শাহনামা: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

বিষয়বস্তু বিয়োগ হয়েছে বিষয়বস্তু যোগ হয়েছে
৪ নং লাইন:
মহাকাব্যটি বর্তমান ইরানের পূর্ব ইতিহাসকে তুলে ধরেছে ও ফার্সি লোকদের সাংস্কৃতিকে ধারন করছে।<ref>{{cite web|last=Ashraf|first=Ahmad|title=Iranian Identity iii. Medieval Islamic Period|url=http://www.iranicaonline.org/articles/iranian-identity-iii-medieval-islamic-period|work=Encyclopædia Iranica|date=30 March 2012}}</ref> এটিতে ইসলাম পূর্ব শেষ সামানাইড রাজার কথাও বলা হয়েছে।
 
ফেরদৌসীর শাহনামা
== তথ্যসূত্র ==
{{reflist|2}}
 
{{Shahnameh}}
{{Persian literature}}
{{Iran topics}}
 
অনেকেরধারণা, পারস্যে ফেরদৌসীই প্রথম শাহনামা রচনায় হাত দেন। আবার অনেকে মনেকরেন গজনীর সুলতান মাহমুদের ফরমায়েশেই ফেরদৌসী শাহনামা রচনা শুরু করেন। এদুটির কোনোটিই সম্পূর্ণ সঠিক নয়। পারস্য সাহিত্যে শাহনামা বেশ প্রাচীনগ্রন্থ। তবে সংস্কারের পূর্বে এর নাম ছিল সিরাজুলমুলক অথবা রোস্তমনামা।যারা সর্বপ্রথম এর সংস্কার সাধনে আত্মনিয়োগ করেন তাদের মধ্যে মারভের সুলতানমাসুদী এবং বলখের সুলতান আবুল মুআঈদ ও আবুল আলী ছিলেন অন্যতম। এ সংস্কারহয় খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দীর প্রথম দিকে। এ শতাব্দীর শেষার্ধে ৯৫৭খ্রিস্টাব্দে তুসের শাসনকর্তা আবু মনসুর শাহনামা রচনার জন্য একদল যারতুস্তিবুদ্ধিজীবী ও পন্ডিতদের নিযুক্ত করেন। পন্ডিতদল দীর্ঘ সাধনার পর এর রচনাসমাপ্ত করেন। তাদের সঙ্কলিত পান্ডুলিপি পরবর্তী সময়ে একজন মুসলিম পন্ডিতকর্তৃক সংশোধন ও সম্পাদনা করা হয় এবং এই শতকের শ্রেষ্ঠ কবি দাকিকী তুসীরওপর এর কাব্যরূপ দেবার ভার ন্যস্ত করা হয়। দাকিকী ২ হাজার পঙ্ক্তি সমাপ্তকরার পর স্বীয় কৃতদাসের হাতে নিহত হন। এটি হিজরি ৩৬৭-৩৭০-এর সময়কার ঘটনা। এসময় তুসের গভর্নর ছিলেন আবু মনসুর। এ সময় ফেরদৌসীর বয়স ছিল ৩৫ কী ৩৭ বছর।কারণ অধিকাংশ জীবনীকারের মতে ফেরদৌসীর জন্ম হয় ৩২৯ অথবা ৩৩০ হিজরিতে।দাকিকীর মৃত্যুর পর তুসের অধিবাসী কবি ফেরদৌসী স্বউদ্যোগেই কবি দাকিকীরঅসমাপ্ত শাহনামা সমাপ্ত করার কাজ শুরু করেন। অন্যদিকে গজনীর অধিপতি সুলতানমাহমুদও শাহনামা রচনার জন্য তার দরবারের প্রধান কবি উনসুরীকে নিযুক্ত করেন।
[[বিষয়শ্রেণী:ইরানী লোক সাহিত্য]]
 
