দ্বিজেন শর্মা: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

বিষয়বস্তু বিয়োগ হয়েছে বিষয়বস্তু যোগ হয়েছে
WikitanvirBot I (আলোচনা | অবদান)
বট কসমেটিক পরিবর্তন করছে, কোনো সমস্যা?
৩ নং লাইন:
== ব্যক্তিগত জীবন ==
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভক্ত। আড্ডা, বিশেষ করে তরুণদের সাথে আড্ডা দিতে খুব পছন্দ করেন।<ref>সাক্ষাৎকার: ''যা নিয়ে আছি:মর্ত্যে স্বর্গের আলো'', সাক্ষাৎকার গ্রহণে: মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ, অন্য আলো, দৈনিক প্রথম আলো, পৃষ্ঠা ২, ১০ ডিসেম্বর ২০১০।</ref>
 
দ্বিজেন শর্মা
 
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, কার্জন হলের সামনে বোটানিক্যাল উদ্যানের লাগোয়া গ্লিরিসিডিয়া গাছটির সঙ্গে পরিচয় ভোলার নয় দ্বিজেন শর্মার। "বসন্তের শুরুতেই নিষ্পত্র শাখাগুলিতে বেগুনির আঁচ মেশানো সাদা ফুলের ঢল নামতো। একটি কোকিল গাছটিতে বসে সারাদিন অবিরাম ডাকতো। দক্ষিণ হাওয়ায় একটি দু'টি করে ফুল ঝরতো। আমরা প্রতি সন্ধ্যায় ওই গাছতলায় আড্ডা বসাতাম। আবছা আলোয় ক্রমে কার্জন হলের মোগল স্থাপত্য রহস্যময় হয়ে উঠতো। কার্জন হলের কাছে সেগুন বাগিচার মোড়ের পথ দ্বীপে পুরনো বটগাছের আশ্রয়ে বেড়ে ওঠা বাগানবিলাসের একটি লতা ম্যাজেন্টা রঙের ফুলের ধ্বজা উড়িয়ে শহরে বসন্তের আগমনী ঘোষণা করত। স্পেক্টাবিলিস জাতের ওই বাগানবিলাসটি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাবাসী বহু প্রজন্মের জীবনের সঙ্গে অজান্তেই জড়িয়ে গিয়েছিল। সেই তো আমাদের জানাতো 'ওরে ভাই ফাগুন লেগেছে বনে বনে।' সাতাত্তরের বৃক্ষনিধনে বেইলী রোডে নাগলিঙ্গম, রমনা পার্কের লাগোয়া সেগুনবীথি, নিউমার্কেটের পাশের বটগাছের সারির সঙ্গে আমাদের যৌবন দিনের স্মারণিক ওই বাগানবিলাসটিও নিহত হয়।" কথাগুলো বলতে বলতে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন দ্বিজেন শর্মা। গাছের প্রাণের সঙ্গে নিজের প্রাণের অস্তিত্ব যিনি অনুভব করেন তাঁর পক্ষেই নিজের সন্তানের মতো বৃক্ষকে আপন করে নেওয়া সম্ভব। আর দ্বিজেন শর্মা তাঁর জীবনভর সেই কাজটিই করেছেন। নিভৃতচারী ও প্রচারবিমুখ এই উদ্ভিদবিদ, বিজ্ঞান মনস্ক শিক্ষাবিদ-তাঁর নিসর্গ প্রেমকে ধারণ করেছেন নিজস্ব আঁধারে। গাছের সঙ্গে কথা বলা আর তাদের ভালোবাসা আদান-প্রদানের মাঝেই কেটে গেছে তাঁর জীবনের অনেকটা পথ।
 
