করেছিল, কিন্তু সেদিন অদ্ভুত একদল কর্মী ভাইদের আমরা একান্ত করে আমাদের পাশে পেয়েছিলাম। মা’র কাছে গল্প শুনেছি। শুনতাম মা প্রায়ই বলতেন, মদিনার আনসারদের আল্লাহ আমাদের জন্য পাঠিয়েছেন। এদের আপনারা সকলেই আজ চিনেন-ইখওয়ানুল মুসলিমুন। ইখওয়ান ভাইরা সেদিন শুধু আমাদের জন্য চিকিৎসা, খাদ্য আর তাঁবুরই ব্যবস্থা করেছিলেন না। উদ্বাস্তু পল্লীগুলোকে বিভিন্ন ইউনিটে ভাগ করে প্রত্যেকটিতে একটি করে শিক্ষায়তন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছিল দীর্ঘমেয়াদী সামরিক ট্রেনিং এর ব্যবস্থা। শিবিরগুলিতে ইখওয়ান কমীরা শিক্ষক ও উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করতেন। তাঁরা বলতেন বলে শুনেছি, বিশ্ব -রাজনীতিতে অনুন্নত ও অন্তর্দ্বন্দ্বে মুসলিম দেশগুলো যে ভাবে মার খেয়ে যাচ্ছে, তাতে ফিলিস্তিনের মুক্তির জন্য তাদের সামরিক শক্তির উপর নির্ভর করা যেতে পারে না। ফিলিস্তিনের প্রকৃত মুক্তি অকুতোভয মুসলিম তরুণদের বেসরকারী সংগ্রামেই অর্জিত হবে।’ আজকের সাইমুমের জন্ম হয়েছিল সেদিন আমাদের ইখওয়ান ভাইদের হাতইে। হয়ত অনেক আগেই তেলআবিবের প্রাসাদ শীর্ষ থেকে ইহুদী – পতাকা ভুমধ্যসাগরে ডুবে যেত, কিন্তু হঠাৎ করে আমাদের আশার আলোক বর্তিকা রাগুগ্রস্থ হল। ইখওয়ান নেতা হাসানুল বান্না মিশরের রাজপথে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেলেন। হঠাৎ আমিন চুগতাই এর কনুই এ গুতা খেয়ে সম্মুখে তাকিয়ে রশিদ দেখতে পেল, পাহাড়ের অন্ধকার গুহা থেকে আলোক সংকেত হল নির্দিষ্ট নিয়মে কয়েকবার। সে তার সাথীদের জানাল আমরা প্রথম চেকপোষ্টে এসে গেছি। কয়েক গজ সামনে দেখা গেল উদ্ধত মেশিন গান হাতে পথ রোধ করে দাড়িয়ে আছে দু’টি ছায়ামূর্তি।
 
আবদুর রশিদ বিচিত্র স্বরে একটি শীষ দিয়ে উঠল। আর সঙ্গে সঙ্গে গোটা দেহ কালো কাপড়ে আবৃত একজন বিশালকায় প্রহরী একটি প্লেটে করে কতগুলি কাঠের অক্ষর এনে আবু বকর সেনৌসির সামনে তুলে ধরল। সেনৌসি তার থেকে W অক্ষরটি তুলে নিল। অমনি লোকটি রিভলভার নামিয়ে ছালাম দিয়ে হ্যান্ডশেক করল সকলের সাথে। প্রথম চেকপোষ্ট পেরিয়ে এল ওরা।
 
বিস্মিত আমিন চুগতাই প্রশ্ন করল, কি ব্যাপার?
 
আবদুর রশিদ হেসে বলল, তিন নম্বরে আপনার পালাও আসছে। ঘাটিতে ঢোকার জন্য এ ধরনের টেষ্টে আপনাকেও উত্তীর্ণ হতে হবে। চিন্তিত আমিন চুগতাই বলল, কিন্তু আমি তো এ সংকেত জানতে পারিনি হাসান তারিক আমাকে ………..।
 
-তা আমি বুছলাম। কিন্তু এ ব্যাপারে আমি আপনার মতই অজ্ঞ। দেখা যাক, আমি মুসা ভাইকে জানিয়েছি আপনার কথা।
 
আরও কয়েক মাইল কষ্টকর আরোহন-অবতরণের পর তারা দ্বিতীয় চেক পোষ্টে পৌঁছল। সেখাসে আগের মত করেই প্লেটে কতগুলো কাঠের অক্ষর আনা হল আব্দুর রহমানের সামনে। তা থেকে তিনি A অক্ষরটি তুলে নিলেন।
 
তৃতীয় চেকপোষ্ট গিয়ে আমিন চুগতাই প্রহরীদের হাতে আটকা পড়ে গেল। হেড কোয়ার্টার থেকে নূতন নির্দেশ না আসা পর্যন্ত তাদেরকে ওখানে অপেক্ষা করতে আদেশ করা হল।
 
প্রায় পনর মিনিট পর আহমদ মুসার বিশেষ নির্দেশে আমিন চুগতাইকে ছাড়া হল।
 
আম্মান থেকে ১২ মাইল উত্তরে জর্দান নদী থেকে ২০ মাইল পূর্বে একটি সংকীর্ণ পার্বত্য উপত্যকার পাশে পর্বত গাত্রের কয়েকটি গোপন প্রকোষ্ঠ আলোকিত হয়ে উঠেছে। পর্বত গুহার চতুর্দিকে মাইলের পর মাইল ধরে ‘সাইমুম’ মুক্তি সেনার ঘাঁটি ও পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র ছড়িয়ে আছে। এখান থেকে পরিচালিত গেরিলাভিযান ইসরাইলের ইলাত থেকে গাজা, হাইফা থেকে জেরুজালেম পর্যন্ত ইহুদী সম্রাজ্যবাদীদের সুখনিদ্রাকে চিরতরে বিলুপ্ত করে দিয়েছে। রাতের অন্ধকারে রাইফেল নিয়ে পাহারায় বসতেও তাদের বুক আজ দুরু দুরু করে। যেন তার বুঝতে পারছে, হিসাবের দিন আসন্ন। প্যালেষ্টাইনী মুসলমানদের প্রতিটি ফোটা রক্তের শোধ আজ তাদের দিতে হবে।
 
উজ্জ্বল প্রকোষ্ঠগুলির একটিতে বিরাট এক গোল টেবিলের চারদিকে চেয়ার পাতা। ঘরের প্রতিটি চিনিস ঝকঝক তকতক করছে। টিবিল ঘিরে ১০ টি চেয়ার। ৮ জন লোক বসে আছে। এক পাশের দু’টি চেয়ার তখন ও খালি – একটি হাসান তারিকের অপরটি মেজর জেনারেল আলী এফেন্দির। হাসান তারিক নিখোঁজ। আর আলী এফেন্দী এখনো পৌঁছুতে পারেনি। সাইমুমের তিনজন সদস্য ছাড়াও যারা আজকের বৈঠকে এসছে, তারা হলো আফ্রিকার দু’ জন, তুরষ্ক থেকে একজন। UMLLA কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের পাঠানো রিপোর্ট পড়ছিলেন আফ্রিকার অন্যতম প্রতিনিধি আবদুর রহমান। এ শীতের রাতেও তার কপালে জমে উছেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। আহমদ মুসার মুখ নিচু। তন্ময়তার কোন অতল গভীরে যেন হারিয়ে গেছে সে। আবদুর রহমান তাঁর রিপোর্টে বলছিলেনঃ -‘‘আফ্রিকার মোট ৩২২০ মিলিয়ন মানুষের মধ্যে মুসলমানের সংখ্যা হল ১৯৪ মিলিয়ন। আর বহিরাগত ঔপনিবেশিক খৃষ্টানদের নিয়ে মোট খৃষ্টান জনসংখ্যা হল ৪৭ মিলিয়ন। এ খৃষ্টানরা দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে রয়েছে। এ অঞ্চলের কোন মুসলিম দেশেই এদের সংখ্যা ১৫% এর বেশী নয়। অথচ এ সামান্য সংখ্যক হয়েও তারা স্বগোত্রীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সহায়তায় ইথিওপিয়া, চাঁদ, মালি, নাইজেরিয়া, তানজানিয়া, ঘানা, সিয়েরলিওন, ডাহোমী, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক, আপার ভোল্টা, আইভরি কোষ্ট, সেগোল প্রভৃতি মুসলিম দেশে সাম্রাজ্যবাদী শোষণ আর নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে। এসব দেশে শিক্ষার দ্বার মুসলমানদের জন্য প্রায় অবরুদ্ধ। অবশ্য কোন মুসলিম সন্তান যদি একান্তই কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কখনও ঢুকবার সুযোগ পায়, তাহলে তাকে মুসলমান নাম বদল করে খৃষ্টান নাম গ্রহণ করতে বাধ্য হন এবং অবশেষে খৃষ্টানই হয়ে গেছেন। অর্থনৈতিক কায়কারবার ব্যাবসায় বাণিজ্যের সব সুযোগই খৃষ্টানদের কুক্ষিগত। রাজনীতি ক্ষেত্রে মুসলমানরাতো অস্পৃশ্য। এভাবে সর্বমুখী শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় পড়ে মুসলমানদের অস্তিত্ব আজ নিশ্চিহ্ন হতে বসেছে, এসব কিছুর উপরে রয়েছে আবার রাজনৈতিক নির্যাতন। মাত্র কিছুদিন আগে চাদের লিবারেশন ফ্রন্টের সহস্র সহস্র কর্মীকে অমানুষিক যন্ত্রণা দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ইথিওপিয়ার মুক্তিযোদ্ধাদেরকে হত্যা করে গাছে গাছে লটকিয়ে রাখা হয়েছিল যা দেখে নিরপেক্ষ বিদেশীরাও চোখের পানি রোধ করতে পারেনি। জাঞ্জিবারের মুসলিম জননেতা কাশিম হাঙ্গা, আলি মহসিন, সালাম বাম্ব, ইবনে সালেহ্ আবদার জুমা, খাতির মুহাম্মদ সামত, জুমা আলই, আমিরাল আল্লারখিয় বছরের পর বছর ধরে কারাগারে যন্ত্রণা ভোগ করেছে। শুধু তাঞ্জানিয়ার কারাগারেই নয়, এমনই সহস্র সহস্র নরনারী আফ্রিকার বিভিন্ন কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে মৃত্যুর প্রহর গুনছে।
 
আমরা ঠেকে ঠেকে বুঝেছি এবং একথা আমরা নিশ্চিতভাবে আজ বিশ্বাস করি যে, ভিক্ষা করে সুবিচার আদায় করা যাবে না কিংবা আন্তর্জাতিক ন্যায় বিচারের মহড়াও এসব নির্যাতিত মানুষের কোন কাজে আসবে না। মজলুম মানুষের মুক্তির একমাত্র পথ -সংগ্রাম। এ সংগ্রামকে লক্ষ্যের পথে এগিয়ে নেওয়ার জন্য আমাদের আবেদন ৫ টিঃ
 
(১) দীর্ঘ মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য পর্যাপ্ত অর্থনৈতিক সাহায্য।
 
(২) মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্র – শস্ত্রের সরবরাহ।
 
(৩) আহত মুক্তিযোদ্ধাদের যথাযথ আধুনিক চিকিৎসার ব্যবস্থা।
 
(৪) মুক্তিযোদ্ধাদের শিক্ষা ও ট্রেনিং এর জন্য উপদেষ্টা প্রেরণ।
 
(৫) সাইমুম কর্তৃক নির্যাতিত মানুষের মুক্তি আন্দোলন গুলোর নেতৃত্ব গ্রহণ।
 
সুদীর্ঘ দশ পৃষ্ঠাব্যাপী লিখিত রিপোর্ট শেষ করলেন আবদুর রহমান। কয়েক মুহূর্ত সবাই চুপচাপ। ধীরে ধীরে টেবিলে রাখা আফ্রিকার একটি বিশেষ মানচিত্র থেকে মুখ তুলল আহমদ মুসা। আর লিবিয়া ও চাদের পর্বতমালাকে আপনাদের প্রধান ও স্থায়ী ঘাঁটি হিসেবে মনোনীত করেছেন কোন কারণে? এর চেয়ে সমুদ্র কুলবর্তী কোন স্থানকে নির্বাচন করলে যুক্তিযুক্ত হতো না কি?
 
আহমদ মুসার প্রশ্নের উত্তর দিতে এগিয়ে এলেন আবু বকর সেনৌসি। তিনি বললেন এর কারণ তিনটি। প্রথম কারণ উভয় স্থানই অত্যন্ত দুর্গম এবং যে কোন বিরূপ মনোভাবাপন্ন শত্রু রাজধানী থেকে বহুদূরে। শুধু স্থান দুটি ভৌগলিক দিক দিয়ে দুর্গমই নয়, এর চারিদিকে হাজার হাজার মাইল জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে বিভিন্ন পার্বত্য আর বেদুঈন গোত্র। তারা আমাদের বন্ধু এবং আমাদের সংগ্রামী শক্তির বিশিষ্ট অঙ্গ।
 
দ্বিতীয় কারণ ¬এখান থেকে অতি সহজেই বিভিন্ন আফ্রিকান মুসলিম দেশের সাথে ঘনিষ্ট যোগাযোগ রাখা যাবে।
 
তৃতীয় কারণ – অস্ত্র-পাতির সরবরাহও এখানে নিরাপদ হতে পারবে। বন্ধুদেশ সুদানের পথে, লোহিত সাগরের পথে সহজেই আমরা কোন সরবরাহ পেতে পারি। আর উত্তরদিকে ভূমধ্যসাগরের পথে সাইরেনিকা ও লিবিয়া মরুভূমির মধ্য দিয়ে সকল রকমের সরবরাহ নিরাপদে আসতে পারে। সাইরেনিকার নির্জন ও দুর্গম সমুদ্রতীর এবং এর গভীর পার্বত্য বনাঞ্চল এ কাজের খুবই অনুকুল। সাইরেনিকার আরব বেদু্ঈনদের অমূল্য সাহায্য আমরা এ কাজে পাব। বেদুঈনরা সাম্রাজ্যবাদীদেরকে মজ্জাগত ভাবে ঘৃণা করে। ইতালীয় কোম্পানীদের উপনিবেশী নির্যাতনের কথা বেদুঈনরা আজও ভুলে নাই। আজও সাইরেনিকা আর লিবিয়ার পথেঘাটে প্রান্তরে নির্যাতনের সাক্ষর জীবন্ত হয়ে আছে। বেদুঈনদের পানি কষ্ট দিয়ে মেরে ফেলার জন্য যে অসংখ্য কূপ সিমেন্ট দিয়ে বুজিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তা আজ ও তেমনি আছে। লিবিয়া ও সাইরেনিকার বহুস্থানে ধ্বংস হয়ে যাওয়া এমন বহু জনপদ পাওয়া যাবে যেগুলো একমাত্র পানির অভাবে বিরাণ হয়ে গেছে। ঘাঁটি হিসাবে ‘কুফরা’ আর লিবিয়ার মরুভূমির দক্ষিণ সীমান্তের পর্বতমালাকে নির্বাচনের আর একটি বড় কারণ হল, আজও এ অঞ্চলের লক্ষ লক্ষ মুসলিম বৃদ্ধ ও তরুণদের মনে সেনৌসী আন্দোলনের আদর্শ ও আবদুল করিম রিনফের জ্বালাময়ী প্রেরণা রূপকথার মত হলেও জীবন্ত হয়ে আছে।
 
আহমদ মুসার চোখ দু’টি খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। সে বলল, আপনাদের দূরদৃষ্টি অত্যন্ত প্রশংসনীয়। আমি বিশ্বাস করি বিজয় আপনাদের সুনিশ্চিত। আপনাদের পিছনে সেনৌসী আন্দোলনের ঐতিহ্য রয়েছে, আবদুল করিম রিফের প্রেরণা রয়েছে, আর রয়েছে, হাসানুল বান্নার সংগঠন ও আত্মত্যাগের শিক্ষা।
 
মোস্তফা আমিন চুগতাই বললেন, তিনি রিপোর্ট এখনও শেষ করতে পারেননি, রিপোর্ট তিনি সমাপ্তি অধিবেশনে পেশ করবেন।
 
রিপোর্ট অধিবেশন তখনকার মত স্থগিত হল। আহমদ মুসা টেবিলের পাশে একটি বোতাম টিপে ধরল। কিছুক্ষণ পর একজন লোক প্রবেশ করে ছালাম জানাল। মুসা বলল – আলি এফেন্দির কোন খবর নেই?
 