[[বিষয়শ্রেণী:ফারসি শব্দ এবং শব্দসমষ্টি]]
তুসেরগভর্নর আবু মনসুরের মৃত্যুর পর গভর্নর হয়ে আসেন সালান খাঁ। তিনিই ফেরদৌসীরপ্রতিভার কথা জানতে পেরে সুলতান মাহমুদকে অবহিত করে লিখে পাঠান : তিনিগজনীতে যে শাহনামা রচনার জন্য কবি উনসুরীকে নিযুক্ত করেছেন প্রকৃতপক্ষে একাজের যোগ্যতম ব্যক্তি হচ্ছেন কবি আবুল কাসেম মোহাম্মদ ফেরদৌসী। মূলতসুলতান মাহমুদ সালান খাঁর পত্রের মাধ্যমে ফেরদৌসীর প্রতিভা সম্পর্কে অবহিতহয়েই ফেরদৌসীকে গজনী আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে তার মীর মুনশি (মুখ্য সচিব)বদীউদ্দীনকে একটি পত্র লেখার নির্দেশ দেন। সেই মোতাবেক বদীউদ্দীন সুলতানমাহমুদের অভিপ্রায় জানিয়ে তুসের গভর্নরের মাধ্যমে ফেরদৌসীকে গজনী আগমনেরআমন্ত্রণ জানিয়ে একটি পত্র প্রেরণ করেন। এই আমন্ত্রণের ভিত্তিতেই ফেরদৌসীতুস থেকে গজনী অভিমুখে রওনা করেন। ইতোমধ্যে এই সংবাদ জানতে পেরে কবি উনসুরীমীর মুনশির সঙ্গে যোগসাজশে ফেরদৌসীকে তুসে ফেরত যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে অন্যএক মুনশি আখোরীকে ফেরদৌসীকে এই মর্মে একটি পত্র প্রেরণের নির্দেশ দেন যে, সুলতান মাহমুদ তার পরিকল্পনা পরিবর্তন করেছেন। সুতরাং ফেরদৌসী যেন তুসেফিরে যান।
 
এই পত্র যখন ফেরদৌসীর হাতে পৌঁছে তিনি তখন হেরাতেপৌঁছেছেন। এরই মধ্যে মীর মুনশি বদিউদ্দীন ও উনসুরীর মধ্যে কোনো এক বিষয়নিয়ে মনোমালিন্য ঘটে। তখন বদিউদ্দীন প্রকৃত ঘটনা জানিয়ে ফেরদৌসীকে লেখেনযে, পূর্বের পত্রটি মূলত সুলতান মাহমুদের নির্দেশে লেখা হয়নি, সেটি লেখাহয়েছিল উনসুরীর পরামর্শে। তিনি যেন অতিসত্বর গজনীতে চলে আসেন। এই পত্রপাওয়ার পরই ফেরদৌসী পুনঃযাত্রা করে হেরাত থেকে গজনী এসে পৌঁছেন।বদিউদ্দীনের এই পত্র প্রেরণ এবং ফেরদৌসীর গজনী আগমন সম্পর্কে উনসুরী কিছুইজানতেন না। তাই ফেরদৌসী যখন গজনী এসে পৌঁছেন তখন এক মজার ঘটনা ঘটে।
 
ফেরদৌসীযখন গজনী এসে পৌঁছেন ঘটনাক্রমে উনসুরী তখন তার কবি বন্ধু ফররুখী এবংআসজাদীকে নিয়ে বাগানে আড্ডা দিচ্ছিলেন। ফেরদৌসী তখন রাজদরবারের পথ খুঁজতেখুঁজতে তাদের আড্ডায় গিয়ে হাজির হন। কবিরা বিরক্ত হয়ে বলেন, কবিদের আড্ডায়তুমি অকবি তো অভাজনই বটে। জবাবে ফেরদৌসী বলেন আমিও একজন নগণ্য কবি। কবিরাতাচ্ছিল্যের স্বরে বলে, আচ্ছা তাই নাকি? তো হয়ে যাক কবিতার লড়াই। আমরাতিনজনে তিনটি চরণ বলবো। চতুর্থ চরণটি বলতে হবে তোমাকেই। বলেই উনসুরী শুরুকরলেন :
 
চুন আরেজে তো মাহ নাবাশাদ রওশান
 
(যেহেতু তোমার আগমনে চাঁদ হয় না আলোকিত)
 
ফররুখী বললেন :
 
মানান্দে দেরাখতে গোল দার গোলশান
 
(ফুলবাগানে ফুলের গাছ যেমন)
 
আসজাদী বললেন :
 
মোজ্বেগানে তো হামি গোজার কোনাদ জওশান
 
(তোমার চোখের পাপড়িগুলো শুধুই ভেদ করে যায় লৌহবর্ম)
 