জন্ম ও পারিবারিক পরিচয়
 
১৯২৯ সালের ২৯ মে সিলেট বিভাগের বড়লেখা থানার শিমুলিয়া গ্রামে ভিষক চন্দ্রকাণ্ড শর্মা ও সমাজসেবী মগ্নময়ী দেবীর ঘরে জন্ম নেন দ্বিজেন শর্মা৷ বাবা ভিষক বা গ্রাম্যভাষায় কবিরাজ ছিলেন বলে বাড়িতেই দেখেছেন নানা লতা-পাতা আর বৃক্ষের সমাহার। প্রজাপতি ডানা মেলা দিনগুলোতে পাথারিয়া পাহাড়ের আরণ্যক নিসর্গে ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি। সেখান থেকেই হয়তো গাছ-পালার প্রতি তাঁর এই ভালোবাসার জন্ম।
 
শৈশবকাল
 
ফুলের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের সেই মধুর দিনক্ষণটি দ্বিজেন শর্মার মনে নেই। কিন্তু শৈশব-কৈশোরেই যে তিনি গাছের জন্য রক্তের মাঝে টান অনুভব করতেন, তা বেশ মনে পড়ে। বাড়ির বাগানে অজস্র গাছগাছালির মধ্যে ছিল স্বর্ণচাঁপা, কনকচাঁপা, মধুমালতীসহ নানা রঙবেরঙের ফুল। বসন্ত শেষের বৃষ্টির পর সারা বাড়ি ফুলে ফুলে ভরে উঠতো। দ্বিজেন শর্মা সকালে পূজার ফুল তুলতেন। সেখানে দেখতেন অশোক পরেছে সারা গায়ে থোকা থোকা লাল-হলুদ জড়োয়া আর ফুলের তোড়া হয়ে উঠেছে পুষ্পপাগল গোলকচাঁপার গাছটি। ভোরের আলোয় কাঁপতো কচিপাতার সবুজ বাতাস, উতলা হতো ফুলের মধুগন্ধে। সেইসব আশ্চর্য দিনে পৃথিবীর সব কিশোরের মতো দ্বিজেন শর্মাও প্রকৃতির প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন। তিনি কৈশোরের একটি দিনের কথা বললেন, "সরস্বতী পূজার সময় ফুল খুঁজতে গিয়ে ভিন্ন গাঁয়ে এক বৈষ্ণবীর আখড়ায় গাঁদা ফুলের একটি আশ্চর্য বাগান দেখেছিলাম। সারা উঠোনে ফুলের সে কী সমারোহ : হলুদ, কমলা, গাঢ় লাল, যেন রঙের বিস্ফোরণ। তার গোপালসেবার জন্য মানতি বলে বৈষ্ণবী আমাকে একটি ফুলও তুলতে দেননি। সেদিন বাড়ি ফেরার সময় পথ হারিয়ে এক বিলের কাছে পৌঁছে যে দৃশ্য দেখেছিলাম, আজও তা মনে আছে। আদিগন্ত দুর্বাশ্যামল মাঠ, মাঝে মাঝে হিজলবন, ছড়ানো ছিটানো বনগোলাপ আর পুষ্পিত ভুঁইওকরার ঝোপ, বিলের স্বচ্ছ জলে রঙ বেরঙের হাঁস, যেন এক স্বপ্নের দেশ। অনেকক্ষণ ওখানে দাঁড়িয়ে ফুল না পাওয়ার দুঃখটাই ভুলে গিয়েছিলাম।"
 