-জি না।
 
-আমরা কন্ট্রোল রুমে যেতে চাই, তুমি জামিলকে বলে সত্তর ব্যবস্থা কর।
 
তারপর সকলের দিকে ফিরে হেসে বলল, ভাই আমিন চুগতাই জানতে চেয়েছেন কিভাবে আমরা ইসরাইলের বিরুদ্ধে অগ্রসর হচ্ছি। তার জন্যই এ ব্যবস্থা। আবু বকর সেনৌসি মৃদু হেসে বলল, আমরা আমিন ভাই এর কাছে এজন্য কৃতজ্ঞ।
 
পাহাড়ের কয়েকটি অন্ধকার আকাবাঁকা গলি পেরিয়ে আটটি ছায়ামূর্তি ত্রিকোণ একটি জায়গায় এসে দাঁড়াল। জায়গাটি স্বল্প পরিসর। একটি প্রকান্ড পাথর উত্তর দিক থেকে এসে মাথার উপর ছাদের মত আড়াল সৃষ্টি করেছে, তারা ওখানে পৌঁছাতেই উত্তর পশ্চিম কোণ থেকে একটি পাথর সরে গেল এবং সঙ্গে সঙ্গে এক ঝলক সন্ধানী আলো এসে তাদের চোখ ধাঁধিয়ে দিল। আহমদ মুসা সবাইকে নিয়ে সে উন্মক্ত পথ দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করল। আবার পূর্বের মতই সে গলি পথ শুরু হল। দু’ধারে পাহাড়ের দেয়াল। অন্ধকারে কিছুক্ষন চলার পর এক জায়গায় এসে থমকে দাঁড়াল আহমদ মুসা। পাশে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় প্রথমে তিনটি জোরে এবং পরে পাঁচটি আস্তে টোকা দিল। টোকা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রায় বিশ গজ উপরে একটি ম্লান নীল বাল্ব জ্বলে উঠল।
 
আহমদ মুসা পুনরায় প্রথমে পাঁচটি ও পরে তিনটি টোকা দিল নির্দিষ্ট জায়গায়। এবার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আটটি দড়ির মই নেমে এল নিচে। ঢাকনীর বিপ্লব পরিষদের মওলানা ফারুক হেসে বললেন, আবার একি ট্রেনিং এ পাল্লায় ফেল্লেন?
 
পাহাড় দেশের মানুষ হয়ে আমাদের এ ক্ষুদে পাহাড়কে আর লজ্জা দিবেন না মওলানা। হেসে আহমদ মুসা জবাব দিল।
 
দড়ির মইগুলি নেমে এল। সেগুলোতে উঠতেই মুহূর্তে তাদেরকে উপরে নিয়ে এল। তারা একটি কংক্রিটের ছাদে গিয়ে দাঁড়াল। ছাদটি বিরাট প্রশস্ত। ছাদে উঠে দাঁড়াতেই এক ঝলক ঠান্ডা বাতাস এসে গায়ে হিমেল পরশ বুলিয়ে গেল।
 
জর্দান নদীর এ সওগাত। রাত্রির অন্ধকার না থাকলে দেখা যেত কিছু দূর দিয়ে রূপালী ফিতার মত জর্দান নদী বয়ে যাচ্ছে। আহমদ মুসা সবাইকে নিয়ে ছাদটি পেরিয়ে একটি সিঁড়ি মুখে প্রবেশ করল। সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেল মওলানা ফারুক, আবু বকর সেনৌসি ও আবদুর রহমানের মুখ। তারা দেখল সিঁড়ির প্রান্তে হাসি মুখে দু’হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিশ্ব মুসলিম সম্মেলনের বিশিষ্ট কর্ণধার আশিন আল – আজহারী এবং বিশ্ব মুসলিম কংগ্রেসের সামরিক বিশেষজ্ঞ আবদুল্লাহ অতিথিদেরকে জড়িয়ে ধরল আনন্দে।
 
সকলে মিলে আবার তারা চলতে শুরু করল। আবু বকর সেনৌসিদের বিস্ময়ের ঘোর তখনও কাটেনি। আহমদ মুসা তাদের তিকে চেয়ে হেসে বলল – জনাব আমিন আল আজহারী সাইমুমের পরিকল্পনা বিভাগের প্রধান এবং জনাব আবদুলাহ আমর এ বিভাগের প্রধান উপদেষ্টা।
 
তারা সকলে পার্শ্বস্থ একটি প্রায়ান্ধকার কক্ষে প্রবেশ করল। দরজা দিয়ে বাহির থেকে এক টুকরো আলো এসে বৃহৎ লম্বা টেবিলটির একাংশ আলোকিত করেছে। তারা লম্বা টেবিলটির দক্ষিন পার্শে গিয়ে তারপর দরজাটি ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যেতেই অল্প আলোর রেশটুকুও মিলিয়ে গেল। ঘরটি হয়ে গেল সম্পূর্ণ অন্ধকার।
 
আহমদ মুসার গম্ভীর কণ্ঠ শুনা গেল। সে বলল, বিজ্ঞ ইহুদী মুরুব্বিদের পরিকল্পিত বহু বছর ধরে গড়ে তোলা বিশ্বজোড়া ইহুদী চক্রান্তের বিষফল ইসরাইলের বিরুদ্ধে কিভাবে আমরা অগ্রসর হচ্ছি তা এবার আপানদেরকে বুঝিয়ে দিবেন জনাব আমিন আল – আজহারী।
 
আমিন আল আজহারী টেবিলের উপর দু’টি কনুই রেখে সামনের দিকে এইটু ঝুকে বসলেন তাঁর শান্ত কন্ঠে শোনা গেল – সাইমুমের মূল পরিকল্পনার বিষয়ে কিছু বলার আগে প্রসঙ্গক্রমে একটি কথা বলা দরকার। আরব দেশগুলোর লক্ষ্যগত অনৈক্য, বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে দুর্বলতা এবং সামরিক ক্ষেত্রে পরনির্ভরশীলতার জন্য আজও ইহুদীদের হাত থেকে আরবভূমি মুক্ত করতে পারা যায়নি। এ পরিস্থিতিতে নিয়মিত পদ্ধতিতে যুদ্ধ করে ইহুদীদের উৎখাত করা যাবে না। তাদের পিছনে রয়েছে পূর্ব ও পশ্চিম উভয় শক্তি জোট। আরব ভূমিকে মুক্ত করতে চাইলে এবং কয়েক যুগ ধরে মুসলমানদের উপর কৃত সকল জুলুমের প্রতিশোধ গ্রহণ করতে হলে ইসরাইলকে ভিতর থেকে আঘাত হেনে টুকরো টুকরো করে ফেলতে হবে। এ ধারণার উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে সাইমুম। সাইমুমের পরিকল্পনাকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। কথাগুলো বলে থামলেন তিনি একটু। আবার বললেন – চেয়ে দেখুন সামনে।
 
সবাই সামনে তাকাল। কোথায় যেন খুট করে একটু শব্দ হল দেয়ালের কাল সীমান্ত রেখায় ইসরাইলের একটি বিরাট মানচিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠল। তারপর মানচিত্রের বিভিন্ন স্থানে ফুটে উঠল অসংখ্য নীল বিন্দু।
 
আমিন আল-আজহরী শুরু করলেন, ইসরাইলের মানচিত্রে যে নীল বিন্দুগুলো দেখছেন ওগুলো ইসরাইলের গ্রাম। গুনে গুনে দেখুন ওদের সংখ্যা ২৩৯৯ টি হবে। প্রত্যেকটি গ্রামে ৭ সদস্যের একটি করে বিপ্লবী ইউনিট প্রতিষ্ঠা করেছি আমরা। ইউনিটের অধিকাংশ সদস্য প্যালেষ্টাইনের ছদ্মবেশী আরব মুসলমান। সুদীর্ঘ ৬ বৎসর অবিরামভাবে কাজ করেছি আমরা এ ইউনিটগুলো প্রতিষ্ঠা করতে। প্রতিটি গ্রামের মাটির তলায় একটি করে ক্ষুদ্র অস্ত্রাগার তৈরী করেছি। পূর্বে অস্ত্রাগারগুলো প্রায় শূন্য ছিল কিন্তু গত ১৯৬৭ সালের জুন যুদ্ধের পর সিনাই মরুভূমি থেকে কুড়িয়ে পাওয়া অস্ত্র দিয়ে তা আমরা পূর্ণ করে ফেলেছি। প্রত্যেকটি অস্ত্রগারে রয়েছে দু’ডজন হাতবোমা, ৫ টি রাইফেল, ৬ টি পিস্তল ও ১টি সাবমেশিনগান। বিপ্লবী ইউনিটগুলো প্রতিষ্ঠার সময় ইসরাইলী গোয়েন্দা ও সৈন্য বিভাগের দৃষ্টি দেশের অভ্যন্তর থেকে সরিয়ে নেবার জন্য আমরা ইসরাইলের সীমান্ত এলাকায় চালিয়েছি হাজার হাজার অভিযান। ইসরাইল পাগল হয়ে উঠেছিল তার সীমান্ত নিয়ে। তাদের উন্মত্ত মানসিকতার পূর্ণ পরিচয় ফুটে উঠে ‘‘সাইমুমের’’ ঘাঁটি সন্দেহে জর্দানের ‘‘কারামা’’ আক্রমণের মধ্যে।
 
খুট করে আর একটি শব্দ হল। মানচিত্রে সিনাই মালভূমির অভ্যন্তরে এবং গোলান হাইট থেকে প্রায় ৫০ মাইল ভিতরে দু’টি বড় নীল আলো ফুটে উঠল। জনাব আজহারী বললেন – ইসরাইলের অভ্যন্তরে এ দু’টি আমাদের মূল সরবরাহ ঘাঁটি। দু’টি পুরান গির্জার নীচে মাটির তলায় এ দু’টি ঘাঁটি স্থাপন করা হয়েছে।
 
প্রথম পর্যায়ের কাজ আমাদের সমাপ্ত। মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ দ্বিতীয় অধ্যায়ে আমরা প্রবেশ করেছি। তার কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানচিত্রে চারটি লাল বিন্দ স্পষ্ট হয়ে উঠল। জনাব আল আজহারী আবার শুর করলেন, লাল বিন্দু চারটি হল ইসরাইলের ইলাত, লুদ, তেলআবিব আর হাইফা এ চারটি স্থানে ইহুদীরা ক্ষেপনাস্ত্র ঘাঁটি স্থাপন করেছি। এ ক্ষেপনাস্ত্র ঘাঁটিগুলির আওতায় রয়েছে হেজাযের দু’টি পবিত্র শহর। তুরস্ক আর আরব রাষ্ট্রগুলির রাজধানী এবং সবগুলো গুরুত্বপূর্ণ শহর। দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রথম ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল ইসরাইলের চরম আঘাত হানার ঠিক পূর্বমুহূর্তে একটি নির্দিষ্ট সময়ে ক্ষেপনাস্ত্র ঘাঁটিগুলি বিনষ্ট করে দেয়া। অবশ্য আমরা জানি ইসরাইলের কমপক্ষে ১১টি আণবিক বোমা রয়েছে কিন্তু ওগুলো ব্যবহার করতে সমর্থ হবে না ইসরাইল। কারণ তার উপর আঘাত হানা হবে ভিতর থেকে -কোন আরব রাষ্ট্র থেকে নয়। তবুও আমরা এ বিষয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখব এবং আনবিক অস্ত্র ব্যবহারের যে কোন প্ল্যান আমরা বিনষ্ট করে দেব।
 
জনাব আজাহারির শেষের বাক্যটি শেষ হবার সাথে সাথে আমিন চুগতাই যেন অনেকটা সঙ্কোচ জড়িত কন্ঠে বললো, আপনাদের আপত্তি না থাকলে আমি একটি সিগারেট ………।
 
দ্রুত চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল আহমদ মুসার মনে। অবশেষে সে পরিস্কার গলায় বলল, না না আমাদের আপত্তি থাকবে কেন?
 
আমিন চুগতাই একটি সিগারেট মুখে পুরে লাইটার জ্বালল। লাইটারটি জ্বলে উঠতেই চমকে উঠল আহমদ মুসা। এক ঝলক তীক্ষ্ণ আলো আর লাইটার থেকে ভেসে আসা অতি সুক্ষ্ণ একটি পরিচিত শব্দ আহমদ মুসার দৃষ্টিকে ফাঁকি দিতে পারলো না। ইতিমধ্যে জনাব আজহারি আবার বলতে শুরু করেছেন ‘দ্বিতীয় পর্যায় সমাপ্ত হবার পর একটি নির্দিষ্ট সময়ে শুরু হবে আমাদের সর্বাত্মক সংগ্রাম। ভিতর থেকে যে দুর্বার আঘাত আমরা হানব তা রোধ করার সাধ্য ইসরাইলের নেই। তার বিদেশী মুরব্বীরা তার পাশে এসে দাঁড়াবার পূর্বেই সে খতম হয়ে যাবে।
 
আমিন আল আজহারির কথার শেষ রেসটুকু ইথারে মিলিয়ে যাবার আগেই উজ্জ্বল সাদা আলোয় ঘরটি যেন হেসে উঠল। আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়েছিল আগেই। সে ধীরে ধীরে এগোচ্ছিল চুগতাই এর দিকে। ভাবলেশহীন মুসা। চুগতাই টেবিলের উপর হাত রেখে বসে ছিল। তার চোখ দু’টি ঘরের চারদিকে ঘুরছিল। অনুসন্ধিৎসা সে চোখে। মনে তার প্রচন্ড ঝড় – শামিল এফান … “দেশের ইন্টারনাল সিকিউরিটির দায়িত্ব ঐ বুড়োটার উপরই তো ছিল। শুধু গাদা গাদা বেতন মেরেছে আর নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়েছে বুড়ো … আচ্ছা দ্বিতীয় পর্যায়ের কতদূর পৌঁছেছে এরা। পরিকল্পনা এদের নিখুঁত। ভাবতে আতঙ্ক লাগে -প্রতি গ্রামে এরা ছড়িয়ে আছে …।
 
আহমদ মুসা ধীরে ধীরে একটি হাত রাখল চুগতাই এ কাঁধে । তার হাতে একটি সিগারেট। চিন্তা সূত্র ছিন্ন হয়ে গেল চুগতাইয়ের । প্রচন্ড এক হোঁচট খেল যেন সে। ভীষণ চমকে উঠল। ফিরে তাকিয়ে আহমদ মুসাকে দেখে ঠোঁটের প্রান্তে হাসি টেনে নিল। সামলে নিয়েছে সে নিজেকে। বলল, খুব চমকে দিয়েছেন তো আমাকে? আপনাদের বিস্ময়কর পরিকল্পনার রঙীন জগতে ঘুরছিলাম আমি এখনও।
 
– আমি দুঃখিত ভাই। বলল আহমদ মুসা। তারপর সিগারেটের একটি শলা বাম থেকে ডান হাতে নিয়ে সে বলল, আপনার লাইটারটি কি পেতে পারি? কথাটি শোনার সাথে সাথে ঠোঁটের কোনের হাসিটি দপ করে যেন নিভে গেল। এক টুকরো তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মুহূর্তের জন্য আহমদ মুসার চোখে এসে স্থির হল। কিন্তু ক্ষণিকের জন্যই। তারপরই আবার উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল মোস্তফা আমিন চুগতাই। বলল, নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। বলে পকেট থেকে লাইটারটি বের করে জ্বালিয়ে আহমদ মুসার মুখের কাছে তুলে ধরল। সিগারেট ধরিয়ে নিয়ে আহমদ মুসা বলল, বাঃ লাইটারটির সিষ্টেম তো খুব সুন্দর। জার্মানির তৈরী না? দেখতে পারি একটু?
 
মোস্তফা আমিন চুগতাই এই অবস্থার জন্য বোধ হয় প্রস্ত্তত ছিল না মোটেই্। কেমন একটি বিমূঢ় ভাব চোখে মুখে ফুটে উঠল তার। সে দ্বিধাজড়িত হাতে লাইটারটি তুলে দিল আহমদ মুসার হাতে।
 
আহমদ মুসা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ্য করছিল চুগতাইকে। দেখল একটি হাত তার কোটের পকেটে। এর অর্থ মুসার অজানা নয়। সূক্ষ্ম এক টুকরো হাসি ফুটে উঠতে চাইল তার মুখে। সে লাইটারের দিকে এক মুহূর্ত তাকিয়েই বুঝতে পারল, একটি শক্তিশালী ক্যামেরা সংযোজন করা আছে ওতে।
 
একগাল ধোয়া ছেড়ে একটু ঝুঁকে পড়ে দু’টি কনুই টেবিলে রেখে মুফতি আল আজহারির দেকে একটু তাকিয়ে মৃদু হেসে আহমদ মুসা বলল, জনাব আমিন এ সামান্য ধরনের নেশাকেও ভালো চোখে দেখেন না। তবু রক্ষে যে আজ আপানাকে একজন সাথী হিসেবে পাওয়া গেল। এ অভ্যেস আপনার কত দিনের?
 
শুধু আমিন আল আজহারিই নয়, আবু বকর সেনৌসি, আবদুর রহমান এবং মওলানা ফারুকসহ সকলেই আহমদ মুসার জলজ্যান্ত মিথ্যা কথা আর এ অস্বাভাবিক ব্যবহার বিস্ময়ে বোবা হয়ে গেছে। আহমদ মুসা সিগারেট খায় না এটা সকলেই জানে। আহমদ মুসার এটি ছেলেমি না কোন বিশেষ অভিনয়? এ ধরনের ছেলেমি করার মতো লোক তো আহমদ মুসা নয়। তাহলে … সকলের চোখে একরাশ বিস্ময়ভরা প্রশ্ন।
 
আহমদ মুসার কথায় চুগতাইকে একটু খুশী মনে হল। যেন এক খন্ড মেঘ তার মুখের উপর থেকে সরে গেল। মুফতি আমিন আল আজহারির দিকে একটু চোরা দৃষ্টিতে চেয়ে সকৌতুকে নিচু গলায় বলল, এ বদ অভ্যেসটি আমার ছোট বেলার। বন্ধুদের সংসর্গ দোষও বলতে পারেন একে।
 
আহমদ মুসা হেসে বলল, বন্ধুরা অনেক উপকারও করেছে আপনার। তা না হলে দেশের সেরা ফুটবল খেলোয়াড় কি হতে পারতেন আপনি।
 
-ভালো দিকগুলো অস্বীকার আমিও করি না। হেসে বলল চুগতাই। আহমদ মুসা আবার শুরু করল, আমার মনে হয় কি জানেন, আপনি চেষ্টা করলে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মল্লযোদ্ধা হতে পারতেন। এ প্রচেষ্টা ছেড়ে দিলেন কেন?
 
