বার্ণপুর ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বর্ধমান জেলার আসানসোলের একটি অঞ্চল। ভারতের সর্বপ্রাচীন লৌহ-ইস্পাত কারখানাটিকে (ইস্কো - IISCO) কেন্দ্র করে এখানে একটি শতাব্দীপ্রাচীন সমাজ ও সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে । দামোদর নদের তীরে ঝরিয়া-আসানসোল-রাণীগঞ্জ খনিজ অঞ্চলের কেন্দ্রে অবস্থিত হওয়ার ফলে বার্ণ এন্ড কোম্পানী ১৯১৮ সালে এখানে ইস্কো স্থাপন করে এবং বার্ণপুর টাউনশিপ গড়ে তোলে।

বার্ণপুর
আসানসোল উপনগরীয় অঞ্চল
বার্ণপুর পশ্চিমবঙ্গ-এ অবস্থিত
বার্ণপুর
বার্ণপুর
পশ্চিমবঙ্গ, ভারতে অবস্থান
স্থানাঙ্ক: ২৩°২৪′ উত্তর ৮৬°৩৩′ পূর্ব / ২৩.৪০° উত্তর ৮৬.৫৫° পূর্ব / 23.40; 86.55
দেশ ভারত
রাজ্যপশ্চিমবঙ্গ
জেলাবর্ধমান
উচ্চতা৭৫ মিটার (২৪৬ ফুট)
ভাষা
 • অফিসিয়ালবাংলা, ইংরেজি
সময় অঞ্চলআইএসটি (ইউটিসি+৫:৩০)

ভৌগোলিক উপাত্ত

সম্পাদনা

অঞ্চলটি ছোটোনাগপুর মালভূমির অন্তর্গত তাই আবহাওয়া চরমভাবাপন্ন । অঞ্চলটির অক্ষাংশ ২৩ ডিগ্রি ৪০ মিঃ উত্তর এবং দ্রাঘিমাংশ ৮৬ ডিগ্রি ৫৫ মিঃ পূর্ব[]। বার্নপুর বর্ধমান,বাঁকুড়া ও পুরুলিয়া জেলার সংযোগস্থলে দামদর নদের তীরে অবস্থিত । অঞ্চলটি সমুদ্রতল থেকে ২৪৯ ফুট (৭৫ মিটার) উঁচুতে অবস্থিত । দক্ষিণবঙ্গের দুটি গুরুত্বপূর্ণ নদী দামোদরঅজয় পরস্পরের সাথে ৩০ কিমি ব্যবধান রেখে প্রায় সমান্তরাল হয়ে এই শিল্পাঞ্চলের দুদিকে বয়ে চলেছে । তাই এখানের জমি খুবই উর্বর এবং ঘন অরণ্যকীর্ণ ছিল । পরবর্তীকালে কয়লার ভান্ডার খুঁজে পাওয়া গেলে জঙ্গল কমতে থাকে ও জনবসতি বাড়তে থাকে । বর্তমানে এখানে জঙ্গল বিলুপ্ত ।

ইতিহাস

সম্পাদনা
 
ইস্কোর এক উচ্চতর করণিকের বাংলো,ব্রিটিশ স্থাপত্যের একটি উৎকৃষ্ট নিদর্শন ।

পঞ্চকূট (বর্তমানে পুরুলিয়া জেলার অন্তর্গত) রাজাদের অধীনস্থ শেরগড় পরগনার অন্তর্গত শালবনের মাঝে একটুকরো গ্রাম ছিলো হিরাপুর । নিকতবর্তী গ্রামগুলি ছিল সাঁতা, নাকরাসোতা, রাঙ্গাপাড়া, ধরমপুর, কালাঝারিয়া, নরসিংবাঁধ, নাপুরিয়া,নবঘন্টি,ছোটোদিঘারি । স্টীলপ্ল্যান্ট স্থাপনের সময় নাপুরিয়া গ্রামটির অস্তিত্ব লোপ পায় । এখানে সে সময় বেঙ্গল-নাগপুর রেলওয়ের একটি ছোটো স্টেশন ছিল নরসিংবাঁধ নামে । পরবর্তীকালে যখন নতূন শহর তৈ্রী হল তখন এর নাম বদলে রাখা হয় বার্ণপুর স্টেশন যা বর্তমানে দক্ষিণ-পূর্ব রেলওয়ের অঙ্গ ।

পুরাতন পরিবারগুলির মধ্যে হীরাপুর ঠাকুরবাড়ীর নাম উল্লেখযোগ্য । মানিকচাঁদ ঠাকুর, শ্রীনিবাস ঠাকুর(শ্রীচৈতণ্যদেবের অন্যতম শিষ্য)-এর উত্তরসূরি এখানে এসে বসবাস স্থাপন করেন । ১৮৮৪ সালে হীরাপুর আসানসোল পুলিশ স্টেশন এবং অবিভক্ত বাংলার পোষ্টমাষ্টার জেনারেল এর তালিকাকৃত বর্ধমান জেলার গ্রামতালিকায় স্থান পায় ।পুলিশ স্টেশান ও বিধানসভা কেন্দ্র-র নাম এখনো হীরাপুর রয়েছে ।