দ্বিজেন শর্মার বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে উত্তরে তাকালে দেখা যেত নিকড়ি নদী, মৌলভী সাহেবের মাজার, ধানক্ষেত, দূর দিগন্তে খাসিয়া পাহাড়ের নীলাভ ঢেউ। মাজারের কাছেই ছিল কয়েকটি জারুল গাছ। প্রতি গ্রীষ্মে গাছগুলি বেগুনি রঙের ফুলে আচ্ছন্ন হতো, রঙিন মিনারের মতো দাঁড়িয়ে থাকা ওই গাছগুলির ঝরে পড়া ফুলে কবর ভূমি ঢেকে যেত। জন্মভূমির এই অনুপম দৃশ্যপট দ্বিজেন শর্মার আজও মনে পড়ে। শৈশব- কৈশোরের স্মৃতিতে অম্লান হয়ে আছে লাল ঘন্টা ফুল আর কাঞ্চনের সঙ্গে পাহাড়ী পথ। নিবিড় অরণ্যঘেরা ওই নির্জন পথের দু'পাশে ফুটতো সাদা নাগবল্লী, জংলী জুঁই সহ বহুজাতের অর্কিড। আরও ছিল ফুলকে হার মানানো রঙ বেরঙের পাখিরা- কালো ময়না, সবুজ-পাটকিলে ডানার হরিয়াল, সিঁদুর-লাল আলতাপরী, লালবুক শ্যামা, সুকন্ঠী ভিংরাজ এবং ওদের কলকাকলীর অপূর্ব অর্কেস্ট্রা। কোনও দিন হঠাত্‍ দমকা হওয়ায় অরণ্যে দোলা লাগতো। মাটির বন্ধনমুক্তির ব্যর্থ আর্তিতে অরণ্য যেন মাথা কুটতো৷ জল মর্মরের মতো সেই গোঙানি কিছুতেই শেষ হতো না। পুষ্পিত বনজুঁই কেঁপে কেঁপে ফুল ঝরাত আর দ্বিজেন শর্মা নির্বাক বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে তা দেখতেন। এভাবেই অরণ্যের মাঝে কেটে যায় তাঁর শৈশবের আনন্দময় দিনগুলি।
 
শিক্ষাজীবন
 
শৈশবেই গ্রামের পাঠশালায় তাঁর হাতেখড়ি হয়। তারপর করিমগঞ্জ পাবলিক হাইস্কুলে পড়াশুনা। মায়ের ইচ্ছে ছিল ছেলে ডাক্তার হবে কিন্তু প্রকৃতিপ্রেম তাঁকে উদ্ভিদবিজ্ঞানের প্রতি আকৃষ্ট করল। আর তাই কলকাতা সিটি কলেজে স্নাতক ডিগ্রি লাভের পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উদ্ভিদবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর (১৯৫৮) ডিগ্রি লাভ করেন।
 
কর্মজীবন
 
১৯৫৮ সালে বরিশালের ব্রজমোহন কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬২ সাল পর্যন্ত সেখানেই কর্মরত ছিলেন। তারপর শিক্ষকতা শুরু করেন ঢাকার নটরডেম কলেজে। ১৯৭৪ সালে সোভিয়েত প্রকাশনা সংস্থা প্রগতি প্রকাশনের অনুবাদকের চাকরি নিয়ে চলে যান মস্কো। তিনি চল্লিশটিরও বেশি বই অনুবাদ করেছেন। মস্কোর মাটিতে প্রথম পা রেখেই মস্কোকে ভালোবেসে ফেলেছিলেন। ১৯৯১ সালের এপ্রিল মাসে অনুবাদ বন্ধ করার নির্দেশ পাওয়ার পর ওই দেশের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সব সম্পর্ক চুকে গিয়েছিল। কিন্তু ১৭ বছরের ভালোবাসা তাঁকে সেখানকার মাটির সঙ্গে যেভাবে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধেছে, সেগুলো সম্পূর্ণ উপড়ে ফেলা পরবর্তী সময়ে আর সম্ভব হয়নি।
 
বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে পরোক্ষ সংযোগের কারণে কিছুকাল আত্মগোপন, এমনকি কারাবাসেরও অভিজ্ঞতা হয়েছে, যাকে তিনি দুর্লভ সৌভাগ্য মনে করেন। সত্তরের জলোচ্ছ্বাসে দুর্গত মানুষের সেবাকার্যে যোগ দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের অধিকাংশ সময়ই কাটিয়েছেন বাংলাদেশে। দ্বিজেন শর্মার ভাষায়,'তখনই স্বদেশ আত্মার জ্যোতির্ময় রূপের ক্ষণিক উদ্ভাস প্রত্যক্ষ করেছি।' ভ্রমণ করতে ভালোবাসেন, প্রবাসপূর্ব জীবনে ঘুরে বেড়িয়েছেন সারা বাংলাদেশ। শৈবাল ও অন্যান্য উদ্ভিদের নমুনা সংগ্রহের জন্য চষে ফিরেছেন বাংলাদেশের যত খাল-বিল হাওর-বাওড়।
 
পারিবারিক জীবন
 
ব্যক্তিজীবনে দ্বিজেন শর্মা নিসর্গ ও তাঁর পরিবারকে এক সঙ্গেই দেখেছেন। তাঁর ভালোবাসার খণ্ড খণ্ড রূপেই প্রকাশ পেয়েছে তাঁর নির্সগ ও পরিজনেরা। ১৯৬০ সালে বরিশালে দেবী চক্রবতীর সাথে বিবাহ হয়। এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে তাঁর স্বপ্নময়তার শুরু হয়েছিল। এখন তারা বড় হয়েছে, ছোট্ট চারা গাছ থেকে মহিরুহ হয়েছে তাঁর যত্নে, তাঁর ছায়াতেই। পরিবারের অনেকটা সময় কেটেছে মস্কোতেই। মস্কোর দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে আকাদেমিকা আনোখিনা সড়কে এক বহুতল ভবনের নবম তলার যে ফ্যাটে দ্বিজেন পরিবারের কেটেছে অনেকগুলো বছর, সেটা এখনো দ্বিজেন শর্মার অন্যতম মূল গৃহ। একমাত্র পুত্র ডা: সুমিত শর্মা রুশ দেশে বিয়ে করে সংসার সাজিয়েছে মস্কোরই অন্যত্র। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত একমাত্র কন্যা শ্রেয়সী শর্মা বাস করেন বাংলাদেশে। পত্নী এখন বেশীর ভাগ সময় মেয়ের সঙ্গেই থাকেন। ড: দেবী শর্মা ঢাকার সেন্ট্রাল উইমেনস কলেজের দর্শনের সাবেক অধ্যাপিকা। দ্বিজেন শর্মা থাকছেন ৪২ সিদ্ধেশ্বরী রোডে অবস্থিত ক্রিস্টাল গার্ডেন এ্যাপার্টমেন্টে। এখনও তাঁর অনেক কাজ বাকি আর তাই নিয়েই তাঁর ব্যস্ত দিন কাটছে আপন নিবাসে।
 
সমাজতন্ত্র ভাবনা ও দ্বিজেন শর্মা
 
'শোষণ' সম্পর্কে কার্ল মার্কসের যুক্তি ব্যাখ্যাগুলোর সঙ্গে নিজের চিন্তাভাবনার সাদৃশ্য খুঁজে পান দ্বিজেন শর্মা। তিনি মনে প্রাণে নিজেকে একজন মার্কসবাদী মনে করেন। এমন একটা সময় ছিল যখন মাকর্সবাদকে তাঁর নিজের জীবনদর্শন বলে মনে হতো৷ দীর্ঘদিন ধরে সোভিয়েত ইউনিয়নে বসবাসের ফলে সমাজতন্ত্র সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতা যে দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে দিয়েছে, তা অনেকের চেয়েই আলাদা। সোভিয়েত ব্যবস্থাকে বাইরে থেকে দেখে আর খবরের কাগজ পড়ে এ দেশের অনেকেই সমাজতন্ত্রের পতন নিয়ে লিখেছেন। সেসব বইয়ের একটির মূল বক্তব্য হচ্ছে : সমাজতন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে তার অন্তর্নিহিত অসঙ্গতির কারণে, সমাজতন্ত্র একটি ইউটোপিয়া, অলীক স্বপ্নমাত্র, সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্র সত্তর বছর ধরে টিকে ছিল শুধু জবরদস্তির কারণে। আরেকটা মতও আছে - সেটা হলো : আমেরিকার সঙ্গে যোগসাজশ করে গর্বাচভ ও ইয়েলত্‍সিন সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিনাশ ঘটিয়েছেন। কিন্তু দ্বিজেন শর্মা ৩৪ বছর সোভিয়েত রাশিয়ায় বাস করেও এ ব্যাপারে কোন নিশ্চিত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেন নি। 'সমাজতন্ত্রে বসবাস' বইটিকে দ্বিজেন শর্মা নিজেই 'স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের ইতিবৃত্ত' বলে বর্ণনা করেছেন। বইটির ভূমিকায় তিনি লিখেছেন, "দীর্ঘকাল ওখানে বসবাস সত্ত্বেও সমাজতন্ত্রের গলদ ও সঙ্কটের আলামত কেন আঁচ করতে পারিনি এমন স্বাভাবিক প্রশ্ন অনেকেই জিজ্ঞেস করেন। প্রশ্নটি নিজেকেও করি, কোন সদুত্তর পাই না, অথচ অনেককে এ দেশে পা দেওয়া মাত্রই সমাজতন্ত্রের ভবিষ্যত্‍হীনতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে দেখেছি। আর্থার কুয়েসলারের 'ডার্কনেস অ্যাট নুন' বইটির কথা মনে পড়ে। পড়ার শুরুতে দিশেহারা হলেও শেষাবধি সামলে উঠেছি এবং ওগুলো বুর্জোয়া প্রচার বলে নিজেকে প্রবোধ দিয়েছি। গরিব দেশের অমানবিক সমাজের বাসিন্দার জন্য সমাজতন্ত্রে আস্থা স্থাপন ব্যতীত কি কোনো বিকল্প পথ থাকে? ধনবাদী রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীরা তো আমাদের সসম্মানে বেঁচে থাকার কোনো বিকল্প পথের দিশা দিতে পারেন না। তাই সমাজতন্ত্রে আত্মসমর্পণই একজন গরিব বা বিবেকবান মানুষের নিয়তিকল্প হয়ে ওঠে। সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্রের পতনের পরেও ব্যবস্থাটিকে নিছক ইউটোপিয়া বলে নাকচ করে দিতে পারিনি। তবু নানা প্রশ্ন, নানা সংশয়। এই বাস্তব অবস্থা এখন স্বতঃস্পষ্ট যে, সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন যতই রঙিন আর উদ্দীপক হোক না কেন, সেটি নির্মাণ সুকঠিন। আবার এটাও সত্যি যে কঠিন বলেই তা মানব প্রজ্ঞার আয়ত্তাতীত হতে পারে না। প্রকৃতির নিয়মগুলো আবিষ্কারের মাধ্যমে যেভাবে প্রকৃতিকে মানুষ পোষ মানিয়েছে সেভাবেই হয়তো সমাজ বিকাশের নিয়মগুলোর সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে একদিন এই সমস্যার নিষ্পত্তি তথা ব্যষ্টির বিকাশকে সমষ্টিক বিকাশের মধ্যে আত্তীভূত করা সম্ভব হবে।"
 