হঠাৎ চুগতাই এ চোখ মুখ তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল। কি যেন বুঝতে চেষ্টা করল। মুহূর্তকাল পরে শান্ত কন্ঠে বলল, কিন্তু আপনি এ সব প্রশ্ন করছেন কেন?
 
আহমদ মুসা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, মোস্তফা আমিন চুগতাই -এ সাথে আপনাকে মিলিয়ে নিতে চেষ্টা করছিলাম। আমিন চুগতাই এর ডসিয়ার থেকে জানি, উনি জীবনে ফুটবলে পা রাখেননি। আর সত্যিই একজন শ্রেষ্ঠ মল্লযোদ্ধা তিনি। অথচ আপনি …….।
 
আহমদ মুসার কথা শেষ হবার আগেই স্প্রীং এর মত ছিটকে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল চুগতাই। কিন্তু দেরী হয়ে গেছে তখন। আহমদ মুসার ছয়ঘরা রিভলভারের চকচকে নল স্থির লক্ষ্যে চেয়ে আছে চুগতাই এর দিকে।
 
আহমদ মুসার গম্ভীর কণ্ঠ ভেসে এল, পকেট থেকে হাত বের করে নিন। মৃত্যু না চাইলে আত্মসর্পণ কারাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
 
-মৃত্যুকে আমি ভয় করি না মুসা। কিন্তু তোমরা জীবিত থাক তাও আমার কাম্য নয়। বলে সে বিদ্যুৎ বেগে পকেট থেকে হাত বের করল, হাতে ডিম্বাকৃতির একটি গ্রেনেড।
 
বিমূঢ় হয়ে পড়েছে সবাই ঘটনার এ অবিশ্বাস্য আকস্মিকতায়। বেপরোয়া ঐ লোকটির দিকে তাকিয়ে শিউরে উঠল সবাই। তারা জানে হাতের ঐ বিশেষ হ্যান্ডে গ্রেনেডটি দিয়ে শুধু গুহার এ কয়জন মানুষই নয়, পাহাড়ের একটি অংশ সহজেই উড়িয়ে দেয়া যাবে।
 
কিন্তু গ্রেনেডটি ছুড়বার অবসর পেল না চুগতাই। আহমদ মুসার রিভলভার নিঃশব্দে একরাশ ধুম্র উদগিরণ করল। হ্যান্ডে গ্রেনেডটি হাতেই রইল, টেবিলের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল চুগতাই – এর দেহ। ঠিক এ সময় দরজা ঠেলে প্রবেশ করল আলী এফেন্দি এবং তার সাথে সাথে মোস্তফা আমিন চুগতাই। ওদের দিকে তাকিয়ে একমাত্র আহমদ মুসা ছাড়া সকলের মুখ বিস্ময়ে হা হয়ে উঠল।
 
গত একরাত একদিনের কাহিনী শেষ করে চুপ করল মেজর জেনারেল আলী এফেন্দি। একটি গোল টেবিল ঘিরে সবাই বসে আছে নির্বাক হয়ে।
 
কথা বলল আহমদ মুসা প্রথম। বলল, পরশু দুপুরেই ইস্তাম্বুল গেছে হাসান তারিক। অথচ এত অল্প সময়ের মধ্যে হাসান তারিকের আটক থেকে শুরু করে মোস্তফা আমিনের কিডন্যাপ, একজন ইহুদি স্পাইকে নিখুঁত প্লাষ্টিক অপারেশন দ্বারা মোস্তফা আমিন চুগতাই এর পরিবর্তন কেমন করে সম্ভব হল? তাহলে আমাদের আজকের এ অধিবেশনের কথা এবং মোস্তফা আমিন চুগতাই এ এখানে যোগদানের কথা কি ওরা আগেই জানতে পেরেছিল?
 
আলী এফেন্দি বলল, যতদূর জানতে পেরেছি WRF এবং ‘মোসাদে’র সম্মিলিত তৎপরতায় এটা সম্ভব হয়েছে। টার্কিস সিক্রেট সার্ভিস জানিয়েছে, গতকাল তুরস্ক ইরাক সীমান্ত থেকে একটি কফিন ইরান দিয়ে কাস্পীয়ান সাগরে অপেক্ষমান একটি সাবমেরিনে উঠেছে। সে কফিনের আবরণে যদি হাসান তারিককে পাচার করা হয়ে থাকে, তাহলে বলা যায়, আমাদের এ অধিবেশন সংক্রান্ত সকল খবর ও তথ্য দিয়ে ডজঋ ‘মোসাদ’কে সাহায্য করেছে, বিনিময়ে ‘‘মোসাদ’’ হাসান তারিককে তাদের হাতে তুলে দিয়েছে।
 
-WRF এর এ তৎপরতার কথা আরও সূত্র থেকে আমরা জানতে পেরেছি। কিন্তু বুঝতে পারছি না হাসান তারিকের উপর WRF এর এ বিশেষ আগ্রহ কেন? বলল আহমদ মুসা।
 
একটু চিন্তা করে আলি এফেন্দি বলল, আপনার নিশ্চয় মনে আছে, দু’ বছর আগে জর্দানে বিদেশী কূটনীতিক মার্থাল খিরভ গুপ্তচর বৃত্তির দায়ে ধরা পড়েছিলেন। একমাত্র হাসান তারিকের কৃতিত্বেই দলিল দস্তাবেজসহ খিরভ হাতে নাতে ধরা পড়ে এবং সে দুর্ঘটনার সময় বিশ্বব্যাপী বহু আলোচিত দুর্ধর্ষ গোয়েন্দা কূটনীতিক ব্রিগেডিয়ার ক্লিমোভিচ হাসান তারিকের গুলিতেই নিহত হয়েছিল। আমার মনে হয় হাসান তারিকের উপর তারই প্রতিশোধ নিতে এসেছে বেসরকারী আন্তর্জাতিক কম্যুনিষ্ট সন্ত্রাসবাদী সংস্থা WRF। খিরভ ও ক্লিমোভিচ উভয়েই যে এ বেসরকারী কম্যুনিষ্ট সংগঠন WRF এরও সদস্য ছিল, তা আমরা আজ নিঃসন্দেহে ধরে নিতে পারি।
 
আলী এফেন্দি থামল। ধীরে ধীরে মুখ তুলল আহমদ মুসা। মনে হল চিন্তার কোন অতল থেকে জেগে উঠল সে। বলল ধীরে ধীরে, ক্লিমোভিচকে অনুসরণ করে তার গোপন আড্ডার হানা দিয়ে একটি পরিকল্পনার দুর্বোধ্য নক্সা পেয়েছিল হাসান তারিক। কিন্তু নক্সাটি হাসান তারিক রাখতে পারেনি। সে দিনই গভীর রাতে আক্রান্ত হয়েছিল সে। ক্লিমোভিচের লাশ পেছনে রেখে তারা নক্সাটি নিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল। কিছুক্ষণ থামলো আহমদ মুসা। আবার শুরু করল সে, পরিকল্পনার মূল কপি আমাদের কাছে না তাকলেও এর একটি ফটো কটি আমাদের কাছে আছে। এ কথা ওরা জানে কিনা জানি না, তবে আমার মনে হয় যদি প্রতিশোধ গ্রহণই WRF এর লক্ষ্য হত, তাহলে হাসান তারিককে ধরে না নিয়ে গিয়ে হত্যা করতে পারত। কিন্তু তা তারা করেনি। এ থেকে প্রমাণ হয়, পরিকল্পনার নক্সা সম্পর্কে হাসান তারিককে তারা জিজ্ঞাসাবাদ করতে চায়। হাসান তারিক পরিকল্পনার কতদূর জেনেছে, আর কেউ এর কোন কিছু জানতে পেরেছে কিনা, ইত্যাদি জেনে না নেয়া পর্যন্ত তারা হাসান তারিককে কিছুতেই হত্যা করবে না।
 
-পরিকল্পনা কি সম্পর্কিত এবং আপনারা কি জানতে পেরেছেন তা থেকে? উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞাসা করে মোস্তফা আমিন।
 
-পরিকল্পনাটির অর্থ আজও আমাদের কাছে পরিস্কার নয়। মধ্য এশিয়ার মুসলিম দেশগুলো থেকে আফ্রিকার মুসলিম অধ্যুষিত তানজানিয়া এবং মরক্কো থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত অধ্যুষিত মুসলিম বিশ্বের মানচিত্র। এর মাঝে অসংখ্য সাংকেতিক চিহ্ন এবং লাল ও কালো রেখার অসংখ্য সারি। সাম্প্রতিক ঘটনা থেকে নিঃসন্দেহে আমরা বুঝতে পারছি, পরিকল্পনাটি আসলে WRF এর এবং তা যদি হয়, এর অর্থ আমাদের কাছে পরিস্কার, সমগ্র মুসলিম বিশ্ব জুড়ে ওরা চক্রান্তের জাল বিছিয়ে রেখেছে। পরিকল্পনাটির নক্সাটি নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে আমাদের। কিন্তু তার আগে হাসান তারিক সম্বন্ধে আমাদের … কথা শেষ হলো না আহমদ মুসার। ঘরে পাথরের দেয়ালে এক বিশেষ স্থানে লাল সংকেত জ্বলে উঠল। আহমদ মুসা সেদিকে তাকিয়ে বলল, আকাশে নিশ্চয় কোথাও হানাদার ইসরাইলী বিমান দেখা গেছে। আমাদের রাডারের সংকেত ওটা। আসুন বলে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। সবাই উঠে এল ছাদে। পশ্চিম আকাশ তখন লাল হয়ে উঠেছে।
 
জর্দান নদীর ওপারে বোমা ফেলেছে ইহুদিরা নিশ্চয়। বলল আহমদ মুসা।
 
ঘড়ি দেখে আব্দুর রশিদ বলল, আজ রাত ১২ টায় আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ইউনিট জেরুজালেমের তিন মাইল পশ্চিমে নতুন ইসরাইল ঘাঁটি আক্রমণ করেছে। মনে হয় তার দায়িত্ব পালন করে ইতিমধ্যেই নদীর ওপারে ফিরে এসেছে। ইসরাইলী বিমানগুলো মনে হয় তাদেরকেই তাড়া করে এসেছে। এসময় রাডার পর্যবেক্ষক আবদুল্লাহ মাসুদ এসে জানাল, জর্দান নদীর আড়াই মাইল পশ্চিমে আরব পল্লীর উপর বোমা ফেলেছে ইসরাইলীরা। সবাই চোখ ফিরাল লাল হয়ে ওঠা দিগন্তের দিকে। ঐ লাল আগুন কত অসংখ্য নারী পুরুষ আর অসহায় শিশুর রক্ত চুষে নিল কে জানে। কারো মুখে কোন কথা জাগলো না। বোধ হয় সবার মনে একই প্রশ্নঃ এ অগ্নি পরীক্ষা আর কতদিন চলবে? এ কোরবানীর শেষ হবে কবে?
 
= ৪ =
রাতের তেলআবিব। রাস্তার জন সমাগম কমে গেছে। পিচ ঢালা কালো মসৃণ রাস্তা। পাশে সরকারী বিজলি বাতিগুলো আলো আঁধারীর সৃষ্টি করেছে। বাতাস গায়ে লাগে না, কিন্তু কেমন যেন একটু ঠান্ডার আমেজ অনুভূত হয়। সাগর ভেজা বাতাসের স্বাদ এতে অনেকটা। এ বাতাসে নরম ঘুমের পরশ অনুভব করা যায়।
 
এক অভিজাত আবাসিক এলাকা। কদাচিত দু’একটি বাড়ির জানালা দিয়ে আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে। এ এলাকার রাস্তায় লোকের চলাচল প্রায় নেই বললেই চলে। ডি,বি, রোড। মাঝে মাঝে দু’একটা গাড়ী চোখ ধাঁধিয়ে তীব্র গতিতে ছুটে চলে যাচ্ছে। ডি,বি, রোড থেকে একটা ছোট রাস্তা বেরিয়ে কিছু দক্ষিণে গিয়ে শেষ হয়েছে। রাস্তাটি যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানে সুন্দর একাট দু’তালা বাড়ী।
 
দূরের কোন একটি পেটা গড়িতে ঢং ঢং করে ১২টা বেজে গেল। ধীরে ধীরে একটা কালো রং এর গাড়ী এসে অন্ধকারে দাঁড়ানো বাড়ীটির গেটে এসে থামল। কালো পোশাক দেহ ঢাকা এক ছায়ামূর্তি গাড়ী থেকে নেমে এল।
 
ঠক্ ঠক্ ঠক্। বন্ধ জানালার শক্ত কবাটে ধীরে ধীরে তিনটি শব্দ হল।
 
ছায়ামূর্তিটি বাড়ীটির সম্মুখের বাগানটি পেরিয়ে নীচের তলার একটি বন্ধ জানালার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
 
কিছুক্ষণ চুপচাপ। ছায়ামূর্তিটির তর্জ্জনী আবার শব্দ করল বন্ধ জানালার গায়ে – ঠক্ ঠক্ ঠক্।
 
ধীরে ধীরে এবার জানালার একটি পাল্লা খুলে গেল ভিতরে জমাট অন্ধকার। অন্ধকারের ভিতর থেকে একটি হাত বেরিয়ে এল, ছায়ামূর্তিটি সে হাতে তুলে দিল ভাজ করা এক টুকরো কাগজ। সঙ্গে সঙ্গে জানালাটি আবার বন্ধ হয়ে গেল। জানালাটি বন্ধ করে দিয়েই কর্ণেল মাহমুদ দোতলার ব্যালকনিতে উঠে এল। আকাশ থেকে একটি বড় উল্কা পিন্ড খসে পড়ল। মনে হল উল্কাটি যেন সামনের ২২তলা দালানটির ছাদের উপর এসে নামল। ব্যালকনি থেকে ডি,বি, রোড়ের মোড় পর্যন্ত দেখা যায়। মাহমুদ দেখলো কাল গাড়ীটি ছোট রাস্তা পেরিয়ে ডি,বি, রোডে গিয়ে পড়ল। গাড়ীটির পিছনে রক্তাভ আলো দু’টি ক্রমে দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল। মাহমুদ সেখানে থেকে দৃষ্টি ফিরাতে গিয়েও পারল না। দেখল ছোট রাস্তা পেরিয়ে আর একটি গাড়ী গিয়ে ডি,বি, রোডে পড়ল।
 
চমকে উঠল মাহমুদ। বিদ্যুৎ খেলে গেল মনে -অনুসরণ। তর তর করে সে নেমে এল সিঁড়ি দিয়ে। গ্যারেজ থেকে গাড়ী বের করে খোলা দরজা দিয়ে ছুটে বেরিয়ে এল। ডি,বি, রোডে যখন কর্ণেল মাহমুদের গাড়ী বেরিয়ে এল, তখনও দীর্ঘ পথের প্রান্তে অনুসরণকারী গাড়ীটির পিছনের রক্তাভ আলো দেখা যাচ্ছে। কর্ণেল মাহমুদের ছোট্টগাড়ীটি তীব্র গতিতে ছুটে চলল। সামনের অনুসরণকারী গাড়ীটির স্পীড ছিল মাঝারী গোছের। অল্প সময়ের মধ্যেই কর্ণেল মাহমুদের গাড়ীটি অনুসরণকারী গাড়ীটির দুশো গজের মধ্যে এসে পড়ল। কিছুক্ষণ চলার পর সামনের গাড়ীটির স্পীড হঠাৎ বেড়ে গেল। কর্ণেল মাহমুদও তার গাড়ীর স্পীড বাড়িয়ে দিল। মাহমুদ বুঝতে পারল সামনের অনুসরণকারী গাড়ীটি তাকে সন্দেহ করেছে। মাহমুদ ভেবে খুশি হল যে গাড়ীটি হয়তো এবার সামনের সাইমুমের গাড়ীটির অনুসরণ পরিত্যাগ করে অন্য পথ ধরবে। কারণ দু’দিক থেকে আক্রান্ত হওয়ার পরিস্থিতি সে সৃষ্টি হতে দিবে না, কিন্তু অল্পক্ষণেই ভুল ভেঙ্গে গেল মাহমুদের। সে দেখলো সমান গতিতে গাড়ীটি সামনের গাড়ীটির অনুসরণ করে যাচ্ছে। সামনের অনুসরণকারী গাড়ী থেকে মাহমুদরে গাড়ীর দুরত্ব কমপক্ষে দু’শ গজের মত। আর সে গাড়ী থেকে তার সামনের গাড়ীটির দূরত্ব কমপক্ষে একশত গজ। এ সময় গাড়ীর রিয়ারভিউ এ চোখ পড়তেই চমকে উঠল মাহমুদ, দেখলো পিছন থেকে পাশাপাশি জ্বলন্ত চোখের মত দু’টি অগ্নিপিন্ড তার দিকে ছুটে আসছে। মুহূর্তে মাহমুদের কাছে বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে গেল। বুঝতে পারল সামনের অনুসরণকারী ‘মোসাদের’ (ইসরাইলী গোয়েন্দা সংস্থা) গাড়ীটি বেতারে চতুর্দিকে খবর পাঠিয়েছে। পিছনের মত সামনে থেকেও হয়তো অনুরূপভাবে গাড়ী তাদের দিকে ছুটে আসছে। মুহূর্তে তার করণীয় ঠিক করে নিল কর্ণেল মাহমুদ। দেখতে দেখতে গতি নির্দেশক গাড়ীর কাঁটা ৫০ থেকে ৯০ এ গিয়ে পৌঁছল। মোসাদের গাড়ী সাইমুমের যে গাড়ীটি অনুসরণ করছিল, তা একই গতিতে চলছিল। মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই তেলআবিবের সাইমুম প্রধান কর্ণেল মাহমুদরে গাড়ী মোসাদের গাড়ীটির সমান্তরালে গিয়ে পৌঁছল। মাত্র কয়েক সেকেন্ড, কর্ণেল মাহমুদরে গাড়ী থেকে একটি ডিম্বাকৃতি বস্তু তীব্র বেগে ছূটে গিয়ে মোসাদের গাড়ীটিকে আঘাত করল। সঙ্গে সঙ্গে প্রচন্ড বিষ্ফোরণের শব্দ হল। ততক্ষণে কর্ণেল মাহমুদের গাড়ী তার সহকর্মীটির গাড়ীর সমান্তরালে গিয়ে পৌঁছল। কর্ণেল মাহমুদ একবার পিছনে ফিরে দেখল, মোসাদের গাড়ীটিতে আগুন জ্বলছে। পিছনের অনুসরণকারী গাড়ীটিও তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তার মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠলো। কর্ণেল মাহমুদ ও তার সহকর্মীর গাড়ী পাশাপাশি সমান গতিতে এগিয়ে চলছে। সামনেই ভিক্টোরী স্কোয়ার। এখানে পশ্চিম দিক থেকে হায়কল এভিনিউ উত্তর দিক থেকে গোলান রোড এবং পূর্ব থেকে ডি,বি, রোড এসে মিশেছে। হায়কল এভিন্যুকে দক্ষিণ পার্শ্বে এবং গোলান রোডকে পূর্ব পার্শ্বে রেখে ইসরাইলীরা এখানে গড়ে তুলেছে স্বাধীন ও সার্বভৌম ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্টার স্মারক স্তম্ভ। স্মৃতি স্মারক কেন্দ্রটিতে স্মরক স্তম্ভ ছাড়াও আছে সুপরিকল্পিতভাবে সাজান সুন্দর বাগান, বিশ্রামাগার, পাঠাগার এবং জাতীয় ইতিহাসের এক প্রদর্শনী কেন্দ্র। সর্বসাধারণের জন্য এ কেন্দ্রটি সর্বদা উন্মুক্ত থাকে।
 