এদেরধারণা ছিল ফারসি ভাষায় ‘শান’ অন্তঃ দিয়ে এই তিনটি ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই।সুতরাং আগন্তুক নিশ্চিত আটকে যাবেন এবং তাদের কাছে তার কাব্যপ্রতিভারপ্রমাণ দিতে না পেরে লজ্জিত হবেন। কিন্তু ফেরদৌসী বললেন : মানান্দে সেনানেগিয়ু দার জাঙ্গে পেশান
 
(পেশানের যুদ্ধে গিয়ুর বর্শার ফলার মতো)
 
তখনতারা তিনজনই বিস্মিত হয়ে পেশানের যুদ্ধ এবং এই যুদ্ধের বীর গিয়ু সম্পর্কেজানতে চাইলেন। ফেরদৌসী তাদের পেশানের যুদ্ধ-ইতিহাস শোনালে তারা শুধুফেরদৌসীর কাব্যপ্রতিভায়ই মুগ্ধ হন না, তার ইতিহাস-জ্ঞান দেখেও বিস্মিত হন।পরবর্তী সময়ে ফেরদৌসী সুলতান মাহমুদের রাজদরারের ভার মহকের মাধ্যমে দরবারেএলে সুলতান মাহমুদ ফেরদৌসীর পরিচয় ও প্রতিভা নিশ্চিৎ হয়েই উনসুরীর পরিবর্তেতার ওপর শাহনামা রচনার দায়িত্ব অর্পণ করেন; যে কাজ ফেরদৌসী ইতোপূর্বেতুসে অবস্থানকালেই শুরু করেছিলেন সুলতান মাহমুদের পৃষ্ঠপোষকতায় দীর্ঘ ত্রিশবছরে গজনীতে এসে তিনি তা সমাপ্ত করেন। এবং এর মাধ্যমে তিনি বিলুপ্তপ্রায়ফারসি ভাষাকে পুনরুজ্জীবিত করেন। কারণ ইতোমধ্যে আরব মুসলিমগণ পারস্য বিজয়করে ফেলেছিল এবং ইসলাম-উত্তর পারস্য-পন্ডিতগণ তাদের মাতৃভাষা ফারসিরপরিবর্তে আরবিতে জ্ঞানচর্চা এবং গ্রন্থ রচনা করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। এসম্পর্কে ফেরদৌসী তার শাহনামাতেই উল্লেখ করেছেন :
 
বাসি রান্জ বোরদাম দার ইন সালে সি
 
আজাম জেন্দে কারদাম বেদিন পারেসি
 
(এই ত্রিশ বছর অনেক কষ্ট করেছি
 
এই ফারসির মাধ্যমে পারস্যকে পুনরুজ্জীবিত করেছি)
 
গজনীতেফেরদৌসী শাহনামা শুরু করেছিলেন ৯৮০ খ্রিস্টাব্দে আর শেষ করলেন ১০১০খ্রিস্টাব্দে, ষাট হাজার শ্লোকে। কিন্তু নিয়তির কী নির্মম পরিহাস। শাহনামারচনার সূচনাকালেই ফেরদৌসী যে ষড়যন্ত্রের বেড়াজালে আটকা পড়ে গিয়েছিলেন তাথেকে আর বেরুতে পারলেন না। রচনা সমাপ্ত করে ফেরদৌসী যখন সুলতান মাহমুদেরহস্তে এই উপঢৌকন তুলে দিলেন এবং রাজদরবারে এটি পাঠ করা হলো তখন নিন্দুকেরাএর কাহিনী শুনে বলতে লাগল জাহাপনা একি করেছে ফেরদৌসী? আপনার ফরমায়েশে লেখাশাহনামায় আপনার গুণকীর্তন খুব অল্প জায়গাজুড়ে রয়েছে, সমস্ত জায়গাজুড়ে দেখছিঅন্যান্য রাজ-রাজড়াদের কাহিনী-কীর্তন। নিন্দুকদের কথা সত্যি হলেও এরউদ্দেশ্য যে মহত নয় সেটি সুলতান বুঝতে পারলেন না। এটি তো খুবই স্বাভাবিকযে, চার হাজার বছরের ইরানের কথা-কিংবদন্তি, লোকবিশ্বাস আর পারস্যেরপ্রাগৈতিহাসিক বাদশাহ কিয়ুমার্সসহ উনচল্লিশ জন রাজরাজড়া ও শতাধিক মহৎ বীরেরসৌর্যগাথা বিবৃত হওয়া ষাট হাজার শ্লোকে সুলতান মাহমুদের মাত্র ত্রিশ বছরশাসনকালের বর্ণনা এরচে’ বেশি জায়গাজুড়ে স্থান দেওয়া কি যুক্তিযুক্ত ছিল?
 
