বিনয় বসু
বিনয় কৃষ্ণ বসু (১১ই সেপ্টেম্বর ১৯০৮ – ১৩ই ডিসেম্বর ১৯৩০), যিনি বিনয় বসু নামে বেশি পরিচিত, ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন অন্যতম বাঙালি ব্যক্তিত্ব এবং অগ্নিযুগের বিপ্লবী।
বিনয় বসু | |
---|---|
![]() বিনয় বসু একজন বাঙালি বিপ্লবী ও মুক্তিসংগ্রামী | |
জন্ম | ১১ই সেপ্টেম্বর ১৯০৮ |
মৃত্যু | ১৩ ডিসেম্বর ১৯৩০ | (বয়স ২১–২২)
নাগরিকত্ব | ব্রিটিশ ভারতীয় |
আন্দোলন | ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন |
প্রাথমিক জীবনসম্পাদনা
বিনয় বসুর জন্ম হয় ১৯০৮ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর, মুন্সীগঞ্জ জেলার রোহিতভোগ গ্রামে। তার পিতা রেবতীমোহন বসু ছিলেন একজন প্রকৌশলী। ঢাকায় ম্যাট্রিক পরীক্ষা পাস করার পর বিনয় মিটফোর্ড মেডিকেল স্কুল (বর্তমানের স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ) এ ভর্তি হন। এসময় তিনি ঢাকার ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী হেমচন্দ্র ঘোষের সংস্পর্শে আসেন এবং যুগান্তর দল এর সাথে জড়িত মুক্তি সঙ্ঘে যোগ দেন। বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার জন্য তিনি চিকিৎসা শাস্ত্রে তার পড়ালেখা শেষ করতে পারেননি।
বিপ্লবী কর্মকাণ্ডসম্পাদনা
বিনয় ও তার সহযোদ্ধারা নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স দলে যোগ দেন ১৯২৮ সালে। অল্পদিনের মধ্যেই বিনয় এই সংগঠনের ঢাকা শাখা গড়ে তুলেন। অচিরেই রাজবন্দীদের উপর পুলিশী নির্যাতনের বিরূদ্ধে তার সংগঠনটি রুখে দাঁড়ায়। ১৯৩০ সালে বিপ্লবীরা পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল লোম্যানকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন। লোম্যানের মিটফোর্ড হাসপাতালে এক সহকর্মীকে দেখতে আসার কথা ছিল। ১৯৩০ সালের ২৯ আগস্ট বিনয় সাধারণ বেশভূষায় নিরাপত্তা গন্ডীকে ফাঁকি দিয়ে লোম্যানের খুব কাছে চলে এসে তাকে গুলি করেন। দুই দিন পরে লোম্যানের মৃত্যু হয় এবং তার সঙ্গে থাকা পুলিশের সুপারিন্টেন্ডেন্ট হডসন চিরতরে পঙ্গু হয়ে যান।
পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে বিনয় কলকাতা শহরে পালিয়ে যান বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স দলের অ্যাকসন স্কোয়াডের প্রধান সুপতি রায়ের সাহায্যে। এসময় তাদের নানা ছদ্মবেশ ধরতে হয়। পুলিশ তাকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য ৫০০০ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিল।
রাইটার্স ভবনে হামলাসম্পাদনা