জি.এইচ.ফেয়ারহার্ষ্ট-এর নেতৃত্বে বার্ণ এন্ড কোম্পানী ১৯১৮ সালের ১১ই মার্চ এখানে স্থাপন করে দি ইন্ডিয়ান আইরন এন্ড ষ্টিল কোম্পানী ইস্কো । তিনি গড়ে তোলেন বার্ণপুর টাউনশিপ । মেরী ফেয়ারহার্ষ্ট-এর নামে একটি বিদ্যালয়ও স্থাপন করেন তিনি। ১৯৩৬ সালের ২০শে এপ্রিল মার্টিন এন্ড কোং এবং বার্ণ এন্ড কোং যুক্ত হয়ে তৈরি হয় মার্টিন বার্ণ । সে সময় ইস্কোর নির্দেশক ছিলেন এইচ.ভি.পিলিং যিনি জীবনের প্রায় পঁচিশ বছর এই শহরে কাটান ও একে পরিবর্ধন করেন । ১৯৩৭ সালের ২০শে এপ্রিল দা ষ্টিল কর্পোরেশন অব বেঙ্গল নামে নতুন একটি সংস্থা এখানে উৎপাদন শুরু করে যা পরবর্তীকালে ২৯শে অক্টোবর ১৯৫২ সালে ইস্কোর সাথে মিশে যায় । যদিও ইস্কোর প্রধান প্রবেশদ্বার-এর নাম আজও স্কব গেট । ১৯৪৯ সালে আই.এস.পুরি হন ইস্কোর নতুন নির্দেশক । সে সময় মার্টিন বার্ণ-এর সামাজিক ও জনকল্যাণ উপদেষ্টা অশোক চ্যাটার্জি বিশেষভাবে দায়ী ছিলেন কারখানা ও শহরের সমৃদ্ধির জন্য । পুরাতন জনবসতির দ্বারা ঘিরে থাকার জন্য একসময় বার্ণপুর অঞ্চলের বৃদ্ধি আটকে যায় । তখন ছোটোদিঘারিতে নিউটাউন এবং দামোদর নদের তীরবর্তী স্থানে কালাঝরিয়া গ্রামের সন্নিকটে রিভারসাইড টাউনশিপ গড়ে তোলা হয় । বার্নপুর রোড ও রাধানগর রোড এর মধ্যবর্তী স্থান একসময় পুরো জনবসতিতে ভরে যায় ও বার্ণপুর শহর আসানসোল শহর যুক্ত হয় । ১৯১৮ সালে বার্ণপুরে আরো একটি কারখানা স্থাপন হয় যার নাম দা ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ড ওয়াগন ফ্যাক্টরী । এই সংস্থাটিও বার্ণপূর অঞ্চলের কিছুটা বিস্তারের জন্য দায়ী । ১৪ই জুলাই, ১৯৭২ সালে ইন্দিরা গান্ধির নেতৃত্বাধীন কেন্দ্র সরকার ইস্কো অধীগ্রহণ করে । বিভিন্ন রাজনৈতিক ও শ্রমিক আন্দোলনের জেরে ইস্কোর আধুনিকিকরন বিলম্বিত হতে থাকে এবং ১৯৮৯ সালে রাজীব গান্ধি সরকার ইস্তফা দেওয়ার পর ইস্কোর ভাগ্য অনিশ্চিত হয়ে পড়ে । সে সময় আন্তর্জাতিক দরপত্র ডাকা হয় ইস্কো কে পুনরায় বেসরকারিকরনের উদ্দেশ্যে, তবুও কোনো ক্রেতা পাওয়া যায় না । শিল্পাঞ্চলের অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়ে । আস্তে আস্তে ইস্কো রুগ্ন ও অলাভজনক শিল্পে পরিণত হয় । ২০০৬ সালে স্টীল অথারিটি অব ইন্ডিয়ার(সেইল) সহযোগী সংস্থা থেকে সেইল-এর অঙ্গে পরিণত হয় ইস্কো । পুনরায় জেগে ওঠে শহরের প্রাণ । কারখানার নতুন নাম হয় ইস্কো স্টিল প্ল্যান্ট ।

নগরজীবন

সম্পাদনা
 
ভারতী ভবন প্রাঙ্গনে উদযাপিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান

ইস্কো স্টিল প্ল্যান্ট এখানে অনেকগুলি উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় পরিচালনা করে । এগুলি হল বার্ণপুর বয়েজ হাই স্কুল, বার্ণপুর গার্লস স্কুল, বার্ণপুর রিভারসাইড স্কূল (কো-এড ইংলিশ মিডিয়াম), ছোটোদিঘারি বিদ্যাপীঠ । এছাড়া এখানে রয়েছে সুভাষপল্লি বিদ্যানিকেতন, শান্তিনগর বিদ্যামন্দির, হীরাপুর মানিকচাঁদ ঠাকুর স্কুল এবং অনেগুলি সরকারি স্কুল । উচ্চতর শিক্ষার জন্য এখানে কোনো কলেজ নেই, আসানসোলের উপরেই নির্ভরশিল ।

