বিষয়বস্তু বিয়োগ হয়েছে বিষয়বস্তু যোগ হয়েছে
নতুন পৃষ্ঠা: ইতিহাস : ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসের মাসের শেষ দিক...
(কোনও পার্থক্য নেই)

১৮:৫২, ২৩ মার্চ ২০১৭ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ

ইতিহাস : ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসের মাসের শেষ দিকের কথা। তখন আমরা হাওড়ার নরসিংহ দত্ত কলেজে বিএ প্রথম বর্ষের ছাত্র। জাতীয় সেবা প্রকল্পের নরসিংহ দত্ত কলেজ ইউনিটের সম্পাদক অধ্যাপক নীলিম মিত্র জানালেন, ''তোমরা কয়েক জনের একটা গোষ্ঠি তৈরি করে ডা. বিরল মল্লিকের কাছে প্রাথমিক প্রতিবিধানের পাঠ নেবে তিনদিনের নিবিড় শিক্ষাক্রমে।'' যথারীতি প্রাথমিক প্রতিবিধানের পাঠ সমাপ্ত হল। প্রথম দফায় আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা হল হাওড়া শহরাঞ্চলে কয়েকদিনের বিসিজি টিকা দেওয়ায় পুরকর্মীদের সাহায্য করা।

এবার জাতীয় সেবা প্রকল্পের প্রতিনিধি হিসেবে কৃষ্ণপদ ঘোষ ও আমাকে পাঠানো হল তখনকার পশ্চিম দিনাজপুরের হিলি সীমান্তে। প্রকল্পটি ছিল একটি সেবা প্রতিষ্ঠান খ্রিস্টান এজেন্সি ফর সোশ্যাল অ্যাকশনের তখনকার বিশ্ব প্রধান মিস্টার জন পি হেস্টিংস এবং তাঁর স্ত্রী মেরির সঙ্গে বাংলাদেশ (তখনকার পূর্ব পাকিস্তান) থেকে আসতে থাকা হাজার হাজার শরণার্থীর একটা সমীক্ষা তৈরি করা। ব্যাপারটা আমাদের কাছে সুদূর অজানায় পাড়ি বলেই মনে হয়েছিল। যাইহোক, ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসের এক ভোরে আমরা কলকাতার সিমলা অঞ্চলের এক বাড়ি থেকে যাত্রা শুরু করলাম। আসলে সিমলায় বিবেকানন্দের বাড়িটাও সেই প্রথম দেখলাম গাড়ির চালক ব্যানার্জিবাবুর কল্যাণে !

সারাদিন অ্যাম্বাসাডর গাড়ি ঠেঙিয়ে সন্ধের পর আমরা পাঁচজন উঠলাম ইসলামপুরের সার্কিট হাউসে। মাঝে দু-তিন জায়গায় থামতে হয়েছিল গাড়ির ও আমাদের খাবার সংগ্রহের জন্যে। আর আমাদের অবাক করে দিয়ে মিস্টার হেস্টিংস নিজেও কিছুক্ষণ গাড়ি চালালেন ! রাতে একটা ঘরে সাহেব ও মেমসাহেব এবং পাশের ঘরে আমরা তিনজন। পরদিন সকালেই হিলি সীমানায় খানিক সমীক্ষা করতে যাওয়া হল। কিন্তু অবস্থা খুবই করুণ ছিল, কেননা তখনই শরণার্থীদের ভিড় বেড়েছে ওখানে ! যাঁদের তখনই সহায়তা দরকার।সব বুঝে সংস্থার প্রধান তাড়াতাড়িই কলকাতায় ফিরে এলেন পরবর্তী পদক্ষেপ করার জন্যে।