বিজ্ঞান নিয়ে ভাবনা
 
দ্বিজেন শর্মা আজীবন ভেবেছেন কীভাবে বিজ্ঞান ও শিক্ষাকে জনকল্যাণের সঙ্গে যুক্ত করা যায়। তিনি দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করেছেন, প্রযুক্তির প্রাধান্যের এ যুগে বিজ্ঞান ও শিক্ষা আপন সমাজপ্রেক্ষিত হারিয়ে যান্ত্রিক হয়ে উঠেছে। বিশেষীকরণ ও উপযোগবাদের কাছে সমর্পিত বিজ্ঞান ও শিক্ষা বিষয়ক পরিকল্পনায় ইতিহাস ও সামাজিক অনুষঙ্গগুলো নিদারুণভাবে উপেক্ষিত হয়েছে। আমাদের দেশে বিজ্ঞানকে মরূদ্যানের মতো সীমিত ও সঙ্কীর্ণ দেখতে পেয়ে দ্বিজেন শর্মা বলেন, "এটাই আমাদের বিজ্ঞান সাধনার মূল সঙ্কট। যতদিন মরুতে উর্বরতার প্রবল আবেগ সঞ্চারিত হবে না, ততদিন আমাদের স্কুলের কাঠের আলমারিতে আটকানো যন্ত্রপাতি'র মতো বিজ্ঞানও বন্দিদশা থেকে মুক্তি পাবে না। বলাবাহুল্য, এ জন্য যতই অর্থ ও শক্তি ব্যয় হোক, অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে না। তাই বিজ্ঞানীদের জন্য শুধু শিক্ষা ও গবেষণাই নয়, সমাজচিন্তায়ও মনোনিবেশ আবশ্যক।" বিজ্ঞানের সার্বিক বিকাশ কার্যত অগ্রসর অর্থর্নীতি ও গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার সঙ্গে সন্নিবদ্ধ। অনগ্রসর অর্থনীতির দেশে বিজ্ঞানীর দায়িত্ব তাই বহুমুখী। শুধু সত্যের অনুসন্ধানই নয়, সত্যের প্রতিষ্ঠাও তাঁর কর্তব্য। বিজ্ঞানী কেবল নিরাসক্তভাবে সত্যের সন্ধান করবেন, নাকি সমাজে সেই সত্য প্রতিষ্ঠা করার দায়িত্বও তাঁর এ নিয়ে ঘোর তর্ক আছে। শিক্ষক কী শেখাবেন, র্নিলিপ্তভাবে কেবলই তথ্য নামক জ্ঞান দান করবেন, নাকি সামাজিক দায়িত্ব শিক্ষার্থীদের মধ্যে সঞ্চারিত করাও তাঁর কাজ-এ নিয়ে তর্কের শেষ নেই। কিন্তু এ নিয়ে দ্বিধা দ্বন্দ্ব নেই দ্বিজেন শর্মার মনে। বিজ্ঞান ও শিক্ষাকে সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ও প্রেক্ষিত থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখতে তিনি মোটেই রাজি নন। কারণ তিনি দেখতেই পাচ্ছেন বিজ্ঞান গ্রিন হাউসের নিরাপদ আশ্রয়েই আটকা পড়ে আছে। আর তাতে এ দেশের কোনো উন্নতিই হয়নি। তিনি মনে করেন, অনুন্নত দেশে বিজ্ঞানের প্রসার বস্তুত উত্‍পাদিকা শক্তির বিকাশ। একটি প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা ও দেশগঠন সকল শ্রেণীর আত্মনিয়োগের ওপরই নির্ভরশীল। যতদিন এ পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হবে না, ততদিন আমাদের বিজ্ঞানও ছিদ্রযুক্ত পাত্রে জল ঢেলে তৃষ্ণা মেটানোর ব্যর্থ দুর্ভাগ্য থেকে মুক্তি পাবে না। এই চিন্তায় প্রভাবিত হয়ে তিনি ডারউইনকে নিয়ে তিনটি বই লিখেছেন, কেননা ডারউইনবাদ জ্ঞানের সকল শাখাপ্রশাখাকে প্রভাবিত আলোড়িত করেছে,বিজ্ঞানের সঙ্গে মানবাধিকার সেতুবন্ধন রচনা করেছে।
 
ক্ষেত্রভিত্তিক অবদান
 
নিভৃতিপ্রিয়, প্রচারবিমুখ উদ্ভিদবিদ, নিসর্গী, বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষাবিদ দ্বিজেন শর্মা সেই প্রজন্মের মানুষ যাঁরা এই উপমহাদেশের বৈপ্লবিক সব পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ সাক্ষী। কিন্তু এসব রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের মধ্যেই তিনি তাঁর প্রকৃতিপ্রেমকে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছেন। উদ্ভিদ বিজ্ঞানের ওপর পড়াশোনা থাকলেও তাঁর মধ্যে ছিল শিল্পবোধ আর দেখার চোখ, সুন্দরকে অন্বেষণের আকাক্ষা। মানবজাতির জন্য তাঁর মনে সব সময় এক অনিঃশেষ আশাবাদ ও শুভকামনা কাজ করে। লেখালেখির মধ্যেই তাঁর সৃষ্টিশীলতা ফুটে ওঠে বার বার। জীবনে প্রথম যে লেখা ছাপার অক্ষরে বেরিয়েছিল সেটি ছিল একটি গল্প, ১৯৪৯ সালে আই.এস.সি. ক্লাসের শেষবর্ষের কলেজ বার্ষিকীতে। সেটি ছিল একটি আত্নজীবনীমূলক গল্প। এক দরিদ্র ছাত্রের শিক্ষালাভের কঠোর সংগ্রামের কাহিনী, এরপর তত্‍কালীন পূর্ব পাকিস্তানের একাধিক দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য সাময়িকীতে তাঁর লেখা গল্প প্রকাশিত হয়েছিল। সেগুলোর বিষয়বস্তুও ছিল অভিন্ন, দারিদ্র্যের জীবনযুদ্ধ। সমাজতন্ত্র সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতাজাত যে দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠেছে, তা পুঁজিবাদী বিশ্বের সোভিয়েত গবেষক পণ্ডিতদের চেয়ে আলাদা। এসব বিষয় নিয়ে তিনি বেশ কিছু নিবন্ধ ও স্কেচধর্মী লেখা লিখেছেন।
 