কর্ণেল মাহমুদের গাড়ী ভিক্টোরী স্কোয়ারে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে তার নজরে জড়ল পশ্চিম দিক থেকে চারটি অগ্নি গোলক ছুটে আসছে। উত্তর দিকে গোলান রোডের দিকে তাকিয়েও একই দৃশ্য নজরে পড়ল কর্ণেল মাহমুদের। কর্ণেল মাহমুদ মুহূর্তের মধ্যে তার কর্তব্য স্থির করে নিল। গাড়ীর ডান দিকের দরজা খুলে চলন্ত গাড়ী থেকে ছিটকে নেমে পড়ল সে। তারপর চোখের নিমিষে ভিক্টোরী স্কোয়ারের পাঁচিল টপকে সে ভিতরে ঢুকে পড়ল। কর্ণেল মাহমুদের চালকহীন গাড়ীটি প্রায় গজ পঞ্ঝাশেক দুরে গিয়ে এক লাইট পোষ্টের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে উন্টে গেল। কিছু দূর গিয়ে কর্ণেল মাহমুদের সহকর্মীর গাড়ীটিও থেমে গেল। ইতিমধ্যে তিন দিক থেকে মোসাদের গাড়ী ভিক্টোরী স্কোয়ারে এসে পড়েছে। এই সময় গাঢ় কাল সামনের রাস্তাঘাট আচ্ছন্ন হয়ে গেল। মোসাদের কুকুরদের কাচকলা দেখিয়ে তার সহকর্মীও সরে পড়তে পেরেছে বলে কর্ণেল মাহমুদ একটি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। কর্ণেল মাহমুদ ভিক্টোরী পার্কের আরও অভ্যন্তরে ঢুকে গেল। সে জানত মোসাদের লোকেরা কিছুক্ষণের মধ্যেই গোটা ভিক্টোরী পার্ক চষে ফেলবে। তার আগেই পার্ক থেকে সরে পড়তে হবে। কর্ণেল মাহমুদ সুইমিং পুলের পাশ দিয়ে উত্তর দিকে এগুচ্ছিল, এমন সময় পাশের বিশ্রামাগার থেকে ধ্বস্তাধ্বস্তি তারপর নারী কন্ঠের চাপা চীৎকার শুনতে পেল সে। দ্রুত সে ওদিকে এগুলো। দেখতে পেল একটি নগ্ন প্রায় নারী দেহের উপর একটি লোক চেপে বসেছে। নারীটি মুক্তি পাবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কিন্তু তার সব চেষ্টাই ব্যর্থ হচ্ছে। কর্ণেল মাহমুদ কক্ষে প্রবেশ করল। পায়ের শব্দ থেকেই লোকটি উঠে দাঁড়িয়েছে। মাহমুদের দিকে নিবদ্ধ চোখ দু’টি তার হিংস্রতায় জ্বলছে। মাহমুদকে লক্ষ্য করে সে বলল, বেরিয়ে যা কুকুর, নইলে… উত্তেজনায় সে কথা শেষ করতে পারল না।
 
মাহমুদ এক নিমিষে লোকটির আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করে বুঝলো লোকটি তৃতীয় কোন অমানুষ। সে শান্ত কন্ঠে বলল, ‘বেরিয়ে যাব কিন্তু তোমাকে নিয়ে।’ লোকটি পকেটে হাত দিতে যাচ্ছিল। মাহমুদ এর অর্থ বুঝে। সে এক লাফে লোকটির নিকটবতী হল। লোকটি পকেট থেকে হাত বের করবার আগেই মাহমুদের প্রচন্ড একটি লাথি গিয়ে তার তলপেটে পড়ল। কোঁথ করে একটি শব্দ বেরুল লোকটির মুখ দিয়ে। তার সাথে গোটা দেহটি তার সামনের দিকে বেঁকে গেল। পর মুহুর্তে আর একটি প্রচন্ড ঘুষি গিয়ে পড়ল লোকটির চোয়ালে। এবার নিঃশব্দে জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। কর্ণেল মাহমুদ এতক্ষণ পরে প্রথমবারের মত মেয়েটির মুখের দিকে তাকাল। মেয়েটি ইতিমধ্যে পোশাক ঠিক করে নিয়েছে। অবিন্যস্ত স্বর্ণাভ চুল কপালের একাংশ ঢেকে রেখেছে। নীল চোখ দু’টি থেকে আতংকের ঘোর তখনও কাটেনি। ইহুদীদের স্বভাবজাত উন্নত নাসিকার নীচে পাতলা রক্তাভ ঠোঁট দু’টি তার কাঁপছে। প্রায় সাড়ে পাঁচ ফুট লম্বা শ্বেত স্বর্ণাভ মেয়েটি অদ্ভুত সুন্দরী। মাহমুদ কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু বাইরে পদশব্দ শুনে সে থেমে গেল। পকেট থেকে রিভলভার বের করে সে দ্রুত দরজার আড়ালে সরে গেল এবং ইঙ্গিতে সে মেয়েটিকে বসে পড়তে বলল, দরজার ফাঁক দিয়ে মাহমুদ দেখলো, দু’জন লোক ঘরের কিছুদূর সামনে দিয়ে সুইমিং পুলের পূর্ব পাশ দিয়ে ঘুরে আবার দক্ষিণ দিকে চলে গেল। মাহমুদ মনে মনে হাসল, সাইমুমের লোক যে ভিক্টোরী পার্কের বিশ্রামাগারে আশ্রয় নিয়ে মোসাদের লোকের হাতে পড়ার মত বোকামী করবে না – ইসরাইলী গোয়েন্দাদের এই স্বাভাবিক বিশ্বাসই তাকে আজ এক অঘটন থেকে বাঁচাল। কর্ণেল মাহমুদ ফিরে দাঁড়িয়ে মেয়েটিকে বলল, দেখনু আমি একটা এ্যাকসিডেন্ট করেছি, ‘পুলিশের লোক আমার পিছু নিয়েছে, আমাকে এখনই সরে পড়তে হবে। আপনি পুলিশের সাহায্যে বাড়ী ফিরতে পারেন।’ বলে মাহমুদ বাইরের দিকে পা বাড়াতে যাচ্ছিল।
 
মেয়েটি ডাকল,শুনুন।
 
মাহমুদ ফিরে দাঁড়াল। মেয়েটি বলল, বাগানে আমার গাড়ী আছে। চলুন গাড়ীতে যাবেন। মাহমুদ বলল, এখন এখান থেকে গাড়ীতে যাওয়া আমার পক্ষে নিরাপদ নয়। তাহলে আমাকে পৌঁছে না দিয়ে আপনি যেতে পারেন কেমন করে? গাড়ী নিয়ে যাবেন, কোন বিপদ আপনার হবে না। কোন বিপদের ভয় না করেই তো হোটেল থেকে বাড়ীতে পথে বেরিয়ে ছিলাম, কিন্তু বিপদ তো হল। একটু থেমে মেয়েটি বলল,আমার সঙ্গে গাড়ীতে চুলন। আমি নিশ্চিত আশ্বাস দিতে পারি, পুলিশের লোক আমার গাড়ী সার্চ করবে না। দু’জন ঘর থেকে বেরুল। বাগানের এক অন্ধকার কোণে রাখা গাড়ী নিয়ে তারা খোলা গেট দিয়ে রাস্তায় বেরুল।
 
গাড়ী পূর্ণ গতিতে গোলান রোড ধরে উত্তর দিকে এগিয়ে চলল। দু’জনেই চুপচাপ। মাহমুদ তখন অন্য চিন্তা করছে। তাকে দেওয়া চিরকুটটি সে এখন ও পড়তে পারেনি। তাতে জরুরী কোন নির্দেশ থাকলে গুরুত্বপূর্ণ সময় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
 
গাড়ী চালানোর ফাঁকে মেয়েটি ইতিমধ্যে কয়েকবার মাহমুদের দিকে তাকিয়েছে। সুন্দর শান্ত দর্শন লোকটির অদ্ভুত বলিষ্ঠ গড়ন। ঐ শান্ত দর্শন দেহে যে অবিশ্বাস্য রকমের সাহস ও বিদ্যুৎ গতি রয়েছে, তা সে নিজ চোখেই দেখেছে। চোখ মুখ থেকে প্রতিভা তার যেন ঠিকরে পড়ছে। সবচেয়ে আশ্চর্য মাহমুদের নির্বিকার ভাব।
 
নির্জন রাজ পথের উপর দিয়ে তীর বেগে গাড়ী এগিয়ে যাচ্ছে। সামনে একটি মোড়। গাড়ী থামানোর লাল সংকেত জ্বলে উঠল। সাদা পোশাকধারী পুলিশ হাত উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। গাড়ী তার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। মেয়েটি গাড়ী থেকে মুখ বের করল। সে কিছু বলার আগেই পুলিশ স্যালূট দিয়ে গাড়ীর সামনে থেকে সরে দাঁড়াল। গাড়ী আবার ছুটে চলল। মেয়েটি এবার মুখে একটু হাসি টেনে কর্ণেল মাহমুদের দিকে চেয়ে বলল, কেমন ভয় পাননি তো?
 
মাহমুদ বুঝলো মেয়েটি সরকারী মহলে শুধু সুপরিচিতাই নয়, সম্মানিতাও। উত্তরে বলল, বেকায়াদায় পড়লে ভয় না পায় কে?
 
মাহমুদ আবার চুপচাপ। গড়ীর বাইরে আলো আঁধারের খেলা। নির্জন রাতের নিঃশব্দ পরিবেশের মধ্যে মৃদু স্পন্দন তুলে এগিয়ে চলছে গাড়ী। মেয়েটি স্টিয়ারিং হুইলে হাত রেখে সামনে তাকিয়ে আছে। মনে তার চিন্তার ঝড় পাশে বসা এই লোকটি কে? টাকা, প্রশংসা ও সুন্দরী নারীদেহের প্রতি লোভ মানুষের চিরন্তন। এই লোকটি কি সব কিছুর উর্ধ্বে? এতক্ষণের মধ্যে লোকটি তার পরিচয় এমন কি নামটি পর্যন্ত জিজ্ঞেস করেনি। ডেভিড বেনগুরিয়ানের সুন্দরী মেয়ে এমিলিয়া কোন যুবকের মনে আগ্রহ সৃষ্টি করতে পারে না – এমন কথা অবিশ্বাস্য। শুনেছি, অর্থ সুনাম ও নারীদেহের মোহ যে কাটিয়ে উঠতে পারে, সে লোক অতি মানব। মেয়েটি আবার মাহমুদের দিকে তাকায়। সেই প্রশান্ত মুখ, সামনে প্রসারিত সেই অচঞ্চল দৃষ্টি।
 
গাড়ী এসে এক বিরাট প্রাসাদ তুল্য বাড়ীর ফটকে দাঁড়াল। বাড়ী দেখে মাহমুদ চমকে উঠল। এ যে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী এবং ইসরাইলী রাষ্ট্রের অন্যতম কর্ণধার ডেভিড বেনগুরিয়ানের বাড়ী। মেয়েটি সাম্পর্কে মাহমুদের মনে নতুন আগ্রহের সৃষ্টি হল। মুহুর্তের জন্য মেয়েটির দিকে মাহমুদ তার চোখ দু’টি তুলে ধরল। মেয়েটি কি তাহলে ডেভিড বেনগুরিয়ানের কেউ? সরকারী মহলে সম্মানিতা হবার কারণ তাহলে কি এইটিই? মাহমুদকে তাকাতে দেখে মেয়েটি বলল, বাড়ী এসে গেছি?
 
বাড়ীর ফটক খুলে গেল। মাহমুদ কিছু বলার আগেই ছুটে গিয়ে গাড়ী বারান্দায় দাঁড়াল।
 
মেয়েটি গাড়ী থেকে নেমেই গাড়ীর পাশ ঘুরে এসে দরজা খুলে দিল।
 
মাহমুদ গাড়ী থেকে বেরিয়ে মেয়েটির দিকে আর এক পলক তাকিয়ে মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে বলল, এবার আসি।
 
মাহমুদ যাবার উদ্যোগ করতেই মেয়েটি পথ আগলে দাঁড়িয়ে বলল, দয়া করে একটু বসবেন, অন্ততঃ এক কাপ চা খাবেন চলুন। আমার জরুরী কাজ আছে, ক্ষমা করুন আমাকে। বলল মাহমুদ।
 
মেয়েটি এক মুহূর্ত থামল। তারপর ধীরে গম্ভির কন্ঠে বলল, আপনি যে উপকার আমার করেছেন সে ঋণ অপরিশোধ্য। কৃতজ্ঞতা প্রকাশের … মাহমুদ বাধা দিয়ে বলল, মানুষের প্রতি মানুষের যে দায়িত্ব, তার বেশিকিছু আমি করিনি। বলেই মাহমুদ গেটের দিকে পা বাড়াল।
 
– শুনুন, আপনার পরিচয় দয়া করে কি বলবেন? মেয়েটির কন্ঠে এবার অনুনয়ের সুর।
 
মাহমুদ ফিরে দাঁড়িয়ে একটু হেসে বলল, আমরা সামান্য ব্যক্তি, দিবার মত কোন পরিচয় আমাদের নেই। তবে বেঁচে থাকলে দেখা হবে, এখন আসি।
 
ডেভিড বেনগুরিয়ানের গেট পেরুবার আগেই মাহমুদ একবার ঘড়ির দিকে তাকাল। রাত ১ টা। মাহমুদের মন আনচান করে উঠল। কিছুক্ষণ আগের পাওয়া চিঠিটি তার এখনও পড়া হয়নি। জরুরী কোন সংবাদ বা নির্দেশ তাতে থাকতে পারে। চলতে চলতেই মাহমুদ বাম পকেট থেকে চিঠিটি বের করে একবার তাতে চোখ বলাল। সাইমুমের সাংকেতিক অহ্মরে লেখাঃ
 
“আগামী সতের তারিখে ওসেয়ান কিং জাহাজে ইসরাইলের জন্য ইউরেনিয়াম, হেভিওয়াটার ও অন্যান্য আনবিক গবেষণার বহু মূল্যবান মাল মসলা আসছে। জাহাজটি রাত নয়টায় জাফা বন্দরে ভিড়বে। রাত এগারটায় জাহাজে প্রীতিভোজের অনুষ্ঠান।’’
 
চিঠি পড়ে মাহমুদ মনে মনে তারিখ গুনল। আজ পনের তারিখ, হাতে সময় মাত্র দু’দিন। মাহমুদ গেটে আসতেই গেটম্যান গেট খুলে দিয়ে স্যালুট করে দাঁড়াল।
 
= ৫ =
সূর্য তখনো উঠেনি। রক্তিম পূর্বাকাশ। মাহমুদ কোরআন পড়া শেষ করে উঠে দাঁড়াল। তারপর ড্রেসিং রুমে প্রবেশ করে, কিছুক্ষণ পর ধনী ইহুদী ব্যবসায়ীর সাজ পরে বেরিয়ে এল এবং পশ্চিমের ব্যালকনিতে ইজি চেয়ারে গিয়ে শুয়ে পড়ল।
 