১৯৭১ খ্রিস্টা্ব্দের এপ্রিল মাসে তপন মণ্ডল, জিতেন সাহাসহ আমরা চারজন জাতীয় সেবা প্রকল্পের অধীনে খ্রিস্টান এজেন্সি ফর সোশ্যাল অ্যাকশন সংস্থায় শরণার্থীদের সেবা করার কাজে বনগাঁ সীমান্তে যাই। বনগাঁয় আমরা যশোহর রোডের ধারে সলভেশন আর্মির বাগানবাড়িতে ঘাঁটি করি। প্রথমে আমাদের কাজ ছিল তখন যেসব শরণার্থী শিবির চালু হয়েছে সেখানে ডাক্তারদের সাহায্য করা এবং শিশু ও রোগীদের নন-ফ্যাট ড্রাই মিল্ক সরবরাহ করা।

পরবর্তীকালে সারা বনগাঁ মহকুমায় ১৫টা শরণার্থী শিবির সংগঠিত হয় সরকারিভাবে। সেখানে কার্ড বানিয়ে রেশনিং অথবা রান্না করা খাবার সরবরাহ করা হত সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার তত্ত্বাবধানে। ১৫টা শরণার্থী শিবিরের মধ্যে গাঁড়াপোতা, বাগদা, হেলেঞ্চা, মামাভাগনা, বয়রা, আংরাইল ইত্যাদি ছিল। আমাদের কর্মীসংখ্যাও আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। কলকাতা থেকে প্রদীপ ড্যানিয়েল, ঢাকার জ্যোতি হাজরা, খুলনার অজিত বৈরাগী, পান্নলাল ও হীরালল সাহা সিলেটের সলোমন মণ্ডল, পাবনার অবকাশ বারুই ও প্রদীপ বৈদ্য, উত্তর ২৪ পরগনার গৌরাঙ্গ সরকার ও রাজু ঘোষ এবং আরো অনেকে। আর বনগাঁয় আমাদের প্রধান ছিলেন শ্যামনগরের বিবেকানন্দ যশ।

বনগাঁর সলভেশন আর্মির চত্বরে প্রথমে ৫০ এবং পরে ৭৫ শয্যার বুলেট ইনজুরির চিকিৎসার জরুরি হাসপাতাল আমাদের তত্বাবধানে তৈরি হয়েছিল। তখন যুদ্ধ ভয়ংকর আকার নিয়েছে। প্রথম দিকে এলএমজি আর মর্টারের আওয়াজে রাতে ঘুম হতনা ! পরে আস্তে আস্তে বেনাপোল, ঝিকরগাছা, যশোহর দখল হওয়ার পর আমরা একটু স্বস্তি পাই !

একটা বড়ো কাজের সঙ্গে আমরা যুক্ত ছিলাম; তাহল, জেট ইনাকুলেটর বা মেশিনে কলেরা ভ্যাকসিন দেওয়া। কারণ বনগাঁ সীমান্তে সেসময় লক্ষ লক্ষ শরণার্থী আসছেন আর ওই অঞ্চলে কলেরা মহামারিরূপে দেখা দিয়েছে। আমরা এবং রেডক্রস থেকে ওই ভ্যাকসিন নিলে তবে শিবিরে কার্ড করা যাবে এরকম নির্দেশ জারি হয়। এমনকি বেনাপোল ক্যাম্প যখন ভারতীয় সেনা তথা মুক্তিবাহিনী দখল করেছে ওখানে সেনাবাহিনীকেও আমরা আমন্ত্রিত হয়ে ভ্যাকসিন দিতে যাই। আমাদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর দুই গাড়ি চালক নূর মিয়া ও আনসার আলির সঙ্গে ওদের বাড়ি ঝিকরগাছায় গিয়েছিলাম। তখন ইছামতীর ওপর ঝিকরগাছার হার্ডিঞ্জ ব্রিজে লেখা দেখলাম : 'হার্ডিঞ্জ ব্রিজ রিকন্সট্রাকটেড বাই বম্বে রেজিমেন্ট, ইন্ডিয়ান আর্মি '।

আমরা বনগাঁ ত্যাগ করলাম ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে গর্বের সঙ্গে নতুন বাংলাদেশের মুক্তিপ্রাপ্ত নাগরিকদের চোখের জলে বিদায় দিয়ে !!