বার্ণপুরের সাংস্কৃতিক জীবন আবর্তিত হয় বার্ণপুর ক্লাব, ভারতী ভবন, এমপ্লয়ীজ রিক্রিয়েশন সেন্টার (নিউটাউন) ও অন্যান্য ছোট-বড় সংগঠন দ্বারা । বার্ণপুরে একটি জাতীয়মানের ফুটবল স্টেডিয়াম ও ক্রিকেট গ্রাউন্ড আছে । এখানে অনেকগুলি সম্মানজনক কাপ ও শীল্ডএর খেলা হয় । বার্ণপুর ক্রিকেট গ্রাউন্ড-এ জাতীয় স্তরের প্রতিযোগিতা যেমন দলীপ ট্রফি ইত্যাদির খেলা হয়ে থাকে । বার্ণপুরে একটি মাত্র টকিজ আছে । কিন্ত এখানে বেশ কটি খ্যাতনামা নাট্যগোষ্ঠি রয়েছে । মার্টিন বার্ণ এর লক্ষ্য ছিল একটি পরিপূর্ণ শহর গড়ে তোলা । সেই লক্ষ্যে তারা যেমন তৈরি করেছিল স্কুল,হাসপাতাল,রাস্তাঘাট তেমনি গড়ে তুলেছিল সর্বধর্মের জন্য প্রার্থনাকেন্দ্র । টাউনপূজা নামে খ্যাত বারি ময়দান মন্দির ক্ষেত্রে আছে একসাথে দুর্গা,কালি ও শিবের মন্দির । পাশেই গীর্জা । এছাড়া রয়েছে একটি করে মসজিদ,গুরুদোয়ারা,জগন্নাথ মন্দির,শিবস্থান ও বৌদ্ধমন্দির । দামোদর নদের তীরে এক বিস্তীর্ন অঞ্চল জুড়ে এফ ডব্লু এ লামিয়ের স্থাপন করেন এক বাগান যা পরে লামিয়েরস পার্ক নামে পরিচিত হয় ও বর্তমানে নবীকরনের পরে নেহেরু পার্ক নামে খ্যাত । এটি এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় ও সুপরিচিত প্রমোদকেন্দ্র ও পিকনিকের ক্ষেত্র । এখানে রয়েছে কৃত্রিম ঝর্ণা, গ্রীনহাউস,পার্কের ওপর শিরাধমনীর মত বয়ে চলা অজস্র খাল ও তার ওপর তৈরি ছোটো ছোটো সেতু । বার্ণপুরে রয়েছে ইস্কো নিয়ন্ত্রিত ৫০০ বেডের একটি হাসপাতাল যা আকারে ও উৎকর্ষতায় এ অঞ্চলের সেরাদের অন্যতম । দামোদরের তীরে কালাঝরিয়া গ্রামের নিকটে রয়েছে ইস্কোর নিজস্ব বিমানঘাঁটি যেখানে ছোট বিমান অবতরন করতে পারে । ভবিষ্যতে একে একটি জাতীয়মানের বিমানবন্দর করার পরিকল্পনা আছে ।

রাজনীতি

সম্পাদনা

সি•পি•এম• এর বামাপদ মুখার্জী হীরাপুর বিধানসভা জয় করেন ১৯৭৭ সালে কংগ্রেসের শান্তিময় আইচকে হারিয়ে । সি•পি•এম• এর বামাপদ মুখার্জী জেতেন ১৯৮২ সালে কংগ্রেসের শিবদাস ঘটককে হারিয়ে । কংগ্রেসের সুহৃদ বসু মল্লিক জেতেন ১৯৮৭ সালে সি•পি•এম• এর বামাপদ মুখার্জীকে হারিয়ে । জনতাদলের মুমতাজ হোসেন জেতেন ১৯৯১ সালে কংগ্রেসের সুহৃদ বসু মল্লিককে হারিয়ে । কংগ্রেসের শ্যামদাস ব্যানার্জী জেতেন ১৯৯৬ সালে জনতাদলের মুমতাজ হোসেনকে হারিয়ে । তৃণমূল কংগ্রেসের মলয় ঘটক জেতেন ২০০১ এ নির্দল প্রার্থী দিলীপ ঘোষকে হারিয়ে । সি•পি•এম• এর অমিতাভ মুখার্জী জেতেন ২০০৬ সালে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী তৃণমূল কংগ্রেসের মলয় ঘটককে হারিয়ে।

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. "burnpur"Falling Rain Genomics, Inc। ১৭ সেপ্টেম্বর ২০০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ সেপ্টেম্বর ২৫, ২০০৬