জাফা বন্দরে মাহমুদের এটি একটি নতুন আস্তানা ভূমধ্যসাগরের তীরে পাঁচতলা এই বাড়ী। ইজি চেয়ারে অর্ধশায়ীত মাহমুদ পলকহীন দৃষ্টিতে ভূমধ্যসাগরের নীল জলরাশির দিকে চেয়ে ছিল। দূরে পশ্চিম দিগন্তে একটি জাহাজের চিমনি দেখা যাচ্ছিল। ধীরে ধীরে পশ্চিম দিগন্তে তা মিলিয়ে গেল। জাহাজটির সাথে যেন মাহমুদের মনটিও ছুটে গেল দীগন্ত পেরিয়ে জীব্রালটার অতিক্রম করে। জিব্রালটার – জাবালুৎ তারিকের কথা মনে পড়তেই মাহমুদের মন ছুটে গেল চৌদ্দ শ’ বছর আগের একটি ঘটনার দিকে। সিপাহসালার তারিক সাতশ’ সৈন্য নিয়ে শত্রু অধ্যুষিত স্পেনের মাটিতে নামলেন। তারপর পুড়িয়ে দিলেন ফেরবার একমাত্র উপায় নৌযানগুলো। তাদের সামনে রইল সুসজ্জিত অগণিত শত্রু সৈন্য আর পেছনে তরঙ্গ – বিক্ষুব্ধ সমুদ্র। আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় সম্পর্কে কি দৃঢ় প্রত্যয়। মুসলিম সিপাহসালার তারিকের এ আত্মপ্রত্যয় অবাস্তব ছিল না। শীঘ্রই সত্য ও ন্যায়ের প্রতীক মুসলমানদের হেলালী নিশান স্পেনের সীমানা পেরিয়ে ফ্রান্সের প্রান্তদেশ পারেনিজ পর্বতমালার বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ইসলামের জয় বার্তা ঘোষনা করল। শুধু কি তাই? মুসা আর তারিককে যদি দামেস্কের দরবারে ফিরিয়ে না আনা হতো, তাহলে ‘ওয়াশিংটন আরভিং এর ভাষায়, ‘‘আজ প্যারিস ও লন্ডনের গীর্জাসমূহে ক্রসের বদলে হেলালী নিশানই শোভা পেত।’’ এই ভূমধ্যসাগরের প্রতিটি ইঞ্চি স্থানে একদিন মুসলমানদেরই হুকুম চলত। কিন্তু আজ? মাহমুদের মন বেদনায় ভরে যায়, যে স্পেনকে মুসলমানরা আট শত বছর ধরে গড়ে তুলল আপন করে, সেই স্পেনে আজ মুসলমানদের সাক্ষাত মিলে না। তারা বিধ্বস্ত ও বিতাড়িত। কিন্তু কেন এই পতন? ইতিহাস মুসলমানদের দুর্বলতা আত্মকলহকেই এর জন্য দায়ী করেছে। কিন্তু এই আত্মকলহ আর দুর্বলতা এল কোত্থেকে? সে কি আদর্শচ্যুতি থেকে নয়? মাহমুদের মনে পড়ে যায় একজন লেখকের কথা, ‘‘মুসলমানরা আপন উসূল এবং ইসলামী জোশ হতে যখন দূরে সরে পড়ল, তখন খোদা তাদের এ নিয়ামত কেড়ে নিলেন। এরই ফলে আবার একদিন খৃষ্টান শক্তি সেই বিজয়ী মুসলমানদের উত্তরাধিকারীদেরকে এসব দেশ হতে এমনই ভবে বের করে দিল যে, সে সব দেশের মুসলমানদের নামের আর কোন চিহ্নই থাকল না।’’ পূর্বসুরীদের ভুল কি আমরা শুধরে উঠতে পেরেছি? মাহমুদ ভেবে চলে। যদি পারতাম, তাহলে ক্ষুদ্র ইসরাইলের হাতে এমন করে আমরা মার খাব কেন? আফ্রিকা আর এশিয়ার বিভিন্ন দেশে মুসলমানরা এমনই করে নির্যাতীতই বা হতে থাকবে কেন? মধ্য এশিয়া, ফিলিপাইন, সাইপ্রাস, ইরিত্রিয়া, চাঁদ, নাইজেরিয়া, মোজাম্বিক প্রভৃতি দেশের মজলুম মানুষের আমানুষিক দুর্দশা মাহমুদের মনকে ভারি করে তুলে। প্রশ্ন জাগে তার মনে, এদের মুক্তি কত দূরে? মুসলিম তরুণরা কি জাগবে না? তারা কি এগিয়ে আসবে না মজলুম মানুষের মুক্তির জন্য? আমাদের চেষ্টা কি বৃথা যাবে?
 
এই সময় ধীর পায়ে নাস্তা নিয়ে সেখানে প্রবেশ করল আফজল। আফজল এই বাড়ীর প্রহরী, দারোয়ান, রাধুনী, পরিবেশক সবকিছু। পায়ের শব্দে মাহমুদের চিন্তা সূত্র ছিন্ন হয়ে গেল। মাহমুদ পিছনে ফিরে আফজলকে দেখে মৃদু হেসে বলল, আজকে নাস্তা খুব সকাল সকাল মনে হচ্ছে না?
 
-সকালেই তো জনাবের কোথাও বেরুবার কথা ছিল।
 
মাহমুদের মনে পড়ে গেল, আগামীকালের ‘ওসেয়ান কিং’ জাহাজের প্রোগ্রামের ব্যাপারে অনেক কাজ আছে বাইরে। যেমন করে হোক সহজ উপায়ে ওসেয়ান কিং জাহাজের ভোজসভায় প্রবেশের একটি পথ করে নিতেই হবে। গভীর রাত পর্যন্ত মাহমুদ এইবষয় নিয়ে চিন্তা করছে, কোন সহজ পথ সে খুঁজে পায়নি। হঠাৎ এ সময় এমিলিয়ার কতা মনে পড়ে গেল মাহমুদের। ওসেয়ান কিঙ জাহাজের প্রীতিভোজে কাদের নিমন্ত্রণ করা হবে? সে প্রীতিভোজ থেকে ডেভিড বেনগুরিয়ানের পরিবার কি বাদ পড়তে পারে? মাহামুদের মনটা প্রসন্ন হয়ে উঠল। নাস্তা শেষ করে মাহমুদ আফজলকে বলল, এখন আর বাইরে যাচ্ছি না, তুমি ডিকশনারীটা বের কর। ডিকশনারী ডসিয়ারের ছদ্মনাম। নাস্তা শেষ করে রুমালে মুখ মুছতে মুছতে সে উঠে দাঁড়াল। প্রবেশ করল তার ষ্টাডি রূমে।
 
ডসিয়ারের পাতা উলটিয়ে বের করল এমিলিয়ার নাম। তার পুরো নাম ‘পলিন ফ্রেডম্যান’ এমিলিয়ার অভ্যেস আচরণ সম্পর্কে বিবরণীকার লিখেছেন, উঁচু মহলে অবাধ গতি। অত্যন্ত মিশুক। কিন্তু আত্মমর্যাদা সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতেন। মুক্তি ও সৌন্দর্যের পূজারী। গোঁড়া জাতীয়তাবাদীদের সাথে তার কোন মিল নেই। … হোটেল বারগুলো তার কাছে ড্রইং রুমের মতো। সাগর বেলার দি মিষ্টী হোটেলে তাকে রাত ৯ টার পরে প্রায় প্রতিদিনই দেখা যায় ’’।
 
মাহমুদ ডসিয়ারের পাতা বন্ধ করল। মনে মনে বলল, খোদা সহায় হলে আজ দি মিষ্টীতে আবার এমিলিয়ার সাথে দেখা হবে। রাত ন’টা। দি মিষ্টী’র বলরুম। বিরাট হলঘর। অর্ধেক চেয়ার টেবিল এখনও খালি পড়ে আছে। দরজা থেকে পরিস্কার চোখে পড়ে এমন একটি চেয়ারে মাহমুদ বসে আছে। এমিলিয়া তখনো আসেনি। মাহমুদের স্বভাব শান্ত মনে কোন চাঞ্চল্য নেই বটে, কিন্তু মনে তার প্রশ্ন জাগছে, সে আসবে কি?
 
অবশেষে পরম লগ্নটি এল। বলরুমের দরজায় এসে মুহূর্তের জন্য দাঁড়াল এমিলিয়া। লাল পোশাকে এমিলিয়াকে অদ্ভুত সুন্দরী মনে হচ্ছে। মাহমুদ চোখ সরিয়ে নিল। ইচ্ছা মাহমুদের আগ্রহ যাতে প্রকাশ না হয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ পরে চোখ তুলে মাহমুদ দেখল, কয়েক টেবিল সামনে একটি খালি টেবিলে এমিলিয়া  এসে বসেছে। এমিলিয়ার দিকে তাকাতে গিয়ে হঠাৎ তার সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল। চোখাচোখি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্প্রিং এর মতো এমিলিয়া উঠে দাঁড়াল। মাহমুদ ঈষৎ হেসে উঠে দাঁড়াল। এমিলিয়া মাহমুদের পাশে এসে বলল কেমন আছেন? আপনাকে দেখে যে কতো খুশি হয়েছি তা বোঝাতে পাবো না। বলে মাহমুদের সামনের চেয়ারে এমিলিয়া বসে পড়ল। বলল, আপনার টেবিলে একটু বসতে পারি?
 
-এ ধরনের বৃটিশ এটিকেট কিন্তু কোন কোন ক্ষেত্রে খুবই খারাপ, অভদ্রতা সূচক।
 
-যেমন? এমিলিয়া ঈষৎ হেসে বলল।
 
-যেমন আমাদের এই ক্ষেত্রে। ‘আপনার টেবিলে কি একটু বসতে পারি’ বললে কি আপনি খুশি হতেন? বিশেষ করে সম্পর্ক যেখানে ঘণিষ্ঠতর সেখানে … … মৃদু হেসে কথা অসম্পূর্ণ রেখে মাহমুদ চুপ করল।
 
-সত্যই তাই। এ ধরনের ফর্মালিটি আমার কাছে খুবই পীড়াদায়ক। একটু থেমে এমিলিয়া বলল, কি অর্ডার দেব বলুন, হুইস্কি, জিন, ভারমুখ।
 
-আমি মদ খাই না।
 
-সত্যি? বলে বিস্ময়ের সাখে মাহমুদের দিকে চোখ তুলল এমিলিয়া।
 
-সত্যি। আপনার নিশ্চয় অসুবিধা করলাম।
 
-অসুবিধা নয়। কিন্তু আমি অবাক হচ্ছি। এই সমাজে এটা কম বিস্ময়ের কথা নয়। বলে এমিলিয়া ওয়েটারকে ডেকে দু’বোতল কোকা কোলার অর্ডার দিল। মনে হল পরিচিত ওয়েটার কিছুটা বিস্মিত হলো। ওয়েটার চলে গেলে মাহমুদ বলল, ‘বোধ হয় আজকের সন্ধ্যা আপনার আমি নষ্ট করলাম।’
 
-কৃত্রিম আনন্দের উৎসের চেয়ে অকৃত্রিম আনন্দের উৎসই কি বেশী সুখকর নয়? মুখ টিপে হেসে বলল এমিলিয়া।
 
-উৎসটি যদি অকৃত্রিম হয় তবেই।
 
-উৎসটিতে যেহেতু কৃত্রিমতা নেই, তাই ওকথা নিঃসন্দেহেই বলা যায়।
 
-না পরখ করেই কি এত বড় সার্টিফিকেট দেয়া চলে
 
-পরখ করতে কত সময় লাগে বলুন?
 
ইতিমধ্যে ওয়েটার দু’বোতল কোকো কোলা এনে দিল। কোকা কোলা পান করতে করতে তাদের অনেক আলাপ হলো মাহমুদ অনুভব করল, মেয়েটির মধ্যে তীব্র আকর্ষণী শক্তি রয়েছে, আর রয়েছে মানুষকে আপন করে নেবার এক অদ্ভুত ক্ষমতা। মাহমুদের মনে পড়েছে ‘ওসেয়ান কিং’ জাহাজের অনুষ্ঠানের কথা কিন্তু প্রাসঙ্গিক কোন আলোচনা না তুলে তা জেনে নেয়া যাবে না। কিন্তু এসব কিছুর পূর্বে মেয়েটির সাথে আরো কিছু ঘনিষ্ঠতর হতে হবে।
 
মাহমুদরা ঠান্ডা পানীয় ছাড়া আর কিছুই খেল না। জিন, হুইস্কি, ভারমুখ প্রভৃতি বিভিন্ন রকমের দামী মদের ফেনিল উচ্ছ্বাসে তখন হল ঘরটি পূর্ণ। প্রায় প্রতিটি টেবিলেই একটি যুগল মুখোমুখি। তাদের প্রকৃত সম্পর্ক কি, তা করো জানার উপায় নেই। কিন্তু যে সম্পর্কই থাক, আজ এ হল ঘরে এ চত্তরে এক সমান হয়ে দাঁড়িয়েছে তারা। তাদের ইচ্ছার সামনে বাধ সাধবার কেউ নেই। ঐ যে সামনের শ্বেতাংগ তরুণ যুগলটি। শ্বেতাংগিণীর ঠোঁটের লিপষ্টিক শ্বেতাংগটির ঠোঁটকে ও রঞ্জিত করেছে। প্রত্যেকের চোখেই আদিম নেশা।
 
এমিলিয়া বলল, এমন সুস্থ চোখে কখনো কোন দিন আমি হল ঘরের এ পরিবেশকে দেখিনি। মদ আমাকে মাতাল করে না বটে, কিন্তু নেশায় কাতিয়ে দেয়।
 
এই সময় হলের উজ্জ্বল আলো নিভে গিয়ে ম্লান নিলাভ আলোতে ভরে গেল হল ঘরটি। হলের কোণের ষ্টেজ থেকে ইংরেজী সুরে বাজনা বেজে উঠল। প্রতিটি যুগল হাত ধরাধরি করে উঠে নাচের জন্য হলের মাঝখানে গিয়ে জমা হতে এমিলিয়া তার ডান হাত মাহমুদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, চলুন।
 
মাহমুদ এমিলিয়ার হাত ধরে উঠে ধরে উঠে দাঁড়াল। এই স্পর্শের জন্যই হোক বা মাহমুদের নৈতিকতা বোধে আঘাত লাগার জন্যই হোক মাহমুদের হাত যেন কেমন কেঁপে উঠল। এই কম্পনই এমিলিয়ার মধ্যে সংক্রামিত হলো। তার দেহের জাগল শিহরণ। মাহমুদের দিকে চেয়ে মুখ টিপে একটু হাসল এমিলিয়া।
 
নাচ শুরু হল। নেচে চলছে সবাই। মাহমুদরাও নাচছে। এমিলিয়ার তপ্ত নিঃশ্বাস মাহমুদের গলায় এসে লাগছে। দু’টি দেহের মধ্যে যে ব্যবধান, তা বেশী কিছু নয় মোটেই। দু’জনেই দু’জনের দেহের উত্তাপ অনুভব করতে পারে। আর মানুষ যদি ফেরেশতা না হয়, তাহলে এ উত্তাপ নারী পুরুষের হৃদয়ে রোমাঞ্চ জাগাবেই। মাহমুদ জানে, মানুষ মানুষই, ফেরেশতা নয়। এ কারণেই আল্লাহ স্বামী-স্ত্রী ছাড়া অন্য নারী পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্ক ও মেলামেশার একটি সীমারেখা নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। সীমারেখাতিক্রম করলে সামাজিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি হবে। মদের টেবিল আর এই বল নাচের মঞ্চ কত স্বামী স্ত্রীর বিচ্ছেদ এবং কত কুমারীর কুমারীত্বের অপকৃত্যুর যে উৎস তার ইয়ত্তা নেই। তবুও এটা চলছে চলবে। মাহমুদের চিন্তা স্রোতে বাধা পড়ল। এমিলিয়া ফিস ফিস করে বলল, তোমাকে কেমন উদাসীন দেখাচ্ছে। কিছু ভাবছ? ভালো লাগছে না বুঝি?
 
মাহমুদ এমিলিয়ার চোখে চোখ রেখে বলল, ভাবছি আজকে আমিই বোধ হয় সবচেয়ে বেশী ভাগ্যবান।
 
-কেন?
 
-ডেভিড বেনগুরিয়ানের নাতনী এমিলিয়াকে আমার চেয়ে নিবিড় করে কে পেয়েছে আজ? এমিলিয়া মাহমুদের কাঁধে মৃদু চাপ দিয়ে বলল, কথাটা কিন্তু সৌজন্যের সীমা ছাড়িয়ে গেল।
 
-মাফ চাচ্ছি।
 
-মাফ চাইলেই বুঝি কথা উঠে গেল?
 
-তাহলে কি করব?
 
-কিছু করার দরকার … এমিলিয়ার কথা শেষ হলো না। বিজলি বাতি নেভে গেল। হল ভরে গেল নিকষ কালো অন্ধকারে। মাহমুদরা থেমে গেছে। বাজনা কিন্তু তখনো বেজে চলেছে। বোঝা গেল এ আলো নিভে যাওয়া অস্বাভাবিক।
 
পরমুহূর্তেই ঘোষকের কণ্ঠ শোনা গেলঃ ভদ্র মহিলা ও ভদ্র মহোদয়গণ, আমরা দুঃখিত যে, যান্ত্রিক গেলিযোগের জন্য আলো নিভে গেছে, এক মিনিটের মধ্যেই আলো ব্যবস্থা হচ্ছে। মনোযোগ নিজের দিকে কেন্দ্রীভূত হতেই মাহমুদ অনুভব করল, এমিলিয়া মাহমুদের বুকে মুখ গুঁজে রয়েছে এবং দু’হাতে জড়িয়ে ধরেছে তাকে। মাহমুদ তার অভিনয়ের এ পর্যায়ে এসে কেঁপে উঠল অপরাধ বোধের এক তীব্র খেলায়।
 
কট করে একটি শব্দ হল, তারপর আলো জ্বলে উঠল আবার। এমিলিয়া আগেই সরে দাঁড়িয়েছিল। মুখ তার আনত, আরক্ত। কিন্তু মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিল। মুখ তুলে হেসে মাহমুদকে বলল, চলুন এবার যাওয়া যাক।
 
দু’জন হাত ধরাধরি করে হোটেল থেকে বেরিয়ে এল। মাহমুদের হাতে মৃদু চাপ দিয়ে বলল এমিলিয়া, কোলাহল ভাল লাগছে না, চলুন পার্কে যাই।
 
-কোন পার্ক?
 