বিপ্লবীদের পরবর্তী লক্ষ্য ছিল কারা কর্তৃপক্ষের অত্যাচারী ইন্সপেক্টর জেনারেল কর্নেল এন.এস সিম্পসন। রাজবন্দীদের উপর অত্যাচার চালানোর জন্য সিম্পসন বিপ্লবীদের কাছে কুখ্যাত ছিলেন। তারা সিম্পসনকে হত্যার সাথে সাথে ব্রিটিশ সরকারের মধ্যে ত্রাস সৃষ্টি করার জন্য তদানিন্তন সচিবালয়ে - কলকাতা শহরের রাইটার্স বিল্ডিঙে (বর্তমানে বিবাদি বাগে অবস্থিত মহাকরণ) - হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত নেন।
১৯৩০ সালের ৮ই ডিসেম্বর তারিখে বিনয়, বাদল গুপ্ত ও দীনেশ গুপ্ত একত্রে মিলে ইউরোপীয় বেশ ভূষায় সজ্জিত হয়ে রাইটার্স ভবনে প্রবেশ করেন ও সিম্পসনকে গুলি করে হত্যা করেন।
টেগার্টের নেতৃত্বে ব্রিটিশ পুলিশ বাহিনী সাথে সাথে গুলি বর্ষণ শুরু করে। গুলি বিনিময়ে টেয়ানাম, প্রেন্টিস, নেলসন সহ আরো কিছু পুলিশ অফিসার গুলিবিদ্ধ হন। তবে অচিরেই তিন বিপ্লবী পরাভূত হন। পুলিশের কাছে ধরা না দেয়ার অভিলাসে বাদল গুপ্ত পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন। বিনয় ও দীনেশ পিস্তলের গুলিতে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন।
বিনয়-বাদল-দীনেশের এই আত্মত্যাগের স্মরণে কলকাতার ডালহৌসি চত্ত্বরের নাম করণ করা হয় বিবাদি বাগ।
মৃত্যুসম্পাদনা
বিনয় ও দীনেশকে অবিলম্বে কলকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তি করা হয়। যখন বিনয়কে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখনো তাঁর জ্ঞান ছিল। সেই সময় কিছু সিআইডি কর্তা তাঁকে চেপে ধরেন ও বিনয় এতদিন কোথায় ছিল, আগ্নেয়াস্ত্র কোথা থেকে এলো ইত্যাদি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে শুরু করেন । এসবের উত্তরে বিনয় একটি কথাই বলেছিলেন -
"I have saved your 5,000 rupees and what more you expect from me? "( আমি আপনাদের ৫,০০০ টাকা বাঁচিয়ে দিলাম, তার চেয়ে বেশি আর কিইবা চাইতে পারেন আমার কাছ থেকে?)
লোম্যান হত্যার পর বিনয়ের নামে হুলিয়া জারি করা হয় ও ৫,০০০ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয় । পরে পুরস্কারের পরিমাণ বাড়িয়ে ১০,০০০ টাকা করা হয়। সম্ভবত বিনয় পুরস্কার বৃদ্ধি সম্পর্কে অবগত ছিলেন না।
বিনয়ের জন্য পুলিশ চিকিৎসার সুবন্দোবস্ত করে যাতে সুস্থ হলে তাঁর কাছ থেকে অনেক তথ্য সংগ্রহ করা যায়। কিন্তু সেই সম্ভাবনাকে অসীম সাহসের সাথে চূর্ণ করে, ডাক্তারি ছাত্র বিনয় নিজের মাথার ব্যান্ডেজ আলগা করে গুলির ক্ষতে আঙুল ঢুকিয়ে দিয়ে ক্ষত বিষাক্ত করে তোলেন। ফলস্বরূপ ক্ষত সেপটিক হয়ে যায়। অবশেষে দিনকয়েকের যমে - মানুষে টানাটানির পর ১৩ ডিসেম্বর ১৯৩০ সালে বিনয়ের পুণ্য আত্মা পাড়ি দেয় অন্য লোকে , স্বাধীন দেশের স্বপ্ন বুকে নিয়ে ।
গ্রন্থসূত্রসম্পাদনা
- হেমেন্দ্রনাথ দাসগুপ্ত, ভারতের বিপ্লব কাহিনী, ২য় ও ৩য় খন্ডI, কলকাতা, ১৯৪৮।
- রমেশচন্দ্র মজুমদার, History of the Freedom Movement in India, III, কলকাতা, ১৯৬৩।
- গঙ্গানারায়ণ চন্দ্র, অবিস্মরণীয়, কলকাতা, ১৯৬৬।