বিয়েট্রিস হিকস

মার্কিন প্রকৌশলী

বিয়েট্রিস এলিস হিকস (২রা জানুয়ারি, ১৯১৯ – ২১ শে অক্টোবর, ১৯৭৯) ছিলেন একজন আমেরিকান প্রকৌশলী, যিনি সর্বপ্রথম নারী প্রকৌশলী হিসেবে ওয়েস্টার্ন ইলেক্ট্রিক কর্তৃক অস্থায়ী নিযুক্ত হন এবং একই সাথে তিনি 'সোসাইটি অব উইমেন ইঞ্জিনিয়ার্স' এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম প্রেসিডেন্ট।[১] যে সময়ে প্রকৌশলী হিসেবে নারীদের পেশাকে যথেষ্ট আড়চোখে দেখা হতো, সে সময়ে প্রকৌশল ক্ষেত্রে প্রবেশ করা সত্ত্বেও হিকস বিভিন্ন পদে নেতৃত্ব প্রদান করেন এবং একটি প্রকৌশল কারখানার মালিক হন। তার সময়ে তিনি 'অ্যাপোলো মুন ল্যান্ডিং মিশনস' নামক যুক্তরাষ্ট্রের একটি মহাকাশ প্রোগ্রামে যে গ্যাস ঘনত্বকরণের সুইচ (Gas Density Switch) ব্যবহার করা হয়েছিলো তার উন্নতিসাধন করেন ।

বিয়েট্রিস হিকস
জন্মজানুয়ারি ২, ১৯১৯
মৃত্যু২১ অক্টোবর ১৯৭৯(1979-10-21) (বয়স ৬০)
দাম্পত্য সঙ্গীপ্রকৌশলী রডনে ডিউয়েন শীপ
Work
প্রতিষ্ঠান সদস্যপদনিওয়ার্ক কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিং
স্টিভেনস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি
উল্লেখযোগ্য পুরষ্কারন্যাশনাল উইমেনস হল ফেম,২০০২

প্রথম জীবন ও শিক্ষা সম্পাদনা

বিয়েট্রিস হিকস ১৯১৯ সালে নিউ জার্সি'র অরেঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন এবং তার বাবা লাক্স হিকস ছিলেন একজন কেমিক্যাল প্রকৌশলী এবং তার মা ছিলেন ফ্লোরেন্স বেনেডিক্ট ।[২] ছোটবেলা থেকেই হিকসের ইচ্ছে, বড় হয়ে তিনি বাবার মতো প্রকৌশলী হবেন। যেহেতু সে সময় মেয়েদের প্রকৌশল নিয়ে পড়াটা সামাজিক ভাবে বেমানান হিসেবেই দেখা হতো, তাই বাবা-মা তাদের মেয়ের ইচ্ছের বিরোধিতা কিংবা তাকে প্রকৌশল পড়াতে অপারগতা প্রকাশ করলেন, এছাড়াও তার কিছু শিক্ষক ও সহপাঠী তাকে প্রকৌশল নিয়ে পড়তে নিরুৎসাহিত করেছিল।[৩] শত বাঁধা-বিপত্তিসত্ত্বে হিকস ১৯৩৫ সালে অরেঞ্জ হাই স্কুল থেকে স্নাতক শেষ করলেন এবং ১৯৩৯ সালে নিওয়ার্ক কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিং (বর্তমানে যেটি নিউ জার্সি ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি হিসেবে পরিচিত) থেকে কেমিক্যাল প্রকৌশলের উপর স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন ।[২] তার পাঠ্য ক্লাসে কেবলমাত্র দুজন নারী ছিলো।[৪] কলেজে পড়াশুনার ফাঁকে, হিকস 'অ্যাবারক্রম্বি এন্ড ফিচ' নামের কোম্পানিতে টেলিফোন অপারেটর হিসেবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে কাজ করেন ।[৩] স্নাতক ডিগ্রী অর্জনের পর হিকস নিওয়ার্ক কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিং-এ গবেষণা সহকর্মী হিসেবে তিন বছর থাকেন এবং এখানে তিনি এডওয়ার্ড ওয়েস্টনের আবিষ্কারের ইতিহাস সম্পর্কে পড়াশোনা করেন এবং রাতে অতিরিক্ত ক্লাস নেন।[২][৩]