-ভিক্টোরিয়া।
 
গাড়ীতে উঠে মাহমুদ ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ী ষ্টার্ট দিতে দিতে বলল –
 
পার্কটা বড় কুলক্ষণে। এমিলিয়া মাহমুদের কাছে সরে এসে তার কাঁধে মাথাটি হেলান দিয়ে বলল, কিন্তু ঐ পার্কটিতেই তোমার সাথে আমার সাক্ষাত!
 
-তা বঠে। মাহমুদ অনুচ্চ সুরে বলল। তার মনে তখনো ঝড়। ওসেয়ান কিং জাহাজে যাবার উপায় কি? এমিলিয়ারা কি আমন্ত্রিত সেখানে? ওদের সাথে ওখানে প্রবেশের কোন পথ করা যায়? পার্কে এসে তারা একটি ছায়া ঘেরা জায়গা দেখে বসে পড়ল। আকাশে তখন নবমীর চাঁদ। সামনের গাছটিকে আলোকিত করেছে। মাহমুদের কোলে মাথা রেখে এমিলিয়া শুয়ে পড়েছে। মাহমুদের একটি হাত এমিলিয়ার দু’হাতের মুঠোয়।
 
ধীরে ধীরে এমিলিয়া বলল, দানিয়েল। তুমি হয়তো ভাবছ মেয়েটি কি নির্লজ্জ। কিন্তু বিশ্বাস করো তুমি, তুমি আমাকে মাতাল করেছ। মদও কোনদিন আমার আমিত্বকে এমন করে কেড়ে নিতে পারেনি। বল নাচে অংশ নিয়েছি অসংখ্যবার, কিন্তু কোন পুরুষ আমাকে তার বুকে টানতে পারেনি। তুমি কি যাদু জান দানিয়েল?
 
-যাদু নয় এমিলিয়া, নারী পুরুষের স্বাভাবিক আকর্ষণ। বলল মাহমুদ।
 
-আমি এটা মানিনা পুরুষের সাথে অনেক মিশেছি। কিন্তু এমনতো হয়নি। প্রথম সাক্ষাতের দিন থেকেই আমি বারবার হারিয়ে ফেলছি নিজেকে।
 
-এটা হয়তো স্রষ্টার ইচ্ছা এমিলিয়া। বলে কিন্তু মাহমুদ নিজেই চমকে উঠল? একি, এমিলিয়ার জীবনের সাথে সে কি তাহলে জড়িয়ে যাচ্ছে না? চাঁদ আর একটু পশ্চিমে সরে গেল। চাঁদের যে আলোটুকু ছিলো, তা সরে গেল। যতই সময় যাচ্ছে মাহমুদের মন উদ্বেগে ভরে ইঠছে ওসেয়ান কিং জাহাজের ব্যাপারটা নিয়ে। কিভাবে সে কথাটা তুলতে পারে? হঠাৎ মাথায় তার একটা বুদ্ধি খেলে গেল। মাহমুদ কোল থেকে এমিলিয়ার মাথা তুলে নিল। বলল, কাল রাত্রের খানা আমার ওখানে খাবে এমিলিয়া?
 
-তুমি বললে যাবো অবশ্যই। কিন্তু কাল সন্ধ্যায় একটি পার্টি আছে, আব্বা কাল সকালে বিলেতে যাচ্ছেন বলে তিনি যেতে পারছেন না। তাই আমার যাওয়া সেখানে জরুরী ছিল।
 
মাহমুদ বলল -কোথায় পার্টি জানতে পারি কি?
 
-নিশ্চয়ই, ‘ওসেয়ান কিং’ জাহাজে। তুমি বরং চল না দানিয়েল সেখানে আমার সাথে?
 
-মাহমুদের গোটা শরীর শীর শীর করে উঠল। মনে মনে আলহামদু লিল্লাহ উচ্চারণ করল। মুখে বলল, আমি কি সেখানে অনাহূত হব না?
 
-নিশ্চয় না। আব্বা যাচ্ছেন না, মা অসুস্থ। আমি ইচ্ছামত সাথী নিতে পারি। নিমন্ত্রণ পত্রও আছে সে রকম। মাহমুদ মুখটি একটু নিচু করে বলল, ঠিক আছে আমার আপত্তি নেই। এমিলিয়া? কিন্তু আমার ওখানে যাচ্ছ কবে তুমি?
 
-এমিলিয়া মুখটি উঁচু করল। এমিলিয়ার ঈষৎ কম্পনরত ঠোঁট দু’টি মাহমুদের মুখের কাছাকাছি এল। মাহমুদ মুখ উঁচু করল। এমিলিয়া তার মুখটি আবার নামিয়ে নিয়ে বলল, আমি যত কাছে আসছি তুমি তত সরে যাচ্ছ দূরে।
 
-আরো কাছে টানতে চাই হয়তো। বলল মাহমুদ।
 
-আমি জানি দানিয়েল, বুঝি। কিন্তু তোমার চরিত্রের এ পবিত্রতাই আমাকে মুগ্ধ করেছে সবচেয়ে বেশী। এমিলিয়ার কথাগুলি গম্ভীর। দূরের কোন পেটা ঘড়িতে ১২টা বেজে গেল। মাহমুদ বলল, চল আজ উঠা যাক। দু’জনই উঠে দাঁড়াল। এক ঝলক দমকা বাতাস এসে ঝাউ গাছে শোঁ শোঁ শব্দ তুলল। চারিদিক নিঝুম নিস্তব্ধ। মাঝে মাঝে নিঃশব্দে ছুটে চলা মোটর কারের ভেঁপুর নীরবতার মাঝে কম্পন তুলছে শুধু। মাহমুদরা হাত ধরাধরি করে বেরিয়ে এল পার্ক থেকে।
 
= ৬ =
গভীর রাত। মাহমুদ তখনো তার টেবিলে বসে। চারিদিক নিঝুম -নিস্তব্ধ। রাস্তার বিজলি বাতিগুলি চাঁদের আলোয় ফিকে মনে হচ্ছে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে সে। দূরে ভূমধ্যসাগরের জলরাশির উপর চাঁদের এক মায়া রাজ্যের সৃষ্টি করেছে। মাহমুদ সেদিকে তাকিয়ে আছে ঠিকই কিন্তু মনে তার চিন্তার ঝড়। সে মনে মনে ‘ওসেয়ান কিং’ জাহাজের দৃশ্যটা কল্পনা করে নেয়। কাপ্তান কক্ষ, ইঞ্জিন রুম, ফুয়েল ট্যাঙ্ক, বহনকৃত মালপত্রের সেল, ষ্টাফদের কক্ষ, প্রশস্ত উন্মুক্ত ডেক প্রভৃতি নিয়ে জাহাজ। জাহাজটি ধ্বংস করার জন্য ফুয়েল ট্যাঙ্কে বিষ্ফোরণ ঘটাতে হবে। ইউরেনিয়াম ও আণবিক গবেষণার অন্যান্য মাল-মসলা যাতে সরিয়ে নেবার কোন সুযোগ না পায় সেজন্য সেখানেও দ্রুত আগুন ধরাবার ব্যবস্থা করতে হবে। এবং এসব কাজ অবশ্যই জাহাজে পৌঁছার পর ভোজ অনুষ্ঠানের আগেই সম্পন্ন করতে হবে। পরিকল্পিত সময়ে বিষ্ফোরণের জন্য ডেজিচেইনের ব্যবহারই উপযুক্ত বিবেচনা করল সে। ডেজিচেইনের একপ্রান্তে জুড়ে দেয়া যাবে ডেটানেটর। ডেটোনেটরের সাথে ইচ্ছামত সময়ের টাইম ইগনেটর ব্যবহার করা যায়। সেফটীপিন তুলে নেবার পর টাইম ইগনেটরে নির্দিষ্ট সময়ে বিষ্ফোরণ ঘটে থাকে। মাহমুদ চিন্তা করল, ১১টা ভোজ, ১২টা বাজার আগে নিশ্চয়ই তা শেষ হয়ে যাবে। সোয়া বারটায় বিষ্ফোরণ ঘটাতে চাইলে ২ ঘন্টা সময়ের টাইম ইগনেটার ব্যবহার করলেই চলতে পারে। কিন্তু সে আবার ভাবল, ডেজিচেইন পাততে গিয়ে যদি বাধা কিংবা অস্বাভাবিক কিছুর মোকাবিলা করতে হয়, তাহলে দু’ঘন্টা পর্যন্ত ডেজিচেইন পেতে রাখা নিরাপদ হবে না, কারণ এ সময়ের মধ্যে অনুসন্ধান হতে পারে এবং ডেজিচেইন তাদের চোখে পড়ে যেতে পারে।
 
সুতরাং সিদ্ধান্ত নিল, ১১টা থেকে ১১ -১৫ মিনিটের মধ্যেই বিষ্ফোরণ ঘটাতে হবে। এতে অবশ্য ঝুঁকি আছে। তার এবং এমিলিয়ার নিরাপত্তার প্রশ্ন আছে। এ ঝুঁকি তবু নিতে হবে।
 
‘ওসেয়ান কিং’ জাহাজের ডেকে যখন মাহমুদরা পা রাখল, তখন ১০টা বেজে ২৯ মিনিট হয়েছে। আজকের এ প্রীতি ভোজ ইসরাইলী স্বরাষ্ট্র বিভাগ কর্তৃক ইসরাইলী পারমাণু বিজ্ঞানী এবং ইসরাইলের জন্য আণবিক গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ মালমসলা ও যন্ত্রপাতি বহনকারী ওসেয়ান কিং জাহাজের ক্যাপটেন ক্রুদের সম্মানে আয়োজিত। অবশ্য এ ভোজ এমিলিয়াদের মত বাছাই করা কিছু অতিথিদেরও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
 
জাহাজে উঠবার সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে ইসরাইলী স্বরাষ্ট্র বিভাগের একজন উর্ধ্বতন কর্মচারী ও জাহাজের ক্যাপটেন অতিথিদের সম্ভাষণ জানাচ্ছেন। মাহমুদ ও এমিলিয়া ওদের সাথে করমর্দন করে উপরে উঠে গেল। মাহমুদ লক্ষ্য করল, স্বরাষ্ট্র বিভাগীয় অফিসার মিঃ গ্রিনবার্জ ও ক্যাপ্টেন মিঃ আদ্রে সাইমনের পিছনে আর একজন দাঁড়িয়ে রয়েছে। তিনি হলেন ইসরাইলী আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিভাগ ‘সিন বেথের’ সহকারী পরিচালক মিঃ হফম্যান। মাহমুদের ছোঁটের কোণে এক টুকরো বাঁকা হাসি খেলে গেলে।
 
টেবিল আর চেয়ার দিয়ে সুন্দর করে ডেক সাজানো হয়েছে। আমন্ত্রিত অতিথিদের অনেকেই এসে গেছেন। কেউ কেউ জাহাজের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে চন্দ্রালোকিত সাগরের শোভা দেখছেন। আর অবশিষ্টরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বসে জটলা করছেন। মাহমুদ এমিলিয়াকে নিয়ে গোটা ডেকটা একবার চক্কর দিলো। সশস্ত্র কোন প্রহরীকে উপরে দেখা গেল না। মাহমুদ ভবল, নিশ্চয় তাহলে ভিতরে কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এ সময় মাহমুদ লক্ষ্য করল একটি প্লেটে To Lavatory লিখে জাহাজের অভ্যন্তরে নামবার সিঁড়ির দিকে তীর এঁকে দেয়া হয়েছে। মাহমুদের মুখ খুশীতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে এমিলিয়াকে নিয়ে জাহাজের সামনের প্রান্তে রেলিং এর পার্শ্বস্থিত একটি চেয়ারে এসে বসল। ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখল ১০ টা ৩২ মিনিট বেজে গেছে। মাহমুদ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, বাথরুম থেকে একটু আসি।
 
মাহমুদের পরনে চকলেট সুট। পায়ে ক্রেপসু। মাহমুদ সিঁড়ি দিয়ে ডেক থেকে নিচে নেমে এল। ভিতরে কিন্তু বাইরের মত উজ্জ্বল আলো নেই। মাহমুদ সিঁড়ি থেকে নেমে যেখানে এসে দাঁড়াল, সেখান থেকে জাহাজ লম্বালম্বি দীর্ঘ করিডোর, দু’পাশে কেবিন-কার্গো কেবিন। মাহমুদ করিডোরে দাঁড়াতেই একজন ষ্টেনগানধারী প্রহরী মাহমেুদকে জিজ্ঞাসা করল -ল্যাভেটরী স্যার?
 
-হাঁ। মাহমুদ বলল।
 
-আসুন। বামে কয়েক পা এগিয়ে একটি বন্ধ ঘর দেখিয়ে দিল। মাহমুদ হাতল ঘুরিয়ে দরজা খুলল। তারপর পিছন ফিরে দেখল, প্রহরীটি পিছন ফিরে কয়েক পা এগিয়েছে। মাহমুদ দেখল, করিডোরে আর কেউ নেই। তারপর পকেট থেকে একটি রুমাল ও শিশি বের করে বিড়ালের মত নিঃশব্দ পায়ে প্রহরীর দেক এগুতে লাগল। নিকটবর্তী হয়ে অত্যন্ত দ্রুত বাম হাত দিয়ে লোকটির কন্ঠনালি চেপে ধরল, অন্য হাতে ক্লোরোফরম সিক্ত রুমালটি লোকটির নাকে চেপে রাখল। কয়েকবার কোক কোক শব্দ করার পর তার দেহটি নিস্তেজ হয়ে এল। ষ্টেনগানটি হাত থেকে পড়ে গিয়ে ঠক করে একটি শব্দ হল। মাহমুদ তার দেহটি টেনে নিয়ে গিয়ে ল্যাভেটরী ও কার্গো কেবিনের মাঝের সরু গলির মধ্যে রেখে দিল। স্থানটি একটু অন্ধকার। সেখানে একটি সোফাও দেখল মাহমুদ। বুঝল প্রহরীরা এখানে বসে বিশ্রাম নেয়।
 
মাহমুদের হাতে সাইলেন্সার লাগানো নিভলবার। মাহমুদ ইঞ্জিন রুমের সিঁড়িতে পা রাখতে যাবে, এমন সময় পেছন থেকে শব্দ ভেসে এল, ‘হ্যাঁন্ডস আপ’।
 
মাহমুদ হাত উঁচু করে দাঁড়িয়ে পড়ল। মাহমুদ তার পিঠে রিভলভারের ভারী স্পর্শ অনুভব করল। মাহমুদ আশু কর্তব্য ভেবে নিল, তারপর এক ঝটকায় বসে পড়ল এবং সঙ্গে সঙ্গেই পিছনে দাঁড়ানো লোকটির দু’টি পা ধরে সামনে মারল হেচকা টান। লোকটি কাত হয়ে পড়ে গেল। রিভলভার ও ছিটকে গেল তার হাত থেকে। বজ্র মুষ্টিতে চেপে ধরল কণ্ঠনালি। মাত্র কয়েক মুহূর্ত। তারপর নিস্তেজ হয়ে এলো লোকটির দেহ। মাহমুদ তাড়াতাড়ি লোকটিকে টেনে এনে ইঞ্জিন রুমের এক কোণে গুঁজে রেখে দিল। লোকটির মুখের দিকে তাকিয়ে মাহমুদ চমকে উঠল। একি? মিঃ হফম্যান? উজ্জ্বল হাসিতে মাহমুদের মুখ ভরে গেল। অগণিত মুসলিম বাস্ত্তত্যাগী আর বহু সাইমুম কর্মীর রক্তে রঞ্জিত ইসরাইলী গোয়েন্দা এই হফম্যানের হাত। এতদিনে সব লীলা অবসান হলো শয়তানের।
 
মাহমুদ দ্রুত ইঞ্জিন রুমের পাশ দিয়ে জ্বালানি সঞ্চয় কক্ষে প্রবেশ করল এবং দ্রুত কাজে লেগে গেল। তিনটি বৃহদাকার ট্যাঙ্ক। সৌভাগ্যক্রমে ট্যাঙ্কগুলি ঈষৎ উঁচু সারিবদ্ধ কতগুলি ইস্পাত বেজের উপর রাখা। মাহমুদ দ্রুত ডেজিচেইন পেতে তার মাথায় ডেটোনেটর ও টাইম ইগনেটর জুড়ে দিল। প্রত্যেকটি ট্যাঙ্কের জন্য দু’টি করে ডেজিচেইন পাতল মাহমুদ। তারপর ফিরে এল আবার ইঞ্জিন রুমে। সেখান থেকে উঠে এর পূর্বের করিডোরে। করিডোরে কেউ নেই। মাহমুদ বুঝল প্রহরী ও জাহাজের ক্রুরা সবাই নিশ্চিন্তে ভোজ সভার অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছে। মাহমুদ কার্গো কেবিনে ডেজিচেইন পাতার বিষয় বিবেচনা করে দেখল। কিন্তু এর প্রয়োজন হবে বলে মনে হলো না মাহমুদের।
 
এবার নিশ্চিন্ত হয়ে সে প্রবেশ করল ল্যাভেটরীতে। বেশ করে হাত মুখ ধুয়ে বেরিয়ে এল সেখান থেকে। ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখল ১০ টা বেজে ৪৭ মিনিট। মাহমুদ ভবল, এমিলিয়া নিশ্চয় এই দেরীতে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে।
 
মাহমুদ সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল। সোজাসুজি এমিলিয়ার কাছে না গিয়ে রেলিং এর ধারে গিয়ে দাঁড়াল। সে লক্ষ্য করল, সে এখনো এমিলিয়ার দৃষ্টিতে পড়েনি।
 
সাগরে চাঁদের স্থির প্রতিবিম্বের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মাহমুদ। স্থির চাঁদের ঐ আলোক শিখা মাহমুদের মনকে টেনে নিয়ে গেল জর্দানের পাহাড় আর তার পাশ্বের উপত্যকা ভূমিতে। সেখানে তাঁবু আর কুঁড়ে ঘরে বাস করছে অগণিত মানুষ – মজলুম মানুষ। ঐ মজলুম মুসলমানদের জন্য আমরা এ পর্যন্ত কি করতে পেরেছি? সময় যতই গেছে ইসরাইল তার বিষাক্ত থাবাকে আরও সুদৃঢ়, আরও সুবিস্তৃত করেছে। এমিলিয়া এসে মাহমুদের পাশে দাঁড়াল। মাহমুদের দিকে চেয়ে মুচকি হেসে বলল, কি স্বপ্ন দেখছ?
 
