বাঙালি হিন্দুদের পদবিসমূহ
বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে, অসমে, ঝাড়খণ্ডে ও ত্রিপুরায় বসবাসরত বাঙালি হিন্দুদের পদবীসমূহ বেশ বৈচিত্র্যপূর্ণ এখানে যেমন ধর্মীয় জাতিভেদ প্রথার প্রভাব বিদ্যমান তেমনই ঐতিহ্যবাহী পেশাকেও পদবী হিসেবে গ্রহণের রেওয়াজ বিদ্যমান। প্রাচীন কালে কোনও পদবী হতো না। পদবীর সৃষ্টি প্রায় ৮০০ বছর আগে মাত্র। পাল রাজারা ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মমতে বিশ্বাসী সে সময়ের বাংলায় পদবি হতো না, তবে নাম ও অন্তনাম ছিল, কিন্তু বাঙলায় সেন রাজবংশ ও বর্মণ রাজবংশ দ্বারা বাঙলা অধিকৃত হওয়ার পর ধর্মান্তরিতকরণ,[১] বল্লালসেনের সময় বাংলায় জাত ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন,[২] বাঙলায় বৌদ্ধদের উচ্ছেদ করে ব্রাহ্মণ্যবাদ প্রতিষ্ঠার মত ইতিহাস,[৩][৪] এবং কুলপঞ্জিকা মতে কৌলিন্য প্রথার প্রচলনের কাহিনী পাওয়া যায় যা অনেকের কাছে প্রসংশনীয় আবার অনেকের কাছে অন্ধকার অধ্যায় বলে বিবেচিত।[৫][৬][৭]
পদবীর ব্যবহার প্রাথমিকভাবে শুধুমাত্র উচ্চ শ্রেণীর মধ্যেই দেখা যেত। নবাবী শাসন আমলে ভূ-স্বামীদের ও নবাবী কর্মচারীদের পদবী প্রদান করতেও দেখা যায়। কর্মজীবি শ্রেণীর অন্তর্গত ব্যক্তিদের মাঝেও নিজ নিজ কর্মানুসারে পদবী বিদ্যমান ছিল হিন্দু সমাজে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কোর্টের রেকর্ডে যে সমস্ত উচ্চ শ্রেণীর মধ্য ব্যবহৃত পদবী দেখা যায় সেগুলো হল - ব্যানার্জি, বসু, চ্যাটার্জি, দত্ত, ঘোষ, হালদার, খান, মণ্ডল, মিত্র, সেন। আবার ১৮১৭ সালে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার পরে কলেজের রেকর্ডে উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের যে সমস্ত পদবী দেখা যায় সেগুলো হল- রায়, বাহাদুর, ঠাকুর, দেব, সিনহা, ব্যানার্জি, দাস, মুখার্জি।[৮] বাঙালি হিন্দুরা বহুবার নিজেদের পদবি পরিবর্তন করেছেন, কখনও পেশাভিত্তিক কারণে, কখনও ধর্মান্তর হওয়ার জন্য, কখনও বা তথাকথিত উচ্চ জাতির অংশ হিসেবে দাবি করে।[৯]
ব্রাহ্মণ, পুরোহিত এবং বৈষ্ণব পদবীসমূহ
পূর্বে পদবী ছিল না; তবে অন্তনাম ছিল। গুপ্ত, পাল ও আদি মধ্যযুগের বিভিন্ন লিপি ও তাম্রশাসনে -শর্ম্মণ, -দেব, -স্বামী, -ভট্ট ইত্যাদি অন্তনাম যুক্ত ব্রাহ্মণ জাতীয় ব্যক্তির নাম পাওয়া যায়।[১০] ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ১৯৭৭ সালে যুগান্তর পত্রিকায় লিখেছিলেন মুখোপাধ্যায়, বন্দ্যোপাধ্যায়, চট্টোপাধ্যায় প্রভৃতি পদবী গুলি দুই শতাব্দীর বেশি পুরাতন নয়।[১১][টীকা ১]
তবে এখন বাঙালি ব্রাহ্মণদের বিভিন্ন পদবী দেখা যায়।
রাঢ়ী শ্রেণী
- গঙ্গোপাধ্যায়/গাঙ্গুলী
- চট্টোপাধ্যায়/চ্যাটার্জী/ চ্যাটার্জি
- বন্দ্যোপাধ্যায়/ব্যানার্জী/ব্যানার্জি
- মুখোপাধ্যায়/মুখার্জী/মুখার্জি
- ঘোষাল
- পুততুন্ড
- কাঞ্জিলাল
বারেন্দ্র শ্রেণী
পুরোহিত
- ভট্টাচার্য্য/ভট্টাচার্য ( প্রধানত কুলীন ও শ্রোত্রীয়)
- চক্রবর্তী ( প্রধানত শ্রোত্রীয় ও বর্ণবিপ্র)
বৈষ্ণব
- গোস্বামী (গোঁসাই)
- অধিকারী (বোষ্টম, বৈরাগী)[১২]
গ্রহবিপ্র
- আচার্য্য
- শাস্ত্রী
অন্যান্য
এছাড়া কিছু পদবী আছে যেগুলো ব্রাহ্মণদের মধ্যে মাঝেমধ্যে দেখা যায়। যেমন- মজুমদার, রায়, রায়চৌধুরী, চৌধুরী, মণ্ডল, হালদার, সমাদ্দার প্রভৃতি। এই পদবী গুলি অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যেও বহুল পরিমাণে দেখা যায়।[৯]
বণিকদের পদবী
কায়স্থদের পদবী
বৈদ্যদের পদবী
- সেনগুপ্ত
- দাশগুপ্ত
- দত্তগুপ্ত
- করগুপ্ত
- দেবগুপ্ত
মাহিষ্যদের পদবী
ভূ-স্বামীদের প্রাপ্ত পদবী
নবশায়ক ও অন্যান্য পেশাজীবী পদবী
- মুন্সী
- কানুনগো
- কারিগর
- কর্মকার
- মোদক
- ঘটক
- গোঁসাই
- পালাকার
- ঘোষ (গোয়ালা)
- ভাঁড়
- শোলাকার
- মালাকার
- ঘরামী
- মিস্ত্রী
- সূত্রধর/ছুতোর
- শর্মা (ছুতোর)
- পাঁটিকার
- বাড়ৈ
- হাজরা
- হালদার
- মাঝি
- মালী
- পাখাধরা
- কার্য্যী
- দেওরী
- ওঝা
- পটুয়া
- পাটোয়ারি
- ডাকুয়া
- পাল (কুম্ভকার,তেলি,তিলি)
- বৈদ্য
- কংসবণিক (কাঁসারী)
- শংখবণিক (শাঁখারী)
- মিত্র (বারুজীবি)
- বারুই
- স্বর্ণকার
তফশীলী জাতি গৃহীত পদবী
তফশীলী জাতির নিজস্ব কিছু সারনেম উনবিংশ শতকের কিছু তালিকায় পাওয়া যায় এবং পরবর্তী শতাব্দীতে অনেক পদবী গৃহীত হয়েছে । বর্তমানে বর্ণহিন্দুদের বহু পদবীই তফশীলী সম্প্রদায়গুলির মধ্যে দেখা যায়। এমন কিছু পদবী হল - ভক্ত[৯], দাস, বাঁসফোর, বৈরাগী, হালদার, সন্ন্যাসী, সরকার, অধিকারী[৯], মজুমদার, ঠাকুর, বিশ্বাস, রায়[১২], বালা, জলদাস, খাঁ, গায়েন, মন্ডল, মল্লিক, সাঁতরা, সাহা, বাগ, সেন, ধর, টিকাদার, প্রামাণিক, হাজরা, পুরকাইত, পাত্র, শীল, মান্না, মাঝি, শিকদার, হাওলাদার, মিস্ত্রী, বড়াল, ভদ্র, পোদ্দার, মিত্র, বাগচি, সান্যাল, বর্মণ, রাজবংশী প্রভৃতি।
আরও দেখুন
পাদটীকা
- ↑ পৃষ্ঠা ৮০: পূর্বে ব্রাহ্মণদের গাঞি(গ্রাম) নাম ছিল। রাঢ়ী শ্রেণীর গাঞি নামগুলি হল- বন্দ্যঘটি, বাড়র (বাড়ব); বটব্যাল, বড়াল (বোড়া); কুশারী (কুশো); মাসচটক (মাসদহ); কুসুমকুলী (কুসম ও কুলী); ঘোষাল, ঘোষলী (ঘোষল); সেয়ক (সেউর); বসুয়ারী (বসুয়া); করাল (কৌড়ি); দীর্ঘাঙ্গী (দীঘড়া); গড়গড়ি (গড়গড়ে); কুলভী (কুলভ); পারিহাল (পারিহা); কেশরকুনী (কেশরকোণা); মুখটি, মুকুটি (মুকুটি); ডিংসাই (ডিংসা); সাহারিক (সাহুড়া); রায়ী (রায়গ্রাম); পর্কটি, পাকড়াশি (পাকুর); পালধী (পালতী); চাটুতি, চট্ট (চাটতি); সিমলাই (সিমলে); অম্বুলী (আমূল); ভুরীগ্রামী (ভুরসুট); পলসায়ী (পলশা-পলসোনা?); মূলগ্রামী (মূলগ্রাম); গুড় (গুড়া); হড় (হড়); পুষলী, পুষিলাল (পোষলা); তৈলবাটী (তিলাড়া); পোড়ারী (পোড়াবাড়ি); পীতমুণ্ডী (পীতমুড়া); গাঙ্গুরি, গাঙ্গুলী (গাগুর); কুন্দ (কুন্দ, কুদো); সিদ্ধল (সিধলা); নন্দী (নন্দীগ্রাম); বালী (বালীগ্রাম); সিয়ারী (সিয়ারা); পারী (পালীগ্রাম); নায়ী, নায়ারী (নায়); দায়ী (দায়া); কাঞ্জিলাল (কাঞ্জি); পিপলাই (পিপ্পল); শিম্বলাল (শিমুলি); কাঞ্জারি (কাঞ্জিকুড়া); বাপুলী (বাপুলা); পৃতিতুণ্ড, পুতিতুণ্ডি (পাতুণ্ড? পুতুণ্ডা?); চোটখণ্ডী (চোৎখণ্ড); মহিন্তা (মহতা); পূর্বগ্রামী (পূর্বগ্রাম)। আকাশ, কোঁয়ারী, ভট্টশালী, পুংসিক, ষাটক বা সাণ্ডেশ্বরী, ঘন্টা বা ঘাটাল, দীঘল বা দীঘারী প্রভৃতির মূল গ্রামনাম পাওয়া যায় না। উপরে উল্লিখিত গাঞি- পদবী ও গ্রামনামের কিছু কিছু তারতম্যও দেখা যায়। এই গ্রামের নামগুলি মূলত অস্ট্রিক বা দেশজ শব্দ ছিল, পরে সংস্কৃত শব্দে শুদ্ধিকরণ করা হয়, অথবা এগুলি সংস্কৃতেরই অপভ্রংশ কিনা তা নিঃসন্দেহে বলা যায় না।
তথ্যসূত্র
- ↑ BALACHANDRAN, P. K. (২০২৪-০৯-১৪)। "Growth, decline and survival of Buddhism in Bengal"। Sunday Observer (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-১১-১৭।
Buddhism began to decline with the rise of the Sena dynasty (1095 to 1207 CE). It was a serious challenge to the existence of Buddhism in Bengal as the Senas aggressively revived Brahmanical Hinduism and denied patronage to Buddhist deities, institutions, and scholars.
- ↑ বসু, রাজেশ্বর (২০১৪-০৫-০৪)। "বর্ণপ্রথা"। বাংলাপিডিয়া। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৩-২০।
বল্লালচরিতে যে বর্ণনা রয়েছে তা পৌরাণিক পুঁথিসমূহের বর্ণনা থেকে অনেকটা পৃথক। নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে যুক্তি দেখানো যায় যে, বল্লালসেনের সময় বাংলায় জাত ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের সম্মুখীন হয়।
- ↑ "Disappearance of Buddhism from India – An Untold Story - Velivada - Educate, Agitate, Organize"। Velivada (ইংরেজি ভাষায়)। ২০১৭-০৮-১৭। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-১১-১৭।
While it is true that with time the Buddhist priests became increasingly lax in the observance of religious rules, corruption alone cannot explain the death of Buddhism. After all, in places such as Bengal and Sind, which were ruled by Brahminical dynasties but had Buddhist majorities, Buddhism was replaced by an even more corrupt Brahminism.