কর্মজীবন সম্পাদনা

১৯৪২ সালে হিকস ওয়েস্টার্ন ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে নিউ জার্সির কার্নিতে কোয়ার্টজ ক্রিস্টাল অসিলেটর এর ডিজাইন এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার চাকরি নেন ।[২] ওয়েস্টার্ন ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে নারী প্রকৌশলী হিসেবে তিনিই প্রথম নিযুক্ত হন এবং এখানে তিনি তিন বছর চাকরি করেন ।[৩] তার বাবার মৃত্যুর পর তিনি নিউ জার্সির ব্লুমফিল্ড ভিত্তিক আরেকটি মেটালওয়ার্কিং কারখানা 'নিওয়ার্ক কন্ট্রোলস কোম্পানি' (যেটি হিকসের বাবা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন) -তে যোগ দেন । ১৯৫৫ সালে তার চাচার কাছ থেকে কোম্পানিটি কেনার আগ পর্যন্ত হিকস প্রথমে প্রধান প্রকৌশলী এবং পরবর্তীতে ভাইস প্রেসিডেন্ট ইনচার্জ অব ইঞ্জিনিয়ারিং হিসেবে কাজ করেন। হিকস গ্যাস ঘনত্বকরণের সুইচের ডিজাইন এবং উদ্ভাবন করেন, পরে যেটি যুক্তরাষ্ট্র চাঁদে অবতরণ মহাকাশ প্রোগ্রামে ব্যবহার করেছিলো এবং তিনি ডিভাইসের কাঠামোগত সীমা অতিক্রম নির্ধারণে সেন্সরের ক্ষেত্রে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।[২][৪] গ্যাস ঘনত্বকরণের সুইচের উপর হিকস একাধিক প্রযুক্তিগত গবেষণাপত্র তৈরি করেছিলেন ।[৫] নিওয়ার্ক কন্ট্রোল কোম্পানিতে কর্মরত থাকাকালীন, হিকস ১৯৪৯ সালে স্টিভেনস ইনস্টিটিউট থেকে পদার্থ বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন ।[৩]

যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূলে (ইস্ট কোস্ট) ১৯৫০ সালে হিকস এবং অন্যান্য নারীরা একটি সংগঠন করার উদ্দেশ্যে আলোচনার আয়োজন করেন, যে সংগঠনটির মূল লক্ষ্য ছিলো নারী প্রকৌশলীদের আরো দক্ষ করে তোলা এবং প্রকৌশল ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ আরো বৃদ্ধি করা। দুই বছর পর সংগঠনটি 'সোসাইটি অব উইমেন ইঞ্জিনিয়ার্স'-এ রূপান্তরিত হয়। হিকস ১৯৫০ থেকে ১৯৫২, পরপর দুইবার সংগঠনটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন।[২] ১৯৬৩ সালে দ্যা সোসাইটি অব উইমেন ইঞ্জিনিয়ার্স হিকসকে সর্বোচ্চ সম্মান হিসেবে 'দ্যা সোসাইটি অব উইমেন ইঞ্জিনিয়ারস অ্যাসিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড' পদকে ভূষিত করে।[২] নারী প্রকৌশলী পেশার প্রসারে হিকস জনমানুষের সম্পৃক্ততা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন সভাসমাবেশে যোগদান এবং এ বিষয়ে বলিষ্ঠ বক্তৃতা প্রদানের উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, নারী প্রকৌশলীদের আরো নিবিড়ভাবে প্রশিক্ষণ ও পর্যবেক্ষণ করা গেলে, তাদের গ্রহণযোগ্যতা দ্রুত বেড়ে যাবে।[২][৩]