কিন্তুসুলতান সেই যুক্তি-বিচারে না গিয়ে নিন্দুকদের কথায়ই কান ভারি করলেন। নিজেরপ্রতিশ্রুত প্রতিটি পঙ্ক্তির বদলে একটি করে স্বর্ণমুদ্রা না দিয়ে কবিকেষাট হাজার রৌপ্য মুদ্রা প্রদানের নির্দেশ করলেন। সুলতানের এই অবিচক্ষণতা ওঅবিবেচনা দেখে ফেরদৌসী বিস্মিতই শুধু হলেন না, ভীষণ রকম মর্মাহতও হলেন।সুলতানের পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করে পরদিন ভোরে কাউকে কিছু না বলেই গজনীত্যাগ করে স্বীয় জন্মভূমি তুসে চলে গেলেন কবি। তবে যাবার আগে সুলতানের এহেনআচরণের জবাবে একটি নিন্দাসূচক কবিতা রচনা করে তার একটি কপি রাজকীয়গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত শাহনামার একটি কপির শেষে সংযুক্ত করে গেলেন। আর একটিকপি টাঙিয়ে দিয়ে গেলেন গজনীর শাহি মসজিদের দেয়ালে। যেখানে অভিমানি কবিসুলতানের বংশ পরিচয় নিয়ে এভাবেই প্রশ্ন তুলেছেন :
 
সুলতান যদি (স্বভাবে) দরিদ্র না হতেন,
 
তবে আমাকে আজ সিংহাসনে বসানো হতো।
 
কাজেই আশা করবো, কোনো নরপতির মধ্যে যেন দীনতার অস্তিত্ব মাত্র না থাকে,
 
পৌরুষের সঙ্গে যেন দারিদ্র্যের সহ-অবস্থান না ঘটে।
 
প্রজ্ঞার উপর সুলতানের ছিল না কোনো অধিকার,
 
থাকলে তিনি আমাকে আজ নিশ্চিতই সিংহাসনে বসাতেন।
 
সিংহাসনের অধিকারী যদি অভিজাত না হয়,
 
তবে সিংহাসনধারীগণের স্মৃতি তার মনে উদিত হতে পারে না।
 
সুলতানের পিতা যদি সুলতান হতেন,
 
তবে আমার শিরে আজ রক্ষিত হতো স্বর্ণ-মুকুট
 
যদি সুলতানের মাতা কোনো রাজপরিবারের কন্যা হতেন,
 
তবে আমাকে জঙ্ঘাদেশ পর্যন্ত প্রোথিত করা হতো স্বর্ণ-রৌপ্যের স্তূপের মধ্যে।
 
যদি বংশমধ্যে মাহাত্ম্য না থাকে,
 
তবে মহত্ত্বের লক্ষণ সেখানে কেমন করে প্রকাশ পাবে?
 
হে উঁচুবংশীয় নরপতি মাহমুদ, তোমার মুখে থুথু!
 
এইনিন্দাকবিতাটি বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশে এত বেশি পরিচিত যে, শাহনামারঅপর কোনো একটি পঙ্ক্তিও যাদের জানা নেই তারাও এই অপবাদ-সূচক কবিতাটিরদু’চার পঙ্ক্তির উদ্ধৃতি দিতে পারেন। ফেরদৌসী এতে যে শুধু সুলতান মাহমুদেরনিন্দাই করেছেন তাই-ই নয়, বরং এই নিন্দা-কবিতায় তিনি তার কাব্যপ্রতিভা ওশাহনামার স্থায়িত্ব নিয়ে তার যে আত্মবিশ্বাসমূলক উক্তি করেছেন কালেরবিবর্তনে তা আজ মহাসত্যে পরিণত হয়েছে। এতে ফেরদৌসী আরও বলেছিলেন :
 
বহু অর্থময় বাণীর মুক্তা আমি এতে গ্রথিত করেছি।
 
যদি পৃথিবীতে ফেরদৌসীর জন্ম না হতো,
 
তবে তরুতে উদ্গত হতো না বদান্যতার কিশলয়।
 
যদি এই কাহিনীর দিকে আমি দৃষ্টিপাত না করতাম,
 
তবে তা মিথ্যাবাদীদের দ্বারা অন্যপথে পরিচালিত হতো।
 
যারা আমার এই কবিতাকে তুচ্ছজ্ঞান করবে,
 
আবর্তমান আকাশ তাদেরকে হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে যাবে না।
 
আমি এই কাব্যে প্রাচীন সম্রাটদের কাহিনীর মাধ্যমে
 
নিজেদেরই কথা সূক্ষ্মভাবে বর্ণনা করেছি।
 
বাণীর মাধ্যমে ধরিত্রীকে আমি ফুলবনের অনুরূপ করে সাজিয়েছি,
 
আমার পূর্বে বাণীর এমন বীজ কেউ আর বপন করতে পারেনি।
 
অগণিত কবি জন্মেছেন এই পৃথিবীতে,
 
তারা সংখ্যায় অনেক ছিলো তাও স্বীকার করি,
 
কিন্তু একথা নিশ্চিত যে, এমন করে কেউ আর বলতে পারেননি।
 
দীর্ঘ ত্রিশ বছর ধরে পরিশ্রমের পর
 
এই পারসি দ্বারা ইরানকে আমি পুনরুজ্জীবিত করে গেলাম।
 
সুলতানমাহমুদের আচরণে বিস্মিত হয়ে লেখা নিন্দাসূচক এই দীর্ঘ কবিতায় ফেরদৌসীসুলতান মাহমুদের নিন্দার পাশাপাশি সংক্ষেপে এর বিষয়বস্তুর প্রতিও এভাবেআলোকপাত করেছেন :
 
এই কাহিনীতে আমি ত্রিশ হাজার শ্লোকের পানপাত্র আবর্তিত করেছি,
 
তাতে কীর্তিত হয়েছে রণক্ষেত্রের রীতি-নীতি;
 
আমি এতে বর্ণনা করেছি তীরধনুক ও পাশের কথা,
 
প্রহরণ ও তরবারির কার্যকারিতার কথা এতে ব্যক্ত হয়েছে।
 
এতে আছে বর্ম, তনুত্রাণ ও শিরস্ত্রাণ,
 
আছে অরণ্য ও সমুদ্র, আছে মরুভূমি ও বহতা নদী;
 
নেকড়ে, সিংহ, হস্তী ও ব্যাঘ্রের কথাও এখানে রয়েছে,
 
দৈত্য, আজদাহা ও নত্রের রূপকথাও স্থান পেয়েছে এতে।
 
এতে আছে মন্ত্রোচ্চারণকারীদের মন্ত্র ও দৈত্যদের ইন্দ্রজাল,-
 
যাদের গর্জন বায়ুরাশিকে দীর্ণ করেছে।
 
যুদ্ধের দিনে শক্তিপরীক্ষায় যেসব বীর
 
তাদের বীরত্ব ও ঔদ্ধত্যের পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন,
 
সেই সব খ্যাতনামা ও পরম সম্মানিত পুরুষের কাহিনীও বর্ণিত হয়েছে এই কাব্যে;
 
তাদের মধ্যে রয়েছেন তূর, সুলম্ ও আফ্রাসিয়াবের মতো নরপতি;
 
রয়েছেন ফারেদুন ও কায়কোবাদের অনুরূপ বাদশাহ,
 
জোহাকের মতো বিধর্মী, অত্যাচরী ও অসভ্য সম্রাটের কথাও এতে আছে।
 
আরো আছেন, র্গাশাসপ ও নূরীমান-পুত্র সামের মতো বীর-
 
যারা বিশ্ববিখ্যাত পুরুষদেরকেও পরাভূত করতে সক্ষম হয়েছেন।
 
হোশাঙ্গ ও দৈত্যদমন তহমূরসের কাহিনীও এতে আছে,
 
আছে মুনুচেহের ও সমুচ্চ সম্রাট জামশেদের কীর্তিগাথা।
 
কায়কাউস ও কায়খসরুর মতো মুকুটধারী সম্রাট
 
এবং রুস্তম ও ইসফান্দিয়ারের অনুরূপ সেনাপতিদের কাহিনীও
 
বর্ণিত হয়েছে এই ‘নামায়’।
 
জীবনও জগৎ ব্যাপকাকারে চিত্রিত হলেও, হোমারের ইলিয়ড-ওডিসি কিংবা ভারতবর্ষেররামায়ণ-মহাভারত কিংবা প্রাচীন মিসরের গিলগামেশ যে ধরনের মহাকাব্য, শাহনামাসে ধরনের মহাকাব্য নয়। ইলিয়ড-ওডিসি, রামায়ণ-মহাভারত ও গিলগামেশ-এর নিয়ামকশক্তি কাল নয়- স্থান। সেখানে গ্রিস ও ট্রয়, অযোধ্যা ও লঙ্কা, হস্তিনাপুর ওকুরুক্ষেত্র এবং প্রাচীন মিসরকে কেন্দ্র করেই ঘটনা আবর্তিত হয়েছে; একেরপতনে অন্যের মহিমা সেখানে ভাস্বর। অন্যপক্ষে ফেরদৌসীর শাহনামাকে নিয়ন্ত্রিতকরেছে মহাকাল। যে কালের বহমান স্রোতে ঘটনা ও স্থান মুহূর্তের জন্যউদ্ভাসিত হয়ে বিলীন হয়ে যায়, সেখানে রাজা ও রাজবংশের উত্থান-পতনে, বীরদেরশৌর্যে ও সম্রাটদের মহানুভবতায় এক মূল্যবোধের উদ্ভব ঘটেছে, এবং শেষ পর্যন্ততা মানুষের হাতে আসছে উত্তরাধিকার সূত্রে ইতিহাসেরই শিক্ষা হয়ে। তবে তাইবলে শাহনামা ইতিহাস গ্রন্থ হয়ে ওঠেনি। শাহনামা হয়ে উঠেছে মহাকালের মহাকথন।ইতিহাসের অস্থিসংস্থান অতিক্রম করে সেখানে দেদীপ্যমান হয়ে উঠেছে কবিরকল্পনা। জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার সহায়তায় জীবনের এমন এক প্রবহমানরূপ সেখানে ফুটেউঠেছে, যার পটভূমিতে কখনও সমতলভূমি, কখনও পর্বত, কখনও নদী-উপত্যকা, কখনওমরুভূমি, কখনও দীপাবলী সজ্জিত সমুন্নত নগরী। এই পটভূমি ইরান-তুরান, চীন-ভারত যাই হোক না কেন, কবি তা অবলীলায় অতিক্রম করে চলেছেন। কালাশ্রিতহয়েও কালাতীত তেমন মূল্যবোধের ওপরই স্থাপিত হয়েছে শাহনামার সৌধ। সত্যের জয় ওমিথ্যার পরাজয়ের ওপরই চিরদিন মহৎ কাব্যের বিষয়বস্তু সংস্থিত হলেও শাহনামায়তা মানবীয় প্রজ্ঞার কেন্দ্রস্থলে বিরাজ করে প্রত্যেকটি ঘটনাকে নিয়ন্ত্রণকরছে; বলকে উজ্জীবিত করছে বীর্যে।
 
ফেরদৌসীর শাহনামার ইতিহাস পৃথিবীরসৃষ্টি থেকে শুরু করে সপ্তম শতাব্দীতে পারস্যে ইসলামের বিজয় পর্যন্তসম্প্রসারিত। এতে তিনি অন্তর্ভুক্ত করেছেন ৬২টি আখ্যান, ৯৯০টি অধ্যায় এবং৬০ হাজার পঙ্ক্তি। এ এক বিস্ময়কর শক্তির পরিচায়ক। প্রাচীন ইতিহাসনির্ভরমহাকাব্যে মৌখিক এবং লিখিত সাহিত্যের যে পরস্পর প্রবিষ্ট সাহিত্যশৈলীলক্ষ্য করা যায় শাহনামাতেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। এটি প্রাচীন সভ্যতা ওসংস্কৃতির বিকাশধারা সংক্রান্ত এক অতুলনীয় আকর গ্রন্থ। এতে যেমনপ্রাক-ইতিহাস, ইরান ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলের সভ্যতা বিকাশের নানা উপাদান যেমন-আগুনের ব্যবহার, রান্নাবান্না, আইন-কানুন ও সামাজিক বিধিবিধানসহ বহু বিষয়যুক্ত হয়েছে, তেমনি সহস্রাধিক বছরের কালক্রমিক ইতিহাস ও মানব সমাজেরইতিহাসের ধারায় পথচলার নানা মূল্যবান বিবরণও এতে পাওয়া যায়। এসব বর্ণনায়তিনি যে বিষয়টির ওপর জোর দিয়েছিলেন তা হলো এই পৃথিবী চলমান এবং এই পৃথিবীতেমানুষ ইতিহাসের পথে যুগযুগান্তের পথপরিক্রমায় আসে আর যায়। সে জন্যই তাদেরবিজ্ঞতার সঙ্গে নিষ্ঠুরতা, মিথ্যাচার এবং সব অশুভ কল্পনা বর্জন করেসুবিচার, সত্য, ন্যায়, শৃঙ্খলা এবং অন্যান্য গুণ অর্জন করে বিশ্বসভ্যতায়তার ছাপ রেখে যাবে।
 
ফেরদৌসী তার শাহনামা রচনা সমাপ্ত করেন ১০১০খ্রিস্টাব্দে। ২০১০ খ্রিস্টাব্দে এ গ্রন্থের সহস্রবর্ষ পূর্ণ হলেওসারাবিশ্বে এর আবেদন এখনও একটুও কমেনি। এ যেন শাহনামার অন্তে যুক্ত সুলতানমাহমুদকে ভর্ৎসনা করে রচিত নিন্দাকাব্যে ফেরদৌসী যে আত্মবিশ্বাস ব্যক্তকরেছিলেন তারই কালোত্তীর্ণ জাজ্বল্য প্রমাণ। শাহনামা ইরান-তুরানের রাজরাজড়াও বীরদের কাহিনী হওয়া সত্ত্বেও আজ তা বিশ্বজনীন হয়ে উঠেছে। দীর্ঘ সহস্রবছরেও শাহনামার জ্ঞান-প্রভা একটুও ম্লান না হয়ে বরং দিন দিন আরও উজ্জ্বলতরহয়েছে। বিশ্বের বহু ভাষায় অনূদিত হয়ে পঠিত ও সমাদ্রিত হয়েছে ফেরদৌসীরশাহনামা। এর অন্যতম আখ্যান সোহরাব-রুস্তম আজ আর ইরান-তুরানের কাহিনী নয়।বাংলাদেশের জনমানুষের সঙ্গে এর কাহিনী অবিচ্ছেদ্য সূত্রে জড়িয়ে আছে। আমাদেরযাত্রায়, নাটকে, লোককথায় এ কাহিনী এমনভাবে সম্প্রচার লাভ করেছে যে, আজ আরএকে বিদেশি বলে চেনার উপায় নেই। এ যেন আমাদের ঐতিহ্যেরই অংশ। এই গুরুত্বেরদিকে লক্ষ্য করেই পৃথিবীর অন্যান্য ভাষার মতো বাংলা ভাষায়ও শাহনামারপূর্ণাঙ্গ অনুবাদ করেন কবি মনিরউদ্দীন ইউসুফ এবং বাংলা একাডেমী সেটিপ্রকাশও করে।
 
কবি মনিরউদ্দীন ইউসুফকে বাংলা একাডেমী শাহনামারবঙ্গানুবাদের দায়িত্ব দিয়েছিলেন ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দের শেষ দিকে। অনুবাদের শেষকিস্তি পান্ডুলিপি তিনি দেন ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে। এ হিসাব মতে শাহনামা রচনাশেষ করতে ফেরদৌসীর যেখানে সময় লেগেছিল ত্রিশ বছর তার অনুবাদ শেষ করতে কবিমনিরউদ্দীন ইউসুফের সময় লাগে সতেরো বছর। তবে ফেরদৌসীর মতো মনিরউদ্দীনকেওবরণ করতে হয় একই বঞ্চনার ভাগ্য। ফেরদৌসী তার জীবৎকালে ষাট হাজার স্বর্ণমুদ্রা পাননি। সুলতান মাহমুদের স্বর্ণ মুদ্রা যখন ফেরদৌসীর বাড়ির দরজায়পৌঁছে তখন আরেক দরজা দিয়ে ফেরদৌসীর শবযাত্রা বের হচ্ছে। বাংলা একাডেমীওমনিরউদ্দীন ইউসুফের জীবদ্দশায় এর পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ প্রকাশ করতে পারেনি।১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বময় শাহনামা রচনার সহস্রবার্ষিকী উৎসব উপলক্ষে বাংলাএকাডেমী অনুবাদকের পরিকল্পনা অনুসারে ছয় খন্ডে সমগ্র শাহনামার বাংলাঅনুবাদ প্রকাশ করে। যদিও এর প্রথম কিয়দংশ দুটি খন্ডে, যথাক্রমে ১৯৭৭ ও ১৯৭৯খ্রিস্টাব্দে বাংলা একাডেমী প্রকাশ করেছিল।
 