রচিত গ্রন্থসমূহ
 
ক্রমিক বইয়ের নাম প্রকাশ সাল প্রকাশনা সংস্থা
১. শ্যামলী নিসর্গ ১৯৮০,১৯৯৭ বাংলা একাডেমী
২. সপুষ্পক উদ্ভিদের শ্রেণী বিন্যাস ১৯৮০ বাংলা একাডেমী
৩. ফুলগুলি যেন কথা ১৯৮৮, ২০০৪ বাংলা একাডেমী
৪. গাছের কথা ফুলের কথা ১৯৯৯ শিশু একাডেমী
৫. এমি নামের দুরন্ত মেয়েটি ১৯৯৫, ১৯৯৯ শিশু একাডেমী
৬. নিসর্গ নির্মাণ ও নান্দনিক ভাবনা ২০০০ ইউপিএল
৭. সমাজতন্ত্রে বসবাস ১৯৯৯ ইউপিএল
৮. জীবনের শেষ নেই ১৯৮০, ২০০০ জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন
৯. বিজ্ঞান ও শিক্ষা : দায়বদ্ধতার নিরিখ ২০০৩ জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন
১০. ডারউইন ও প্রজাতির উত্‍পত্তি ১৯৯৭ সাহিত্য প্রকাশ
১১. বিগল যাত্রীর ভ্রমণ কথা ১৯৯১ সাহিত্য প্রকাশ
১২. গহন কোন বনের ধারে ১৯৯৪ সাহিত্য প্রকাশ
১৩. হিমালয়ের উদ্ভিদরাজ্যে ডালটন হুকার ২০০৪ সাহিত্য প্রকাশ
১৪. বাংলার বৃক্ষ ২০০১ সাহিত্য প্রকাশ
১৫. সতীর্থ বলয়ে ডারইউন ১৯৭৪, ১৯৮৪, ১৯৯৯ মুক্তধারা
১৬. মম দুঃখের সাধন ১৯৯৪ সাহানা
 
সম্মাননা, স্বীকৃতি ও সংবর্ধনা
trans
কর্মক্ষেত্রে অবদানের জন্য বিভিন্ন সংস্থা থেকে দ্বিজেন শর্মা বিভিন্ন সময় সংবর্ধিত হয়েছেন।
 
ক্রমিক পুরস্কারের নাম পুরস্কার প্রদানকারী সংস্থা সাল
১. ড: কুদরত-এ খুদা স্বর্ণপদক চট্টগ্রাম বিজ্ঞান সমিতি ১৯৮৬
২. বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার বাংলা একাডেমী ১৯৮৭
৩. এম নুরুল কাদের শিশু-সাহিত্য পুরস্কার ২০০০
 
এছাড়া তিনি এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত বাংলাপিডিয়া গ্রন্থাবলীর জীববিদ্যা বিভাগের অনুবাদ ও সম্পাদক (২০০১- ২০০৩) এবং বাংলা একাডেমীর সম্মানিত ফেলো।
 
== রচনাবলী ==