১৯৪৮ সালে হিকস ফেলোশীপ প্রাপ্ত প্রকৌশলী রডনে ডিউয়েন শীপকে বিয়ে করেন। তিনি কারখানায় পরামর্শকারী হিসেবে কাজ করার আগেও প্রকৌশল পদ সমপর্যায়ের পরিচালক হিসেবে দুইবার দায়ত্ব পালন করেন। ১৯৬০ সালে 'ন্যাশনাল সোসাইটি অব প্রফেশনাল ইঞ্জিনিয়ার্স' কর্তৃক দক্ষিণ আমেরিকায় একমাস ব্যাপী গবেষণা এবং বক্তৃতা প্রদানের জন্য এই দম্পতিকে নির্বাচিত করা হয়। আর এ সফরের মূল উদ্দেশ্য ছিলো আমেরিকা দক্ষিণ আমেরিকার প্রকৌশলীদের মধ্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পারস্পরিক সহযোগিতার উপর আলোকপাত করা।[২] ১৯৬৬ সালে শীপ মারা যাওয়ার পর, হিকস নিওয়ার্ক কন্ট্রোলস কোম্পানিটি বিক্রি করে দেন এবং তার পরবর্তী স্বামীর পরামর্শমূলক ব্যবসার দায়িত্ব নেন। ১৯৬০ থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত সময়ে বিভিন্ন সেবাখাতে কর্মরত নারীদের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা কমিটিতে কাজ করার জন্য হিকস নির্বাচিত হন এবং তিনি প্রথম আন্তর্জাতিক নারী প্রকৌশলী ও বিজ্ঞানীদের সম্মেলনের পরিচালক ছিলেন। এছাড়া তিনি চারটি আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাপনা অধিবেশনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করেন।[৫]

১৯৭৯ সালের ২১ শে অক্টোবরে, নিউ জার্সির প্রিন্সটোনে হিকস মারা যান।

সম্মাননা ও পদভূষণ সম্পাদনা

নিওয়ার্ক কন্ট্রোল কোম্পানিতে বিশেষ ভূমিকা রাখার কারণে ১৯৫২ সালে মেডময়জেলে (Mademoiselle) ম্যাগাজিন হিকসকে উইমেন অব দ্যা ইয়ার ইন বিজনেস হিসেবে ঘোষণা দেয় ।[২] ১৯৭৮ সালে প্রকৌশলে সর্বোচ্চ সম্মাননা হিসেবে ন্যাশনাল একাডেমি অব ইঞ্জিনিয়ারিং এ যোগদানের জন্য হিকসে আমন্ত্রণ জানানো হয় এবং তিনি ষষ্ঠতম নারী হিসেবে এই সংগঠনে যোগদান করেন ।[২] ২০০২ সালে হিকস ন্যাশনাল উইমেনস হল ফেম এ অভিষিক্ত হন ।[৬]

হিকস হোবার্ট এন্ড উইলিয়াম স্মিথ কলেজ, রেঞ্জেলার পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, স্টিভেনস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি এবং ওরসেস্টার পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেন। তিনি ছিলেন রেঞ্জেলার পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রী লাভকারী প্রথম নারী। তাছাড়া তিনি আমেরিকান সোসাইটি অব মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার্স এবং ইনস্টিটিউট অব ইলেক্ট্রিকাল এন্ড ইঞ্জিনিয়ার্স এর সদস্যও ছিলেন।[১]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "বিয়েট্রিস এলিস হিকস (ইংরেজিতে)"IEEE Global History Network। Institute of Electrical and Electronics Engineers। সংগ্রহের তারিখ অক্টোবর ১৬, ২০১২ 
  2. James, Edward T.; James, Janet Wilson; Boyer, Paul S. (২০০৪)। (ইংরেজিতে) Notable American Women: A Biographical Dictionary, Volume 5: Completing the Twentieth Century। Cambridge, MA: Belknap Press। আইএসবিএন 978-0674014886 
  3. "(ইংরেজিতে) Hicks, Beatrice A. Jan. 2, 1919– Engineering executive"। Current Biography। The H. W. Wilson Company। ১৯৫৭। 
  4. Cummings, Charles F. (মার্চ ৯, ২০০০)। "(ইংরেজিতে) Knowing Newark"। The Star-Ledger। Newark, NJ। 
  5. National Academy of Engineering of the United States of America (১৯৮৪)। Memorial tributes। Washington, DC: National Academy Press। পৃষ্ঠা 118। আইএসবিএন 0309034825 
  6. Associated Press (অক্টোবর ৫, ২০০২)। "(ইংরেজিতে) 2002 National Women's Hall of Fame inductees"। The Associated Press State & Local Wire 

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা