বাবরনামা

ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জহির-উদ্দিন মুহম্মদ বাবরের লেখা আত্মজীবনী

বাবরনামা (চাঘতাই/পার্শি بابر نامہ‎;´, আক্ষরিক অর্থ 'বাবরের লেখা' বা 'বাবরের বই') হল ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জহির-উদ্দিন মুহম্মদ বাবরের (১৪৮৩-১৫৩০) লেখা আত্মজীবনী। চাঘতাই ভাষায় রচিত এই বইটি তুজুক-ই-বাবরি নামেও যথেষ্ট পরিচিত। পরবর্তীকালে মুঘল সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে হিজরি ৯৯৮ সনে বা ১৫৮৯-৯০ খ্রিষ্টাব্দে মুঘল সভাসদ আব্দুল রহিম বইটি সম্পূর্ণ পারসিক ভাষায় অনুবাদ করেন। বাবরের জীবন ও ইতিহাস সংক্রান্ত তথ্য আহরণের পক্ষে এই গ্রন্থটি একটি সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ও বিশ্বস্ত গ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃত। সাহিত্যমূল্যর দিক থেকেও বইটি উচ্চ প্রশংসিত।

দরবারের একটি দৃশ্য - বাবরনামা থেকে

আত্মজীবনীমূলক অত্যন্ত মূল্যবান এই ঐতিহাসিক গ্রন্থটি চাঘতাই তুর্কি ভাষায় রচিত। উইগুরউজবেক ভাষার সংমিশ্রণে তৈরি এই কৃত্রিম ভাষাটি মধ্য এশিয়ায় চাঘতাই খানদের রাজত্বে সরকারি ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হত। বিংশ শতাব্দীর শুরু পর্যন্তও এই ভাষা মধ্য এশিয়ার একটি অন্যতম সাহিত্যিক ভাষা হিসেবে ব্যাপক প্রচলিত ছিল। বাবরের কাছে অবশ্য এই ভাষা শুধুমাত্র তুর্কি ভাষা হিসেবেই পরিচিত ছিল। সেই সময় আন্দিজানে বসবাসকারী তৈমুরের বংশধরদের মধ্যে এটিই ছিল প্রচলিত ভাষা। অবশ্য বাবরনামায় বাবরের ভাষা, তাঁর লেখায় আমরা যেমন দেখতে পাই, ছিল শব্দভাণ্ডার, বাক্যরীতি ও গঠনের দিক থেকে পার্শি ভাষার দ্বারা গভীরভাবেই প্রভাবিত। এমনকী লেখার মাঝে মাঝে তিনি কিছু কিছু ছোট কবিতা ব্যবহার করেন, যেগুলি পার্শি ভাষাতেই রচিত।

 
বাবরনামার সচিত্র পাণ্ডুলিপি

সংক্ষিপ্তসার

সম্পাদনা

তৈমুরের বংশধরদের মধ্যে বাবর ছিলেন একজন অত্যন্ত শিক্ষিত অভিজাত মানুষ। তাঁর সেই শিক্ষিত ও মার্জিত মননের প্রতিফলন এই বই'এ আমরা দেখতে পাই। প্রকৃতি, সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতি সংক্রান্ত বিষয়ে তাঁর চিন্তা-ভাবনা ও ধ্যান-ধারণাও এই গ্রন্থে প্রতিফলিত হয়েছে। জীবনের নানা বিষয় এবং দিক সম্বন্ধে তিনি আগ্রহী ছিলেন। ফলে এই বইতে শুধুমাত্র আমরা তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের নানা ঘটনাবলীর বাইরেও তিনি যেসব অঞ্চলে বাস করেছেন বা নানা সময়ে ভ্রমণ করেছেন, সেই সব অঞ্চলের ইতিহাস ও ভূগোল সম্পর্কেও বহু কিছু জানতে পারি। এছাড়াও তাঁর পরিচিত মানুষদের সম্পর্কেও খুব সুন্দর জীবন্ত বিবরণ এই বই'এর এক অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ফলে সেই সময়ের ইতিহাসকে জানার পক্ষে তাঁর লেখা এই গ্রন্থটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক উপাদান হিসেবেই সাধারণভাবে গণ্য করা হয়ে থাকে।

বিষয়বস্তু

সম্পাদনা

বাবরনামা শুরু হয়েছে খুবই সাধারণভাবে। অত্যন্ত সহজ ও সাধারণ ভঙ্গিতে তিনি সেখানে সরাসরি বলছেন -

[] এরপর কিছুটা পশ্চাদপট বর্ণনার পর তিনি মধ্য এশিয়ার একজন ক্ষুদ্র শাসক হিসেবে তার অভিজ্ঞতার কথা এই বইতে লিপিবদ্ধ করেন। আমরা দেখতে পাই, কীভাবে বারবার তার ভাগ্য সেখানে উঠেছে, পড়েছে। দু' দু'বার তিনি এর মধ্যে সমরখন্দ দখল করেন। কিন্তু কোনোবারই সেখানে তার শাসন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। দু'বারই শেষপর্যন্ত তাকে ঐ শহরের অধিকার হারাতে হয়। দ্বিতীয়বার অত্যন্ত পরাক্রমশালী প্রতিপক্ষ মুহম্মদ শয়বানি খানের হাতে ঐ শহরের অধিকার খুইয়ে তাকে অত্যন্ত দুরবস্থার মধ্যে পড়তে হয়। ফরাঘানার উপরও তার অধিকার চলে যায়। তখন ১৫০৪ খ্রিষ্টাব্দে মূলত তাজিক জনগোষ্ঠীর কিছু সৈন্য ও বদখশানের কিছু সৈন্যকে সাথে নিয়ে তিনি কাবুলের উদ্দেশ্যে রওনা হন।

১৫০৮ থেকে ১৫১৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ঘটনার কথা গ্রন্থতে লিপিবদ্ধ হয়নি। আবার যখন বাবর লেখা শুরু করেন, আমরা দেখতে পাই, তিনি ইতোমধ্যেই কাবুলে একটি শক্তিশালী ও ধনী রাজ্যের অধিপতি হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত। সেখান থেকেই তিনি তখন উত্তর-পশ্চিম ভারতে অভিযান চালানোর কথা ভাবছেন। বইটির শেষ অংশে ১৫২৫-২৯ খ্রিষ্টাব্দের ঘটনাবলীর কথা লিখিত হয়েছে। এই অংশেই আমরা পাই, তার দিল্লি অভিযান, পানিপথের যুদ্ধ, ভারতে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা ও তার প্রাথমিক বিস্তারের কথা।

ঐতিহাসিক মূল্য

সম্পাদনা
 
প্রথম মুঘল সম্রাট বাবর

গ্রন্থটির ঐতিহাসিক মূল্য যথেষ্টই বেশি। বাবরের ব্যক্তিগত জীবনের ইতিহাসের পাশাপাশি মধ্যযুগের মধ্য এশিয়ার অধিবাসীদের জীবন, চিন্তা-ভাবনা, ধ্যান-ধারণা, ধর্মাচরণ, অভিজাত শ্রেণির জীবন, তাদের মধ্যে লেগে থাকা ক্রমাগত সংঘর্ষ, তার ফলে সাধারণ মানুষের জীবনে নেমে আসা দুর্ভোগ, প্রভৃতি নানা বিষয়ে মূল্যবান আলোকপাত পাওয়া যায় এই গ্রন্থটি থেকে। বাবরের সমকালীন দুনিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের বিষয়ে, বিশেষত যেসব অঞ্চল সম্পর্কে তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছিল, সুন্দর বস্তুনিষ্ঠ বর্ণনা এই বই'এর এক উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। উদাহরণস্বরূপ, এখানে তিনি তার জন্মস্থান ফরঘানা সম্পর্কে লিখেছেন -

[] ভারতে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রথম দিকের সময় উত্তর-পশ্চিম ভারত ও দিল্লি সংলগ্ন অঞ্চলের সমাজ ও জীবন সম্পর্কেও এই বই থেকে বেশ কিছু তথ্য জানতে পারা যায়। যেমন, এই অঞ্চলে জাঠ উপজাতির লোকেদের গণধর্মান্তরণ ও ইসলাম ধর্ম গ্রহণের সবচেয়ে প্রাচীন উল্লেখগুলির অন্যতম আমরা এই গ্রন্থেই দেখতে পাই।

সাহিত্যমূল্য

সম্পাদনা

আগেই বলা হয়েছে, গ্রন্থটি যথেষ্ট সুলিখিত। সুস্পষ্ট ভাষা ও সরাসরি বাচনভঙ্গি এই বই'এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আবার তার কাব্যপ্রতিভারও সাক্ষ্য বহন করে এই বই। তার বর্ণনা তাই আমরা দেখি মাঝেমাঝেই ছোট ছোট নানা কবিতায় পূর্ণ। এই কবিতাগুলি অবশ্য বেশিরভাগই পার্শি ভাষায় রচিত। চাঘতাই ভাষায় রচিত মূল বইটির শব্দচয়ন ও বাক্যগঠনরীতি এবং বাচনভঙ্গিও একইভাবে তার উপর পার্শি ভাষা ও সাহিত্যের প্রভাবের ইঙ্গিত বহন করে। অন্যদিকে তার বর্ণনা কতটা জীবন্ত হয়ে উঠতে পারে তা ফুটে ওঠে নিচের লাইন ক'টিতে -

 
ময়ূর ও অন্যান্য পাখিদের চিত্র, বাবরনামা থেকে

বাবরের প্রকৃতির প্রতিও যে যথেষ্ট আগ্রহ ছিল, তারও প্রমাণ আমরা এই বই'এ পাই। প্রকৃতি, উদ্ভিদ ও নানাস্থানে প্রাপ্ত স্বাভাবিক জীবজন্তুর বর্ণনাও তাই আমরা দেখি এই বই'এ জায়গা করে নিয়েছে যথেষ্ট পরিমাণেই।[] উত্তর-পশ্চিম ভারত ছিল তার কাছে একেবারেই এক নতুন দেশ। তাই বিশেষ করে এই অঞ্চলের বিভিন্ন উদ্ভিদ, ফুল-ফল ও প্রাণীদের তিনি যথাসম্ভব খুঁটিয়ে বর্ণনা দেবার চেষ্টা করেছেন। যেমন জবা (Hibiscus rosa sinensis)। তিনি বলেছেন এর রঙ একেবারে রক্তের মতো লাল। এর আকার গোলাপের মতো, কিন্তু তার রঙ বেদানার থেকেও ঘন। তিনি একটি ফোটা জবাকে একটি পাপড়ি ঘেরা হৃৎপিণ্ডের সাথে তুলনা করেন। কিন্তু একদিন বাদেই এই ফুল শুকিয়ে যায়।[] এছাড়াও করবী[]জুঁই[] ফুলেরও খুব আকর্ষক ও খুঁটিয়ে বর্ণনা এই বই'এ পাওয়া যায়। বইটিতে পাওয়া নানা ধরনের পাখির বর্ণনা থেকেও আমরা তার বস্তুনিষ্ঠ পর্যবেক্ষক মনটির পরিচয় পাই। যেমন কোকিল সম্বন্ধে তিনি লিখেছেন যে এই পাখি দৈর্ঘ্যে কাকের সমান, কিন্তু দেহ কাকের চেয়ে সরু। গান গায়। হিন্দুস্তানের বুলবুল। আমরা যেমন বুলবুল ভালোবাসি হিন্দুস্তানের লোকেরা তেমনি কোকিল ভালোবাসে। ঘন গাছের বাগানে থাকে।

গুরুত্ব ও অনুবাদ

সম্পাদনা

ভারতের প্রথম মুঘল সম্রাট বাবরের লেখা এই বইটি মধ্যযুগে রচিত আত্মজীবনীমূলক সাহিত্য হিসেবে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। পার্শি ভাষায় এর প্রথম অনুবাদের কথা আগেই বলা হয়েছে। পরবর্তীকালে পৃথিবীর আরও বহু ভাষাতেই বইটির অনুবাদ হয়। যেমন গুরুত্বপূর্ণ ইংরেজি অনুবাদগুলির মধ্যে জন লেইডেন ও ঊইলিয়াম আরসকিন কৃত ১৮২৬ সালে প্রথম প্রকাশিত মেময়ারস অফ জহির-উদ্দিন মুহম্মদ বাবরঃ এম্পারর অফ হিন্দুস্থান বইটিকেই প্রথম পূর্ণাঙ্গ ইংরেজি অনুবাদ ধরা হয়। অপরদিকে ১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দে আবে পাভ দ্য কুরতেই বইটির প্রথম পূর্ণাঙ্গ ফরাসি অনুবাদ প্রকাশ করেন। বর্তমানে মধ্য, পশ্চিম ও দক্ষিণ এশিয়ার অন্তত ২৫টি দেশে এই বইটি বা তার কিছু অংশ স্কুলস্তরে পাঠ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ঢাকার বাংলা একাদেমি থেকে প্রকাশিত বইটির বাংলা অনুবাদও এখন সহজলভ্য।

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. Traduction française
  2. Traduction française
  3. Annette Susanne Beveridge, Babur-nama (Memoirs of Babur). Translated from the original Turki text of Zahiru'd-din Muhammad Babur Padsha Ghazo. Delhi 1921 (Reprint Low Price Publications 1989 in einem Band, আইএসবিএন ৮১-৮৫৩৯৫-০৭-১), পৃঃ ৪৮৮-৫১৫
  4. Annette Susanne Beveridge, Babur-nama (Memoirs of Babur). Translated from the original Turki text of Zahiru'd-din Muhammad Babur Padsha Ghazo. Delhi 1921 (Reprint Low Price Publications 1989 in einem Band, আইএসবিএন ৮১-৮৫৩৯৫-০৭-১), পৃঃ ৫১৩
  5. Annette Susanne Beveridge, Babur-nama (Memoirs of Babur). Translated from the original Turki text of Zahiru'd-din Muhammad Babur Padsha Ghazo. Delhi 1921 (Reprint Low Price Publications 1989 in einem Band, আইএসবিএন ৮১-৮৫৩৯৫-০৭-১), পৃঃ ৫১৪
  6. Annette Susanne Beveridge, Babur-nama (Memoirs of Babur). Translated from the original Turki text of Zahiru'd-din Muhammad Babur Padsha Ghazo. Delhi 1921 (Reprint Low Price Publications 1989 in einem Band, আইএসবিএন ৮১-৮৫৩৯৫-০৭-১), পৃঃ ৫১৫

আরো পড়ুন

সম্পাদনা

বহিঃসংযোগ

সম্পাদনা

আরও দেখুন

সম্পাদনা