মাহমুদ চমকে উঠল। কিন্তু পরক্ষণেই মুখে ফুটিয়ে তুলল মৃদু হাসির রেখা। বলল, ভাবছি এই সাগর আর এ তারকা খচিত নিকষ কালো আকাশের অসীমত্বের কথা। আমরা কত ক্ষুদ্র। এই সাগর ঐ অসীম আকাশ আর এই বিচিত্র পৃথিবীর মালিক স্রষ্টা না জানি কত মহাশক্তিশালী। শান্ত ও অনুচ্চস্বরে বলল স্রষ্টাকে তুমি মহাশক্তিশালী মনে কর দানিয়েল?
 
-আমার স্বীকার করা বা না করার সাথে এর সম্বন্ধ নেই এমিলিয়া। মহা সৃষ্টির মাইে যে তার মহাশক্তির সাক্ষ্য নিহিত। স্রষ্টাকে তুমি অস্বীকার করতে পারো এমিলিয়া?
 
-কিন্তু স্রষ্টাকে মানতে গেলে ধর্মকে মানতে হয়। আর ধর্মকে মানতে গেলে দেখ না কত ফ্যাসাদ।
 
-যেমন?
 
-কোন ধর্ম মানবো, ইহুদী না খৃষ্টান, না মোহামেডান? এত সংঘর্ষ আর বৈপরীত্য কেন?
 
-বৈপরীত্য নেই এমিলিয়া। মুসা, যিশু খৃষ্ট আর মোহাম্মদ এর মূল শিক্ষা একই। ব্যবহারিক ক্রিয়া কর্মের মধ্যে পার্থক্য আছে শুধু এই পার্থক্যকে শাসনতন্ত্রের পরিবর্তন ও সংশোধনের সাথে তুলনা করা যায়।
 
-কিন্তু এটা স্বীকার করে নিলে যে ইসলামকে মানব সমাজের জন্য শেষ ও অনুসরণীয় একমাত্র জীবন বিধান বলে মেনে নিতে হয়?
 
-কিন্তু যা সত্য, তাকে আমরা অস্বীকার করব কেমন করে?
 
-এটা গুরুতর কথা দানিয়েল? এত সহজে এমন কথা তুমি বলতে পার না। যাক। আজ ধর্মের কি সত্যই কোন প্রয়োজন আছে বলে তুমি মনে কর?
 
-ধর্মের অর্থ জীবন পদ্ধতি। সুতরাং এ ভূমন্ডলে মানুষের জীবন যত দিন থাকবে ধর্মের প্রয়োজনও ততদিন থাকবে।
 
-জীবন পদ্ধতি আমরা নিজেরাই গড়ে নিতে পারি।
 
-তা পারি। এ ধরনের জীবন পদ্ধতি ফেরাউন, নমরুদ, সাদ্দাদ গড়ে তুলেছিল। প্লেটো, রুশো, ভল্টেয়ার মানুষের জন্য নতুন জীবন পদ্ধতির দিক নির্দেশ করেছিল। হেগেল, কার্ল মার্কস মানব সমাজের জন্য ঐতিহাসিক বস্ত্তবাদের আলোকে নতুন জীবনদর্শনের রূপরেখা এঁকে গেছে এবং সে মোতাবেক লেনিন, মাওসেতুং এর নেতৃত্বে রাশিয়া ও চীনে সর্বাত্মক বিপ্লবও সাধিত হয়েছে। গণতন্ত্রের উপর ভিত্তিশীল এক নয়া সমাজ পদ্ধতি (অবশ্য প্রকৃত পক্ষে এটা প্রাচীন গ্রীসিয় সমাজ সভ্যতার নবতর সংস্করণ) পশ্চিমা দেশগুলোতে চালু আছে কিন্তু এগুলোর কোন একটিও কি রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যক্তি জীবনে শান্তির সন্ধান দিতে পেরেছে? শ্রেণী স্বার্থের ধ্বজা তুলে সাম্যবাদের নামে সমাজবাদী দেশগুলো কি জনতাকে দাসে পরিণত করেনি? আর পুঁজিবাদী দেশগুলোতে ব্যক্তিস্বার্থ ও ব্যক্তি স্বাধীনতার নামে লুণ্ঠন শোষণের অবাধ সয়লাব কি বয়ে যাচ্ছে না? অশান্ত অস্থির মানুষকে ঘুমের বড়ি খেয়ে ঘুমোতে হয় কোন কারণে?
 
-কিন্তু স্রষ্টার নির্দেশিত জীবন পদ্ধতি সব সমস্যার সমাধান করবে, তার নিশ্চয়তা কি?
 
-আচ্ছা এমিলিয়া সাপের কোন জিনিসকে আমরা ভয় করি?
 
-বিষ দাঁতকে?
 
-আচ্ছা সাপের বিষ দাঁতকে যদি উপড়ে ফেলা হয়, তাহলে সে আর কোন ক্ষতি করতে পারে কি?
 
-না পারে না। এমিলিয়া হাসল। বলল, কিন্তু মানুষের বিষদাঁত তুমি পাবে কোথায়?
 
-মানুষের বিষদাঁত তার স্বেচ্ছাচারিতা ও স্বার্থপরতা। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র জীবনে সকল প্রকার বিপর্যয়, অশান্তি ও অনর্থের মূল কারণ মানুষের স্বার্থপরতা ও স্বেচ্ছাচারিতা। স্বার্থপরতা অন্যায়ের বাহন আর স্বেচ্ছাচারিতা তার অমোঘ অস্ত্র।
 
-কিন্তু এ বিষদাঁতকে তো ভাঙ্গা যায় না।
 
-ভাঙ্গা যায় না, কিন্তু এর বিলুপ্তি ঘটানো সম্ভব। মানুষ যখন এক স্রষ্টার সার্বভৌম ক্ষমতার কাছে সত্যিকার ভাবে মাথা নত করে তখন তার স্বেচ্চাচারিতা ও স্বার্থপরতার কোন সুযোগই আর থাকে না। সে সত্যিকারভাবে তখন স্রস্টার দেয়া বিধানবলীর প্রতিপালণকারী ও প্রয়োগকারী হয়ে দাঁড়ায়।
 
এমিলিয়া এক দৃষ্টিতে মাহমুদের দিকে তাকিয়ে ছিল। তার মুগ্ধ দৃষ্টি যেন আনন্দে নাচছে। সে বলল, আমার দেখা, আমার পরিচিত জনস্রোতের মাঝে তুমি সত্যই ব্যতিক্রম দানিয়েল। তুমি কখনো কঠিন বস্তুবাদী আবার কখনো কঠোর ভাববাদী। তুমি আসলে কি দানিয়েল?
 
-আমি একজন মানুষ। হাসল মাহমুদ।
 
এমিলিয়াও হাসল। কিছু বলতে যাচ্ছিল। এমন সময় ক্ষুদ্রকার ডেকমাইক থেকে ঘোষিত হল, লেডিজ এন্ড জেন্টলম্যান আপনাদের স্ব স্ব আসন গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করা যাচ্ছে।
 
সবাই গিয়ে আসন গ্রহণ করল। মাহমুদ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল রাত এগারটা বাজতে এক মিনিট বাকী।
 
রাত ১১ টা বেজে গেছে। আজকের অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ইসরাইলের বিজ্ঞান ও কারিগরি মন্ত্রী এ্যারোন কোপল্যান্ড তার আসন গ্রহণ করেছেন। ১১ টা বাজার সাথে সাথে ইসরাইলী অণুবিজ্ঞানী মিঃ মরিস কোহেন এবং মিঃ মোসে সারটক এসে আসন গ্রহণ করলেন।
 
১১ টা ১ মিনিট বাজল। মিঃ এ্যারোন কোপল্যান্ড উঠে দাঁড়ালেন উপস্থিত আমন্ত্রিত ব্যক্তিদের দিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন, উপস্থিত ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণ, আজ আমাদের জন্য এক পরম খুশীর দিন। আমাদের পিতৃভূমি ইসরাইল এক নতুন যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। আমাদের সমরশক্তিতে পরমাণু বিজ্ঞানের আশির্বাদ লাভের জন্য আমরা এতদিন পরের অনুগ্রহের উপর নির্ভর করেছি। আমাদের বিজ্ঞান ও আমাদের কারিগররা পারমাণবিক কৌশল আয়ত্ব করেছে অনেক আগে, কিন্তু নিজস্ব গবেষণাগার স্থাপনের কোন সুযোগ আমরা পাইনি। এতদিনে সে সুযোগ আমরা লাভ করতে যাচ্ছি। সুতরাং আজকের এদিন আমাদের বিজ্ঞানী, আমাদের জনসাধারণ, আমাদের সরকার এবং আমাদের বিদেশের শুভানুধ্যায়ীদের জন্য মহা আনন্দের সওগাত বয়ে এনেছে। আমরা এ নিশ্চয়তা আজ সবাইকে দিতে পারি সেদিন বেশী দূরে নয়, যেদিন আমরা আমেরিকা ও রাশিয়ার মত ইন্টারকন্টিনেন্টাল ব্যালেষ্টিক মিসাইলের অধিকারী হবো।
 
শ্রোতমন্ডলি করতালি দিলেন। একটু থেমে মন্ত্রী মহোদয় আবার শুরু করলেন, পিতৃভূমির যে অংশটুকুর উপর আমরা অধিকার লাভ করেছি, তা নিয়ে আমরা কেউই সন্তুষ্ট নই, সন্তুষ্ট থাকতে পারি না। হেজাযের ইয়াসরেব নগরী ( আল মদিনা ) থেকে তুরস্কের আলেকজান্দ্রিয়া প্রদেশ এবং ভূমধ্যসাগর ও নীল নদের সীমা থেকে ইউফ্রেটিস-তাইগ্রিস নদীর মোহনা পর্যন্ত বিস্তৃত আমাদের পিতৃভূমির উপর আমরা যে কোন মূল্যেই হোক অধিকার কায়েম করবো। এজন্য চাই আরো শক্তি – আরো শক্তি ( আবার তুমূল করতালি কিন্তু মাহমুদের হাত দু’টিই শুধু নড়ল না )।
 
১১ টা ৭ মিঃ অনুষ্ঠানে শেষ হলো। খাবার প্রস্ত্ততি শুরু হল। সবাই নিজের কোলের উপর রুমাল বিছিয়ে নিচ্ছেন। মাহমুদের মন চঞ্চল হয়ে উঠল। আর তিন মিনিটের মধ্যেই প্রথম বিষ্ফোরণ ঘটার কথা। আল্লাহ কি দয়া করবেন? তার মিশন কি সফল হবে। বলদর্পী সাম্রাজ্যবাদী রক্ত পিপাসু ইহুদীদের আশার এ দীপশিখাকে কি সে নিভিয়ে দিতে পারবে? সকলের সামনে স্যুপ পরিবেশিত হয়েছে। চামচ দিয়ে স্যুপ নাড়ছে সবাই। চামচ দিয়ে ধীরে ধীরে মুখে তুলছে স্যুপ। সবার মত মাহমুদের মুখেও স্যুপ উঠছে। কিন্তু তার মন আশা নিরাশার তরঙ্গঘাতে অশান্ত চঞ্চল। ১১ টা ৯ মিঃ ৩০ সেকেন্ড। জাহাজ প্রচন্ডভাবে কেঁপে উঠল। প্রচণ্ড বিষ্ফোরণের শব্দ। সঙ্গে সঙ্গে এক বিরাট অগ্নিপিন্ড আকাশের দিকে উঠে গেল। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল খাবার টেবিলে। স্যুপের পিয়ালা অনেকের কাত হয়ে পড়ে গেছে ইতিমধ্যেই। সবাই উঠে দাড়িয়েছে। ভীত আতঙ্কগ্রস্থ সবাই। মাহমুদ তার কর্তব্য আগেই ঠিক করে রেখেছিল। এমিলিয়াকে বলল, এস আমার সাথে। বলে সে ছুটলো ডেক থেকে জেটিতে নামবার সিঁড়ির দিকে। জাহাজ কাঁপছে। প্রথম বিষ্ফারণের ফলে উৎক্ষিপ্ত অগ্নিপিন্ড নিচে নেমে জাহাজে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল। সিঁড়ির মুখে গিয়ে মাহমুদ এমিলিয়াকে বলল, হাত দিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে আমার পিঠে উঠ।
 
এমিলিয়ার মুখ ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। সে কাঁপছে। মাহমুদের আদেশ পালন করল সে। অভ্যস্ত মাহমুদ দ্রুত কম্পমান সিঁড়ি দিয়ে জেটিতে নেমে এল। জেটিতে পা রাখার সাথে সাথে আর একটি বিষ্ফারণের শব্দ হল। মাহমুদ পিছনে ফিরে দেখল, জাহাজের বিজলি বাতি নিভে গেছে। কিন্তু বিষ্ফোরণের ফলে উৎক্ষিপ্ত আগুন জাহাজকে আলোকিত করে তুলছে। সেই আলোতে দেখা গেল জাহাজের একটা অংশ সম্পূর্ণ উড়ে গেছে। দ্বিতীয় বিষ্ফোরণের অগ্নিপিন্ড জাহাজে ছড়িয়ে পড়ায় জাহাজের স্থানে স্থানে আগুন জ্বলতে দেখা যাচ্ছে। মাহমুদ এমিলিয়াকে নিয়ে জেটি থেকে আর একটু দূরে সরে এল। মাহমুদ দেখল আরো কয়েকজন মানুষ সিঁড়ি দিয়ে জেটিতে নেমে এল। আর একটি বিষ্ফোরণ ঘটল এ সময়। মনে হল জাহাজটি যেন একদিকে কাত হয়ে গেল। অপেক্ষকৃত ছোট আরও অনেকগুলি বিষ্ফোরণের শব্দ শোনা গেল। জাহাজের অন্যান্য কয়েক স্থান থেকেও আগুনের লেলিহান শিখা দেখা যেতে লাগল। দূরে ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ীর ঘন্টাধ্বনি শোনা গেল। মাহমুদ ও এমিলিয়া গাড়ীতে গিয়ে বসল। মাহমুদ গাড়ি ছেড়ে দিল। পোর্ট রোড ধরে গাড়ী তীব্র গতিতে পূর্বদিকে এগিয়ে চলছে। তেলআবিব অনেক দূরের পথ। লম্বা রাস্তা। মাহমুদের দৃষ্টি সামনে প্রসারিত। তার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে পেরে তার মন তৃপ্ত। এ তৃপ্তির মাঝেও তার মনে একটি কাঁটা বিধছে। এবার এমিলিয়ার সাথে তার অভিনয়ের ইতি করতে হবে। কিন্তু শুধুই কি তা অভিনয় ছিল? মনের কোথায় যেন বেদানার সুর বাজছে তার। এমিলিয়া তার পরিচয় পেলে কি ভাববে তাকে? কালকেই গোয়েন্দা পুলিশ এসে এমিলিয়াকে ব্যস্ত করে তুলবে। বিনা অপরাধে বেচারী কষ্ট পাবে। এমিলিয়া একটু কাত হয়ে একটি হাত মাহমুদের পিছনে সোফার উপর প্রসারিত করে একটি হাত মাহমুদের কাঁধে রেখে মুখটি মাহমুদের কাঁধে গুঁজে রেখেছে। এক সময় ধীর কন্ঠে সে বলল, দানিয়েল, একবার তুমি আমাকে নৈতিক মৃত্যু থেকে বাঁচিয়েছ, আবার আজ তুমি আমাকে দৈহিক মৃত্যুর হাত তেকে বাঁচালে। জীবন দিয়েও এ ঋণ শোধ করতে পারব না আমি দানিয়েল। মাহমুদের গোটা দেহে একটি শিহরণ খেলে গেল। কিন্তু কোন উত্তর দিল না মাহমুদ। কি উত্তর দেবে সে? যে তার জীবনকে জাতির জন্য উৎসর্গ করেছে, সে কেমন করে একজন ইহুদী তরুণীর এ আত্ম নিবেদনকে গ্রহণ করবে? মাহমুদ ধীরে ধীরে বলল, কাল সকালে পুলিশ আসবে। আমার সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করবে তারা। কি জবাব দিবে তুমি?
 
-কেন পুলিশ আসবে?
 
