সুতানুটি: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

বিষয়বস্তু বিয়োগ হয়েছে বিষয়বস্তু যোগ হয়েছে
WikitanvirBot (আলোচনা | অবদান)
বট বানান ঠিক করছে, কোনো সমস্যায় তানভিরের আলাপ পাতায় বার্তা রাখুন
৩০ নং লাইন:
শহরের বিকাশলাভের পর এখানে গড়ে ওঠে নানা পাড়া। মেছুয়াবাজার (বর্তমান [[জোড়াসাঁকো]]) ছিল একটি মাছের বাজার। কলুটোলা ছিল কলু অর্থাৎ তেলপ্রস্তুতকারক ও ব্যবসায়ীদের প্রধান আস্তানা ও ব্যবসাকেন্দ্র। [[কুমারটুলি]] অঞ্চলের নামকরণ হয় এখানকার কুমোর অর্থাৎ মৃৎশিল্পীদের নামানুসারে। জোড়াবাগানের আদিনাম ছিল শেঠবাগান; এখানে ১১০ বিঘা জমির উপর শেঠ পরিবারের একটি বাগানবাড়ি ছিল। আরও উত্তরে গড়ে ওঠে সেযুগের কলকাতার বাঙালি অভিজাতপল্লি [[বাগবাজার]] ও [[শ্যামবাজার]]। [[হুগলি জেলা|হুগলি অঞ্চল]] থেকে বসু ও পাল পরিবার কলকাতায় এসে বোসপাড়া গড়ে তোলেন। মনে করা হয়, বসু পরিবারের আদিপুরুষ নিধুরাম বসু ইংরেজদেরও আগে সুতানুটিতে পদার্পণ করেছিলেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আবার গাছের নামেও অঞ্চলগুলির নামকরণ করা হত। যেমন বড়তলার নামকরণ করা হয় জোড়া বটগাছের নামানুসারে এবং তালতলার নামকরণ করা হয় তালগাছের নামানুসারে। সেযুগে [[এন্টালি]] ছিল লবন হ্রদ এবং [[বালিগঞ্জ]] ও রসাপাগলা (অধুনা [[টালিগঞ্জ]]) নিঝুম গ্রাম।<ref name = "Nair">Nair, P. Thankappan, ''The Growth and Development of Old Calcutta'', in ''Calcutta, the Living City'', Vol I, pp. 11-18.</ref>
 
১৭৪২ সালে মারাঠা [[বর্গি|বর্গিদের]] সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য পুরনো কলকাতাকে ঘিরে একটি তিন মাইল দীর্ঘ পরিখা খনন করা হয়। এটির নাম ছিল [[মারাঠা খাত]]। মারাঠারা শেষ পর্যন্ত কলকাতা আক্রমণ করেনি। ১৭৫৬ সালে বর্তমান [[শিয়ালদহ|শিয়ালদহের]] নিকট সিরাজদ্দৌলা অতি সহজেই এই খাত অতিক্রম করে কলকাতা আক্রমণ করেন। এই সময় কলকাতার শ্বেতাঙ্গ বসতির চারিদিকে শক্ত বেড়া দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছিল। এর ফলে একটি ‘white ghetto’ বা ‘শ্বেতাঙ্গ সীমাবদ্ধতা’র সমস্যা উদ্ভুতউদ্ভূত হয়।<ref name = "Lahiri">Lahiri Choudhury, Dhriti Kanta,''Trends in Calcutta Architecture'', in ''Calcutta, the Living City'', Vol I, pp. 156-157.</ref>
 
সিরাজদ্দৌলার কলকাতা আক্রমণের বহু পূর্বেই উত্তরের শ্বেতাঙ্গপ্রধান দুর্গএলাকায় ‘হোয়াইট টাউন’ ও দেশীয় অধিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় ‘ব্ল্যাক টাউন’ নামে একপ্রকার মনস্তাত্ত্বিক বিভাজন ঘটে গিয়েছিল। ইংরেজরা সুতানুটি পরিত্যাগ করলে এই বিভাজনেরও অবসান ঘটে।<ref name = "Lahiri"/> ১৭১০ সালে সুতানুটিতে যে ১৬-১৮ ফুট চওড়া খাতটি খনন করা হয়েছিল সেটি সম্ভবত ব্ল্যাকটাউনকে হোয়াইট টাউন থেকে পৃথক করার জন্যই নির্মিত হয়।<ref>Nair, P. Thankappan, ''Civic and Public Services in Old Calcutta'', in ''Calcutta, the Living City'', Vol I, p. 227</ref> ইংরেজরা সুতানুটি ত্যাগ করার পূর্বে সুতানুটির উত্তরভাগে তাঁদের একটি প্রমোদকানন ছিল। পেরিন’স গার্ডেন নামে পরিচিত এই বাগানে কোম্পানির ইংরেজ কর্মচারীরা তাঁদের ‘লেডি’দের নিয়ে সান্ধ্যভ্রমণে আসতেন। পরে এটি রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে যায় এবং শেষ পর্যন্ত ১৭৫২ সালে বিক্রয় করে দেওয়া হয়।<ref>Cotton, H.E.A., p. 34.</ref> [[গোবিন্দপুর]] গ্রামে নতুন [[ফোর্ট উইলিয়াম, কলকাতা|ফোর্ট উইলিয়াম]] দুর্গের নির্মাণকার্য শুরু করে, সেখানকার অধিবাসীদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে [[তালতলা]], [[কুমারটুলি]] ও [[শোভাবাজার|শোভাবাজারে]] জমি দেওয়া হয়। ইউরোপীয় অধিবাসীরা ধীরে ধীরে পুরনো ‘হোয়াইট গেটো’র বেড়া ভেঙে দক্ষিণে [[ময়দান (কলকাতা)|ময়দান]] পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বসতি স্থাপন করতে শুরু করে।<ref>Cotton, H.E.A., p. 72.</ref>
৪০ নং লাইন:
শোনা যায়, ষোড়শ শতাব্দীর প্রথমার্ধে মুকুন্দরাম শেঠ সপ্তগ্রাম থেকে গোবিন্দপুরে এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন। গোবিন্দপুর দুর্গনির্মাণের জন্য ধ্বংস করা হলে শেঠেরা উত্তর সুতানুটি হাট (বর্তমান [[বড়বাজার]]) অঞ্চলে সরে আসেন। এরপর এই বংশের সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ ব্যক্তি ছিলেন জনার্দন শেঠ। তিনি ছিলেন কেনারাম শেঠের (কোনো কোনো মতে কিরণচন্দ্র শেঠের) পুত্র। তাঁর দুই ভাই ছিল – বারাণসী শেঠ ও নন্দরাম শেঠ। জনার্দন শেঠের পুত্র বৈষ্ণবচরণ শেঠ বোতলবন্দী গঙ্গাজল বিক্রি করে এক বিরাট ব্যবসা পত্তন করেছিলেন।<ref>Patree, Purnendu, p. 135-139.</ref>
 