- ↑ ভট্টাচার্য্য, পি.কে; রায়, কৃষ্ণেন্দু (২০১৪-০৯-০৯)। "কৌলীন্য প্রথা"। বাংলাপিডিয়া। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-১১-১৭।
বর্মণ বংশের সামলবর্মণ বৈদিক ব্রাহ্মণদের বাংলায় বসতি স্থাপনের জন্য নিয়ে আসেন। সেন বংশের বল্লাল সেনকেও কৌলিন্য প্রথার স্রষ্টা হিসেবে কৃতিত্ব দেওয়া হয়ে থাকে। বর্মণ ও সেন উভয় রাজবংশই বাংলার বাইরে থেকে ব্রাহ্মণ আমদানি এবং বাংলায় ব্রাহ্মণ-প্রাধান্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বর্মণ ও পাল উভয় রাজবংশই বাংলায় বহিরাগত এবং উভয় বংশই বাংলায় ব্রাহ্মণবাদের প্রসারে কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, কান্যকুব্জ থেকে পাঁচ ব্রাহ্মণের আগমনের গল্প দক্ষিণ ভারতে ইতোমধ্যেই প্রচলিত ছিল। সেন রাজবংশও দক্ষিণ ভারত থেকে এসেছিল এবং পূর্ব ভারতে তাদের রাজ্য স্থাপনের পর এ গল্পটা বাংলায় জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে, কান্যকুব্জ থেকে ব্রাহ্মণদের নিয়ে আসা হয়েছিল।
- ↑ SIRCAR, D. C. (১৯৫৯)। STUDIES IN THE SOCIETY AND ADMINISTRATION OF ANCIENT AND MEDIEVAL INDIA VOL. 1। FIRMA K. L. MUKHOPADHYAY, CALCUTTA। পৃষ্ঠা ১১৬।
1. "It is well known that, according to the Kulapanpanjikas, king Ballalasena (12th century) introduced the orders of nobility known as Kullnism amangst the Brhmanas, KSyasthas and Vaidyas of Bengal. 2. The absence of any reference to Kulnism in the epgraphic records of the Senas suggests that the Sena kings could not have been entirely responsible for it.
- ↑ Majumdar, R. c। History Of Bengal Vol.1। পৃষ্ঠা 567।
- ↑ "Kulinism | Kulinism | Caste System, Rituals & Marriage | Britannica"। www.britannica.com (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-১১-১৭।
Kulinism, in Hinduism, caste and marriage rules said to have been introduced by Raja Vallala Sena of Bengal (reigned 1158–69). The name derives from the Sanskrit word kulina (“of good family”). Hypergamy (marrying a bride of a lower caste) was allowed for the top three castes.
- ↑ Iversen, Vegard; Krishna, Anirudh; Sen, Kunal (২০২২-০১-০৬)। Social Mobility in Developing Countries: Concepts, Methods, and Determinants (ইংরেজি ভাষায়)। Oxford University Press। পৃষ্ঠা ২৮৯। আইএসবিএন 978-0-19-289685-8।
- ↑ ক খ গ ঘ Khagendranath Bhowmik (১৯৮২)। পদবীর উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের ইতিহাস ।। খগেন্দ্রনাথ ভৌমিক।
- ↑ "Land and Society in Early South Asia: Eastern India 400–1250 AD"। Routledge & CRC Press (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-১১-১৬।
- ↑ ক খ "Amader Podobir Itihaas by Lokeshwar Bosu | PDF"। Scribd (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৯-০১।
- ↑ ক খ গ "বাঙালির পদবি, উদয় চট্টোপাধ্যায়, পরবাস-৭৬"। www.parabaas.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৯-০১।
- ↑ Sep 17, Arya Rudra /; 2001; Ist, 00:55। "Baniks of Bengal | Kolkata News - Times of India"। The Times of India (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৩-২০।
- ↑ "The Subarnabaniks « Mutty Lall Seal" (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৩-২০।
- ↑ "বণিক - বাংলাপিডিয়া"। bn.banglapedia.org। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৩-২০।
- ↑ "Bawali Rajbari - West Bengal Tourism, Experience Bengal, Dept. of Tourism, Govt. of W. B."। wbtourism.gov.in। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০১-১৪।
- বাঙ্গালার সামাজিক ইতিহাস, দুর্গাচন্দ্র সান্যাল, মডেল পাবলিসিং হাউস, ISBN 81-7616-067-9.