-আসবে।
 
-কেন আসবে?
 
-ধর যদি আসেই?
 
-আমি তোমার ঠিকানা বলে দেব, তোমার কাছে পাঠিয়ে দেব।
 
-পুলিশ আমাকে খুঁজে পাবে না।
 
-কেন? কোথাও চলে যাচ্ছ তুমি? বলে সোজা হয়ে বসল এমিলিয়া।  মাহমুদ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর এমিলিয়ার প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়েই বলল, পুলিশকে আমাদের পরিচয়ের আসল ঘটনাটির কথা জানাবে তাহলে আমাদের বন্ধুত্বের কারণ তারা বুঝবে এবং তোমার কোন দোষ হবে না।
 
-পুলিশ কেন তোমার সন্ধান করবে? কেন দোষ দিবে আমাকে তারা? এমিলিয়ার কন্ঠে উদ্বগ।
 
-ওসেয়ান কিং’ জাহাজ ধ্বংসের জন্য আমাকেই দায়ী করবে তারা।
 
-কেন তা করবে? তুমি ও কাজ করতে যাবে কোন কারণে? মাহমুদ মুহূর্তের জন্য এমিলিয়ার মুখের দিকে তাকাল। তার লাবণ্যভরা মুখটি উদ্বিগ উত্তেজনায় যেন কাঁপছে। ওর কোমল হৃদয়ে আঘাত দিতে কষ্ট লাগছে মাহমুদের। তবু সত্য ঘটনা তাকে বলতেই হবে মাহমুদ গম্ভীর কন্ঠে বলল, ‘ওসেয়ান কিং’ জাহাজের ফুয়েল ট্যাংকে আমি বিষ্ফোরণ ঘটিয়েছি এমিলিয়া।
 
-তুমি? এমিলিয়ার কণ্ঠ আর্ত চিৎকারের মত শোনাল। বিস্ময় উত্তেজনায় এমিলিয়ার মুখ হা হয়ে গেছে। সে বির্বাক দৃষ্টিতে আকিয়ে আছে মাহমুদের দিকে।
 
-মাহমুদ আবার এমিলিয়ার দিকে চাইল। তার মুখে ফুটে উঠল হাসির রেখা। কিন্তু তা যেন তাসি নয়, কান্না। বলল, জানি এমিলিয়া তুমি বিস্মিত হয়েছ। হয়তো ভাবছও আমি কেমন করে অমন খুনী হতে পারলাম। কিন্তু তুমি জান না, ‘ওসেয়ান কিং’ জাহাজে যে অগ্নিকুন্ড তুমি দেখেছ, তার চেয়েও অনেক বড় অগ্নিকুন্ড আমার হৃদয়ে জ্বলছে। শুধু আমার হৃদয়ে নয়, ফিলিস্তিন থেকে বিতাড়িত আমার মত লক্ষ লক্ষ আরব মুসলমানের হৃদয়ে এ আগুন অমনি জ্বলছে।
 
-তুমি আরব? তুমি মুসলমান? এমিলিয়ার কণ্ঠ আর্তনাদ করে উঠল।
 
-হাঁ এমিলিয়া, আমি মুসলমান।
 
-বিস্ময় বিষ্ফারিত এমিলিয়ার চোখ। গভীর বেদনায় শক্ত নীল হয়ে উঠেছে এমিলিয়ার শুভ্র গন্ডদেশ। গোলাপের মত ঠোঁট দু’টি তার কাঁপছে। বিহ্ব্ল দৃষ্টিতে মুহূর্ত কাল মাহমুদের দিকে চেয়ে থাকল। তারপর ভেঙ্গে পড়ল কান্নায়। উপুড় হয়ে হাঁটুতে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে সে। মাহমুদের দৃষ্টি সামনে প্রসারিত। জন বিরল প্রশস্ত রাস্তা। তীব্র গতিতে এগিয়ে চলেছে কার্ডিয়াক। মাহমুদ এবার এমিলিয়ার দিকে চাইল, কাঁদুক, কাঁদা উচিত। চোখের পানিতে ধুয়ে মুছে যাক মাহমুদে সব স্মৃতি।
 
খোলা প্রশস্ত গেট দিয়ে ডেভিড বেনগুরিয়ানের বারান্দায় প্রবেশ করল গাড়ী। মাহমুদ গাড়ী থেকে নেমে পাশ ঘুরে এসে গাড়ীর দরজা খুলে ধরে বলল, নেমে এস। এমিলিয়া মুখ তুলল। অশ্রু ধোয়া মুখ তার। দু’একটি অবিন্যস্ত চুল মুখে এসে পড়েছে। অশ্রুতে ভিজে গেছে সে গুলোও। কঠিন আঘাতে যে চোখে অশ্রু আসে না, মাহমুদের সে চোখ দু’টিও ভারী হয়ে উঠল। এমিলিয়া বেরিয়ে এসে মাহমুদের পাশে দাঁড়াল। নতমুখী এমিলিয়া। দু’জনই নির্বাক। প্রথমে কথা বলল মাহমুদ। বলল, পরিচয় গোপন করার জন্য এবং তোমাকে এমন করে আঘাত দেয়ার জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী এমিলিয়া। তুমি যদি আমাকে ভুল না বুঝ, তাহলে আমাকে ক্ষমা তুমি করতে পারবে।
 
এমিলিয়া নীরব। কোন কথা বলল না। মুখও তুলল না সে।
 
মাহমুদ আবার বলল, আর যদি প্রতিশোধ নিতে চাও তাহলে আমাকে পুলিশে ধরিয়ে দাও। আমি রাজী আছি।
 
এমিলিয়া যেন পাথর হয়ে গেছে। কোন উত্তর এল না তার কাছে থেকে। যেন অলক্ষ্যে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল মাহমুদের বুক থেকে চোখের কোণও বোধ হয় ভিজে এল তার বলল সে, তাহলে আসি এমিলিয়া, পারলে ক্ষমা করো।
 
দু’হাত মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠল এমিলিয়া। মাহমুদ কয়েক পা এগিয়ে ছিল। ফিরে এল আবার। এমিলিয়ার মুখ তুলে ধরে ডাকল এমিলিয়া।
 
-দানিয়েল। বলে মাহমুদের হাত জড়িয়ে ধরে বাঁধ ভাঙ্গা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল এমিলিয়া।
 
আর দানিয়েল নায় এমিলিয়া। আমার নাম মাহমুদ। ধীর স্বরে বলল মাহমুদ।
 
এমিলিয়া কেঁদেই চলল। মাহমুদের হাত এমিলিয়ার চোখের পানিতে ভিজে গেল।
 
মাহমুদ বলল, মুখ তোল কথা বল এমিলিয়া।
 
এমিলিয়া ধীরে ধীরে মুখ তুলল। অবিন্যস্ত চুল আর অশ্রু ধোয়া এমিলিয়াকে দেখে মনে হচ্ছে, কি এক প্রচন্ড ঝড় বয়ে গেছে এমিলিয়ার উপর দিয়ে। তার নীল শান্ত চোখে কি নিঃসীম মায়া বলল সে, আবার কবে দেখা হবে?
 
শক্ত একটি প্রশ্ন। মাহমুদ বলতে চাইল। স্রোতে ভাসা পানার মত নিরুদ্দিষ্ট আমাদের জীবন। কোন আবর্ত কোথায় কখন আমাদের নিয়ে যাবে তা আমরাও জানি না। কিন্তু কথা বাড়াতে চাইল না মাহমুদ। বলল, যদি কোথাও দূরে চলে না যাই তাহলে দেখা হবে।
 
-আর যদি দূরে চলে যাও? অবরুদ্ধ কান্নায় কাঁপতে লাগল এমিলিয়ার ঠোঁট দু’টি।
 
-একটি যাযাবর জীবনের জন্য তুমি অপেক্ষা করবে এমিলিয়া?
 
এমিলিয়ার দুই গন্ড বেয়ে আবার নেমে এল অশ্রুর দু’টি ধারা। বলল সে, কোন কথা নয় কথা দাও তুমি আসবে?
 
-কথা দিলাম আসব।
 
-বেশ। বলে এমিলিয়া মাহমুদের হাত ছেড়ে দিয়ে বলল, এ সময় এ অঞ্চলে কোন ট্যাক্সি পাবে না, হেঁটে যাবে কেমন করে? চল আমি তোমাকে রেখে আসব। মাহমুদ ম্লান হাসল। বলল, এতক্ষণ তোমাদের গোয়েন্দারা হয়ত আমার সন্ধানে ছুটে আসছে। তোমাকে আর কোন বিপদে জড়াতে চাই না এমিলিয়া।
 
-কিন্তু তোমার বিপদের কথা তুমি ভাবছ না কেন?
 
-বিপদ আমাদের নিত্য খেলার সাথী। কোন চিন্তা করো না তুমি। আর আমাকে হেঁটে যেতে হচ্ছে না, তোমাদের গেটের বাইরে আমার জন্য গাড়ী অপেক্ষা করছে। বলে মাহমুদ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, আসি এমিলিয়া। খোদা হাফেজ।
 
-আচ্ছা এস। কম্পিত কন্ঠে বলল এমিলিয়া।
 
মাহমুদ কয়েক কদম এগিয়ে আবার পিছনে ফিরে চাইল। দেখল, এমিলিয়া একটি হাত গাড়ীর উপর ঠেস দিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। গাড়ি বারান্দায় ম্লান আলো তার চোখের পানিতে প্রতিবিম্বত হয়ে চিক চিক করছে। হৃদয়ের কোথায় যেন মোচড় দিয়ে উঠল মাহমুদের। তার যাত্রা পথের দিকে চোখ দু’টি বুজে এল মাহমুদের। উচ্চারিত হল তার কন্ঠেঃ রাববানা আজআলনা মুসলিমাইনিলাকা (প্রভু আমার, তোমার কাছে আত্মসমর্পণকারী মুসলমানদের মধ্যে আমাদের সামিল কর)।
 
পরদিন সকালে অনেক বেলা করে ঘুম থেকে উঠল এমিলিয়া। অনেক রাত্রে ঘুমিয়েছে সে। রাত্রেই এসেছিল নিরাপত্তা পুলিশরা। নাইট ক্লাবের মৌখিক পরিচয় ছাড়া মাহমুদ সম্বন্ধে আর কোন কিছু্ই জানে না বলেই জানিয়েছে এমিলিয়া তাঁদের। এমিলিয়ার বিশ্বস্ততা সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নেই বলেই তার হয়ত কোন পীড়াপীড়ি করেনি আর।
 
শয্যায় উঠে বসেই সে দেখতে পেল পাশের টিপয়ে রাখা সেদিনের সংবাদপত্র। কাগজটি হাতে নিয়ে চোখ বুলোতেই সে দেখতে পেল, ওসেয়ান কিং জাহাজের খবরটি লিড ষ্টোরি  হয়েছে। সে পড়ল, ওসেয়ান কিং জাহাজের ভয়াবহ অগ্নিকান্ডঃ
 
অণূ বিজ্ঞানী মিঃ মরিস কোগেনসহ পাঁচজনের মৃত্যুঃ
 
২ জন নিখোঁজঃ ১০ জন আহতঃ সমুদয় কার্গো ভস্মিভূত। পরে ওসেয়ান কিং জাহাজে অগ্নিকান্ডের সময় ও পূর্ণ বিবরণ দিয়ে পরিশেষে লিখেছে ‘‘এই অগ্নিকান্ডে ইসরাইলের ৫০০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের মহা মূল্যবান যন্ত্রপাতি ও মালপত্র সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়েছে। সবচেয়ে ক্ষতি অণূ বিজ্ঞানী মিঃ মরিস কোহেনের মৃত্যু। তিনি ইসরাইল বিজ্ঞানাকাশের সূর্য এবং আমাদের জাতীয় জীবনের এক অমূল্য রত্ন ছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে পরমাণু বিজ্ঞানে আমাদের দেশ যে অনেক দূর পিছিয়ে গেল, তা বলাই বাহুল্য। এক বিশ্বস্ত সূত্রে প্রাপ্ত খবরে জানা গেছে যে ওসেয়ান কিং জাহাজে ৫০ মিলিয়ন ডলারের পারমাণবিক গবেষণা সরঞ্জাম বোঝাই ছিল। এই মহামূল্যবান গবেষণা সরঞ্জামের বিনষ্টি আমাদের জাতীয় অগ্রগতির জন্য কত মর্মান্তিক, তা সহজেই অনুমেয়। ওসেয়ান কিং জাহাজের ঘটনায় নিহতদের মধ্যে আরো রয়েছেন, জাহাজের ক্যাপটেন জন টমসন এবং নিরুদ্দিষ্টদের মধ্যে আরো রয়েছে ইসরাইলী গোয়েন্দা বিভাগের সহকারী প্রধান মিঃ হফম্যান। জানা গেছে, ভোজ অনুষ্ঠানের কিছু পূর্বে থেকেই তাঁকে জাহাজের ডেকে দেখা যায়নি। ধারণা করা হচ্ছে যে, দুষ্কৃতিকারীদের সাথে সংঘর্ষে তিনি নিহত হয়েছেন।
 
সাইমুদের নাশকতাকারীরা জাহাজের ফুয়েল ট্যাংকে বিষ্ফোরণ ঘটিয়ে জাহাজে আগুন ধরিয়েছে বলে জানা গেছে, সংগৃহীত তথ্যের বরাত দিয়ে আমাদের নিরাপত্তা পুলিশ বিভাগ জানাচ্ছেন, আমন্ত্রিত অতিথির ছদ্মবেশে সাইমুমের জনৈক নাশকাতাকারী জাহাজে প্রবেশ করেছিলো।’’
 
এমিলিয়া রুদ্ধ নিঃশ্বাসে খবর পড়া শেষ করল। বৈজ্ঞানিক মিঃ মরিস কোহেন এবং মি হফম্যানের মৃত্যু হয়েছে? এমিলিয়ার স্নায়ুতন্ত্রী দিয়ে এক হিম শীতল স্রোত বয়ে গেল। কি নিষ্ঠুরতা? কিন্তু পরক্ষনেই তার মানস দৃষ্টিতে ভেসে উঠল মাহমুদের মুখ আর তার কথাঃ ‘‘এমিলিয়া তুমি জান না, ওসেয়ান কিং জাহাজে যে অগ্নিকান্ড তুমি দেখেছ, তার চেয়েও অনেক বড় অগ্নিকুন্ড আমার হৃদয়ে জ্বলছে। শুধু আমার হৃদয়ে নয় ফিলিস্তিন থেকে বিতাড়িত লক্ষ লক্ষ আরব মুসলমানদের হৃদয়ে এ আগুন এমনিভাবে জ্বলছে।’’ এমিলিয়ার মনে পড়ল, তাইতো আমরা ইহুদীরা বিভিন্ন দেশ থেকে এসে ফিলিস্তিনী মুসলমানদের সহায় সম্পদ দখল করেছি, তাদেরকে তাদের পিতৃ পুরুষের ভিটা বাড়ী থেকে উচ্ছেদ করেছি। আর যুগ যুগ ধরে মুক্ত আকাশের নীচে বৃষ্টি রোদের মধ্যে তাবুতে অমানুষিক জীবন যাপন করছে তারা। এমিলিয়ার আরো মনে পড়ল হত কালকের ভোজসভার বিজ্ঞান বিষয়ক মন্ত্রী মিঃ এ্যারোন কোপল্যাডের ভাষণঃ ‘হেযাজের ইয়সবরিব নগরী (মদিনা শরিফ) থেকে তুরস্কের আলেকজান্দ্রিয়া প্রদেশ এবং ভূমধ্যসাগর ও নীলনদের মোহনা পর্যন্ত বিস্তৃত আমাদের পিতৃভূমির উপর আমরা যে কোন মূল্যেই হোক অধিকার কায়েম করব।’’ ইসরাইলের এ ঘোষণা এ লক্ষ্যতো কোন আত্মরক্ষাকারী জাতি বা দেশের কথা নয়। এ যে সাম্রাজ্যবাদী দেশের আগ্রাসী নীতি। এ লক্ষ্য যদি অর্জিত হয়, তাহলে ঐ বিশাল ভূখন্ডের কোটি কোটি মুসলমানের ভাগ্যে কি ঘটবে? তারা কোথায় যাবে?
 
এতদিন এমিলিয়ার ধারণা, ছিল, ইসরাইলীরা আত্মরক্ষায় সচেষ্ট। কিন্তু আজ তার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল, ঘৃণ্য সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনা নিয়ে তার দেশ শক্তি বৃদ্ধি করছে। আর ফিলিস্তিন ও আরব মুসলমানরাই যথাযথভাবে আত্মপ্রতিষ্ঠা আর আত্মরক্ষার জন্য সংগ্রাম করেছে। ওসেয়ান কিং জাহাজের অগ্নিকান্ড যদি তাদের সেই সংগ্রামের অংশ হয়, তাহলে তাকে নিষ্ঠুর বলা যাবে কোন যুক্তিতে? মাহমুদকে নির্দোষ করতে পেরে গভীর প্রশান্তিতে বলে গেল এমিলিয়ার মন।
 
'''চলবে'''
 
{{Selfref|উইকিপিডিয়ার অ-বিশ্বকোষীয় পরিদর্শক পরিচিতির জন্য, দেখুন {{srlink|উইকিপিডিয়া:বৃত্তান্ত}}।}}
{{citation style|date=জানুয়ারি ২০১৫}}
১,০৯৬ ⟶ ৩৯৩ নং লাইন:
[[বিষয়শ্রেণী:ভার্চুয়াল সম্প্রদায়]]
[[বিষয়শ্রেণী:উইকিসমূহ]]
<references group="notes" />