পরে মাড়োয়ারিদের আগমনের ফলে শেঠ ও বসাকেরা কোণঠাসা হয়ে পড়েন। সুতানুটি হাটের নামও পরে পরিবর্তিত হয়ে বড়বাজার হয়।<ref name = "Nair"/> তবে তা সত্ত্বেও এঁদের ব্যবসায়িক সমৃদ্ধি ক্ষুন্নক্ষুণ্ণ হয়নি। শোভারাম বসাকের উত্তরসূরি রাধাকৃষ্ণ বসাক (মৃত্যু ১৮১১) বেঙ্গল ব্যাংকের দেওয়ান হয়েছিলেন। অষ্টাদশ শতাব্দীতে শহরের প্রধান ব্যবসায়িক পরিবারগুলি নগরাঞ্চলীয় সম্পত্তিতে বিনিয়োগ করতে শুরু করেন। শোভারাম বসাক তাঁর উত্তরসূরিদের জন্য সাঁইত্রিশটি বাড়ি রেখে গিয়েছিলেন। রাধাকৃষ্ণ বসাক কেবল বড়বাজারেই রেখে যান ষোলোটি বাড়ি।<ref>Bhattacharya, Sabyasachi, ''Traders and Trades in Old Calcutta'', in ''Calcutta, the Living City'', Vol I, p. 206.</ref> অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে কলকাতার বিকাশ শুরু হলে শেঠ ও বসাকদেরও পতন শুরু হয়।<ref name = "Deb"/>
 
শেঠ ও বসাকদের সঙ্গে সঙ্গে সুতানুটিও কলকাতায় বিলীন হয়ে যায়। এই অঞ্চলে গড়ে ওঠে অনেকগুলি পাড়া। সুতানুটির উল্লেখ থেকে যায় কেবলমাত্র পুরনো গ্রন্থে ও মানপত্রে। শোনা যায়, [[নবকৃষ্ণ দেব|নবকৃষ্ণ দেবকে]] সুতানুটির তালুকদারি দেওয়ার প্রস্তাব রাখা হয়েছিল।<ref>Raychoudhuri, Subir, ''The Lost World of the Babus'', in ''Calcutta, the Living City'', Vol I, p. 72.</ref> বিশিষ্ট সংস্কৃতি-ইতিহাসবিদ [[বিনয় ঘোষ]], আদি কলকাতার সংস্কৃতিকে চার ভাগে বিভক্ত করেছেন। যথা: সুতানুটি সংস্কৃতি (নবকৃষ্ণ দেব প্রবর্তিত শহুরে-সামন্ততান্ত্রিক সংস্কৃতি), কলিকাতা সংস্কৃতি (শেঠ ও বসাক কর্তৃক প্রবর্তিত বাঙালি ব্যবসায়িক শ্রেণির সংস্কৃতি), গোবিন্দপুর সংস্কৃতি (ইউরোপীয় নব্য ধনী সংস্কৃতি) ও ভবানীপুর সংস্কৃতি (বাঙালি মধ্যবিত্ত হিন্দু শ্রেণির সংস্কৃতি)।<ref name = "Deb"/> ১৬৯০ সালে সুতানুটিতেই জব চার্ণক প্রথম পদার্পণ করেন। এই অঞ্চলকে কেন্দ্র করে শুধুমাত্র কলকাতা শহরটিই বিকশিত হয়ে ওঠেনি, বরং ভারতে [[ব্রিটিশ ভারত|ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের]] সূচনায় এখানেই ঘটেছিল। আদি কলকাতার ব্ল্যাক টাউন তথা কলকাতার সংস্কৃতির আঁতুড়ঘর সুতানুটি আজও কলকাতার ইতিহাস সম্পর্কে অনুসন্ধিৎসু ব্যক্তিদের কাছে এক পরম আগ্রহের বিষয়। বর্তমানে পুরনো কলকাতার স্মৃতিরক্ষার্থে [[কলকাতা মেট্রো|কলকাতা মেট্রোর]] [[শোভাবাজার]] স্টেশনটির নামকরণ করা হয়েছে “শোভাবাজার-সুতানুটি”।