তবে ভারতীয় উপমহাদেশেশাহনামার একটি পান্ডিত্যপূর্ণ সংকলন প্রকাশিত হয় আরও অনেক আগে, ১৮২৯খ্রিস্টাব্দে। এটি সঙ্কলন ও সম্পাদনা করেন টি. ম্যাকান। সতেরটি পান্ডুলিপিরতুলনামূলক যৌগিত সম্পাদনার মাধ্যমে এটি প্রস্তুত করা হয়। ফ্রান্স, রাশিয়াপ্রভৃতি অঞ্চলে শাহনামার বেশ ক’টি গুরুত্বপূর্ণ সঙ্কলন প্রকাশিত হলেওভারতবর্ষের অন্য কোনো অঞ্চলে ম্যাকানের সঙ্কলনের আগে এর পূর্ণাঙ্গ, সুসম্পাদিত সঙ্কলনের খবর আমরা পাই না। তবে মুঘল সম্রাটরা যে এ গ্রন্থটিগুরুত্বের সঙ্গে পাঠ করতেন তার প্রমাণ আছে বাবর, আকবর, জাহাঙ্গীর, শাহজাহানপ্রমুখের শাহনামার সঙ্গে পরিচয়ের সূত্রে। কারণ প্রথম মুঘল সম্রাট বাবরশাহনামা থেকে কিছু পঙ্ক্তি উদ্ধৃত করেছিলেন। বাংলার নবাব আলীবর্দী খাঁওশাহনামা পাঠ করে উদ্দীপ্ত হয়েছিলেন- এমন সংবাদ জানা যায়।
 
ইতোপূর্বেবাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলে বিচ্ছিন্নভাবে শাহনামা বিষয়ে কোনো কোনো গ্রন্থপ্রকাশিত হলেও এই গ্রন্থের কোনো সম্পূর্ণ সঙ্কলন ইতোপূর্বে প্রকাশিত হয়নি।বাংলা একাডেমীর প্রথম শাহনামার পূর্ণাঙ্গ বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করেন।প্রকাশের পর থেকেই এটি ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা পায়। তাই অল্প ক’বছরেই এর সব কপিনিঃশেষ হয়ে যায়। বাংলা ভাষাভাষী বেশির ভাগ পাঠকই অতৃপ্ত থেকে যান এইমহাকথন পাঠ করতে না পেরে। তাদের এই অতৃপ্তির কথা ভেবেই দীর্ঘদিন পর হলেও২০১২ খ্রিস্টাব্দে বাংলা একাডেমী এর দ্বিতীয় মুদ্রণ প্রকাশ করেছে। বাংলাভাষাভাষী পাঠকদের প্রতি এই সম্মান প্রদর্শনের জন্য বাংলা একাডেমীনিঃসন্দেহে ধন্যবাদ প্রাপ্ত।
 
বলাবাহুল্য শাহনামার বাংলা অনুবাদেরপ্রথম মুদ্রণে অর্থায়ন করেছিল ইরান সরকার। দ্বিতীয় সংস্করণ সম্পূর্ণ বাংলাএকাডেমীর অর্থায়নেই প্রকাশিত হয়েছে।সে জন্য শাহনামা পাঠকদের পক্ষ থেকেবাংলা একাডেমীর প্রতি রইল আরও একটি বিশেষ ধন্যবাদ। আর পাঠকদের আমন্ত্রণরইলো এই মহাকাব্য অধ্যয়নের।